Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারি || Sunil Gangopadhyay

কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারি || Sunil Gangopadhyay

এমন ঝিঁঝির ডাক যে, কানে যেন তালা লেগে যায়। রাত্তিরবেলার জঙ্গল। খুব নিস্তব্ধ হয় বলেই তো সবাই জানে। কিন্তু রাত্তিরেও যে জঙ্গলের কোথাও-কোথাও এত ঝিঁঝি ডাকে, তা সন্তুর জানা ছিল না।

জঙ্গল একেবারে মিশমিশে অন্ধকারও নয়। আকাশে একটু-একটু জ্যোৎস্না আছে। মাঝে-মাঝে পাতলা সাদা মেঘ ঢেকে দিচ্ছে চাঁদ, আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। কাছে-দূরে ঝিকমিক করে জ্বলছে অজস্র জোনাকি। ঝিঁঝিগুলো অবিরাম শব্দ করে যায়, অথচ তাদের দেখা যায় না। আর জোনাকিগুলো আলো দেখায় কিন্তু কোনও শব্দ করে না।

একটা জিপ গাড়ির সামনের দিকে বসে আছেন কাকাবাবু আর রাজ সিং, পেছন দিকে জোজো আর সন্তু। কেউ নড়াচড়া করছে না একটুও। এইভাবে কেটে গেছে দেড় ঘণ্টা। শীতের রাত, মাঝে-মাঝে শিরশিরে হাওয়া দিলে বুকের ভেতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।

একসময় রাজ সিং কোটের পকেট থেকে একটা চুরুট বের করলেন। তারপর ফস করে একটা দেশলাই জ্বেলে ধরালেন সেটা।

কাকাবাবু পাশ ফিরে তীব্র চাপা গলায় বললেন, চুরুট ধরিয়েছেন? ছিঃ, আপনার লজ্জা করে না? ফেলে দিন এক্ষুনি!

রাজ সিং চুরুটে দুটো টানও দিতে পারেননি, কাকাবাবুর ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি সেটা জুতোর তলায় পিষে নিভিয়ে দিয়ে, ফেলে দিলেন বাইরে।

কাকাবাবু বললেন, দেখুন, সামনে এক জায়গায় পাশাপাশি দুটো আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। ও দুটোও জোনাকি, না কোনও জানোয়ারের চোখ?

রাজ সিং বললেন, জোনাকি নয়, পিট-পিট করছে না, স্থির হয়ে আছে। তবে, বেশ নীচের দিকে। ছোট জানোয়ার। মনে হয়, খরগোশ!

কাকাবাবু বললেন, পেছন দিকে আরও দুটো চোখ। একজোড়া খরগোশ। ওই যে লাফাচ্ছে!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই চোখ দুটোও মিলিয়ে গেল। আবার অন্ধকার।

কাকাবাবু হঠাৎ রাজ সিংয়ের কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।

রাজ সিং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সে কী? কেন?

কাকাবাবু অনুতপ্ত গলায় বললেন, আপনি চুরুট ধরিয়েছিলেন বলে আমি ধমকালাম। সেটা আমার উচিত হয়নি। আমি তো আপনার বস নই। আপনি আমার অধীনে চাকরি করেন না। আমি একজন সাধারণ মানুষ!

রাজ সিং বললেন, তাতে কী হয়েছে, আমি কিছু মনে করিনি। আপনি আমার চেয়ে বয়েসে বড়।

কাকাবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন? একসময় আমার নিজেরই খুব চুরুটের নেশা ছিল। হাতে সবসময় জ্বলন্ত চুরুট থাকত। এখন ধূমপান একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। গন্ধও সহ্য করতে পারি না। এখন কাছাকাছি কেউ সিগারেট বা চুরুট ধরালে আমার রাগ হয়ে যায়।

রাজ সিং বললেন, আমিও চুরুট টানা ছেড়ে দেব ভাবছি। বড় বাজে নেশা।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, চেষ্টা করুন ছেড়ে দিতে!

পেছন থেকে জোজো বলল, কাকাবাবু, আমি একটা কথা বলব?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কী বলবে, বলো!

জোজো বলল, কী বলব, মানে, যে-কোনও একটা কথা। অনেকক্ষণ কথা বললে আমার পেটের মধ্যে সুড়সুড়ি লাগে।

সন্তু বলল, এতেই তো তোর দুটো সেনটেন্স বলা হয়ে গেল, জোজো!

কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, চুপ!

জঙ্গলের মধ্যে এবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে আসছে কেউ। যেন মানুষেরই মতন কেউ। খোঁড়া মানুষেরা যেমন পা টেনে-টেনে হাঁটে, শব্দটা অনেকটা সেরকম।

কাকাবাবু পাশ থেকে রাইফেলটা তুলে নিলেন হাতে। রাজ সিংয়ের কাছে একটা চার ব্যাটারির মস্ত বড় টর্চ। তা ছাড়া জিপের ওপরেও একটা সার্চলাইট লাগানো আছে।

এই জায়গাটায় জঙ্গল খুব ঘন। কোনও রকম পথের চিহ্ন নেই। এত ঝোপঝাড় যে, এর মধ্যে গাড়ি চালানোও প্রায় অসম্ভব! তবু জিপ গাড়িটা কী করে এলো, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার! কাকাবাবুই জোর করে রাজ সিংকে নিয়ে এসেছেন। আসবার সময় ধারালো টাঙ্গি দিয়ে মাঝে-মাঝে দু-একটা গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে।

কাছেই একটা জলাশয়। ইচ্ছে করেই জিপটাকে জলাশয়ের একেবারে ধারে নিয়ে যাওয়া হয়নি। একটা ঝাঁকড়া গাছের ডালপালার আড়ালে জিপটা লুকিয়ে রয়েছে।

আওয়াজটা খানিক দূর দিয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল এক সময়। রাজ সিং কান খাড়া করে শুনে ফিসফিসিয়ে বললেন, মানুষ নয়, মনে হচ্ছে ভালুক। ভালুকরা শুকনো পাতা ঠেলতে-ঠেলতে যায়।

কাকাবাবু বললেন, হরিণ দেখা যাচ্ছে না কেন? জলের কাছে হরিণ তো খুব আসে দল বেঁধে!

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, কাছাকাছি বাঘ আছে। আমি গন্ধ পাচ্ছি।

কাকাবাবু দু-তিন বার জোরে-জোরে শ্বাস টেনে বললেন, কই, আমি তো কোনও গন্ধ পাচ্ছি না!

জোজো বলল, বাঘ থাকলে হরিণ আসে না। রাজ সিং বললেন, হরিণরা সাধারণত আসে সন্ধের একটু আগে কিংবা ভোরের দিকে। মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি কি এখানে সারারাত থাকার প্ল্যান করছেন?

কাকাবাবু বললেন, কেন, আপনার ঘুম পাচ্ছে নাকি? এখন মোটে সাড়ে বারোটা।

রাজ সিং বললেন, এটা জঙ্গলের কোর এরিয়া। এখানে অনেক রকম জন্তু-জানোয়ার আসে। হঠাৎ হাতির পাল এসে গেলে খুব বিপদ হতে পারে।

জোজো বলল, বাঘ এলে বুঝি বিপদ হবে না?

রাজ সিং বললেন, আমরা জিপগাড়িতে বসে আছি, বাঘ আমাদের দেখতে পেলেও হঠাৎ আক্রমণ করবে না। অসমের বাঘ তো মানুষখেকো নয়, নিজে থেকে প্রথমেই মানুষকে আক্রমণ করতে আসে না। গণ্ডার এলেও বিপদ নেই। গণ্ডার কোনও কিছু ভুক্ষেপ করে না। ভালুকও কাছ ঘেঁষবে না। কিন্তু হাতিকে বিশ্বাস নেই। জিপটা দেখে হাতির হয়তো লোফালুফি খেলার ইচ্ছে হতে পারে। গত বছরে একজন ফরেস্ট রেঞ্জারের জিপ গাড়ি উলটে দিয়ে একপাল হাতি তাঁকে পা দিয়ে পিষে মেরেছিল!

কাকাবাবু বললেন, কেন যেন হাতি সম্পর্কে আমার কোনও ভয় হয় না। হাতি দেখলেই মনে হয়, কেমন যেন আপনভোলা ভালমানুষ গোছের প্রাণী।

রাজ সিং বললেন, দেখলে ওরকম মনে হয় বটে, কিন্তু এক-এক সময় হাতি খুব হিংস্র হতে পারে। বিশেষত কোনও দলছাড়া একলা হাতি সবসময় রেগে থাকে।

কাকাবাবু বললেন, হাতি অত বড় প্রাণী, চুপিচুপি তো আসতে পারবে না। আমরা যদি জেগে থাকি, ডালপালা ভাঙার মড়মড় শব্দ শুনতে পাব, তখন সবাই মিলে চ্যাঁচামেচি শুরু করব। মানুষের চিৎকার শুনলে হাতি কাছে আসে। আর জোজো যদি বেসুরো গলায় একটা গান ধরে, হাতিরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পালাবে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আমি একবার অল ইণ্ডিয়া মিউজিক কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়েছিলাম।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, টপ্পা, না ঠুংরি?

জোজো সগর্বে বলল, খেয়াল! দরবারি কানাড়া গেয়েছিলাম, বুঝলি? জাজ ছিলেন ওস্তাদ বন্দে আলি মিঞা!

কাকাবাবু বললেন, তিনি খুব বিখ্যাত ওস্তাদ বুঝি? নাম শুনিনি। সে যাই হোক, হাতিরা খেয়াল শুনতে ভালবাসে, না ভয় পায়, তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার।

রাজ সিংয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, আপনারা গাড়িতে বসুন, আমি একটু ঘুরে আসি।

রাজ সিং আঁতকে উঠে বললেন, সে কী! আপনি একলা-একলা কোথায় যাবেন? না, না, এই জঙ্গলে পায়ে হেঁটে ঘোরা একেবারে নিরাপদ নয়।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার যখন অল্প বয়েস ছিল, তখন অনেকবার শিকার করতে গেছি। ওড়িশার জঙ্গলে বাঘও মেরেছি। এখন তো শিকার করা নিষেধ। বাঘ, গণ্ডার এত কমে আসছে, এদের বাঁচিয়ে রাখাই উচিত। নেহাত আত্মরক্ষার প্রয়োজন না হলে কোনও প্রাণীকেই আমি মারতে চাই না। কিন্তু রাত্তিরবেলা জঙ্গলে আসতে খুব ভাল লাগে। কোনও জন্তু-জানোয়ারের দেখা পেলে রোমাঞ্চ হয়। সেইজন্যই তো এসেছি এখানে।

রাজ সিং বললেন, গাড়িতে বসেই দেখুন, নামবার দরকার কী? কোনও-না-কোনও জন্তুর দেখা পাওয়া যাবেই।

কাকাবাবু বললেন, গাড়িতে আমরা বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারব। মুখ দিয়ে কথা বেরিয়ে আসবেই। কথা শুনতে পেলে কোনও জন্তু কাছে। আসবে না। আমি জলাটার ধার থেকে একটু ঘুরে আসি। ভয় নেই, আমি সাবধানে থাকব, কোনও জানোয়ারের মুখে প্রাণ দেওয়ার ইচ্ছে আমার একটুও নেই।

সন্তু বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি!

কাকাবাবু হুকুমের সুরে বললেন, না, আমি একলা যাব। তোমরা কেউ গাড়ি থেকে নামবে না।

কাকাবাবু রাইফেলটা নামিয়ে রেখে, ক্রাচদুটি তুলে নিয়ে পা দিলেন মাটিতে।

রাজ সিং ঝুঁকে পড়ে মিনতি করে বললেন, সার, আমি অনুরোধ করছি, আপনি এভাবে যাবেন না। একটা অঘটন ঘটে গেলে আমি বড়সাহেবের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।

কাকাবাবু বললেন, মিস্টার সিং, আপনি আগে কোনও দিন এই জায়গাটায় এসে রাত কাটিয়েছেন?

রাজ সিং একটু থতমত খেয়ে বললেন, না, মানে, দিনের বেলা ঘুরে গেছি, রাত্তিরে কখনও থাকিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমি যতদূর জানি, আপনার মতন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কোনও অফিসারই এত দূরে এসে রাত্তিরে থাকেননি।

তারপর কাকাবাবু আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা জোরে কথা বলিস না। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসব। ঝিলের ধারটা দেখে আসব শুধু।

সন্তু জানে, কাকাবাবু একবার জেদ ধরলে তাঁকে কিছুতেই ফেরানো যাবে।

ক্রাচে ভর দিয়ে কাকাবাবু এগোতে লাগলেন আস্তে-আস্তে। একটুক্ষণ তাঁকে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল, তারপর মিলিয়ে গেলেন গাছপালার আড়ালে।

জোজো বলল, কাকাবাবু রাইফেলটাও নিলেন না?

সন্তু বলল, দু হাতে ক্রাচ থাকলে রাইফেল নেবেন কী করে? তবে ওঁর কোটের পকেটে রিভলভার আছে নিশ্চয়ই।

জোজো বলল, রিভলভার দিয়ে কি বাঘ মারা যায়?

সন্তু বলল, বাঘ মারা নিষেধ, তা জানিস না? হ্যাঁ রে, তুই কি এখনও বাঘের গন্ধ পাচ্ছিস?

জোজো বলল, একটু আগে পাচ্ছিলাম। এখন আর একটা বোঁটকা গন্ধ…নিশ্চয়ই বুনো শুয়োরের। জানিস, একবার মধ্যপ্রদেশে বাবার সঙ্গে গেছি, সন্ধেবেলা এরকম একটা জিপে করে যেতে-যেতে বাবা হঠাৎ বললেন, কাছাকাছি নেকড়ে বাঘ আছে। ঠিক তাই। জিপটা আরও দু মাইল এগোবার পর দেখা গেল, রাস্তার ওপরেই সার বেঁধে বসে আছে তিনটে নেকড়ে।

সন্তু বলল, তোর বাবা দু মাইল দূর থেকে গন্ধ পেয়েছিলেন?

জোজো বলল, দু মাইল আর এমন কী! একবার আমেরিকা থেকে আমাদের রাষ্ট্রদূত বাবাকে ফোন করেছিলেন। বাবা কথায় কথায় বললেন, তোমার বাড়িতে আজ বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে, তাই না? আমি টেলিফোনেই গন্ধ পেয়ে গেছি। নুন একটু কম হয়েছে, যে রান্না করছে তাকে আরও দু চামচ নুন মিশিয়ে দিতে বলো।

সন্তু বাঁ হাতে মুখ চাপা দিয়ে হাসতে লাগল।

রাজ সিং খুবই উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। তিনিও জোজোর কথা শুনে না হেসে পারলেন না। তারপরই গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, তোমাদের আংকল গেলেন কোথায়? এইভাবে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াবার কোনও মানে হয়?

জোজো বলল, জানেন সিং সাহেব, আমার বাবা খুব বড় জ্যোতিষী! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ইংল্যান্ডের রানি, গারফিল্ড সোবার্স, পেলে, কপিলদেব, অমিতাভ বচ্চন, এঁরা সবাই আমার বাবার কাছে ভবিষ্যৎ জানতে চান।

হঠাৎ এ-কথার কী মানে হয় তা বুঝতে না পেরে রাজ সিং শুকনো ভদ্রতা করে বললেন, ও, তাই নাকি?

জোজো আবার বলল, আমার বাবার কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, কাকাবাবুর ভবিষ্যৎ, মানে উনি কতদিন বাঁচবেন?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবুর ঠিকুজি কুষ্টি তুই কোথায় পেলি? কাকাবাবুর তো ওসব কিছু নেই-ই।

জোজো বলল, আমার বাবার কাছে ওসব দরকার হয় না। ছবি দেখলেই উনি বলে দিতে পারেন। কাকাবাবুর ছবি আমার কাছে নেই? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাকাবাবুর ওপর অনেকের রাগ আছে, অনেক ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল কাকাবাবুকে খুন করতে চায়, কাকাবাবুর কি হঠাৎ কোনও বিপদ হতে পারে? বাবা অনেকক্ষণ দেখে-টেখে বললেন, নাঃ, একে হঠাৎ কেউ মেরে ফেলতে পারবে না। এর ইচ্ছামৃত্যু। নিজে ইচ্ছে না করলে এর মরণ হবে না। মহাভারতের ভীষ্ম যেমন, কাকাবাবু সেই টাইপের মানুষ!

রাজ সিং বললেন, কোনও লোক হয়তো মেরে ফেলতে পারবে না, কিন্তু জন্তু-জানোয়ার? তারাও কি জ্যোতিষীর গণনার মধ্যে পড়ে? এই জঙ্গলে অনেক বিষাক্ত সাপ আছে।

জোজো বলল, উঁহুঃ! সাপে কামড়ালেও উনি মরবেন না। ওই যে বললাম, ইচ্ছামৃত্যু!

সন্তু বলল, এত শীত, সাপের ভয়টা অন্তত এখন নেই। কাকাবাবু বলেছেন, আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবেন, আর কত বাকি?

রাজ সিং টর্চটা নীচের দিকে জ্বেলে, ঘড়ি দেখে বললেন, মাত্র এগারো মিনিট হয়েছে, তাতেই যেন মনে হচ্ছে কতক্ষণ কেটে গেল! কোনও জন্তুও দেখা যাচ্ছে না, এই জিপটার কথা সবাই টের পেয়ে গেছে!

এর পর একটুক্ষণ কথা না বলে সবাই চেয়ে রইল সামনের দিকে। কাকাবাবুর কোনও পাত্তাই নেই। অরণ্য একেবারে সুনসান। রাত্তিরবেলা সব জঙ্গলই খুব রহস্যময় হয়ে ওঠে। মনে হয়, অন্ধকারে কারা যেন লুকিয়ে আছে, তারা দেখছে, কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না।

এক-এক সময় শুকনো পাতায় খসখস শব্দ হচ্ছে। সে আওয়াজ এমন মৃদু যে, খরগোশের মতন ছোট প্রাণী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। ঝিলের জলে একবার একটু জোরে শব্দ হল, তাও অনেক দূরে।

আবার একটুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ সমস্ত নিস্তব্ধতা খানখান করে পর-পর দু বার রাইফেলের গুলির শব্দ হল। এত জোর সেই শব্দ, যেন পিলে চমকে গেল ওদের তিনজনের।

রাজ সিং সঙ্গে-সঙ্গে জিপের ওপরের সার্চলাইট জ্বেলে দিলেন। টর্চের আলোও ফেললেন সেই শব্দের দিক লক্ষ্য করে। সেই আলোর রেখা অনেক দূর পৌঁছলেও দেখা গেল না কিছুই। রাজ সিং টর্চটা ঘোরাতে লাগলেন, একজায়গায় দেখতে পেলেন, ঝোপঝাড় ঠেলে বেশ বড়সড় কোনও একটা প্রাণী দৌড়ে যাচ্ছে।

আরও দু বার গুলির শব্দ শোনা গেল, আওয়াজ যেন দু রকম।

সন্তু বলল, কাকাবাবুর কাছে রাইফেল নেই, অন্য কেউ…

সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু লাফিয়ে জিপ থেকে নেমে ছুটতে শুরু করল। রাজ সিংও এক হাতে রাইফেল আর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে দৌড়তে লাগলেন ঝিলের দিকে, জোজো প্রায় তাঁর পিঠ ছুঁয়ে রইল।

সন্তুই প্রথমে দেখতে পেল কাকাবাবুর একটা ক্রাচ। সেটা তুলে নিয়ে সে ব্যাকুলভাবে তাকাল এদিক-ওদিক।

রাজ সিং বললেন, ওই যে…

ঝিলের একেবারে ধার ঘেঁষে একপাশ ফিরে পড়ে আছেন কাকাবাবু। কপালে আর গালে রক্তের রেখা। সন্তুর বুকের মধ্যে যেন ভূমিকম্প হতে লাগল। এরকমভাবে শুয়ে আছেন কেন কাকাবাবু? বেঁচে নেই? জোজোর বাবা বলেছিলেন, ইচ্ছামৃত্যু…

সন্তু বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে।

ঠিক যেন একজন মৃত লোক বেঁচে ওঠার মতন কাকাবাবু অন্য পাশ ফিরে খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোরা আবার জিপ থেকে নামতে গেলি কেন? গোলাগুলি চলছিল, তোদের বিপদ হতে পারত!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 1 of 10 ): 1 23 ... 10পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *