মুখের চেহারা কী হয়েছে দেখেছেন?
লালমোহনবাবু তক্তপোষে বসে হাতে তাঁর দাড়ি কামানোর আয়নাটা নিয়ে তাতে নিজের মুখ দেখে মন্তব্যটা করলেন। ওঁর মুখের যা অবস্থা, আমাদের সকলেরই তাই।
গোসাঁইপুরের ওই একটা ড্রব্যাক, বললেন তুলসীবাবু।এটার বিষয় আপনাদের আগে থেকেই ওয়ার্নিং দেওয়া উচিত ছিল।
আপনি গোসাঁইপুর বলছেন, আমি বলব মল্লিকবাড়ির বাগানে, বললেন লালমোহনবাবু। ওইটেই হল মশার ডিপো।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমরা দোতলায় আমাদের ঘরে এসে বসেছি। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। ফেলুদা এভাবে গুম মেরে গেছে কেন বুঝতে পারছি না। আমার বিশ্বাস জীবনবাবুর খুনটা ওর কাছে এতই অপ্রত্যাশিত যে ওর ক্যালকুলেশন সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে। আর ডাকাতই যদি খুনটা করে থাকে, তা হলে তদন্তের মজাটা কোথায়? ডাকাত ধরার রাস্তা তো পুলিশের ঢের বেশি ভাল জানা আছে; সেখানে একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা আর কী করতে পারে?
দারোগী সুধাকর প্রমাণিক ইতিমধ্যে ফেলুদার সঙ্গে এসে কথা বলে গেছেন। তিনি ফেলুদার নাম শুনেছেন, তবে ফেলুদার উপর খুব একটা ভক্তিভাব আছে বলে মনে হল না। বিশেষ করে জীবনবাবুর লাশ লোপাট হয়ে যাওয়াতে তিনি রীতিমতো বিরক্ত।
আপনারা যাঁরা শখের ডিটেকটিভ, বললেন সুধাকর দারোগ, তাদের দেখেছি কাজের মধ্যে সিসটেমের কোনও বালাই নেই। আরেকজন দেখেছি আপনার মতো গণেশ দত্তগুপ্ত–তার সঙ্গে একটা কেসে ঠোকাঠুকি লাগে। যেখানে দরকার অ্যাকশনের, সেখানে চোখ কুঁচকে বসে ভাবছে। কী যে ভাবছে তা মা গঙ্গাই জানে। আবার যেখানে কাজ করছে, তার পেছনে কোনও চিন্তা নেই। লাশটা যখন দেখলেন পড়ে আছে, আর সেটাকে ছেড়ে যদি যেতেই হয় তো একটা লোককে পাহারায় বসিয়ে যেতে পারলেন না? এখন আমাদের ওই পেছনের পুকুরের জলে জাল ফেলতে হবে। আর তাতে যদি বডি না ওঠে তো ভেবে দেখুন–এই গাঁয়ে এগারোটা পুকুর, তার মধ্যে একটাকে দীঘি বলা চলে! আর তাতেও যদি না হয় তা হলে.এ সবই কিন্তু আপনার নেগলিজেন্সের জন্য।
ফেলুদা পুরো ঝালটা হজম করে উলটে একটা বেয়াড়া প্রশ্ন করে সুধাকর দারোগকে আরও উসকে দিল।
আপনি প্ৰেতাত্মায় বিশ্বাস করেন?
দারোগা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, আপনার সিরিয়াস বলে খ্যাতি আছে শুনেছিলুম, এখন দেখছি সেটাও ভুল।
ফেলুদা বলল, কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। কারণ আপনারা যদি খুনি ধরতে না পারেন তা হলে আমাকে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি প্রেতাত্মা নামাতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে জীবনলালের আত্মাই জীবনলালের খুনির সঠিক সন্ধান দিতে পারেন।
আপনি নিজে তা হলে হাপলেস ফিল করছেন বলুন।
খুনের তদন্ত আমার সাধ্যের বাইরে সেটা স্বীকার করছি, বলল ফেলুদা, কিন্তু ডাকাতের হাতে হাতকড়া পরাতে পারব বলে আমার বিশ্বাস আছে।
সুধাকরবাবুর যে ফেলুদার উপর আস্থা কত কম সেটা তাঁর পরের কথা থেকেই বুঝতে পারলাম!
আপনি ডেড় বডি আয় জ্যাস্তু বডি তফাত করতে পারেন। আশা করি? গলায় ফাঁস দিয়ে টান মারলে কী কী পরিবর্তন হয় সেটা জানা আছে আপনার?
ফেলুদা ঠাণ্ডা ভাবেই উত্তরটা দিল।
সুধাকরবাবু, আমার যখন পুলিশে চাকরি নেবার কোনও বাসনা নেই, তখন আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা আমার মর্জির ব্যাপার। পুলিশের উপর নির্ভর না করে যখন আমি প্রেতাত্মার কথা বলছি তখন বুঝতেই পারছেন আমার তদন্তের রাস্তাটা একটু স্বতন্ত্র।
ভোলানাথবাবু সম্পর্কে আপনার মনে কোনও সন্দেহের ভাব নেই?
নিশ্চয়ই আছে। আমার সন্দেহ হয় আপনারা দিগ্বিদিক বিবেচনা না করেই ভদ্রলোকের হাতে হাতকড়া পরাবেন, কারণ তাঁর পূর্বপুরুষ যে জীবনবাবুর পূর্বপুরুষের দ্বারা লাঞ্ছিত। হয়েছিলেন সে খবর হয়তো আপনাদের কানো পৌঁছেছে। কিন্তু সেটা করলে আপনারা মারাত্মক ভুল করবেন।
সুধাকর দারোগ সশব্দে হেসে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ফেলুদার দিকে চেয়ে চুক চুক করে আক্ষেপের শব্দ করে বললেন, মুশকিল হচ্ছে কী জানেন, আপনারা বেশি ভেবে সহজ জিনিসটাকে জটিল করে ফেলেন। কেসটা জলের মতো পরিষ্কার।
আপনাদের জাল ফেলা পুকুরের জলের মতো?
ফেলুদার খোঁচা অগ্রাহ্য করে দারোগা বলে চললেন, আপনি একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারতেন কেন ভোলানাথবাবুর কথা বলছি। ডাকাতি এবং খুন দুটোর জন্যেই সে দায়ী। এ ডাকাতি ঘরের লোকের কাজ সে তো বোঝাই যায়। আসল ডাকাত হলে সিন্দুক ভাঙত-চাবি দিয়ে খুলত না। ভোলানাথ টাকা নিয়ে পালাচ্ছিল, পিছনের বাগান দিয়ে, খুন করবার কোনও অভিপ্রায় ছিল না তার। জীবনবাবু ঘুম ভেঙে ট্টের পেয়ে তাকে ধাওয়া করেন; ভোলানাথ খুন করতে বাধ্য হয়। তারপর সন্দেহ যাতে না পড়ে। তাই আপনাদের খবর দিতে আসে। ভোলানাথ বলেছে ডাকাত তাকেও বেঁধে রেখেছিল, জীবনবাবু এসে তার বাঁধন খোলে। এ কথা যে সত্যি তার প্রমাণ কই? এর তো কোনও সাক্ষী নেই।
সিন্দুকের টাকা তা হলে কোথায় গেল সুধাকরবাবু? ফেলুদা গভীরভাবে জিজ্ঞেস করল।
সেইেটাকাও খুঁজতে হবে, বললেন সুধাকরবাবু। লাশ পেলে পর আমরা ভোলানাথবাবুকে জেরা করব। তখন সব সুরসুর করে বেরিয়ে পড়বে।
আমার কিন্তু সুধাকরবাবুর কথাগুলো বেশ মনে ধরল; কিন্তু ফেলুদা কেন আমল দিচ্ছে না? দারোগ যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখনই কেন সে বলতে গেল, আজি সন্ধ্যায় জীবনলালের আত্মা নামানো হবে মৃগাঙ্কবাবুর বাড়িতে! এলে ঠিকবেন না!
তুলসীবাবুর দেখলাম একমাত্র চিন্তা কালকের সংবর্ধনা হবে কি না সেই নিয়ে; রহস্যের কিনারা না হলে, খুনির হাতে হাতকড়া না পড়লে, নিশ্চয়ই হবে না, কারণ গ্রামের লোকের সংবর্ধনা সভায় যোগ দেবার উৎসাহই হবে না। লালমোহনবাবু অবিশ্যি মেনেই নিয়েছেন যে মালা আর মানপত্র ফসকে গেল, আর স্পিচটা মাঠে মারা গেল। হয়তো নিজেকে সাত্মনা দেবার জন্যই বললেন, আমরা মশাই রহস্য বেচে খাই; বাস্তবিক একটা খাঁটি রহস্যের সামনে পড়লে সেইটেই আমাদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
মুখে এটা বলা সত্ত্বেও লক্ষ করছি উনি বার বার নিজের অজানতে বিড় বিড় করে স্পিচের লাইন বলছেন, আর বলেই নিজেকে সামলে নিচ্ছেন।
মৃগাঙ্ক ভটাচায্যি কোন বাড়িতে থাকেন বলতে পারেন?
প্রশ্নটা এল তুলসীবাবুর বাড়ির দরজার বাইরে থেকে।
এই শুরু হল, বললেন তুলসীবাবু।সোম আর শুকুরে এ উপদ্রব লেগেই আছে, আর রাস্তায় প্রথম বাড়ি বলে আমাকেই এ ঝক্কি পোয়াতে হয়।
ভদ্রলোক জানালা দিয়ে নীচের দিকে চেয়ে বললেন, আরও তিনটে বাড়ি পরে ডান দিকে।
ফেলুদা বলল, আমরা আসছি বলে খবরটা পাঠিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। আর বলবেন কিউয়ে দাঁড়াতে পারব না। আমাদের আত্মাকে প্রাইয়রিটি দিতে হবে।
তুলসীবাবু বোধহয় এই প্রথম বুঝলেন যে ফেলুদা ব্যাপারটা সম্বন্ধে সত্যিই সিরিয়াস। তাঁর মুখের ভাব দেখে ফেলুদা বলল, আমার একার কাজ ফুরিয়ে গেছে তুলসীবাবু। এখন ভটচায্যি মশাইয়ের সাহায্য ছাড়া এগোতে পারব না।
ফেলুদা অনেক সময়ই বলে যে মনের দরজা খোলা রাখা উচিত, বিশেষ করে আজকের দিনে; কারণ রোজই প্রমাণ হচ্ছে যে এমন অনেক ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে যার কারণ বৈজ্ঞানিকেরা জানে না, অথচ জানে না বলে সেটাকে উড়িয়েও দিতে পারছে না। এই যেমন সেদিন কাগজে বেরোল যে ইউরি গেলর বলে এক হুইদি যুবক চোখের চাহনির জোরে পাঁচ হাত দূর থেকে বৈজ্ঞানিকের হাতে ধরা কাঁটা চামচ বেঁকিয়ে ফেলছে। এ ঘটনা চোখের সামনে দেখছে আরও একজন ডাকসাইটে বৈজ্ঞানিক, আর দেখে তারা না পারে কারণ বলতে, না পারে উড়িয়ে দিতে। মৃগাঙ্কবাবুর ক্ষমতাও কি এই ধরনের?
তুলসীবাবু বললেন, সাড়ে পাঁচটা বাজে; চলুন আমি আপনি একসঙ্গে গিয়ে ওঁকে রিকোয়েস্টটা করি, তা হলে জোরটা বেশি হবে।
ফেলুদা উঠে পড়ে বলল, তোরা বরং একটু বেড়িয়ে আয় না।
আমার নিজেরও এক ঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, লালমোহনবাবুও বলছিলেন গোসাঁইপুরের শরৎকালের বিকেলের তুলনা নেই, তাই ফেলুদার বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই আমরাও দুজন বেরিয়ে পড়লাম।