নিরুদ্দেশ-প্রাপ্তি-হারানো
চারদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেন বাড়ির আবহাওয়ায় টান লাগল। মাধুরী নীচু গলায়
শাশুড়িকে জানাল, মা, বাবাকে ওঁর খবর নিতে বলবেন?
কেন, কদিন হল? ফুল তুলতে-তুলতে শোভনা প্রশ্ন করলেন।
চারদিন।
সেকি! ও তো দু-দিনেই ফিরে আসে। তোমাকে কিছু বলে যায়নি?
নীরবে মাথা নাড়ল মাধুরী। শোভনা আড়চোখে পুত্রবধূর দিকে তাকালেন। অনেক খুঁজে খতিয়ে এই মেয়েকে এনেছিলেন তিনি বেআক্কেলে ছেলেটাকে বাঁধবার জন্যে। এরকম সুন্দরী সচরাচর চোখে পড়ে না, ব্যবহারটিও ভারি মিষ্টি। কিন্তু কিছুই হয়নি। সেই মাঝরাতে টলতে-টলতে বাড়ি ফেরা, চিৎকার চেঁচামেচি, অবিরত শহরের মানুষের নালিশ এবং পুলিশের শাসানি একটুও বন্ধ হয়নি। না, ঠিক হল না। মাসছয়েক হল, বিয়ের দুমাস পর থেকেই চিৎকার চেঁচামেচিটা শোনা। যাচ্ছেনা। কখন বাড়িতে আসছে কখন বের হচ্ছে টের পাওয়া যাচ্ছেনা।
শোভনা বললেন, ঠিক আছে যাও, আমি দেখছি। মাধুরী ফিরে গেল। মেয়েটার শরীরে ঈশ্বর সব দিয়েছেন। শোভনার নিজের যৌবনের দিনেও এত পাননি। অথচ ছেলেটা এসব চোখ মেলে দেখল না। ভাগ্যিস ওর বাপ নেই, মায়ের অবস্থা ভালো নয়! নইলে এই মেয়েকে একমাসও ধরে রাখা যেত না!
ঠাকুরঘরে বসেও শোভনার অস্বস্তি হচ্ছিল। চারদিন উধাও হয়নি কখনও ছেলেটা। যখন পেটে কিছু থাকে না তখন খুব ভালো ব্যবহার, অমন ছেলে হয় না। স্বর্ণকমল অত্যন্ত সুদর্শন। দীর্ঘদেহ, গলা খুলে হাসতে জানে। কিন্তু কতক্ষণ? ঘুমের সময় বাদ দিলে বড়জোর ঘণ্টাচারেক। তবে ইদানীং একটা কালচে ছায়া শরীরে। তিরিশ বছরেই অত্যাচারের চিহ্নগুলো শরীরে ফুটছে। কোনও কিছুতেই পালটানো গেল না তাকে।
যে নিজে সুন্দর তার কেন সুন্দর পছন্দ হয় না বুঝতে পারেন না শোভনা। যা কিছু কুৎসিত, কুরুচির ছাপ যাতে তার দিকেই ঢলে ছেলেটা। ডাক্তার অনিল সেনের ছেলে দল বেঁধে মারপিট করছে, বাড়ির যুবতি কুশ্রী ঝি-এর সঙ্গে রসিকতা করছে কী করে তার কোনও কারণ খুঁজে পান না শোভনা। সেই ছেলে চারদিন উধাও হয়ে আছে।
পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নামলেন শোভনা। এখন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে যাওয়ার সময়। সকালে এই সময় যা কিছু কথা সারতে হয়। শহরের সবচেয়ে দামি এবং ব্যস্ত ডাক্তার অনিল। সেন। নীচে নেমে দেখলেন ডাক্তারবাবুর জামা-কাপড় পরা হয়ে গেছে। চিরকালই সাহেব মানুষ, নিজের কাজ নিজে করতে ভালোবাসেন। স্ত্রীকে দেখে বললেন, দাগটা কেমন আছে?
শোভনা মাথা নাড়লেন, তোমার ওষুধে কমবে না।
দেখি। হাত বাড়ালেন ডাক্তার। মাসখানেক হল শোভনার ডান বাজুতে একটা সাদা-কালো মেশা দাগ জন্মেছে। প্রথমে ভেবেছিলেন শ্বেতী কিন্তু একটু-একটু করে বোঝা গেল তা নয়। ডাক্তার ওষুধ দিচ্ছেন, অথচ কাজ হচ্ছে না তেমন।
শোভনা হাত নাড়লেন, ও এমন কিছু না। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
ডাক্তার বললেন, আবার কী হল?
শোভনার গলায় উদ্বেগ, তুমি খোকার খবর নাও।
খোকা! কী হয়েছে তার? ডাক্তারের গলায় বিস্ময়।
চারদিন বাড়ি ফেরেনি।
কিছু বলে যায়নি?
না। বলে গেলে তোমায় বিরক্ত করতাম না।
বউমা কী বলছে?
এ অবস্থায় একটা মেয়ে কী বলতে পারে?
আমি বুঝি না, সত্যি বুঝতে পারি না। স্বামী মাতলামি করছে, ছোটলোকদের সঙ্গে মিশছে, দিনরাত বেশ্যাবাড়িতে পড়ে থাকছে আর স্ত্রী হয়ে বউমা এসব সহ্য করছে কী করে? ওর তো ইতিমধ্যেই ডিভোর্স নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল।
আমরা কী করে সহ্য করছি? শোভনা স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন।
তোমার জন্যে, নইলে আমি ওকে ত্যাজ্যপুত্র করতাম।
করনি যখন, তখন এটুকু করো।
কী করব?
ওর একটু খোঁজ নাও।
চমৎকার! আমি যত গুন্ডা বদমাশ মাতালদের কাছে গিয়ে বলব ও মশাই আমার পুত্ররত্নটিকে দেখেছেন? অসম্ভব! তোমার ছোট ছেলেকে পাঠাও।
অনিল সেনের এই কথাগুলো শোভনাকে হজম করতে হল। তিনি স্বামীর চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিজেই যেন নিজেকে শোনালেন অনিল ডাক্তার, চিন্তা করে কোনও লাভ নেই। ও ছেলের কোনও ক্ষতি হবে না। আরে বাবা, যারা খুনখারাপি করে। তারাই তো ওর বন্ধু। যাবে কোথায়, পেটে টান পড়লেই ফিরবে।
শোভনা দোতলার কোণার ঘর চলে এলেন। ছোটছেলে অরুণদীপ্তি বিছানায় উপুড় হয়ে তার কলেজের পড়া করছিল। ফরসা, দাদার মতনই লম্বা, অত্যন্ত রোগা শরীর। ছাত্র হিসেবে এই জেলার প্রথম সারির। শোভনার একমাত্র গর্বের কারণ। শোভনাকে দেখে অরুণদীপ্তি উঠে বসল, কিছু বলবে মা?
