Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অপহরণ || Bimal Kar

অপহরণ || Bimal Kar

মাত্র কয়েকদিন আগে উমাপ্রসাদ দত্ত-র মৃত্যুসংবাদ খবরের কাগজে ছাপা হয়ে বেরিয়েছে। তিনি কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি নন; তাঁর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আমি যতদূর জানি, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও উমাপ্রসাদের কিছু নেই। তবু খবরের কাগজে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হবার কারণ, অস্বাভাবিক এক অবস্থার মধ্যে ওঁর মৃত্যু। উমাপ্রসাদ রাত্রের ট্রেনে হাজারিবাগ রোড স্টেশন থেকে গয়া যাচ্ছিলেন। জায়গার অসুবিধের জন্যে তিনি তাঁর টিকিট বদলে নেন। ফার্স্ট ক্লাস কামরায় তাঁর সহযাত্রী ছিল এক অবাঙালি দম্পতি। কোডারমা স্টেশনের কাছে চেন-টানা গাড়ি থামলে উমাপ্রসাদের কামরার সেই অবাঙালি ভদ্রলোকের ভীত, সন্ত্রস্ত, প্রায়-উন্মত্ত চেহারা এবং তাঁর চেঁচামেচি ও কান্নাকাটিতে রেলের লোকজন ও পুলিশ কামরায় ঢুকে দেখে—উমাপ্রসাদ নিহত, অবাঙালি মহিলাটি সামান্য আহত ও মূর্ছিত অবস্থায় পড়ে আছেন। —খবরের কাগজে এই মৃত্যুটিকে ‘শোচনীয় ও নৃশংস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সঙ্গত কারেণই যে তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য, উমাপ্রসাদ যদি এই ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থায় মারা না যেতেন খবরের কাগজে তাঁর উল্লেখ থাকত না। প্রকাশিত সংবাদের বিবরণে বলা হয়েছে, অর্থ ও অলঙ্কারের লোভে জনৈক দুর্বৃত্ত কামরায় প্রবেশ করেছিল। যখন সে কামরার মহিলাটিকে আক্রমণ করে, তখন মহিলার স্বামী ভয়ে দিশেহারা হয়ে নিজেদের প্রাণভিক্ষা করছিলেন; তিনি স্ত্রীর অলঙ্কার ও অর্থ দুর্বৃত্তের হাতে তুলে দিতেও চেয়েছিলেন; উমাপ্রসাদ কিন্তু আততায়ীকে বাধা দিতে যান; এবং আহত হন। ভদ্রলোকের জবানবন্দী অনুসারে আততায়ী কোডারমা স্টেশনে গাড়ি পৌঁছবার আগেই পালিয়ে গেছে।

কাগজে সম্পূর্ণ ঘটনাটির রোমহর্ষক বিবরণ ও নৃশংসতার পরিচয় যত্ন করে তুলে ধরা হয়েছে; উমাপ্রসাদের দুঃসাহসের উল্লেখ তেমন কোনো যত্ন অবশ্য আমি খুঁজে পাইনি। এর জন্যে কাগজকে দোষারোপ করি না, কেননা নিশীথরাত্রে চলন্ত ট্রেনে ভয়ংকর রাহাজানি, খুন, মূৰ্ছিত মহিলা ইত্যাদি একটা ঘটনা, উমাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবে কোনো ঘটনা নন, ঘটনার নিমিত্তমাত্র।

উমাপ্রসাদকে আমি চিনতাম, তাঁর ব্যক্তিগত রূপটিও আমার পরিচিত। তিনি সম্পর্কে আমার আত্মীয়। গত বছর পুজোর সময় আমি তাঁকে শেষ দেখেছি। আমার ধারণা, উমাপ্রসাদ এই মৃত্যুর দ্বারা তাঁর নিজের এবং তাঁর আঁকা ছবিগুলো কিছুটা সম্পূর্ণ করেছেন। সম্ভবত এবার যদি ছুটিতে হাজারিবাগে যাই, উমামামার ছবি আঁকার ঘরে ঢুকে আমি তাঁর শেষ বয়সের আঁকা ‘অপহরণ’ সিরিজের ছবিগুলিতে এই সম্পূর্ণতা অনুভব করতে পারব।

উমামামা ছবি আঁকতেন। ছবি আঁকিয়েদের লোকে শিল্পী বলে। উমামামাকে শিল্পী বলতে আমার কুণ্ঠা হয়। তিনি নিজেও কখনো বলতেন না, তিনি শিল্পী; বলতেন: চুপচাপ বসে থাকি সারাদিন, ওই একটা শখ, ছবি আঁকার চেষ্টা করি। উমাপ্রসাদ যদি শিল্পী হতেন, বাংলা দেশের মতন শিল্পীর দেশে লোকে তাঁর নাম শুনত বই কি! আমি প্রায় নিঃসন্দেহ, উমাপ্রসাদের নাম আজ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কেউ কোথাও শোনেনি; ঘরেও নয়, বাইরেও নয়। কাগজে উমাপ্রসাদের যে মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছে—তার কোথাও আপনারা উমামামার শিল্পী-পরিচয় পাবেন না।

উমামামার সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল, যোগাযোগ ছিল না। উনি আমার মা’র দূর সম্পর্কের ভাই। বছর পাঁচেক আগে আমরা একবার সপরিবারে শীতের সময় হাজারিবাগে বেড়াতে যাই। মা শুনেছিলেন, এখানে তাঁর এক আত্মীয় বহুকাল ধরে আছেন। খোঁজ-খবর করতে উমামামাকে আবিষ্কার করা গেল।

পাঁচ বছর আগে উমামামাকে যখন প্রথম দেখি, তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। মাথায় বেশ লম্বা, ছিপছিপে শক্ত চেহারা। তাঁর শারীরিক গড়নের মধ্যে পুরুষোচিত দীর্ঘতা ও সবলতার ভাব ছিল। গায়ের রঙটি ছিল কালো। মুখের ছবিটি মনে রাখার মতন: লম্বা ছাঁদের মুখ, শক্ত চোয়াল, দীর্ঘ উঁচু নাক, সরু পাতলা চিবুক চোখ দুটি তেমন উজ্জ্বল ছিল না, মোটা কাচের চশমার আড়ালে তাঁর দৃষ্টি সব সময়ই কেমন দুর্বল দেখাত। উনি চোখের অসুখে কিছুকাল যাবৎ ভুগছিলেন। উমামামার মাথার চুলগুলি আর কালো ছিল না, সাদা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ঠোঁট সবসময় ফাঁক হয়ে থাকত, এবং লক্ষ করলে বোঝা যেত তাঁর মুখের মধ্যে কিছু আছে। তিনি মুখের মধ্যে হরিতকীর কুচি রাখতেন।

কথাবার্তায় উমামামা সদালাপী, একটু জোরে জোরে কথা বলতেন এই যা, গলার স্বরটি ছিল ভরাট। দোষের মধ্যে, উনি এক সময় হয়তো অনর্গল কথা বলে গেলেন কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেলেন। কিছুতেই আর মুখে একটি কথা ফুটনো যেত না। আমরা প্রথম প্রথম ভাবতাম, কোনো কারণে তিনি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, স্বভাবতই আমরা অস্বস্তি বোধ করতাম পরে বুঝতে পারলাম, এইটেই ওঁর স্বভাব। হয়তো হাঁপানির অসুখের জন্যে খানিকক্ষণ একটানা কথা বলার পর তিনি ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে ওঠেন। কিংবা সাবধান হবার কথা মনে পড়ে যায়।

উমামামার বাড়িটা ছিল একেবারে একপ্রান্তে, তারপর আর লোকালয় ছিল না। বাড়ির পরই জঙ্গলের ঢালু জমি, একটা খালের মতন নদী, নদীর ওপর রেলের সাঁকো। ওঁদের বাড়িটা অনেককালের পুরনো, ভাঙা পাঁচিলে ঘেরা মস্ত চৌহদ্দি, অসংখ্য গাছপালা; প্রায় যেন জঙ্গল। বাড়িতে উমামামার আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ ছিল না। বাড়ির একপাশে দু-তিনটি দেহাতি স্কুল-পড়ুয়া ছেলে থাকত; কুয়াতলার দিকে তারের ভাঙা জালের মধ্যে কিছু বুনো পাখি খুশিমতন আসত যেত, এক সময় ওখানে তিনি ময়ূর থাকার ঘর করেছিলেন। কয়েকটি দিশি কুকুর সপরিবারে উমামামার বাড়িতে বসবাস করত।

বাড়িটা দেখে প্রথম দিন আমার তেমন ভাল লাগেনি। হাওয়া-বদলের শহরে ছিমছাম, সুন্দর, সুদৃশ্য বাড়ি কিছু কম ছিল না; সে-সবের তুলনায় উমামামার সেই শুকনো লেবুর মতন রঙ-ধরা জীর্ন বাড়ি, চতুর্দিকে গাছপালার অরণ্য, কুকুর বেড়ালের সর্বত্র বিচরণ আমার দৃষ্টিকটু লেগেছিল।

পরিচয়ের পর উমামামাকে আমার বড় পছন্দ হয়েছিল। মা’র কথা বলতেই সামান্য সময় যেন পুরনো স্মৃতি হাতড়ালেন, তারপরই চিনে ফেললেন; “রমার ছেলে তুমি!…আরে, আরে, তাহলে তো তুমি আমার ভাগ্নে। এসো, চলে এসো।…রমা এখানে এসেছে! আমায় একটা চিঠি দিল না কেন?…কোন বাড়ি নিয়েছ? ‘শুকতারা’? না বাড়িটা ভালই; তবে অযথা ভাড়া নিলে। আমার এখানে উঠলে তোমাদের অসুবিধে হত না। ক’জন তোমরা?”

ঘরে এনে বসিয়ে উমামামা চাকরটিকে হাঁক দিলেন, “চা তৈরি কর; বাবুকে আণ্ডা তৈরি করে দে।”

তারপর উমামামা পুরননা প্রসঙ্গে চলে এলেন। “নাইনটিন নাইনে অক্টোবরে আমার জন্ম, আর রমার—মানে তোমার মা’র—নো—সে জন্মেছিল নাইনটিন নাইনের ডিসেম্বরে। তিন মাসের ছোট-বড়। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত আমরা ধরো একই বাড়িতে মানুষ। তারপর বাবা মুন্সেফ হয়ে নর্থ বেঙ্গলে চলে গেলেন, আমরাও চললাম।”

উমামামার ভরাট গলায় যতখানি আত্মীয়তা ও অন্তরঙ্গতা ছিল ঠিক ততখানি স্নেহ। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা উমামামার ভক্ত হয়ে উঠলাম।

মা উমামামাকে নাম ধরে ডাকত, উমামামা মাকে বলত, বুড়ি। মা’র ওটাই ডাক-নাম। আমার বাবা করপোরেশনের চাকুরে ছিলেন; মারা গেছেন কয়েক বছর আগে, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়ে গিয়েছিলেন বরানগরে। উমামামা মাকে বলতেন, “বুড়ি, এখানে থাক না ক’টা মাস। তোর তো সব সাবালক ছেলেমেয়ে।” মা বলতেন, “তোমার জঙ্গলে আমার মন টিকবে কেন। এখন ক’টা লোক আছে, এরা চলে গেলে শুনেছি সব ফাঁকা। আর তোমার বাড়ি তো ভূতের বাড়ি করে রেখেছ।”…কথা শুনে উমামামা জোরে জোরে হাসতেন।

শীত কাটিয়ে ফেরার কথা, বউদির অসুখের জন্যে সেবারে আমাদের মাসখানেক পরেই ফিরতে হল।

উমামামা আমায় বললেন, “তোর তো কলেজের চাকরি চঞ্চল, তাও ছাত্র পড়াস না, ল্যাবরেটরি গুছোস। থেকে যা এই জানুয়ারি মাসটা।”

বললাম, “এবারে না মামা, পরে আবার আসব।”

“মিথ্যে কথা বলছিস কেন?…তোরা কলকাতা শহরের আজকালকার ছেলে, এই ঝোপজঙ্গল গাছপালা অন্ধকার তোদের ভাল লাগে না। তুই কি আর সহজে আসবি, চঞ্চল!”

“আমি প্রমিস করছি আসব।”

“কেন আসবি?”

