শিষ্টতার প্ৰবল ধাক্কা
শিষ্টতার এই প্ৰবল ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাঁর ঘর কোনটা?’
‘ঐ যে পাঁচ নম্বর ঘর।’
পাঁচ নম্বর ঘরের দ্বারে তালা লাগানো ছিল, ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘এর চাবি কোথায়?’
ম্যানেজার বলিলেন, ‘আমার কাছে একটা চাবি আছে, কিন্তু—‘
‘খুলুন।’
চাবির থোলো পকেট হইতে বাহির করিতে করিতে ম্যানেজার উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিলেন, ‘কি–কি হয়েছে ব্যোমকেশবাবু?’
‘বিশেষ কিছু নয়; যে ভদ্রলোকটি এই ঘরে ছিলেন তিনি একজন দাগী আসামী।’
ম্যানেজার তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া ব্যোমকেশ একবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘তিনি তো কিছুই নিয়ে যাননি দেখছি। বাক্স বিছানা সবই রয়েছে।’
ম্যানেজার বলিলেন, ‘তিনি কেবল ছোট হ্যান্ডব্যাগ আর জলের কুঁজে নিয়ে গেছেন–আর সবই রেখে গেছেন। বললেন, দুচার দিনের মধ্যে ফিরবেন, আমিও ভাবলুম–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক কথা। আপনি এবার থানার দারোগা বীরেনবাবুর কাছে খবর পাঠান—তাঁকে জানান যে চোরের সন্ধান পাওয়া গেছে, তিনি যেন শীগগির আসেন। —আমরা ততক্ষণে এই ঘরটা একবার দেখে নিই।’
ম্যানেজার প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ ঘরের আসবাবপত্রের মধ্যে অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। এই মেসের প্রায় সব ঘরগুলিই বড় বড়, প্রত্যেকটিতে দু’ বা তিনজন করিয়া ভদ্রলোক থাকিতেন। কেবল এই পাঁচ নম্বর ঘরটি ছিল ছোট, একজনের বেশি থাকা চলিত না। ভাড়াও কিছু বেশি পড়িত, তাই ঘরটা অধিকাংশ সময় খালি পড়িয়া থাকিত। যিনি মেসে থাকিয়াও স্বাতন্ত্র্য ও নিভৃততা রক্ষা করিতে ইচ্ছুক তাঁহার পক্ষে ঘরটি চমৎকার।
ঘরে গোটা দুই ট্রাঙ্ক ও বিছানা ছাড়া আর বিশেষ কিছু ছিল না। ব্যোমকেশ বিছানাটা পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, ‘শীতের সময়, অথচ লেপ তোষক বালিশ কিছুই নিয়ে যাননি। অর্থাৎ–বুঝেছ?’
‘না। কি?’
‘অন্যত্র আর একসেট বন্দোবস্ত আছে।’
ব্যোমকেশ বিছানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি কি আশা করছি দেশলায়ের বাক্সটা তিনি এই ঘরে রেখে গেছেন?’
‘না।–তাহলে তিনি ফিরে এলেন কেন? আমি খুঁজছি। তার বর্তমান ঠিকানা; যদি কোথাও কিছু পাই যা-থেকে তাঁর প্রকৃত নামধামের কিছু ইশারা পাওয়া যায়। তাঁর সত্যিকারের নাম যে ব্যোমকেশ বসু নয় এটা বোধ হয় তুমিও এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে।’
‘মানে—কি বলে—হ্যাঁ, পেরেছি বৈকি। কিন্তু ‘ব্যোমকেশ’ ছদ্মনাম গ্রহণ করবার উদ্দেশ্য কি?’
বিছানার উপর বসিয়া ব্যোমকেশ ঘরের এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে বলিল, ‘উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা সাধন। অজিত, প্রতিহিংসার মনস্তত্ত্বটা বড় আশ্চর্য। তুমি গল্প-লেখক, সুতরাং মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সবই জানো। তোমাকে বলাই বাহুল্য যে নেপথ্য থেকে প্ৰতিহিংসা সাধন করে মানুষ সুখ পায় না; প্রত্যেকটি আঘাতের সঙ্গে সে জানিয়ে দিতে চায় যে সে প্রতিহিংসা নিচ্ছে। শত্ৰু যদি জানতে না পারে কোথা থেকে আঘাত আসছে, তাহলে প্রতিহিংসার অর্ধেক আনন্দই ব্যর্থ হয়ে যায়। ইনি তাই একেবারে আমার বুকের ওপর এসে চেপে বসেছিলেন। এটা যদি সুসভ্য বিংশ শতাব্দী না হয়ে প্রস্তর-যুগ হত, তাহলে এত ছল চতুরীর দরকার হত না, উনি একেবারে পাথরের মুগুর নিয়ে আমার মাথায় বসিয়ে দিতেন। কিন্তু এখন সেটা চলে না, ফাঁসি যাবার ভয় রয়েছে। মোট কথা, প্ৰতিহিংসার পদ্ধতিটা বদলেছে বটে। কিন্তু মনস্তত্ত্বটা বদলায়নি। আজ যে উনি আমার মৃত মুখখানা দেখবার জন্যে শ্রীরামপুরে ছুটেছিলেন, সেও ওই একই মনোভাবের দ্বারা পরিচালিত হয়ে।’ ব্যোমকেশ খামখেয়ালী গোছের হাসিল–’চিঠিখানার কথা মনে আছে তো, সেটা আমারই উদ্দেশ্যে লেখা এবং উনি নিজেই লিখেছিলেন। তার বাহ্য কৃতজ্ঞতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল অতি ক্রূর ইঙ্গিত। তিনি যতদূর সম্ভব পরিষ্কার ভাবেই লিখে জানিয়েছিলেন যে তিনি ভোলেননি–ঋণ পরিশোধ করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছেন। আমরা অবশ্য তখন চিঠির মানে ভুল বুঝেছিলাম, তবু–আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। তোমার বোধহয় মনে আছে।’
সেই চিঠিতে লিখিত কথাগুলো যেন এখন নূতন চক্ষে দেখিতে পাইলাম। বলিলাম, ‘মনে আছে। কিন্তু তখন কে জানত–; আচ্ছা, লোকটা তোমার কোনও পুরনো শত্ৰু–না?’
‘তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।’
‘লোকটা কে তা কিছু বুঝতে পারছি না?’
‘বোধহয় একটু একটু পারছি। কিন্তু এখন ও কথা যাক, আগে তাঁর বাক্সগুলো দেখি।’
একটা বাক্সের চাবি খোলাই ছিল, তাহাতে দৈনিক ব্যবহার্যকাপড়-চোপড় ছাড়া আর কিছু ছিল না। অন্যটার তালা লইয়া ব্যোমকেশ দু’একবার নাড়াচাড়া করিয়া একটু চাপ দিতেই সেটাও খুলিয়া গেল। ভিতরে কয়েকটা গরম কোট পাঞ্জাবি ইত্যাদি রহিয়াছে। সেগুলা বাহির করিয়া তলায় অনুসন্ধান করিতে এক শিশি স্পিরিট-গাম ও কিছু বিনুনিকরা ক্রেপ চুল বাহির হইয়া পড়িল। সেগুলি তুলিয়া ধরিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ, মুখে যার অ্যাসিড ছাপ মেরে দিয়েছে তাকে মাঝে মাঝে গোঁফ দাড়ি পরে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয় বৈকি। এই সব পরে সম্ভবত ইনি ট্রামে আমার দেশলাই বদলে নিয়েছিলেন।’
ক্ৰেপ ইত্যাদি সরাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ আবার কয়েকটা জিনিস দুই হাতে বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিল, বলিল, ‘কিন্তু এগুলো কি?’
মোমজামার মত খানিকটা কাপড়ে কি কতকগুলা জড়ানো রহিয়াছে। ব্যোমকেশ সাবধানে সেগুলা মেঝের উপর রাখিয়া মোড়ক খুলিল। একটি আধা আউন্সের খালি শিশি, কয়েকখণ্ড সীলমোহর করিবার লাল রংয়ের গালা ও অর্ধ-দগ্ধ একটি মোমবাতি রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ শিশির ছিপি খুলিয়া আঘ্রাণ গ্ৰহণ করিল, মোমবাতি ও গালা খুব মনোযোগের সহিত দেখিল, শেষে, মোমজামাটা তুলিয়া লইয়া পরীক্ষা করিল। দেখিলাম সাধারণ মোমজামা নয়, খুব ভাল জাতীয় ওয়াটারপ্রুফ কাপড়–ঈষৎ নীলাভ এবং স্বচ্ছ-আয়তনে একটা রুমালের মত। বর্তমানে তাহার একটা কোণের প্রায় সিকি ভাগ কাপড় নাই–মনে হয় কোনও কারণে ছিঁড়িয়া লওয়া হইয়াছে।
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘শিশি, গালা, মোমবাতি এবং ওয়াটারপ্রুফের একত্র সমাবেশ।
মানে বুঝতে পারলে?’
‘না–কি মানে?’
‘ওয়াটারপ্রুফ থেকেও কিছু আন্দাজ করতে পারলে না?’
হতাশভাবে বলিলাম, ‘কিছু না। তুমি কি বুঝলে?’
‘সবই বুঝেছি, শুধু ভদ্রলোকের বর্তমান ঠিকানা ছাড়া।–চল, এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়েছে।’
এই সময় ম্যানেজারবাবু ফিরিয়া আসিলেন, বলিলেন, ‘দারোগাবাবুকে খবর দিয়েছি, তিনি এলেন বলে।‘
‘বেশ।–আচ্ছা ম্যানেজারবাবু্, আমার এই মিতেটি যখন চলে গেলেন তখন আপনি নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে সদর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, গিয়েছিলুম।’
‘ট্যাক্সির নম্বরটা আপনার চোখে পড়েনি?’
মাথা নাড়িয়া ম্যানেজার বলিলেন, ‘আজ্ঞে না। নীল রঙের পুরনো ট্যাক্সি—ড্রাইভার একজন শিখ—এইটুকুই লক্ষ্য করেছিলুম।’
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সে সময় দোরের কাছে আর কেউ ছিল?’
ম্যানেজার ভাবিয়া বলিলেন, ‘ভদ্রলোক কেউ ছিলেন বলে তো মনে পড়ছে না, তবে আপনাদের চাকর পুঁটিরাম দাওয়ায় বসেছিল। আপনারা বাসায় ছিলেন না, তাই সে বোধহয় একটু—’
নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুঁটিরাম থাকা না-থাকা সমান। সে তো আর ইংরিজি জানে না, কাজেই ট্যাক্সির নম্বর চোখে দেখলেও পড়তে পারবে না।–চল অজিত, দেড়টা বাজল, পেটও বাপান্ত করছে। ম্যানেজারবাবু্, এবেলা দুটি ভাত আমাদের দিতে হবে। অবশ্য যদি অসুবিধা না হয়।’
ম্যানেজার সানন্দে বলিলেন, ‘বিলক্ষণ! অসুবিধে কিসের! ব্যোমকেশবাবুর-মানে, দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর–ভাত হাঁড়িতেই আছে, তিনি তো খাননি। আপনারা স্নান করুনগে, আমি ভাত পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘মন্দ ব্যবস্থা নয়। দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর বাড়া ভাত এক নম্বর ব্যোমকেশবাবু খাবেন। দুনিয়াতে এই ব্যাপার তো হরদম চলছে—কি বল অজিত? এখন দুনম্বর ব্যোমকেশবাবু কোথায় বসে কার ভাত খাচ্ছেন সেইটে জানতে পারলে বড় খুশি হতুম।’
আহার তখনো শেষ হয় নাই, বীরেনবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কোনও রকমে অন্ন গলাধঃকরণ করিয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিতেই বীরেনবাবু উঠিয়া প্রশ্ন-ব্যাকুল নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে তাকাইলেন। তাহার সমস্ত দেহ একটা জীবন্ত জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার ধারণ করিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার এখনো খাওয়া হয়নি দেখছি।’
‘না। খাবার জন্যে বাড়ি যাচ্ছিলুম। এমন সময় আপনার ডাক পেলুম। —কি হল ব্যোমকেশবাবু? ধরেছেন তাকে?’
‘বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে কিছু খাবার আনিয়ে দিই।’
‘খাবার দরকার নেই। তবে যদি এক পেয়াল চা–?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বেশ। এবং সেই সঙ্গে দুটো নিষিদ্ধ ডিম। —পুঁটিরাম।’
পুঁটিরাম হুকুম লইয়া প্রস্থান করিলে পর, ব্যোমকেশ বীরেনবাবুকে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করিয়া বলিল। তাঁহাকে না বলিয়া এত কাজ করা হইয়াছে, ইহাতে বীরেনবাবু একটু আহত হইলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে যথা সম্ভব মিষ্ট করিয়া সাত্ত্বিনা দিল, তথাপি তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বলিলেন, ‘আমি যদি জানতুম তাহলে সে এমন হাত-ফসকে পালাতে পারত না। এখন তাকে ধরা কঠিন হবে। এতক্ষণে সে হয়তো কলকাতা থেকে বহু দূরে চলে গেছে।’
ব্যোমকেশ মেঝের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, ‘আমার কিন্তু মনে হয় সে কলকাতাতেই আছে। কারণ সে মার্কা-মারা লোক, ওরকম মুখ নিয়ে মানুষ বেশি দূর পালাতে পারে না। কলকাতা শহরই তার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ।’
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘তাহলে এখন কর্তব্য কি? তার চেহারার বর্ণনা দিয়ে ইস্তাহার জারি করা ছাড়া আর তো কোনো পথ দেখছি না।’
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘ওটা তো হাতেই আছে। কিন্তু তার আগে-যদি ট্যাক্সির নম্বরটা পাওয়া যেত—‘
ইতিমধ্যে পুঁটিরাম চা ইত্যাদি আনিয়া বীরেনবাবুর সম্মুখে রাখিতেছিল, ব্যোমকেশ তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘পুঁটিরাম, তোমার ইংরিজি শেখা দরকার, আজই একখানা প্যারী সরকারের ফার্স্টবুক কিনে আনবে। অজিত আজ থেকে তোমাকে ইংরেজি শেখাবে।’
অবাস্তুর কথায় বীরেনবাবু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশের দিকে চাহিলেন, ব্যোমকেশ বলিল, ‘ও যদি ইংরিজি জানত তাহলে আজ কোনও হাঙ্গামাই হত না।’ পুটরামের দ্বারের কাছে অবস্থিতি ও ট্যাক্সি দর্শনের কথা বলিয়া ব্যোমকেশ বিমৰ্ষভাবে মাথা নাড়িল।
পুঁটিরাম মুখের সম্মুখে মুষ্টি তুলিয়া সসম্ভ্রমে একটু কাশিল—
‘আজ্ঞে—‘
‘কি?’
‘আজ্ঞে টেক্সির লম্বর আমি দেখেছি।‘
‘তা দেখেছ–কিন্তু পড়তে তো পারেনি।’
‘আজ্ঞে, পড়তে পেরেছি। চারের পিঠে দুটো শূন্য, তারপর আবার একটা চার।’
আমরা তিনজনে অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুই ইংরিজি পড়তে জনিস?
‘আজ্ঞে না।’
‘তবে?’
‘বাংলাতে লেখা ছিল বাবু্, সেই জন্যেই তো চোখে পড়ল।’
আমরা চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া রহিলাম। তারপর ব্যোমকেশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—’বুঝেছি।’ পুঁটিরামের পিঠ চাপড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘বহুত আচ্ছা! পুঁটিরাম, আজ থেকে—তোমার মাইনে এক টাকা বাড়িয়ে দিলুম।’
পুটিরাম সহৰ্ষে এবং সলজ্জে বলিল, ‘আজ্ঞে, বাইরের দাওয়ায় বসেছিলুম, টেক্সিতে বাংলা লম্বর দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলুম। তাইতো লম্বরটা মনে আছে হুজুর।’
বীরেনবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘কিন্তু ব্যাপারটা কি? ট্যাক্সিতে বাংলা নম্বর এল কোত্থেকে?
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বাংলা নয়–ইংরিজি নম্বরই ছিল। কিন্তু আমাদের ভাগ্যক্রমে সেটা বাংলা হয়ে পড়েছিল। বুঝলেন না? আসলে নম্বরটা ৮০০৮, পুঁটিরাম তাকে পড়েছে। ৪০০৪ Ι
‘ওঃ–’ বীরেনবাবুর চক্ষুদ্বয় ও অধরোষ্ঠ কিছুক্ষণ বর্তুলাকার হইয়া রহিল।
অবশেষে ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে আর দেরি করে লাভ কি? বীরেনবাবু্, এ তো আপনার কাজ। নীল রংয়ের গাড়ি, চালক শিখ, নম্বর ৮০০৮–খুঁজে বার করতে বেশি কষ্ট হবে না। আপনি তাহলে বেরিয়ে পড়ুন, খবরটা যত শীঘ্ৰ পাওয়া যায় ততই ভাল।’
‘আমি এখনি যাচ্ছি—‘ বীরেনবাবু উঠিয়া এক চুমুকে চা নিঃশেষ করিয়া বলিলেন, ‘সন্ধ্যের আগেই আশা করি খবর নিয়ে আসতে পারব।’
‘শুধু খবর নয়, একেবারে গাড়ি ড্রাইভার সব নিয়ে হাজির হবেন। ইতিমধ্যে আমি কমিশনার সাহেবকে টেলিফোন যোগে খবরটা জানিয়ে দিই। তিনি নিশ্চয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’
গমনোদ্যত বীরেনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আসামীর নাম বা পূর্ব পরিচয় সম্বন্ধে আপনি কোনও খবর দিতে পারেন না?’
‘নির্ভুল খবর এখন দিতে পারি। কিনা জানি না, তবু–’ এক টুকরা কাগজে একটা নম্বর লিখিয়া তাঁহার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আলিপুর জেলে এই কয়েদীর ইতিহাস খুলে হয়তো কিছু পরিচয় পাবেন।‘
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘লোকটা তাহলে দাগী?’
‘আমার তো তাই মনে হয়। কাল সকালে তার খোঁজ করে নম্বরটা বার করেছিলুম, কিন্তু তার জেলের ইতিহাস পড়বার ফুরসত হয়নি। আপনি সরকারী লোক, এ কাজটা সহজেই পারবেন–অফিসের মারফত। কেমন?’
‘নিশ্চয়।’
বীরেনবাবু কাগজটা সাবধানে ভাঁজ করিয়া পকেটে রাখিয়া প্রস্থান করিলেন।