Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আর্টগ্যালারি থেকে প্রস্থান || Humayun Azad

আর্টগ্যালারি থেকে প্রস্থান || Humayun Azad

দুই যুগ আগে সবে শুরু হয়েছে তখন আমার যৌবন।
কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি যেমন বাঁশির অভ্যন্তর আলোড়িত
হয় সুরে সুরে, সুন্দরে সৌন্দর্যে। স্বপ্নে জাগরণে শুধু চাই
সুন্দর ও সৌন্দর্যকে; আর কিছুকেই চাওয়ার যথেষ্ট যোগ্য
বলে ভাবতেও পারি না। ঘৃণা করি সব কিছু, তীব্র ঘৃণা করি
মুদ্রাকে, তোমরা যেমন ঘৃণা করো আবর্জনাকে। ধ্যান করি
শুধু সুন্দরের, সৌন্দর্যের। অথচ আমার চারদিকে শুধু
পরিব্যাপ্ত বাস্তবতা, আর সেই অশ্লীল নোংরা কদর্যতা,
যাকে মানুষেরা পুজো করে ‘জীবন’ অভিধা দিয়ে। ভিখিরিরা
যাকে সযত্নে লালন করে, বিকলাঙ্গ যাকে ধরে রাখে সারা অঙ্গে;
কুষ্ঠরোগী যাকে বোধ করে দেহের প্রতিটি ক্ষতে; রূপসীর
রূপ যার খাদ্য হয়ে পরিণত হয় মলে। আমি প্রাণভ’রে।
ঘেন্না করেছি সেই কুৎসিত, নোংরা, তুচ্ছ জীবনকে।

আমি চেয়েছি সুন্দর, আর সৌন্দর্যকে, আর শিল্পকলাকে,
জীবনের চেয়েও যা শাশ্বত ও মূল্যবান। আমার দয়িতা
ছিলো বিমানবিক সুন্দর, যা নেই নারীতে, রৌদ্রে, মেঘে, জলে,
পাখিতে, পশুতে, পুষ্পে। আছে শুধু শিল্পে, শাশ্বত শিল্পকলায়।
সৌন্দর্যের খোঁজে আমি ঢুকে গিয়েছিলাম কলামন্দিরে; এবং ঢুকেই
সেঁটে দিয়েছিলাম সমস্ত দরোজা; এবং ভুলে গিয়েছিলাম
দরোজা খোলার মন্ত্র, জানালা খোলার সব গোপন কৌশল।
আমি মনে রাখতে চাই নি; আমি জানতাম ওই সৌন্দর্যের
গ্যালারিতে প্রবেশের পর আমার কখনো আর দরকার
পড়বে না জীবনে ঢোকার। ওই মানুষেরা যাকে সুখ বলে,
আমি তার চেয়ে অনেক বিশুদ্ধ কিছু পেয়েছি আমার বুকে,
জীবনপাগল মানুষেরা যা কখনো বুঝতে পারবে না।

দুই যুগ ধরে আমি সৌন্দর্যের গ্যালারিতে সৌন্দর্য যেপেছি।
আমার সম্মুখে ছিলো অনিন্দ্য সুন্দর, আর পশ্চাতে বিশুদ্ধ
সৌন্দর্য। চারপাশে অনশ্বর শিল্পকলা : চোখের মণিতে গাঁথা
থাকতো সবুজ রঙের চাঁদ; মণিমাণিক্যের দ্যুতি নাচতো করতলে
অহর্ণিশ; এমন সুগন্ধ উঠতো বুক জুড়ে যা কোনো ইন্দ্রিয়
দিয়ে উপভোগ্য নয়। অতীন্দ্রিয় স্বাদেগন্ধে ভ’রে ছিলো রক্তমাংস;
এমন নারীরা ছিলো যারা শুধু স্তবযোগ্য, সম্ভোগের জন্যে
যারা নয়। দুই যুগ ধরে আমি আমার অজস্র চোখ
নিবদ্ধ রেখেছি সৌন্দর্যের পদতলে ফোঁটা একটি পুষ্পের
শতদলে; দুই যুগ ধরে আমি আমার ওষ্ঠকে মানবিক
কোনো স্থূল স্বাদ আস্বাদ করতে দিই নি। যা কিছু শিল্প নয়
এমন কিছুর স্বাদ নিতে ভুলে গিয়েছিলো আমার ওষ্ঠ।
সৌন্দর্য ও শিল্পকলা ছাড়া আর সব কিছু দেখতে অনভ্যস্ত
হয়ে ওঠে আমার সমস্ত চোখ। আমার শরীর ভুলে যায়
সৌন্দর্যপ্রবাহ ছাড়া আর কোনো প্রবাহ রয়েছে।

যা কিছু পচনশীল, যা কিছু মাংসে গঠিত আমার তা নয়;
আমি তার নই। পার্থিব পুষ্প দেখেছি; জলাশয়ে প্রাণবন্ত
মাছ, আর বনভূমে পশুপাখি অনেক দেখেছি। পৃথিবী যে
রমণীয়, তার মৌল কারণ যে-রমণীরা, তাদেরও দেখেছি।
কিন্তু সবই পচে যায়, মানবিক সব কিছু প’চে নষ্ট হয়ে
যায়। শুধু থাকে শিল্পকলা, যা কিছু পবিত্র শুদ্ধ অনশ্বর,
যার জন্যে আমার জীবন আমি ভত্যদের বকশিশ দিয়ে দিতে পারি।
দুই যুগ পরে আস্তে আমার চোখের সামনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে
খুলে যায় আর্টগ্যালারির দরোজাজানালা। দরোজার কথা
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পুরোপুরি, আর যে-কোনো গৃহে যে
জানালা গবাক্ষ থাকে, আমার স্মৃতিতে তা একেবারেই ছিলো না।
আমি কেনো মনে রাখবো প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ, বাহ্যজগত?
একটি দরোজাকে শিল্পকলা ভেবে এগোতেই ইট-কাঠ-কাঁচ
চুরমার করে আর্টগ্যালারিতে ঢোকে সদ্যভূমিষ্ঠ এক
শিশুর চিৎকার; আর সমস্ত গ্যালারি কেঁপে ওঠে ভূমিকম্পে।
আমি বাইরে বেরোই : দুটি ছাগশিশু নাচছিলো সমস্ত শিল্পিত
হরিণের চেয়ে সুন্দর ভঙ্গিতে, মুখে কাঁপছিলো সবুজ কাঁঠাল
পাতা, যুবকের রক্তে রূপময় হয়ে উঠছিলো চৌরাস্তার
শুকনো কংক্রিট, যুবতীর অবিনাশী অশ্রুতে ফুটে উঠছিলো
দিকে দিকে গন্ধরাজ রঙিন গোলাপ। দুই যুগ পরে।
আমি জীবনশিল্পের মধ্যে টলতে টলতে হুঁ হুঁ করে উঠি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *