রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – রাবণসহ দেবগণের যুদ্ধ ও পরাজয়
স্বর্গলোক মর্ত্ত্যলোক আইল পাতাল।
চারিদিকে পড়ে অস্ত্র অগ্নির উথাল।।
নানা অস্ত্র পড়ে, নাহি যায় সংখ্যা করা।
অমরাবতীতে যেন বরিষয়ে ধারা।।
নানা অস্ত্র রাক্ষস করিছে অবতার।
সুরপুরী বাণেতে হইল অন্ধকার।।
জাঠা জাঠি শেল শূল মুষল মুদগর।
খাণ্ডা খরশাণ বাণ অতি ভয়ঙ্কর।।
পড়ে গদা সাবল নাহিক লেখা জোখা।
চারিদিকে ফেলে বাণ যার যত শিক্ষা।।
রথে রথে ঠেকাঠেকি ভাঙ্গি পড়ে কত।
হস্তী ঘোড়া চাপনেতে হস্তী ঘোড়া হত।।
পড়ে দেব দানব গন্ধর্ব্ব বিদ্যাধর।
লেখা জোখা নাহি বাণ পড়িছে বিস্তর।।
দেব-অস্ত্র রাক্ষসাস্ত্র করে অবতার।
সকল অমরাবতী বাণে অন্ধকার।।
দুই সৈন্য যুদ্ধে পড়ে রক্তে হৈয়া রাঙ্গা।
রক্তে নদী বহে যেন ভাদ্রমাসের গঙ্গা।।
হস্তী ঘোড়া ঠাট কত রক্তোপরি ভাসে।
হরিষে পিশাচণ্ডলা মনে মনে হাসে।।
বিম্বকে বিম্বকে রক্তে বান্ধি উঠে ফেনা।
শকুনি গৃধিনী তাহে করিছে পারণা।।
ইন্দ্র বলে, রাবণ করিস যুদ্ধ ছল।
জনে জনে যুঝ দেখি কার কত বল।।
শুনিয়া ইন্দ্রের কথা হাসিল রাবণ।
মোর সনে যুঝেছে সকল দেবগণ।।
বরুণ কুবের যম জিনেছি মান্ধাতা।
যুঝিবে আমার সনে কে আছে দেবতা।।
হেনকালে শনি গেল রাবণের পাশে।
দশমাথা খসে পড়ে দেবগণ হাসে।।
বিকৃত আকার রাবণ সংগ্রাম ভিতরে।
দেখি যত দেবগণ উপহাস করে।।
দশ মাথা খসে পড়ে বল নাহি টুটে।
ব্রহ্মার বরেতে তার দশ মাথা উঠে।।
একবার ভিন্ন শনির আর নাহি রণ।
উড়িল শনির প্রাণ দেখিয়া রাবণ।।
ব্রহ্মার বরেতে মাথা খসিলে না মরে।
শনি পলাইয়া গেল রাবণের ডরে।।
শনি পলাইল যে রাক্ষসগণ হাসে।
হেনকালে যম গেল রাবনের পাশে।।
যমেরে দেখিয়া তবে দশানন হাসে।
মরিবারে কেন যম এলি মোর পাশে।।
যম বলে রাক্ষস কি করিস্ অহঙ্কার।
সেই দিন আমি তোরে করিতাম সংহার।।
ভাগ্যেতে বাঁচিলি প্রাণে ব্রহ্মার কারণ।
ব্রহ্মা আজ নাহি হেথা জীবি কতক্ষণ।।
আছয়ে চৌষট্টি রোগ যমের সংহতি।
রাবণের অঙ্গে প্রবেশিল শীঘ্রগতি।।
ত্রিভুবনের মায়া জানে রাজা দশানন।
ব্রহ্ম-অগ্নি শরীরেতে জ্বালিল তখন।।
পুড়ে মরে রোগ সব ডাকে পরিত্রাহি।
সহিতে না পারে সবে গেল যম ঠাঁই।।
রোগ পীড়া পলাইল দশানন হাসে।
মোর কাছে যম তুমি দর্প কর কিসে।।
যম বলে রাবণ কি করিস্ অহঙ্কার।
আমার হাতেতে তোর সবংশে সংহার।।
রোগ পীড়া পলাইল মনে পাইলি আশ।
আমার দণ্ডেতে তোর সবংশে বিনাশ।।
করিলি বিস্তর তপ হইতে অমর।
অমর হইতে ব্রহ্মা নাহি দিলা বর।।
অবশ্য মরণ হবে যাবি মোর ঘরে।
চক্ষু পাকাইয়া গর্জ্জে যমের কিঙ্করে।।
যম আর রাবণে দুজনে গালাগালি।
দূর হৈতে শুনে কুম্ভকর্ণ মহাবলী।।
ধেয়ে যায় কুম্ভকর্ণ যমে গিলিবারে।
কুম্ভকর্ণে দেখি যম পলাইল ডরে।।
পলাইয়া রহে যম ইন্দ্রের গোচর।
দেখিয়া যমের ভঙ্গ কহে পুরন্দর।।
সর্ব্বজন মরে যম তোমা দরশনে।
যম তুমি ভঙ্গ দিলে যুঝে কোন্ জনে।।
হেনকালে পবন বহিল মহাঝড়।
উড়াইয়া রাক্ষসে একত্র কৈল জড়।।
রাবণের যত ঠাট ঝড়ে উড়াইল।
ভয়েতে রাবণ রাজা চিন্তিত হইল।।
কুম্ভকর্ণ বীরে ঝড়ে উড়াইতে নারে।
কুম্ভকর্ণ চলিল পবনে গিলিবারে।।
কুম্ভকর্ণে দেখিয়া পবন দিল রড়।
পলাইল পবন ঘুচিল সর্ব্ব ঝড়।।
পবন পলায়ে গেল মনে পেয়ে ডর।
বরুণ প্রবেশ করে রণের ভিতর।।
বরুনের মায়াতে সকল জলময়।
জল দেখি রাবণের লাগে বড় ভয়।।
কুম্ভকর্ণের নাহি ভয় দুর্জ্জয় শরীর।
আর যত সেনা সব হইল অস্থির।।
বরুণের মায়া চূর্ণ করিতে রাবণ।
অগ্নিবাণ ধনুকেতে যুড়িল তখন।।
রাবণের অগ্নিবাণ অগ্নি-অবতার।
অগ্নিবাণে সব জল করিল সংহার।।
বরুণের মায়া যদি ভাঙ্গিল রাবণ।
রণেতে প্রবেশ করে যত গ্রহগণ।।
একাদশ রুদ্র আর দ্বাদশ ভাস্কর।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল হইল দীপ্তিকর।।
একবারে হইল দ্বাদশ সূর্য্যোদয়।
ভয়েতে রাক্ষসগণ গণিল সংশয়।।
ধনুকেতে যোড়ে রাজা বাণ ব্রহ্মজাল।
বাণ হইতে বরিষয়ে অগ্নির উথাল।।
রাবণের বাণেতে দেবতাগণ কাঁপে।
সূর্য্য তেজ নিভাইল রাবণ-প্রতাপে।।
সকল দেবতাগণে জিনিল রাবণ।
মেঘনাদ জয়ন্ত দুজনে বাজে রণ।।
দুই রাজপুত্র যুঝে দুজনে প্রধান।
কেহ কারে নাহি জিনে দুজনে সমান।।
মেঘনাদ-বাণেতে জয়ন্ত পায় ডর।
পলায়ে জয়ন্ত গেল পাতাল ভিতর।।
পৌলব দানব তার মাতামহ হয়।
পাতালে লুকায়ে রহে তাহার আলয়।।
ইন্দ্রস্থানে বার্ত্তা কহে যত দেবগণ।
আচম্বিতে জয়ন্তে না দেখি কি কারণ।।
মেঘনাদের বাণ বুঝি না পারি সহিতে।
আছে কি না আছে বেঁচে না পারি বলিতে।।
অন্তঃপুরে নারীগণ যুড়িল ক্রন্দন।
যম গিয়া ইন্দ্রে কহে প্রবোধ বচন।।
পরলোক গেলে মোর সঙ্গে হৈত দেখা।
মরে নাই জয়ন্ত সে পাইয়াছে রক্ষা।।
পৌলব দানব তার পাতালে নিবাস।
লুকাইয়া জয়ন্ত রয়েছে তার পাশ।।
যমের প্রবোধে ইন্দ্র সম্বরে ক্রন্দন।
তবে ইন্দ্র রাজা গেল চণ্ডীর সদন।।
তোমা বিদ্যমানে দেবগণের সংহার।
রাবণে মারিয়া মাতা কর প্রতিকার।।
চৌষট্টি যোগিনী ছিল দেবীর সংহতি।
যুঝিতে যোগিনীগণ চলে শীঘ্রগতি।।
যুঝিতে যোগিনীগণ চলে কাচে কাচে।
রক্ত মাংস খাইয়া যোগিনী সব নাচে।।
দেখিতে যোগিনী সব মহা ভয়ঙ্করে।
একেক যোগিনী শত রাক্ষসে সংহারে।।
দশানন বলে মাতা কর অবধান।
যুদ্ধ সম্বরিয়া তুমি যাহ নিজ স্থান।।
রাবণ যোগিনী-যুদ্ধ দেখি ভয়ঙ্কর।
যোড়-হাতে স্তুতি করে দেবীর গোচর।।
মোর সনে মাতা তব কিসে বিসংবাদ।
তোমার চরণে কিছু নাহি অপরাধ।।
শঙ্কর-সেবক আমি, তুমি মা শঙ্করী।
এ কারণ তবে সনে যুদ্ধ নাহি করি।।
আমারে জিনিয়া তব হইবে কি কাজ।
তুমি যদি হার মাতা পাবে বড় লাজ।।
রাবণের বচনে চণ্ডীর হৈল হাস।
চৌষট্টি যোগিনী লয়ে চলিলা কৈলাস।।
একে একে দেবগণে জিনিল রাবণ।
ইন্দ্র আর রাবণ দুজনে বাজে রণ।।
ঐরাবতে চড়ে ইন্দ্র বজ্র-অস্ত্র হাতে।
সাজিয়া রাবণ রাজা এল দিব্য-রথে।।
ইন্দ্রের যে বজ্র-অস্ত্র করিছে গর্জ্জন।
বজ্রের গর্জ্জন শুনি চিন্তিত রাবণ।।
হেনকালে কুম্ভকর্ণ আইল ধাইয়ে।
ইন্দ্রের সম্মুখে আসি রহিল দাণ্ডায়ে।।
কুম্ভকর্ণ বলে ইন্দ্র আর যাবি কোথা।
স্বর্গপুরী নিবসতি করিব দেবতা।।
বজ্র বিনা ইন্দ্র তোর আর নাহি বাড়া।
দন্তে চিবাইয়া বজ্র করে যাব গুঁড়া।।
ইন্দ্র বলে কুম্ভকর্ণ ছাড় অহঙ্কার।
বজ্র-অস্ত্রে আমি তোর করিব সংহার।।
মহামন্ত্র পড়ি ইন্দ্র বজ্র-অস্ত্র ফেলে।
লাফ দিয়া কুম্ভকর্ণ সেই বজ্র গিলে।।
বজ্র-অস্ত্র গিলে বীর ছাড়ে সিংহনাদ।
দেখি যত দেবগণ গণিল প্রমাদ।।
চলিল সে কুম্ভকর্ণ দেবতা গিলিতে।
ভয়েতে দেবতাগণ পলায় চারিভিতে।।
সৃষ্টিনাশ হেতু তারে সৃজিল বিধাতা।
চারিভিতে লাফ দিয়ে গিলিছে দেবতা।।
অমর দেবতাগণ নাহিক মরণ।
নাসিকা কর্ণের পথে পলায় তখন।।
শ্রবণ নাসিকা-পথ ঘরের দুয়ার।
তাহা দিয়া দেবগণ বেরয় অপার।।
স্বর্গ হৈতে দেবগণে আছাড়িয়া ফেলে।
হাত পা ভাঙ্গিয়া যায় পড়ি ভূমিতলে।।
কুম্ভকর্ণের রণে কারো নাহি অব্যাহতি।
হইল সমর স্বর্গে সমুদয় রাতি।।
এক দিন রাত্রি মাত্র জাগে কুম্ভকর্ণ।
কুম্ভকর্ণ নিদ্রা গেল সুখী দেবগণ।।
ছয় মাসে এক দিন জাগে কুম্ভকর্ণ।
রজনী প্রভাত হলে সবার এড়ান।।
রাত্রি পোহাইল বীর নিদ্রায় বিভোল।
এতক্ষণে রক্ষা পাইল দেবতা সকল।।
কুম্ভকর্ণ নিদ্রা গেল রাবণ চিন্তিত।
রথে তুলি লঙ্কাপুরে পাঠায় ত্বরিত।।
ইন্দ্র সহ রাবণে বাজে মহারণ।
দুই জনে নানা বাণ করে বরিষণ।।
দুই জনে বাণ মারে নাহি লেখাজোখা।
চারিদিকে বাণ ফেলে যার যত শিক্ষা।।
দুই জন সম কেহ না পারে জিনিতে।
পদ্মাপন বাণ ইন্দ্রের পড়িল মনেতে।।
ইন্দ্র বলে কৌতুক দেখহ দেবগণ।
পদ্মাপন বাণে বন্দী করিব রাবণ।।
ব্রহ্মমন্ত্র পড়ি ইন্দ্র পদ্মাপন এড়ে।
ব্রহ্ম-অস্ত্র রাবণের গায়ে গিয়া পড়ে।।
ছুঁলে মাত্র নিদ্রা যায় হেন পদ্মপন।
রথোপরি রাবণ নিদ্রায় অচেতন।।
অচেতন হয়ে পড়ে রথের উপরে।
সকল দেবতা আসি বেড়ে রাবণেরে।।
লোহার শিকল বান্ধে হাতে ও গলায়।
রাবণে বান্ধিয়া লৈল ঐরাবত পায়।।
অবনীতে লোটায় রাবণের দশ মাথা।
তাহার অবস্থা দেখি হাসেন দেবতা।।
হিঁচড়িয়া লয়ে যায় বুকে ছড় যায়।
ঐরাবত-দন্ত ঠেকে রাবণের গায়।।
খান্ খান্ হয় অঙ্গ দন্ত দিয়া চিরে।
পরিত্রাহি ডাকে রাবণ বিষম প্রহারে।।
হরিষ দেবতাগণ জিনিয়া রাবণ।
শিরে হাত দিয়া কান্দে নিশাচরগণ।।
রাবণ হইল বন্দী মেঘনাদ দেখে।
রথে চড়ি মেঘনাদ উঠে অন্তরীক্ষে।।
মেঘনাদ গর্জ্জে যেন মেঘের গর্জ্জন।
ঘরে না যাইস্ ইন্দ্র ফিরে দেহ রণ।।
রাবণ-কুমার আমি নাম মেঘনাদ।
আজিকার যুদ্ধে তোর পাড়িল প্রমাদ।।
পিতারে করিলি বন্দী আমা বিদ্যমানে।
