Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য || Suchitra Bhattacharya » Page 4

ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য || Suchitra Bhattacharya

০৭-৮. কাকে চাই

কাকে চাই?

মিস্টার বাসব সমাদ্দার… আই মিন, ডক্টর সমাদ্দার…

এখন দেখা হবে না। উনি কাজে বসেছেন।

একটা জরুরি দরকার ছিল যে।

কাল আসবেন। সকাল নটায়। পড়াশোনায় বসে গেলে উনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।

কাজের মেয়েটি মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল, তার আগেই মিতিন চৌকাঠে পা গলিয়ে দিয়েছে।

মেয়েটি রুক্ষ স্বরে বলল, আপনারা জোর করে ঢুকবেন নাকি?

ধরো তাই, মিতিনের স্বরও কড়া, গিয়ে বলল, আমরা থানা থেকে আসছি।

কথাটা যেন বিশ্বাস হল না মেয়েটির। তিন আগন্তুককে আপাদমস্তক জরিপ করে বলল, ভেতরে ঢুকবেন না। এখানেই দাঁড়ান। আমি জিজ্ঞেস করে আসি।

উঁকি দিয়ে বাইরের ঘরখানা দেখে নিল টুপুর। ভারী অগোছালো। কালচিটে হয়ে যাওয়া বেতের সোফা যেমন-তেমন ছড়িয়ে আছে, মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে বই, তক্তপোশের উপরও বইয়ের স্তূপ, জানলায় পাতলা পাতলা মলিন পরদা, দেওয়ালের কোনায় কোনায় ঝুল। কোনও অধ্যাপকের ঘর এমন ছ্যাতাপ্যাতা হয়?

কাজের মেয়েটি ফিরেছে। পিছনে কুচকুচে কালো গাঁট্টাগোট্রা এক মানুষ। মাথার চুল ধবধবে সাদা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।

দূর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, তোমরা পুলিশের লোক? ভাঁওতা দেওয়ার জায়গা পাওনি?

মিতিন মিষ্টি করে হাসল, আমরা হাফ পুলিশ স্যার। আমি একজন ডিটেকটিভ।

অ। তা আমার কাছে কী মনে করে?

মিস্টার ঝাও ঝিয়েনের ব্যাপারে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।

তার ব্যাপারে আবার কী কথা? সে তো মরে ভূত হয়ে গিয়েছে।

কী কৰ্কশ লোক রে বাবা! এরকমভাবে কেউ মৃত মানুষ সম্পর্কে বলে?

মিতিনের অবশ্য হেলদোল নেই। নরম করেই বলল, মিস্টার ঝিয়েনের মৃত্যুটা তো আনন্যাচারাল, তাই…

জানি। গাড়িচাপা পড়েছে। সবসময় যে লোক ভাবের ঘোরে থাকে, তার এই পরিণতিই হয়।

ভাবের ঘোরে মানে? উনি তো যথেষ্ট সাবধানি লোক ছিলেন।

তা হবে। আমি তো দেখতাম, সর্বদা আজব আজব থিয়োরিতে বুঁদ হয়ে আছে। অ্যাদ্দিন ধরে হিস্টোরিয়ানরা, অ্যানথ্রোপলজিস্টরা, যা বলেছে সবই নাকি ভুল। দুনিয়ায় সব কিছু নাকি চিনেরাই আগে করেছে। হ্যাঃ, যত্ত সব।

আমি মিস্টার ঝিয়েনের সম্পর্কেই আর-একটু ডিটেলে জানতে এসেছিলাম।

যা বলার তা তো বলেই দিলাম। আর কিছু জানি না।

তবু স্যার… আপনারা তো একসঙ্গে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসতেন…

একসঙ্গে নয়। আমি গেলে ও ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে থাকত।

আপনার সঙ্গে মিস্টার ঝিয়েনের কদ্দিনের পরিচয়?

বছর দুয়েক। আমেরিকার কোথায় কারা প্রথম কলোনি বানিয়েছিল, তাই নিয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে আমার একটা লেকচার ছিল, সেখানেই ও যেচে এসে আলাপ করে। বাসব সমাদ্দারের গলা ঘড়ঘড় করে উঠল, প্রথমে ভেবেছিলাম জ্ঞানপিপাসু। পরে দেখলাম, ট্যাড়া বাঁশ। নিজের মত থেকে এক চুল নড়বে না, এবং অন্যকেও সেটা মানাতে চাইবে।

শুনছিলাম উনি নাকি প্রায়ই রাতে আপনাকে ফোন করতেন?