কেন আসব সেকথা আমি বলতে পারিনি, অনুভব করেছিলাম শুধু। উমামামার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতেও আমার লজ্জা হচ্ছিল। মুখ ফিরিয়ে অনেকক্ষণ পরে শুধু বললাম, “তোমার এই জায়গাটা বেশ। আমার ভাল লাগে খুব।”

উমামামা আমার মুখ দেখছিলেন। এক সময় বললেন, “আচ্ছা, দেখা যাক…”

তারপর গত পাঁচ বছরে আমি বার তিনেক উমামামার কাছে গিয়েছি। তাঁর কাছেই উঠতাম। কখনো পুজার আগে, কখনো পূজার পর ওঁর কাছে গিয়ে হাজির হতাম, পনেরো-বিশ দিন থাকতাম, ফিরে আসার আগে পায়ের ধুলো নিতে গেলেই উমামামা বেশ বিচলিত হয়ে উঠতেন।

“আবার সেই আসছে বছর—।”

“দেখি, শীতের সময় যদি পারি!”

“শীত ভাল; তবে একবার বর্ষার সময় আয় এমন বর্ষা চোখে দেখিসনি তুই। একেবারে কালিদাসের সেই ‘পাণ্ডুচ্ছায়োপবনবৃতয়ঃ কেতকৈঃ’…।”

“আমি সংস্কৃত জানি না, মামা।” হেসে বলি।

“আচ্ছা, আচ্ছা, বাংলা কালিদাসই পড়ে শোনাব তোকে। …ওই নে ঘন্টি পড়ল তোর গাড়ির।”

প্লাটফর্মে যাত্রীদের চাঞ্চল্য লক্ষ করতে করতে বললাম, “মামা, এবারে এসে তোমার ছবি শেষ হয়েছে দেখব তো?”

উমামামা আমার দিকে দু-মুহূর্ত তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

বললাম, “কতবার আর এই জিনিস আঁকবে!…একদিন তো শেষ করতে হবে তোমায়।”

উমামামা অস্পষ্ট করে অন্যমনস্কতার মধ্যে শব্দ করলেন।

এরপর গত পূজায় ওঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ। উমামামা চিঠি লিখতে অনভ্যস্ত ছিলেন। কদাচিৎ আমার চিঠির জবাব দিতেন। তাঁর শেষ চিঠি পেয়েছিলাম গত এপ্রিল মাসে। আজ আগস্ট মাসে তিনি আর ইহলোকে নেই।

উমামামার মৃত্যুসংবাদ শুনে মা মর্মাহত হয়ে বলল, “নিয়তি। মরণ টানছিল। নয়তো যাবার কথা সেকেন্ড ক্লাসে, টিকিট বদলে অন্য কামরায় আসে!”

দাদা বলল, “কোনো মানে হয় না। বুড়ো মানুষ, কি দরকার ছিল তাঁর এগিয়ে যাবার। যাদের যাচ্ছিল তারা তো প্রাণের মায়া করে সব দিতেই যাচ্ছিল—ওঁর এইরকম হঠকারিতা করতে যাওয়া কেন!”

ছোট বোন মায়া বলল, “দেখ আবার, যে লোকটা সাধু সাজছে তারই কোনো হাত আছে কিনা। অচেনা মানুষ সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না, বাবা।”

মা যা বলেছে: নিয়তি; দাদা যা বলেছে: বুড়ো মানুষের হঠকারিতা; এবং মায়ার যা ধারণা—আমি তার কোনোটাকেই অস্বীকার করতে চাই না, আবার স্বীকার করতেও রাজি না।

উমামামার এই মৃত্যু আমার কানে কানে যেন বলছে: “চঞ্চল, আমি আমার ছবি শেষ করেছি।”

উমামামার চরিত্রের যেদিকটা সামাজিক এবং পারিবারিক, আত্মীয়-স্বজনের মত তার আভাস আমি দিয়েছি, কিন্তু তাঁর জীবনের অন্য কোনো কথা আমি বলিনি। আমার সঙ্গে তাঁর এমন একটি ঘনিষ্ঠতা হয়ে এসেছিল, যা ঠিক পারিবারিক আত্মীয়তার নয়, অন্য কিছুর। স্পষ্ট করে এই সম্পর্কের কথা বোঝানো আমার সাধ্য নয়। খুব গোপনে, কখনো কোনো হতাশায়, কখনো আবেগবশত, চেতনায় এবং অবচেতনে আমি যা অন্বেষণ করি, উমামামা আমায় তার ইঙ্গিত দিতে পারতেন। তাঁর এবং আমার মধ্যে অনুভবের একটি যোগসূত্র রচিত হয়েছিল, হয়ত বা আত্মিক এবং আন্তরিক। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম বস্তুত এই কারণে; উমামামার প্রতি আমার আকর্ষণ ও মমতার হেতুও তাই। তিনিও আমার কাছে তাঁর মন অনেকখানি খুলে দিতে পেরেছিলেন, অনেক অনুভবের কথা বলতে চেষ্টা করতেন। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ প্রায় সখ্যের রূপ নিয়েছিল, বন্ধুর মতন আমরা অনেক সময় কথাবার্তা বলতাম, তিনি কখনো কখনো বয়সের পার্থক্য ভুলে গিয়ে আমায় তাঁর সমবয়স্ক করে তুলতেন।

উমামামার একটি জীবন ছিল, যাকে আমরা বাস্তবের জীবন বলি। মা’র কাছে কিছু, খানিক বা উমামামার মুখে আমি সেই জীবনের কথা শুনেছি।

উমামামার বাবা ছিলেন সেকেলে মুন্সেফ, পরে সাবজজ হয়েছিলেন। রাসভারী, কড়া মেজাজের মানুষ। উনি পরিবারের মেজ ছেলে; বড় ছেলে ছিল প্রায় বাবার মতন। উমামামার মা ছিলেন শান্তশিষ্ট ধর্মভীরু প্রকৃতির। উমামামার বাবাকে চাকরিতে প্রায়ই বদলি হতে হত। ছেলেদের শিক্ষার ব্যাপারে সেটা নিতান্ত ব্যাঘাত মনে হওয়ায় তিনি উভয় ছেলেকেই স্থায়ীভাবে রাজসাহীতে রেখে দেন, মামার বাড়িতে। যথাসময়ে উমামামা কলকাতায় কলেজে পড়তে এসে স্বদেশী হুজুগে মেতে কলেজ ছেড়ে দেন। তারপর হুজুগ কাটলে বেনারসে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। যে বছর তিনি পাস করলেন, সে বছর দাদার মৃত্যু ঘটল। শোকাহত জনক-জননী সান্ত্বনার আশায় গয়া কাশী হরিদ্বার করে বেড়ালেন, মন প্রবোধ মানল না। শেষে লোকালয়বর্জিত এই হাজারিবাগ জায়গাটিতে কেমন করে মন পড়ে গেল। উমামামার বাবা জায়গা-জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন এখানে। জপতপে মন দিলেন মা। বাবাও শেষ বয়সে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন।

উমামামা কিছুকাল চাকরিবাকরি করার চেষ্টা করেছেন, কোথাও মন বসাতে পারেননি। বাবার মৃত্যুর পর এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে গেলেন; বাবার গচ্ছিত অর্থ ও এখানে জমিজমাতে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা ভালই ছিল। জঙ্গলের দেশ ছেড়ে তিনি আর নড়লেন না।

তারপর মা মারা গেলেন।

কৌতূহলবশত আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “উমামামা বিয়ে করেননি?”

আমার মা উমামামার বাল্যকালের কথা ছাড়া আর কিছু প্রায় জানতেন না, সুতরাং বিয়ের কথাটাও তাঁর জানার কথা নয়। আত্মীয়স্বজনের মুখে শোনা কথা যা জেনেছিলেন, তাতে বিবাহ প্রসঙ্গ ছিল না। ফলে তিনি উমামামাকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি বরাবর বাউন্ডুলে হয়ে থাকলে! বিয়ে-থা করলে না কেন?”

জবাব উমামামা হেসে বলেছিলেন, “করেছিলাম, কপালে টিকল না।”

আমরা ধরে নিয়েছিলাম, উমামামার স্ত্রীও মৃত।

পরে আমার সঙ্গে উমামামার সম্পর্ক গভীর হলে আমি অন্য কিছুও জানতে পারি।

উমামামার সাধারণ পরিচয় শেষ হল। এবার তাঁর অন্য পরিচয়।

উমামামার সেই শুকনো লেবুর মন রঙ-ধরা বাড়ি, সেই প্রাচীনতা ও জীর্ণতা, গাছপালার জঙ্গল এবং কুকুর বেড়ালের আবাসস্থলাটি আমার প্রথম দিন ভাল না লাগলেও প্রথম পরিচয়ের পর তিনি যখন আমায় সেই বিরাট চৌহদ্দির পিছন দিকের একটি জায়গায় নিয়ে গেলেন, আমি যেন অরণ্যের মধ্যে একটি নির্জন স্তব্ধ পরিচ্ছন্ন দেবমন্দির দেখে বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম।

কদমগাছের আড়ালে একটি ‘কটেজ’ মতন, সামনে সবুজ ঘাসের প্রাঙ্গণ, চারপাশে তারের জাল দেওয়া বেড়া বেয়ে দেশি লতার ফুল ফুটে আছে, ছোট ছোট সবুজ পাতার রাশ! মাধবীলতার গুচ্ছ দুলছে শীর্ষে। একদিকে কয়েকটি গোলাপ চারা, অন্যদিকে একজোড়া শিউলি গাছ। কাঠের ছোট্ট ফটক খুলে পা বাড়ালে সিঁড়ি, সিঁড়ির গায়ে অপরাজিতার ঝোপ।

সিঁড়ি উঠে সরু বারান্দা, বারান্দার ওপর উমামামার খরগোশ-থাকা বাক্স, গাছের ডাল কেটে-একটা পাখি-বসা দাঁড়, একপাশে জলচৌকির ওপর মাটির এক শিবমূর্তি। একটা ডেক-চেয়ার পাতা ছিল বারান্দায়।

বারান্দার বাঁ দিক ঘেঁষে একটা ঘর, পিছনে আরও একটা; পিছনের ফালি মতন বারান্দার সঙ্গে এক চিলতে জায়গা মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।

বাড়িটার গাঁথুনি ইটের, মাথার ওপর খাপরার ছাউনি, তলায় চুনকাম করা চটের সিলিং।

দু’টি ঘরের একটিতে বসে উমামামা ছবি আঁকার কাজ করেন, খুব খোলামেলা; অন্য ঘরটিতে কিছু ছবি, কিছু পুরনো বইপত্র, মাটি এবং কাঠের কিছু শিল্পকর্ম, তামার নৃসিংহমূর্তি, পেতলের মস্ত এক প্রদীপ পড়ে আছে, আর একপাশে সরু মতন একটি তক্তপোশ, বিছানা-পাতা।

উমামামার দ্বিতীয় পরিচয়টুকু জেনে আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, “আপনার স্টুডিয়ো?”

উনি বললেন, “না, আমি এখানে বসে একটু কাজকর্ম করার চেষ্টা করি, বিশ্রাম নিই।”

“আপনি আর্টিস্ট?”

“কে বলল! আমি শখ করে মাঝে মাঝে ছবি আঁকার চেষ্টা করি। এসব কিছু না। চলো, তোমায় আমার বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং দেখাই।”

উমামামা আমার কথাটা গায়ে মাখলেন না।

প্রাথমিক এই পরিচয় ক’দিনেই কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। মানুষটি আমায় কৌতূহলী ও আকৃষ্ট করে তুলেছিলেন; আচার, আচরণ, স্বভাব, এমনকি তাঁর জীবনযাপনও আমার কাছে অন্য রকম লাগত। উনি যে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন তা সহজেই বোঝা যেত, কিন্তু এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে যে তিনি কাতর অথবা পীড়িত হচ্ছেন তা অনুমান করা যেত না। বরং আমার মনে হত, উমামামা নির্জনে এক ধরনের সাত্ত্বিক জীবনযাপন করেছেন যেন। তিনি নিরামিষাশী ছিলেন, বাড়িতে অনেকগুলি মুরগি দেখে আমি তাঁকে আমিষভোজী ভেবেছিলাম; আসলে মুরগিগুলি তাঁর গৃহে আপন স্বভাবে বিচরণ করত এবং উমামামার চাকর ও দেহাতি ছাত্রগুলি তাতে লাভবান হত। ওঁর কোনো রকম নেশাও ছিল না, চা অবশ্য খেতেন, সিগারেট পান ইত্যাদি খেতে দেখেনি। আমি তাঁকে কখনো পূজাটুজা করতে দেখতাম না। কিন্তু তিনি যে ধর্মগ্রন্থাদি পাঠ করতেন তা আমি দেখেছি, শুনেছি। উমামামার পুরনো বইয়ের মধ্যে মার্কণ্ডেয় চণ্ডীও ছিল। তবে, আমার ধারণা, উমামামা রামায়ণের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। আমার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয় তখন তিনি রামায়ণ থেকে একটি বিষয় বেছে নিয়ে কয়েকটি ছবি আঁকার কাজে হাত দিয়েছেন। বিষয়টি সীতাহরণের। তিনি আমায় নাম দিতে বলায় আমি ছবিগুলির নাম দিয়েছিলাম ‘অপহরণ’ সিরিজ।

