কাচের জানলা
কাচের জানলা, তাই অতি ভোরের সূৰ্য যখন রক্তবর্ণ, তখনই আলোয় বাংলোর খানা ঘর ভরে যায়। এক ঘরের খাটে সঞ্জয় আর শেখর, অন্য ঘরে অসীম আর রবি, চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে দেখা যায়। রবির লম্বা শরীরটা কুঁকড়ে আছে–শেষ রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শেখরের মুখখানা যেন বিষদাচ্ছন্ন, বোধহয় কোনো দুঃখের স্বপ্ন দেখেছে একটু আগে।
বারান্দায় খাবারের ভাঁড়ট ভর্তিই পড়ে আছে, অসংখ্য কালো পিঁপড়ে সেটাকে ছেঁকে ধরেছে। থামের পাশে পড়ে আছে রক্তমাখা তুলো, ঐখানে বসে কাল রবি পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধেছিল।
সিঁড়িতে একটা বড় কোলা ব্যাঙ বিস্কুলের মতন এদিক-ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছিল, এবার সে থাপ্ থৰ্প করে নিচে নেমে গেল। নেমে গিয়ে ব্যাঙটা দুতিনটে মল্লিকা ফুলের চারার গায়ে ধাক্কা মারলো, কেঁপে উঠলো ফ্রক-পরা মেয়েদের মতন মল্লিকা ফুলগুলো—তাদের গা থেকে টুপি টুপ করে খসে পড়লো। কয়েক ফোঁটা শিশির। কী একটা পাখি ডেকে উঠলো টু-চি–টু, টু-চি-টু, সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক শালিক তার উত্তর দিলো, কুরু-রাং কু-রু-রাং কু-রু—রাং–। ভোরবেলায় পৃথিবীকে প্রত্যেকদিন মনে হয় পবিত্র নির্মল।
প্রথমে রবির ঘুম ভাঙলো! চোখ ঘুরিয়ে একবার এদিক-ওদিক তাকালো, যেন তার মনে ছিল না, সে কোথায় শুয়ে আছে! সঙ্গে সঙ্গে সে তুড়াক করে উঠে গিয়ে পা-জামাটা পরে নিলো এবং অসীমকে ধাক্কা দিয়ে বললো, এই অসীম, ওঠ ওঠ, আজ আমাদের চায়ের নেমন্তান্ন আছে। অসীম চাদর সরিয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়েই রবির দিকে ঘাড় ঘোরালো–সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দ হাসিতে তার চোখ-মুখ ভরে গেল! আবার চাদরটা টেনে গায়ে জড়িয়ে বললো, দাঁড়া, আর একটু ঘুমিয়ে নি। এক্ষুনি কি?
পাশের ঘরে শেখরের ঘুম ভাঙলো আস্তে আস্তে। প্রথমে চোখ খুললো, তখন শুধু ওর চোখ দুটোই জেগে উঠেছে, বাকি শরীরটা ঘুমন্ত। আলসভাবে শেখর তাকালো জানলার বাইরে। রান্নাঘরের দিকে বিশাল কালোজাম গাছটা হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে, তাতে এক একবার ঝিকমিকে রোদ এসে পড়ছে শেখরের মুখে, এক একবার পাতার ছায়া! তিনটে সাদা বক জামগাছটার ডালে বসে রোদ পোহাচ্ছে। এবার শেখর ওর হাতেরও ঘুম ভাঙালো। ডান হাতটা খুলে পাশের খাটের দিকে নিয়ে সঞ্জয়ের পিঠে রাখলে। ডাকলো, সঞ্জয়, ওঠা। সঞ্জয় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়েছিল, বেশ কয়েকবার ডাকেও সাড়া দিলো না।