তোকে একটা কাজ করতে হবে বাবা। স্বর্ণ চারদিন বাড়ি ফেরেনি। এরকম কখনও করে না। তোর বাবাকে বললাম তিনি আমলই দিলেন না। তুই একটু খোঁজ নিবি?
কোথায় খোঁজ নেব? দাদা কোথায় যায় আমি জানি না!
শোভনা এই নিরীহ ছেলেটির দিকে আদরের চোখে তাকালেন। বাড়ল কিন্তু বড় হল না। ওর দাদা এই বয়সেই পেতলে একটা দাঁত বাঁধিয়ে বাড়িতে অশান্তির ঝড় তুলেছিল। শোভনা বললেন, ওর বন্ধুদের কাছে খোঁজখবর নে। বড় হয়েছিস, নিজের বিচার-বিবেচনা নেই? ছোট্ট একটা শহরে সে কোথায় থাকতে পারে খুঁজে দ্যাখ।
স্বর্ণকমলকে অরুণদীপ্তি ইদানীং এড়িয়ে চলে। তার দাদা গুন্ডা-বদমাসদের বন্ধু, দিনরাত মদ খায়, এই তথ্যগুলো তাকে ভীষণ হেয় করে। স্বর্ণকমলের ভাই এই পরিচয় তাকে পীড়িত করে। শোভনা চলে যাওয়ার পর সে খুব বিরক্ত মনে পোশাক পালটে বের হতেই মাধুরীকে দেখতে পেল। এই সুন্দরী সুশীলা বউদিটির প্রতি সে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ বোধ করে। প্রায়শই নিজেকে অমল এবং মাধুরীকে চারুলতা হিসেবে কল্পনা করে। কিন্তু স্বর্ণকমল ভূপতি? কস্মিনকালেও নয়।
অরুণদীপ্তি এগিয়ে গেল, বউদি?
মাধুরী মুখ ফিরিয়ে হাসল, ওমা, পড়া হয়ে গেল?
হল কোথায়? মাতৃদেবীর আদেশ হয়েছে রামচন্দ্রকে খুঁজতে যেতে হবে। অরুণাদীপ্তি মাধুরীর সামনে এসে দাঁড়াল। এই শহরে এত সুন্দরী মেয়ে সে আর একটিও দেখতে পায়নি। তাকালেই মন নরম হয়ে যায়, বুকের ভেতরটা কেমন লাগে। মাধুরী মুখ নামিয়েছিল, অরুণাদীপ্তি শুধাল, দাদা কোথায় যেতে পারে বলো তো? নীরবে মাথা নাড়ল মাধুরী, সে জানে না।
ঠিক আছে, তুমি চিন্তা করো না, আমি দাদাকে ধরে এনে দিচ্ছি। বউদির জন্যে কিছু কাজ করার সুযোগ পেয়ে খুশি হল অরুণদীপ্তি। স্বর্ণকমলের ওপর তার যা কিছু বীতরাগ তা মাধুরীকে দেখলেই উবে যায়।
পাড়াতেই স্বণকমলের এক বাল্যবন্ধু থাকে। স্থানীয় স্কুলের মাস্টার। অরুণাদীপ্তির তার সঙ্গে পরিচয় ছিল। তাকে দেখে মাস্টারমশাই বললেন, কী খবর অরুণ?
আমার দাদাকে দেখেছেন?
কে, স্বর্ণ? না তো! কী হয়েছে ওর?
জানি না। চারদিন বাড়িতে ফেরেনি।
ও। তা আমার সঙ্গে তো ইদানীং যোগাযোগ নেই। মানে তুমি বুঝতেই পার ওর জীবন আর আমারটা আলাদা। তুমি থানায় খবর নাও।
থানা? অরুণদীপ্তি চমকে উঠল, বাবাকে না জানিয়ে থানায় যাব?
ও, মেলোমশাই জানেন না বুঝি! তাহলে এক কাজ করো, রঞ্জিতকে চেনো?
রঞ্জিত!
ওই যে চৌমাথায় যে লন্ড্রিটা আছে তার মালিক। তোমার দাদার এখন খুব বন্ধু। ওর কাছে চলে যাও, ও জানতে পারে।
সাইকেল চালিয়ে রঞ্জিতের লন্ড্রিতে চলে এল অরুণদীপ্তি। দোকানটা সবে খুলেছে। বড় গোঁফ মোটাসোটা লোকটাই রঞ্জিত। আসা যাওয়ার পথে দেখেছে অরুণদীপ্তি। সে দোকানে ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?
আমি স্বর্ণকমল সেনের ভাই।
সঙ্গে-সঙ্গে রঞ্জিতের কপালে ভাঁজ পড়ল, মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল, ও।
আমার দাদাকে আপনি দেখেছেন?
আমি? না তো! কেন?
অরুণদীপ্তি হতাশ হল, দাদা কদিন বাড়ি ফেরেনি তাই।
না ভাই, আমার সঙ্গেও দেখা হয়নি।
আচ্ছা, দাদা কোথায় যেতে পারে বলতে পারেন?
রঞ্জিত দু-মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর হেসে বলল, তোমরা কিছু জানো না?
না।
তাহলে আমার মুখে নাই বা শুনলে। ঠিক আছে, দেখা পেলে পাঠিয়ে দেব।
অরুণদীপ্তি বুঝল এখানে দাদার খবর পাওয়া যাবে না। লোকটা যেন তাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচে। সে মাথা নীচু করে রাস্তায় নেমে সাইকেলটা ধরে হাঁটতে লাগল। এবার কার কাছে যাওয়া যায়? কোনও সূত্র জোগাড় না করে বাড়িতে ফিরলে খুব অসম্মানের ব্যাপার হবে। চৌমাথায় দাঁড়িয়ে ও মানুষ দেখছিল। এখন অফিসের সময়। রিকশা এবং সাইকেলের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। কী করা যায় বুঝতে পারছিল না অরুণদীপ্তি। এই সময় একটা রিকশা এসে সামনে দাঁড়াল। এক ভদ্রলোক ভাড়া মিটিয়ে চলে গেলে রিক্সাওয়ালা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, কী খোকাবাবু, এখানে?
বিরক্ত হল অরুণাদীপ্তি, এমনি।
রিকশাওয়ালা অনিল সেনের কাছে ওষুধ নিতে আসে প্রায়ই। সেই সূত্রে বোধহয় ওকে চেনে।
হঠাৎ ওর মনে হল প্রায় রাতেই দাদা নেশা করে রিকশায় চেপে বাড়ি ফেরে। সে রিকশাওয়ালাকে ডাকল, শোনো।
রিক্সাওয়ালা রিক্সাটা নিয়েই সামনে এগিয়ে এল। অরুণদীপ্তি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, কাল পরশু তুমি আমার দাদাকে দেখেছ?
স্বর্ণবাবু! না, কদিন তো দাদাকে দেখিনি।
আচ্ছা, তুমি কি রাত্রে দাদাকে কখনও এনেছ?
রিকশাওয়ালা হাসল, হ্যাঁ বাবু, অনেকবার।
দাদা কোত্থেকে রিকশায় উঠল?
