Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পলতার বাগান

পলতার বাগান মনে প’ড়ে দুঃখও পাচ্ছি আনন্দও পাচ্ছি। কতই বা বয়েস তখন আমার। বেশ চলছিল, হঠাৎ একদিন সব বন্ধ হয়ে গেল, ঘরে ঘরে তালা পড়ল। বড়পিসেমশায় ছোটপিসেমশায় আমাদের সবাইকে নিয়ে বোটে রওনা হলেন। দারুণ ঝড়, নৌকো এ-পাশ ও-পাশ টলে, ডোবে বুঝি বা এইবারে। বড়পিসিমা ছোটপিসিমা আমাদের বুকে আঁকড়ে নিয়ে ডাকতে লাগলেন, ‘হে হরি, হে হরি!’ এলুম আবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। দোতলার নাচঘরে ছিল জ্যেঠামশায়ের বড় একখানি অয়েলপেন্টিং, বসে আছেন সামনের দিকে চেয়ে। ছোটপিসিমা বড়পিসিমা আছড়ে পড়লেন সেই ছবির সামনে, ‘দাদা, এ কী হয়ে গেল আমাদের!’

অদ্ভুত কাণ্ড। যেন চলতে চলতে হঠাৎ সামনে একটা দেয়াল পড়ে গেল; সব কিছু থেমে গেল, ঘড়িটা পর্যন্ত। বড় হয়ে যখন গেলুম পলতার বাগানে, দেখি, বাবার সেই শোবার ঘর ঠিক তেমনি সাজানো আছে, একটু নড়চড় নেই—দেয়ালে ঘড়িটি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় স্থির, বাবামশায়ের মৃত্যুর সময়টি তখনও ধরে রেখেছে। ঘরজোড়া মেঝেতে সাদা গালচে, তার নকশাটা যেন পাথরের চাতালে ফুলপাতা হওয়ায় খসে পড়েছে। দেয়ালে বেলোয়ারি কাচে রঙিন সব ফুলের মালা, বাতিনেবা গোলাপি রঙের ফটিকের ঝাড়, দেয়ালগিরি, পর্দা, সবই যেন তখনও একটা মহা আনন্দ-উৎসব হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ার ম্লান বিশৃঙ্খল রূপ ধরে রয়েছে। মা সেখানকার কোনো জিনিস আনতে দেননি। কিন্তু সেই ঘড়িটি সেবারে আমি নিয়ে আসি, এখনও আছে বেলঘরিয়ার বাড়িতে। আশ্চর্য ঘড়ি—কেমন আপনি বন্ধ হয়ে যায়। সেদিনও বন্ধ হয়ে গেল অলকের মা যেদিন চলে গেলেন, ঠিক জায়গায় কাঁটার দাগ টেনে। অলকরা চাবি ঘোরায় ঘড়ি চলে না। অলককে বললুম, ‘ও ঘড়ি তোরা ছুঁসনে, তোদের হাতে বিগড়ে যাবে। আমার সঙ্গে ওর অনেক কালের ভাব। আমি জানি ওর হাড়হদ্দ; আমার কাছে দে দেখি নামিয়ে।’ ঘড়িটি নামিয়ে এনে দিলে কাছে। আমি তাতে হাত দেবা মাত্র ঘড়ি নতুন করে আবার চলতে লাগল। বহুকালের জিনিস, অনেক মৃত্যুর সময় রেখেছে এ-ঘড়ি। মাসির গল্পে পড়নি এ-ঘড়ির কথা? দিয়েছি গল্পে ঢুকিয়ে। এখন আমার হয়েছে ওই—গল্পের মধ্যে ধরে রাখছি আমার আগের জীবন আর আজকের জীবনেরও কথা।

একটি ভাই ছিল আমার—সকলের ছোট, দেখতে রোগা টিংটিঙে, বড় মায়াবী মুখখানি। আমরা ছিলুম তার কাছে পালোয়ান। একটু হুমকি দিলেই ভয়ে কেঁদে ফেলত। বাবামশায় খুব ভালবাসতেন তাকে, আদর করে ডাকতেন ‘র‍্যাট’। তার জন্য আসত আলাদা চকোলেট লজেঞ্জুস বাবামশায় নিজের হাতে তাকে খাওয়াতেন। মা এক-এক সময়ে বলতেন, এত লজেঞ্জুস খাইয়েই এর রোগ সারে না। বাবামশায়ের ‘র‍্যাট’ ছিল তার গোলাপি হরিণেরই সামিল, এত আদরযত্ন। হরিণেরই মত সুন্দর চোখ দুটাে ছিল তার।

এখন, সেই ভাই মারা যেতে বাবামশায়ের মন গেল ভেঙে। বললেন, ‘এই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আর থাকব না। পলতায় তখন সবে বাগান কিনেছেন, সবাইকে নিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে উঠলেন গিয়ে সেখানে। চারিদিকে ঝোপঝাড়, মাঝে বিরাট একটা ভাঙা বাড়ি—এ-দেয়াল সে-দেয়াল বেয়ে জল প’ড়ে ছ্যাতলা ধরে গেছে। বড়পিসিমা বললেন, ‘ও গুনু, এ কোথায় নিয়ে এলি? এখানে থাকব কি করে?’ বাবামশায় বললেন, ‘এই দেখোনা দিদি, কদিনেই সব করে ঠিক ফেলছি।’ মাঝে ছিল দুখানি বড় হল, পাশে ছোটবড় নানা আকারের ঘর, ওরই মধ্যে যে কয়টি বাসযোগ্য ঘর পেলেন তাতেই পিসিমারা সব গুছিয়ে নিয়ে বসলেন। এদিকে লোক লেগে গেল চারদিক মেরামত করতে। বাবামশায়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিল অক্ষয় সাহা। বাবামশায় নিজের হাতে প্ল্যান করে করে অক্ষয় সাহার হাতে দেন, তিনি আবার প্ল্যান দেখে দেখে তা তৈরি করান। সেই খাতাটি আমি রেখে দিয়েছি, পলতার বাগানের প্ল্যান তাতে ধরা আছে।

দেখতে দেখতে সমস্ত বাগানের চেহারা গেল ফিরে ফোয়ারা বসল, ফটক তৈরি হল, লাল রাস্তা এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়ল। বন হয়ে উঠল উপবন। পুরনো যে বাড়িটা ছিল সেটা হল বৈঠকখানা। সেখান থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে অন্দরমহল উঠল। বৈঠকখানা থেকে বেরিয়েই একটি তারের গাছঘর—নানারকম গাছ, অরকিড ফুল, তারই মাঝে নানাজাতের পাখি ঝুলছে। সেখান থেকে লাল রাস্তাটি, খানিকটা এগিয়ে ফোয়ারা বসানো হয়েছে মাঝখানে, তা ঘিরে চলে গেছে একেবারে অন্দরমহলে। বাবামশায় বিকেল হলে মাঝে মাঝে এসে বসেন ফোয়ারার ধারে। ফেয়ারাটির মাঝে একটি কচি ছেলের ধাতুমূর্তি আকাশের দিকে হাত তুলে, উঁচু হয়ে ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে, আশেপাশে পাখিরা গাইছে, ফুলের সুবাস ভেসে আসছে; তারই মাঝে বাবামশায় বসে। মস্ত বড় একটা বিল তৈরি হল একপাশে। যখন কাটা হত দেখতুম মাঝে মাঝে মাটির স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে পর পর। শ’য়ে শ’য়ে লোক মাটি কাটছে, ঝুড়িতে করে এনে ফেলছে পাড়ে। সেই ঝিল একদিন ভরে উঠল তলা থেকে ওঠা নতুন জলের লহরে। দলে দলে হাঁস চরে বেড়ায়। ঝিলের এক পারে প্রকাণ্ড একটি বটগাছ, তলায় সারস সারসী, ময়ূর ময়ূরী, রুপোলি সোনালি মরাল দলে দলে খেলা করে। তার ওদিকে হরিণবাগান; পালে পালে হরিণ একদিক থেকে আর একদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার ও-দিকে মাঠভরা ভেড়ার পাল; তার পর গেল গোরু, মোষ, ঘোড়া, তার পর হল শাকসবজি তরিতরকারি নানা ফসলের খেত। এই গেল একদিকের কথা। আর একদিকে ফুলের বাগান, বাগানে সুন্দর সুন্দর খাঁচা। সে কি খাঁচা যেন এক-একটি মন্দির; সোনালি রঙ, তাতে নানা জাতের রঙবেরঙের পাখি, দেশবিদেশ থেকে আনানো, বাবামশায়ের বড় শখের। বাগানের পরে খেলার মাঠ। তার পর আম কাঁঠাল লিচু পেয়ারার বন; তার পর আরো কত কি, মনেও নেই সব। বাগান তো নয়, একটা তল্লাট। ফ্রেঞ্চ টেরিটরি থেকে আরম্ভ করে বদ্দিবাটির মিলের ঘাট অবধি ছিল সেই বাগানের দৌড়।

সেই তল্লাট দু-মাসের মধ্যেই বাবামশায় সাজিয়ে ফেললেন। অনেক মূর্তির ফরমাশ হল বিলেতে। একটা ব্রোঞ্জের ফোয়ারার অর্ডার দিলেন, পছন্দমত নিজের হাতে এঁকে। পুকুরপাড়ে বোধ হয় বসাবার ইচ্ছে ছিল। ফোয়ারাটি যেন একগোছা ঘাস; তেমনি রঙ, দূর থেকে দেখলে সত্যিকারের ঘাস বলেই ভ্রম হয়। তখনকার দিনে ইণ্ডিয়ান আর্ট বলে তো কিছু ছিল না, বিলিতি আর্টেরই আদর হত সবখানে। পরে আমরা দেখি টি. টমসনের দোকানে বিলেত থেকে তৈরি হয়ে এসেছে সেই ফোয়ারা আর দুটি মানুষপ্রমাণ ক্রীতদাসীর ধাতুমূর্তি বাবামশায়ের ফরমাশি জিনিস। ইন্টারন্যাশন্যাল একজিবিশন হয়, সেখানে তা সাজানো হল। প্রত্যেকটি ঘাসের মুখ দিয়ে ফোয়ারা ছুটছে তালগাছ সমান উঁচু হয়ে। ছ হাজার টাকা শুধু সেই ফোয়ারাটির দাম। সেই একজিবিশন থেকে ফোয়ারাটি মূর্তিটি কোন দেশের এক রাজা কিনে নিলেন। ভালো ভালো ফুলদানি, কাচের ফুলের তোড়া, দেখলে তাক লাগে। জ্যেঠামশায় এলেন পলতার বাগানে; বাবামশায় ঘুরে ঘুরে তাকে সব দেখাতে লাগলেন। দেখতে দেখতে বাবামশায়ের ঘরে এলেন। সেই ঘরে ঢুকে জ্যেঠামশায় বললেন, ‘বাঃ গুনু, তোমার মালী তো চমৎকার তোড়া বেঁধেছে। যাবার সময়ে আমাকে এমনি একটি তোড়া বেঁধে দিতে বোলো।’ বাবামশায় বললেন, ‘এ কাচের ফুল, বড়দা তুমি বুঝতে পারনি?’ জ্যেঠামশায়ের তখন হো-হো করে হাসি, ‘আমি আচ্ছা ঠকেছি তো। একটুও বুঝতে পারিনি।’

বাবামশায় প্রায়ই কলকাতায় যেতেন, নানারকম জিনিসপত্তর কিনে নিয়ে আসতেন। একদিন এলেন, একঝাঁক হাঁস নিয়ে, ঠিক যেন চিনেমাটির খেলনার হাঁস; মুঠোর মধ্যে তা পোরা যায়, সাদা ধবধব করছে। সেই হাঁসগুলি নিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়ালেন ঝিলে; খেলা করতে থাকবে, সেইখানেই বাসা বাঁধবে, বাচ্চ পাড়বে জলের কিনারায় ঘাসের ঝোপে। পরদিন ভোরে গেছেন হাঁসগুলিকে খাওয়াতে ; দেখেন একটি হাঁসও বেঁচে নেই, ঝিলের জলে রাশ রাশ সাদা সাদা পালক ছেঁড়া পদ্মের পাপড়ির মত ভাসছে। ছোটপিসিমা বললেন, ‘তোর যেমন কাণ্ড, অতটুকু-টুকু হাঁসগুলোকে এমনি ছেড়ে রাখে? রাতারাতি শেয়ালে সব খেয়ে গেছে।’

আর একবার মনে আছে, বাবামশায় বসে আছেন ফোয়ারার ধারে। অন্দরমহলের সামনে বড় বড় প্যাকিং বাক্স এসেছে, চাকররা খুলছে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে। প্রায়ই নানা জায়গা থেকে এইরকম প্যাকিং বাক্স আসে বাবামশায়ের ফরমাশি জিনিসে ভরা। তিনি কাছে বসে চাকরদের দিয়ে তা খোলান; আমার খুব ভালো লাগে দেখতে কী বের হয় বাক্সগুলো থেকে। চাকরদাসীদের এড়িয়ে কখনও কখনও সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। তা সেদিন বের হল বাক্স থেকে দুটি কাচের ফুলদানি, একটি গোলাপি ডাটার উপর টিউলিপফুল, ফুলে শিশির পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা, দুপাশে দুটি সোনালি পাতা উঠে দু দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মার চুল বাঁধবার গোল একটি আয়না ছিল, পরে মা সেটি অলকের মাকে দিয়ে দেন। তিনি যতদিন ছিলেন তাতেই মুখ দেখেছেন। এখন সেই আয়নার যা দুর্দশা; আমার ঘরে এনে রেখে দিয়েছে, তার সামনে চুল আঁচড়াতে যাই, কেমন করে ওঠে মন। বলি, ‘আর কেন, নিয়ে যা একে এ ঘর থেকে।’ সেই আয়নার সামনে থাকত টিউলিপফুলের ফুলদানিটি, বরাবর দেখেছি তা। মাঝে একবার এক চাকর সেটি বাজারে নিয়ে গেছে বিক্রি করতে। আর-একটি চাকর খোঁজ পেয়ে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে আনে। আমি বললুম ‘ও পারুল, এটা যত্নে তুলে রাখে। এ কি জিনিস, তা তোমরা বুঝবে না, মা চুল বাঁধতে বসতেন, টিউলিপফুলের ছায়া আর মার মুখের ছায়া এই দুটি ছায়া পড়ত আয়নাতে। এখনও যেন দেখতে পাই সেই ছবি। সোনালি পাতা দুটি এখনও তেমনি ঝকঝক করছে। আমার বাল্যস্মৃতিতে এই টিউলিপফুল ও আয়নার কাহিনী আরো স্পষ্ট লেখা আছে। আর অন্য ফুলদানিটি ছিল, ক্র্যাক্ড চায়না, সবুজ রং, তার গায়ে হাতে আঁকা নীল হলুদ দুটি পাখি আর লতাপাতা কয়েকটি। ভারি সুন্দর সেই ফুলদানিটি থাকত বাবামশায়ের আয়নার টেবিলে। সেটি গেল শেষটায় বউবাজারে, কি হল কে জানে!

বাবামশায় তো এমনি করে বাগানবাড়ি ঘর সাজাচ্ছেন। আমরা ছোট, কিছু তেমন জানিনে বুঝিনে। থাকতুম অন্দরমহলে। মাঝে মাঝে ঈশ্বরবাবু বেড়াতে নিয়ে যেতেন গঙ্গার ধারে বিকেলের দিকে। রাস্তাঘাট তখন ছিল না তেমন। এখানে ওখানে মড়ার মাথার খুলি। চলতে চলতে থমকে দাড়াই। ঈশ্বরবাবু বলেন, ‘ছুঁয়ো-টুয়োনা, ভাই, ও-সব।’ আমরা একটা ডাল বা কঞ্চি নিয়ে খুলিগুলি ঠেলতে ঠেলতে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে বলি, ‘যা, উদ্ধার পেয়ে গেলি।’ ওই ছিল এক খেলা। দু-বেলা হেঁটেই বেড়াতুম।

সেই সময়ে পলতার বাগানে একবার ঠিক হয়, দাদা বিলেতে যাবেন। সাজপোশাক সব তৈরি করবার ফরমাশ গেল কলকাতায় সাহেব দরজির দোকানে। বাবামশায় বললেন, ‘মেজদা আছেন বিলেতে, গগন বিলেত যাক। সতীশ আছে জর্মনিতে, সমর সেখানে যাবে।’ আমাকে দেখিয়ে, বড়পিসিমাকে বললেন, ‘ও থাকুক এখানেই। আমার সঙ্গে ঘুরবে, ইণ্ডিয়া দেখবে, জানবে।’ তখন থেকেই সকলে আমার বিদ্যেবুদ্ধির আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, ওসব আমার হবে না। বিদেশ তো যাওয়াই হল না, এদেশেও আর বাবামশায়ের সঙ্গে ঘোরা হয়নি। তবে বাবামশায় যে বলেছিলেন ‘ইণ্ডিয়া দেখবে জানবে’, তা হয়েছে। ভারতবর্ষের যা দেখেছি চিনেছি তিনি থাকলে খুশি হতেন দেখে।

পলতার বাগানে মাস ছয়েক কেটেছে; বাগান সাজানো হয়েছে। বিনয়িনীর বিয়ের ঠিকঠাক, এবারে জামাইষষ্ঠীর দিন পাত্র দেখা হবে। বাবামশায়ের ইচ্ছে হল বন্ধুবান্ধব সবাইকে বাগানে ডেকে পার্টি দেবেন। আয়োজন শুরু হল, যেখানে যত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সাহেবসুবো, কেউই বাদ রইল না। কেবল আসতে পারেননি একজন, বলাই সিংহ, বাবামশায়ের ক্লাসফ্রেণ্ড। শেষ বয়েস অবধি তিনি যখনই আসতেন, দুঃখ করতেন, বলতেন, ‘কেন গেলুম না আমি। শেষ দেখা দেখলুম না।’ যাক সে কথা। এখন বিরাট আয়োজন হল। এত লোক আসবে দু-তিন দিন থাকবে বুঝতেই পার ব্যাপার। দিকে দিকে তাঁবু পড়ল। কেক-মিষ্টান্নে, ফুলে-ফলে, আতর-গোলাপে ভরে গেল চারদিক। নাচগানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা ঘোরাঘুরি করছি অন্দর-মহলে। বাবুর্চি-খানসামা টেবিল ভরে স্যাণ্ডউইচ আইসক্রিম সাজাচ্ছে। ছেলেমানুষ খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারিনে। ঘুরে ফিরেই সেখানে যাই। নবীন বাবুর্চি এটা সেটা হাতে তুলে দেয়, বলে, ‘যাও যাও, এখান থেকে সরে পড়।’ চলে আসি, আবার যাই। এমনি করে আমাদের সময় কাটছে। ওদিকে বৈঠকখানায় শুরু হয়েছে পার্টি, নাচ, গান। রবিকা, জ্যেঠামশায় ওঁরাও ছিলেন; রবিকার গান হয়েছিল। প্রথম দিন দেশি রকমের পার্টি হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন হল সাহেবসুবোদের নিয়ে ডিনার পার্টি। আমাদের নীলমাধব ডাক্তারের ছেলে বিলেতফেরত ব্যারিস্টার নন্দ হালদার সাহেব টোস্ট প্রস্তাবের পর গ্লাস শেষ করে বিলিতি কায়দামাফিক পিছন দিকে গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। অমনি সকলেই আরম্ভ করে দিলেন গ্লাস ছুঁড়ে ফেলতে। একবার করে গ্লাস শেষ হয় আর তা পিছনে ছুঁড়ে ফেলছেন ঝন্‌ন্‌ন্‌ শব্দে চারদিক মুখরিত করে। মনে আছে, খানসামারা যখন লাইন করে করে সাজাচ্ছিল কাচের গ্লাস—গোলাপি আভা, খুব দামি। পরদিন সকালে যখন ঝাটপাট শুরু হল গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে গোলাপি কাচের টুকরো স্তূপাকার হয়ে বাইরে চলে গেল। দু-তিনদিন পরে পার্টি শেষ হল, বাবামশায় নিজে দাঁড়িয়ে সকলের খোঁজখবর নিয়ে সব ব্যবস্থা করে অতিথি-অভ্যাগত আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলকে হাসিমুখে বিদায় দিলেন। অন্দর-মহলে মা পিসিমা ব্যস্ত আছেন জামাইষষ্টীর তত্ত্ব পাঠাতে।

এমন সময়ে খবর হল বাবামশায়ের অসুখ। এত হৈ-চৈ হতে হতে কেমন একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ছায়া পড়ল সবার মুখে চোখে চলায় বলায়। পিসেমশাইরা ছুটলেন ওষুধ আনতে, ডাক্তার ডাকতে; নীলমাধববাবু হাঁকছেন, ‘বরফ আন্‌, বরফ আন্‌।’ দাসদাসীরা গুজগুজ ফিসফাস করছে এখানে ওখানে। জ্যৈষ্ঠ মাস, ঝড়ের মেঘ উঠল কালো হয়ে, শোঁ-শোঁ বাতাস বইল। ভোরের বেলা পিসীরা আমাদের ঠেলে তুলে দিলে, ‘যা শেষ দেখা দেখে আয়।’ নিয়ে গেল আমাদের বাবামশায়ের ঘরে। বিছানায় তিনি ছট্‌ফট্‌ করছেন। পাশ থেকে কে একজন বললেন, ‘ছেলেদের দেখতে চেয়েছিলে। ছেলেরা এসেছে দেখ।’ শুনে বাবামশায় ঘাড় একটু তুলে একবার তাকালেন আমাদের দিকে, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাথা কাত হয়ে পড়ল বালিশে । বড়পিসিমা ছোটপিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এ কি, এ কি হল! কাল-জ্যৈষ্ঠ এল রে কাল-জ্যৈষ্ঠ।’

সেইদিন থেকে ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *