সোমভদ্র যখন নিজ গৃহের সম্মুখীন
সোমভদ্র যখন নিজ গৃহের সম্মুখীন হইল সূর্য অস্ত গিয়াছে, অদূরস্থ নদীর নিস্তরঙ্গ নীল জলে অস্তরাগের খেলা চলিতেছে। গৃহ-প্রাঙ্গণের দ্বারে তাহার পিতা মাতা, ভগিনী শফরী ও বালক-ভ্রাতা শ্যেনভদ্র দাঁড়াইয়া; সকলের দৃষ্টি একসঙ্গে সোমভদ্রের উপর পড়িল। মায়ের মুখে হাসি, চোখে জল; পিতার মুখ তৃপ্তি-গম্ভীর। শ্যেনভদ্র ছুটিয়া দাদার কাছে যাইবার উপক্রম করিলে পিতা তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে আটকাইয়া রাখিলেন। কেবল শফরীকে কেহ আটকাইল না। সোমভদ্রকে স্বাগত সম্ভাষণ করিবার অগ্রাধিকার তাহারই।
শফরীর বয়স সতেরো। রূপ ও যৌবন মিলিয়া সাবলীল স্বর্ণাভ শফরীর মতোই তাহার দেহ। সে লঘুপদে ছুটিয়া গিয়া সোমভদ্রের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, গ্রীবার মধ্যে মুখ খুঁজিয়া গদ্গদ স্বরে ডাকিল—ভাই!
ক্ষণকালের জন্য সোমভদ্রের মনে হইল, তাহার সন্তাপ শান্ত হইয়াছে, অঙ্গ জুড়াইয়া গিয়াছে, দেহমন ভরিয়া একটি পরিতৃপ্ত আনন্দ সুগন্ধি ফুলের মতো ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে শফরীর স্কন্ধ জড়াইয়া লইল।
শফরী মুখ তুলিল। দুই চক্ষে আনন্দ বিকীর্ণ করিয়া সোমভদ্রের অধরের কাছে অধর ধরিল। বলিল—চুমু খাও।
সোমভদ্রের মন আবার অশান্ত হইয়া উঠিল। শফরীকে বলিতে হইবে, মেরুকার কথা বলিতে হইবে। সে শফরীর অধরে অধর স্পর্শ করিয়া বলিল—শফরি, তুমি ভাল আছ?
শফরী বলিল—উঃ, কতদিন পরে তুমি ফিরে এলে!
সোমভদ্র লঘু হাসিয়া বলিল—যদি না ফিরে আসতাম? যদি যুদ্ধে মরে যেতাম!
শরীর মুখের হাসি মিলাইয়া গেল, সে বুভুক্ষু চক্ষে কিছুক্ষণ সোমভদ্রের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল—তাহলে—তাহলে—তাহলে আমিও মরে যেতাম।
না, আর নয়, এ প্রসঙ্গ আর বাড়িতে দেওয়া উচিত নয়। সোমভদ্র নিজেকে শরীর বাহুমুক্ত করিয়া বলিল—না, তুমি মরে যেতে কেন? কিছুদিন হয়তো আমার জন্য দুঃখ করতে, তারপর অন্য কারুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হত। শফরী—
তাহার কথা শেষ হইল না, শ্যেনভদ্র পিতার হাত ছাড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়া বনবিড়ালের মতো তাহার পৃষ্ঠে লাফাইয়া পড়িল, হাঁচোড় পাঁচোড় করিয়া তাহার স্কন্ধে উঠিয়া বসিল। শ্যেনভদ্রের বয়স দশ বছর।
তিনজনে হাসিতে হাসিতে মাতাপিতার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সোমভদ্র নতজানু হইয়া মাতাপিতাকে অভিবাদন করিল। শরীর চক্ষু সারাক্ষণ সোমভদ্রের মুখের উপর নিবদ্ধ হইয়া রহিল। সোমভদ্রের আচরণে কোথায় যেন বিকলতা রহিয়াছে, সে তাহাকে ভগিনী বলিয়া ডাকে নাই, শফরী বলিয়া ডাকিয়াছে। কেন?–
বাড়িতে অনাড়ম্বর উৎসবের হাওয়া। প্রাঙ্গণে বাঁধা শ্বেত গর্দভটি ঘন ঘন কর্ণ আন্দোলিত করিয়া কোমল চক্ষে চাহিয়া সোমভদ্রকে সম্ভাষণ জানাইয়াছে, গরু ছাগল ও মেষ নিজ নিজ ভাষায় সংবর্ধনা করিয়াছে। মা রন্ধনশালাতে গিয়াছেন, শফরী তাঁহার সঙ্গে গিয়াছে। পিতা
প্রীতিবিম্বিত মুখে প্রাঙ্গণ-বেদীর উপর স্থির হইয়া বসিয়া আছেন। কেবল শ্যেনভদ্র জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গ ছাড়ে নাই, ছায়ার মতো তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে এবং নানা প্রশ্ন করিয়া তাহার মন আরও উদভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে।
সন্ধ্যার পর আহারের সময় সকলে সমবেত হইলে সোমভদ্র তাহার যুদ্ধযাত্রার অনেক বিচিত্র কাহিনী বলিল। সকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনিল। তারপর মাতা ক্লান্ত সোমভদ্রকে শয়ন করিতে পাঠাইলেন। শ্যেনভদ্র শরীর কোলে মাথা রাখিয়া নিদ্রালু হইয়াছিল, সে তাহাকে শোয়াইয়া দিয়া আসিল। ফিরিয়া আসিয়া দেখিল পিতামাতা ঘনিষ্ঠ হইয়া বসিয়া বিবাহের আলোচনা করিতেছেন। সোমভদ্র ও শফরী বড় হইয়াছে; সোমভদ্র যুদ্ধে কীর্তি অর্জন করিয়া ফিরিয়াছে, এখন আর বিলম্ব করিয়া লাভ নাই, যত শীঘ্র সম্ভব বিবাহ দেওয়া প্রয়োজন। কালই পিতা মন্দিরে গিয়া পুরোহিতের সহিত দিনক্ষণ স্থির করিয়া আসিবেন।
শফরী দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের কথাবার্তা শুনিল। তাঁহাদের স্বর ক্রমশ গাঢ় ও স্মৃতিমধুর হইয়া আসিল; তখন শফরী শয়ন করিতে গেল। নিজের শয়নকক্ষে যাইবার আগে একবার সোমভদ্রের কক্ষে উঁকি মারিল।
ঘরের কোণে প্রদীপের নিষ্কম্প শিখা মৃদু আলোক বিতরণ করিতেছে। সোমভদ্র শয্যায় শুইয়া আছে। তাহার একটি বাহু চোখের উপর ন্যস্ত; নিশ্চয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। শফরী চাহিয়া চাহিয়া একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল। তাহার হৃদয়ে একটি প্রশ্ন বারংবার কাঁটার মতো ফুটিতে লাগিল। কেন? কেন সোমভদ্র তাহাকে ভগিনী বলিয়া ডাকিল না? তবে কি সে আর তাহাকে ভালবাসে না। তবে কি?–
শফরী নিজ কক্ষে গিয়া শয়ন করিল, কিন্তু তাহার ঘুম আসিল না। গৃহ নিঃশব্দ হইয়া গিয়াছে, বাহিরে নদীতীরে কচিৎ হংস বা সারসের উচ্চকিত ধ্বনি শুনা যাইতেছে। নগর সুপ্ত, গৃহ সুপ্ত; কেবল শফরী জাগিয়া আছে।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে শফরী উঠিল। অন্ধকারে ধীরে ধীরে সোমভদ্রের কক্ষের দিকে চলিল। ঘরের কোণে দীপশিখাটি ক্ষুদ্র হইয়া আসিয়াছে, সোমভদ্র পূর্ববৎ চক্ষের উপর বাহু রাখিয়া শুইয়া আছে। শফরী নিঃশব্দে তাহার শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইল। তাহার বুকে দুরন্ত ব্যাকুলতা আলোড়িত হইয়া উঠিল। আমার প্রিয়তম! আমার ভাই! এক রক্ত, এক দেহ; আমরা পরস্পরের হয়ে জন্মেছি, পরস্পরের জন্যে বড় হয়েছি, আমাদের মাঝখানে ব্যবধান নেই। আমরা কি কখনো আলাদা হতে পারি!
শয্যাপার্শ্বে নতজানু হইয়া শফরী সোমভদ্রের বুকের মাঝখানে অতি সন্তর্পণে চুম্বন করিল।
সোমভদ্র তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে শয্যায় পড়িয়া ছিল, চমকিয়া জাগিয়া উঠিল।
আজ গৃহে ফিরিবার পর হইতে সে সকলের কাছে মেরুকার কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু বলি-বলি করিয়াও বলিতে পারে নাই; মেরুকার নাম কণ্ঠ পর্যন্ত আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছে। মনে হইয়াছে, মেরুকার নাম উচ্চারণ করিলেই গৃহের এই শান্ত আনন্দময় পরিমণ্ডল চূর্ণ হইয়া যাইবে। সতেরো বছর পূর্বে শফরী যেদিন জন্মগ্রহণ করে সেইদিন হইতে স্থির হইয়া আছে। তাহারা দুজনে স্বামী-স্ত্রী। দুজনে একসঙ্গে বড় হইয়াছে, কেহ অন্য কথা ভাবিতেও পারে নাই। তারপর যুদ্ধযাত্রা। কোথা হইতে বন্দিনী মেরুকা আসিয়া তাহার হৃদয় হরণ করিয়া লইল। সোমভদ্র প্রাণমন দিয়া মেরুকাকে ভালবাসিয়াছে, তাহাকে বিবাহ করিতে চায়। কিন্তু গৃহে ফিরিবার পর পিতামাতার মুখের পানে চাহিয়া, শরীর মুখের পানে চাহিয়া তাহার মনে অপরাধের গ্লানি আসিয়াছে, মুখ ফুটিয়া মনের কথা বলিতে পারে নাই। গৃহে ফিরিয়াই সকলের মনে আঘাত দিতে তাহার মন সরে নাই।
কিন্তু একথা বেশিক্ষণ লুকাইয়া রাখা চলিবে না। কাল প্রাতেই সে মেরুকাকে আনিতে যাইবে; মেরুকাকে লইয়া গৃহে ফিরিবার পর কিছুই আর অজ্ঞাত থাকিবে না। পিতামাতা তখন কি করিবেন, শফরী কি করিবে কিছুই অনুমান করা যায় না। তার চেয়ে আগেই কথাটা জানাইয়া রাখা ভাল। পিতামাতা যদি অমত করেন তখন মেরুকাকে লইয়া সে অন্যত্র ঘর বাঁধিবে। তাহার অর্থের অভাব নাই; সে যোদ্ধা, যুদ্ধে কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছে, অর্থও প্রচুর অর্জন করিবে–
তবু সে বলিতে পারে নাই। বিক্ষুব্ধ মন লইয়া সে শয়ন করিতে গিয়াছিল। তারপর তন্দ্রার ঘোরে সে পিতামাতা ও শরীর সঙ্গে তর্ক করিয়াছে, স্বপ্নে মেরুকাকে ভগিনী বলিয়া চুম্বন করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে, আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে—এইভাবে অর্ধেক রাত্রি কাটিয়াছে।
শরীর চুম্বনে ঘুম ভাঙিয়া সে উঠিয়া বসিল। চোখের জড়িমা দূর হইলে দেখিল, মেরুকা নয়, শফরী। তাহার মন অপ্রত্যাশিতভাবে স্বস্থ ও নিরুদ্বেগ হইল। শফরী একাকিনী, তাহাকে সে সব কথা বলিতে পারিবে। শরীর সহিত তাহার মনের একটি সংযোগ আছে, নাড়ির যোগ, শফরী তাহার মনের কথা বুঝিতে পারে। তাহাকে মেরুকার কথা বলিলে সে বুঝিবে।
সোমভদ্র শফরীর হাত ধরিয়া তাহাকে শয্যার পাশে বসাইল, চুপি চুপি বলিল—শফরি, তোর সঙ্গে কথা আছে।
শফরী তাহার কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল—কি কথা?
প্রায় আলিঙ্গনবদ্ধভাবে বসিয়া দুজনের মধ্যে হ্রস্বকণ্ঠে কথা হইতে লাগিল। জোরে কথা বলিলে মা-বাবার ঘুম ভাঙিয়া যাইতে পারে।
সোমভদ্র বলিল—আমি একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি। কী সুন্দর মেয়ে, একবার দেখলে তুইও ভালবেসে ফেলবি।
সোমভদ্রের বাহুবেষ্টনের মধ্যে শফীর দেহ শক্ত হইয়া উঠিল—কে সে?
সোমভদ্র বলিল—তার নাম মেরুকা, যাদের আমরা যুদ্ধে বন্দিনী করে এনেছি তাদেরই একজন। বন্দিনী হলেও উঁচু ঘরের মেয়ে। আমি তাকে বোন বলে ডেকেছি, তাকেই বিয়ে করব।
শফরীর মেরুযষ্টি লৌহশঙ্কুর ন্যায় ঋজু হইয়া রহিল, সে ধীরে ধীরে বলিল—তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু সে তো তোমার সত্যিকারের বোন নয়।
সোমভদ্র বলিল—নাই বা হল সত্যিকারের বোন। যার সঙ্গে ভালবাসা হয় সেই তো বোন। ভেবে দ্যাখ, যার সত্যিকার বোন নেই তার কী হয়? সে তো বাইরের মেয়েকে বিয়ে করে। আমিও তেমনি বাইরের মেয়েকে বিয়ে করব।
শরীর জিহ্বা শুষ্ক হইয়া গিয়াছিল। অনেকক্ষণ পরে সে বলিল—কিন্তু ওর তো ঘর নেই। ওকে নিয়ে তুমি যাবে কোথায়?
অবশ্য স্ত্রীর ঘরেই স্বামীকে যেতে হয়। কিন্তু ওর যখন ঘর নেই তখন বাবাকে বলব এই বাড়িতেই আমাদের স্থান দিতে। তা যদি তিনি না দেন তখন আলাদা ঘর বাঁধব।
আর আমি? আমার কি হবে? কথাগুলি শফরী অতিকষ্টে কণ্ঠ হইতে বাহির করিল।
সোমভদ্র তাহার কণ্ঠস্বরের মর্মান্তিক শুষ্কতা লক্ষ্য করিল না, সাগ্রহে বলিল—তুইও আমার মতো বাইরে বিয়ে করবি। শাস্ত্রে বলেছে মাঝে মাঝে বাইরে বিয়ে করতে হয়, নইলে বংশের অধোগতি হয়। কিন্তু তুই যদি নিতান্তই বাইরের মানুষকে ঘরে না আনতে চাস—তাহলে শ্যেনভদ্র তো রয়েছে! দুচার বছরের মধ্যে ও জোয়ান হয়ে উঠবে–
শফরী সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল—আমি যদি বিয়ে না করি তাতেই বা ক্ষতি কি? তোমার যা। ইচ্ছা তুমি তাই কর। আচ্ছা, এবার ঘুমোও।
সোমভদ্র তাহার হাত টানিয়া বলিল—আমি ভোর না হতেই চলে যাব মেরুকাকে আনতে। মা-বাবাকে তুই কথাটা শুনিয়ে রাখিস।
আচ্ছা— শফরী তাহার হাত ছাড়াইয়া চলিয়া গেল। সোমভদ্র অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে আবার শয়ন করিল। এ ভালই হইল। পিতামাতাকে নিজের মুখে কিছু বলিতে হইবে না।