সেই তালঢ্যাঙা লোকটার সঙ্গে
সেই তালঢ্যাঙা লোকটার সঙ্গে আমরা গুটি গুটি পায়ে বেরোলুম নেংটীশ্বরীর মন্দির থেকে। লোকটা বলল, এবার হাওয়া মহল। এই ডানদিকের সিঁড়ি।
একটা চওড়া সিঁড়ি ওপর দিকে উঠে গেছে, আমরা দেখতে পেলুম। এক সময়ে সিঁড়িটা খুব ভালো ছিল, পাথর-টাথর দিয়ে বাঁধানো ছিল বলে মনে হয়। এখন এখানে-ওখানে পাথর উঠে গিয়ে গর্ত হয়ে গেছে, এই দুপুর-বেলাতেও কেমন যেন একটা গুমোট অন্ধকার। মাঝে মাঝে রেলিং ভেঙে গেছে। লোকটা বললে, একটু সাবধানে এসো হে ইয়ে, কী বলে, সিঁড়িটা তেমন সুবিধের নয়। আমরাই কখনও কখনও আছাড়টাছাড় খাই। দুঃখের কথা আর কী বলব হে, আমাদের গুরুদেব বিটকেলানন্দ তো সিদ্ধপুরুষ, তা তিনিই একবার এমন কুমড়ো-গড়ান গড়ালেন যে–
হাবুল বললে, সিদ্ধপুরুষ অ্যাঁকেবারে ভাজাপুরুষ হইয়া গেলেন।
লোকটা থেমে দাঁড়িয়ে কটকট করে হাবুলের দিকে তাকালো। বললে, তুমি তো দেখছি ভারি ফক্কড় হে ছোকরা! গুরুদেবকে নিয়ে মস্করা।
ক্যাবলা বললে, ছেড়ে দিন, ওর কথা ছেড়ে দিন। ওটা একটা ঢাকাই পরোটা।
ঢাকাই পরোটা! তার মানে?
মানেটা বোঝার আগেই একটা চিৎকার ছাড়লুম আর গুরুজী বিটকেলানন্দের মতোই একটা কুমড়ো-গড়ান অনেক কষ্টে সামলে গেলুম। আমার দুকানে দুটো ঝাপটা মেরে ই-কি-কি বলতে বলতে একজোড়া চামচিকে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।
লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল :ভয় নেই হে, ওরা আমাদের পোষা। কিছু বলে না কাউকে।
টেনিদা ব্যাজার হয়ে বললে, কী যা-তা বলছেন। চামচিকে কারও পোষা হয়?
হয়—হয়। গুরুজী বিটকেলানন্দ চামচিকে তো দূরের কথা ছারপোকাকে পর্যন্ত বশ মানাতে পারেন। হয়তো ডেকে বললেন, এই খটমলনিকাল আও বাচ্চা—জেরা ড্যানস করো, অমনি দেখবে তক্তপোশের ফাটল থেকে দলে দলে ছারপোকা বেরিয়ে ট্যাঙ্গো নাচ শুরু করেছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ট্যাঙ্গো নাচ কাকে বলে?
লোকটা বললে, আমি কী করে জানব? অতই যদি জানব, তা হলে তো অ্যাঁদ্দিনে একটা কেষ্ট-বিষ্ণু হতে পারতুম। এসব ধাষ্টামো করে বেড়াতে হত না।
হাবুল মাথা চুলকোতে লাগল। ভেবে-চিন্তে বললে, তা হলে পাটকেলানন্দেরে ম্যাও ম্যাও-তে ধইর্যা লইয়া গ্যাল ক্যান? তিনি তো তাগোও ট্যাঙ্গো কইর্যা নাচাইতে পারতেন।
লোকটা আরশোলার মতো ঘাবড়ানোঘাবড়ানো মুখ করে বললে, বোকো না। এখন সবাই বেশ লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপ করে থাকো দিকি। এইবার কাজের কথা হবে। আমরা এসে গেছি।
সত্যিই আমরা এসে গিয়েছিলুম। দোতলায়। সামনেই একটা ফাটল ধরা ময়লা মতন মস্ত বড় ন্যাড়া ছাদ। আর এক কোনায় একটা ঘর। ঘরের সামনে বড় একটা খাঁচা, তার ভেতরে একটা বাদুড় নীচে মাথা দিয়ে ঝুলে রয়েছে। আমাদের দিকে ঘুম-ঘুম চোখ মেলে চেয়ে দেখল একার।
ক্যাবলা বলে, ও কী স্যার—ওখানে একটা বাদুড় কেন?
বাদুড় বোলো না, ওর নাম অবকাশঞ্জিনী।
অবকাশরঞ্জিনী! ক্যাবলা খাবি খেলো : বাদুড়ের কখনও অমন নাম হয়?
হয়—হয়। নামের তোমরা কী জানো হে? এসব গুরুদেবের লীলা। জানোউনি একটা ছারপোকার নাম দিয়েছেন বিক্রমসিংহ। আর এই-যে বাদুড় দেখছ, ইটি সামান্যি নয়। এই-যে অবকাশঞ্জিনী—এ খুব ভালো ধামার গাইতে পারে।
টেনিদা হঠাৎ গাঁ-গাঁ করে বললে, কিছু বিশ্বাস করি না—একদম গুল।
গুল?—লোকটা কী রকম যেন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল : বেশ, তা হলে এসব কথা থাক। এখন কাজের কথা হোক।
কার সঙ্গে কাজের কথা?—আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলুম : ওই অবকাশরঞ্জিনীর সঙ্গে নাকি?
চুপ!–ঠোঁটে আঙুল দিয়ে লোকটা বললে, দাঁড়াও।
সামনের ঘরটার দরজা ভেজানো ছিল। ঢ্যাঙা লোকটা আলগোছে একটা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। আর তক্ষুনি ভেতর থেকে যেন ক্যাঁকা করে বললে, দোহাই হুজুর, আমার জ্বর হয়েছে, ডিপথিরিয়া হয়েছে, পেটের মধ্যে রিং-ওয়ার্ম হয়েছে, কে জানে জলাতঙ্কও হয়েছে কিনা। আমি এখন যাকে-তাকে কামড়ে দিতে পারি। আমি কোনও কথাই জানিনে–হুজুর আমাকে ছেড়ে দিন।
আমরা দেখতে পেলুম, ঘরের ভেতরে মাদুর পাতা। তার ওপর একটা লোক একরাশ কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর খালি বিচ্ছিরি গলায় বলছে, আমার জলাতঙ্ক হয়েছে স্যার-মাইরি বলছি—এখন লোক পেলেই কামড়ে দেব।
তিন লাফ দিয়ে আমরা চারজন পিছিয়ে এলুম। ঢ্যাঙা লোকটা বললে, আঃ, কী হচ্ছে হে চক্রধর! খামকা ভদ্দরলোকের ছেলেদের ঘাবড়ে দিচ্ছ কেন? কম্বল ফেলেই চেয়ে দ্যাখোনা একবার। ম্যাও ম্যাও নেই, তারা অনেকক্ষণ চলে গেছে, আমি বিন্দেবন কথা কইছি।
শুনেই, কাঁথা-কম্বলের ভেতর যেন তুফান উঠল একটা। সেগুলোকে চারিদিকে ছিটকে ফেলে সোজা উঠে বসল একটা লোক যার বর্ণনা এর আগেই আমরা শুনেছি। আমরা চারজন দেখলুম, লোকটার কটকটে কালো রঙ, মুখে একটা ঝোল্লা গোঁফ, কপালের বাঁ-দিকে মস্ত আব। এই দারুণ গরমে কাঁথা-কম্বল চাপা দিয়ে সে ঘামে নেয়ে গেছে, কেমন ম্যাড়মেড়ে মুখ করে সে গঙ্গারামের মতো আমাদের দিকে চেয়ে রইল।
তারপর সে বিবেন,অথাৎ ঢ্যাঙা লোকটাকে বললে, তা তুমি এয়েচ, সেটা আগে কইতি কী হয়েচেল?
কইব কখন?—বিন্দেবন বিরক্ত হয়ে বললে, আমাদের সাড়া পেয়েই তুমি কাঁথার ভেতরে সেন্ধিয়ে ক্যাঁচর-ম্যাচর করতে লাগলে। বিদ্বেন দিব্যি তখন দেশী ভাষায় কথা বলতে লাগল।
সাবধানের বিনেশ নেই বুয়েচো না?—চক্রধর ফ্যাঁচ করে হেঁচে ফেলল : অ্যাঁই দ্যাকো—গরম কম্বল চাপিয়ে ঘেমে নেয়ে গেইচি, এখন বুঝি সর্দি লেগে গেল আবার। সে যাক—এঁয়ারা?
এঁয়ারা খদ্দের।
খদ্দের! আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকালাম। টেনিদা কী একটা বলতেও যাচ্ছিল, ক্যাবলা তার পাঁজরায় ছোট্ট একটা চিমটি কাটল, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম। আর চক্রধরও চোখ কুঁচকে আমাদের দিকে চেয়ে রইল—যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
বললে, খদ্দের? এত ছেলেমানুষ?
টেনিদা বললে, আমরা কলেজে পড়ি। ছেলেমানুষ নই।
তা বটে—তা হলে তো আর ছেলেমানুষ কওয়া যায় না।
বিন্দেবন মাথা নাড়ল : তা ছাড়া ওঁরা ছড়া বলেচেন; চাঁদনিতে তোমার দোকানেও গেছলেন।—বিন্দেবন আমাদের দিকে তাকাল : বুঝছেন তো, ইনিই হচ্ছেন গুরুদেবের প্রধান শিষ্য-পাটকেলানন্দ। একেই বাইরের লোক চক্রধর সামন্ত বলে জানে। বসুন-বসুন আপনারা!
আমরা মাদুরে বসে পড়লুম।
পাটকেলানন্দ ওরফে চক্রধর এবার গম্ভীর হয়ে ঝোল্লা গোঁফে তা দিলে। তারপর খানিকক্ষণ ভাবুক-ভাবুক মুখ করে চোখ বুজে বসে রইল। সে যে আর চক্রধর নয়, একেবারে মূর্তিমান পাটকেলানন্দ, সেইটেই যেন বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল আমাদের। এতক্ষণ যে কম্বলের তলায় পড়ে ক্যাঁক্যাঁ করছিল, এখন আর তা বোঝবারও জো নেই।
বাইরে বাদুড়টা হঠাৎ খ্যাঁচম্যাচে আওয়াজ করে উঠল।
সেই আওয়াজে চক্রধর চোখ খুলল।
ঠিক আছে। অবকাশরঞ্জিনী সাড়া দিয়েছে। ঠিক আছে।
টেনিদা বোকার মতো বললে, মানে?
মানে অবকাশরঞ্জিনীর ভেতরে গুরুদেব যোগশক্তি সঞ্চার করেছেন। ও ক্যাঁচমেচিয়ে উঠলেই আমরা বুঝতে পারি, কোথাও কোনও গোলামাল নেই।
যদি ক্যাঁচম্যাচ না করে?—আমি জানতে চাইলুম।
তা হলে খোঁচা দিতে হয়।
যদি তাও চুপ কইরা থাকে?–হাবুল কৌতুহলী হল।
তখন বুঝতে হবে ব্যাপার খুব সঙ্গিন। তখন তক্তপোশের ফাটল থেকে বিক্ৰমসিংহকে ডাকতে হবে। যাকগে, সে সব অনেক কথা।—চক্রধর বললে, তা হলে আপনারা চারজন?
টেনিদা বললে, হুঁ, চারজন।
কোথায় থাকেন?
—পটলডাঙা।
ছড়া বলুনসঙ্গে সঙ্গে নামতা পড়ার মতো আমরা কোরাসে আরম্ভ করলুম : চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর–
চক্রধর বললে, থাক–থাক, আর দরকার নেই। চন্দ্রকান্তকে ওখানে গিয়েই। পাবেন—মানে মহিষাদলে। এই বিলেবনই আপনাদের নিয়ে যাবে। টাকার রসিদ আছে তো?
টাকার রসিদ! আমি চমকে কী বলতে যাচ্ছিলুম, ক্যাবলা আমাকে একটা খোঁচা মারল। তারপর বললে,আজ্ঞে হ্যাঁ, রসিদ-উসিদ সব আছে। বাড়িতে রেখে এসেছি।
তা হলে আর কী? কবে যাবেন?
ক্যাবলা ফস করে বললে, রবিবার?
সে তো বেশ কথা। আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবেন। ভোর ছটার মধ্যে এলে চটপট চলে যেতে পারবেন, সন্দের মধ্যে ফিরেও আসতে পারবেন। রাজি?
আমরা কিছু বলার আগেই ক্যাবলা বললে, রাজি।
তা হলে এই কথা রইল।—চক্ৰধর আবার ফ্যাঁচ করে বেঁচে উঠল : ইঃ, জব্বর সর্দিটাই লাগল। খামকা ক্যাঁথা কম্বল চাপিয়ে মরুকগে, এখন মা নেংটীশ্বরীকে প্রণাম করে বাড়ি চলে যান। আর রবিবারে ভোর ছটায় আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবেন। ঠিক?
ক্যাবলা বললে, ঠিক।
জয় মা নেংটীশ্বরী—তোমারই ইচ্ছে মা!—চক্রধর শিবনেত্র হয়ে যেন ধ্যানে বসল। তারপর বললে, হাঁ, আর একটা কথা। যাবার আগে অবকাশরঞ্জিনীর ভোগের জন্য সপাঁচ আনা পয়সা রেখে যাবেন মনে করে।