অমানবিকতা
কুন্তলার ছেলে চেন্নাই থেকে এম.এস করে কোলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ডাক্তারি করবে।কুন্তলার আনন্দের শেষ নেই।আজ পড়ানোর ছুটি দিয়েছে সব ছাত্রছাত্রীদের, কেননা তার ছেলে কুন্তল বাড়ি ফিরবে।
এই আসে এই আসে ছেলে,মা অপেক্ষা করে থাকে।কিন্তু ছেলে ফিরল সেই সন্ধ্যায়, তাও সঙ্গে একজন মেয়ে বান্ধবী নিয়ে।বান্ধবী আজ রাতে এখানে থাকবে।
বেশ ছেলের সাথে গল্প গুজব হল।রাতে খাওয়া শেষ করে আবার বৈঠক খানায় আড্ডা।কুন্তলার মনে হচ্ছে কুন্তল কিছু বলতে চাইছে।
কুন্তল বলল মা ,এ হল আমার বান্ধবী,সামনের বছর বিয়ে করব ভাবছি।তবে একটা সমস্যা, কাকলির বাড়িতে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে আপত্তি,কারণ আমি কোনো মা বাবার অবাঞ্ছিত সন্তান ,এছাড়া আমি বড় হয়েছি এক হিজরা মায়ের কাছে।
কুন্তলা বলে আমায় ত্যাগ করতে চাইলে করতে পারো।
কুন্তল বলে আমার বাবা ও মা ঘৃণা করে ফেলে দিয়েছিল,কিন্তু কাকলির বাবা ও মা আমি ডাক্তার জেনে ও কেন এত ঘৃণা করছেন বলতে পারো।
কুন্তলা বলে তুমি আমার ইতিহাস জানো বাবা,তোমায় কি করে বড় করেছি সেটা তোমার বান্ধবী জানে কি?
তবে শোনো তোমরা ,আমার বাড়ির লোকজন আমায় জঙ্গলে ফেলে আসে ,তখন আমার বয়স পাঁচ।প্রচুর খাবার দিয়ে,জল রেখে ,আমায় একা রেখে চলে যায়।ভেবেছিল কোন পশুর পেটে চলে যাব।কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে যখন চোখের জল শোকায়,তখন এক সাধুবাবা আমায় হিজরা জেনেও আশ্রয় দেন। তারপর যখন আমার ছয় বছর বয়স ,প্রত্যহ আমায় শারীরিক অত্যাচার শুরু করেন।তারপর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পালাই ও শেষে হিজরা দলে যাই।আমায় ঐ মাসি লেখাপড়া শেখায়।আমাকে মেয়েদের মত দেখতে ,গলাটাও ওদের মত মোটা নয়।তাই কলেজে ও কেউ টের পাই নি আমি হিজরা।
প্রচুর টিউশুনি করে নিজের খাওয়া ,পড়া,এমন কি যে মা আমায় মানুষ করেছিল,সে বুড়ি হয়ে গেছিল বলে,তাকে ও দেখতাম।
তারপর আমার কলেজে কাজলের সাথে আলাপ হয়,আমি যে হিজরা তা ভুলে গিয়ে তার সঙ্গে প্রেমে ভাসতে থাকি।কাজলকে আমার সব ঘটনাও জানাই।সে বলে তাতে কি হয়েছে,তুমি হিজরা হলেও চলবে,তোমায় বিয়ে করব।
ব্যাস সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে এম.এ ও পাশ করলাম।তখন প্রায় দশ হাজার টাকা টিউশন পড়িয়ে পেতাম।
একদিন ঐ কাজল ,সুন্দরী বউ নিয়ে আমার বাসায় হাজির।আমি হিজরে তাই ওর সমাজে আমার স্হান নেই।
সত্যি আমি খুব বোকা ছিলাম।
আমার স্কুলের চাকরি হল,টিউশনি সব মিলিয়ে আমার খুবই স্বচ্ছল অবস্থা।
নিজে এই বাড়িটা বানালাম।হঠাৎ একদিন কাজল একমাসের দুধের শিশুকে আমার কাছে রেখে গেল।ওদের প্রচুর সম্পত্তি,বাবা সব নাতির নামে লিখে দিয়েছেন।তাই কাজলের কুলাঙ্গার ভাই ওদের মারবার হুকুম দিয়েছে,আজই জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে।কুন্তলার কাছে বাচ্চা,দলিল,কিছু টাকা রেখে কাজল চলে যায়।আর বলে মানুষ করিস বন্ধু।আজ বুঝতে পারছিস,কেন তোকে বিয়ে করি নি।তুই তো সন্তান দিতে পারবি না।বাবার উইল করে গেছেন,আমার ছেলে বা মেয়ে যেই হোক সে পাবে।আমার ভাই গুন্ডা,তাই ওকে ত্যজ্য পুত্র করেছিলেন।
কুন্তল ও কাকলি বলে মা তারপর।
তারপর__ আমার কাজল ও তার বউকে হত্যা করে ঐ পাষন্ড ভাই। ছেলেটাকে পাগলের মত খোঁজে।
সে বাচ্চাতো আমার কোলেই মানুষ হচ্ছে।শুনলাম জেলে ভাইটা ক্যানসারে মারা গেছে।
এখন আমার কাজলের ছেলে কুন্তলের কোনো বিপদ নেই। ওরে কাকলি যা নিয়ে কুন্তল কে তোর বাবার কাছে।
বলবি ও অবাঞ্ছিত সন্তান নয়।ওর দাদুর অগাধ সম্পত্তি,সব কুন্তলের নামে আছে রে।আর বলিস আমি ওর বড়মা।আমি হিজরা মা নয়।
কুন্তল. বলে মাগো তুমি আমার গর্ভধারিণী মা।আজ তোমায় আমার কোন আসনে বসাব মা,নিজেও জানি না।
পর্ব..২
কুন্তল বলে ,তুমি জান মা তোমার বাড়ি কোথায় ছিল।হুম খুঁজে পেয়েছি, চাকদহতে।যে থলিতে খাবার ছিল,জামা প্যান্ট ছিল,ঐ ব্যাগের একটা চেনের ভিতর বাডির ঠিকানাটা মা হয়তো চুপ করেরেখে দিয়েছিল।মাসি বড় হবার পর আমায় দেন।ভাগ্যিস সাধুবাবাটা ব্যাগ ঘাটেন নি।আমিও এতটাই ছোট ,চেন খুলে দেখি নি।তবে পালানোর সময় ব্যাগটি নিতে ভুলি নি।নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে গেছিলাম।ঐ মাসি আর বেঁচে নেয়।তিনি হিজরা হয়ে ও আমায় ঐ দলে কখনো ঢোকাননি।মাধ্যমিক অবধি পড়িয়েছেন।তারপর থেকে আমি টিউশনি করে সংসার ও পড়াশুনা চালিয়ে গেছি।
কুন্তলা কুন্তলকে বলে আমি আমার বাড়ি গেছিলাম,গিয়ে দেখি মা আর আমার বিধবা বোন রয়েছে।খেতে ও পান না। তবে থেকেই এক সমাজসেবী হিসাবে টাকা দিচ্ছি ওনাদের।
কাল বোন ও মা আসবে আমার বাড়ি ওদের অসুখ সাড়াতে।কদিন সমাজসেবী র বাড়ি থাকবে,ও তোর কাছে চিকিৎসা করবে।ওরা কিন্তু জানে না,আমি তাদের মেয়ে।কুন্তল মায়ের গলা জড়িয়ে বলে ঠিক আছে।
পর্ব..৩
মা ও বোন সমাজসেবীর বাড়ি আসেন।ওনাদের একতলায় থাকতে দেন।দুজনের জন্য নুতন জামা কাপড় দেন।কুন্তলা বলেন যে কদিন থাকবে এই জামাকাপড় পরবে।এটা তো ডাক্তারবাবুর বাড়ি,তাই নুতন জামা কাপড় পরো।
মা ও বোনের যত্নের ত্রুটি রাখে নি কুন্তলা।মা একবার বলেই ফেলে তুমি আগের জন্মে আমার মেয়ে ছিলে মা।
কুন্তল শুনতে পেয়ে বলে কুন্তলাদেবী যদি এজন্মের মেয়ে হন,তাহলে দিদা আপনার আপত্তি আছে।ধরেই নিন না এ আপনার বড় মেয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।
ডাক্তার বাবু আমায় দিদা বললেন।
তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার বড় মেয়ে জঙ্গলে সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছিল।এখন হয়তো কোন চিতার পেটে।
কুন্তল ভাবে মা তো এখানে নেয়,বলেই ফেলি..আচ্ছা দিদা ভেবে বলুন তো উনি জঙ্গলে হারিয়ে গেছিল না ফেলে দিয়ে এসেছিলেন।এবার বেশ রেগেই বলে কুন্তল।ভেবেই বলুন নাহলে আপনার অসুখ সাড়াতে পারব না।
দিদার সঙ্গে যে মহিলা ছিলেন,সে বলে ওঠে ডাক্তার বাবু আপনি কি বলছেন?
কুন্তল বলে চুপ করো মাসী।দিদাকে বলতে দাও।
দিদা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।মা চিৎকার শুনে ছুটে আসে।এটা কি হচ্ছে কুন্তল,আমার মা কে কাঁদালি কেন?
নাও নাও মা ,মাসী ও দিদা গলা জড়িয়ে কাঁদো।সবার মন হালকা করো।
শোনো মা ,বোন মা পেয়ে আমায় ভুলে যেও না কিন্তু।