রিকশাওয়ালার মুখ কুঁকড়ে গেল। বোধহয় কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সে।
অরুণদীপ্তি সেটা লক্ষ্য করে আশ্বাস দিল, তুমি নির্ভয়ে বলো। দাদাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় নেশা করত জানলে খোঁজ করতে পারি।
এবার রিকশাওয়ালা বলল, সে বড় খারাপ জায়গা বাবু।
আমাকে নিয়ে যেতে পারো?
আপনি যাবেন! পাড়াটা ভালো না।
অরুণদীপ্তির রোখ চেপে গেল। সে দুগ্ধপোষ্য নাকি! কড়া গলায় বলল, দিনদুপুরে গেলে আমার কী হবে! তোমাকে বলছি দাদাকে দরকার–চলো, আমি যাব।
রিকশাওয়ালা তখনও কিন্তু কিন্তু করছিল, ডাক্তারবাবু জানলে জানে স্বর্ণবাবুকে ওখানেই পাওয়া যায়–বেশ, চলুন তবে।
খালি রিকশার পেছনে-পেছনে অরুণদীপ্তি সাইকেল চালিয়ে শহরের এক প্রান্তে চলে এল। এদিকে একটা বড় বাজার আছে। ভীষণ ঘিঞ্জি এলাকা। বাজার পেরিয়ে একটা গলির মুখে এসে রিকশাওয়ালা তার গাড়ি থামাল, স্বর্ণবাবু এই গলি থেকে বের হয়।
অত্যন্ত নোংরা রাস্তা। পাশেই নর্দমা। সেখানে শুয়োরের পাল চলছে। দুতিনজন মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক এই বেলায় ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছে। অরুণদীপ্তি বন্ধুদের মুখে এই গলির কথা শুনেছে। শহরের গণিকাদের বাস এখানে। তারা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং অঞ্চলে কোনও ভদ্রসন্তান পথ ভুলেও পা দেয় না।
ওখানে মদের দোকান আছে? অরুণদীপ্তির অস্বস্তি হচ্ছিল।
হ্যাঁ খোকাবাবু, হরি শার দোকান আছে। তারপর কী ভেবে বলল, এক কাজ করুন। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমি খোঁজ নিচ্ছি, আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আপনার একা যাওয়া। ঠিক নয়, গলিটা খারাপ।
রিকশাওয়ালার পেছন-পেছন অরুণদীপ্তি গলিতে ঢুকল। দু-ধারে চাপা-চাপা ঘর। তার বারান্দায় বসে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা গল্প করছে। অরুণদীপ্তির মনে হল এত কুৎসিত চেহারার মেয়েকে সে একসঙ্গে কখনও দেখেনি। হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে উঠল, এই যে নাগর, মুখ তুলে চাও! আর। একটি কণ্ঠ খিলখিলিয়ে উঠল, কচি ছাগল।
রিকশাওয়ালা চাপা গলায় বলল, এসব কথায় কান দেবেন না ছোটবাবু, দিলেই পেয়ে বসবে।
অরুণাদীপ্তির মুখে রক্ত জমেছে, খুব রাগ এবং ঘেন্না লাগছিল তার। দাদা এই জায়গায় মদ খেতে আসে? আশ্চর্য! ওরা নিশ্চয়ই দাদার সঙ্গেও এইসব কথা বলে।
হরি শার দোকান ঠিক মাঝখানে। তখন সবে দোকান খুলেছে। রিকশাওয়ালা তাকে দাঁড়াতে বলে ভিতরে চলে গেল। অরুণদীপ্তি দেখল চারপাশে খুব জোরে রেডিও বাজছে, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে এবং তারই মধ্যে একটি বালিকা অশ্লীল পোশাক পরে নেচে নিল কয়েক পাক।
রিকশাওয়ালা বলল, ছোটবাবু, স্বর্ণবাবু চারদিন মাল কেনেনি এখান থেকে।
অরুণাদীপ্তি হতাশ হয়ে পড়ল, তাহলে?
রিকশাওয়ালা বলল, এরা সব স্বর্ণবাবুকে খুব ভয় পায়। মিথ্যে কথা বলবে না। আপনি একজনকে জিজ্ঞাসা করলে সব জানতে পারবেন, হরি শার ছেলে তাই বলল।
কাকে?
এখানে পদ্মা বলে একটা মেয়েছেলে থাকে দুটো ঘর নিয়ে। একটা ঘরে নাকি স্বর্ণবাবু থাকত।
লোকে বলে, তুমি বুঝতেই পারছ ছোটবাবু। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। আমার একটা মেয়েকে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। তোমাকে ঘরটা চিনিয়ে দিচ্ছি চলল। রিকশাটা সেখানে সরিয়ে রেখে লোকটা তাকে নিয়ে একটা গলিতে ঢুকল। সরু ময়লা গলি। কোথাও খুব ঝগড়া বেধেছে। টিনের চাল আর কাঠের দেওয়াল দেওয়া দুটো ঘর দেখিয়ে রিকশাওয়ালা বলল, এখানে পদ্মা থাকে। তুমি কথা সেরে চলে যেও। এসব জায়গায় বেশিক্ষণ থেকো না।
রিকশাওয়ালা চলে যেতে অরুণদীপ্তি নাকে রুমাল দিল। বিশ্রী পচা গন্ধ বের হচ্ছে। একটা বুড়ো মতন রোগা লোক দাওয়ায় বসে ছিল, জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?
অরুণাদীপ্তি রুমাল সরালো না, এখানে পদ্মা বলে কেউ থাকে?
থাকে, কিন্তু এখন ঘরে বসাবে না। বুড়ো মুখ ফেরালো!
মানে?
সাতসকালে বাচ্চা ছেলে ঘরে নেওয়ার মেয়ে পদ্মা নয়। তাছাড়া ওর মেজাজ খুব খারাপ আছে, অন্য ঘর দ্যাখো।
এবার বুঝতে পারল অরুণদীপ্তি এবং বোঝামাত্র সে সঙ্কুচিত হল। এবং সেটা এড়াতে বেশরাগত গলায় বলল, আমার ওঁর সঙ্গে দরকার আছে। ডাকুন ওঁকে।
বুড়ো একটু অবাক চোখে তাকে দেখল। তারপর বসে-বসেই চিৎকার করল, ও পদ্মা, পদ্মা, তোকে ডাকে দ্যাখ।
একটু পরেই একটি থ্যাবড়ামুখো স্ত্রীলোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। ত্রিশের নীচে নয় বয়স, মোটাসোটা কিন্তু বুক এবং পাছা অত্যন্ত ভারি, গায়ের রং বেশ কালো। প্রথম দেখায় খুবই বিরক্তিকর মনে হয় এবং একটু বোকা-বোকা দেখায়।
কী চাই? ওমা, এ-যে দেখছি দুধের দাঁত পড়েনি। এই বুড়ো, তোকে বলিনি এখন আমাকে বিরক্ত করবি না! কোমরে হাত রেখে খিঁচিয়ে উঠল স্ত্রীলোকটি।
আপনি কি পদ্মা? সাহস করে বলল অরুণদীপ্তি।
হ্যাঁ। নামও জানা আছে দেখছি।
আপনি স্বর্ণকমল সেনকে চেনেন?
এবার দুটো চোখ যেন মাংসের আড়ালে চলে গেল, চিনি।
উনি আছেন?
কে আপনি?
আমি ওঁর ভাই।
সঙ্গে-সঙ্গে আঁচলটা পিঠে জড়ালো পদ্মা, ও। কিছু মনে করবেন না ভাই, আমি মানে–আসুন আসুন।
না, দাদা আছে কিনা তাই বলুন।
পাঁচ মিনিটের জন্যে আসুন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে খারাপ ভাববে। আপনি স্বর্ণবাবুর ঘরেই বসবেন। দয়া করে আসুন। পদ্মা এতবার অনুনয় করতে লাগল যে এড়াতে পারল না অরুণদীপ্তি, পাশের ঘরে একটি তক্তপোশ পরিষ্কার করে পদ্মা বলল, এখানে কোনও ছিরিছাদ নেই ভাই, কষ্ট করে বসতে হবে। আমার কি সৌভাগ্য!
অরুণদীপ্তি দেখল ওই তক্তপোশ এবং বালিশ ছাড়া ঘরে কিছু নেই। নেই বললে ভুল হবে, অনেকগুলো খালি মদের বোতল পড়ে আছে। এইটে তার দাদার ঘর? দাদা এখানে ভাড়া নিয়েছিল? এই স্ত্রীলোকটি? অরুণদীপ্তির শরীর গুলিয়ে উঠল। বউদির শরীরের ছায়া এর থেকে ঢের সুন্দর। দাদা এই প্রায় কুৎসিত স্ত্রীলোকটির সঙ্গে থাকত? ঘিনঘিন ভাবটা বেড়ে গেল তার। আর ওই স্ত্রীলোকটি এমনভাবে খাতির করছে যেন সে তার পরমাত্মীয়। অরুণদীপ্তি জিজ্ঞাসা করল, দাদা আছেন?
মাথা নাড়ল পদ্মা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, বাড়িতে ফেরেনি, না?
ফিরলে আমি এখানে আসব কেন? কোথায় গিয়েছে জানেন?
হঠাৎ আঁচলের কোণা মুখে গুঁজে পদ্মা যেন কান্না চাপল, আমার কথা শুনল না!
কী কথা?
ওরা ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। বর্ডার থেকে কীসব জিনিস আসবে, অনেক টাকার ব্যাপার–
আমার খুব ভয় করছে। পদ্মার গলার স্বরে কান্নার টোকা।
কারা ডাকতে এসেছিল? অরুণদীপ্তি অবাক হয়ে গেল।
চারজন। ওর পরিচিত। নাম বলতে পারব না। ওরা আমাকে কেটে ফেলবে। তবে স্বর্ণবাবুর যদি কিছু হয় তাহলে আমি ছেড়ে দেব না।
দাদা এই ঘরে থাকত?
হ্যাঁ। সারাদিন এখানে শুয়ে মদ খেত। আমার কাজে বাধা দিত না।
অরুণদীপ্তি ভেবে পাচ্ছিল না বাড়ি ফিরে দাদার এইসব ঘটনা বউদিকে বলতে পারবে কিনা। সে উঠল, দাদা যদি ফেরে তাহলে বাড়িতে যেতে বলবেন।
পদ্মা বলল, সে তো নিশ্চয়ই। আমিই তো জোর করে রোজ ওকে বাড়ি পাঠাতাম।
অরুণদীপ্তি বেরিয়ে আসছিল, পদ্মা বলল, আপনি প্রথম এলেন, একটু মিষ্টি খেয়ে যাবেন?
অরুণদীপ্তি জবাব দিল না। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে তত ভালো।
ফাঁকা রাস্তায় প্যাডেল ঘোরাতে-ঘোরাতে অরুণদীপ্তি ব্যাপারটা আর একবার খতিয়ে দেখল। মাধুরীর মতো অমন সুন্দরী বউকে ছেড়ে দাদা ওই পাড়ায় ঘর নিয়ে মদ গিলত? আর পদ্মার বেঢপ স্বাস্থ্য ছাড়া আর সব যে-কোনও ঝি-এর চেয়েও অস্বস্তিকর। দাদা তাই নিয়ে পড়ে থাকত? মেয়েছেলেটা অবশ্য তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে, যেন স্বর্ণবাবুর আত্মীয় ওরও নিকটজন! এসব কথা বাড়িতে বলা চলবে না। কিন্তু দাদা কোথায় গিয়েছে? পদ্মা বলল চারজন লোক দাদাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। দাদা কি স্মাগলিংও করত? হয়তো। কারণ দাদার কোনও রোজগার ছিল না এবং বাড়ি থেকেও পয়সা নিত না। বিয়ের সময় দাদা ব্যবসা করছিল কিন্তু বিয়ের পরেই সেটা তুলে দেয়। অন্য পথে টাকা না এলে দাদা খরচ চালাত কী করে? ওই পাড়ায় বাড়ি ভাড়া মদ খাওয়ার তো খরচ আছে!
এলোমেলো কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে অরুণদীপ্তি হাসপাতালের সামনে এসে পড়ল। আচ্ছা, দাদার যদি কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়ে থাকে? উঁহু, তাহলে ওরা খবর পেত। স্বর্ণ সেনকে এই শহরের প্রত্যেকটা মানুষ চেনে। তাছাড়া বাবার তো বিরাট পরিচয়। অতবড় ডাক্তার এই শহরে দ্বিতীয়টি নেই। অরুণদীপ্তির মনে পড়ে ছেলেবেলায় সে দাদাকে অন্যরকম দেখেছে। খুব ভাল। ফুটবল খেলত, হইহই করত সর্বক্ষণ। সেই দাদা বড় হয়ে যা কিছু সুন্দর তা থেকে এমন দূরে সরে গেল কী করে!
বাড়ি ফিরে আসার সময় ওর মনে পড়ল পদ্মা সেই চারটে লোকের নাম বলেনি, বললে লোকগুলো নাকি পদ্মাকে মেরে ফেলবে! লোকগুলো কে? কথাটা বাবাকে বলা দরকার। কিন্তু বাবাকে সে সবসময় এড়িয়ে যায়। অত রাশভারি এবং রাগী মানুষ বলে ছেলেবেলা থেকেই। একটা দূরত্ব থেকে গেছে। কী করা যায়?
শোভনা ছোটছেলের মুখে শুনলেন কোনও খবর পাওয়া যায়নি। মুখ ভার হয়ে গেল তাঁর। অরুণদীপ্তি আর বউদির সামনে গেল না। খেয়েদেয়ে কলেজে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে এমন সময় অনিল সেন বাড়ি ফিরলেন, দারোগাকে বলে এলাম খোঁজখবর নিতে। আর বলতে গিয়ে যা শুনে এলাম তাতে আর এই শহরে থাকা যাবে না।
শোভনা চকিতে চারপাশে তাকিয়ে নিলেন, আস্তে বলল, কী শুনলে?
