প্ৰথম খণ্ড – আদি পর্ব : ১.১১
ব্রজেশ্বর এসেছেও। অশৌচের সময় নিত্যই এসেছে। তার মায়ের শ্রাদ্ধে খেটেছে। এতটুকু কীর্তিহাটের প্রকৃতির পরিচয় পায় নি। কীর্তিহাটের বাড়ির জ্ঞাতিদের ভার তার উপরেই ছিল। মেজঠাকুমা এসেছিলেন। তিন বছরে তিনি ম্লান হয়েছেন। চার বছর আগে দেখেছিল সে। তখন যে অপরূপ লাবণ্যটি ছিল সেটি ঝরে গেছে। একটু বিষণ্ণ হয়েছেন। ছেলেরা তাঁকে খেতে দেয় না। কোন খোঁজই করে না। এখান থেকে পঞ্চাশ টাকা মা পাঠাতেন, তাই তাঁর সম্বল। আর অন্ন, তাও এক বেলা মাত্র প্রয়োজন তাঁর—সে আসে রাজ-রাজেশ্বরের ও গোবিন্দজীর প্রসাদ থেকে। তিনি ব্রজেশ্বরের জন্য বলে গিয়েছিলেন—হ্যাঁ ভাই, ব্রজেশ্বর দেখি তোমাকে খুব রাজা রাজা করে, কি ব্যাপার?
সে বলেছিল—ব্রজেশ্বর-দা মোটের উপর লোক ভাল ঠাকুমা। কথাগুলি ভারী মিষ্টি, অন্তরটিও ভাল। আমাকে রাজা বলেন।
—হ্যাঁ। লোকের মন নিতে জানে। কিন্তু ভাই, মেলামেশা বন্ধুত্ব ওর সঙ্গে না হওয়াই ভাল।
একটু দুঃখিত হয়েছিল সে মনে মনে। মনে হয়েছিল, ঠাকুমা যেন সতীনের ছেলে নাতিদের প্রতি স্বাভাবিক ঈর্যাবশে কথা বলছেন। তার কাছে বেশী আপন হতে চাচ্ছেন। সে বলেছিল—না। বন্ধুত্ব ঠিক ওঁর সঙ্গে আমার হতে পারে না ঠাকুমা। উনি চাকরী করেন, মাড়োয়ারী ধনীর বাড়ি তৈরী হচ্ছে তার তদ্বির তদারক করেন, সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কাজ। আলাপ আমার সঙ্গে মায়ের মৃত্যুর পর। আসেন, কিছুক্ষণ বসেন, চলে যান। টাকা কি কোন জিনিস তা চান নি। চাইলেও আমি দেব না। তবে চোর-টোর নন তো?
—না, তা নয়। তা বলতে পারব না।
—বেশ, তা হলেই হল। না হলে নিকট-আত্মীয়, আপনারই নাতি, বারণ করব কি করে? আর কোন কথা মেজঠাকুমা বলেননি।
মেজঠাকুমা চলে গেছেন। যাওয়ার সময় তার মনে হয়েছিল, যেন অবিচার অন্যায় হল। তাঁর সঙ্গে কীর্তিহাটের সেই পরম আপনার জনটির মত ব্যবহার করা হল না। কীর্তিহাটের জ্ঞাতিদের সম্পর্কে সে শঙ্কিত ছিল, হয়তো এসে যেতে চাইবে না। কিন্তু ব্রজেশ্বরই তাদের ঠেলা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। নিজে তাদের স্টেশনে নিয়ে গিয়ে টিকিট করে চাপিয়ে দিয়ে এসেছে। সুরেশ্বর মেজঠাকুমাকে যাবার সময় বলেছিল-ঠাকুমা, কাজকর্মের ভিড়ে একবার কাছে বসতে পেলাম না, সুবিধে অসুবিধে অনেক হয়েছে, কিছু যেন মনে করবেন না।
মেজঠাকুমা তার চিবুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন-না ভাই, পরম সমাদরে থেকেছি। এখানকার ঐশ্বর্য এ আরাম এ তো কখনও জীবনে পাই নিই। তোমাদের এতবড় কীর্তিহাটের বাড়ীতেও তো বোধ হয় কোনকালে ছিল না। আমি কাঙ্গালের মেয়ে, দুদিন বুড়ো স্বামীর দৌলতে রাণী হয়েছিলাম। মান্য খাতির পেতাম। তাও শেষ হয়ে এখন আবার কাঙাল হয়েছি। আমাকে এমন করে বলে না। তোমার মা পঞ্চাশ টাকা করে পাঠাতো, তাতেই আজও স্বামী-শ্বশুর বংশের বউ সেজে বেঁচে আছি।
—টাকা আপনার ঠিক সময়ে যাবে যেমন যেত।
—যাবে বইকি। না গেলে চাইব। লিখব নাতিহুজুর, অধীনার প্রতি কৃপা-কটাক্ষ করতে হুকুম হোক। টাকা পাঠাও।
হেসেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে, দুটি জলের ধারাও এসেছিল চোখ থেকে। তার চোখও সজল হয়ে উঠেছিল। তিনি চলে গেলে মনে হয়েছিল ঠাকুমাকে থাকতে বললে হত। এখানে থাকলে মায়ের অভাব পূর্ণ করতে না পারুন যত্ন করতে পারতেন। কিন্তু পরক্ষণেই শ্রাদ্ধের মধ্যে সদ্য খ্যাতি ও গৌরবের স্বাদ পাওয়া তরুণ আধুনিক মন বলে উঠেছিল—তুমি আর্টিস্ট, ছবি আর ফ্রেম এ দুটোর নিকটসম্পর্ক ভুলো না। এ ফ্রেমে ও ছবি কি মানায় না খাপ খায়? ডোন্ট বি সিলি!—
তবু মনখারাপ করেই বসেছিল। ব্রজেশ্বর স্টেশন থেকে ফিরে এসে বসে বলেছিল- বাপস! রাজা, তোমার ধৈর্য বটে। ওঃ! ঠাকুমার সঙ্গে যে ভাবে কথা কইলে তুমি! এবং এদের যে অত্যাচার এ ক’দিন ধরে সহ্য করলে। আমার তো নিজের গুষ্টি। আমি যে এই কদিনে কতবার ওদের খ্যাঁক-ঝ্যাঁক করেছি! আজ তুমি আমায় লজ্জা দিচ্ছ। ওঃ! তোমাকে সেলাম। এখন প্রজার জন্যে একটু চা হুকুম কর। আর কিছুদিন ওরা থাকলে তোমাকে পাগল করে দিত।
চা খেয়ে সে আর থাকে নি। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল, সে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। বলেছিল—আজ শনিবার ভাই, মিনার্ভা থিয়েটারে নেমন্তন্ন আছে—ওদের সঙ্গে খুব খাতির আছে। যাই। দু হপ্তা দেখিনি।—হ্যাঁ জগদীশ্বরকাকার ছেলেমেয়েদের গরম কাপড় জামার জন্যে যে একশো টাকা দিয়েছিলে তুমি—তার ফেরত আছে পাঁচ টাকা ক’ আনা। সেটা ভাই রাজা, রাখলাম আমি। আমার হ্যান্ড বড্ড টাইট। মাইনের টাকা পাইনি।
হেসেছিল সে।
সুরেশ্বর বলেছিল—টাকার দরকার আছে তোমার?
খুব হেসেছিল ব্রজেশ্বর, বলেছিল—এই না হলে রাজা? প্রজার চব্বিশ ঘণ্টাই টাকা চাই টাকা চাই টাকা চাই। আর রাজার তাতে বিস্ময়! কেন? না টাকা সে কি করবে ভেবে পায় না।
পরিশ্রমের ঋণ শোধ করবার জন্যই সে তাকে কিছু দিতে চেয়েছিল, বলেছিল—কত চাই তোমার?
—যত দেবে রাজা। প্রজা ইজ অলওয়েজ পুয়োর। তার হাঁড়িটা শতছিদ্র। সে কলঙ্কিনী রাধা। তাকে ওই শতছিদ্র কুম্ভে জল এনে জালা ভরতে হয়! তা দাও না ভাই-রাজা, একশোটা টাকা। বেশি দিলেও আপত্তি করব না। জামা কাপড় সব ছিঁড়ে গেছে। তা ছাড়া কীর্তিহাটের রায়দের মেজ তরফের বড় ছেলের বড় ছেলে। সুদিন দেখেছি, সমাদর বলতে গেলে তোমার মতই ছিল। খুব ভাল জামা কাপড় একসময় পরেছি হে! প্রথম ষোল বছর পর্যন্ত ফরাসডাঙ্গার ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি ছাড়া পরি নি। কিছু করিয়ে নিই!
নায়েবের কাছে টাকা চাইতে সুরেশ্বরের সংঙ্কোচ হয়েছিল। নায়েব জানতে চাইবেনই এবং একটু আপত্তিও করবেন। তা ছাড়া রায়বাড়ীর তারই জ্ঞাতির অপমান হবে সেটাও তার মনে লেগেছিল। তার নিজের কাছে দেড়শো টাকা ছিল, তাই বের করে সে তাকে দিয়েছিল।
এরপর কয়েকদিনই ব্রজেশ্বর আসেনি। তারপর এসেছিল সে চমৎকার সাজসজ্জা করে। ফরাসডাঙার ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, চকচকে সেলিম সু প’রে এসেছিল। গায়ে সেন্টের গন্ধ। হেসে বলেছিল—জয় হোক রাজা! প্রজা তব হইয়াছে সুখী! এই তো রাজার ধর্ম। প্রজানুরঞ্জন! সেদিন গানবাজনা করে, অনেকক্ষণ থেকে, রাত্রি আটটায় সে গিয়েছিল।
তার এগজিবিশনে সাজানোর কাজেও সে যথেষ্ট খেটে গেছে। পরশু পর্যন্ত এসেছিল। তারপর কাল আজ সে আসে নি। তার অভাব সে অনুভব করেছে। সেই ব্রজেশ্বর, এই করেছে। করেছে, মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছে—যায় আসে, তার বিরুদ্ধে বলার তার কিছু নেই। কিন্তু তার নামে নিজের পরিচয় দিয়েছে! একসঙ্গে সুরেশ্বরের মুখে অতি সূক্ষ্ম একটি বক্র তিক্ত হাস্য দেখা দিল, সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কপাল কুঁচকে উঠল!
মেয়ে দুটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
সে বললে—ওর নাম সুরেশ্বর নয়, ওর নাম ব্রজেশ্বর। আমার জ্ঞাতি বটে। চিনি তাকে।
—কোথায় থাকে সে বাবু?
—তা আমি জানি না। কোন দিন জিজ্ঞাসা করি নি।
—বাবু!
—বল!
—সে তো আপনার নিজের লোক। আমাদের যে বড় বিপদ বাবু! ধারে মদ খেয়ে গেছে। আমরা আনিয়ে দিয়েছি। ভাড়া বাকী। আজ না দিলে কাল সকালে জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দেবে। তা আপনি দিয়ে—যদি তার কাছে—
—না। অত্যন্ত রূঢ়স্বরে সুরেশ্বর বললে।
সে কণ্ঠস্বরে তারা চমকে উঠল ভয়ে।
—চল মা চল!
—দাঁড়াও। তোমাদের ঠিকানা দিয়ে দাও। সে যদি এখানে আসে তবে লোক দিয়ে তাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেব।
—মেয়ের নাম শেফালি বাবু। ঠিকানা—নতুন রাস্তা, সেন্ট্রাল এ্যাভেনু আর বিডন স্ট্রীটের ধারে। ৫ নম্বর রাম ঘোষের গলি। ওই মনোমোহন থিয়েটারের পেছনে। তখনও সেন্ট্রাল এ্যাভেনু শ্যামবাজার পর্যন্ত আসে নি—ওই বিডন স্ট্রীটে মনোমোহন থিয়েটারের সামনে পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছিল। বুঝতে দেরী হল না তার। ব্রজেশ্বরও কাছাকাছি কোথাও থাকে। বিডন স্ট্রীটেই কোথায় যেন মাড়োয়ারীটির বাড়ী তৈরী হচ্ছে। সে এবার ডাকলে—রঘু!
রঘু দরজার পাশেই ছিল। সে ভিতরে এল, সুরেশ্বর বললে—এদের নিচে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দে।
তারা চলে গেলেও সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল সীমা অসীমা সুলতা ঘরে বসে আছে।
ফিরে আসতেই সীমা বললে —বাবা! ওরা কে?
প্রশ্ন করো না। উত্তর দিতে আবার কষ্ট হবে। সম্ভবত দিতে পারব না!
—ওরা ভদ্রঘরের মেয়ে?
—উঁকি মেরে দেখেছ?
—দেখেছি।
—কথা শোন নি?
—শুনে বুঝতে পারি নি।
—তা হ’লে থাক
—বাঃ-অভদ্র মেয়েরা তোমার বাড়ী আসবে! জিজ্ঞাসা করব না?
—না করাই উচিত। জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমিও ওদের চিনি না-ওরাও আমাকে চেনে না।
—তবে এল কেন?
—এল, আমার না হলেও আমার বংশের কারুর দায় আছে।
এতক্ষণে সুলতা বললে—ওদের কিছু সাহায্য করলে পারতেন আপনি। মুখ দেখে বড় বিব্রত মনে হল!
অবাক হয়ে তার মুখের দিকে সুরেশ্বর তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ হয়ে গেল সে। মুখের দিকে অসংকোচ বিস্ময়ের সঙ্গে চেয়ে থেকেই বললে—ঠিক বলেছেন। কিন্তু—!
—কিন্তু কি?
—আপনি অদ্ভুত!
লাল হয়ে উঠল সুলতা।
সুরেশ্বর বললে-আমি শাম্মলী বৃক্ষের চারা কিন্তু আপনি বেত নন। অত্যন্ত নরম লতা। মালতী বললে রাগ করবেন।
—এখন আপনার বাজনা শোনান!
বাজনা সে শুনিয়েছিল। এবং সারাটা দিন সুলতার কথাই ভেবেছিল। ওর কথার টানে ওই মেয়ে দুটির কথাও এসে পড়েছিল বার বার ঘুরে ঘুরে।
ওদের কিছু দেওয়া উচিত ছিল। সুলতা বললে-ওদের মুখ দেখে মনে হল ওরা খুব বিব্রত
মুখের দিকে বার দুই তাকিয়েছিল সে। মেয়েটির রূপ আছে। কিন্তু বেশভূষাতে সে রূপে বেশী চড়া রঙের শেড দিয়ে ফেলেছে। ভালগার হয়েছে তাতে। তাই জন্যে তাকাতে পারেনি। সুলতার মুখেও রঙ ছিল। ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল। চুল রুখু ছিল। দুটোতে আশ্চর্য সমন্বয় হয়েছে।
ব্রজেশ্বরের উপর রাগ হয়েছিল। রাস্কেলের কি শয়তানি বুদ্ধি! তার নাম ব্যবহার করেছে। কেন? মনে হয়েছিল, তাকে বিপন্ন করবার জন্যে? কিন্তু তাই বা কি করে করবে? তবে? তা হলে একটু বড়লোকী আত্মপ্রসাদ অনুভব করবার জন্য? তা হয়তো হবে। ব্রজেশ্বরের কথাবার্তা মনে পড়েছিল। মিষ্টিমুখ, চতুর! ধনেশ্বর রায়ের ছেলে! ওর পক্ষে এ আর বিচিত্র কি? একটু হাসিও পেয়েছিল।
সারাটা দিন কথাগুলো ঘুরছিল মনের মধ্যে। তারই মধ্যে সন্ধ্যার পর মনে হয়েছিল, কাল সকালেই ওদের জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে মেয়েদুটিকে পথে বের ক’রে দেবে। ভাড়া বাকী আছে, ধার পড়ে আছে। অস্বস্তি অনুভব করতে করতে হঠাৎ সে একসময় উঠে পড়েছিল ইজিচেয়ার থেকে। কিন্তু
টাকা? নায়েব ম্যানেজারকে সুরেশ্বর শুধু সংকোচই করে না—অভিভাবকের মত ভয়ও করে! হঠাৎ মনে পড়েছিল আজ চারখানা ছবি দেড়শো টাকায় বিক্রী হয়েছে-সেটা তার আলমারিতে আছে এবং তার হাত খরচের টাকাও আছে। সে দুশো টাকা বের করে নিয়ে একটা জামা টেনে মাথায় গলিয়ে প’রে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ডাকলে—রঘু!
—বাবু?
—আমি একটু বেরুচ্ছি। হঠাৎ কৈফিয়তের প্রয়োজন অনুভব করলে, বললে-একজনের সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার, ভুলে গিছলাম। বুঝলি?
—গাড়ী বলব?
বাড়ীতে একখানা ব্রুহাম গাড়ী আছে। সে সেই তার বাবার আমল থেকে। সেটা হেমলতা ঘোচান নি। আবার মোটরের যুগ উঠেছে, মোটরও কেনে নি। সুরেশ্বর বললে—গাড়ী? তারপর বললে—না। বলে বেরিয়ে চলে গেল। জানবাজার থেকে হেঁটে চৌরিঙ্গীর মোড় পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। একটা ভুল হয়ে গেছে। মনে ছিল না এটা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। শীতটা ক’দিন গাঢ় হয়ে পড়েছে। শুধু আলখাল্লার মত একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। গায়ের আলোয়ানটার প্রয়োজন অনুভব করলে। হ’লে অন্তত ভাল হত। থাক। সে চৌরিঙ্গী পার হয়ে এসে আবার একটু দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি নিলে একখানা। ট্রামে সে বড় একটা চড়ে না। হয় হেঁটে, নয় বাড়ীর ব্রুহামে, নয় ট্যাক্সিতে চড়ে। দিনের ভাগে প্রায়ই চরণবাবুর জুড়ি। মানে হেঁটে।
ট্যাক্সিতে চড়ে বললে—চলিয়ে বিডন স্ট্রীট আর সেন্ট্রাল এ্যাভেনু জংশন।
১৯৩৪/৩৫ সালের কলকাতা, কলকাতার লোকসংখ্যা হয়তো দশ পনের লক্ষ। গাড়ীই বেশী, মোটর কম-বাস হয়নি। ট্রামে ভিড় নেই। বেলা বারোটা থেকে ট্রাম ফাঁকা ছোটে। রাত্রি আটটার পরও তাই। ট্যাক্সিখানা প্রচণ্ডবেগে ছুটে চলেছিল। বাইরে কনকনে হাওয়া গাড়ীর ভিতর ঢুকে তাকে শীত ধরিয়ে দিল। সে কাচ বন্ধ করে দিয়ে বসল। হঠাৎ বললে—রোখিয়ে তো সর্দারজী! বাঁয়া তরফ।
গাড়ী রুখলে সে। গাড়ী থেকে নেমে এক বাক্স গোল্ডফ্লেক সিগারেট দেশলাই কিনে নিলো, যেন একটা উত্তেজক কিছুর দরকার ছিল। ঠান্ডায় যে শীত তার থেকে আলাদা একটা কিছুর তাড়না তার বুকের স্পন্দনকে দ্রুততর করে যেন একটু কাঁপুনির সৃষ্টি করেছিল। গাড়ীর ভিতর বসে সিগারেট ধরিয়ে সে একটু আরাম পেলে।
বিডন স্ট্রীটে এসে নেমে তার ভাবনা হল—এই বাড়ী কোথায় পাবে? কি ভাবে বের করবে, কি বলে ঢুকবে? ব্যাপারটা এবার তার কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। অভিজ্ঞতা নেই। বলতে গেলে এ অঞ্চলে কয়েকবার থিয়েটার দেখতে আসা ছাড়া এমনি কখনও আসে নি! কিন্তু পড়েশুনে একটা ধারণা আছে—তবে সেটা বেশ সহজ সরল নয়।
সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলে ফিরে যাই। পিছনে একটা পানের দোকান। সেখানে হিন্দুস্থানী পানওয়ালা পান বেচছে। সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন বেশ পাঞ্জাবি পরা, পাকানো গোঁফ, তেল-চকচকে চুলে বাহারে টেরী হিন্দুস্থানী হাসছে গল্প করছে। মধ্যে মধ্যে রিকশা করে বাবু চলছে মালা গলায়। রজনীগন্ধার মালা। গোড়ের মালা এখন নেই। একজন একটা খড়-জড়ানো কাঠে-গোঁজা গোলাপ ফুলের কুঁড়ি এবং ফুল বিক্রী করছে। হাঁকছে—চাই ফুল!
হঠাৎ একজন হিন্দুস্থানী এসে পাশে দাঁড়িয়ে বললে-বহুৎ আচ্ছা বিবি, বাবু সাহেব! দেখিয়ে গা?
সুরেশ্বর নার্ভাস হল। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে নার্ভাসনেসের সঙ্গেই যুদ্ধ করছিল। এ-প্রশ্নে সে বেশ একটু দমে গেল! উত্তর দিল না।
—বাবুসাহেব!
—না!
—তব ইখেনে দাঁড়িয়ে কেনো?
এবার সে সাহস সঞ্চয় করে বললে—একটা বাড়ী খুঁজছি, বাতলে দিতে পার?
—হ্যাঁ। বাতাইয়ে।
ঠিকানাটা বললে সে। এবং বললে-ওখানে শেফালি বলে একটি মেয়ে থাকে, তার বাড়ী।
—হাঁ-হাঁ। জরুর জানি। উ তো মিনার্বার সখী ছিলো। আব এক বাবু উসকে রাখিয়েসে। আসেন। লেকিন বকশিস লিবো হামি!
—চল!
.
সে একটা সংকীর্ণ গলিপথ। দুধারের বাড়ীর দরজায় আলো জ্বেলে বসে দাঁড়িয়ে নানান সাজে সাজা মেয়ের দল। নানান বাড়ী থেকে গান ভেসে আসছে। শিউরে উঠল সে। শীত তার বেশী ধরে গেল। প্রায় প্রতি ঘরের দরজা থেকেই ইঙ্গিতে আহ্বান করছিল তারা। সরব আহ্বানেও ডাকছিল—আসুন না! অ বাবু!
হিন্দুস্থানীটা বললে-বাবু শেফালির কামরামে যাবেন। মিনার্বার শেফালি ।
—আমি শেফালির চেয়ে ভাল। তাকিয়ে দেখুন। বলে হেসে উঠল মেয়েটা।
সে মাটির দিকে চেয়েই পথ চলছিল। আর সিগারেট টানছিল।
মনে হচ্ছিল পা থেকে মাথার দিকে সসন্ করে একটা কিছুর স্রোত বইছে। কানদুটো গরম হয়ে উঠেছে। হাত ঘামছে। মনে অনুতাপ হচ্ছিল। নিজের উপর রাগ, তার চেয়েও বেশী রাগ হচ্ছিল ব্রজেশ্বরের উপর। তাকে পেলে সে তার পায়ের জুতো খুলে মারতে পারত।
—এহি বাড়ী বাবুজী!
বাড়ির দরজায় দু-তিনটে মেয়ে দাঁড়িয়ে। এখানটায় এত ভিড় নেই। যে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে ছিল, তার মধ্যে শেফালি নেই। সুরেশ্বর বললে—জিজ্ঞেস কর তো, শেফালি আছে কিনা! হয়তো লাঞ্ছনার ভয়ে আগেই বাড়ী ছেড়ে চলে গিয়ে থাকতে পারে।
একটি মেয়ে বললে—কাকে খুঁজছেন? শেফালিকে?
—হ্যাঁ।
—তার ঘরে হজ্জুত চলছে। ভাড়া বাকী, বাড়ীওলী পা লাগিয়ে বসেছে। টাকা দেওয়ার কথা ছিল, দিতে পারেনি। তার বাবু ভেগেছে। সেখানে সুবিধে হবে না। হেসে উঠল সে।—
তা আমার ঘরে আসতে পারেন।
—আমাকে ভিতরে যেতে পথ দিন!
—হামার বকশিশ বাবু!
—কত?
—সেলাম, খুশীসে দো-চার রুপেয়া দে দিজিয়ে।
চারটে টাকাই তার হাতে দিয়ে দিলে সে। বললে—চল ভিতরে গিয়ে ঘরটা দেখিয়ে দেবে।
জরুর! বলেই সে সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াল। মেয়ে দুটি তাকে পথ দিল সরে গিয়ে। তাকে ডাকলে—আইয়ে হুজুর!
ঘুপচি কুয়োর মত একটা উঠোন। তার চারিপাশে ঘর। সব ঘরেই দরজা প্রায় ভেজানো। ভিতরে আলো জ্বলছে। কোন ঘরে হাসি-উল্লাস, কোন ঘরে গান, কোন ঘর প্রায় স্তব্ধ। মধ্যে মধ্যে দু-চারটে কথা ভেসে আসছে। তারই মধ্যে একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে লোকটা ডাকলে—শেফাইলি বিবি!
সামনেই ওপাশে একখানা ঘরের দরজা খোলা। দরজায় বসে আছে একটি স্থূলাঙ্গী মেয়ে। নিচ হাত খালি—উপর হাতে তাগা আলোর ছটায় ঝক ঝক করছে। তার ওদিকে ঘরের মধ্যে শেফালিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মাথা হেঁট করে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। বেশ নেই, ভূষা নেই, হেঁটকরা মাথা থেকে খোলা চুল কিছু সামনে এসে পড়েছে। ডাক শুনে সে মাথা তুললে। আলোর ছটা মুখে পড়ল। সুরেশ্বর দেখতে পেলে, মেয়েটা কাঁদছিল। এবার সুরেশ্বর সহজ হয়ে উঠল মুহূর্তে। সে হিন্দুস্থানীটিকে পাশ কাটিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
অবাক হয়ে গেল শেফালি।
সুরেশ্বর বললে-তোমার মা কই?
—সেই বাবু মা। বিহ্বলকণ্ঠে বললে শেফালি। ঘরের কোণ থেকে এবার উঠে এল তার মা। শেফালিও উঠে দাঁড়াল। তার মায়ের বিস্ময়ের অবধি রইল না। সে সুরেশ্বরের ঐশ্বর্য দেখে এসেছে। এবং আরও দেখে এসেছে আজ তার বাড়ীতে বড় বড় লোকের ভিড়। তারা যখন গিয়েছিল, তখন ওই ভিড় দেখে বাড়ীতে ঢুকতে সাহস করেনি। অন্য লোককেও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। জিজ্ঞাসা করছিল একটু দূরের এক ভুজাওলাকে—ও-বাড়িতে কি হচ্ছে? তারা বলেছিল—এগজিবিশন! তসবীরের এগজিবিশন! ছবির গো ছবির। ওহি বাড়ীর মালিক বহুত লায়েক আদমী। বহুত নাম। উনি তসবীর আঁকিয়েছেন, ওহি দেখনে লিয়ে বড়াবড়া আমির, বড়াবড়া ভারী ভারী আদমী আসিয়েছেন!
ওরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছিল। শেফালির গৌরব-গর্বের অন্ত ছিল না, তার বাবুর এত ঐশ্বর্য, এত গৌরব! তারপর সকলে চলে গেলে ভিতরে ঢুকে ঐশ্বর্য দেখে বিস্মিত হয়েছিল। তারপর যখন সুরেশ্বর এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। সুরেশ্বরের ব্যক্তিত্ব, তার আকার অবয়ব দেখে নিতান্ত ছোট হয়ে পড়েছিল। কথায়বার্তায় ভয় পেয়েছিল। সুরেশ্বর একবার রূঢ়কণ্ঠে ‘না’ বলেছিল, তাতে চমকে উঠেছিল দুজনেই। সেই মানুষ তাদের এই কদর্য পঞ্চপম্বলে নিজের পা-দুখানাকে হাঁটু পর্যন্ত কর্দমাক্ত করে এখানে এসেছেন! বুঝতে পারছিল না তারা। কিন্তু ওরা দেহব্যবসায়িনী, ওরা দুনিয়ায় দেহের চাহিদার বিচিত্র তত্ত্ব নিপুণভাবে বোঝে মা-মেয়ে দুজনের মুখ-চোখই পরমুহূর্তে দীপ্ত হয়ে উঠল। মা বললে —আসুন, বাবা আসুন। তারপরই দরজায় বসে-থাকা স্থূলাঙ্গীকে বললে—এখন যাও দিদি। পাবে বইকি। দেব বইকি। উনি দাঁড়িয়ে আছেন। মস্ত বড়লোক, রাজার ছেলে, তার চেয়েও বড়। এখন যাও—
সুরেশ্বর বললে—উনি ভাড়া পাবেন?
স্থূলাঙ্গী বললে—হ্যাঁ বাবু, আমি দুমাসের ভাড়া পাব। এক মাসের ভাড়া আগাম দিয়ে ঘর ভাড়া করে তারপর—
—কত পাবেন?
—দুমাসের ভাড়া ষাট টাকা। বাড়ীর সব থেকে ভালো ঘর বাবু। আলাদা কল, আলাদা সব।
একখানি একশো টাকার নোট তার হাতে দিয়ে বললে সুরেশ্বর—তিন মাসের ভাড়া মানে আগামী মাসের ভাড়াও নিয়ে রাখুন। বাকী টাকাটা। কি যেন মদের ধার আছে বলেছিলে তুমি? কার কাছে?
—সেও আমার কাছে। সেও কুড়ি টাকা।
আর একখানা একশো টাকার নোট সে শেফালির মায়ের হাতে দিয়ে বললে—ওকে দশ টাকা দিয়ে বাকী টাকাটা তোমরা রাখো। এক মাসের মধ্যে তোমরা যা হয় কাজ দেখে নিয়ো। বুঝলে! আমি চললাম!
—চললেন?
—হ্যাঁ। সে ফিরল।
—বাবু! বাবু! আপনার পায়ে ধরছি! বাবু!
এক্ষেত্রে বোধহয় নাটক করার লোভ সম্বরণ কেউ করতে পারে না। সুরেশ্বরও সম্বরণ করতে পারলে না। সে ফিরল না-সে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। যে নাটকটি হয়ে গেল উপরে, সে নাটকটির বেগ এবং গতি এত প্রবল এবং তীক্ষ্ণ যে, তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সে নামতে নামতেই নিচে এসে গিয়েছিল। ফলে দরজা ফাঁক করে তাকে সকলে বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে দেখলে। দরজায় যে-দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা দরজা থেকে সরে এসে তখন উঠোনে দাঁড়িয়েছে। সে আবার থমকে দাঁড়াল। তার এখন সাহস হয়েছে। অন্তর শুধু তৃপ্তি নয়, তার সঙ্গে অহঙ্কারেও পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে বললে—একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
তারা প্রগল্ভতা করলে না। একজন বললে—কি?
—কত উপার্জন কর তোমরা?
অবাক হয়ে গেল তারা। উত্তর কি দেবে বুঝতে পারলে না।
সুরেশ্বর হেসে বললে—এই শীতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাক। এই তো ফিনফিনে পোশাক। শীত করে না? কষ্ট হয় না?
করুণভাবে একটি মেয়ে বললে-খাব কি বাবু?
পকেট থেকে দুখানা দশ টাকার নোট বের করে তাদের দুজনের হাতে দিয়ে বললে—আজকের দিনটে আর কষ্ট কোরো না। রাত্রি বোধহয় দশটা বাজে!
বলে সে বাড়ী থেকে বেরিয়ে চলে এল। তার পিছন পিছন আসছিল সেই হিন্দুস্থানীটি। সে-ও বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতবাক হয়ে গেছে। এইসব শরীফ-আমীর সে তার জিন্দীতে দেখেনি। কানেও শোনেনি। হ্যাঁ শুনেছে বটে—বাদশাহী জমানাতে। এ-জমানাতে নয়!
সে তাকে কিছু বলতেও সাহস করলে না। সুরেশ্বর এসে আবার দাঁড়াল। সেন্ট্রাল এ্যাভেনুর মোড়ে। একটা ট্যাক্সি চাই।
লোকটা এসে শুধু বললে—হুজুর!
—একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে পার?
—ট্যাক্সি মিলবে না হুজুর, ঘোড়ারগাড়ী ডেকে দিই।
—আচ্ছা। ওই তো আড্ডা। আমি নিয়ে নিচ্ছি। দীর্ঘ পদক্ষেপে এসে সে একখানা গাড়ীতে চেপে বসে বললে—জানবাজার।
মনে মনে একটা নেশা লেগেছিল। আশ্চর্য একটা নেশার ঘোরের মত। ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছিল। মধ্যে মধ্যে এই সদ্য সমাপ্ত দৃশ্যটার টুকরো টুকরো ছবি মনে ভেসে উঠছিল এবং গভীর তৃপ্তি অনুভব করছিল। গাড়ির পিছনের সিটটায় বসে সামনের সিটের কোণের দিকে চেয়ে যেন ছবিগুলো দেখছিল। ঘুরে ঘুরে শেফালির একটা ছবি মনের সামনে আসছিল। প্রথম তাকে যেমন দেখেছিল—সেই ছবি। সেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল মেয়েটি, মুখ আধখানা দেখা যাচ্ছিল উপরের দিকটা। ভুরুর নিচে চোখ পর্যন্ত। কতকগুলো রুখু চুল কপালে এসে পড়েছিল। অত্যন্ত সকরুণ। গাড়ীর ভিতরে অন্ধকারের মধ্যে সেই স্মৃতির ছবিটা যেন সে স্পষ্ট দেখছিল। সিগারেট টানা ও সে ভুলে গিয়েছিল এবং সিগারেটটা পুড়েই যাচ্ছিল ধোঁয়ার একটি আঁকাবাঁকা রেখা তুলে। অনুভব করছিল নিঃশ্বাস দিয়ে। তার শিল্পী-মন আপসোস করছিল। একখানি সুন্দর ছবি হত। অতি সুন্দর ছবি হতে পারত। হঠাৎ হাতের আঙ্গুলে গরম লাগায় আঙ্গুল সরিয়ে নিয়ে আগুনের ছেঁকা খেলে। সচেতন হয়ে সিগারেটটা বাইরে ফেলে দিয়ে সে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। ফিরে গেলে হয় না? খানিকটা নড়েচড়ে বসে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে। আঁকবার কোন সরঞ্জাম নেই, গিয়ে কি হবে? তাছাড়া সে-মুহূর্ত তো আর ফিরবে না!
গাড়ীটা ততক্ষণে ধর্মতলায় পৌঁছেছে। বাইরে ব্রিস্টল হোটেল—একটু দুরে মেট্রোতে এবং অন্য দোকানগুলোতে আলো ঝলমল করছিল। সায়েব-মেমের ভিড় চলেছে। ফিরিঙ্গী এবং দেশী ক্রিশ্চান মেম-সাহেবগুলো এদিকে-ওদিকে ঘুরঘুর করছে।
সব ভেসে যাওয়া ছবি যেন। গাড়িটা কর্পোরেশন স্ট্রীটে ঘুরল। কর্পোরেশন স্ট্রীটের নতুন নাম হয়েছে—সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড।
গাড়ী এসে বাড়ীর দরজায় লাগল। নামল সে। ভাড়া দিয়ে সে উপরে উঠে গেল। বসল কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে গিয়ে ক্যানভাসের উপর কয়লার স্টিক দিয়ে ওই ছবিটা আঁকতে চেষ্টা করলে। কিন্তু হল না।
শুধু একটা উত্তেজিত অস্থিরতায় পায়চারি করলে ঘরের ভিতর। হঠাৎ একবার মনে হল ছবির সরঞ্জাম নিয়ে ফিরে যাবে সে?
নাঃ। তবে কি করবে সে? একটা কিছু করার যেন প্রয়োজন। ওই মেয়েটার সেই মুখচ্ছবি ভাসছে। রাস্তার ধারে দরজায় দাঁড়ানো মেয়েগুলোর সেই শীতে কষ্ট পাওয়ার ছবি মনে পড়ছে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে সে চিঠির কাগজ নিয়ে চিঠি লিখতে বসল সুলতাকে। হঠাৎ সুলতাকে মনে পড়েছে। সেই তাকে বলেছিল—মুখ দেখে মনে হল বড় বিব্রত। কিছু দিলে পারতেন।