আস্তে আস্তে চারজনেই বিছানা ছেড়ে উঠলো। মুখ ধোয়ার পর, দাড়ি কামিয়ে নিলো সবাই, অসীমের কাছে আফটার-শেভ লোশান এবং ক্রিম ছিল। প্রত্যেকের ব্যাগ থেকে ফরসা জামাপ্যান্ট বেরুলো, জুতোগুলো পর্যন্ত পালিশ করা হলো! রতিলাল তখনো আসে নি, সুতরাং এখানে চা খাওয়ার কোনো উপায় নেই। একেবারে বাড়িতে গিয়েই প্রথম চা খেতে হবে।
একটু বাদে যখন বাংলো থেকে বেরিয়ে এলো ওরা চারজন, তখন ওরা সকলেই ছিমছাম পরিচ্ছন্ন যুবা, নিখুঁত পোশাক ও সুবিন্যস্ত চুল। জঙ্গল ছেড়ে ওরা বাইরে এলো।
পরমেশ্বর গেট খুলে দিলো। ওদের দেখে, জয়ার শ্বশুর কারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলেন–সবল চেহারার বৃদ্ধ, ধবধবে মাথার চুল ও গোঁফ, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এসো, এসো—। বৌমা, ফেঁচুলের এসে গেছে–।
জয়া ও অপূৰ্ণ বেরিয়ে এলো পাশের একটি ঘর থেকে, এই সকালেই তাদের স্নান ও বেশবাস পাল্টানো হয়ে গেছে। ওরা ঘরে ঢ়োক মাত্রই সাবান, স্নো, পাউডার, মাথার তেলের মিলিত কৃত্রিম সুগন্ধে ঘর ভরে গেল! জয়া বললো, বাবা, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, এরা হচ্ছেন–।
সদাশিব ত্ৰিপাঠীর প্রশান্ত মুখে সামান্য দুচারটি মাত্র অন্য রকম রেখা। দেখলে মনে হয়, এই মানুষ জীবনে সার্থক ও তৃপ্ত, সৎ এবং উদার। তবু মুখের রেখাগুলো পড়েছে জীবন যাপনের বৈচিত্র্যে। এখানে কাছাকাছি কোথায় ওঁর একটি কাঠের কারখানা আছে, তার পরিচালনার জন্য হয়তো ওকে কখনো কঠোর হতে হয়, সেই জন্য মুখে একটি রেখা, যৌবনে কোনো হটকারিতার জন্যও সম্ভবত মুখে আর একটা রেখা পড়েছে, একমাত্র পুত্রের মৃত্যু বাঁ আত্মহত্যার জন্যও কি মুখে আর একটি রেখা পড়ে নি? তবু তাঁর সমগ্র মুখে একটি সমগ্র ব্যক্তিত্ব, তিনি হেসে বললেন, এইসব স্বাস্থ্যবান ছেলেদের দেখলে আমার, বেশ ভালো লাগে। এখানে তো বিশেষ কেউ আসে না–।
অসীমই প্রথম, বিনা ভূমিকায় ঝুপ করে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। সুতরাং বাকি তিনজনকেও প্ৰণাম করতে হয়। জয়া বললো, আসুন, ব্রেকফাস্ট রেডি—
সদাশিব বললেন, তোমরা চা খেয়ে নাও। আমি কিন্তু আগেই সেরে নিয়েছি। আমার সকাল ছটার মধ্যেই চা খাওয়া হয়ে যায়।
বড় গোল টেবিল ছিমছাম সাজানো। এখানে পাঊরুটি দূস্প্রাপ্য, কিন্তু জয়া টেবিলের মাঝখানে টোষ্টের স্তুপ সাজিয়ে রেখেছে, এমন কি টিনের সার্ডিন মাছ এবং ভালো জাতের মার্মালেড়াও উপস্থিত। প্রত্যেকের ডিশে দুটি করে মুর্গার ডিম। সবারই খিদে পেয়েছিল, খেতে শুরু করে শেখর বললো, জয়, তোমার কালকে পাঠানো কাটলেট বেশ ভালো হয়েছিল। বেশ রাঁধতে শিখেছে তো!
জয়া হাসতে হাসতে বললো, আমি তো রাঁধি নি! ঠাকুর রেঁধেছে—একটু বেশি ঝাল হয়েছে, না?
–আমি একটু বেশিই ঝাল খাই।
–কাল সন্ধে বেলা আপনার কি করলেন?
–কি আর করবো, জঙ্গলের মধ্যে একটু ঘুরলাম-টুরলাম, আর আড্ডা-সারাক্ষণ আড্ডা! ঐ জন্যই তো আসা! তোমরা কাল ঘাটশীলা থেকে কখন ফিরলে?
–বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার কপার মাইন্সের ইঞ্জিনিয়ার মিঃ সেনগুপ্তের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর বউ মহাশ্বেতা আমার মাসতুতো বোন–কিছুতেই রাত্রে না খাইয়ে ছাড়লো না।
অপর্ণা প্রত্যেকের কাপে কফি ঢেলে দিচ্ছিল, রবির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আপনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন কেন?
রবি অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললো, এই, মানে–
শেখর সঙ্গে সঙ্গে বললো, কাল রবি ফুল পাড়ুতে একটা গাছে উঠেছিল–
–গাছ থেকে পড়ে গেছেন নাকি?
–না, একেবারে ধপাস করে পড়ে গেলে কি আর হাড়গোড় আস্ত থাকতো! নামবার সময় শেষ দিকটায় পা পিছলে–
রবি বললো, একটা ছোট ডাল ধরেছিলুম, সেই ডালটা ভর্তি কাঠপিঁপড়ে–
অপর্ণা অন্যদের কাপে কফি ঢালা শেষ করলো, তারপর নিজের চেয়ারে বসে এক চুমুক দিয়ে বেশ স্পষ্ট গলায় বললো, মিথ্যে কথা মোটেই গাছ থেকে পড়ে যান নি।
এমনই অপর্ণার বলার ভঙ্গি, প্রত্যেকে ওরা চমকে উঠলো। একটা অজানা অস্বস্তি এক মুহূর্তে ওদের মুখে খেলা করে গেল। একটু লম্বা ধরনের মসৃণ মুখ অপর্ণার, সে মুখে এ পর্যন্ত একটিও রেখা পড়ে নি, বড় বড় দুটি টানা চোখের মণি দুটো সদা চঞ্চল, ভিজে চুল আলগা বেণি করে ফে লে রেখেছে বুকের ওপর, বাঁ হাতের কনুই টেবিলে রাখা, মণিবন্ধে ঘড়ি ছাড়া আর কোনো অলঙ্কার নেই, একুশ বছরের যুবতী সুলভ কোনো অকারণ লজ্জাও নেই তার, অপর্ণার চাহনি ঝর্নার জলের মতন স্বচ্ছ।
শেখর হাসার চেষ্টা করে বললো, কেন, মিথ্যে কথা কেন?
অপৰ্ণাও হাসলো, বললো, আমি জানি।
–কি করে জানলে?
–আমি মিথ্যে কথা শুনেই বুঝতে পারি। মিথ্যে কথা বলার সময় মানুষের মুখ-চোখ কি রকম বদলে যায়!
জয়া বললো, সত্যিই কিন্তু রুণি ভীষণ বুঝতে পারে।
অসীম বললো, যাঃ, তা হতেই পারে না। আমি এমন মিথ্যেবাদী দেখেছি, সারা পৃথিবী তাদের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য।
অপর্ণা বললো, আনবেন। একবার তাদের আমার সামনে!
–ইস্, খুব গর্ব যে দেখছি। আর নিজের বুঝি সব সময় সত্যি কথা বলা হয়।
–আমি তা তো বলি নি! আমি তো বলি নি, মিথ্যা কথা বলা খারাপ। আমি বলেছি, আমি মিথ্যে কথা শুনলেই বুঝতে পারি।
জয়া বললো, রুণি মাঝে মাঝে লোককে এমন অপ্রস্তুত করে দেয়! সেদিন আমাদের সরকার মশাই বাবাকে বলছেন–
রবির মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে যেন এতক্ষণ কী একটা খুঁজছিল, জয়ার মুখে রুণি নামটা সে যেন খুঁজে পেলো! এতক্ষণ কেউই অপৰ্ণাকে তুমি কিংবা আপনি বলে নি, ভাববাচ্যে কাজ সারছিল, এবার রবিই অপ্রত্যাশিতভাবে অপর্ণাকে ডাক নামে ডেকে উঠলো। বললো, তুমি আমারটা কিন্তু ঠিকই ধরেছে, রুণি! আমি সত্যি গাছ থেকে পড়ে যাই নি। কিন্তু কেন পড়ে গিয়েছিলুম, তা অবশ্য বলবো না! তুমি তো মিথ্যেটা ধরতে পারে, কিন্তু সত্যিটা আসলে কি তা বুঝতে পারো?
–অনেক সময় তাও পারি।
–এটা কিছুতেই পারবে না।
জয়া আর অপর্ণা পরস্পর চোখাচোখি করে মেয়েদের অন্তর্জগতের ভাষায় হেসে উঠলো। অপর্ণা বললো, দেখলি দিদি, কায়দাটা কি রকম খেটে গেল!
জয়া বললো, আমিও কী রকম তোকে সাহায্য করুলুম বল!
অপৰ্ণা বললো, আহা, তা না করলেও—
এরা দুবোন যেন কী একটা রহস্য করছে আঁচ পেয়ে অসীম বললো, আমরা কিন্তু রুণিকে খুশি করার জন্যই স্বীকার করছি যে, আমরা মিথ্যে কথা বলেছি।
অপর্ণা ঝরঝর করে হেসে উঠে বললো, থাক, আর বলতে হবে না! গাছে উঠে ফুল পাড়তে গিয়েছিলেন! অতই যদি ফুল ভালবাসেন, তবে আজ আসবার সময় কিছু ফুল আনতে পারেন নি!
–বাঃ, তোমাদের বাগানেই তো কত ফুল রয়েছে, সেই জন্যেই আমরা বাইরে থেকে আর ফুল আনি নি।
–আহা, কি বুদ্ধি। বাগানে ফুল থাকা আর বাইবে থেকে কারুর উপহার আনা বুঝি এক কথা?
–ইস্! সত্যিই এটা ভূল হয়ে গেছে!
–তা বলে বোকার মত কাল যেন ফুল নিয়ে আসবেন না!
শেখর বলে উঠলো, তাহলে কালও আমাদের চায়ের নেমন্তগ্ন তো! যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! এবার মেয়েদের দমন করে পুরুষদের হাসির আওয়াজ দীর্ঘ।
চায়ের পাট শেষ হলে সদাশিব ঘুরে ঘুরে সারা বাড়িটা ওদের দেখালেন। সদাশিবের কোনো পূৰ্বপুরুষ এখানকার রাজাদের কুলপুরোহিত ছিলেন—সেই আমলের কিছু স্মৃতিচিহ্ন আছে! সেই পুরোহিত বংশ এখন ধনী ও অভিজাত হয়েছে, সেই জন্যই বোধহয় ঐশ্বর্যের অহমিকার কোনো প্রকাশ নেই। দোতলার ঘরগুলো বনেদী চালে সাজানো! প্রত্যেক ঘরে পুরু গালিচা পাতা, দেয়ালে দেয়ালে অয়েল পেইন্টিং, এক ঘরে কিছু তলোয়ার, বর্শা, তীর আর গাদা বন্দুকের সংগ্রহও রয়েছে! এর অনেকগুলোই সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ব্যবহার হয়েছিল। ইতিহাস ও পুরাণ সদাশিবের বেশ ভালো পড়া আছে–তিনি ওদের বুঝিয়ে বলছিলেন, সঞ্জয় একাই প্রশ্ন করছিল শুধু।
তবে ওরা লক্ষ করলো, সদাশিব কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যান, বাক্য শেষ না করে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। এই বাড়ির প্রতিটি ঘরে একদিন আর একটি যুবার পায়ের শব্দ শোনা যেতো। বিলেতের কোন অন্ধকার ঘরে এক বরফ-পড়া ব্রাতে অপমানিত অরুচিকর মৃত্যু তাকে নিয়ে গেছে।
সদাশিব নিজের ছেলের কথা একবারও তুললেন না! ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধের মতন একবারও নিজের ভাগ্যকে দোষ দিলেন না! কঠোর সহ্যশক্তির চিহ্ন তাঁর চোখে-মুখে। দুই মেয়ের পর ঐ একটি মাত্র ছেলে ছিল তাঁর রূপবান, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান ছেলে; পার্থিব কোনো কিছুরই অভাব ছিল না তার, নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল জয়াকে, ফুটফুটে সন্তানের পিতা হয়েছিল—তবু কেন সব ছেড়ে সে দূর লন্ডনের এক ভ্যাপসা গন্ধমাখা ঘরে একা একা স্বেচ্ছায় মৃত্যুর কাছে চলে গেল-এই একটা বিরাট প্রশ্ন এ বাড়ির নিস্তব্ধতার মধ্যে মিশে আছে।
খানিকক্ষণ ওরা হৈ-হৈ করে সামনের বাগানে ব্যাডমিন্টন খেললো। রবির হাতে র্যাকেট ঘোরে তলোয়ারের মতন, অপর্ণাও মন্দ খেলে না। চটি খুলে রেখে খালি পায়ে ছুটছে অপর্ণা, এক একটা পয়েন্ট নিয়ে রবিকে বলছে, জানি, আপনি বলবেন, আপনার পা খোঁড়া বলে আজ খেলতে পারছেন না! আপনাকে হারিয়ে আনন্দ নেই।
রবি বললো, দেখো-না, এক পায়েই কী রকম খেলি! সঞ্জয়, তুই পেছন দিকটা সামলে রখ।
–অসীমদা, আপনি অত চাপ মারবেন না, প্লেসিং করুন। পরমেশ্বর জয়ার ছেলে দেবকুমারকে বেড়িয়ে নিয়ে ফিরে এলো। শেখর তাকে নিয়ে আদর করলো, তার সঙ্গে ছেলেমানুষ হয়ে খেললো খানিকক্ষণ। দুগেম খেলেই জয়া হাঁপিয়ে উঠেছিল, সে এসে পাথরের বেদিতে বসলো। শেখর বললো, জয়া, আজ তো হাট হবে। আজ হাটে যাবে নাকি?
জয়া বললো, হাঁ, রুণি বলেছে কাচের চুড়ি কিনবে।
–আমরাও যাবো গুঃখানে তা হলে দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে।
–ভাগ্যিস আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো। নইলে বড় একঘেয়ে লাগছিল। রুণি তো হাঁপিয়ে উঠেছে এরই মধ্যে!
–তোমরা আর কতদিন থাকবে?
–বাবা আরও দিন পনেরো থাকতে চান। কুণিরও তো এখন ছুটি। আপনাদের কেমন লাগছে এ জায়গাটা?
–আমার তো বেশ ভালোই লাগছে। তোমরা আমাদের বাংলোয় চলে না—সবাই মিলে পিকনিক করা যাবে!
–খুব ভালো কথাই তো! কবে বলুন?
–আজ?
–আজ থাক। আজ হাটে যেতে হবে যখন-সকাল সকাল খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়াই ভালো। আপনারাই বরং দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খেয়ে নিন না!
শেখর একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। অপর্ণা—রবিদের খেলার দিকে দেখলো একবার। তারপর কি যেন ভেবে জয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো, না আজ খাবো না। নেমন্তন্ন করো নি! এমনি খাবো কেনা! তোমার বিয়েতেও তুমি আমায় নেমন্তন্ন করো নি!
জয়া বললে, আপনি অনেক বদলে গেছেন!
শেখর জয়ার বাহুতে একটা টোকা মেরে বললো, তুমি বদলাও নি? তুমিও অনেক বদলে গেছ।
ফেরার সময় মাঝপথে এসে অসীম পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে বললো, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা উচিত হবে না, বুঝলি! আগে থেকেই ঠিক করা ভালো-কে কার দিকে মনোযোগ দেবে? সঞ্জয় তো গম্ভীর হয়েই আছে ও বাদ। আর শেখর তো জয়ার সঙ্গেই–জানা কথা। রবি, তোর আর আমার মধ্যে কে অপর্ণাকে চান্স নেবে–আগে থেকে ঠিক হয়ে যাক।
শেখর হাসতে হাসতে বললো, ওরকমভাবে হয় নাকি? মেয়েটার কাকে ভালো লাগবে–কিংবা কারুকেই ভালো লাগবে কিনা–সেটা দ্যাখ!