বিনাশিব স্বর্গপুরী আজিকার রণে।।
গর্জ্জিতেছে মেঘনাদ থাকিয়া আকাশে।
মেঘনাদ গর্জ্জনেতে ইন্দ্ররাজ হাসে।।
তোর ঠাঁই শুনিলাম অপূর্ব্ব কাহিনী।
পিতা হৈতে পুত্র বড় কোথাও না শুনি।।
এত যদি দুইজনে হৈল গালাগালি।
দুইজনে যুদ্ধ বাজে দোঁহে মহাবলী।।
অন্তরীক্ষে মেঘনাদ মেঘে হয়ে লুকি।
মেঘের আড়েতে যুঝে মেঘনাদ ধানুকী।।
নানা অস্ত্র মেঘনাদ ফেলে চারিভিতে।
ফাঁফর হইল ইন্দ্র না পারে সহিতে।।
অন্তরীক্ষে থাকি বাণ এড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে।
কোথা হৈতে পড়ে বাণ কেহ নাহি দেখে।।
খাণ্ডা খরশান শেল শূল এক ধারা।
চারিভিতে পড়ে যেন আকাশের তারা।।
নানা অস্ত্র মেঘনাদ করে বরিষণ।
জর্জ্জর হইল বাণে যত দেবগণ।।
ইন্দ্রে ছাড়ি দেবগণ পলায় তখন।
একেশ্বর থাকি ইন্দ্র করে মহারণ।।
সন্ধান পূরিয়া ইন্দ্র ঊর্দ্ধদৃষ্টে চায়।
কোথা হৈতে আসে বাণ দেখিতে না পায়।।
সহস্র চক্ষেতে ইন্দ্র না পায় দেখিতে।
দেখিতে না পায় আর না পারে সহিতে।।
মেঘনাদ যুড়িলেক বন্ধন নাগপাশ।
তাহা দেখি দেবগণে লাগিল তরাস।।
মেঘনাদ জানে বাণ বড় বড় শিক্ষা।
যজ্ঞেতে পাইল বাণ কারো নাহি রক্ষা।।
এক বাণে ভুজঙ্গম অনেক জন্মিল।
হাতে গলে দেবরাজে বান্ধিয়া পাড়িল।।
বিষের জ্বালাতে ইন্দ্র হইল মূর্চ্ছিত।
ইন্দ্রে ছাড়ি দেবগণ পলায় ত্বরিত।।
স্বর্গ ছাড়ি পলায় যতেক দেবগণ।
রাক্ষসেতে রাবণের ছাড়ায় বন্ধন।।
ইন্দ্রে বান্ধে মেঘনাদ পিতা বিদ্যমান।
মেঘনাদে করিতেছে রাবন বাখান।।
আমারে বান্ধিয়াছিল ইন্দ্র দেবরাজ।
হেন ইন্দ্রে বান্ধিয়া করিলা পুত্র-কাজ।।
ইন্দ্রকে বান্ধিয়া পুত্র লহ লঙ্কাপুরী।
তবে আমি লুটিব এ অমর-নগরী।।
মেঘনাদ বলে পিতা আজ্ঞা কর তুমি।
ইন্দ্রকে বাঁধিয়া আগে লয়ে যাই আমি।।
শুনি মেঘনাদের বচন দশানন।
আজ্ঞা দিল কর তাহা যাহে তব মন।।
আজ্ঞা পেয়ে মেঘনা ইন্দ্রকে ধরিল।
রথের নিকটে গিয়া কহিতে লাগিল।।
পিতারে বান্ধিয়াছিলে ঐরাবত-পায়।
বান্ধিব তোমারে ইন্দ্র রথের চাকায়।।
ইন্দ্রে বান্ধি পাঠাইল লঙ্কার ভিতর।
অমর-নগরী লুটে রাজা লঙ্কেশ্বর।।
একে দশানন তাহে ইন্দ্রের নগরী।
বাছিয়া বাছিয়া লুটে স্বর্গ-বিদ্যাধরী।।
নানা রত্ন-মাণিক্য ভাণ্ডার হৈতে নিল।
স্বর্গ-বিদ্যাধরী তথা অনেক পাইল।।
শচীরে চাহিয়া বেড়ায় রাজা দশানন।
শচী লয়ে দেবগণ হৈল অদর্শন।।
শচী জন্য রাবণের ছিল বড় আশ।
শচী না পাইয়া রাজা হইল নিরাশ।।
ইন্দ্রের নন্দন-বন দেখে মনোহর।
প্রবেশে নন্দন-বনে রাজা লঙ্কেশ্বর।।
পারিজাত-বৃক্ষ উপাড়িল ডালে মূলে।
লুটিয়া অমরাপুরী চলে কুতূহলে।।
লঙ্কার ভিতরে গিয়া করিল দেয়ান।
কটক ছত্রিশ কোটি সম্মুখে প্রধান।।
মেঘনাদ গিয়া তবে বাপের গোচর।
রাবণ বলে কোথায় রেখেছ পুরন্দর।।
ইন্দ্র করিয়াছে বড় আমার অবস্থা।
হেন ইন্দ্রে বান্ধি পুত্র রাখিয়াছ কোথা।।
মেঘনাদ বলে তবে বাপের গোচর।
বান্ধিয়া রেখেছি ইন্দ্রে লঙ্কার ভিতর।।
লোহার শিকলে বান্ধিয়াছি হাতে গলে।
বুকে পাথর চাপায়ে রেখিছি যজ্ঞশালে।।
এত যদি কহে মেঘনাদ বীরবর।
রাজপ্রসাদ পায় বহু বাপের গোচর।।
মেঘনাদে রাজা তবে করিছে বাখান।
ধন্য ধন্য পুত্র মোর বীরের প্রধান।।
নানা অলঙ্কার দিল, মাথে দিল মণি।
অযুতের বিদ্যাধরী দিলেন নাচনী।।
বাপের প্রসাদ পেয়ে হরিষ অন্তরে।
কুতূহলে দেবকন্যা লয়ে রতি করে।।
বহু ধন পায় লুটি অমর-নগরী।
দিগ্বিজয়ী-দ্রব্য রাজা আনে লঙ্কাপুরী।।
দেব দানবের কন্যা লয়ে কেলি করে।
ত্রিভুবন জিনিল যে রাজা লঙ্কেশ্বরে।।
কৌতুকেতে লঙ্কাপুরে আছে লঙ্কেশ্বর।
সকল দেবতা গেল ব্রহ্মার গোচর।।
আচম্বিতে ব্রহ্মা তব সৃষ্টি হয় নাশ।
দিবা রাত্রি গেল চন্দ্র সূর্য্যের প্রকাশ।।
আচম্বিতে স্বর্গ আসি বেড়ি লঙ্কেশ্বর।
ইন্দ্রকে বান্ধিয়া নিল লঙ্কার ভিতর।।
দেবগণ ছাড়িয়াছে স্বর্গের বসতি।
কি প্রকারে দেবরাজা পাবে অব্যাহতি।।
এতেক শুনিয়া ব্রহ্মা ভাবেন বিষাদ।
রাবণেরে বর দিয়া পাড়িনু প্রমাদ।।
দেবগণে রাখি ব্রহ্মা চলিল সত্বর।
একেশ্বর ব্রহ্মা গেল লঙ্কার ভিতর।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পূজা করিল রাবণ।
ভক্তিভাবে পূজে রাবণ ব্রহ্মার চরণ।।
আচম্বিতে কেন প্রভু হেথা আগমন।
আজ্ঞা কর আছে তব কোন্ প্রয়োজন।।
বিরিঞ্চি বলেন তুই সৃষ্টি কৈলি নাশ।
রাত্রি দিবা গেল চন্দ্র সূর্য্যের প্রকাশ।।
ইন্দ্রে বান্ধি লঙ্কাতে আনিলি কি কারণ।
স্বর্গপুরে নাহি রহে যত দেবগণ।।
যোড়হাতে বলে রাবণ ব্রহ্মার গোচর।
ত্রিভুবন জিনিলাম পাইয়া তব বর।।
সকলি জিনিনু আমি তোমার প্রসাদে।
ইন্দ্রে বান্ধিয়াছে মোর পুত্র মেঘনাদে।।
যজ্ঞশালে রাখিয়াছে দেব পুরন্দর।
আজ্ঞা কর আনি আমি তোমার গোচরে।।
ব্রহ্মা বলিলেন রাজা চলে যজ্ঞশালা।
মেঘনাদের যজ্ঞ দেখাইবে নিকুম্ভিলা।।
আগে আঘে ব্রহ্মা যান পশ্চাতে রাবণ।
তার পিছু চলিল রাক্ষস বিভীষণ।।
মেঘনাদের যজ্ঞ দেখি ব্রহ্মার হৈল হাস।
মেঘনাদে ব্রহ্মা কহে করিয়া প্রকাশ।।
তোর বাপ ইন্দ্র-রণে পাইলে পরাজয়।
হেন ইন্দ্রে জিন তুমি সংগ্রামে দুর্জ্জয়।।
তোর বাণে ত্রিভুবন হইল কম্পিত।
আজি হৈতে নাম তোর হৈল ইন্দ্রজিৎ।।
বর মাগ ইন্দ্রজিৎ তুষ্ট হৈনু আমি।
সৃষ্টি রক্ষা কর, ইন্দ্রে ছাড়ি দেহ তুমি।।
ইন্দ্রজিৎ বলে আগে দেহ তুমি বর।
তবে আমি ছাড়িব এ রাজা পুরন্দর।।
অমর বর দেহ আমায় করি সম্বিধান।
অন্য বর আমি নাহি চাহি তব স্থান।।
ইন্দ্রজিৎ-কথা শুনি ব্রহ্মার হৈল হাস।
তুমি অমর হৈলে আমার সৃষ্টি নাশ।।
ব্রহ্মা বলে দিনু বর শুন ভালমতে।
ত্রিভুবন জিনিবে যে জজ্ঞের ফলেতে।।
এই যজ্ঞ ভঙ্গ তোর করিবে যে জন।
সেই জন হবে তোর বধের কারণ।।
শুনেছিল এ সন্ধি রাক্ষস বিভীষণ।
তারি জন্যে ইন্দ্রজিতে বধিল লক্ষ্মণ।।
ইন্দ্রে এনে দিল তবে ব্রহ্মা-বিদ্যমান।
অধোমুখে রহে ইন্দ্র পেয়ে অপমান।।
ব্রহ্মা বলিলেন ইন্দ্র কিবা ভাব মনে।
এ দুঃখ পাইলে তুমি শাপের কারণে।।
তোমার শাপের কথা পড়ে মোর মনে।
পূর্ব্বকথা কহি ইন্দ্র শুন সাবধানে।।
কৌতুকেতে এক কন্যা সৃজিলাম আমি।
রাজ্যভোগে পূর্ব্বকথা পাসরিলে তুমি।।
অহল্যা কন্যার নাম রাখিনু যতনে।
আইল গৌতম মুনি আমা দরশনে।।
অহল্যার রূপ দেখি মুনি অচেতন।
লাজে মুনি প্রকাশ না করে কদাচন।।
বুঝিয়া মুনির মন কন্যা দিনু দান।
কন্যা লয়ে কৈল মুনি স্বস্থানে প্রস্থান।।
তপস্যাতে গেল মুনি তমসার কূলে।
হেনকালে গেলে তুমি পড়িবার ছলে।।
অহল্যা গৌতম-পত্নী পরমা-সুন্দরী।
গৌতমের রূপে তুমি গেলে তার পুরী।।
সতীকন্যা অহল্যা যে সর্ব্বলোকে জানে।
জলাসন দিল সে তোমারে স্বামী-জ্ঞানে।।
নারীজাতি নাহি জানে মায়া-ব্যবহার।
বলে ধরে তুমি তারে করিলে শৃঙ্গার।।
হেনকালে তপ করি মুনি আইল ঘরে।
সর্ব্বজ্ঞ গৌতম-মুনি চিনিল তোমারে।।
অহল্যারে শাপ আগে দিল মুনিবর।
পাষাণ হইয়া থাক অনেক বৎসর।।
আপনি হবেন প্রভু রাম-অবতার।
তিনি পদধূলি দিলে তোমার নিস্তার।।
অহল্যা পাষাণী হৈল সে মুনির শাপে।
তোমারে শাপ দিল সে মুনি মহাকোপে।।
তোর অনাচার ইন্দ্র রহিল ঘোষণা।
তোরে পড়াইয়া পাইলাম এ দক্ষিণা।।
ভগে অভিলাষ তোর ইন্দ্র তুই ঠগ।
আমার শাপেতে তোর গায়ে হক ভগ।।
শাপ দিল মহামুনি খণ্ডণ না যায়।
হইল সহস্র ভগ ইন্দ্র তব গায়।।
ধরিয়া মুনির পায়ে করিলে ক্রন্দন।
পরদার-পাপ মোর করহ খণ্ডন।।
মুনি বলে খণ্ডন না যায় এই পাপ।
এই পাপে তুমি অন্তে পাবে বড় তপ।।
মুনির বচন কভু না যায় খণ্ডন।
এত দুঃখ পাইলে ব্রহ্মশাপের কারণ।।
বিরিঞ্চি বলেন ইন্দ্র কহি তব কাণে।
রামনাম দুই বর্ণ জপ রাত্রি দিনে।।
ইহা বিনা তোমার নাহিক প্রতিকার।
রামনামে হয় সর্ব্ব পাপের সংহার।।
এক নামে সহস্র নামের ফল হয়।
রাম নামের তুল্য নাহি চারি বেদে কয়।।
এতেক বলিয়া ব্রহ্মা গেল নিজ স্থান।
ইন্দ্র গেল সুরপুরে পাইয়া প্রাণদান।।
ব্রহ্মার কারণে ইন্দ্র পেয়ে অব্যাহতি।
আইল অমরাবতী আপন বসতি।।
রামনাম দেবরাজ রাত্রিদিন জপে।
পরিত্রাণ পান ইন্দ্র পরদার পাপে।।
দিগ্বিজয় করি রাবণ আইল নিজ ঘর।
চৌদ্দ যুগ রাজ্য করে লঙ্কার ঈশ্বর।।
আর চৌদ্দ যুগ দিল রাবণের আয়ু।
সীতার চুলেতে ধরি হইল অল্পায়ু।।
লঙ্কাতে করিল রাজ্য মালী ও সুমালী।
পরে রাজ্য করিল কুবের মহাবলী।।
তৎপরে লঙ্কায় রাজ্য করিল রাবণ।
তোমার এ ঘোষণা রহিল ত্রিভুবন।।
অগস্ত্যের কথা শুনি শ্রীরামের হাস।
কহ কহ বলি রাম করিলা প্রকাশ।।
রাবণের দিগ্বিজয় কহিলা যে মুনি।
রাবণ অধিক হনুমানেরে বাখানি।।
বহু স্থানে শুনিলাম রাবণ-পরাজয়।
হনুমান পরাজয় কোথাও না হয়।।
গন্ধমাদন-পর্ব্বত রাত্রি মধ্যে আনে।
হনুমান সম বীর নাহি ত্রিভুবনে।।