তোমার ছেলে বেশ্যাবাড়িতে বসে মদ খেত। এর আগেও এক-আধবার ওই ধরনের কথা কানে এসেছিল, বিশ্বাস করিনি। আজ খোদ দারোগার মুখে শুনলাম। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে রইলেন ডাক্তার অনিল সেন।
যা শুনেছ-শুনেছ, এই নিয়ে চেঁচামেচি কোরো না। বউমার কানে না যায়!
কার ওপর চেঁচামেচি করব? ঘরের সুন্দরী বউদের চিরকালই বেশ্যারা হারিয়ে দেয়, না? ঠিক আছে, তোমরা সরে যাও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও। অনিল সেন হাত নাড়লেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো শুনে অরুণদীপ্তির বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। যাক, কোনও কথা তাকে মুখ ফুটে বলতে হবে না।
বিকেলে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে অরুণদীপ্তি থানায় গেল। সারাটা দুপুর ওই চারটে লোকের কথা মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছে। পুলিশ যদি পদ্মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে-তাহলে নিশ্চয়ই একটা সূত্র পাওয়া যাবে। সে ঠিক করেছিল চুপিচুপি দারোগাবাবুকে খবরটা দিয়ে আসবে। এর আগে কখনও সে থানায় ঢোকেনি। চারধারে পুলিশ এবং বিচিত্র চেহারার লোকজন।
স্লিপ পাঠিয়ে শুনল দারোগাবাবু খুব ব্যস্ত, এখনই বের হবেন। কিন্তু তার ডাক এল। ঘরে ঢুকে দেখল কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে দারোগাবাবু কথা বলছেন। তাকে দেখে কথা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ডাক্তার সেনের ছেলে?
হ্যাঁ।
কী দরকার বলুন। আমি খুব ব্যস্ত। আপনার দাদার ব্যাপার তো? কিছু মনে করবেন না, উনি এই শহরে নেই জেনে আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছি। শুধু ডাক্তার সেন খুব শ্রদ্ধেয় মানুষ, তাই–। দারোগাবাবু জানালেন।
একজন অফিসার মনে করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললেন, স্যার, ওই ডেডবডিগুলোর কথা বলবেন বলছিলেন ডাক্তারবাবুকে।
ও হ্যাঁ, গত তিনদিন আমরা দুটো বেওয়ারিশ ডেডবডি পেয়েছি। আমার লোক আইডেন্টি ফাঁই করতে পারেনি। আপনারা দেখতে পারেন।
ডেডবডি? অরুণদীপ্তি কেঁদে উঠল।
হ্যাঁ। একটা নেপালির। নিশ্চয়ই আপনার দাদা নন। অন্যটি মনে হচ্ছে বুড়ো মানুষের। তবে ডিসফিগারড। মাথার চুল সাদা।
অরুণদীপ্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, আমার দাদা বুড়ো নয়।
জানি। তাই গা করিনি। এটা আমাদের রুটিন চেক। দারোগাবাবু বললেন।
আমি একবার দেখব দারোগাবাবু? মেয়েলি গলা শুনে চমকে উঠল অরুণদীপ্তি। সে দেখল ঘরের এক কোণায় বেঞ্চিতে বসে আছে পদ্মা। মাথায় ঘোমটা। ও যে এই ঘরে আছে তা সে লক্ষ্যই করেনি এতক্ষণ।
আঃ, তখন থেকে নাকে কাঁদছে। ল্যাংটো ব্যাটাছেলে না দেখলে নোলা শুকোচ্ছ না! স্বর্ণবাবু কোথায় গিয়েছে তুমি জানো না?
না বাবু, আমি তো বারবার বলছি, আমায় কিছু বলে যায়নি সে।
ওষুধ খাবে নাকি?
আমি সত্যিকথা বলছি বাবু, উনি শুধু আমার ওখানে থাকতেন, আর কিছু না।
নেকি! লীলা করতেন নীল মাখতেন না! ঠিক আছে যাও, কিন্তু ডাকলেই যেন পাই। আর মিথ্যে কথা বলেছ জানলে চামড়া ছাড়িয়ে নেব। দারোগাবাবু টুপিটা তুলে নিয়ে বললেন, আচ্ছা ভাই, আপনার বাবাকে বলবেন আমরা চেষ্টা করছি।
অরুণদীপ্তি বলতে গেল যে এই মেয়েছেলেটা চারটে লোকের খবর জানে, ওকে চাপ দিন। কিন্তু তার আগে পদ্মা হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, দারোগাবাবু, আমাকে একবার মড়া দেখতে দেবেন?
দারোগা বললেন, আশ্চর্য! ও-দুটোর সঙ্গে স্বর্ণবাবুর কোনও মিল নেই তবু দেখতে চাইছ কেন? আর তোমার চেয়ে ওর ভাইকে দেখালে বেশি কাজ হবে!
ওই যে আজ বললেন পাহাড়ে পাওয়া গিয়েছে!
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
পাহাড়ের কাছেই তো বর্ডার!
হ্যাঁ।
স্বর্ণবাবু কিছুদিন আগে বর্ডারের কথা বলছিলেন।
আই সি! এতক্ষণ বলোনি কেন?
অনেক কথাই তো বলত। সব মনে রাখা যায়?
দারোগাবাবু বললেন, কিন্তু এই লোকটা তো বুড়ো! আপনি কী দেখবেন? প্রশ্নটা অরুণদীপ্তিকে।
অরুণদীপ্তি বলল, যদি বুড়োমানুষ হয় তাহলে দেখে কী করব? তাছাড়া আমার দাদার চুল সাদা ছিল না।
এই সময়ে বাইরে হইচই শুরু হল। দারোগাবাবু অফিসারদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে অরুণদীপ্তি আর দাঁড়াল না। এই মুহূর্তে দারোগাকে ওসব কথা বলা যাবে না। পদ্মাকে যখন পুলিশ এখানে এনেছে তখন কাল সকালেই বললে চলবে। সে হনহন করে বারান্দা ডিঙিয়ে সাইকেলে উঠল। পদ্মার সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তি তার ছিল না।
অনিল সেনের বাড়ির পেছনে সুন্দর বাগান এবং পুকুরঘাট আছে। অপরাহ্নের ম্লান ছায়ায় সেই ঘাটে বসে জলের শরীর দেখছিল মাধুরী। দু-দিন না বলে-কয়ে যে উধাও হয়ে গিয়েছে সে। চারদিন হতে পারে, তবু চারদিন তাই সে শাশুড়িকে জানিয়েছিল। স্বর্ণকমল কখন আসে কখন। যায় এ বাড়ির কেউ খবর রাখে না। বেশিরভাগ দিন বাড়িতে খায় না, থাকলে ঘর ছেড়ে বের হয়। অনেক কান্নাকাটি অনেক চেঁচামেচির পর এখন সম্পর্কটা থিতিয়ে রয়েছে। স্বর্ণকমল সেদিন নেশার ঘোরে বলেছিল, কেন পড়ে আছো বুঝি না! চেহারা ভালো স্বাস্থ্য ভালো ডিভোর্স চাও দিয়ে দিচ্ছি।
আমি কী দোষ করলাম? মাধুরী স্পষ্ট শুধিয়েছিল।
কিছু না। সুন্দরী মেয়ে আমার সহ্য হয় না। পুতুল-পুতুল লাগে।
তাহলে বিয়ে করলে কেন?
এই কেনর উত্তর যদি জানতাম। ডাক্তার অনিল সেনকে জিজ্ঞাসা করো কেন আমি বিয়ে করেছি। তাছাড়া তোমাকে দেখলে আমার একটুও উত্তেজনা আসে না।
মাধুরী কিছুই দেখছিল না। একটা অবশ অনুভূতি সর্বাঙ্গে নিয়ে বসেছিল। আট মাস তো হয়ে গেল। এবার বাপের বাড়ি চলে গিয়ে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেললেই হয়। লোকটা তো তাই চাইছে। আর এখন যদি সে মুক্ত হয়, তাহলে মাধুরী দু-হাতের বেড়ে চিবুক রাখল। না, পুরুষের অভাব হবে না তাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে। এই আটমাসে লোকটার ওপর তার একটুও মায়া পড়েনি। নিজের কাছেই অবাক লাগে, সে এখনও কুমারী রয়ে গেল! মাধুরী সিদ্ধান্ত নিল, এবার লোকটা ফিরলে কথা বলে ছেদ টানতে হবে। তার বিয়ের আগে তো কৃপাপ্রার্থীর অভাব ছিল না, তাহলে নিজেকে সে বঞ্চিত করবে কেন? মাধুরী দেখল, কী একটা পুকুরে পড়ল। শব্দ হল, ঢেউ কাঁপুনি ছড়ালো এবং একসময় মিলিয়ে গেল। বাঃ, চমৎকার।
কী ভাবছ বউদি?
মাধুরী চমকে মুখ তুলল। তারপর হেসে বলল–আমার ভাগ্যটার কথা।
দূর! ওসব ভেবে কী হবে? ওঠো তো! অরুণদীপ্তি তাগাদা দিল।
কেন?
এক জায়গায় বসে থাকতে হবে না। দাদা-দাদার মতো আছে তুমি তোমার মতো থাকোনা! চলো, হাঁটি। অরুণদীপ্তি হাত বাড়াল।
কী নিয়ে থাকব অরুণ?
কত কী আছে পৃথিবীতে!
ছেড়ে দাও এসব কথা। কোনও খবর আসেনি, না?
না।
খবর না আসা পর্যন্ত আমি যেতেও পারছি না।
যাবে, কোথায় যাবে?
তোমাদের বাড়িতে আমার সংসার করা হল না অরুণ। তোমার দাদা আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন। এভাবে তো কোনও মানুষ থাকতে পারে না। ভেবেছিলাম একবছর দেখব। কিন্তু না, ও ফিরে এলেই আমি চলে যাব।
এই সময় একটি চাকর বাগানে এসে দাঁড়াল, ছোটবাবু, আপনাকে ডাকছে।
কে?
একটা মেয়েছেলে। নাম জানি না।
অরুণদীপ্তি অনুমান করতে পারছিল না। হনহন করে সে সামনের গেটে পৌঁছে হোঁচট খেল। পদ্মা দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে সেই বুড়োটা। রাগে মাথায় আগুন জ্বললো। সে চকিতে পেছন ফিরল, না, কেউ নেই। কর্কশ গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী চাই? এখানে কেন?
পদ্মা যেন সেসব গায়েই মাখল না। তার গলা কাঁপছে, আমি মড়া দেখে এলাম।
তা আমাদের কী?
আমার মনে হচ্ছে, ডুকরে উঠল পদ্মা, মনে হচ্ছে ওটা স্বর্ণবাবুর শরীর।
কী যা-তা বলছ? চিৎকার করল অরুণদীপ্তি, দারোগা বলল লোকটা বুড়ো!
ঘনঘন মাথা নাড়ল পদ্মা। তার চোখ জলে বন্ধ, ঠোঁট টিপে রেখেছে। অরুণদীপ্তি আবার আড়চোখে বাড়ির দিকে তাকাল। মা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ওখান থেকে যদিও কোনও কথা শুনতে পাওয়া যাবে না, কিন্তু নিশ্চয়ই স্ত্রীলোকটির পরিচয় জানতে চাইবেন। হঠাৎ পদ্মা বলল, আপনারা একবার দেখুন। আমি প্রায় নিশ্চিত যে উনিই স্বর্ণবাবু। তবু মানুষের তো ভুল হয়।
দারোগা বলেছিল লোকটার চুল সাদা, দাদার তো কালো চুল!
উঁহু, উনি মাথায় রং মাখতেন। একটু পাকতে আরম্ভ করলেই রং মাখা শুরু করেছিলেন। আপনার মা-বউদিকে জিজ্ঞাসা করুন।
পদ্মা তখনও কেঁদে যাচ্ছিল। আর বুড়োটা মাঝে-মাঝে বলছিল, কাঁদিস না পদ্মা, কাঁদিস না।
অরুণদীপ্তি ভেতরে-ভেতরে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। দাদার মাথার চুল সাদা ছিল? এক বাড়ির ছেলে হয়ে সে জানত না? হঠাৎ এই স্ত্রীলোকটিকে সে ঈর্ষা করতে আরম্ভ করল। এবং সেই কারণেই ক্রোধ প্রকাশ করতে পারল অরুণদীপ্তি, কিন্তু তুমি কাঁদছ কেন? বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছ তুমি।
বাঃ, আমি কাঁদব না? আমি তো কিছুই চাইনি, একটু কাঁদতে পারব না? আপনি আর দেরি করবেন না। আমি পুলিশকে বলে এসেছি। আপনি গিয়ে একবার দেখুন, আপনার বউদি যদি যায় খুব ভালো হয়। আপনারা যদি চিনতে পারেন তাহলে আমি ওই চারজনকে ছাড়ব না। একবার শুধু বলে দিন ওটা স্বর্ণবাবুর শরীর, তাহলেই আমি বদলা নেব। হিসহিস শব্দ করল পদ্মা।
এবার নাড়া খেল অরুণদীপ্তি। সেই চারজনের প্রসঙ্গ মনে পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, এদের কথা তুমি পুলিশকে বলেছ?
মাথা খারাপ! সঙ্গে-সঙ্গে ওরা পিছলে বেরিয়ে যাবে। আপনি আসুন, আমি ওখানেই যাচ্ছি। পদ্মা ফিরে গেল বুড়োকে নিয়ে।
কিছুক্ষণ কী করবে বুঝতে পারল না অরুণদীপ্তি। পেছনে ফিরলেই মা তাকে ইশারায় ডাকবেনই। না, নিজের চোখে দেখবে সে। নিজের দাদাকে সে ভালো চেনে। কে কী বলল আর সঙ্গে-সঙ্গে মেনে নিতে হবে! বরং ফিরে এসে মাকে গল্পটা বলা যাবে। অরুণদীপ্তি গেট খুলে বেরিয়ে এল।
নদীর পাশে মর্গ। অরুণদীপ্তি পৌঁছে দেখল পদ্মরা তার আগে এসে গিয়েছে। একজন পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়েছিল। অরুণদীপ্তি তার সাহায্যে মৃতদেহের কাছে পৌঁছাল। উকট পচা গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল তার। তখন মর্গে মাত্র দুটো মৃতদেহ। নাকে রুমাল দিয়ে তাদের সামনে পৌঁছে অরুণাদীপ্তি দেখল পদ্মাও তার সঙ্গ নিয়েছে। ডোমটা দেখাল। একটি নেপালির তা স্পষ্ট বোঝা যায়। দ্বিতীয়টির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সে। সমস্ত শরীর কুঁকড়ে উঠল যেন। উঃ, কি ভয়ানক!
লোকটার চোখ দুটো নেই। দুটো ঠোঁট কেটে নেওয়া হয়েছে। বুকের কাছে বিশাল ক্ষত। হাত এবং পা, কবজি এবং গোঁড়ালির ওপর থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। থাই-এই কাছে ক্ষত। সমস্ত শরীর বেঢপ ফুলে নীলচে কালো হয়ে রয়েছে। দু-বার তাকালেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এবং চুল সাদা কিন্তু একটা কালচে ভাব আছে। অরুণদীপ্তি মাথা নাড়ল, না, এ তার দাদা নয়। দাদার। শরীরের আকৃতির সঙ্গে মিলছে না। নাক কান তো সব মানুষের একরকম হতে পারে। সে মাথা নাড়ল।
সেটা দেখে পদ্মা বলল, যাতে কেউ চিনতে না পারে তাই ওইরকম কেটে দিয়েছে। স্বর্ণবাবুর বুক আর থাই-তে জরুল ছিল, সেখানটাই কেটেছে।
মাথা নাড়ল আবার অরুণদীপ্তি, এ আমার দাদা নয়।
দাঁত দেখুন, ভেতরের দাঁত, পেতলে বাঁধানো। চাপা গলায় বলল পদ্মা।
ডোম হাঁ-মুখ দেখার ব্যবস্থা করে দিলে অরুণাদীপ্তি চমকে উঠল। হ্যাঁ পেতলের দাঁত এবং পেতলের ওপর এস লেখা, খুব সূক্ষ্মভাবে। তার মাথাটা ঘুরে গেল। কোনওরকমে সামলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। পুলিশটা জিজ্ঞাসা করল, কী, চিনতে পারলেন?
মাথা নাড়ল অরুণদীপ্তি। না। তারপর প্রায় দৌড়ে বড় রাস্তায় চলে এসে রিক্সা নিল।
মায়ের ঘরে ঢুকল অরুণদীপ্তি। তার শরীর টলছিল। চেহারা দেখে আঁতকে উঠলেন শোভনা। তারপর উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন, তিনি, কী হয়েছে?
দাদা! মর্গে। ওরা দাদাকে মেরে ফেলেছে!
কোথায়? শোভনার মুখে উদ্বেগ। বুঝতে পারছিলেন খবরটা ভালো নয়।
একটা আর্তনাদ ছিটকে এল শোভনার গলা থেকে, কী বললি?
বিছানায় বসে দুহাতে মুখ ঢাকল অরুণদীপ্তি। তার শরীর কাঁপছিল।
কী হয়েছে আমাকে খুলে বল। শোভনা ছেলের দুই কাঁধ আঁকড়ে ধরলেন।
অরুণদীপ্তির সময় লাগল। স্থির হয়ে বসতে পারছিল না। তারপর এক-এক করে সে সমস্ত ঘটনা উগরে গেল। শেষ হওয়ামাত্র শোভনা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তুই দেখেছিস পেতলের ওপর লেখা?
মাথা নাড়ল অরুণদীপ্তি, হ্যাঁ।
আর শরীর? হাত পা মুখ?
চেনা যাচ্ছে না, কিছু চেনা যাচ্ছে না।
পেতলে এস লিখে কেউ তো দাঁত বসিয়ে দিতে পারে, পারে না?
অরুণদীপ্তি চমকে উঠল, কেন বসাবে?
যারা খুন করেছে লোকটাকে তারা লুকোতে চাইবে। আবার এও তো হতে পারে, আর একটা লোকের পেতলের দাঁতে এস লেখা ছিল। একটা পেতল দিয়ে মানুষ চেনা যায়? না, আমি বিশ্বাস করি না। যে ছেলেকে আমি পেটে ধরেছি তার শরীর একবার দেখলেই আমি চিনতে পারব। আমি না দেখা পর্যন্ত তুই কাউকে এসব কথা বলবি না। শোভনার কণ্ঠ কঠোর।
পরদিন ভোরে দারোগাবাবু এলেন, আমি বুঝতে পারছি আপনাদের খুব কষ্ট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন উপায় নেই। যে লোকটিকে আইডেন্টি ফাঁই করা যাচ্ছে না তার সম্পর্কে গতকাল একটি স্ত্রীলোক দাবি করেছিল স্বর্ণবাবু বলে। আমরা আমল দিইনি।
স্ত্রীলোক! অনিল সেনের চোখে বিস্ময়।
হ্যাঁ। বাজারের মেয়ে। কিন্তু আজ সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। খুনী ধরা পড়েনি। মনে হচ্ছে সে চিনতে পেরেছে বলেই খুনি তাকে বাঁচিয়ে রাখেনি।
একটা বাজারের মেয়ের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
আপনার নয়! স্বর্ণবাবুর তো সুনাম ছিল না। বডি যদি স্বর্ণবাবুর হয় তাহলে কেস খুব জটিল হয়ে যাবে। সমস্ত শহরের লোক জেনে গিয়েছে। এখন আপনারা একবার যদি আইডেন্টি ফাঁই করে দেন তাহলে মেয়েটির খুনি সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা করতে পারি। দারোগাবাবু জানালেন।
অনিল সেনের চোয়াল ঝুলে পড়েছিল। তবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো স্বর্ণকে চেনেন। আপনি আইডেন্টি ফাঁই করতে পারছেন না?
না। কারণ, ওর হাত-পা-চোখ-ঠোঁট সব কেটে নেওয়া হয়েছে। শরীরের রং পালটে গেছে, চুল সাদা এবং অনেক ক্ষত।
চুল সাদা? আমার ছেলের চুল সাদা ছিল না।
আমরা তাই জানি। কিন্তু স্ত্রীলোকটি কাল বলেছে স্বর্ণবাবু চুল রং করত। আজ আমি সেটা দেখে প্রমাণ পেয়েছি। আমার মনে হয় একমাত্র আপনার স্ত্রী এবং বউমা ছাড়া আর কারও পক্ষে এই অবস্থায় ওকে চেনা মুশকিল। দারোগাবাবু বললেন।
অনিল সেন এবার প্রতিবাদ করলেন, আমার বাড়ির মেয়েরা যার-তার মড়া দেখতে যাবে? অসম্ভব! ঠিক তখনই শোভনা এলেন, আমি যাব।
তুমি যাবে? অনিল সেন চমকে উঠলেন।
হ্যাঁ। ভুল বোঝাবুঝির শেষ হওয়া উচিত। বউমাকে আমি বলেছি, সে-ও যাবে।
অনিল সেন হতাশ গলায় বললেন, যা হয় করো, আমার আর মুখ দেখানোর উপায় রইল না। তবে ওটা যদি স্বর্ণ হয় তাহলে বউমা বেঁচে গেল, এইটুকুই লাভ।
সমস্ত শহর মর্গের সামনে ভেঙে পড়েছে বললে খুব বেশি বলা হবে না। স্বর্ণকমল সেনের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে পাহাড়ে। এই শহরের এককালের টেরর স্বর্ণকে কেউ খুন করেছে কিন্তু চেনা যাচ্ছে না ভালো করে। শহরের এক বেশ্যা যে কিনা স্বর্ণর রক্ষিতা ছিল সে চিনতে পেরেছে বলেই খুন হয়ে গেছে। রহস্যের গন্ধ এতটা প্রবল যে সবাই ভিড় করে এসেছে খবর পেয়ে। এই অবস্থায় পুলিশের সঙ্গে শোভনা বউমা আর ছোট ছেলেকে নিয়ে মর্গের সামনে নামলেন। সাদা। পোশাকেও রুচির ছাপ রয়েছে। চারপাশে গুঞ্জন শুরু হল। দারোগাবাবু ওঁদের নিয়ে দরজার। সামনে এলেন, আপনারা একটু শক্ত থাকবেন। বডি পচছে। খুব দুর্গন্ধ। একসঙ্গে যাবেন?
শোভনা বললেন, আমি আগে যাব। আমি না চিনতে পারলে বউমা যাবে।
দারোগা একটু ইতস্তত করে রাজি হলেন। ডোম নিয়ে গেল ঘরে। শিউরে উঠলেন শোভনা। ভগবান, মানুষ এত নির্দয় হয়! কিন্তু একি স্বর্ণ? শরীরের যেসব জায়গায় ক্ষত সেখানেই চিহ্নগুলো ছিল। ওর বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নখ ভাঙা ছিল, সেটাও এখন প্রমাণ করা যাবে না। চিনতে না পেরে এই দুর্গন্ধটাকে সহ্য করে ফেললেন শোভনা। ড্ডামকে বললেন, ওদের ডাকো।
মাধুরী এল। মুখে আঁচল চেপে। ফ্যালফ্যাল করে দেহটাকে দেখল। এই প্রথম একটি নগ্ন পুরুষের দেহ দেখল সে। স্বর্ণকমল কখনও তার সামনে নগ্ন হয়নি। দারোগা জিজ্ঞাসা করল, চিনতে পারছেন? ওর চুল সাদা ছিল?
একদিন চুলের গোড়া সাদা দেখেছিল মাধুরী, পরদিনই কালো। বাইরে রং করে আসতেন। কিন্তু এত সাদা? সে জিজ্ঞাসা করল, দাঁত দেখব? মনে হয় দাঁতটা বাঁধানো ছিল!
ও হ্যাঁ। কাল স্ত্রীলোকটি তাই বলেছিল বটে। আমার খেয়াল ছিল না। দারোগার নির্দেশে ডোম দাঁত দেখাল। দুটো দাঁত নেই। কিন্তু কোনও পেতল দেখা গেল না। সঙ্গে-সঙ্গে চিষ্কার করে উঠলেন শোভনা, না, এ আমার ছেলে নয়।
দারোগা ডোমের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন, পেতলের দাঁত কোথায়?
ডোম মাথা নাড়ল, হামি জানে না সাব।
দারোগা বিড়বিড় করলেন, কী আশ্চর্য! স্ত্রীলোকটি বলল একটা পেতলের দাঁত আছে আর এখন দুটো দাঁত উধাও! তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, কাল রাত্রে কেউ এখানে ঢুকেছিল?
ডোম সজোরে প্রতিবাদ করল, নেহি সাব।
শোভনা পুত্রবধূকে নিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন, দারোগা তাঁকে আবার অনুরোধ করলেন, মিসেস সেন, ভালো করে দেখুন, আর কোনও চিহ্ন আছে কিনা!
শোভনা মাথা নাড়লেন, কী আশ্চর্য! আমার ছেলেকে আমি চিনব না?
দারোগা মাধুরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে? ইনি আপনার স্বামী নন?
কী বলবে মাধুরী! স্বর্ণকমলকে যতটা সে দেখেছে তার সঙ্গে এর মিল কোথায়? সে নীচু গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
ওরা যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখনই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। মা এবং স্ত্রী বলছে ওটা। স্বর্ণকমলের শরীর নয়। নাটকটা জমল না বলে ভিড় পাতলা হল। দারোগা বললেন, ওই স্ত্রীলোকটির জন্যে আপনাদের বিব্রত করলাম, উপায় ছিল না। তবে ভালোই হল, স্বর্ণবাবু বেঁচে আছেন জেনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কিন্তু এই স্ত্রীলোকটি কেন খুন হল বুঝতে পারছি না!
এই সময় স্ত্রীলোকটি মৃতদেহ নিয়ে আসা হল মর্গে। ক্ষতবিক্ষত চেহারা। কারা যেন কুপিয়ে মেরে গেছে। শোভনা সেদিকে না তাকিয়ে পুত্রবধূকে নিয়ে রিকশার কাছে চলে এলেন। অরুণদীপ্তি রিকশার পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, চিনতে পারলে না?
শোভনা মাথা নাড়লেন, না, তোর দাদা নয়। ওরা বলছিল পেতলের দাঁত ছিল, কিন্তু আমরা তো দেখতে পেলাম না। অত কুৎসিত শরীর তোর দাদার নয়। কথাটা শুনে আঁতকে উঠল। অরুণদীপ্তি। সেই চারজন লোক। চকিতে পদ্মার কথা মনে পড়ল। ওর মুখ দেখে শোভনা ধমক দিলেন, হাঁ করে কী দেখছিস? তাড়াতাড়ি বাবাকে খবর দে। এ স্বর্ণ নয়, আমাদের কিছুই হারায়নি, তিনি মাথা উঁচু করে প্র্যাকটিশে যেতে পারেন। যা।
বিহুল অরুণদীপ্তি বেরিয়ে গেলে শোভনা রিকশায় উঠলেন। হঠাৎ শোভনা আবিষ্কার করলেন, মাধুরী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে আছে। অসহিষ্ণু গলায় তিনি ডাকলেন, কী দেখছ ওদিকে, উঠে এসো!
মাধুরী নিঃস্ব গলায় বলল, ওই মেয়েটাকে ওরা এক ঘরে ঢোকাচ্ছে, মা!
শোভনা বললেন, তাতে তোমার কী!
মাধুরী ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, আমার কী!