–সে আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেবো! অসীম টুসকি দিয়ে আধুলিটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে মুঠোয় লুফে নিয়ে বললো, বল রুবি, হেড না টেল! এই আধুলিটা হচ্ছে অপর্ণা।
রবি অভাবিত রকমের নিষ্পৃহ গলায় বললো, আমার দরকার নেই। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই!
–সে কি, তুই যে সব সময় ওর দিকেই মনোযোগ রেখেছিলি?
–সে এমনি খেলার খেলা। যেটুকু সময় দেখা, তাছাড়া আর—
–তোর বুঝি আবার মনে পড়েছে—
রবি হাত তুলে নীরস গলায় বললো, থাকা! এখন ওকথা থাক।
সবাই এক মুহূর্ত চুপ করে গেল। অসীমের হাত তখনো মুঠো করা, মুঠোয় বন্দী আধুলি। শেখর বললো, আচ্ছা অসীম, আমিই কনটেস্টে নামছি। তুই হেড আমি টেল, এবার হাত খোল, দেখি অপর্ণা কার ভাগ্যে উঠেছে।
অসীম মুঠোর মধ্যে রেখেই আধুলিটা পকেটে ভরে বললো, তা হলে থাক, ব্যাপারটা রহস্যেই থেকে যাক!
–খুললে দেখবি, তোর ভাগ্যে ওঠে নি। ওখানে কিছু সুবিধে হবে না-ও বড় কঠিন মেয়ে। মুখ দেখলেই বোঝা যায়।
–আমিও কম কঠিন ছেলে নই। কঠিনে কঠিনে বেশ টক্কর খাবে। কথাটা বলে অসীম আড়চোখে রবির দিকে তাকালো। একটানা এতক্ষণ খেলার পর রবির মুখটা ঘামে ভেজা-ভেজা, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। জামার সব কটা বোতাম খুলে দিয়েছে। রবি, কারুর কথায় কোনো মনোযোগ দিচ্ছে না। অসীম রবিকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, কি রে, তুই চান্স নিবি না বলছিস, আর ওদিকে তো বেশ রুণির হাতখানা খপ করে ধরে ফেললি একবার।
রবি এবার স্নানভাবে হেসে বললো, ওটা অভ্যোস!
–তার মানে!
–মানে আর কি। হাতের কাছে কোনো মেয়ের হাত দেখলেই ধরতে ইচ্ছে করে। সুন্দর শরীর দেখলেই ইচ্ছে করে একটু আদর করতে। এইসব পুরোনো অভ্যোসগুলো কিছুতেই কাটাতে পারছি না। কিন্তু মেয়েদের আর আমার একেবারে সহ্য হয় না।
—মেয়েদের সহ্য হয় না তোর? মাইরি, বেশ লাগলো শুনতে কথাটা!
সন্ন্যাসী হবি নাকি? সন্ন্যাসী কেন হবে? কিন্তু ঐ সব স্নো-পাউড়ার মাথা ন্যাক মেয়েদের আমি দুচক্ষে সইতে পারি না!
–রুণি তুই ন্যাক বলছিস!
–নিশ্চয়ই ন্যাক। ওরা সবাই একরকম!
–বাজে বকবক করিস না! তুই নিজেই একটা ন্যাকা হচ্ছিস দিন দিন!
রবি এবার পরিপূর্ণভাবে হেসে বললো, কি রে, রুণির নাম তোর এত গায়ে লাগছে কেন? আমি তো বললুমই তোকে চান্স নিতে।
অসীম গজগজ করে তবু বলে, তপতীর ব্যাপারের পর তুই গোটা মেয়ে জাতটার ওপরে খেপে গেছিস। কিন্তু আমি জোর গলায় বলতে পারি, তপতীর শুধু একারই দোষ ছিল না, তোরও দোষ ছিল–
রবি হঠাৎ রূঢ় হয়ে উঠলো, ঝাঁঝাল গলায় বললো, দ্যাখ অসীম, তোদের কারুর মুখ থেকে আমি তপতীর নাম উচ্চারণও শুনতে চাই না, বুঝলি? আর কক্ষনো বলিস না।
–কেন বলবে না? বেশ করবো!
শেখর মাঝখানে এসে বললো, আঃ, অসীম, থাক না। চুপ কর।