বাজে কথা। মাঝে মাঝে করত। আমি ওকে সাফ বলে দিয়েছিলাম, তোমার চিনে অহমিকা তুমি ছাড়ো, নচেৎ আমার কাছে আর ভেড়ার চেষ্টা কোরো না।

উনি কি আপনাকে একটা ওয়ালহ্যাঙ্গিংয়ের ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন?

যত্ত সব গুলগাপ্পি। আমি ওর কথা বিশ্বাসই করিনি। শুভ্র চুলে আঙুল চালাচ্ছেন বাসব সমাদ্দার। হঠাৎই কটকট করে তাকালেন, অ্যাই, এবার তোমরা যাও তো। ফালতু বকবক করার সময় আমার নেই।

বি পেশেন্ট ডক্টর সমাদ্দার। মিতিনও ফের গলা রুক্ষ করেছে, আপনাকে একটা কথা বলে রাখা দরকার। মিস্টার ঝিয়েন কিন্তু অ্যাকসিডেন্টে মারা যাননি, ওঁকে মার্ডার করা হয়েছে। ওঁর চেনাপরিচিত সকলকেই আমরা সন্দেহের তালিকায় রেখেছি। আপনিও কিন্তু তার বাইরে নন।

কীমাশ্চৰ্যম, বাসব সমাদ্দার হঠাৎই শান্ত হয়ে গেলেন। তাঁর পুরু ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। ঠান্ডা গলায় বললেন, তা হলে তো আমি আর একটি কথাও বলব না। তোমরা এসো।

মিতিনও ছাড়ার পাত্রী নয়। ততোধিক শীতল গলায় বলল, তার মানে আপনি আরও কিছু বলতে পারতেন?

বাসব সমাদ্দার পিছন ঘুরে ভারী পায়ে ভিতরে চলে গেলেন। যেতে যেতেই বললেন, রত্না, দরজায় ছিটকিনি তোল। আর কোনও টিকটিকি-গিরগিটি যেন আমায় বিরক্ত করতে না পারে।

একতলা বাড়িটার বাইরে এসে টুপুর বেঁঝে উঠল, কী অভদ্র লোক রে বাবা! একটু বসতে পর্যন্ত বলল না।

কুশল আহত গলায় বলল, লোকের বাড়ি গেলে অন্তত এক গ্লাস জল তো খাওয়ায়!

মিতিন বলল, সহবতজ্ঞান নেই। তবে লোকটা ইন্টারেস্টিং। টুকুস টুকুস করে কিছু খবর তো বের করা গেল।

সেটাও বললেন কী রেগে রেগে!

রাগের অনেকটাই লোক দেখানো। ইচ্ছেমতো স্নায়ু কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আছে প্রোফেসর সাহেবের। এই ধরনের মানুষরা সাংঘাতিক ক্লেভার হয়। ইনি মিস্টার ঝিয়েনকে সমাধি দেওয়ার দিন গিয়েছিলেন না?

কুশল গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, হ্যাঁ। লিয়াংরা তো তাই বলল।

বোঝ তা হলে। একদিকে কথা শুনে মনে হচ্ছে, মিস্টার ঝিয়েনের নাম শুনতে পারেন না, ওদিকে তাঁর ফিউনারালে প্রেজেন্ট!

টুপুর ফুট কাটল, ওঁকে কিন্তু আর-একটু টোকা দিয়ে দেখলে পারতে, মিতিনমাসি।

হুম। কিন্তু এখন যে পেটে ইঁদুররা টোকা দিচ্ছে রে। চল, আমার বাড়িতে গিয়ে আগে খাওয়াদাওয়াটা সারি।

কী মেনু গো?

দিশি মোরগের ঝোল, আর ভাত।

কুশল সিটে বসেই লাফিয়ে উঠল, ওয়াও!

.

একটু তাড়াতাড়িই সন্ধে নেমেছে আজ। দুপুর পর্যন্ত দিব্যি রোদ ছিল, তারপর আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। তড়িঘড়ি গা ঢাকা দিয়েছেন সূর্যদেব। তাপ এখন অনেক কম। বাতাসে যেন কেমন স্যাঁতসেঁতে ভাব।

সারাদিন চটচটে গরমের পর বাতাসটা ভালই লাগছিল টুপুরের। সিটে হেলান দিয়ে বলল, মিতিনমাসি, এবার কি সিমলাইপাড়া?

মিতিনের চোখ জানলার বাইরে, গভীর মনোযোগে ভাবছিল কী যেন। হাল্কাভাবে বলল, হুঁ।

কুশল সামনের সিটে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, তরুণ বসুকে তোমার কেমন লাগল, মিতিনমাসি? ডক্টর সমাদ্দারের একেবারে উলটো টাইপ না?

মিতিন নিচু স্বরে বলল, হুঁ, খুবই ঠান্ডা মানুষ।

টুপুর বলল, একটু বেশিই ঠান্ডা। তবে আঙ্কল ঝিয়েনের মৃত্যুতে বড়ই মর্মাহত।

কুশল বলল, ওঁর কাছে যাওয়াটা কিন্তু বেকার হল। আঙ্কল ঝিয়েনের ব্যাপারে নতুন কিছুই জানা গেল না। … আপ্যায়নটা অবশ্য মন্দ হয়নি।

ওয়ালহ্যাঙ্গিংয়ের ব্যাপারে একটা পয়েন্ট কিন্তু পাওয়া গিয়েছে।

কী বলো তো?

যা বাবা, এর মধ্যে ভুলে গেলি? মিষ্টি সাঁটানোর সময় তোর কি কোনও দিকে মন থাকে না?

অ্যাই, আওয়াজ দিস না। তুইও দুটো সন্দেশ, একটা রসগোল্লা খেয়েছিস। সেটাও নেহাত কম নয়।

তুইও খা না যত খুশি, আনমাইন্ডফুল হোস কেন? টুপুর গলা নামাল, তরুণবাবু বলছিলেন, স্বপন দত্তর কাছ থেকে কালেক্ট করা নামটা নাকি রিয়েল হতেও পারে। ওই নামে একজন শিল্পী নাকি সত্যিই ছিলেন। ফিফটিন্থ সেঞ্চুরিতে। চিনে তখন মিং বংশের রাজত্ব চলছে। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে উনি আর-একটা কথাও বললেন। গবেষকরা নাকি অনেক সময় ফেক জিনিসকে মূল্যবান বলে ভুল করেন। ইতিহাসে তো নাকি আকছার এরকম ঘটনা ঘটছে।

কুশল সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, তার মানে ওয়ালহ্যাঙ্গিংটাও জালি নাকি?

কী জানি, উনি তো ওয়ালহ্যাঙ্গিংটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছিলেন বটে, আঙ্কল ঝিয়েনের খুন হওয়ার সূত্র নিৰ্ঘাত চিনে পাড়াতেই লুকিয়ে আছে।

তা হলে তো মহা মুশকিল। লিয়াংয়ের রিলেটিভদেরও ধরে ধরে জেরা করতে হয়। কেসটা কিন্তু আস্তে আস্তে বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে!

ভাড়াগাড়ি ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস ধরে উত্তরমুখো ছুটছে। এবার ভি-আই-পি রোডে পড়ে, লেকটাউন ভেদ করে, ঢুকবে পাইকপাড়ায়। সিমলাইপাড়া লেন নাকি পাইকপাড়ায়, মিতিনমাসি চেনে।

কুশল বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারে না। আপন মনেই বলে উঠল, তরুণবাবু কিন্তু বেশ মালদার। কী ঘ্যামা ফ্ল্যাট, দারুণ সাজানো ড্রয়িংরুম, ওয়ালে প্লাজমা টিভি… বাসব সমাদ্দারের বাড়ির সঙ্গে আকাশ পাতাল তফাত।

টুপুর সায় দিল, তরুণবাবুর গাড়িটাও বিদেশি। রংটা কী সুন্দর! হাঁসের ডানার মতো ধবধবে সাদা।

গাড়ি তুই কখন দেখলি?

আশ্চর্য, তুই কি অন্ধ নাকি? আমরা রওনা দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তো উনিও বেরোলেন। আমাদের গাড়ির পাশ দিয়েই গেলেন। নিজেই ড্ৰাইভ করছিলেন। পাশে মিসেস।

মনে হয় খানদানি বড়লোক। এখনও ওল্ড বালিগঞ্জে এরকম বনেদি পরিবার অনেক আছে। তাই না মিতিনমাসি?

অনেকক্ষণ পর মিতিনের গলা পাওয়া গেল, তোদের দেখছি তরুণবাবুকে খুব পছন্দ হয়েছে।

স্বাভাবিক। কী ভদ্র ব্যবহার…এতটুকু অহংকার নেই, টুপুরের স্বরে মুগ্ধতা, তুমিই বলো, তরুণবাবু তো বাসববাবুর চেয়ে কম পণ্ডিত নন… কিন্তু কোনও খিটকেলপনা করলেন কি?

হুম।

তারপর ধরো, সামনের মাসেই উনি বিদেশে সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছেন। অথচ সে খরবটাও কত বিনয়ের সঙ্গে জানালেন।

ঠিক।

একটা কথা বলি, মিতিনমাসি? কুশল গলা ঝাড়ল, আমার মনে হয়, তরুণবাবুর অ্যাডভাইসই আমাদের শোনা উচিত। লিয়াংদের পরিবারের মধ্যেই বোধহয় কোনও গন্ডগোল আছে। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাসে পড়েছিলাম, এক চিনা পরিবারেরই কোনও জ্ঞাতিভাই তিন পুরুষ আগের ঝগড়ার ঝাল মেটাতে..

আমি কোনও আশঙ্কাই উড়িয়ে দিচ্ছি না, কুশল। মিস্টার ঝিয়েনের স্কুলেও একবার আমাদের যেতে হবে। যত বেশি ডেটা হাতে আসবে, সত্যের কাছে পৌঁছোতে তত সুবিধে। তবে আপাতত এখন শিবতোষ রায়কে তো মিট করে আসি।

.

০৮.

সিমলাইপাড়ায় এসে শিবতোষ রায়ের বাড়ি খুঁজতে কোনও সমস্যাই হল না। পাড়ার সবাই তাঁকে চেনে। একজনকে জিজ্ঞেস করেই পৌঁছোনো গিয়েছে গন্তব্যস্থানে।

শিবতোষ রায় বাড়িতেই ছিলেন। মিতিনদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বাসববাবুর বাড়িতে অভ্যর্থনার বহর দেখে মিতিন আর ঝুঁকিতে যায়নি, আগেই ফোনে সময় চেয়ে নিয়েছিল শিবতোষবাবুর কাছ থেকে। বেল বাজাতে তিনি নিজেই দোতলা থেকে নেমে দরজা খুলেছেন।

মিতিন হাত জোড় করে নমস্কার করল ভদ্রলোককে স্মিত হেসে শিবতোষবাবু বললেন, আমি কিন্তু আপনাকে একটু একটু চিনি।

কীভাবে?

আপনার একটা কেস ডিটেকশন কাগজে খুব মন দিয়ে পড়েছি। সেই যে… শ্বশুর পুত্রবধূকে টাকার জন্য ব্ল্যাকমেল করত..

সে তো প্রায় চার বছর আগের ঘটনা। আপনার মনে আছে?

সাল, তারিখ, নাম, ঘটনা… এসব মনে রাখাই তো আমাদের পেশা। …আসুন …ভেতরে আসুন।

একতলাতেই ড্রয়িংরুম। বাসববাবুর মতো অগোছালোও নয়, আবার তরুণবাবুর মতো ঘ্যামচ্যাকও নয়, ছিমছাম। ঘরের আসবাব পুরনো ধাঁচের হলেও পরিচ্ছন্ন। দেওয়ালে গাঁথা কাচের আলমারিতে শুধু ইতিহাসের বই নয়, রবীন্দ্রবঙ্কিম-শরৎ রচনাবলিও দৃশ্যমান।

টুপুররা সোফায় বসতে না বসতেই শরবত এসে গেল।

শিবতোষবাবু বসেছেন টুপুরদের উলটো দিকে। বয়স বড়জোর বছর পঞ্চাশ। রোগা, লম্বা চেহারা, গায়ের রং তামাটে। সরু একখানা গোঁফও আছে, শুয়োপোকার মতো। মিতিনদের শরবত শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ভদ্রলোক, গ্লাস খালি হতেই বললেন, বলুন ম্যাডাম, কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

মিতিন ঝুঁকে বসল, ফোনেই তো বললাম… মিস্টার ঝিয়েনের সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই।

শিবতোষবাবু দুএক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে বললেন, আমার সঙ্গে ঝিয়েনের আলাপ বছর পাঁচেক আগে। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। আমি কুবলাই খাঁর উপর একটা বই খুঁজছিলাম। পাচ্ছিলাম না। রোজই শুনতাম কে একজন যেন ইস্যু করে নিয়ে রিডিংরুমে চলে গিয়েছে। খুঁজে খুঁজে দেখি, ঝিয়েন। বইটাকে ও নিজের কাজের রেফারেন্স হিসেবে ইউজ করছিল। সেদিন থেকেই পরিচয়। আমাদের দুজনেরই গবেষণার বিষয়ে বেশ লিঙ্ক ছিল, তাই মোটামুটি জমেও গেল।

আপনি কী নিয়ে কাজ করছেন?

বর্তমানে আমার বিষয়, চিনের উপর বিদেশি আক্রমণের প্রভাব। টাইম টু-টাইম, বহু বহিরাগতই তো চিন আক্রমণ করেছে.. তাতে চৈনিক সংস্কৃতির উপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে…

আর মিস্টার ঝিয়েন?

চিনারা কীভাবে বহির্বিশ্বে ছড়িয়েছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং। ঝিয়েন অনেক ভাল ভাল তথ্য জোগাড় করেছিল। যত্ন করে সিস্টেমেটিক্যালি কম্পাইল করত। অত্যন্ত সিনসিয়ার। ভারী বিদ্যানুরাগী। অ্যাকাডেমিক্যালিও খুব সাউন্ড ছিল তো।

মিস্টার ঝিয়েন তো পিএইচডি, টিএইচডি করেননি?

ডিগ্রিফিগ্রির ওপর ওর আগ্রহই ছিল না। থাকলে তো কবেই ভক্টরেট হয়ে যেত। সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে অত ভাল মার্কস নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন, এম-এতে হিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস… এরকম ছাত্ৰ পেলে তো যে-কোনও গাইড লুফে নিত। প্রথাগত গবেষণায় না-গিয়েও ঝিয়েন অবশ্য কাজ করে যাচ্ছিল। একটা ব্যাপার তো ঝিয়েন প্রমাণই করে দিয়েছে। ইউরোপিয়ানরা চিনাদের যে ইতিহাস তৈরি করেছে, তা একেবারেই অসম্পূর্ণ এবং অনেকটাই ভুল।

যেমন?

যেমন, নেভিগেশন বা জলপথে চলাচলের ব্যাপারটায় চিনারা ইউরোপিয়ানদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। তার নিখাদ প্রমাণ হল, নৌকোর সাইজ। ইউরোপের বিখ্যাত নৌ অভিযাত্রীদের নৌকো যেখানে তিরিশ ফিট থেকে মেরেকেটে চল্লিশ, সেখানে চিনারা একশো ফিটের চেয়ে বড় নৌকো নিয়ে সমুদ্রে ঘুরত। অবশ্য পাল বাঁধার ব্যাপারটা চিনারা খুব ভাল জানত না। তবে দিকনির্ণয়ে ওদের ভুলচুক হত না কোনও। ইউরোপিয়ানরা তো প্রমাণ করতে চান, পৃথিবীটাকে ওঁরাই সভ্য করেছেন। কথাটা যে কত ভুল..

শিবতোষবাবু কথা শুরু করলে আর থামতেই চান না। মিতিন তাঁকে কোনওক্রমে রুখল। বলল, আচ্ছা, সম্প্রতি মিস্টার ঝিয়েন একটা ওয়ালহ্যাঙ্গিং কিনেছিলেন। আপনি কি সে ব্যাপারে কিছু জানেন?

ওই বস্তুটি কেনার পরেই তো মিসহ্যাপটা ঘটল, এবং দুর্ভাগ্যবশত জিনিসটাও লোপাট। খুব ক্ষতি হয়ে গেল. খুব ক্ষতি হয়ে গেল..

কেন?

ওটা আসলে কী জানেন? মো-ই-টং-এর আঁকা ম্যাপ। মিং ডাইনেস্টির সেই ফেমাস আর্টিস্ট…

তরুণবাবুও বলছিলেন উনি খুব বিখ্যাত শিল্পী…

তরুণ তো জানবেই। তরুণ তো ঝিয়েনের লাইনেই কাজ করছে। ইস, ওই ম্যাপটা হাতে থাকলে কত দিনের একটা মিথ্যে প্রচার যে নস্যাৎ করা যেত!

টুপুর হতভম্ব মুখে বলে উঠল, ওই ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা শুধুই একটা ম্যাপ?

মোস্ট প্রবাবলি। ঝিয়েন ভুল করার লোক নয়। ইস, ম্যাপটা আমার আর দেখা হল না।

ওটা কীসের ম্যাপ ছিল স্যার?

পৃথিবীর।

এবার মিতিনও স্তম্ভিত। অক্ষুটে বলল, মানে?

এককথায় বলা কঠিন। বলা যেতে পারে, ওটাই গোটা পৃথিবীর প্রথম অথেন্টিক মানচিত্র।

ঠিক বুঝলাম না, স্যার।

তা হলে একটু ইতিহাসে ঢুকতে হয়।… থারটিন্থ সেঞ্চুরিতে চেঙ্গিস খাঁর নাতি কুবলাই খাঁ চিন দখল করেছিল। তাদের হটিয়ে প্রায় একশো বছর পর মিংদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মিংদের আমলকে বলা হয় চিনের স্বর্ণযুগ।

কুশল বলল, জানি। ওই সময় চাইনিজ ওয়াল তৈরি হয়েছিল।

আরও অনেক কিছুই হয়েছিল। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, সবেতেই তখন চিনের রমরমা। মিং রাজত্ব প্রতিষ্ঠার একশো বছর পরে এক বিখ্যাত চিনা অভিযাত্রীর জন্ম হয়। সালটা তেরোশো একাত্তর। তাঁর নাম মা-সান-পাও। ইতিহাস তাঁকে জানে অ্যাডমিরাল জেং নামে। শৈশব থেকেই বেচারা অনাথ। বড় হয়ে তিনি হলেন রাজা ইয়ং-লোর এক সৈনিক। রাজা তাঁকে খুব ভালবাসতেন। নৌযোদ্ধা হিসেবে তার খুব নাম হয়েছিল বলে রাজা তাকে নৌবাহিনীর বড় পদে বসান। তারপর হঠাৎই একদিন হুকুম দেন, তোমাকে আর যুদ্ধটুদ্ধ করতে হবে না, তুমি চিনের প্রতিনিধি হয়ে দেশে দেশে ঘোরো, আর পারলে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করো। …তারপর থেকে শুরু হল জেংয়ের নৌঅভিযান। একবার নয়, সাত-সাত বার বেরিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বার গিয়েছিলেন মাত্ৰ চৌত্রিশ বছর বয়সে। সঙ্গে ছিল বাষট্টিটা জাহাজ আর সাতাশ হাজার আটশো মতো অনুচর।

আরিব্বাস কুশলের চোখ কপালে, এটাই তো একটা নৌবহর।

বলতে পারে। প্রথমবার জেং গিয়েছিলেন ভিয়েতনাম, মালাক্কা, জাভা, শ্রীলঙ্কা। …আমাদের কোচিন-কালিকটেও এসেছিলেন। ভাস্কো-দা-গামার তিরান্নবই বছর আগে। সেই জেং-ই তাঁর ষষ্ঠ অভিযানের সময় আফ্রিকাটাফ্রিকা পেরিয়ে, অতলান্তিক পাড়ি দিয়ে, পৌঁছেছিলেন আমেরিকায়। চোদ্দোশে একুশ সালে। আমরা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের গল্প শুনি। কলম্বাস কিন্তু তখনও জন্মাননি।

টুপুর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, বলছেন কী স্যার? কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেননি?

আমেরিকা আবার আবিষ্কার করার কী আছে? আমেরিকা বলে দেশটা তো ছিলই। সেখানে অন্তত তিরিশ হাজার মানুষ থাকত। ইনকা, আজটেকের মতো উন্নত সভ্যতা ছিল সেখানে। শুধু তাই নয়, ভাইকিংরা… মানে যারা ইউরোপের উত্তর দিকে থাকত… প্রকাণ্ড প্ৰকাণ্ড চেহারা… জলদস্য হিসেবে যাদের খুব বদনাম ছিল… তারাও কলম্বাসের আগে আমেরিকা গিয়েছিল। কলম্বাসকে অকারণে হিরো করা হয়েছে। যাই হোক, ওই মো-ই-টং ছিলেন জেং-এর সঙ্গী। ম্যাপ আঁকার কাজে দারুণ তুখোড় ছিলেন মো। তিনি দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে আস্ত একখানা ম্যাপ বানিয়ে ফেলেছিলেন পৃথিবীর। অবশ্য ফু শাংয়ের বানানো মানচিত্র তাঁকে হেল্প করেছিল।

ফু শাং নামটা শুনেছি না? টুপুর কুশলের দিকে তাকাল, মেইলি বলছিল না?

হ্যাঁ তো। কুশল ঢকঢক ঘাড় নাড়ল। শিবতোষবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ফু শাং কে স্যার?

তিনিও এক জলের পোকা। তিনি সমুদ্রে চক্কর খেয়েছিলেন সপ্তম শতাব্দীতে। চিনে ফু শাংকে একজন প্রাবদপুরুষ বলে মানা হয়।

টুপুর বলল, বেশ তো, এসব নয় বুঝলাম। কিন্তু ম্যাপটা আমাদের দেশে এল কীভাবে?

বলা খুব কঠিন। ইন ফ্যাক্ট, ম্যাপটা তো থাকারই কথা নয়।

কেন?

সে আর-এক ইতিহাস। ষষ্ঠ বার সমুদ্র অভিযান শেষ করে জেং যখন দেশে ফিরলেন, তখন রাজা ইয়ং লো মারা গিয়েছেন। নতুন রাজা হয়েছেন হুং শি। তিনি সিংহাসনে বসার পর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। হঠাৎ একদিন বাজ পড়ে রাজপ্রাসাদ চৌচির। রাজার মন্ত্রণাদারা তখন রাজামশাইকে বোঝাল, ওই সমুদ্র অভিযানই নাকি যত নষ্টের গোড়া। ওই জন্যই নাকি বজ্রের দেবতা কুপিত। হয়েছেন। ব্যস, যায় কোথায়, অমনই রাজা জেংয়ের উপর চটে। লাল। ফের সমুদ্রে যাওয়া তো বন্ধ হই, জেংয়ের কাছ থেকে সব কাগজপত্ৰ, নথিটথি, কেড়ে নিয়ে রাজামশাই জ্বালিয়ে দিলেন। ওই ম্যাপটাও তখনই পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে মো ছিলেন ধুরন্ধর, বিপদের গন্ধ পেয়ে আগে ভাগে সরিয়ে ফেলেছিলেন ম্যাপটা। তারপর থেকে ওটা লুকোনোই ছিল। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর ওই মোর বংশধররাই ম্যাপটার গোটা চার-পাঁচ কপি করান। যাতে ভবিষ্যতে মানচিত্রটা নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। সম্ভবত ঝিয়েনের কেনা মানচিত্ৰখানা ওই কপিগুলোরই একটা।

শিবতোষবাবু থামলেন। মিতিন নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল, হঠাৎই তার স্বর ফুটেছে, হুঁ, এটা খুবই সম্ভব। মোটামুটি ওই সময় থেকেই তো বেঙ্গলে চিনারা আসতে আরম্ভ করে। তাদের কেউই হয়তো নিয়ে এসেছিল ম্যাপখানা।

হয়তো নয়, তাই হয়েছে। শিবতোষবাবু দৃঢ় স্বরে বললেন, ঝিয়েন আমাকে জিনিসটার যা বর্ণনা দিয়েছিল..

কথায় ব্যাঘাত ঘটল। শিবতোষবাবুর স্ত্রী এসেছেন দরজায়। বললেন, গ্যারাজের লোক অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। গাড়ি রঙের কাজ শেষ। পেমেন্ট দিতে হবে।

শিবতোষ সামান্য অসন্তুষ্ট মুখে বললেন, তুমিই চেক কেটে দাও না।

রং-টা একবার দেখে নেবে না?

দরকার নেই। তুমি তো দেখেছ।

স্ত্রী দরজা থেকে সরে যেতেই আবার সৌম্য ভাব ফুটেছে শিবতোষবাবুর মুখে। হাসিহাসি মুখে টুপুরদের বললেন, তোমাদের একটা ভাল হিস্ট্রির ক্লাস হয়ে গেল, কী বলে?

কুশলের ঘাড় পেন্ডুলামের মতো দুলছে, সে তো বটেই।

মিতিন বলল, তা হলে স্যার, বোঝা যাচ্ছে, ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা ছিল খুবই মূল্যবান। যার জন্য একটা মানুষ খুনও হয়ে যেতে পারেন?

অবশ্যই। জিনিসটার দাম টাকায় মাপা যাবে না। বলেই শিবতোষবাবুর চোখ পিটপিট, হঠাৎ খুনের কথা বললেন কেন? তবে কি ঝিয়েনের মৃত্যুটা..?

হ্যাঁ স্যার। মিস্টার ঝিয়েনকে মেরে ফেলা হয়েছে।

ও নো। শিবতোষবাবুদুহাতে মুখ ঢাকলেন। মিনিটখানেক পর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছেন। বিড়বিড় করে বললেন, আমার বোঝা উচিত ছিল… আমার বোঝা উচিত ছিল। জিনিসটা যখন উধাও হয়েছে, তখনই তো..

শিবতোষের স্বর আটকে গেল। গোটা ঘর নিঝুম, মাথার উপর ফ্যান ঘোরার আওয়াজটাই যা শোনা যাচ্ছে শুধু।

মিতিন নীরবতা ভাঙল, ভেঙে পড়বেন না স্যার। যা ঘটার তা তো ঘটেই গিয়েছে। এখন আপনাকে শক্ত হতে হবে। নিশ্চয়ই আপনি চান কালপ্রিট ধরা পড়ুক।

শিবতোষবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বেচারা ঝিয়েন। পুয়োর সোল।

আরও একটা-দুটো প্রশ্ন করি স্যার? আপনার সঙ্গে মিস্টার ঝিয়েনের লাস্ট কবে দেখা হয়েছিল?

অ্যাকসিডেন্টের আগের দিনই।

কোথায়?

ইউনিভার্সিটিতে। আমার রুমে। ও তো ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আসতই, তখন উলটো দিকে আমাদের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টেও একবার ঢুঁ মেরে যেত। …সেদিন ঝিয়েন অসম্ভব এক্সাইটেড ছিল। বলছিল, সোমবার দিনই আমাকে জিনিসটা দেখিয়ে যাবে।

কত টাকায় জিনিসটা উনি কিনেছিলেন, আপনি জানেন?

এগজাক্ট অ্যামাউন্ট বলতে পারব না। তবে ও বলেছিল, জলের দরে।

আর-একটা প্রশ্ন। ডক্টর বাসব সমাদ্দার… ডক্টর তরুণ বসু… এঁদের তো আপনি চেনেনই। এঁরা মানুষ হিসেবে কেমন?

শিবতোষবাবুর চোখ সরু হল, ঠিক কী জানতে চাইছেন বলুন তো?

তা হলে স্পষ্ট করেই বলি। আপনার কি মনে হয়, এই মহামূল্যবান জিনিসটার জন্য এঁরা কেউ… কোনও ভাবে… মিস্টার ঝিয়েনকে…?

কী যে বলেন আপনি! তা হলে তো আমাকেও সন্দেহ করতে হয়।

ধরুন করছি, মিতিন হাসল, এবার বলুন।

দেখুন, এঁরা দুজনেই বিদ্বান মানুষ। ইতিহাসবিদ হিসেবে এঁদের নামও আছে। এঁদের মধ্যে তরুণ খুব মেথডিক্যাল, অ্যাম্বিশাস…

আর বাসববাবু?

আই ওন্ট কমেন্ট।

কেন?

উনি একটু পিকিউলিয়ার। মাঝে মাঝেই উলটোপালটা কাণ্ডকারখানা করে বসেন। এই কেসের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, তবু বলি…উনি একবার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বইয়ের পাতা কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, ব্যাপারটা থানা-পুলিশ অবধি গড়িয়েছিল।

লাস্ট কোয়েশ্চেন …মিস্টার ঝিয়েন হঠাৎ প্রিন্সেপ ঘাটে কেন গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কোনও আইডিয়া করতে পারেন?

শিবতোষ রায় স্থির চোখে তাকালেন, না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *