সন্দীপের আত্মকথা
আমি নিজের লেখা আত্মকাহিনী যখন পড়ে দেখি তখন ভাবি, এই কী সন্দীপ! আমি কি কথা দিয়ে তৈরি! আমি কি রক্তমাংসের মলাটে মােড়া একখানা বই!
পৃথিবী চাঁদের মতাে মরা জিনিস নয়, সে নিশ্বাস ফেলছে, তার সমস্ত নদী সমুদ্র থেকে বাষ্প উঠছে— সেই বাষ্পে সে ঘেরা। তার চতুর্দিকে ধুলাে উড়ছে, সেই ধুলাের ওড়নায় সে ঢাকা। বাইরে থেকে যে দর্শক এই পৃথিবীটাকে দেখবে, এই বাষ্প আর ধুলাের উপর থেকে প্রতিফলিত আলােই কেবল সে দেখতে পাবে। সে কি এর দেশ-মহাদেশের স্পষ্ট সন্ধান পাবে?
এই পৃথিবীর মতাে যে মানুষ সজীব তার অন্তর থেকে কেবলই আইডিয়ার নিশ্বাস উঠছে, এইজন্যে বাষ্পে সে অস্পষ্ট; যেখানে তার ভিতরে জলস্থল, যেখানে সে বিচিত্র, সেখানে তাকে দেখা যায় না। মনে হয়, সে যেন আলােছায়ার একটা মণ্ডল।
আমার বােধ হচ্ছে, যেন সজীব গ্রহের মতাে আমি আমার সেই আইডিয়ার মণ্ডলটাকেই আঁকছি। কিন্তু আমি যা চাই, যা ভাবি, যা সিদ্ধান্ত করছি, আমি যে আগাগােড়া কেবল তাইই তা তাে নয়। আমি যা ভালােবাসি নে, যা ইচ্ছে করি নে, আমি যে তাও। আমার জন্মাবার আগেই যে আমার সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমি তাে নিজেকে বেছে নিতে পারি নি, হাতে যা পেয়েছি তাকে নিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে।
এ কথা আমি বেশ জানি, যে বড়াে সে নিষ্ঠুর। সর্বসাধারণের জন্যে ন্যায়, আর অসাধারণের জন্যে অন্যায়। মাটির তলাটা আগাগােড়া সমান— আগ্নেয় পর্বত তাকে আগুনের শিঙের ভয়ংকর গুঁতাে মেরে তবে উঁচু হয়ে ওঠে। সে চার দিকের প্রতি ন্যায়বিচার করে না, তার বিচার নিজের প্রতিই। সফল অন্যায়পরতা এবং অকৃত্রিম নিষ্ঠুরতার জোরেই মানুষ বলো, জাত বলাে, এ পর্যন্ত লক্ষপতি মহীপতি হয়ে উঠেছে। ১-কে দিব্যি চোখ বুজে গিলে খেয়ে তবেই ২ দুই হয়ে উঠতে পারে; নইলে ১-এর সমতল লাইন একটানা হয়ে চলত।
আমি তাই অন্যায়ের তপস্যাকে প্রচার করি। আমি সকলকে বলি, অন্যায়ই মােক্ষ, অন্যায়ই বহ্নিশিখা; সে যখনই দগ্ধ না করে তখনই ছাই হয়ে যায়। যখনই কোনাে জাত বা মানুষ অন্যায় করতে সক্ষম হয় তখনই পৃথিবীর ভাঙা কুলােয় তার গতি।
কিন্তু তবু এ আমার আইডিয়া, এ পুরােপুরি আমি নয়। যতই অন্যায়ের বড়াই করিনা কেন, আইডিয়ার উড়ুনির মধ্যে ফুটো আছে, ফাঁক আছে, তার ভিতর থেকে একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ে সে নেহাত কাঁচা— অতি নরম। তার কারণ, আমার অধিকাংশ আমার পূর্বেই তৈরি হয়ে গেছে।
আমার চেলাদের নিয়ে আমি মাঝে মাঝে নিষ্ঠুরের পরীক্ষা করি। একদিন বাগানে চড়িভাতি করতে গিয়েছিলাম। একটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছিল; আমি সবাইকে বললুম, কে ওর পিছনের একখানা পা এই দা দিয়ে কেটে আনতে পারে? সকলেই যখন ইতস্তত করছিল, আমি নিজে গিয়ে কেটে নিয়ে এলুম। আমাদের দলের মধ্যে সকলের চেয়ে যে লােক নিষ্ঠুর সে এই দৃশ্য দেখে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল। আমার শান্ত অবিচলিত মুখ দেখে সকলেই নির্বিকার মহাপুরুষ বলে আমার পায়ের ধুলাে নিলে। অর্থাৎ, সেদিন সকলেই আমার আইডিয়ার বাষ্পমণ্ডলটাই দেখলে। কিন্তু যেখানে আমি নিজের দোষে না ভাগ্যদোষে, দুর্বল, সকরুণ— যেখানে ভিতরে ভিতরে বুক ফাটছিল, সেখানে আমাকে ঢাকা দেওয়াই ভালাে।
বিমল-নিখিলকে নিয়ে আমার জীবনের এই-যে একটা অধ্যায় জমে উঠেছে। এর ভিতরেও অনেকটা কথা ঢাকা পড়ছে। ঢাকা পড়ত না যদি আমার মধ্যে আইডিয়ার কোনাে বালাই না থাকত। আমার আইডিয়া আমার জীবনটাকে নিয়ে আপনার মতলবে গড়ছে। কিন্তু সেই মতলবের বাইরেও অনেকখানি জীবন বাকি পড়ে থাকছে। সেইটের সঙ্গে আমার মতলবের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল থাকে না; এইজন্যে তাকে চেপেচুপে ঢেকেঢুকে রাখতে চাই, নইলে সমস্তটাকে সে মাটি করে দেয়।
প্রাণ জিনিসটা অস্পষ্ট, সে যে কত বিরুদ্ধতার সমষ্টি তার ঠিক নেই। আমরা আইডিয়াওয়ালা মানুষ তাকে একটা বিশেষ ছাঁচে ঢেলে একটা কোনাে বিশেষ আকারে সুস্পষ্ট করে জানতে চাই। সেই জীবনের সুস্পষ্টতাই জীবনের সফলতা। দ্বিগ্বিজয়ী সেকন্দর থেকে শুরু করে আজকের দিনের আমেরিকার ক্রোড়পতি রক্ফেলার পর্যন্ত সকলেই নিজেকে তলােয়ারের কিংবা টাকার বিশেষ একটা ছাঁচে ঢেলে জমিয়ে দেখতে পেরেছে বলেই নিজেকে সফল করে জেনেছে।
এইখানেই আমাদের নিখিলের সঙ্গে আমার তর্ক বাধে। আমিও বলি, আপনাকে জানাে। সেও বলে, আপনাকে জানাে। কিন্তু, সে যা বলে তাতে দাঁড়ায় এই, আপনাকে না-জানাটাই হচ্ছে জানা। সে বলে, তুমি যাকে ফল পাওয়া বলো সে হচ্ছে আপনাকে বাদ দিয়ে ফলটুকুকে পাওয়া। ফলের চেয়ে আত্মা বড়াে।
আমি বললুম, কথাটা নেহাত ঝাপসা হল।
নিখিল বললে, উপায় নেই। প্রাণটা কলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই বলে প্রাণটাকে কল বলে সােজা করে জানলেই যে প্রাণটাকে জানা হয় তা নয়। তেমনি আত্মা ফলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই আত্মাকে ফলের মধ্যে চরম করে দেখাই যে আত্মাকে সত্য দেখা তা বলব না।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তবে তুমি কোথায় আত্মাকে দেখছ? কোন্ নাকের ডগায়, কোন ভ্রূর মাঝখানে?
সে বললে, আত্মা যেখানে আপনাকে অসীম জানছে, সেখানে ফলকে ছেড়ে এবং ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।
তা হলে নিজের দেশ সম্বন্ধে কী বলবে?
ঐ একই কথা। দেশ যেখানে বলে ‘আমি আমাকেই লক্ষ্য করব’ সেখানে সে ফল পেতে পারে, কিন্তু আত্মাকে হারায়। যেখানে সকলের চেয়ে বড়ােকে সকলের বড়াে করে দেখে সেখানে সকল ফলকেই সে খাওয়াতে পারে, কিন্তু আপনাকে সে পায়।
ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত কোথায় দেখেছ?
মানুষ এত বড়াে যে সে যেমন ফলকে অবজ্ঞা করতে পারে তেমনি দৃষ্টান্তকেও। দৃষ্টান্ত হয়তাে নেই; বীজের ভিতরে ফুলের দৃষ্টান্ত যেমন নেই, কিন্তু ধীজের ভিতরে ফুলের বেদনা আছে। তবু, দৃষ্টান্ত কি একেবারেই নেই? বুদ্ধ বহু শতাব্দী ধরে যে সাধনায় সমস্ত ভারতবর্ষকে জাগিয়ে রেখেছিলেন সে কি ফলের সাধনা?
নিখিলের কথা আমি যে একেবারেই বুঝতে পারি নে তা নয়। কিন্তু সেইটিই হল আমার মুশকিল। ভারতবর্ষে আমার জন্ম, সাত্ত্বিকতার বিষ রক্তের মধ্যে থেকে একেবারে মরতে চায় না। আপনাকে বঞ্চিত করার পথে চলা যে পাগলামি, এ কথা মুখে যতই বলি এটাকে একেবারে উড়িয়ে দেবার সাধ্য নেই। এইজন্যেই আমাদের দেশে আজকাল অদ্ভুত ব্যাপার চলছে। ধর্মের ধুয়াে, দেশের ধুয়াে, দুটিকেই পুরােদমে একসঙ্গে চালাচ্ছি। ভগবদ্গীতা এবং বন্দেমাতরং আমাদের দুইই চাই। তাতে দুটোর কোনােটাই যে স্পষ্ট হতে পারছে না, তাতে একসঙ্গেই গড়ের বাদ্য এবং সানাই বাজানো চলছে, এ আমরা বুঝছি নে। আমার জীবনের কাজ হচ্ছে এই বেসুরাে গােলমালটাকে থামানাে; আমি গড়ের বাদ্যটাকেই বাহাল রাখব, সানাই আমাদের সর্বনাশ করেছে। প্রবৃত্তির যে জয়পতাকা আমাদের হাতে দিয়ে মা প্রকৃতি, মা শক্তি, মা মহামায়া রণক্ষেত্রে আমাদের পাঠিয়েছেন তাকে আমরা লজ্জা দেব না। প্রবৃত্তিই সুন্দর, প্রবৃত্তিই নির্মল, যেমন নির্মল ভূঁইচাপা ফুল, যে কথায় কথায় স্নানের ঘরে ভিনােলিয়া সাবান মাখতে ছােটে না।
একটা প্রশ্ন কদিন ধরে মাথায় ঘুরছে, কেন বিমলের সঙ্গে জীবনটাকে জড়িয়ে ফেলতে দিচ্ছি? আমার জীবনটা তাে ভেসে-যাওয়া কলার ভেলা নয় যে যেখানে-সেখানে ঠেকতে ঠেকতে চলবে।
সেই কথাই তাে বলছিলুম, যে একটিমাত্র আইডিয়ার ছাঁচে জীবনটাকে পরিমিত করতে চাই জীবন তাকে ছাপিয়ে যায়। থেকে থেকে মানুষ ছিটকে ছিটকে পড়ে। এবার আমি যেন বেশি দূরে ছিটকে পড়েছি।
বিমল যে আমার কামনার বিষয় হয়ে উঠেছে সেজন্যে আমার কোনাে মিথ্যে লজ্জা নেই। আমি যে স্পষ্ট দেখছি ও আমাকে চায়। ঐ তাে আমার স্বকীয়া। গাছে ফল বোঁটায় ঝুলে আছে। সেই বোঁটার দাবিকেই চিরকালের বলে মানতে হবে নাকি? ওর যত রস, যত মাধুর্য, সে যে আমার হাতে সম্পূর্ণ খসে পড়বার জন্যেই। সেইখানেই একেবারে আপনাকে ছেড়ে দেওয়াই ওর সার্থকতা; সেই ওর ধর্ম, ওর নীতি। আমি সেইখানেই ওকে পেড়ে আনব, ওকে ব্যর্থ হতে দেব না।
কিন্তু আমার ভাবনা এই যে, আমি জড়িয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে, আমার জীবনে বিমল বিষম একটা দায় হয়ে উঠবে। আমি পৃথিবীতে এসেছি কর্তৃত্ব করতে। আমি লােককে চালনা করব কথায় এবং কাজে। সেই লােকের ভিড়ই আমার যুদ্ধের ঘােড়া। আমার আসন তার পিঠের উপরে, তার রাশ আমার হাতে। তার লক্ষ্য সে জানে না, শুধু আমিই জানি। কাঁটায় তার পায়ে রক্ত পড়বে, কাদায় তার গা ভরে যাবে; তাকে বিচার করতে দেব না— তাকে ছােটাব।
সেই আমার ঘােড়া আজ দরজায় দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছে! তার হ্রেষাধ্বনিতে সমস্ত আকাশ আজ কেঁপে উঠল। কিন্তু আমি করছি কী! দিনের পর দিন আমার কী নিয়ে কাটছে। ও দিকে আমার এমন শুভদিন যে বয়ে গেল!
আমার ধারণা ছিল, আমি ঝড়ের মতাে ছুটে চলতে পারি। ফুল ছিঁড়ে আমি মাটিতে ফেলে দিই, কিন্তু তাতে আমার চলার ব্যাঘাত করে না। কিন্তু, এবার যে আমি ফুলের চার দিকে ফিরে ফিরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি ভ্রমরেরই মতো, ঝড়ের মতো নয়।
তাই তো বলি, নিজের আইডিয়া দিয়ে নিজেকে যে রঙে আঁকি সব জায়গায় সে রঙ তো পাকা হয়ে ধরে না। হঠাৎ দেখতে পাই সেই সামান্য মানুষটাকে। কোনো-এক অন্তর্যামী যদি আমার জীবনবৃত্তান্ত লিখতেন তা হলে নিশ্চয়ই দেখা যেত আমার সঙ্গে আর ঐ পাঁচুর সঙ্গে বেশি তফাত নেই, এমন-কি, ঐ নিখিলেশের সঙ্গে। কাল রাত্রে আমার আত্মকাহিনীর খাতাটা নিয়ে খুলে পড়ছিলুম। তখন সবে বি. এ. পাস করেছি, ফিলজফিতে মগজ ফেটে পড়ছে বললেই হয়। তখন থেকেই পণ করেছিলুম, নিজের হাতে বা পরের হাতে গড়া কোনো মায়াকেই জীবনের মধ্যে স্থান দেব না। জীবনটাকে আগাগোড়া একেবারে নিরেট বাস্তব করে তুলব। কিন্তু তার পর থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত জীবনকাহিনীটাকে কী দেখছি? কোথায় সেই ঠাস বুনোনি? এ যে জালের মতো। সূত্র বরাবর চলেছে, কিন্তু সূত্র যতখানি ফাঁক তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। এই ফাঁকটার সঙ্গে লড়াই করে করে একে সম্পূর্ণ হার মানানো গেল না। কিছুদিন বেশ একটু নিশ্চিন্ত হয়ে জোরের সঙ্গেই চলছিলুম; আজ দেখি আবার একটা মস্ত ফাঁক।
আজ দেখি, মনের মধ্যে ব্যথা লাগছে। ‘আমি চাই, হাতের কাছে এসেছে, ছিঁড়ে নেব’— এ হল খুব স্পষ্ট কথা, খুব সংক্ষেপ রাস্তা। এই রাস্তায় যারা জোরের সঙ্গে চলতে পারে তারাই সিদ্ধিলাভ করে, এই কথা আমি চিরদিন বলে আসছি। কিন্তু ইন্দ্রদেব এই তপস্যাকে সহজ করতে দিলেন না, তিনি কোথা থেকে বেদনার অপ্সরীকে পাঠিয়ে দিয়ে সাধকের দৃষ্টিকে বাষ্পজালে অস্পষ্ট করে দেন।
দেখছি, বিমলা জালে-পড়া হরিণীর মতো ছট্ফট্ করছে। তার বড়ো বড়ো দুই চোখে কত ভয়, কত করুণা, জোর করে বাঁধন ছিঁড়তে গিয়ে তার দেহ ক্ষতবিক্ষত। ব্যাধ তো এই দেখে খুশি হয়। আমার খুশি আছে, কিন্তু ব্যথাও আছে। সেইজন্যে কেবলই দেরি হয়ে যাচ্ছে। তেমন জোরে ফাঁস কষতে পারছি নে।
আমি জানি, দুবার-তিনবার এমন এক-একটা মুহূর্ত এসেছে যখন আমি ছুটে গিয়ে বিমলার হাত চেপে ধরে তাকে আমার বুকের উপর টেনে আনলে সে একটি কথা বলতে পারত না। সেও বুঝতে পারছিল, এখনই একটা কী ঘটতে যাচ্ছে যার পর থেকে জগৎসংসারের সমস্ত তাৎপর্য একেবারে বদলে যাবে। সেই পরম অনিশ্চিতের গুহার সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে, তার দুই চক্ষে ভয় অথচ উদ্দীপনার দীপ্তি। এই সময়টুকুর মধ্যে একটা-কিছু স্থির হয়ে যাবে তারই জন্যে সমস্ত আকাশ-পাতাল নিশ্বাস রােধ করে যেন থমকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু, সেই মুহূর্তগুলিকে বয়ে যেতে দিয়েছি। নিঃসংকোচ বলের সঙ্গে নিশ্চিতপ্রায়কে এক নিমেষে নিশ্চিত হয়ে উঠতে দিই নি। এর থেকে বুঝতে পারছি, এতদিন যে-সব বাধা আমার প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে ছিল তারা আজ আমার রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়েছে।
যে রাবণকে আমি রামায়ণের প্রধান নায়ক বলে শ্রদ্ধা করি সেও এমনি করেই মরেছিল। সীতাকে আপনার অন্তঃপুরে না এনে সে অশােকবনে রেখেছিল। অত বড়াে বীরের অন্তরের মধ্যে ঐ এক জায়গায় একটু যে কাঁচা সংকোচ ছিল তারই জন্যে সমস্ত লঙ্কাকাণ্ডটা একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেল। এই সংকোচটুকু না থাকলে সীতা আপন সতী নাম ঘুচিয়ে রাবণকে পুজো করত। এইরকমেরই একটু সংকোচ ছিল বলেই যে বিভীষণকে তার মারা উচিত ছিল তাকে রাবণ চিরদিন দয়া এবং অবজ্ঞা করলে, আর মােলাে নিজে।
জীবনের ট্রাজেডি এইখানেই। সে ছােটো হয়ে হৃদয়ের একতলায় লুকিয়ে থাকে, তার পরে বড়ােকে এক মুহূর্তে কাত করে দেয়। মানুষ আপনাকে যা বলে জানে মানুষ তা নয়, সেইজন্যেই এত অঘটন ঘটে।
নিখিল যে এমন অদ্ভুত, তাকে দেখে যে এত হাসি, তবু ভিতরে ভিতরে এও কিছুতে অস্বীকার করতে পারি নে যে সে আমার বন্ধু। প্রথমটা তার কথা বেশি কিছু ভাবি নি; কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে তার কাছে লজ্জা পাচ্ছি, কষ্টও বােধ হচ্ছে। এক-এক দিন আগেকার মতাে তার সঙ্গে খুব করে গল্প করতে, তর্ক করতে যাই, কিন্তু উৎসাহটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এমন-কি, যা কখনাে করি নে তাও করি, তার মতের সঙ্গে মত মেলাবার ভান করে থাকি। কিন্তু এই কপটতা জিনিসটা আমার সয় না, এটা নিখিলেরও সয় না— এইখানে ওর সঙ্গে আমার মিল আছে।
তাই জন্যে আজকাল নিখিলকে এড়িয়ে চলতে চাই, কোনােমতে দেখাটা না হলেই বাঁচি। এই-সব হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ। অপরাধের ভূতটাকে মানবামাত্রই সে একটা সত্যকার জিনিস হয়ে দাঁড়ায়। তখন তাকে যতই অবিশ্বাস করি না কেন সে চেপে ধরে। আমি নিখিলের কাছে এইটেই অসংকোচে জানাতে চাই, এ-সব জিনিসকে বড়াে করে বাস্তব করে দেখতে হবে। যা সত্য তার মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্বের কোনাে ব্যাঘাত থাকা উচিত নয়।
কিন্তু এ কথাটা আর অস্বীকার করতে পারছি নে, এইবার আমাকে দুর্বল করেছে। আমার এই দুর্বলতায় বিমল মুগ্ধ হয় নি। আমার অসংকোচ পৌরুষের আগুনেই সেই পতঙ্গিনী তার পাখা পুড়িয়েছে। আবেশের ধোঁয়ায় যখন আমাকে আচ্ছন্ন করে তখন বিমলার মনও আবিষ্ট হয়, কিন্তু তখন ওর মনে ঘৃণা জন্মে। তখন আমার গলা থেকে ওর স্বয়ংবরের মালা ফিরিয়ে নিতে পারে না বটে, কিন্তু সেটা দেখে ও চোখ বুজতে চায়।
কিন্তু ফেরবার পথ বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের দুজনেরই। বিমলাকে যে ছাড়তে পারব এমন শক্তিও নিজের মধ্যে দেখছি নে। তাই বলে নিজের পথটাও আমি ছাড়তে পারব না। আমার পথ লোকের ভিড়ের পথ; এই অন্তঃপুরের খিড়কির দরজার পথ নয়। আমি আমার স্বদেশকে ছাড়তে পারব না, বিশেষত আজকের দিনে; বিমলাকে আজ আমি আমার স্বদেশের সঙ্গে মিশিয়ে নেব। যে পশ্চিমের ঝড়ে আমার স্বদেশলক্ষ্মীর মুখের উপর থেকে ন্যায়-অন্যায়ের ঘোমটা উড়ে গেছে সেই ঝড়েই বিমলার মুখে বধূর ঘোমটা খুলবে; সেই অনাবরণে তার অগৌরব থাকবে না। জনসমুদ্রের ঢেউয়ের উপর দুলবে তরী, উড়বে তাতে ‘বন্দেমাতরং’ জয়পতাকা, চারি দিকে গর্জন আর ফেনা— সেই নৌকোই একসঙ্গে আমাদের শক্তির দোলা আর প্রেমের দোলা। বিমলা সেখানে মুক্তির এমন একটা বিরাট রূপ দেখবে যে তার দিকে চেয়ে তার সকল বন্ধন বিনা লজ্জায় এক সময়ে নিজের অগোচরে খসে যাবে। এই প্রলয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে ওর এক মুহূর্তের জন্যে বাধবে না। যে নিষ্ঠুরতাই প্রকৃতির সহজ শক্তি সেই পরমাসুন্দরী নিষ্ঠুরতার মূর্তি আমি বিমলার মধ্যে দেখেছি। মেয়েরা যদি পুরুষের কৃত্রিম বন্ধন থেকে মুক্তি পেত তা হলে পৃথিবীতে কালীকে প্রত্যক্ষ দেখতে পেতুম। সেই দেবী নির্লজ্জ, সে নির্দয়। আমি সেই কালীর উপাসক; বিমলাকে সেই প্রলয়ের মাঝখানে টেনে নিয়ে আমি একদিন কালীর উপাসনা করব। এবার তারই আয়োজন করি।