অশনি সংকেত (Ashani Sanket) : 11
গঙ্গাচরণ ও ক্ষেত্র কাপালী সাপ্লাই অফিসারের অফিসে এসে দেখলে সেখানে রথযাত্রার ভিড়। আপিসঘরের জানলা দিয়ে পারমিট বিলি করা হচ্চে, লোকে জানলার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে পারমিট নিচ্চে। সে ভিড়ের মধ্যে ছত্রিশ জাতির মহাসম্মেলন। দস্তুরমত বলবান ব্যক্তি ছাড়া সে বূ্যহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ অসম্ভব। ঘরের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে তাড়া শোনা যাচ্চে, লোকজন কিছু কিছু পিছিয়ে আসচে, কিছুক্ষণ পরেই আবার পূর্বের অবস্থা, ভিড়ের স্থিতিস্থাপকত্ব দিব্যি বেশি।
গঙ্গাচরণ হতাশভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে। ভিড় কমবার নাম নেই,—বরং ক্রমবর্ধমান। গরমও তেমনি, আকাশে মেঘ জমে গুমটের সৃষ্টি করেচে। এক ঘণ্টা কেটে গেল—হঠাৎ ঝুপ করে জানলা বন্ধ হয়ে গেল। শোনা গেল হাকিম আহার করতে গেলেন, আবার আসবেন তার কিছু ঠিক নেই। ভিড় ক্রমে পাতলা হয়ে এল—লোকজন কতক গিয়ে আপিসের সামনে নিমগাছের তলায় বসে বিড়ি টানতে লাগলো।
ক্ষেত্র কাপালী বললে—ঠাকুরমশাই, কি করবেন?
—বসি এসো।
—চলুন বাজারে গিয়ে খোঁজ করি, যদি দোকানে পাই। এ ভিড়ে ঢুকতি পারবেন না।
বাজারে গিয়ে প্রতি দোকানে খোঁজ করা হল। জিনিস নেই কোনো দোকানে। পাতিরাম কুণ্ডুর বড় দোকানে গোপনে বললে—সুজি দিতে পারি, দেড় টাকা সের। লুকিয়ে নিয়ে যাবেন সন্দের পর।
ক্ষেত্র কাপালী বললে—আটা আছে?
—আছে, বারো আনা করে সের।
—মিছরি?
—দেড় টাকা সের। সন্দের পর বিক্রি হবে।
গঙ্গাচরণ হিসেব করে দেখলে, কাছে যা টাকা তাতে বিশেষ কিছু কেনা হবে না। পারমিট পেলে সস্তায় কিছু বেশি জিনিস পাওয়া যেতে পারে।
আবার ওরা দুজনে সাপ্লাই অফিসারের আপিসে এল, তখন ভিড় আরও বেড়েছে কিন্তু জানলা খোলে নি।
একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বসে আছেন। গঙ্গাচরণ বিড়ি খাওয়ার জন্য তার কাছে গেল—জিজ্ঞেস করলে—আপনার নিবাস কোথায়?
—মালিপোতা।
—সে তো অনেক দূর! কি করে এলেন?
—হেঁটে এলাম, আবার কিসে আসবো? গরীব লোক, এ বাজারে নৌকো কি গাড়ীভাড়া করে আসবার খ্যামতা আছে?
—কি নেবেন?
—কিছু খাবার নেই ঘরে। আমার বিধবা পিসী ঘরে, তাঁর একাদশী আসচে। দশমীর দিন রাত্তিরে দুখানা রুটি করেও তো খাবেন। তাই আটা নিতে এসেচি।
—চাল পাচ্ছেন ওদিকে?
—পাবো না কেন, পাওয়া যায়। দু’টাকা কাঠা—তাও অনেক খুঁজে তবে নিতি হবে। খাওয়া হয় না মাঝে মাঝে।
এই সময় জানলা খোলার শব্দ হতেই লোকের ভিড় সেই দিকেই ছুটলো। গঙ্গাচরণ বৃদ্ধের হাত ধরে বললে—শীগগির আসুন, এর পর আর জায়গা পাব না—
তাও এরা পিছিয়ে পড়ে গেল। অতগুলো মরীয়া লোকের সঙ্গে দৌড়পাল্লায় প্রতিযোগিতা করা এদের পক্ষে সম্ভব হল না। এদের পক্ষে বেশির ভাগ এসেচে আটা যোগাড় করতে।
একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সে দুপুরবেলা চাল যোগাড় না করতে পেরে উপবাসে আছে, একটু আটা নিয়ে গেলে তবে তার দিনের আহার পেটে পড়বে। তারা মরীয়া হবে না তো মরীয়া হবে কে?
আরও এক ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর গঙ্গাচরণ জানলার সামনে দাঁড়াবার জায়গা পেলে।
সাপ্লাই অফিসার টানা টানা কড়া সুরে জিজ্ঞেস করলেন—কি?
গঙ্গাচরণের ভরসা ছিল তার চেহারার দিকে চাইলে সাপ্লাই অফিসার ভদ্রলোক বা ব্রাহ্মণ বলে খাতির করবে। কিন্তু তাতে নিরাশ হতে হল, কারণ হাকিম চোখ তুলে তার দিকে চাইলেন না। তাঁর চোখ টেবিলের ওপরকার কাগজের দিকে। হাতে কলের কলম, অর্থাৎ যে কলম কালিতে ডোবানোর দরকার হয় না।
গঙ্গাচরণের গলা কেঁপে গেল, বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। হাত-পা কাঁপতে লাগলো।
সে বললে—হুজুর, আমার স্ত্রী আঁতুড়ে। কিছু খাবার নেই, আঁতুড়ের পোয়াতি, কি খায়, না আছে একটু আটা—
হাকিম ধমকের সুরে বললেন—আঃ কি চাই?
—আটা, চিনি, সুজি, একটু মিছরি—
—ওসব হবে না।
—না দিলে মরে যাবো হুজুর। একটু দয়া করে—
—হবে না। আধসের আটা হবে, এক পোয়া সুজি, একপোয়া মিছরি—বলেই খস খস করে কাগজে লিখে হাকিম গঙ্গাচরণের হাতে তুলে দিয়ে বললেন—যাও—
—হুজুর, পাঁচ-ছ’ক্রোশ দূর থেকে আসচি। এতে ক’দিন হবে হুজুর! দয়া করে কিছু বেশি করে দিন—
—আমি কি করবো? হবে না যাও—
গঙ্গাচরণ হাত জোড় করে বললে—গরীব ব্রাহ্মণ, দয়া করে আমায়—
হাকিম বিরক্তির সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বললেন—দেখি কাগজ? যাও, এক সের আটা—যত বিরক্ত—
লোকজনের ধাক্কায় গঙ্গাচরণকে ছিটকে পড়তে হল জানলা থেকে। পেছন থেকে দু-একজন বলে উঠলো—ওমা, দেরি করো কেন? কেমনধারা লোক তুমি? সরো—
চাপরাসি চেঁচিয়ে বললে—হঠ যাও—
বাজারে দোকান থেকে আটা কিনতে গিয়ে দেখলে আটা এবং সুজি দুই-ই খারাপ, একেবারে খাদ্যের অনুপযুক্ত নয় বটে তবে জিনিস ভালোও নয়।
একটা ময়রার দোকানে ওরা খাবার খেতে গেল। ক্ষেত্র কাপালীর বড় ইচ্ছে সে গরম সিঙাড়া খায়। শহর বাজারে তো প্রায় আসা হয় না—থাকে নিতান্ত অজ পাড়াগাঁয়ে। কিন্তু খাবারের দোকানে সিঙাড়া কিনতে গিয়ে সে দেখলে পানের খিলি অপেক্ষা একটু বড় সিঙাড়া একখানার দাম দু পয়সা। জিনিসপত্রের আগুন দর। সন্দেশের সের এ অঞ্চলে চিরকাল ছিল দশ আনা, বারো আনা—এখন তাই হয়েছে তিন টাকা। রসগোল্লা দু’টাকা।
ক্ষেত্র কাপালী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—কোনো জিনিস কিনবার জো নেই ঠাকুরমশাই!
—তাই তো দেখচি—
—কি খাবো বলুন তো? এ তো দেখচি এক টাকার কম খেলি পেট ভরবে না। আপনি খাবা না?
—না, আমি কি খাবো? আমার খিদে নেই।
—সে হবে না ঠাকুরমশাই। আমার কাছে যা পয়সা আছে, দুজনে ভাগ করে খাই।
গঙ্গাচরণ ধমক দিয়ে বললে—কেন মিছে মিছে বাজে কথা বলিস? খেয়ে নিগে যা—
কিন্তু গঙ্গাচরণের বড় লোভ হল একখানা থালায় সাজানো বড় বড় জোড়া সন্দেশ দেখে। তার নিজের জন্যে নয়, অনঙ্গ-বৌ কতকাল কোনো জিনিস খায় নি। ওর জন্যে যদি দুখানাও নিয়ে যাওয়া যেত!
ক্ষেত্র কাপালী গরম সিঙাড়া খেয়ে জল খেয়ে পানের দোকানে পান কিনতে গিয়েচে—ও তখন ময়রাকে বললে—তোমার ঐ জোড়া সন্দেশের দাম কত?
—চার আনা করে।
—দুখানা চার আনা?
—সেকাল নেই ঠাকুর। একখানার দাম চার আনা।
গঙ্গাচরণ অবাক হল। ওই জোড়া সন্দেশের একখানির দাম ছিল এক আনা। সেই জায়গায় একেবারে চার আনা! সে কি কেনা ওর চলবে? অসম্ভব। হাতে অত পয়সা নেই। গঙ্গাচরণ বার বার জোড়া সন্দেশের দিকে চাইতে লাগলো। সুন্দর সন্দেশ গড়েচে। কারিগর ভালো।
ঠোঙা থেকে বের করেই যদি অনঙ্গর হাতে দেওয়া যেত।
—ওগো, দ্যাখো কি এনেচি—
—কি গা?
—কেমন জোড়া সন্দেশ, দেখেচ? তোমার জন্যে নিয়ে এলাম।
কখনো স্ত্রীর হাতে কোনো ভালো খাবার তুলে দেয় নি। পাবেই বা কোথায়? কবে সচ্ছল পয়সার মুখ দেখেচে সে? তার ওপর এই ভীষণ মন্বন্তর।
ক্ষেত্র কাপালীর কাছেও পয়সা নেই যে ধার করবে। সে পেটুক ব্যক্তি। বসে বসে, যা কিছু এনেছিল, জিলিপি আর সিঙাড়া কিনেই ব্যয় করেচে।
বেলা পড়ে এসেচে। নদীর ধার দিয়ে দিয়ে রাস্তা। দুজনে পথ হেঁটে চললো গ্রামের দিকে। ক্ষেত্র কাপালী বিড়ি টানচে আর বকবক করে বকচে। গঙ্গাচরণ চাদরের প্রান্তে দুটি মুড়ি-মুড়কি বেঁধে নিয়েচে মাত্র দু’আনার। এত অল্প জিনিস যে কয়েক মুঠো খেলেই ফুরিয়ে যাবে। ছেলে দুটো বাড়ীতে আছে, বলবে এখন, বাবা কি এনেচ আমাদের জন্যে? ছেলেমানুষ, তারা কি মন্বন্তর বোঝে? তাদের জন্যে দুটো নিয়ে যেতে হবে, দুটো ও খাবে একটা ভালো পরিষ্কার জায়গায় বসে। খেয়ে নদীর জল পান করবে। সারাদিন অনাহার—ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুই-ই প্রবল।
এক জায়গায় গাছতলায় বসে গঙ্গাচরণ দু’তিন মুঠো মুড়ি-মুড়কি খেয়ে নিয়ে জলে নামতে গিয়ে দেখলে একটা শেওলা দামের ওপারে অনেক কলমীশাক। আজকাল দুর্লভ—শাক-পাতা কি লোক রাখচে? ক্ষেত্র কাপালীকে বললে—জলে নামতে পারবি? শাক নিয়ে আয় তো দিকি—
ক্ষেত্র কাপালী গামছা পরে জলে নেমে একগলা জল থেকে দাম টেনে এনে কলমীলতার ঝাঁক ডাঙার কাছে তুললে। তারপর দুজনে মিলে শাক ছিঁড়ে বড় দু’আঁটি বাঁধলে।
বাড়ী ফিরতেই অনঙ্গ-বৌ ক্ষীণস্বরে বললে—ওগো, এলে? এদিকে এসো—
—কেমন আছ?
—এখানে বোসো। কোথায় গিইছিলে এতক্ষণ? কতক্ষণ যেন দেখি নি—
—টাউনে গেলাম তো। তোমাকে বলেই তো গেলাম। জিনিস-পত্র নিয়ে এলাম সব।
অনঙ্গ নিস্পৃহ উদাস সুরে বললে—বোসো এখানে। সারাদিন টো টো করে বেড়াও কোথায়? তোমায় একটুও দেখতে পাই নে।
গঙ্গাচরণের মনে বড় কষ্ট হল ওকে দেখে। বড় দুর্বল হয়ে পড়েচে অনঙ্গ-বৌ। এমন ধরণের কথাবার্তা ও বড় একটা বলে না। এ হল দুর্বল রোগীর কথাবার্তা। অনাহারে শীর্ণ দুর্বল হয়ে পড়েচে, কতকাল ধরে পেটপুরে খেতে পেত না, কাউকে কিছু মুখ ফুটে বলা ওর স্বভাব নয়, কত সময় নিজের বাড়া ভাত অপরকে খেতে দিয়েচে। শরীর সে সবের প্রতিশোধ নিচ্চে এখন।
গঙ্গাচরণ সস্নেহে বললে—তুমি ভালো হয়ে ওঠো। তোমাকে জোড়া সন্দেশ এনে খাওয়াবো টাউন থেকে। হরি ময়রা যা সন্দেশ করেচে! দেখলে খেতে ইচ্ছে করে।
অনঙ্গ-বৌ আঁতুড় থেকে বেরিয়েচে, কিন্তু বড় দুর্বল, শীর্ণদেহ। খেতেই পায় না তা সারবে কোথা থেকে? গঙ্গাচরণ প্রাণপণে চেষ্টা করে খাবারের এটা-সেটা যোগাড় করতে, কিন্তু পেরে ওঠে না। একটু ঘি কত কষ্টে গঙ্গানন্দপুরের শশী ঘোষের বাড়ী থেকে যোগাড় করে নিয়ে এল। তাও ঘোষমশায় আট টাকা সেরের কমে ছাড়তে চায় না। ব্রাহ্মণত্বের দোহাই দিয়ে অনেক করে ঘিটুকু যোগাড় করা।
ঘি যদি বা মেলে দূর গ্রামে, নিজ গ্রামে না মেলে একটু দুধ, না একটু মাছ।
অনঙ্গ-বৌ বললে—ওগো, তুমি টো টো করে অমন বেড়িও না। তোমার চেহারাটা খারাপ হয়ে গিয়েচে। আয়নায় মুখখানা একবার দেখো তো—
গঙ্গাচরণ বললে—দেখা আমার আছে। তুমি ঠাণ্ডা হও তো।
—চাল পেয়েছিলে?
—অল্প যোগাড় করেছিলাম কাল।
—তোমরা খেয়েছ?
—হুঁ।
অনঙ্গ-বৌ আঁতুড় থেকে বেরুলেও নড়তে চড়তে পারে না—শুয়েই থাকে। রান্না করে গঙ্গাচরণ ও হাবু। পাঠশালা আজকাল সবদিন হয় না। বিশ্বাস-মশায় এখান থেকে সরে যাওয়াতে পাঠশালার অবস্থা ভালো নয়। এ দুর্দিনে আকস্মিক বিপৎপাতের মত দুর্গা ভটচায একদিন এসে হাজির। গঙ্গাচরণ পাঠশালাতে ছেলে পড়াচ্চে।
—এই যে পণ্ডিতমশায়!
গঙ্গাচরণ চমকে গেল। বললে—আসুন, কি ব্যাপার?
—এলাম।
—ও, কি মনে করে?
—মা ভালো আছেন?
—হুঁ।
—সন্তানাদি কিছু হল?
—হয়েচে।
গঙ্গাচরণ তখনও ভাবচে। দুর্গা ভটচাযের মতলবখানা কি? ভটচায কি বাড়ী যেতে চাইবে নাকি? কি মুশকিলেই সে পড়েচে! কত বড়লোক আছে দেশে, তাদের বাড়ীতে যা না কেন বাপু! আমি নিজে পাইনে খেতে, কোনো রকমে ছেলে দুটোর আর রোগা বউটার জন্যে দুটি চাল আটা কত কষ্টে যোগাড় করে আনি, ভগবান তা জানেন। থাকে থাকে, এ ভ্যাজাল কোথা থেকে এসে জোটে তার মধ্যে!
দুর্গা একটা ছেলেকে উঠিয়ে তার কেরোসিন কাঠের বাক্সটার ওপর বসলো, তারপর গলার উড়ুনিখানা গলা থেকে খুলে হাঁটুর ওপর রেখে বললে—একটু জল খাওয়াতে—
—হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরে পটলা টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে আয় দিকি ঘটিটা মেজে।
—একটা কথা আছে আপনার সঙ্গে, বলচি—জলটা খাই। তেষ্টায় জিব শুকিয়ে গিয়েচে।
জল পান করে দুর্গা পণ্ডিত একটু সুস্থ হয়ে বললে—আঃ!
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। তারপর দুর্গাই প্রথম বললে—বললে—বড় বিপদে পড়েচি, পণ্ডিত মশাই—
—কি?
—এই মন্বন্তর, তার ওপর চাকরিটা গেল।
—পাঠশালার চাকরি?
—হ্যাঁ মশাই। হয়েচে কি, আমি আজ ন’টি বছর কামদেবপুর পাঠশালায় সেকেন পণ্ডিতি করচি, মাইনে আগে ছিল সাড়ে তিন টাকা, এখন দেয় পাঁচ টাকা। তা মশাই, গোয়ালা হল ইস্কুলের সেক্রেটারি। আজ পাঁচমাস হল কোথা থেকে এক গোয়ালার ছেলে জুটিয়ে এনে তাকে দিয়েচে চাকরি। সে করলে কি মশাই! দার্জিলিং গেল বেড়াতে। সেখান থেকে এসে উন্মাদ পাগল হয়ে গেল—
—কেন কেন?
—তা কি করে জানবো মশাই? কোথাকার নাকি ফটোগেরাপ তুলতে গিয়েছিল, সায়েবে কি খাইয়ে দেয়—এই তো শুনতে পাই। মশাই, তুমি পাও পাঁচ টাকা মাইনে, তোমার সেই দার্জিলিং-এ যাওয়ার কি দরকার? সেখানে সায়েব-সুবোদের জায়গা। বাঙালীরা সেখানে গেলে পাগল করে দেয় ওষুধ খাইয়ে। সাধে কি আর বলে—
—সে যাক, আসল কথাটা কি সংক্ষেপে বলুন—
—তারপর সে ছোকরা আজ তিন মাস পরে এসে জুটেছে। এখন আর পাগল নেই, সেরে গিয়েচে। তাকে নেবে বলে আমায় বললে—আপনি এক মাস ছুটির দরখাস্ত করুন—
—আপনি করে দিলেন?
—দিতে হল। হেডমাস্টার নিজে আমার টেবিলে এসে বলে—লিখুন দরখাস্ত। লিখলাম। কি আর করি! তখুনি মঞ্জুর করে দিলে। এখন দেখুন বিপদ। ঘরে নেই চাল, তার ওপর নেই চাকরি। আমি এখন কি করি? বাড়ীসুদ্ধ যে না খেয়ে মরে, তাই ভাবলাম যাই আপনার কাছে। একটা পরামর্শ দ্যান। আর তো কেউ নেই যে তাকে দুঃখের কথা বলি।
গঙ্গাচরণ মনে মনে বললে—দুঃখের কথা একবার ছেড়ে একশোবার বলো। কিন্তু বাড়ী যেতে চাও যদি, তবেই তো আসল মুশকিল। দুর্গা ভটচাযের মতলবখানা যে কি, তা গঙ্গাচরণ ধরতে না পেরে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছেলে দুটির চাল জোটানো যাচ্চে না, বউটার জন্যে কত কেঁদেককিয়ে এক সের আটা নিয়ে আসা, এই সময় দুর্গা ভটচায যদি গিয়ে ঘাড়ে চাপে, তবে চোখে অন্ধকার দেখতে হবে যে দেখচি। স্ত্রীও এমন নির্বোধ, যদি ও গিয়ে হাজির হয় আর কাঁদুনি গায় তার সামনে, তবে আর দেখতে হবে না। মুখের ভাত বেড়ে দেবে। নিজে না খেয়ে ঐ বুড়োটাকে খাওয়াবে।
নাঃ, কি বিপদেই সে পড়েচে।
এখন মতলবখানা কি বুড়োর?
বসে বসে গঙ্গাচরণ আকাশপাতাল ভাবতে লাগলো।
যদি ছুটির পরে দুর্গা ভটচায তার সঙ্গে তার বাড়ী যেতে চায়, তবে?
না, ও চলবে না। একটা কিছু ফন্দি বার না করলে চলবে না। এমন কিসের খাতির দুর্গা ভটচাযের সঙ্গে যে নিজের স্ত্রী-পুত্রের মুখ বঞ্চিত করে ওকে খেতে দিতে হবে?
দুর্গা ভটচায বলে—ছুটি দেবেন কখন?
—ছুটি? এখনও অনেক দেরি।
—সকাল বিকেল করেন, না এক বেলাই?
—এক বেলা।
গঙ্গাচরণ তামাক সেজে খাওয়ালে নিজের হাতে দুর্গাকে।
দুর্গা তামাক খেয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হুঁকোটি গঙ্গাচরণের হাতে দিয়ে বললে—এখন বড় যে বিপদে পড়ে গেলাম। চাকরি নেই, হাতে একটা পয়সা নেই—আপনার কাছে বলতে কি, আজ দু’দিন সপরিবারে না খেয়ে খিদের জ্বালায় ছুটে এলাম, বলি কোথায় যাই? আর তো কেউ নেই কোথাও? মা-ঠাকরুণ দয়া করেন, মা আমার, অন্নপুন্নো আমার। তাই—
এর অর্থ সুস্পষ্ট। দুর্গা ভটচায বাড়ীই যাবে। সেইজন্যেই এখনো ওঠে নি, বসে বসে তামাক খাচ্চে। দুদিন খাই নি! সে যখনই আসে, তখনই বলে দুদিন খাই নি, তিনদিন খাই নি। কে মশায় তোমাকে রোজ রোজ খাওয়ায়—আর এই দুর্দিনে? লোকের তো একটা বিবেচনা থাকা উচিত।
কি মতলব ফাঁদা যায়? বলা যাবে কি ও বাপের বাড়ী গিয়েচে? কিংবা ওর বড্ড অসুখ? উঁহু, তাহলে ও আপদটা সেখানে দেখতে যেতে পারে।
গঙ্গাচরণ আকাশপাতাল ভেবে কিছুই পেল না। ছুটির সময় হয়ে এল। পাঠশালার ছুটি দিয়ে গঙ্গাচরণ যেমন বাড়ীর দিকে চলবে, ও অমনি চলবে গঙ্গাচরণের সঙ্গে। সোজাসুজি কথা বললে কেমন হয়? না মশাই, এবার আর সুবিধে হবে না আমার ওখানে। বাড়ীতে অসুখ, তার ওপর চালের টানাটানি।
কিন্তু পরবর্তী সংবাদের জন্যে গঙ্গাচরণ প্রস্তুত ছিল না।
বেলা যত যায় দুর্গা ভটচায মাঝে মাঝে পাঠশালা থেকে নামে আর রাস্তার ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে সেখহাটি-মণিরামপুরের বিলের দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখে।
দু’তিনবার এ রকম করবার পরে গঙ্গাচরণ কৌতূহলের সুরে বললে—কি দেখচেন?
—এত দেরি হচ্চে কেন, তাই দেখচি।
—কাদের দেরি হচ্চে? কারা?
—ওই যে বললাম। বাড়ীর সবাই আসচে কিনা। আমার স্ত্রী, মেয়েটা, আর দুটি ছেলে। সব না খেয়ে আছে যে। আর কোনো উপায় তো দ্যাখলাম না। বলি, চলো আমার অন্নপুন্নো মার কাছে। না খেয়ে ষোল-সতেরো বছরের মেয়েটা বড্ড কাতর হয়ে পড়েচে। দিশেহারা মত হয়ে গিয়েচে মশাই। তা আমি দুটো কলাইসেদ্ধ খেলাম মণিরামপুরের নিধু চক্কত্তির বাড়ী এসে। তাদেরও সেই অবস্থা। গোয়ালার বামুন, এ দুর্দিনে কোনো কাজকর্ম নেই, পায় কোথায় বলুন! চাল একদানা নেই তাদের ঘরে। নিধু চক্কত্তির বুড়ো মা বুঝি জ্বরে ভুগছে আজ দু মাস। ওই ঘুষঘুষে জ্বর। তারই জন্যে দুটো পুরনো চাল যোগাড় করা আছে। তিনি খান। ওরা খেতে বসেচে সিদ্ধকলাই। সব সমান অবস্থা। আমি বলি আমি এগিয়ে গিয়ে বসি পণ্ডিত মশাইয়ের পাঠশালায়, তোমরা এসো।
সর্বনাশের মাথায় পা!
দুর্গা ভটচায গুষ্টিসমেত এ দুর্দিনে তারই বাড়ী এসে জুটচে তা হলে। মতলব করেচে দেখচি ভালোই।
এখন উপায়?
সোজাসুজি বলাই ভালো। না কি?
এমন সময়ে রাস্তা থেকে বালিকা-কণ্ঠে শোনা গেল—ও বাবা—
—কে রে, ময়না? বলেই দুর্গা পণ্ডিত বাইরে চলে গেল।
গঙ্গাচরণ বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে, একটি ষোল-সতের বছরের মেয়ে পাঠশালার সামনে পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে নিয়ে অল্প একটু পরেই দুর্গা পণ্ডিত পাঠশালায় ঢুকে বললে—এই আমার মেয়ে ময়না, ভালো নাম হৈমবতী। প্রণাম করো মা—
কি বিষম মুশকিল!
হৈমবতী এগিয়ে এসে প্রণাম করলে সলজ্জভাবে। বেশ সুন্দরী মেয়ে। ওই রোগাপটকা, দড়ির মত চেহারা দুর্গা ভটচাযের এমন সুন্দর মেয়ে!
দুর্গা ভটচায বললে—ওরা সব কৈ?
হৈমবতী বললে—ওই যে বাবা গাছতলায় বসে আছে মা আর খোকারা। আমি ওদের কাছে যাই বাবা। বোঁচকা নিয়ে মা হাঁটতে পারচে না।
গঙ্গাচরণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েচে। এদের তাড়ানো আর তত সহজ নয়। এরা বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে আহারের সন্ধানে দেশত্যাগ করে যখন রওনাই হয়েচে। বিশেষ করে মেয়েটিকে দেখে গঙ্গাচরণের মন নরম হয়েচে। অমন সুন্দরী মেয়ের অদৃষ্টে কি দুঃখ! খেতে পায় নি আজ দুদিন। আহা!
স্নেহে গঙ্গাচরণের মন ভরে উঠলো।
একটু পরে পাঠশালার ছুটি দিয়ে গঙ্গাচরণ সদলবলে বাড়ীর দিকে রওনা হল।