মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া
যা ভাবা যায়, সেটা যখন না হয়–তখন মনের অবস্থাটা আবার স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সিংঘানিয়ার নামটার সঙ্গে সিংহের মিল আছে বলে বোধহয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে আশা করেছিলাম। যিনি এলেন তাঁর মাঝারি গড়ন, মেজাজে মাঝারি গাম্ভীৰ্য্য, গলার স্বর সরুও নয় মোটাও নয়। শুধু একটা মোটা পাকানো গোঁফে বলা যায় কিছুটা ভারিক্কি ভাব এসেছে।
মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া বললেন ভদ্রলোক–প্লিজ সিট ডাউন।
আমরা তিনজনে দুটো গদিতে ভাগাভাগি করে বসলাম, সিংঘানিয়া বসলেন তৃতীয় গদিতে সোজা আমাদের দিকে মুখ করে। কথা হল ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে।
সিংঘানিয়া বললেন, আপনার খ্যাতির সঙ্গে আমি পরিচিত মিঃ মিটার, কিন্তু আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়নি।
ফেলুদা বলল, বিপদে না পড়লে তো আর আমার ডাক পড়ে না, তাই আলাপ হবার সুযোগও হয় না।
আমি অবিশ্যি আপনাকে বিপদে পড়ে ডাকিনি।
তা জানি, বলল ফেলুদা।আপনার নামও কিন্তু আমি শুনেছি। অবিশ্যি সিংঘানিয়া তো অনেক আছে, কাজেই যাঁর নাম শুনেছি, তিনিই আপনি কিনা বলতে পারব না।
আই অ্যাম ভেরি ইন্টারেস্টেড টু নো, আপনি কী ভাবে আমার নাম শুনলেন।
আপনি হরিদ্বার গিয়েছিলেন কখনও?
সার্টেনলি।
সেখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
করেছিলাম। বাইকী; কিন্তু আপনি সেটা জানলেন কী করে?
উপাধ্যায়ের বাড়িওয়ালা আমাকে বলেছিলেন যে, মিঃ সিংঘানিয়া এবং আর একজন ভদ্রলোক উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
আর কিছু বলেননি?
বলেছিলেন যে উপাধ্যায়কে নাকি আপনি লোভে ফেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু উপাধ্যায় সেটা কাটিয়ে ওঠে।
হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ ম্যান, দিস উপাধ্যায়! আমি এমন লোক আর দ্বিতীয় দেখিনি। ভেবে দেখুন। মিঃ মিটার-লোকটার রোজগার মাসে পাঁচশো টাকার বেশি নয়, কারণ গরিবদের সে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। সেই লোককে আমি পাঁচ লাখ টাকা অফার করুলাম। আপনি জানেন বোধহয় যে, ওঁর কাছে একটা অত্যন্ত ভ্যালুয়েক্ল লকেট আছে—খুব সম্ভবত এককালে সেটা ট্র্যাভাঙ্কোরের মহারাজার ছিল।
সে তো জানি, কিন্তু আমার জানার কৌতুহল হচ্ছে, আপনি এই লকেটের খবরটা জানলেন কী করে। ওটা তো রাজার পাঁচ-ছ জন খুব কাছের লোক ছাড়া আর কারও কাছে প্রচার হয়নি।
আমি খবরটা জেনেছিলাম। সেই কাছের লোকেদের একজনের কাছ থেকেই। আমার জুয়েলারির ব্যবসা আছে দিল্লিতে। আমার কাছে এই লকেটের খবর আনে রূপনারায়ণগড়ের ম্যানেজার মিঃ পুরীর ছেলে দেবীশঙ্কর পুরী। সে আমাকে লকেটা কিনতে বলে। ন্যাচারেলি হি এক্সপেক্টেড এ পারসেনটেজ। আমরা গেলাম হরিদ্ধার। উপাধ্যায় রিফিউজ করলেন। পুরীর উৎসাহ চলে গেল। কিন্তু আমি ওটা কেনার লোভ ছাড়তে পারছি না। আমার মনে হয়, এখনও চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যাবে। তখন তিনি ডাক্তারি করছিলেন, লোকের সেবা করছিলেন, এখন হি ইজ এ সন্ন্যাসী। একজন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর ওই রকম একটা পার্থিব সম্পদের উপর কোনও আসক্তি থাকবে, এটা ভাবতে একটু অদ্ভুত লাগছে না? আমি চাই, ওঁকে আর একবার অ্যাপ্রোচ করতে।
বেশ তো, করুন না।
দ্যাট ইজ ইম্পসিবল, মিঃ মিটার।
কেন?
উনি এমন জায়গায় থাকেন, সেখানে আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
করুন।
প্রধানত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। তবে উপাধ্যায় লোকটার উপর আমার একটা শ্রদ্ধা রয়েছে। তার যদি কোনও অনিষ্ট হচ্ছে দেখি, তা হলে কিন্তু আমি বাধা দেব।
ইউ আর অ্যাকটিং অ্যাজ এ ফ্রি এজেণ্ট? আপনাকে কেউ এমপ্লয় করেনি?
না।
আপনি আমার হয়ে কাজ করবেন?
কী কাজ?
আপনি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে বলে লকেটটা এনে দিন। আমি আপনাকে পাঁচ লাখের টেন পার্সেণ্ট দেব। উনি যদি নিজে টাকা না নেন, তা হলে ওঁর। যদি কোনও উত্তরাধিকারী থাকে, তাকে আমি টাকাটা দেব।
কিন্তু এই লকেট সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড়ি আরও কয়েকজন। এখানে রয়েছে, আপনি জানেন সেটা?
রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার তো?
আপনি জানেন?
জানতাম না। আজ বিকেলেই ভার্গব বলে এক সাংবাদিক এসেছিল। কেদারে এসেও যে সাংবাদিকদের উৎপাত সহ্য করতে হবে, সেটা ভাবিনি। যাই হাক, সে-ই খবরটা দিল। কিন্তু ছোটকুমার তো ফিল্ম তুলতে এসেছে।
জানি। কিন্তু তাতে উপাধ্যায় আর লকেটের একটা বড় ভূমিকা আছে।
সিংঘানিয়ার চেহারাটা এবার একটা ইঁদুরের মতো হয়ে গেল। সে হাতজোড় করে বলল–
দোহাই মিঃ মিটার—প্লিজ হেল্প মি
আপনি ভার্গবকে এ সব নিয়ে কিছু বলেননি তো?
পাগল! আমি বলেছি তীর্থ করতে এসেছি। কেদারে আসার আর কোনও কারণ থাকার দরকার আছে কি?
ভার্গব লোকটাও উপাধ্যায় সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড; তবে খবরের কাগজের খোরাক হিসেবে।
আপনি কিন্তু এখনও আমার কথার উত্তর দেননি।
মিঃ সিংঘানিয়া–আমি এইটুকু বলতে পারি যে, আপনার প্রস্তাব আমি উপাধ্যায়কে জনাব। তবে আমার ধারণা যে তিনি যদি লকেটটা নিজে না রাখেন, তবে সেটা হয়তো অন্য কাউকে দিয়ে যেতে চাইবেন। কাজেই এখন কোনও পাকাপাকি কথা বলার দরকার নেই; তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে, কেমন?
ভেরি গুড।
*
বাইরে রাত। কেদার শহর ঝিমিয়ে পড়েছে। বাড়ির বাতি, রাস্তার বাতি, দোকানের বাতি-সবই যেন ধুঁকছে। তারই মধ্যে এক জায়গায় বেশ একটা উজ্জ্বল আলো দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি, ছোটকুমার পবনদেও একটা ব্যাটারির আলো জ্বলিয়ে কেদারের গলির ফিল্ম তুলছে। আমাদের দেখে শুটিং থামিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করল, উপাধ্যায়ের কোনও খবর পেলেন?
ফেলুদা উত্তর না দিয়ে একটা পালটা প্রশ্ন করল–
আপনি উঠেছেন কোথায়?
এখানে পাণ্ডারা ঘর ভাড়া দেয়, জানেন তো? তারই একটাতে রয়েছি—এই বাঁয়ের রাস্তা দিয়ে দুটো বাড়ির পরে ডান দিকের বাড়ি।
ঠিক আছে–আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি, বলল ফেলুদা। আমরা এগিয়ে গেলাম। আমাদের ধরমশালার দিকে।
লালমোহনবাবু হঠাৎ মন্তব্য করলেন, ছোটকুমার কেমন লোক জানি না মশাই, কিন্তু সিংঘানিয়া লোকটা ধড়িবাজ আছে।
কী করে জানলেন? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
আপনি যেখানে বসেছিলেন, সেখান থেকে বোধ হয় দেখতে পাননি, কিন্তু আমি দেখলাম, লোকটার কেটের বাঁ পকেটে একটা ক্যাসেট রেকডার। কথা শুরু হবার আগে সেটা টুক করে চালু করে দিল।
ধড়িবাজের উপর আবার ধড়িবাজতর হয় জানেন তো?
ফেলুদাও তার পকেট থেকে মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারটা বার করে দেখিয়ে দিল।
আপনি কি ভাবছেন যে, এটা আমি-
ফেলুদার কথা শেষ হল না, কারণ কাঁধে একটা ঘা খেয়ে ততক্ষণে সে মাটিতে পড়ে গেছে। গলির এই অংশটা নিরিবিলি, সেই সুযোগে পাশের কোনও গলি থেকে একটা লোক আচমকা বেরিয়ে এসে ওই কাণ্ডটি করেছে।
মুহূর্তের মধ্যে একটা তুলাকালাম কাণ্ড হয়ে গেল।
লোকটা মেরেই পালাচ্ছিল; আমি তার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তার কোমরটা দু হাতে জাপটে ধরে তাকে দেয়ালে চেপে ধরলাম। সেও পালটা চাপ দিয়ে আমাকে ঠেলে সরিয়ে পালাতে যাচ্ছিল, এমন সময় লালমোহনবাবু তার হাতের অস্ত্রটা দিয়ে তাকে এক ঘায়ে ধরাশায়ী করে দিলেন।
অস্ত্রটা আর কিছুই না, গৌরীকুণ্ডে দুটাকা দিয়ে কেনা সেই লোহা-লাগানো লাঠি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, লোকটার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে কিন্তু সেই অবস্থাতেই সে আবার উঠে, এক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল!
এদিকে ফেলুদা উঠে বসেছে। বাঝাই যাচ্ছে সে বেশ কারু। আমরা দু জন দু দিক থেকে তাকে ধরে তুললাম। আমাদের ধরমশালায় প্রায় পৌঁছে গেছি। শেষ পথটুকু ফেলুদা শুধু একটা কথাই বলল, কেদারেও তাহলে গুণ্ড এসে পৌঁছে গেছে!
কপাল-জোরে আমাদের পাশের ঘরেই একজন বাঙালি ডাক্তার পাওয়া গেল, নাম অধীর সেন। অধীরবাবু আবার ফেলুদাকে চিনে ফেললেন, কাজেই যত না জখম, তার তুলনায় শুশ্রুষাটা একটু বেশিই হল। ডান কাঁধে একটা জায়গায় কেটে গিয়েছিল, সেখানে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ড-এন্ড দিয়ে দিলেন। বললেন, ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না, সেটা তো এক্স-রে না করলে বোঝা যাবে না!
ফেলুদা বলল, ফ্র্যিাকচারই হোক আর যাই হাক, আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখতে পারবেন না, এটা আগে থেকেই বলে দিলাম।
ফি-এর কথা জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক জিভ-টিভ কেটে একাক্কার-তবে ব্যাপারটা কী জানেন, মিঃ মিত্তির। এই নিয়ে আমার তিনবার হল কেদার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন ছিল তেমনই আছে, কিন্তু ক্ৰমে অ্যান্টি-সোশ্যাল এলিমেণ্টস ঢুকে পড়ছে। শহরে। এর জন্য দায়ী কী জানেন তো? আমাদের যানবাহনের সুব্যবস্থা। এক দিকে ভাল করেন তো অন্য দিক দিয়ে খারাপ ঢুকে পড়ে–এই তো দেখে আসছি জগতের নিয়ম।
কালীকমলীর ম্যানেজার নিজের বুদ্ধি খাটিয়েই এখানকার পুলিশকে খবর দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফেলুদা তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলল। বুঝতে পারলাম যে, নানা রকম নির্দেশ দেওয়া হল, এবং সবই দারোগা সাহেব অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনে নিলেন।
পুলিশ চলে যাবার পর সাংবাদিক মিঃ ভার্গব এসে হাজির-শুনলাম আপনার লাইফের উপর একটা অ্যাটেম্পট হয়ে গেছে?
গোয়েন্দার জীবনে এ তো দৈনন্দিন ঘটনা, মিঃ। ভার্গব। এখানকারই কোনও গুণ্ডা হয়তো পকেট মারতে চেয়েছিল, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।
আপনি বলতে চান, আপনার কোনও তদন্তের সঙ্গে এর কোনও কানেকশন নেই?
তদন্ত আবার কোথায়? আমি তো এখানে এসেছি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
ভাল কথা, তিনি কোথায় থাকেন সে খবর পেয়েছেন?
আপনি পেয়েছেন?
উপাধ্যায় বলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না।
তা হলে ভদ্রলোক হয়তো নাম বদলেছেন।
তাই হবে।
ফেলুদা আসল ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেল। ভার্গব কিছুটা নিরাশ হয়েই যেন চলে গেলেন।
কাল সকাল সকাল উঠতে হবে বলে আমরা সাড়ে আটটার মধ্যে পুরি-তরকারি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ার আয়োজন করতে লাগলাম। এই সময় ফেলুদা যে ব্যাপারটা করল, সেটা কিন্তু আমি আর লালমোহনবাবু মোটেই অ্যাপ্রভ করতে পারলাম না। ও বলল, তোরা দুজনে শুয়ে পড়, আমি একটু ঘুরে আসছি।
ঘুরে আসছি মানে? আমি অবাক এবং কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। আমি জানি, ওর কাঁধে এখনও বেশ ব্যথা। কোত্থেকে ঘুরে আসছ?
একবার ছোটকুমারের সঙ্গে দেখা করা দরকার।
সে কী, তুমি সোজা এনিমি ক্যাম্পে চলে যাবে?
আমার এ রকম অনেক বার হয়েছে রে তোপ্সে। একটা চাট খেয়ে বুদ্ধিটা খুলে গেছে। এবারও তাই। পবনদেও আমাদের শত্রু না।
তবে?
আসল শত্ৰু কে, সেটা জানতে পারবি খুব শিগগিরই।
কিন্তু তুমি বেরোবে, আর শক্ৰ যদি এখন ওঁত পেতে থাকে?
আমার সঙ্গে অস্ত্ৰ আছে। তোরা শুয়ে পড়ে। আমি যখনই ফিরি না কেন, কালকের প্রোগ্রামে কোনও চেঞ্জ নেই। গান্ধী সরোবর। ভোর সাড়ে চারটায় রওনা হচ্ছি।
সঙ্গে রিভলভার আর একটা বড় টর্চ নিয়ে ফেলুদা চলে গেল।
তোমার দাদার সাহসের জবাব নেই, বললেন জটায়ু।