ছবি দেখায় আমি অভ্যস্ত নই। উমামামার ছবি অন্যের চোখে কেমন মনে হবে তা আমি জানি না, জানার ইচ্ছাও নেই। হয়ত উমামামা খুবই নিপুণ ও দক্ষ হাতে কাজ করতে পারতেন, হয়ত বা তাঁর হাত ভাল ছিল না, রঙের জ্ঞান ছিল না, অন্যান্য শিক্ষাও ছিল না। তাঁর আঁকা ছবির শিল্পমূল্য সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি একটি বিষয়ে মাত্র নিঃসন্দিগ্ধ, উমামামার ছবি তাঁর আত্মানুসন্ধান।

উমামামার জীবনে কতকগুলি প্রশ্ন ছিল। আমার সঙ্গে তাঁর পাঁচ বছরের ঘনিষ্ঠতায় আমি ওঁর কয়েকটি প্রশ্ন জেনেছি।

ওঁর সমস্ত প্রশ্নের মূল হয়ে শেষাবধি একটি প্রশ্নই দেখা দিয়েছিল—মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি কী?

উমামামা শেষের দিকে রামায়ণের সীতাহরণ অবলম্বন করে যে কয়েকটি ছবি আঁকার কাজে হাত দিয়েছিলেন তার মধ্যে এই প্রশ্নটি ছিল।

তিনি পর পর এই ক’টি ছবি এঁকেছিলেন: পর্ণশালায় সজল নয়নে সীতা বসে আছেন। কুটির সংলগ্নে ছদ্মবেশী রাবণ: পরিধানে কাষায় বস্ত্র, মস্তকে শিখা, স্কন্ধে ষষ্টি ও কমণ্ডলু। দূরে গোদাবরী; চার পাশে বৃক্ষ। রাবণ সীতাকে লোভার্ত ও কামার্ত চোখে যেন স্তুতি করছে: বিশালং জঘনং পীনমূরু করিকরোপমৌ…ইত্যাদি। অর্থাৎ সীতার বিশাল ও স্থূল নিতম্ব, হাতির শুঁড়ের মতন ঊরুদ্বয়, বর্তুল,দৃঢ় পীনোন্নত স্তনযুগল—যা তাল ফলের মতন সুন্দর তা দেখে রাবণ বিমোহিত।

দ্বিতীয় ছবিটি, স্বমূর্তি প্রকাশ করে কুপিত রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। তার বিরাট দেহ, দশ মুখ, কুড়িটি হাত, নীল মেঘের ন্যায় বর্ণ, পরিধানে রক্তবাস।

তৃতীয় ছবিটি সীতাহরণের। রাবণ সীতার কেশ ধরে আকর্ষণ করে রয়ে উঠছে।

চতুর্থ ছবিটি জটায়ুর। বৃক্ষের ওপর বৃদ্ধ জটায়ু নিদ্রিত। সীতার বিলাপ তাঁর কানে আসছে।

পঞ্চম এবং শেষ ছবি: রাবণের সঙ্গে বৃদ্ধ জটায়ুর সংগ্রাম।

উমামামার সীতাহরণ সিরিজের ছবিগুলিতে আমি প্রথমে কোনো বিষয়বৈভব পাইনি। শতবার এই ছবি আঁকা হয়েছে। নতুন কিছু ছিল না।

একদিন উমামামাকে বললাম, “তুমি কি রবি বর্মা?”

উমামামা হেসে মাথা নাড়লেন। “না। কেন বলছিস বুঝতে পারছি।”

পরে একদিন তাঁকে বলেছি, “ওই এক ছবি আজ দু’বছর ধরে কী এত আঁকছ!”

“আঁকছি কোথায়, পারছি না।…”

“তাই দেখছি। তোমার একই ছবি বছরে বছরে পালটে যায়। সীতা খানিকটা পালটেছে। রাবণ আরও পালটে গেছে।”

“হ্যাঁ, যখন মনে হয় ঠিক হয়নি তখন আরও শুধরে নেবার চেষ্টা করি।”

“পারফেক্ট হবার চেষ্টা কর!”

“তা বলতে পারিস।”

“বেশি পারফেক্ট হবার চেষ্টা করার একটা বিপদ আছে মামা। একটা গল্প পড়েছিলাম, গল্পের সেই বিখ্যাত বুড়ো আর্টিস্টের অবস্থা হবে ।…সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।”

উমামামা বললেন, “সমস্ত সাধনাই এক সময় মানুষকে অন্ধ করে।…” বলে উমামামা চুপ করে গেলেন, অনেকক্ষণ পরে উদাসীন গলায় বললেন, হঠাৎ, “যাক গে, আমি তো আর্টিস্ট নই। আমার ভাবনাগুলোই বড় অসম্পূর্ণ।”

পরের বছর উমামামার সঙ্গে যখন দেখা হল, দেখলাম, তাঁর চারটে ছবি শেষ হয়েছে; শেষ ছবিটি নিয়েই তিনি বিব্রত ও অশান্ত হয়ে আছেন। রাবণের সঙ্গে জটায়ুর সংগ্রাম আবার নতুন করে আঁকছেন।

সেদিন কোজাগরী পূর্ণিমা। উমামামার সঙ্গে স্টেশনে ঘুরে বারোয়ারি তলায় গিয়েছিলাম। লক্ষ্মীপ্রতিমা দেখে ফিরছি, একটি মস্ত ঝকঝকে গাড়ি এসে বারোয়ারিতলায় থামল। বৃহৎ একটি পরিবার নেমে এল গাড়ি থেকে; বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বধূ, ছেলেমেয়ে। উমামামা দেখলেন সামান্য, তারপর পা বাড়ালেন।

রাস্তা দিয়ে আমরা পাশাপাশি হাঁটছি। অতি মনোহর জ্যোৎস্না। সমস্ত পথপ্রান্তর বৃক্ষলতা যেন পূর্ণিমার সাগরে ডুবে আছে। কার্তিক মাসের সামান্য হিম পড়ছিল। আকাশটি যেন রুপোর জলে টলমল করছে, মাথার ওপর পূর্ণচন্দ্র । রাস্তায় কুচি পাথরগুলি কিরণে চিকচিক করছিল। ঘাস মাটি এবং শস্যক্ষেত্রগুলি নিস্তব্ধ, যেন কোনো অলৌকিক মোহে অভিভূত হয়ে আছে।

সাঁকোর পর মেঠো পথ, উমামামার বাড়ি। সাঁকো পেরিয়ে এসে উমামামা বললেন, “ওই গাড়িটা দেখেছিলি?”

“কোনটা? যেটা এসে থামল! পেল্লায় গাড়ি।”

“হ্যাঁ । সিঙ্গীমশাইদের গাড়ি। প্রচুর ধনী লোক। পাটনায় থাকেন সব।”

“তোমার চেনা?”

“না, আমি এদের কাউকে চিনি না। একজনকে চিনতাম, সে আসেনি।” বলে উমামামা হাতের ছড়ি দিয়ে পথের ওপর পড়ে থাকা একটা শুকনো ডাল সরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন। আমরা নির্জন ও নিস্তব্ধ মাঠ দিয়ে হাঁটছিলাম।…কিছুক্ষণ নীরবে হেঁটে এসে উমামামা প্রায় আপনমনে কথা বলার মতন করে বললেন, “খুব সম্ভব পেস্তা রঙের শাড়ি পরা সুন্দরী যে মেয়েটিকে দেখলি, সে ওরই মেয়ে।”

“কার?”

“আমি যাকে চিনতাম।”

উমামামা যে মেয়েটির কথা বললেন, আমি যেন তাকে চিনতে পারলাম। খুবই সুন্দরী, কিন্তু আমার ধারণা হল, তিনি বিবাহিতা এবং যুবতী। উমামামার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, “তুমি মেয়ে বলছ কেন, বউ বলো। বছর পঁচিশ বয়স তো হবেই।”

“তা হবে।” উমামামা অন্যমনস্ক।

ফিরে এসে আমরা উমামামার সেই ছবির বাড়িতে গিয়ে বসলাম। চায়ের সাধ হয়েছিল, চাকরে চা দিয়ে গেল। বারান্দায় একটি ডেক-চেয়ারে উমামামা, অন্য বেতের হেলানো চেয়ারটিতে আমি। আমাদের চোখের সামনে অবিরল জ্যোৎস্নার বৃষ্টি পড়ছে যেন।

চা খেতে খেতে আমি শুধোলাম, “তুমি যেন কী ভাবছ, উমামামা!…ছবির কথা?”

উমামামা সাড়া দিলেন না। ধ্যানীর মতন বসে থাকলেন। এই ধরনের মুহূর্তগুলি আমি সহ্য করতে পারি না, অধৈর্য হয়ে উঠি। তবু চুপ করে থাকলাম।

শেষে এক সময় উমামামা বললেন, “আমার ছবিগুলো কেমন লেগেছে তোর তা তো বললি না?”

“সীতা হরণ…! ভালই লেগেছে।…আমি তো ছবির কিছু বুঝি না।”

“সীতা বুঝিস তো!”

“বারে, রাম সীতা বুঝব না?”

উমামামা জবাব দিলেন না কথার। নীরবে বসে থাকলাম। আমার মনে হল, আমি উমামামাকে তাঁর ছবি সম্পর্কে ভাল মতন কিছু বললাম না, এবং আমার জবাব যথেষ্ট হয়নি। বস্তুত, এই ছবি নিয়ে—না, আঁকা নিয়ে নয়, বিষয় নিয়ে—উমামামার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে তর্ক হয়েছে। আমি বুঝতে পারতাম না, তিনি কেন সীতার শারীরিক লক্ষণগুলির প্রতি নজর দেন। উমামামা অবশ্য আমায় বাল্মীকি রামায়ণের শ্লোক উদ্ধার করে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, সীতার ওই সৌন্দর্য স্বয়ং মহাকবির বর্ণনীয় ছিল। আমার অভ্যস্ত চোখ সীতাকে যেন তপস্বিনীরূপে দেখতে চাইত।

কথাটা মনে এল; বললাম, “তোমার সীতাকে দেখলে আগেই আমার চোখ জ্বালা করত, এবার আরও ভীষণ করছে।”

উমামামা আমার কথা নিশ্চয় বুঝলেন, “জানিস, রাবণ সীতাকে বলেছিল: আমি বহু স্থান থেকে বহু উত্তম স্ত্রী সংগ্রহ করেছি; কিন্তু তোমাকে দেখে আমার তাদের ওপর আর অনুরাগ নেই।”

হয়তো উমামামা আমায় ইঙ্গিতে সীতার সৌন্দর্যের দাহের কথা বোঝাবার চেষ্টা করলেন। আমার বলার কথা খুঁজে পেলাম না। শেষে বললাম, “তোমার রাবণ—?”

“আমার রাবণ কী—?” উমামামা শুধোলেন।

“তাকে আরও ভয়ংকর মনে হয়।…কী জানি বুঝি না ঠিক।…ওই যে যেখানে সীতার সামনে স্বমূর্তি প্রকাশ করে দাঁড়িয়ে আছে—ওই ছবিটায় তোমার রাবণকে দেখলে আমার কেমন ভয় করে।”

“দশটা মাথার জন্যে? না কুড়িটা হাতের জন্যে?”

“ঠাট্টা করছ!…তোমার রাবণ কিন্তু রাক্ষসেরও বেশি। চরম পিশাচ।…দম্ভ, লোভ, কাম, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা—সব দিক দিয়েই আদি শয়তানের মতন।…কী করে তোমার মতন মানুষ এই রাবণ আঁকতে পারল ভেবে আমি অবাক হই।”

উমামামা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আমার মনের খুব গভীরের কথাটা বোঝবার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, “রাবণের এই চেহারা তুই দেখতে পাস না?”

“না।”

“এখন তোর অল্প বয়স, আরও বয়স হোক—এই সংসারকে দেখতে শেখ…”

“এর পর তো তুমি বাল্মীকির কথা বলবে। তাঁর রাবণের বর্ণনা শোনাবে।”

“না, আমি বাল্মীকির কথা বলব না, চঞ্চল; নিজের কথা বলব।”

কথায় কথায় আমি কিছু উত্তেজিত হয়েছিলাম, উমামামার কথায় তাঁর দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালাম।

উমামামা মৃদু ও অন্যমনস্ক গলায় থেমে থেমে বললেন, “আমার স্ত্রী খুবই সুন্দরী ছিল। লোকে বলত আগুনের মতন রূপ। তার সেই রূপের আকর্ষণে এক রাবণ এসেছিল।”

আমার বুকের কোথাও যেন একটি ভীত স্পন্দন এসেছিল; সেই স্পন্দন ক্রমশই দ্রুত হচ্ছিল, এবং আমার যেন আন্দোলিত করছিল। সচকিতে উমামামার দিকে তাকিয়ে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল। তিনি স্থির ও শান্ত। জ্যোৎস্নার কিরণ আমাদের ধৌত করছিল। অদ্ভুত একটি ঝিল্লিরবে সব যেন পূর্ণ হয়ে উঠেছে। উমামামার খরগোশের বাক্স শূন্য, তবু যেন জ্যোৎস্নার আলোয় সেই মৃত জীবটিকে অলৌকিকভাবে আমি অনুভব করছি।

“আমি তখন মুঙ্গেরে”, উমামামা বললেন, “চাকরি করি। টুরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি, তাকে কে চুরি করে নিয়ে চলে গেছে।”

আমার আপাদমস্তক কম্পিত হল। অথচ কী নির্বিকার নিরাসক্ত চিত্তে উমামামা এই ভীষণ ঘটনার কথা বললেন, যেন সেই স্মৃতিতে তিনি আর বিচলিত নন, ব্যথিত নন। আমি অপলকে তাঁর মুখপানে তাকিয়ে থাকলাম।

“অসম্মান, অগৌরব, লজ্জা আমায় তখন খুবই পীড়িত করেছিল—”, তিনি বললেন, যেন আমার স্বাভাবিক বিস্মিত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, কিন্তু আমি চোরের অনুসন্ধান করিনি।”

স্তব্ধ ও আহত হয়ে এই মানুষটির অদ্ভুত সেই আচরণের কারণ বোঝাবার চেষ্টা করলাম। “কেন? তুমি খোঁজ করার চেষ্টা করলে না কেন?”

“তাতে কোনো ফল হত না। আমার মনে হয়েছিল, আমি তাকে ধরে রাখতে পারব না।”

“তুমি কী বলছ, উমামামা!…লোকটাকে তুমি চিনতে না?”

“পরে চিনেছি…”

“তবু তুমি এত বড় লজ্জা মুখ বুজে সয়ে গেলে।” উমামামার প্রতি আমার ঘৃণা ও ক্রোধ হচ্ছিল।

উমামামা কয়েক মুহূর্ত যেন আমার সেই উত্তেজনা লক্ষ করলেন; বললেন, “চঞ্চল, সংসারে আমাদের লজ্জা পাবার মতন ঘটনা অহরহ ঘটছে; আমরা কি তা মুখ বুজে সহ্য করে যাই না!…আমার স্ত্রীকে অন্য লোকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় আমি নিশ্চয় গৌরব বোধ করিনি। আমার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। আমার তখনকার মনের অবস্থা আজ বোঝানো যাবে না।” উনি থামলেন, যেন আমায় বুঝতে দিলেন, তিনি সে সময় স্বাভাবিক মানুষের মতনই পীড়িত হয়েছিলেন। তারপর কেমন অদ্ভুত স্বরে বললেন, “…কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখেছিলাম, জীবনে অনেক কিছুর বিরুদ্ধেই তো আমি দাঁড়াতে পারিনি।”

“তুমি কার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাও?”

“আমার যাতে লজ্জা তার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই কি আমার উচিত নয়!…একটু আগে তুই বলছিলি আমার রাবণ সাধারণ রাক্ষসের চেয়েও বেশি, সে চরম পিশাচ। দম্ভ, লোভ, কাম, ক্রোধ, নির্মমতার প্রতিমূর্তি, শয়তান…”

“আমার চোখে তাই মনে হয়েছে।”

“তোর চোখ আর একটু পরিষ্কার হলে বোধ হয় দেখতে পাবি, যে সংসারে আমরা বেঁচে আছি তার মধ্যেও এই বিশাল রাক্ষসটি আছে। দশানন সেই অরি কখনো আমার মধ্যে, কখনো বাইরে।”

আমার মধ্যে কোথাও বুঝি একটি গোপন দ্বার সহসা খুলে গেল, অবরুদ্ধ কক্ষটির অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আমার বোধবুদ্ধি নিঃসাড় হয়ে থাকল; তারপর সেই কক্ষের অন্ধকার ঘুচে গেলে, দশানন সেই অরিটিকে যেন আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।

উমামামা বলছিলেন, “যে লোকটি আমার স্ত্রীকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল সে কামোন্মত্ত, হয়তো রূপোন্মত্ত; আমার স্ত্রীও যে নিজের রূপের আগুনে অন্যকে দগ্ধ করছিলেন না—তা-ই বা আমি জোর করে বলি কেমন করে? এ ধরনের ঘটনা আমাদের সংসারে অনেক ঘটেছে, অনেক ঘটবে। আমিও ঘটাতে পারতুম।”

“আমরা কি এরই মধ্যে বেঁচে আছি!” অব্যক্ত এক বেদনায় আমার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল।

“আমরা এরই মধ্যে বেঁচে আছি বহুকাল ধরে, এরই মধ্যে বেঁচে থাকব।”

উমামামার এই স্থির নিশ্চিত বিশ্বাস আমায় বড় শূন্য দুর্বল করে দিল। যেন আমি তাঁর কথা অবিশ্বাস করে আমার এই চেনা সংসারের দিকে তাকালাম সান্ত্বনার আশায়। দেখলাম, আমার মধ্যে ভয়, অসহায়তা, ব্যর্থতা, অক্ষমতার গভীর খাদ তৈরি হয়ে আছে; দেখলাম—এই জীবনে আমি কাম, ক্রোধ, লোভ, আত্মপরতার ক্রীতদাস; তারপর আমি সেই অবর্ণনীয় দশানন রাবণকে লক্ষ করলাম, যার দশটা ভয়াবহ মাথা এবং কুড়িটি অস্ত্রধৃত হাত আমাকে হনন করছে। মহাভয় সেই পিশাচ তার স্বার্থপরতা, লোভ, আত্মতুষ্টি, প্রতাপ ও প্রভুত্বের লিপ্সার জন্য আমায় ক্ষতবিক্ষত করছে।

উমামামা স্বগতোক্তির মতন বলছিলেন, “চঞ্চল, কবি বাল্মীকি রামকে ঐশী ক্ষমতা দিয়েছিলেন; আমি রাম নই। মানুষকে হারতে হয়। জীবনের অর্থই বেদনা। দুঃখ বই আমাদের গতি নেই। যন্ত্রণা ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কোথায়! আমাদের প্রেমে দুঃখ, সাধনায় দুঃখ, প্রার্থনায় ব্যর্থতা। আমার বাবা জীবনে কিছু পাননি, দাদা মৃত্যুর কাছে বঞ্চিত হয়েছে, মা তার ঠাকুরের কাছে, আমি মানুষের কাছে…। আমি স্বীকার করে নিয়েছি, মানুষের নিয়তিই এই, শেষ অবধি কোথাও না কোথাও পরাজয়।”

“তোমার কোথাও লজ্জা নেই, উমামামা?”

“আগে ছিল না। চোখের সামনে দেখতাম লজ্জা পাবার মতন ঘটনা অহরহ ঘটছে, আমি লজ্জিত হই না।…আমার মনুষ্যত্ব চুরি যাচ্ছিল, আমি অসহায়ের মতন তা চুরি যেতে দিচ্ছিলাম।…শেষে আমার মনে হল, আমি কেন বেঁচে আছি, কী অর্থ বেঁচে থাকার? অনেক দিন থেকেই কথাটা আমি ভাবছি, এখনও ভাবি।”

উমামামা যেন অনেক দূর থেকে রাত্রের পাহারাদারের মতন আমায় সজাগ থাকতে হাঁক দিচ্ছিলেন, আমি তাঁর সেই ডাক শুনতে শুনতে কোনো অতীন্দ্রিয় অনুভবে সহসা আমার মধ্যে জেগে ওঠার আবেগ অনুভব করলাম, আমার চেতনা জাগ্রত হল। পরক্ষণেই আমি এই সংসারের দশানন রাবণটিকে যেন দেখতে পেলাম, সে আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে ক্রমশই বিরাট ও ভয়ঙ্কর হচ্ছিল, তার দর্পিত চক্ষু,অমিত পরাক্রম, নির্মম ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রগুলি, এবং আমার প্রতি পরম অবজ্ঞা লক্ষ করে আমি ভীতার্ত ও অসহায় হয়ে আমার কী যেন মূল্যবান সম্পদ গোপন করার চেষ্টা করলাম। সে অতি অক্লেশে আমার সেই সম্পদ হরণ করার জন্যে হাত বাড়াল।

অস্ফুট স্বরে উমামামাকে আমি সাহায্যের জন্যে ডাকলাম।

সংবিৎ ফিরে পেতে শুনলাম, উমামামা বলছেন, “আজকাল আমার মনে হয় মানুষের জীবনে পরাজয়টা সত্য, বেদনা তার সহচর, তবু আমাদের বেঁচে থাকার একটা সঙ্গত কারণ আছে। এই সাময়িক জীবনকে আমরা সম্মানের জীবন করতে পারি, আমাদের পরাজয় সম্মানের ও অংহকারের হতে পারে।”

“সে কেমন জীবন, উমামামা?”

“আমি ঠিক জানি না।…জানার চেষ্টা করছি। …তুই দেখছিস না, আমি রাবণের সঙ্গে জটায়ুর যুদ্ধটা কতরকম ভাবে আঁকার চেষ্টা করছি।”

উমামামার জটায়ু-ছবিটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি নানাভাবে এই ছবিটি আঁকতে দেখেছি উমামামাকে। কখনও তাঁর জটায়ু বৃদ্ধের সমস্ত শৈথিল্য নিয়ে লড়ছে, কখনও সে যৌবনের মধ্যে ফিরে এসে লড়ছে, কখনও সংগ্রাম নিরাসক্ত নির্লিপ্ত প্রাণহীন, কখনও মনে হয়েছে পাপের বিরুদ্ধে পুণ্যের আদর্শ ও আবেগ নিয়ে সে যুদ্ধ করছে।

“তোমার জটায়ু কোন মূর্তিতে যুদ্ধ করবে, উমামামা?” অস্ফুট গলায় শুধোলাম। যেন এই প্রশ্নটি আমার।

“নানাভাবে তাকে এঁকেছি। হয় তার মূর্তিই এক, আলাদা আলাদা ভঙ্গি; না হয় তার মূর্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমার মনে হয়, জটায়ু তার নিয়তি সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে শুধুমাত্র জীবনের সম্মান ও অহংকারের জন্যে যুদ্ধ করছে…হয়ত সেটাই ভাল।”

উমামামার সঙ্গে সেই আমার শেষ সাক্ষাৎ। তারপর এ-বছরে তিনি গয়া যাবার পথে ট্রেনে আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়েছেন। তিনি বৃদ্ধ ও অক্ষম হয়ে এসেছিলেন, তাঁর দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে এসেছিল। এ বয়সে, শূন্য হাতে, শেষ দৃষ্টিটুকু সম্বল করে তিনি কার বিরুদ্ধে এবং কিসের বিরুদ্ধে বাধা দিতে গিয়েছিলেন তা আমি জানি। নিছক অর্থ অপহরণকারী এক তস্করের বিরুদ্ধে বাধা দিতে গিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন এ কথা স্বীকার করলে আমার পক্ষে তাঁর প্রতি অবিচার হবে। তিনি তাঁর জটায়ু ছবিটি এতদিনে শেষ করেছেন বলেই আমি মনে করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress