Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নাগিনী কন্যার কাহিনী || Tarashankar Bandyopadhyay

নাগিনী কন্যার কাহিনী || Tarashankar Bandyopadhyay

মা-ভাগীরথীর কূলে কূলে

মা-ভাগীরথীর কূলে কূলে চরভূমিতে ঝাউবন আর ঘাসবন, তারই মধ্যে বড় বড় দেবদারু গাছ। উলুঘাস কাশশর আর সিদ্ধি গাছে চাপ বেঁধে আছে। মানুষের মাথার চেয়েও উঁচু। এরই মধ্যে গঙ্গার স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হিজল বিল এঁকেবেঁকে নানান ধরনের আকার নিয়ে চলে গেছে। ক্রোশের পর ক্রোশ লম্বা হিজল বিল। বর্ষার সময় হিজল বিল বিস্তীৰ্ণ বিপুল গভীর, শীতে জল কমে আসে, গঙ্গার টানে জল নেমে যায়, সূর্যের উত্তাপে শুকিয়ে আসে, তখন হিজল বিল টুকরো টুকরো। হিজল বিল থেকে নালার শতনরী গিয়ে মিশেছে গঙ্গার স্রোতের সঙ্গে; আশ্বিনের পর থেকে টুকরো টুকরো বিলগুলিকে দেখে মনে হয়, ওই হারের সঙ্গে গাঁথা কালো মানিকের ধুকধুকি। তখন হিজল বিলের জলের রঙ কাজলকালো, নীল আকাশ জলের বুকে স্থির হয়ে আসে, যেন ঘুমোয়। চারিপাশের ঘাসবনে তখন ফুল ফোটে। সাদা নরম পালকের ফুলের মত কাশফুল, শরফুল—অজস্র, রাশি রাশি। দূর থেকে মনে হয়, শরতের সাদা মেঘের পুঞ্জ বুঝি হিজল বিলের কূলে নেমে এসেছে—তার সেই ঘন কালো রঙ, বর্ষায় যা ধুয়ে ধুয়ে গলে গলে। ঝরে পড়ে জমা হয়ে আছে ওই হিজল বিলের বুকে—তাই ফিরিয়ে নিতে এসে বিলের কূলে প্রতীক্ষমাণ হয়ে বসে আছে। মধ্যে মধ্যে হিজল বিলের বাতাস ভরে ওঠে অপরূপ সুগন্ধে। পাশেই গঙ্গার বুকে নৌকা চলে অহরহ,সেই সব নৌকার মাঝি-মাল্লারা পুরুষানুক্রমে জানে, কোথা থেকে আসছে এ সুগন্ধ। তাদের মনে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কোনো কথাও বলে না–গন্ধ নাকে ঢুকবামাত্র শুধু হিজল বিলের ঘাসবনের দিকে যেন অকারণেই বারেকের জন্য তাকিয়ে নেয়। আরোহী থাকলে তারাই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে—কোথা থেকে এমন গন্ধ আসছে মাঝি? আঃ!

মাঝি আবার একবার তাকায় হিজলের ঘাসবনের দিকে, বলে-ওই হিজল বিলের ঘাসবন থেকা বাবু। ঘাসবনের ভিতর কোথাকে বুনো লতায় কি বুনো ঝোপে-ঝাড়ে ফুল ফুটি থাকবে।

হিজল বিলের ডাক শুধু গন্ধেরই নয়–শব্দেরও আছে।

হিজল বিলে ওঠে বিচিত্ৰ কলকল শব্দ।

আরোহী যদি ঘুমিয়ে থাকে, তবে ওই শব্দে যায় ভেঙে সে ঘুম। সে শব্দ যেমন উচ্চ তেমনি বিচিত্র। মধ্যে মধ্যে উচ্চ শব্দকে উচ্চতমগ্রামে তুলে আকাশে ঠিক যেন ভেরীনাদ বেজে ওঠেক কর্‌ কর্‌ কর্‌ কর্‌ কর্‌! ভেরীর আওয়াজের মত শব্দ ছড়িয়ে পড়ে হিজলের আকাশের দিকে দিগন্তরে। আরোহী জেগে উঠে সবিস্ময়ে তাকায়—কি হল? কোথায়, কে বাজায় ভেরী? সত্যিই কি আকাশে ভেরী বাজছে? কে বাজাচ্ছে? মাঝি আরোহীর বিস্ময় অনুমান করে হেসে রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে–পাখি বাবু—গগন-ভেরী পাখি; হুই-হুই-উড়ে চলছে।

ওই দেখ বিপুল আকারের পাখি তার বিশাল পাখা মেলে ভেসে চলছে আকাশে। ভেরীর আওয়াজের মত ডাক, নাম তাই গগন-ভেরী। গরুড়ের বংশধর ওরা। গরুড় আকাশপথে চলেন। লক্ষ্মীনারায়ণকে পিঠে বয়ে নিয়ে। বংশধরেরা নাকি আগে চলে এই ভেরীনাদ কণ্ঠে বাজিয়ে। মাঝিই বলবে আরোহীকে। ওরাই জানে এ দিব্য সংবাদ। নিচে অন্য পাখিরাও কলরব করে ডেকে ওঠে। তারাও পুলকিত হয় দেবতার আবির্ভাবে।

বিলের বুকে হাঁসের মেলা বসেছে, কার্তিক মাস পড়তে না পড়তে। হাজারে-হাজারে কঁকে-কঁকে নানান আকারের বহু বিচিত্র বর্ণের হস এসে বাসা নিয়েছে। জলের বুকে ভাসছে, ড়ুবছে, উঠছে, বিলের চারি পাশের শালুক-পানাড়ি-পদ্মবনের মধ্যে ঠুকরে ঠুকরে টাটি ভেঙে খাচ্ছে, ড়ুব দিয়ে শামুকগুগলি তুলছে, কলরব করছে, মধ্যে মধ্যে পাক দিয়ে উড়ছে, ঘুরছে, আবার ঝাপঝপ করে জলের বুকে ঝাঁপিয়ে ভেসে পড়ছে। বহু জাতের হাঁসের বিভিন্ন ডাক একসঙ্গে মেশানো এক কলরব–কলকল, ক্যাঁক ক্যাঁক ক্যাও-ক্যাও ক্যা-ও-ক্যা-ও। তার সঙ্গে ওই ভেরীনাদের মত কর্‌-কর্‌-কর্‌-কর্‌ ধ্বনি।

নৌকার আরোহীরা সবিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকায়—এই বিচিত্র সঙ্গীতময় শব্দ শুনে দেখতে পায়, আকাশ ছেয়ে উড়ছে পাখির ঝাঁক।

—এত পাখি!

–হিজল বিল বাবু। ওই তো ওই ঘাসবনের ঝাউবনের উ–পারে। ওই যে দেখছেন নালাগুলি, ওই সব নালা আসছে ওই বিল থেক্যা।

শিকারিরা প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। পুষ্পবিলাসী যারা, তারাও ব্যগ্রতা প্রকাশ করে।

–শিকারি গেলে তো হয়!

–ওই ফুলের চারা পাওয়া যায় না মাঝি?

মাঝিরা শিউরে ওঠে। কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে।

—এমন কথাটি মুখে আনবেন না হুজুর। যমরাজার দখিন-দুয়ার হিজলেরই বিল।

খুব সত্য কথা। এক বিন্দু অতিরঞ্জিত নয়। হিজলের ঘাসবনে, জলতলে মৃত্যুর বসতিই বটে।

রাত্রি হলে সে কথা বলে বুঝিয়ে দিতে হয় না। ঘাসবনের কোল ঘেষে স্রোত বেয়ে রাত্রে যখন নৌকা চলে তখন এ সত্য আপনি উপলব্ধি করে আরোহীরা। জ্যোৎস্না রাত্রি হয়ত; হিজল বিলের উপরে আকাশে চাঁদ, নিচে জলের অতলে চাঁদ। সাদা ফুলে ভরা কাশবন শরবন জ্যোত্সায় ঝলমল করছে; ঝাউগাছের মাথা দেবদারুর পাতা ঝিকঝিক করছে; বাতাসের সর্বাঙ্গে ফুলের গন্ধের সমারোহ, আকাশে প্রতিধ্বনি উঠছে রাত্রিচর হাঁসের ফঁকের কলকণ্ঠের ডাকের বিচিত্র বিশাল একন সঙ্গীতের মত, এমন সময় সমস্ত কিছুকে চকিত করে দিয়ে একটা ডাক উঠল—ফে-উ। মুহূর্তে শিউরে উঠল সর্বাঙ্গ।

কয়েক মিনিট বিরতির পর আবার উঠল ডাক-ফে-উ—ফে-উ।

আবার–ফেউ-ফেউ-ফেউ।

এবার স্তব্ধ ঘাসবনের খানিকটা ঠাঁই সশব্দে নড়ে উঠল। জলে কুমির পাক খেলে লেজের ঝাপটা মারলে যেমন আলোড়ন ওঠে, জল যেমন উতলপাতল করে ওঠে, হিজলের ঘাসবনে তেমনি একটা আলোড়ন ওঠে সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায়—নিম্ন ক্রুদ্ধ গর্জন—গরর্‌!—গ—র্‌–র্‌! ফ্যাঁস-ফ্যাঁস!—গ—র্‌–র্‌! গোঁ! ওঁ!

চতুর কুটিল চিতাবাঘের বাসভূমি—এই ঘাসবন সিদ্ধির জঙ্গল, ঝাউ এবং দেবদারুর তলদেশগুলি। রাত্রে তারা বের হয়, পিছনে বের হয় ফেউ ফেউয়ের ডাকে দাঁড়িয়ে উত্যক্ত চিতা লেজ আছড়ে নিম্ন ক্রুদ্ধ গর্জন করে শাসায়—গর-র গর-! কখনও কখনও এক-একটা উঁচু হকও দিয়ে ওঠেঅ্যাঁক! অ্যাঁও! সঙ্গে সঙ্গে দেয় একটা লাফ! চকিতে জ্যোৎস্নায় দেখা যায় চিত্রিত হলুদ পিঠখানা।

বিলের জলের ধারে কালো কিছু চঞ্চল হয়ে মুখ তুলে কান খাড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। গজরায়—গোঁ-গোঁ-গোঁ! কখনও কখনও অবরুদ্ধ ক্রোধে অধীর হয়ে ছুটে যায় শব্দের দিক লক্ষ্য করে, কখনও বা ছুটেও পালায়। বুনো শুয়োরের দল, বিলের ধারে মাটি খুঁড়ে জলজ উদ্ভিদের কন্দ খেতে খেতে বাঘের সাড়ায় তারাও চঞ্চল হয়ে ওঠে।

ভয় কিন্তু ওসবে নয়। চিতাবাঘ বুনো শুয়োর বল্লমের খোঁচায় লাঠির ঘায়ে মারা যায়। এ দেশের গোয়ালারা চাষীরা জোয়ানেরা দল বেঁধে অত্যাচারী চিতাবাঘ বুনো শুয়োর খুঁজে বের করে মেরে ফেলে। কিন্তু বাঘ শুয়োরের চেয়ে আরও ভয়ের কিছু আছে। বাঘ, শুয়োর—এরাও তাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত। ঘাসের বনের মধ্যে একফালি সরু পথের উপর দিয়ে যখন ওরা চলে, তখন চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে অতর্কিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর আক্রমণের আশঙ্কা। সামান্য শব্দে চকিত হয়ে থমকে দাঁড়ায়, কান পেতে শোনে, মৃদু গর্জন করে। কোথা থেকে হয়ত কোনো ঝাউগাছের ডাল থেকে বা দেবদারুর ঘন পল্লবের মধ্য থেকে অথবা ঘন ঘাসবনের মাথার উপর বিস্তৃত লতার জাল থেকে একটা মোটা লম্বা দড়ি চাবুকের মত শিস দিয়ে আছড়ে এসে পড়বে। তার গায়ে-চোখের সামনে লকলক করে দুলে উঠবে চেরা একখানা লম্বা সরু জিভ, মুহূর্তে বিঁধে যাবে একটা অগ্ন্যুত্তপ্ত সূক্ষ্ম সুচের মত কিছু; সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের শিরায় স্নায়ুতে বয়ে যাবে বিদ্যুতের প্রবাহের মত অনুভূতি; পৃথিবী দুলে উঠবে, ঝিমঝিম করে উঠবে সর্বাঙ্গ।… তারপর আর ভাবতে পারে না, দুরন্ত ভয়ে পিছিয়ে যায় কয়েক পা।

হিজল বিলে মা-মনসার আটন। পদ্মাবতী হিজল বনের পদ্মশালুকের বনে বাসা বেঁধে আছেন। চাঁদো বেনের সাত ডিঙা মধুকর সমুদ্রের বুকে ঝড়ে ড়ুবিয়ে এইখানে এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বৃন্দাবনের কালীদহের কালীগ কালো ঠাকুরের দণ্ড মাথায় করে কালীদহ ছেড়ে এসে এখানেই বাসা বেঁধেছে। কালীনাগ বলেছিল—তুমি তো আমাকে দণ্ড দিয়ে এখান থেকে নির্বাসন দিলে; কিন্তু আমি যাব কোথায় বল? ঠাকুর বলেছিলেন ভাগীরথীর তীরে হিজল বিল, সেখানে মানুষের বাস নাই, সেখানে যাও। বিশ্বাস না হয়, বর্ষার সময় গঙ্গার বন্যায় যখন হিজল বিল আর গঙ্গা এক হয়ে যায় তখন গঙ্গার বুকের উপর নৌকা চড়ে হিজলের চারিপাশে একবার ঘুরে এস। দেখবে, জল জল আর জল; উত্তর-দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে জল ছাড়া মাটি দেখা যায়। না, জলের উপর জেগে থাকে ঝাউ আর দেবদারুর মাথাগুলি। দেখ, আকাশে পাখি উড়ে চলেছে—চলেছে তো চলেইছে। পাখা ভেরে আসছে, তবু সে গাছগুলির মাথার উপর বসছে না, কখনও কখনও খুব ক্লান্ত পাখি গাছের চারিদিকে পাক দিয়ে ঘুরে হতাশকণ্ঠে যেন মরণ কান্না কেঁদে আবার উড়ে যেতে চেষ্টা করে। কেন জান? গাছের মাথাগুলির দিকে তাকিয়ে দেখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। শরীর তোমার শিউরে উঠবে। হয়ত ভয়ে ঢলে পড়ে যাবে। মা-মনসার ব্ৰতকথায় মর্ত্যের মেয়ে বেনে-বেটী মায়ের দক্ষিণমুখী যে মূর্তি দেখেছিল—সেই মূৰ্তি মনে পড়ে যাবে। মা বলেছিলেন বেনের মেয়েকে সব দিক পানে তাকিয়ো, শুধু দক্ষিণ দিক পানে তাকিয়ো না। বেনের মেয়ে নাগলোক থেকে মধামে আসবার আগে দক্ষিণ দিকের দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারে নি। তাকিয়ে দেখেই সে ঢলে পড়ে গিয়েছিল। মা-মনসা বিষহরির ভয়ঙ্করী মূর্তিতে দক্ষিণ দিকে মৃত্যুপুরীর অন্ধকার তোরণের সামনে অজগরের কুণ্ডলীর পদ্মাসনে বসেছেন পরনে তার রক্তাম্বর, মাথায় পিঙ্গল জটাজুট, পিঙ্গল নাগেরা মাথায় জটা হয়ে দুলছে, সর্বাঙ্গে সাপের অলঙ্কার, মাথায় গোখুরা ধরেছে ফণার ছাতা, মণিবন্ধে চিত্রিতা অর্থাৎ চিতি সাপের বলয়, শঙ্খিনী সাপের শঙ্খ, বাহুতে মণিনাগের বাজুবন্ধ, গলায় সবুজ পান্নার কন্ঠির মত হরিদ্রক অর্থাৎ লাউডগা সাপের বেষ্টনী, বুকে দুলছে কালনাগিনীর নীল অপরাজিতার মালা, কানে দুলছে তক্ষকের কর্ণভূষা, কোমরে জড়িয়ে আছে চন্দ্রচিত্র অর্থাৎ চন্দ্ৰবোড়ার চন্দ্রহার, পায়ে জড়িয়ে আছে সোনালি রঙের লম্বা সরু কাঁড় সাপ পাকে পাকে বাঁকের মত; সাপেরা হয়েছে চামর, সেই চামরে বাতাস দিচ্ছে নাগকন্যারাবিষের বাতাস। সে বাতাসে মায়ের চোখ করছে। ঢুলুঢ়লু। মায়ের কাঁধে রয়েছে বিষকুম্ভ, সেই কুম্ভ থেকে শঙ্খের পানপাত্রে বিষ ঢেলে পান করছেন, আবার সেই বিষ গলগল করে উগরে ফেলে বিষকুম্ভকে পরিপূর্ণ করছেন। মায়ের পিঠের কাছে মৃত্যুপুরীর তোরণে অন্ধকার করছে থমথম।

এই রূপই যেন তুমি দেখতে পাবে গাছের দিকে তাকালে। দেখবে হয়ত গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটি জড়িয়ে ফণা তুলে ফুসছে বিশালফণা এক দুধে-গোখরো। শকুনি-গৃধিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করবার জন্য সে অহরহ প্রস্তুত হয়ে আছে। তারপর তাকাও ডালে ডালে। দেখবে, পাকে পাকে জড়িয়ে কি যেন সব নড়ছে, দুলছে কখনও বা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। সাপসব সাপ। বন্যায় ড়ুবেছে হিজলের ঘাসবন, সাপেরা উঠেছে গাছের ডালে ডালে। কত নূতন কালীনাগকত দেশ থেকে গঙ্গার জলে ভেসে আসতে আসতে হিজলের ঝাউডাল দেবদারুডাল জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠেছে। খুব সাবধান! চারিপাশের জলের স্রোতে সতর্ক দৃষ্টি রেখ, হয়ত ছপ করে নৌকার কিনারা জড়িয়ে ধরবে স্রোতে-ভেসে-চলা সাপ। গাছের তলাগুলি সযত্নে এড়িয়ে চল; হয়ত উপর থেকে ঝপ করে খসে পড়বে—সাপ। হয়ত পড়বে তোমার মাথায়। শিরে হৈলে সর্পাঘাত তাগা বাঁধিবি কোথা?

হিজল বিলে মা-মনসার আটন পাতা আছে—জনশ্রুতি মিথ্যা নয়।

প্রাচীন কবিরাজ শিবরাম সেন হিজলের গল্প বললেন।

সে আমলের ধন্বন্তরিবংশে জন্ম বলে বিখ্যাত ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য শিবরাম সেন। ধূর্জটি কবিরাজকে লোকে বলত সাক্ষাৎ ধূর্জটি অর্থাৎ শিবের মত আয়ুর্বেদ-পারঙ্গম। ধূর্জটির সূচিকাভরণ মৃতের দেহে উত্তাপ সঞ্চার করত। লোকে বলে—মৃত্যু যখন এসে হাত বাড়িয়েছে, তখনও যদি ধূর্জটি কবিরাজের সূচিকাভরণ প্রয়োগ করা হত, তবে মৃত্যু পিছিয়ে যেত কয়েক পা, উদ্যত হাত গুটিয়ে নিত কিছুক্ষণের জন্য বা কয়েক দিনের জন্য। নিয়তিকে লঙ্ন করা। যায় না, কবিরাজ কখনও সে চেষ্টা করতেন না, তবে ক্ষেত্রবিশেষে তার সূচিকাভরণ প্রয়োগ করে মৃত্যুকে বলতেন—তিষ্ঠ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর।

স্ত্রী আসছে পথে, শেষ দেখা হওয়ার জন্য অপেক্ষা কর। এমনই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন সূচিকাভরণ এবং সে প্রয়োগ কখনও ব্যর্থ হয় নাই। সাপের বিষ থেকে তৈরি ওষুধ সূচিকাভরণ-সুরে ডগায় যতটুকু ওঠে সেই তার মাত্রা। মৃত্যুশক্তিকে আয়ুর্বেদবিদ্যায় শোধন করে মৃত্যুঞ্জয়ী সুধায় পরিণত করতেন। সকল কবিরাজই চেষ্টা করে, কিন্তু তাঁর সূচিকাভরণ ছিল অদ্ভুত। তিনি সাপ চিনতেন, সাপ দেখে তার বিষের শক্তি নির্ধারণ করতে পারতেন।

ওই হিজলের বিলের নাগ-নাগিনীর বিষ থেকে সূচিকাভরণ তৈরি করতেন।

শিবরাম সেন গল্প করেন—তখন তাঁর বয়স সতের-আঠার, দেশে তর্কপঞ্চাননের টোলে ব্যাকরণ শেষ করে আয়ুর্বেদ শিক্ষার জন্য ধূর্জটি কবিরাজের পদপ্রান্তে গিয়ে বসেছেন। হঠাৎ একদিন আচার্য বললেন–হিজলে যাবেন। সূচিকাভরণের আধারটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। নৌকায় যাত্রা। সঙ্গে শিবরামের যাবার ভাগ্য হয়েছিল।

হিজলের ধারে এসে গঙ্গার বালুচরে নৌকা বাঁধা হল। গঙ্গার পশ্চিম তীরে সুবিস্তীর্ণ সমতল প্রান্তর; সবুজ এক বুক উঁচু ঘাস, যতদূর দৃষ্টি যায় চলে গেছে। ঘাসের বনের মধ্যে দেবদারু আর বুনো ঝাউয়ের গাছ। শিবরামই বলেন—ঘাসবনের ভিতর দিয়ে অসংখ্য নালা খাল গঙ্গায় এসে পড়েছে। ঘন সবুজ ঘাসবন। বাতাসে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের উপর; সরসর শব্দ উঠছে, যেন কোনো অভিনব বাদ্যযন্ত্র বাজছে। ঝাউয়ের শব্দ উঠছে সন্স সন্স। আকাশে উড়ছে হাঁসের অ্যাঁক। জনমানবের চিহ্ন নাই। হঠাৎ মাঝি বললে—খালের পানিতে কি একটা ভেস্যা আসছে কর্তা।

আচার্য কৌতূহল প্রকাশ করেন নাই। তরুণ শিবরাম কৌতূহলবশে নৌকার উপর উঠে দাঁড়িয়েছিল। বিস্মিত হয়েছিল—একটা বাচ্চা চিতাবাঘের শব দেখে; শবটা ভেসে আসছে, তার উপরে কাক উড়ে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে; মধ্যে মধ্যে উপরে বসছে; কিন্তু আশ্চর্য, খাচ্ছে না।

আচার্য বলেছিলেন বিষ। সৰ্পবিষে মৃত্যু হয়েছে। ওর মাংস বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। খাবে না। হিজলের ঘাসবনে বাঘ মরে সাপের বিষেই বেশি।

হঠাৎ পাখিগুলির আনন্দ-কলরব ছাপিয়ে কোন একটা পাখির আর্ত চিৎকার উঠেছিল। সে চিৎকার আর থামে না। যেন তিলে তিলে তাকে কেউ হত্যা করছে। এর অর্থ শিবরামকে বলে দিতে হয় নি। তিনি বুঝেছিলেন–পাখিকে সাপে ধরেছে।

শিবরাম এবং আরও দুজন ছাত্র চড়ার উপরে নেমেছিল। আচার্য বলেছিলেন–সাবধান! সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলাফেরা কোরো। জনশ্রুতি, হিজলের বিলে আছে বিষহরির আটন।

খাওয়াদাওয়ার পর নৌকা ঢুকল একটা খালের মধে। দুধারে ঘাসবন দুলছে, মানুষের। চেয়েও উঁচু ঘন জমাট ঘাসবন।

শিবরাম বলেন—সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময় যেন ওই ঘাসবনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। পাশের ঘাসবন থেকে ছপ করে একটা মোটা দড়ি আছড়ে পড়ল। একটা সাপ। কালো—একেবারে অমাবস্যার রাত্রির মেঘের মত কালো তার গায়ের রঙ, সুকেশী সুন্দরীর তৈলাক্ত বেণির মত সুগঠিত দীর্ঘ আর তেমনি তার কালো রঙের ছটা। জলে পড়ে একখানি তীরের মত গতিতে, সে জল কেটে ছুটল ওপারের দিকে। মাঝখানে জলে মুখ ড়ুবিয়ে দিলে, তার নিশ্বাসে জলের ধারা উঠল ফোয়ারার মত। নৌকা তখন থেমে গিয়েছে। বিহ্বল হয়ে শিবরাম দেখছেন ওদিকে পিছনের ঘাসবনে আলোড়ন প্রবল হয়ে উঠেছে। তীরবেগে বৃহৎ সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু যেন ঘাসবন কেটে এগিয়ে আসছে। এল, শিবরাম অবাক হয়ে গেলেন এ তো ভয়ঙ্কর নয়। ঘাসবন থেকে বেরিয়ে এল। একটি মেয়ে। ওই কালো সাপের মতই গায়ের রঙ। খাটো মোটা কাপড়ে গাছকোমর বেঁধেছে। ভাল করে দেখবার সময় হল না। সাপের পিছনে মেয়েটাও ঝুপ করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল খালের জলে। তবে নাকে এল একটা বিচিত্র তীব্র গন্ধ, আর কানে এল কঠিন আক্রোশ-ভরা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কয়টা কথা, তার ভাষা বিচিত্র, উচ্চারণের ভঙ্গি বিচিত্র, কিন্তু সব চেয়ে বিস্ময়কর বাক্যগুলির ভাবার্থ। বললে-পালাবি? পলায়ে বাঁচবি? মুই তুর যম, মোর হাত থেক্যা পলায়ে বাঁচবি?

বললে ওই সাপটাকে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেও চলল সাঁতার কেটে। সাপের যম? সাপকে চলেছে তাড়া করে? কে এ মেয়ে?

নালাগুলি অদ্ভুত আঁকাবাঁকা। একটা বাঁকের মুখে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার আচার্য এসে দাঁড়ালেন নৌকার ছইয়ের বাইরে। মুখে তাঁর প্রসন্ন সস্নেহ হাস্যরেখা। বললেন—চল বাবা মাঝি, চল। যাত্ৰা ভাল। হিজলে ঢুকতেই দেবাদিদেবের দয়া হয়েছে। ধরা পড়ল একটি কালো সাপ। খাঁটি কালজাতের।

নৌকার গতি সঞ্চারিত হতে হতে অদূরবর্তী বাঁকের মাথায় ঘাসবন থেকে সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এবার কণ্ঠস্বরের মধ্যে বিজয়-হাস্যের তৃপ্তির সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শাসনের সঙ্গে সমাদর। ইবার? ইবারে কি হয়? দিব? দিব কষটা নিঙুড়ে? এর পরই বেজে উঠল হাসি। কালো সাপটার আঁকাবাকা তীব্র গতিতে যেমন অসংখ্য তরঙ্গরেখায় খালের জল চঞ্চল তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমিন চঞ্চল হয়ে উঠল হিজল বিলের বায়ুস্তর খিলখিল হাসির সঙ্গে মেয়েটি কোন কৌতুকে হেসে যেন ভেঙে পড়ছে। হাসির শেষে তার কথা শোনা গেল-ইরে বাবা রে, ইরে বানাস্ রে! মুই কুথাকে যাব রে! গোসা করিছে গো, মোর কালনাগিনীর গোসা হছে গো! ইরে বাবা রে, ফুসানি দেখ গো! আবার সেই খিলখিল হাসি। তরঙ্গায়িত বায়ুস্তর মানুষের বুকে ছলছল করে ঢেউয়ের মত এসে এলিয়ে পড়ছে।

নৌকাখানা বাঁক ঘুরছে তখন।

বাঁকের মাথায় জলের কিনারায় ঘাসের বনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়ে, তার হাতের মুঠোয় ধরা সেই কালো সাপটার মুখ ছোট ছেলের চোয়াল ধরে কথা বলার মত ভঙ্গিতে। সাপটার মুখ নিজের মুখের সামনে ধরে সে তার সঙ্গে কথা বলছে। সাপটার জিভ সকলক করে বেরুচ্ছে; কিন্তু নিমেষহীন তার চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে রয়েছে একান্ত অসহায়ের মত। সারা দেহটা শূন্যে ঝুলছে, এঁকেবেঁকে পাক খাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে মেয়েটার হাতে পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে। জড়িয়ে ধরতে পারলে নিজের নিশ্বাস রুদ্ধ করে সর্বশক্তি প্রয়োগে নিষ্ঠুর পাকে জড়িয়ে পিষে মেয়েটির নিটোল কালো নরম হাতখানির ভিতরের মাংস মেদ স্নায়ু শিরা ছিন্নভিন্ন করে দেবে। হাতের শিরা-উপশিরাগুলি নিরুদ্ধগতি রক্তের চাপে ফেটে যাবে। কিন্তু সে চেষ্টা তার ব্যর্থ। ওই নরম হাতের মুঠিখানি লোহার সঁড়াশির মত শক্ত; আর তেমনি কি বিচিত্র কৌশল তার হাতের, সাপটার সঙ্গে সমানে এঁকেবেঁকে পাল্লা দিয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ ক্ষিপ্ৰ আঁকাবাকা গতিতে সারা দীর্ঘ দেহখানা সঞ্চালিত করে সাপটা যখনই বেদেনীর হাতখানাকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে তখনই বেদের মেয়ের হাতে একটা ক্ষিপ্ৰতর সঞ্চালন খেলে যাচ্ছে, তারই একটা ঝাঁকি এসে সাপটার সকল চেষ্টা ধাক্কা দিয়ে প্রতিহত করে দিচ্ছে। মুহূর্তে তার দেহ শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

শিবরাম কবিরাজ বলেন-এ যেন বাবা নাঙ্গা, মানেখোলা তলোয়ারধারী আর খাপে-ভরা তলোয়ারধারীর তলোয়ার খেলা। একবার তখন আমি, বাবা, মুর্শিদাবাদের গ্রামে কবিরাজি করি, বড় জমিদার ছিলেন সিংহ মশায়রা, তারাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার গুরুর সুপারিশে। তাদের গৃহচিকিৎসক হিসেবে থাকি, গ্রামেও চিকি সাদি করি। সেই সময় একদিন রাত্রে ডাকাত পড়ল তাদের বাড়িতে। দেউড়িতে বাইরে দুজন তলোয়ারধারী দারোয়ান, তারা জেগেই ছিল, খাপে তলোয়ার ঝুলছে—দুজনে কথাবার্তা বলছে। হঠাৎ তাদের সামনে একটা আ-বা-বা-আবা-বা-বা হুঙ্কার উঠল। আমি দেউড়ির সামনের রাস্তাটার ওপারে আমার ঘরে, তখনও চরকের পাতা ওন্টাচ্ছি। চমকে উঠলাম, সঙ্গে সঙ্গে দপদপ করে মশাল জ্বলে উঠল। মনে হল, যেন ওরা মাটি থেকে গজিয়ে উঠল। মশালের আলোয় দেখলাম বাবা, দারোয়ান দুজনের সামনে দুজন খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ানেরা খাপেপোরা তলোয়ারের মুঠিতে হাত দিয়েছে; কিন্তু যেই টানে, অমনি ডাকাতদের ভোলা তলোয়ার দুলে ওঠে। দারোয়ানদের হাত অবশ হয়ে যায়, খাপের তলোয়ার আবার মুঠি পর্যন্ত খাপে ঢুকে যায়—তলোয়ারখানাও যেন অবশ হয়ে গেছে। ডাকাতেরা খিলখিল করে হাসে। বলে–থাক্ যেমন আছে তেমনি থাক; মরতে না চাস তো চাবি দে দেউড়ির। একজন দারোয়ান একটা ট্র্যাক পেয়েছিল। সড়াৎ করে একটা শব্দ হল—সে বের করেছে তলোয়ারখানা; কিন্তু তোলবার আর সময় পেলে না, ডাকাতের খোলা তোয়ার মশালের আলোয় ঝলকে উঠল। ঝনাৎ শব্দে আছড়ে পড়ল দারোয়ানের বের করা তলোয়ারখানার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ারখানা হাতের থেকে খসে পড়ে গেল। ডাকাতটা বললে–হাত নিলাম না তোর রুটি যাবে বলে, নিলে মাথা নোবো। দে, চাবি দে। সাপটার সঙ্গে বেদের মেয়েটার প্যাচের খেলাটা ঠিক তেমনি। সেদিন, মানে ওই ডাকাতির রাত্রে আমার, বাবা, মনে পড়েছিল ওই ছবিটা। তাই বেদের মেয়েটার সেদিনের ছবি মনে পড়লে ওই খোলা তলোয়ার আর খাপে-পিেরা তলোয়ারের খেলাটা মনে পড়ে যায়।

সাপটা হার মেনে শিথিল দেহে এলিয়ে পড়ছে দেখে মেয়েটার সে কি খিলখিল হাসি।

হিজল বিলের ঘাসবনের উপর বাতাস বাধাবন্ধহীন খেলায় একটানা বয়ে যাচ্ছিল—তাতে খিলখিল হাসির কাপন বয়ে গেল, যেন কোনো তপস্বিনী রাজকন্যার এলোচুলে জাদুপুকুরের জলের ছিটে লেগে দীর্ঘ রুক্ষ নরম চুলের রাশি কোকড়া হয়ে গিয়ে ফুলে ফেঁপে দুলে উঠল।

ধূর্জটি কবিরাজ নৌকার মাথায় দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন-আরে বেট, তুই! শবলা মায়ী! যাত্রা ভাল আমার, একেবারে মা-বিষহরির কন্যের সঙ্গে দেখা!

মেয়েটিও মুখ তুলে সুপ্ৰসন্ন বিস্ময়ে ঝলকে উঠল, সেও বলে উঠলই বাবা! ই বাবা গো! ধন্বন্তরি বাবা! আপুনি হেথা কোথেকে গো! ইরে বাবা।

শিবরাম অবাক হয়ে দেখছিলেন মেয়েটিকে। চিনতে দেরি হয় নাই, এ মেয়ে সাপুড়েদের মেয়ে, বেদেনী। কিন্তু এ বেদেনী আগের-দেখা সব বেদেনী থেকে আলাদা। মালবেদে, মাঝি-বেদে এরা তার দেশের মানুষ। এ বেদেনীর জাত আলাদা। চেহারাতে আলাদা, কথায় আলাদা, সাজে পোশাকে আলাদা—এমন বেদের মেয়ে নতুন দেখলেন শিবরাম তাঁর জীবনে। বেদেরা কালোই হয়, কিন্তু এমন মসৃণ উজ্জ্বল কালো রঙ কখনও দেখেন নাই শিবরাম। তেমনি কি ধারালো গড়ন! মেয়েটির বয়স অবশ্য অল্প, কিন্তু বেশি বয়স হলেও একে দূর থেকে মনে হবে কিশোরী মেয়ে। ছিপছিপে পাতলা গড়ন, দীৰ্ঘাঙ্গী, মাথায় একরাশি চুল রুখু কালো। করকরে কোকড়া চুল, খুলে দিলে পিঠের আধখানা ঢেকে চামরের মত ফাপা হয়ে বাতাসে দোলে, কোঁকড়া চুল টেনে সোজা করলে এসে পড়ে জানুর উপর। কালো রঙের মধ্যে চিকচিক। করছে তিন অঙ্গে চার ফালি তুলির রেখায় টানা সাদা রেখা। কালো চুলের ঠিক মাঝখানে পৈতের সুতোর মত লম্বা সিঁথিটি, ধারালো নাকটির দুপাশে নpন দিয়ে চেরা সরু অথচ লম্বা টানা পদ্মের একেবারে ভিতরের পাপড়ির মত দুটি চোখের সাদা ক্ষেত, আর ঠোঁটের ফাঁকে ছোট সাদা। দাঁতের সারি। পরনে লালরঙে ছাপানো তাতে বোনা খাটো মোটা রাঙা শাড়ি, গলায় পদ্মবীজের। মালা, তার সঙ্গে লাল সুতো দিয়ে ঝুলছে মাদুলি পাথর আরও অনেক কিছু; হাতের মণিবন্ধ খালি, উপর-হাতে লাল সুতোর তাগা টান করে বাধা, নরম কালো হাতের বাইরে যেন কেটে বসে। গেছে। তাতেও মাদুলি পাথর জড়িবুটি। গাছ-কোমর বাঁধা, পরনের ভিজে কাপড় হিলহিলে দেহখানির সঙ্গে সেঁটে লেগে রয়েছে; মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, যেন বাতাসে প্রতিমার মত দুলছে। নৌকাখানা আর একটু এগিয়ে যেতেই নাকে একটা তীব্ৰ গন্ধ ঢুকল এসে শিবরামের। মেয়েটি যখন ঘাসবন ঠেলে সাপটার পিছনে বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল, তখন ঠিক মুহূর্তের। জন্য এই গন্ধ নাকে এসে পৌঁছেছিল। শিবরাম বুঝলেন, এ গন্ধ ওর গায়ের গন্ধ। শরীরটা যেন পাক দিয়ে উঠল। যারা বন্য, যারা পোড়া মাংস খায়, তেল মাখে না, তাদের গায়ে একটু গন্ধ থাকে। মাল মাঝি বেদেদের গায়েও গন্ধ আছে, কিন্তু তাতে এই তীব্রতা নাই। এ যেন ঝাজ!

অবাক হয়ে চেয়ে দেখছিলেন শিবরাম। বেদের মেয়ে, কিন্তু এমন বেদের মেয়ে তিনি দেখেন নাই।

–হি–, কন্যে রইছিস্ গঃ! হি–গঃ–

একটা করকরে রুক্ষ মোটা গলার ডাক ভেসে এল। ওই মানুষের-চেয়ে-উঁচু ঘাসবনের থেকে কেউ ডাকছে।

মেয়েটা ডান হাতে ধরে ছিল সাপটা। বা হাতের ছোট তালুখানি মুখের পাশে ধরে গঙ্গার খোলা দিকটা আড়াল করে প্রদীপ্ত হয়ে সাড়া দিয়ে উঠল—হি–গঃ হেথাকে—গঃ! হাঙরমুখীর প্যাঁটের বাঁকে গঃ! ত্বরতি এস গঃ! দেখা যাও, দেখা যাও পা চালায়ে এস গঃ!

কণ্ঠস্বরে উল্লাস উচ্ছ্বসিত হয়ে উপচে উপচে পড়ছে যেন। ব্যগ্ৰ দৃষ্টিতে ঘাসবনের দিকে। চেয়ে কৌতুকহাস্যে বিকশিত মুখে সে বললে—বুড়া অবাক হয়া যাবে গ বাবা! কৌতুকে চোখ যেন নাচছে চঞ্চল পাখির মত।

স্মিতহাস্য ফুটে উঠল ধূর্জটি কবিরাজের মুখে। তিনিও দৃষ্টি ফেরালেন ঘাসবনের দিকে। ঘাসবন চঞ্চল হয়ে উঠেছে, দুলছে; দুপাশে হেলে নুয়ে পড়েছে ঘাসবন—সবল দ্রুতগতিতে চলে আসছে কেউ বুনো দাতালের মত। সবিস্ময়ে প্রতীক্ষা করছিলেন শিবরাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল মানুষটার মাথা, পাকা দাড়ি গোঁফ ও কাঁকড়া চুলে ভরা মানুষের মুখ, রঙ ঘন কালো, চোখে বন্য দৃষ্টি। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে, চোখের বন্য দৃষ্টি বিস্ময়ে বিচিত্র হয়ে উঠল; সস্মিতবিস্ময়ে পুলকিত কণ্ঠে সেও বলে উঠল—ধন্বন্তরি বাবা! সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

কবিরাজ বললেনভাল আছ মহাদেব? ছেলেপুলে পাড়া-ঘর তোমার সব ভাল?

তার কথা শেষ হতে না হতে ঘাসবন থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল সেই মহাদেব। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত গামছার মত একফালি মোটা একটা কাপড়ের আবরণ শুধু, নইলে নগ্নদেহ এক বন্য বর্বর। গলায় হাতে তাবিজ জড়িবুটি কালো সুতোয় বাধা, আর গলায় একগাছি রুদ্ৰাক্ষের মালা। তারও গায়ে ওই উৎকট তীব্র গন্ধ। বৃদ্ধ তবু লোকটা খাড়া সোজা। দেহখানা যেন। শ্যাওলা-ধরা অতি প্রাচীন একটা পাথরের দেওয়াল, কালচে সবুজ শ্যাওলায় ছেয়ে গিয়েছে, কতকালের শ্যাওলার স্তরের উপরে শ্যাওলার স্তর, কিন্তু এখনও শক্ত অটুট রয়েছে। নির্বাকবিস্ময়ে চেয়ে রইলেন তরুণ শিবরাম। হাঁ, এই বাপের ওই বেটীই বটে।

বেদে কিন্তু সাধারণ মাল বা মাঝি বেদে নয়। সাঁতালীর বিষ-বেদে। সাঁতালী ওদের নাম। ওই হিজল বিলের ধারে ভাগীরথীর চরভূমির ঘাসবন ঝাউবন দেবদারু গাছের সারির আড়ালে ওই হাঙরমুখী নালার ঘাট থেকে চলে গেছে একফালি সরু পথ, দুদিকে ঘাসবন, পায়ে-পায়ে-রচা পথ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে ওই বিষ-বেদেদের সাঁতালী গ্রামের মাঝখানে বিষহরি মায়ের থান অর্থাৎ স্থান পর্যন্ত। গ্রামের মাঝখানে ওই দেবস্থানটিকে ঘিরে চারিপাশে বিচিত্ৰ বসতি। দেবস্থানের চারিদিকে দেবদারুডালের খুঁটো পুঁতে মাচা বেঁধে তারই উপর ঘর। মাচাটির চারিপাশে ঝাউডালের বেড়া বেঁধে গায়ে পাতলা মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি করা দেওয়াল, তার উপর ওই ঘাসবনের ঘাসে ছাওয়া চাল, এই ওদের ঘর। প্রতি বৎসরই ঝড়ে উড়ে যায়, বর্ষায় গলে পড়ে, শুধু নিচের শক্ত মাচাটি টিকে থাকে। গঙ্গায় বন্যা আসে, ঘাসবন ড়ুবে যায়, হিজল। বিল আর গঙ্গায় এক হয়ে যায়, সাঁতালী গা জলে ডোবে, মাচাগুলি জেগে থাকে, ঝড় বন্যা হলে তাও ডোবে। তখন গেলে দেখতে পাবে, ঝাউগাছের ভেলার উপর, ছোট ছোট নৌকার উপর বিষ-বেদেরা সেই অথৈ বন্যার মধ্যে ভাসছে। বন্যার জল নেমে যায়, মাটি জাগে, ভিজে পলির আস্তরণ পড়ে যায়, বিষ-বেদেরা নৌকা এবং ভেলার উপর থেকে নেমে আসে, মাচার মেঝের পলি কাদা পরিষ্কার করে। দেওয়ালের খসেপড়া কাদার আস্তরণ আবার লাগায়, ছোট ছেলেমেয়েরা কাদা ঘেঁটে মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে। বড়রা দেবদারু গাছে অ্যাঁকশি লাগিয়ে শুকনো কাঠ ভেঙে আনে, বিলে ফাঁদ পেতে হাঁস ধরে, গুলতি ছুঁড়েও মেরে আনে, আবার সাঁতালীর ঘরে ঘরে উনানের ধোঁয়া ওঠে, ওদের ঘরকন্না আবার শুরু হয়ে যায়। তারপর চলে এক দফা নৌকা নিয়ে সাপ ধরার কাজ। হিজল বিলের চারিপাশে ঝাউ-দেবদারুর উঁচু ডালে, মাথায়—বন্যায় ভেসে এসে নানান ধরনের সাপেরা আশ্রয় নেয়, ওরা সেইসব সাপ দেখে দেখে প্রায় বেছে বেছে। ধরে ঝাঁপি বোঝাই করে। ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে এমন সাপ সৃষ্টিতে নাই। দেবদারুর মাথায় যে দুধে গোখরো ফণা তুলে আকাশের উড়ন্ত শকুন বা গাঙচিল বা বড় বড় বাজের ঠোঁট-নখকে উপেক্ষা করে, সে দুধে-গোখরো ঠিক বন্দি হয়ে এসে ঢেকে ওদের কাঁপিতে। যে ঘন সবুজ রঙের লাউডগা সাপটা গাছের পাতার সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে সাধারণ লোকের চক্ষে পড়ে না, সেও ঠিক ওদের চক্ষে পড়বে এবং তাকে ধরে পুরবে ওদের ঝাপিতে। ভোরবেলা সূর্য যখন সবে পুবের আকাশে লালি ছড়িয়ে উঠি-উঠি করে, তখন ওরা নৌকার উপর দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গাছের মাথার দিকে। উদয়নাগেরা এবার বেরিয়ে ফণা মেলে দাঁড়াবে, দুলবে, দিনের দেবতাকে প্রণাম করে আবার লুকিয়ে পড়বে গাছের পাতার আবরণের অন্ধকারের মধ্যে। তারাও ধরা পড়বে ওদের হাতে। কালকেউটের তো কথাই নাই। কালনাগিনী ওদের কাছে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। তারাই ওদের ঘরের লক্ষ্মী, কালনাগিনীই ওদের অন্ন যোগায়, কালনাগিনী বিষ-বেদের কন্যে। ওই কালনাগিনীর বিষ থেকেই হয় মহাসঞ্জীবনীসূচিকাভরণ। সেও মা-বিষহরির বর। রাত্রির মত কালো কালনাগিনী, সুন্দরী সুকেশী মেয়ের সুচিকণ তৈলমসৃণ চুলে রচনা করা বেণির গঠন আর তেমনি তার কালো রঙের। দীপ্তি। কালো কেউটে অনেক জাতের আছে, কালোর উপর শ্বেত সরষের মত সাদা ছিট আছে যে কেউটের কালো গায়ে, সে কেউটে জেনো—শামুকভাঙা কেউটে। যে কেউটের গলায় তার গায়ের রঙের চেয়েও ঘন কালো রঙের কণ্ঠিমালার মত দুটি দাগের বেড় আছে, সে জেনো কালীদহের কালীগের ছেলের বংশের জাত। কালনাগিনী শুধু কালো। কালীনাগের কন্যে নাগিনী, ও বংশে কন্যে ছাড়া পুরুষ নাই। তার লেজ খানিকটা মোটা। বেহুলা অ্যাঁতি দিয়ে কেটে নিয়েছিল তার লেজের খানিকটা। কালনাগিনীর নাগের জাত নাই। অন্য নাগের জাতের সন্তান প্রসব করে কালনাগিনী। তাই থেকে হয়েছে নাকি নানা জাতের কেউটের সৃষ্টি। মা-বিষহরির ইচ্ছায় ওদের মধ্যে দুই-চারিটি কন্যা একেবারে মায়ের জাত নিয়ে জন্মায়, কালনাগিনীর ধারা অব্যাহত রাখবার জন্য। কালনাগিনী চেনে ওই বিষ-বেদেরা। ওদের ভুল হয় না। ধূর্জটি কবিরাজ জানেন সে তথ্য। তাই তিনি বিষ-বেদের কাছ ছাড়া অন্য বেদের কাছে সূচিকাভরণের উপাদান সংগ্রহ করেন না। সেই কারণেই তার সূচিকাভরণ সাক্ষাৎ সঞ্জীবনী।

আর ভাগীরথীর কূলে হিজল বিলের পাশে মা-মনসার আটনের পাট-অঙ্গনে সাঁতালী গাঁয়ের চারিপাশেই কালনাগিনীর বাসভূমি। তাই তো বিষ-বেদেরা এই ঘাসবনের মধ্যে বন্যার জলে পাকাল মাটির উপরই বাস করে পরমানন্দে। বন্যায় কাদা হয়। ঘাস পচে, ভ্যাপসা গন্ধ হয়, মশায় মাছিতে ভনভন করে চারিদিক, ঘাসবনের মধ্যে বাঘ গৰ্জায়, হিজল বিলের অসংখ্য নালায় কুমির ঘুরে বেড়ায়, হাঙর আসে, কামঠ আসে, তারই মধ্যে ওরা বাস করে চলেছে। এখান ছেড়ে বিষ-বেদেরা স্বর্গেও যেতে চায় না। বাপ রে বাপ, এখানকার বাস কি ছাড়া যায়। মা-বিষহরির সনদ দেওয়া জমি—এ জমির খাজনা নাই। লোকে বলে, অমুক রাজার রাজত্বি ও গায়ের ওই জমিদারের এলাকা, কিন্তু বিষ-বেদেদের খাজনা আদায় নিতে আজও কোনো তসিলদারের নৌকো হাঙরমুখীর নালা বেয়ে সাঁতালী গাঁয়ের ঘাটে এসে পৌঁছে নাই। হুকুম নাইমা-বিষহরির হুকুম নাই। বেদেদের শিরবেদে সমাজের সমাজপতি বুড়ো মহাদেব বলে–মা-বিষহরির হুকুম নাই। তার সনদে মোরা ঘর বাঁধলাম হেথাকে এসে। চম্পাই নগরের ধারে সাতালী পাহাড়ে ছিষ্টির আদিকাল থেকে বাস ছিল–শতেক পুরুষের বাস—জাতে ছিলাম বিষবৈদ্য—সে বাস গেছে, সে জাত গেছে, মা-লক্ষ্মী ছেড়ে গেছেন—তার বদলে পেয়েছি। মা-বিষহরির সনদে কালনাগিনী-কন্যে, মা-গঙ্গার পলি-পড়া জমির ওপর এই নতুন সাঁতালী গাঁয়ে জমি, এ ছেড়ে কোথাকে যাব?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
Pages ( 1 of 11 ): 1 23 ... 11পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress