বুরুনের দাদু রাম কবিরাজ
সন্ধের পর বুরুনের দাদু রাম কবিরাজ তাঁর দোকান-ঘরে বসে আছেন। হাড়-কাঁপানো শীত পড়েছে এবার। সূর্য ডোবার পর
আর রাস্তায় বড় একটা লোক-চলাচল নেই। বাজারও অর্ধেক বন্ধ। খদ্দেরের আনাগোনা খুবই কম। শুধু কবিরাজমশাইয়ের দোকানে নিত্যকার আড্ডাধারীরা এসেছে।
আড্ডাধারীরা সবাই বুড়ো-সুড়ো মানুষ। গায়ে আলোয়ান, মাথায় বাঁদুরে টুপি, গলায় কমফটার, পায়ে মোজা চাপিয়ে সব ঝুম্বুস হয়ে বসে আছেন। টেবিলের ওপর একটা লক্ষ জ্বলছে।
রাম কবিরাজ বললেন, “আমার নাতি বুরুন এবার অঙ্কে তেরো পেয়েছে, জানো তো সবাই!”
সবাই একবাক্যে বলে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব জানি।”
রামবাবু দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, “তা আর জানবে না! ছেলের বাপ যে সারা শহরে ঢোল সহরত করে সে কথা লোককে জানিয়েছে। কিন্তু আমি বলি বাপু, অঙ্কে তেরো পেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়! যারা বিদ্বান বুদ্ধিমান, তাদের অবস্থা তো দেখছি। এই ধরো না কেন, আমার ছেলে ভেলু তো সোনার মেডেল পেয়ে পাশ করা ডাক্তার, নামডাকও খুব। কিন্তু এখনো রুগির নাড়ী ধরে বলে দিতে পারবে না, রুগির পেটের ব্যামো না বুকের ব্যথা, রুগি রাগী না বেকুব। সেসব বোঝা কি সোজা কথা! তবু গলায় নল ঝুলিয়ে হাতে চুঁচ বাগিয়ে মানুষ মেরে বেড়াচ্ছে। আমি বলে দিচ্ছি, নাতিকে কবিরাজি শেখাব। অঙ্কে তেরো পেয়েছে তো কুছ পরোয়া নেই, অবিদ্যা শেখার চেয়ে মুখ থাকা ভাল।”
সবাই সায় দিয়ে ওঠেন, “তা বটে! তা বটে!”
সায় না দিয়ে উপায়ও নেই। রাম কবিরাজকে সবাই ভয় পায়। ভারি সৎ, তেজী আর আদর্শবাদী লোক।
রাম কবিরাজ নাতির পক্ষ হয়ে আরো কী বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এই সময়ে রিটায়ার্ড সাব জজ ধীরেন চাটুজ্যে হাতে ছাতা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
ছাতা দেখে সবাই অবাক।
মহিমবাবু বলে উঠলেন, “ধীরেন যে আজ বড় ছত্রপতি সেজে এসেছ। বাইরে বৃষ্টি-বাদলা হচ্ছে নাকি?”
ধীরেনবাবু হাঁফ ছেড়ে বললেন, “আরে না। ছাতাটা একটা অস্ত্ৰবল।”
“অস্ত্রবল? কিসের অস্ত্রবল হে? অস্ত্রের কথা ওঠে কেন?”
“ওঠে, ওঠে।” বলে ধীরেনবাবু একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে গলাবন্ধ কোটের ওপরের কয়েকটা বোম খুলতে খুলতে বললেন, “দিনকাল ভাল নয় হে। এই গঞ্জে যে বাঘ বেরিয়েছে, সে-খবর রাখো?”
“বাঘ?”
“বাঘ!”
“বাঘ!” সকলের একবাক্যে প্রশ্ন। ধীরেনবাবু বললেন, “গল্প শুনেছিলাম, এক সাহেব ছাতা হাতে জঙ্গলের ধারে বেড়াতে গিয়ে বাঘের মুখোমুখি পড়ে যায়। বুদ্ধি করে তখন সাহেবটা বাঘের মুখের সামনে পটাং করে ছাতাটা খুলে ধরতেই বাঘ ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তাই ছাতাটা নিয়ে বেরিয়েছি আজ।”
রাম কবিরাজ ধমক দিয়ে বললেন, “ধানাই-পানাই ছেড়ে আসল কথাটা বলবে তো! বলি বাঘ কোথায়?”
“আর বলো কেন! বিকেলের দিকে একটু হায়পাথার চা-বাগানের দিকে নিরালা মাঠের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম আজ। সঙ্গে নাতি। তা হঠাৎ নাতি বায়না ধরল, কুকুরের বাচ্চা নেবে। চেয়ে দেখি মাঠের মধ্যে চার-পাঁচটা কুকুরছানা খেলা
করছে। নাতির বায়নায় অবশেষে কুকুরছানা ধরতে মাঠে নামতে হল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি, ও বাবা! কুকুরছানা কোথায়? চার-পাঁচটা বাঘের বাচ্চা এ ওর গায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দিব্যি খেলছে!”
“ঠিক দেখেছ যে সেগুলো বাঘের বাচ্চা?” ধীরেনবাবু দৃঢ় স্বরে বললেন, “একেবারে রায়বাঘা। চিতা বা গেছো বাঘ নয়, গায়ে-ডোরাকাটা দক্ষিণ রায়। সেই দেখে তো আমি নাতিকে পাঁজাকোলে নিয়ে দে ছুট, দে ছুট। বাঘের বাচ্চা যখন দেখা গেছে, তখন মা বাঘ বা বাবা বাঘও কাছেপিঠেই আছে। সবাই খুব সাবধানে থেকো হে!”
হেমবাবু উঠে জুতো পরতে পরতে বললেন, “আমি বরং রওনা দিই। দিগিন আমাকে একটু এগিয়ে গিয়ে আসুক।”
বাকি সবাইও উশখুশ করতে থাকেন। উপেনবাবু আপন মনে “রাম রাম” করছিলেন শুনে শশধরবাবু তাঁর ভুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ও তো ভূতের মন্ত্র! বাঘ কি আর রাম-নাম শুনে পালায়?”
“তবে?” উপেনবাবু জিগ্যেস করেন।
রামবাবুর ভয়ডর নেই। নিশ্চিন্ত মনে বললেন, “তা বাঘের নামে ভয় পেলে চলবে কেন। উত্তরবাংলার এসব অঞ্চলে তো বাঘ বেরোবেই। গত বছরও বেরিয়েছিল। তবে শহরের মাঝখানে আসে না।”
সবাই বলে ওঠে, “তা বটে! তবে কিনা–”
আড্ডাধারীরা আজ আর বেশিক্ষণ বসলেন না। চক্ষুলজ্জায় খানিকক্ষণ বসে থেকে, সব দল বেঁধে উঠে পড়লেন। গেলেন না শুধু মন্মথবাবু।
রামবাবুর ভয়ডর নেই। সবাই চলে যাওয়ার পরেও নিশ্চিন্ত মনে বসে রইলেন। রুগি-টুগি বড় একটা কবিরাজের কাছে আসতে চায় না। তারা মরতে-মরতে গিয়ে ভিড় করে তাঁর ছেলে ভেলুর চেম্বারে। তবু রাম কবিরাজ ধৈর্য ধরে বসে থাকেন। সত্তরের ওপর বয়স হল, তবু এখনো তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভয়ংকর আশাবাদী।
মন্মথবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “আর যাওয়া! বাঘের ভয় করি না হে! এখন তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে।”
“কীরকম?”
“হাবু গুণ্ডার কথা তোমার মনে আছে?”
কবিরাজমশাই বললেন, “খুব আছে, খুব আছে। হাবুর মামলায় তুমি হাকিম ছিলে, আমি সাক্ষী দিয়েছিলাম। বারো-চোদ্দ বছর আগেরকার কথা, মনে থাকবে না কেন?”
মন্মথবাবু আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি হাবুকে যাবজ্জীবন কয়েদের রায় দিয়েছিলাম।”
“তাও জানি। খুব ভাল কাজ করেছিলে। হাবুর মতো বদমাশ দুটো হয় না। কত যে খুন করেছে এ মহকুমায়, তার ঠিক নেই।”
মন্মথবাবু চিন্তিত সুরে বলেন, “সে ঠিক। কিন্তু জেল হওয়ার পর নাকি হাবু রোজ সকালে গীতা পাঠ করত, সন্ধ্যা-আহ্নিক করত, একাদশী-পূর্ণিমায় উপোস দিত। জেলখানায় তার চরিত্রের খুব সুনাম হয়, সবাই তাকে সাধুবাবা বলে ডাকত। এমন কি, পুলিস জেলার পর্যন্ত সবাই তাকে সম্মানও করতে শুরু করে।”
“সেও কানাঘুষোয় শুনেছি।”
মন্মথবাবু আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু সব ভাল যার শেষ ভাল।”
“তার মানে?”
“এই দেখ না!”
বলে মন্মথবাবু তাঁর চাঁদরের তলায় হাত দিয়ে পাঞ্জাবির বুক। পকেট থেকে একটা খাম বের করে কবিরাজ মশাইয়ের হাতে দিলেন।
রামবাবু ভ্রূ কুঁচকে চিঠিটা পড়তে লাগলেন। “শ্রীশ্ৰীকালীমাতা সহায়। মাননীয় মহাশয়, পত্রে আমার নমস্কার জানিবেন। বিধিমতো আপনার বরাবর নিবেদিন করিতেছি যে, আমাদের পরম মাননীয় হাবু ওস্তাদ আগামী দোলের আগের দিন খালাস পাইতেছেন। হাবু ওস্তাদের প্রতি আপনি যে নিষ্ঠুর সাজার বিধান দিয়াছিলেন, তাহা আমরা ভুলি নাই। শ্ৰীশ্ৰীকালীমাতার নামে শপথ করিতেছি, হাবু ওস্তাদ খালাস হইবার সাত দিনের মধ্যে আমরা চরম প্রতিশোধ লইব। প্রস্তুত থাকিবেন। ইতি হাবু ওস্তাদের ভক্তবৃন্দ।”
চিঠি পড়া শেষ করে কবিরাজমশাই বলেন, “কবে পেলে চিঠিটা?”
“আজকের ডাকেই এল।” রাম কবিরাজ একটু নিশ্চিন্তের হাসি হেসে বললেন, “ভয় পেয়েছ নাকি?”
মন্মথবাবু উদাস স্বরে বলেন, “ভয়ের আর কী! বুড়ো হয়েছি, এখন মরার ভয় বড় একটা নেই। তবে কিনা এ-লোকগুলো তো ভাল নয়। এদের হাতে যদি অপঘাতে প্রাণ দিতে হয়, তবে আর পরকালে গতি হবে না।”
রাম কবিরাজ হাঃ হাঃ করে ভরাট গলায় হেসে বললেন, “গতি হবে না তো হবে না, দুজনে অপঘাতে মরে নাহয় গিয়ে গোঁসাইবাগানে ভূত হয়ে থাকব আর দেদার আড্ডা মারব। গোসাঁইবাগান জায়গাও ভাল, ভারি নিরিবিলি, লোক চলাচল নেই, সেখানে গাছ-গাছড়াও প্রচুর। ভূতদের রোগ-ভোগ সারাতে গাছ-গাছড়া তুলে ওষুধ বানাব মনের আনন্দে। প্র্যাকটিস ভালই জমবে। তুমিও গিয়ে হাকিমি করতে পারবে।”
যেই রাম কবিরাজ এ কথা বলেছেন, অমনি দোকানঘরের মধ্যে যেন ছোট্ট একটা ঘূর্ণিঝড় খেলে গেল। শিশি-বোতলগুলো নড়ে উঠল খটাখট করে।
রাম কবিরাজ একটু অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। মন্মথবাবুও সচকিত হয়ে বললেন, “ঝড় ছাড়ল নাকি?”
রামবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “আরে না! শীতকালে ঝড় আসবে কোত্থেকে? বোধ হয় উত্তরে বাতাসের একটা ঝাঁপটা এল।”
মন্মথবাবু আরো খানিকক্ষণ বসে থেকে বলেন, “রাত হল হে! এবার উঠি।”
“বোসো। তামাক সাজি।”
মন্মথবাবু বসেন। রাম কবিরাজ উঠে দোকানঘরের পিছনে ছোট্ট কুঠুরিতে তামাক সাজতে বসেন। কলকে সাজিয়ে ফুঁ দিতে দিতে সামনের দোকানঘরে এসে গড়গড়ার মাথায় বসিয়ে নলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও হে।”
তারপর অবাক হয়ে দেখেন গড়গড়ার নল যার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন, সেই লোকটাই নেই!
“গেল কোথায় মন্মথ?” আপনমনে এই কথা বলে রাম কবিরাজ চেয়ারে বসে অন্যমনে তামাক খেতে লাগলেন। চারদিকটা খুব নিঃঝুম হয়ে এসেছে। বাজারের দোকানপাট সবই প্রায় ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। ছোট গঞ্জ-শহরে এমনিতেই লোক কম, তার ওপর বেজায় শীতের রাত্রি। খামোখা লোকে ঘরের বাইরে থাকতে চায় না।
রাম কবিরাজের অবশ্য শীত, বাঘ, ভূত–কাউকেই ভয় নেই। বুড়ো হলেও ভারি ডাকাবুকো লোক। বসে বসে রামবাবু হাবু গুণ্ডার কথা ভাবছিলেন।