Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

খাদের মাথা থেকে যখন নীচে নামলাম ততক্ষণে ফিল্ম কোম্পানির লোকেরা সরে পড়েছে। তার বদলে এখন স্থানীয় লোকের ভিড়। আর আমেরিকান গাড়ির বদলে রয়েছে একটা জিপ। একজন বছর পয়ত্ৰিশের স্মার্ট ভদ্রলোক ফেলুদাকে দেখে এগিয়ে এলেন। ইনিই নাকি মিস্টার কুলকার্নি-টুরিস্ট গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। ফেলুদার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা হল। ভদ্রলোক বললেন, কাল রাত্রে যে মিস্টার বোস ফেরেননি। সেটা আজ ভোরে জানা গেছে। একটি বেয়ারাকে পাঠিয়েছিলাম ওর খোঁজ করতে, সে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে।

এখন কী ব্যবস্থা হচ্ছে? ফেলুদা প্রশ্ন করল। কুলকার্নি বললেন, আওরঙ্গাবাদে খবর পাঠানো হয়েছে। সি ডি ভ্যান আসছে, ডেডবডি মর্গে নিয়ে যাবে। মিস্টার বোসের ভাই আছেন দিল্লিতে। লাশ সনাক্ত করার ব্যাপারে তাকে খবর পাঠানো হচ্ছে। …ভেরি স্যাড! ভদ্রলোক সত্যিই পণ্ডিত ছিলেন। আগেও একবার এসেছিলেন—সিকসটি এইটে। গেস্ট হাউসেই ছিলেন। এলোরার ওপর বই লিখছিলেন।

আপনাদের এখানে থানা নেই?

একটা পুলিশ আউটপোস্ট আছে। ছোট জায়গা তো! একজন অ্যাসিসন্টান্ট সাব-ইনসাপেক্টর চার্জে আছেন। মিস্টার ঘোটে। আপাতত ডেডবডি ইনসাপেক্ট করছেন।

আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারেন?

সার্টেনলি!…ভাল কথা—

কুলকার্নি কী যেন একটা গোপনীয় কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু আমরা দুজন বাইরের লোক রয়েছি বলে ইতস্তত করছেন। ফেলুদা বলল, আপনি এদের সামনে বলতে পারেন। কুলকার্নি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, আজ সকালে বম্বেতে একটা ট্রাঙ্ক কল হয়েছে।

মল্লিক?

হ্যাঁ।

কী বলল নোট করেছেন?

কুলকার্নি পকেট থেকে একটা কাগজের স্লিপ বার করে সেটা থেকে পড়ে বললেন, মে বালু আচে। আজ রওয়ানা হচি।

মেয়ে ভাল আছে, আজ রওনা হচ্ছি। আবার সেই মেয়ের ব্যাপার।

যাবার কথা বলেছে কিছু? ফেলুদা চাপা উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করল।

কুলকার্নি বললেন, উনি তো আজই সকলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি আপনার কথা ভেবেই একটা ফন্দি বার করে যাওয়াটা পিছিয়ে দিয়েছি। ওর ট্যাক্সির ড্রাইভারকে টিপে দিয়েছি। ডিফারেনসিয়াল গণ্ডগোল—গাড়ি সারাতে টাইম লাগবে।

ব্রাভো! আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন।

ফেলুদার তারিফে কুলকার্নির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ভাল কথা-আপনার এই ঘোটে লোকটি কেমন?

বেশ লোক। তবে মনমরা হয়ে থাকে। এ জায়গা তার ভাল লাগে না। কবে। প্রোমোশন হবে, আওরঙ্গাবাদে পোস্টেড হবে, তাই দিন গুনছে। …আসুন না, আলাপ করিয়ে দিই।

মিস্টার ঘোটে কেভ থেকে বেরিয়ে এসেছেন, কাছাকাছির মধ্যেই ছিলেন, কুলকার্নি তাঁকে ডেকে এনে ফেলুদাকে বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট, চওড়াতেও প্রায় ততখানিই বলে মনে হয়, তার উপরে আবার চার্লি চ্যাপলিনের মতো গোঁফ। কিন্তু মোটা হলে কী হবে, হাঁটাচলা বেশ চটপটে।

ঘোটের সঙ্গে কথা বলার আগে ফেলুদা আমাদের দিকে ফিরে বলল, তোরা বরং বাংলোয় ফিরে যা-আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি।

কী আর করি। গেলাম ফিরে বাংলোয়। ভোরে শুধু চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই বেশ খিদে পাচ্ছিল। বারান্দায় গিয়ে চৌকিদারকে হাঁক দিয়ে দুজনের জন্য ডিমরুটি করতে বলে দিলাম।

ঘরে ফিরে এসে দেখি লালমোহনবাবু কেমন যেন বোকা বোকা ভাব করে খাটে বসে আছেন। আমার্কে দেখে বললেন, আমরা কি বেরোবার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে। গিয়েছিলাম?

আমি বললাম, না তো। নেবার মতো কীই বা আছে বলুন! তা ছাড়া এরা তো সকালবেলা ঘর ঝাড়পোছ করে, তাই…কেন, কিছু হারিয়েছে নাকি?

না, কিন্তু জিনিসপত্তর সব ওলট-পালট হয়ে আছে। আমার খাটে বসে আমার বাক্স ঘেঁটেছে। এই কিছুক্ষণ আগে। খাট এখনও গরম হয়ে আছে। তোমার বাক্সটা দেখো তো।

সুটকেসটা খোলামাত্র বুঝতে পারলাম সেটা কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। যেটা যেখানে ছিল সেটা সেখানে নেই। শুধু বাক্স না, বালিশ-টালিশও এদিক ওদিক হয়ে আছে। এমন কী থাটের তলাতেও যে খুঁজেছে সেটা আমার চটি জোড়া যেভাবে রাখা হয়েছে তার থেকে বুঝতে পারছি।

লালমোহনবাবু বললেন, কীসের জন্য সবচেয়ে ভয় ছিল জান? আমার নেটবুকটা। সেটা দেখছি নেয়নি।

অন্য কিছু নিয়েছে নাকি?

কই, কিছুই তো নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তোমার?

আমারও তাই। কিছুই নেয়নি। যে এসেছিল সে বিশেষ কোনও একটা জিনিস খুঁজতে এসেছিল। সেটা পায়নি।

একবার চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? কিন্তু চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না। সে বাজার করতে গিয়েছিল, তখন যদি কেউ এসে থাকে। এখানে কোনওদিন কিছু চুরিটুরি যায় না, কাজেই বাইরের লোক এসে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে যাবে এটা তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগল।

হঠাৎ মনে হল ফেলুদার ঘরে লোক ঢুকেছিল কি না জানা দরকার। গিয়ে দেখি ফেলুদা দরজা লক করে গেছে। সেটার অবিশ্যি একটা কারণ আছে। ও নিজে ছদ্মবেশে রয়েছে বলে ওর একটু সাবধান হতে হয়। লালমোহনবাবু বললেন, একবার মিস্টার রক্ষিতকে জিজ্ঞেস করবে নাকি?

কাল–রাত্রে জানাল দিয়ে টর্চের খেলা দেখে আমার এমনিই রক্ষিত সম্বন্ধে একটা কৌতূহল হচ্ছিল, তাই লালমোহনবাবুর প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে দুজনে ভদ্রলোকের দরজায় গিয়ে আস্তে করে টাকা মারলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল।

কী ব্যাপার? ভেতরে এসে।

ভদ্রলোক যে খুব একটা খুশি খুশি ভাব দেখালেন তা নয়; তাও যখন ডাকছেন তখন গেলাম।

আপনার ঘরেও কি লোক ঢুকেছিল? লালমোহনবাবু ঢুকেই প্রশ্ন করলেন।

ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর দিকে তাকাতেই বুঝলাম ভাবগতিক ভাল না। চাপা অথচ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, আপনাকে বলে তো লাভ নেই, কারণ আপনি কানে শোনেন না, কাজেই আপনার ভাগনেটিকেই বলছি। —লোক শুধু ঢোকেনি, আমার একটি অত্যন্ত কাজের জিনিস সযত্নে তুলে নিয়ে গেছে।

কী জিনিস? আমি ভয়ে ভায়ে জিজ্ঞেস করলাম।

আমার রেনকোট। বিলিতি রেনকোট। আজ পঁচিশ বছর ধরে ব্যবহার করছি।

মেজোমামা চুপ। কালা সেজে আছেন। আমি খুব জোরে চেঁচিয়ে তাকে খবরটা দিয়ে দিলাম। লালমোহনবাবু বললেন, কাল রাত্রে নিয়েছিল কি? কাল দেখলুম। আপনি কী যেন খুঁজছেন। আপনার টর্চটা…

না। কাল রাত্রে একটা চামচিকে ঘরে ঢুকেছিল। বাতি নিভিয়ে টর্চ জেলে সেটাকে তাড়াতে চেষ্টা করছিলুম। কাল আমার কোনও জিনিস খোয়া যায়নি। গেছে আজ। সকালে। আর আমার ধারণা সেটা নিয়েছে চৌকিদারের ওই ছেলেটা।

এ কথাটাও চেঁচিয়ে মেজোমামাকে শুনিয়ে দিলাম। উনি বললেন, শুনে দুঃখিত হলাম। ছেলেটির দিকে চোখ রাখতে হয় এবার থেকে।

এর পরে আর কিছু বলার নেই। আমরা ভদ্রলোককে ডিসটর্ব করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

চৌকিদার ডিমরুটি এনে দিয়েছিল, দুজনে খাবার ঘরে বসে খেলাম। আমেরিকায় ডিম কী করে ভজে জানি না, আমাদের এই খুলদাবাদের ডিম ফ্রাই বেশ ভালই লাগছিল। ঘরে কে ঢুকে থাকতে পারে সেটা ভাবতে মনটা খচা খচা করছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা হয়তো সত্যিই চৌকিদারের ওই ছেলেটা! ও মাঝে মাঝে বাংলোর পশ্চিমদিকের মাঠাঁটায় পায়চারি করে, আর পদার ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে দেখে, সেটা লক্ষ করেছি।

যদিও ফেলুদা বাংলোয় ফিরে যেতে বলেছিল, তার মানে যে ঘরেই বসে থাকতে হবে এমন কোনও কথা আছে কি? চাবি দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা বাংলোর বাইরে রাস্তায় এলাম।

বাংলোর ঠিক সামনে থেকে গেস্ট হাউসটা দেখা যায় না, একটা অচেনা গাছ সামনে পড়ে। গাড়ি স্টার্ট দেবার একটা শব্দ পেয়ে একটু এগিয়ে গেলাম। এবার গেস্ট হাউসটা দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গাবাদ থেকে যে ট্যাক্সিটা মিস্টার রক্ষিত আর লুইসনকে নিয়ে এসেছিল, সেটা যাবার জন্য তৈরি, ছাতের উপর মাল চাপানো রয়েছে, আমেরিকান ক্রোড়পতি মিস্টার স্যাম ল্যুইসন বেয়ারাকে বকশিশ দিচ্ছেন।

কিন্তু ইনি আবার কে?

আরেকটি লোক গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, লুইসনের সঙ্গে হাত নেড়ে কথা বলছেন। লুইসন দুবার মাথা নাড়ল। তার মানে কোনও একটা প্রস্তাবে রাজি হল। এবার অন্য ভদ্রলোকটি আরার গেস্ট হাউসে ঢুকে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে বেরোলেন। ড্রাইভার গাড়ির পিছনের ডালা খুলে দিল। বাক্স ভিতরে ঢুকে গেল। ডালা বন্ধ হল। আমার বুকের ভিতর ভীষণ ধুকপুকুনি। লালমোহনবাবু আমার হাত খামচে ধরলেন।

জয়ন্ত মক্সিক নিজের গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করে আমেরিকানের সঙ্গ নিয়ে পালাচ্ছেন।

ড্রাইভার তার জায়গায় গিয়ে বসল।

চৌকিদারের সাইকেল?-আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।

ট্যাক্সি স্টার্ট দেবার শব্দ পেলাম।

আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে কোনও রকমে টেনে হিঁচড়ে সাইকেলটাকে বাইরে আনলাম।

উঠে পড়ুন।

লালমোহনবাবুর ভাব দেখে মনে হল তিনি জীবনে এই প্রথম সাইকেলের পিছনে চাপলেন। আমি জানি অন্য সময় হলে চাপতেন না-কিন্তু অপরাধী পালিয়ে যাচ্ছে, এ ছাড়া গতি নেই।

ট্যাক্সি বেরিয়ে চলে গেছে। আমি প্ৰাণপণে পোডাল করে চলেছি। জটায়ু আমার কোমর খামচে ধরেছেন। সাত বছর বয়সে সাইকেল চালাতে শিখেছি। ফেলুদাই শিখিয়েছিল। অ্যাদ্দিনে সেটা কাজে দিল।

বিশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। ওই যে ফেলুদা-ওই যে ঘোটে, কুলকার্নি।

ফেলুদা! মিস্টার মল্লিক পালিয়েছেন-সেই আমেরিকানের ট্যাক্সিতে-এই পাঁচ মিনিট আগে?

এই একটা খবরের দরুন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এত রকম ঘটনা ঘটে গেল যে, এখনও ভাবতে মাথা ভোঁ ভোঁ করে। জিপিও যে ইচ্ছে করলে ঘণ্টায় ষাট মাইল স্পিড়ে ছুটতে পারে সেটা এই প্রথম জানলাম। আমি আর জটায়ু পিছনে ঘাপটি মেরে বসে আছি, সামনে ড্রাইভারের পাশে ঘোটে আর ফেলুদা, দেখতে দেখতে ট্যাক্সি কাছে চলে আসছে, তারপর হর্ন দিতে দিতে সেটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে থামল, ক্রোড়পতি লুইসনের চোখরাঙনি আর ১ বাছাই বাছাই মার্কিনি গালির বিস্ফোরণ, আর তারই মধ্যে মল্লিকের ফ্যাকাসে মুখ, একবার বাধা দিতে গিয়ে কেঁচো হয়ে যাওয়া, আর তারপর ঘোটে তার সুটকেস খুলল, আর তা থেকে টার্কিশ টাওয়েলের প্যাঁচ খুলে বেরোল যক্ষীর মাথা, আর লালমোহনবাবুর হাফ ছেড়ে বলা এন্ডস ওয়েল দ্যাট অলস ওয়েল, আর লুইসনের হা হয়ে যাওয়া আর দুবার বাট…বাট বলা, আর সবশেষে লুইসন ট্যাক্সি করে আওরঙ্গাবাদ, আর আমরা বামাল সমেত চোর গ্রেপ্তার করে খুলদাবাদ।

মল্লিক অবিশ্যি এখন ঘোটের জিম্মায়। অৰ্থাৎ তিনি এখন খুলদাবাদ পুলিশ

আউটপোস্টের বাসিন্দা। ভদ্রলোক এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনও কথাই বলতে পারেননি।

ঘোটে আমাদের গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিলেন, কারণ কুলকার্নি ওখানে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মিশন সাকসেসফুল শুনে কুলকার্নি অবিশ্যি দারুণ খুশি হলেন, কিন্তু ফেলুদা যেন তার উৎসাহে খানিকটা ঠাণ্ডা জল ঢেলেই বলল যে, এখনও কাজ বাকি আছে। -আর তা ছাড়া আপনি বম্বের ওই নাম্বারটা নিয়ে কিন্তু এনকোয়ারিটা করবেন, আর খবর পেলেই আমাকে জানাবেন।

শেষের ইনস্ট্রাকশনটার ঠিক মানে বোঝা গেল না, তবে এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলেও মনে হল না।

কুলকার্নি সকলের জন্য কফি বলেছিলেন, সেটা খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়লে আমাদের ঘরে যে লোক ঢুকে জিনিসপত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, আর রক্ষিতের ঘর থেকে রেনকোট চুরি গেছে, সে খবরটা ফেলুদাকে দেওয়া হয়নি। সেটা ওকে বলতে ও কয়েক মুহূর্ত ভুকুটি করে ভাবল। তারপর কুলকার্নিকে জিজ্ঞেস করল চৌকিদার লোকটি কেমন।

কে, মোহনলাল? ভেরি গুড ম্যান। সতেরো বছর চৌকিদারি করছে, কোনও দিন কেউ কমপ্লেন করেনি।

ফেলুদা আরেকটু ভেবে বলল, কোনও জিনিস নেয়নি বলছিস?

আমি বেশ জোরের সঙ্গে মাথা নেড়ে না বললাম, আর সেই সঙ্গে এটাও বললাম যে রক্ষিত চৌকিদারের ছেলেকে সন্দেহ করছে।

চলুন, লালমোহনবাবু-আপনি বলছেন লোকটা আপনার খাটে বসে খাট গরম করে দিয়েছিল—আপনার বাক্সে কী আছে একবার দেখে আসি; আমরা চলি, মিস্টার কুলকার্নি। এটা আপাতত আপনার জিন্মাতেই থাক।

তোয়ালেতে মোড়া যক্ষীর মাথাটা ফেলুদা কুলকার্নিকে দিয়ে দিল। তিনি সেটা তাঁর আপিসের সিন্দুকে ঢুকিয়ে দিয়ে তাতে চাবি দিয়ে দিলেন। ফেলুদা বলে এল সে অল্পক্ষণের মধ্যেই ফিরবে।

বাংলোয় এসে আমাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফেলুদা আমার আর লালমোহনবাবুর জিনিস খুব ভাল করে ঘেঁটে দেখল। জামাকাপড় ছাড়া লালমোহনবাবুর সুটকেসে যা ছিল তা হল একটা হামিওপ্যাথিক ওষুধের বাক্স, দু খণ্ড অপরাধ-বিজ্ঞান, তাঁর নোটবুক, আর বেলুচিস্তানের বিষয়ে একটা ইংরেজি বই। নোটবুকটা ফেলুদা এতক্ষণ ধরে উলটে পালটে দেখল কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। সব দেখাটেখা হয়ে গেলে বলল, যা আন্দাজ করছি তা যদি ঠিক হয়, তা হলে এসপার ওসপার যা হবার আজই হবে। আর তাই যদি হয়, তা হলে মনে হচ্ছে তোদের একটা জরুরি ভূমিকা নিতে হবে। সব সময় মনে রাখবি যে আমি আছি পেছনে, ভয়ের কিছু নেই। মল্লিকের অ্যারেস্টের কথা কাউকে বলবি না, এখন ঘর থেকে বেরোবি না। এমনিতেও হয়তো বেরোতে পারবি না, কারণ, মনে হয় বৃষ্টি আসছে।

ফেলুদা কথাগুলো বলতে বলতে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল, এখন দেখলাম ও নিঃশব্দে হেঁটে জানালার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল! আমারও চোখ গেল জানালার দিকে। এটা পশ্চিম দিক। এদিকে খানিক দূর ঘাস জমির পরে কতগুলো বড় বড় গাছ, তার মধ্যে ইউক্যালিপটাস গাছটা আমার চেনা। একজন লোককে গাছপালার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে ঘাস পেরিয়ে আমাদের বাংলোর সামনের দিকে চলে আসতে দেখলাম। তার এক মিনিট পরেই লোকটা আমাদের খাবার ঘরে এসে ঢুকল, আর তার পরেই একটা দরজা চাবি দিয়ে খোলা, আর তারপর সেটাকে ভিতর থেকে বন্ধ করার শব্দ পেলাম।

ফেলুদা দুবার মাথা নেড়ে চাপা গলায় বলল-ঠিক আছে, ঠিক আছে।

লোকটা আর কেউ নন-আমাদের প্রতিবেশী মিস্টার রক্ষিত।

আমার কাছ থেকে সময় মতো নির্দেশ পাধি, সেই অনুযায়ী কাজ করবি।

এই শেষ কথাটুকু বলে ফেলুদা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

আমরা দুজনে ঘরে বসে রইলাম। বাইরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাধহয় কালো মেঘে। সূৰ্যটা ঢেকে দিয়েছে বলে আলো কমে এসেছে।

বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেন জানি মনে হল যে, মিস্টার রক্ষিতের চেয়ে বেশি। রহস্যময় লোক আর কেউ নেই, কারণ ওর সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানতে পারিনি।

আর মল্লিক? মল্লিক, সম্বন্ধেও কি সব জেনে ফেলেছি?

জানি না। হঠাৎ মনে হচ্ছে কিছুই জানি না। মনে হচ্ছে যে অন্ধকারে ছিলাম, এখনও সেই অন্ধকারেই আছি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress