Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

স্কুলে ঢুকিবার পূর্বে গেটের কাছে একদল ছাত্র ভিড় জমাইয়া তুলিয়াছে। যদুবাবুকে দেখিয়া ক্লাস নাইনের একটি বড় ছেলে আগাইয়া আসিয়া বলিল, আজ স্কুলে ঢুকবেন না স্যার, আজ আমাদের স্ট্রাইক, কেউ যাবে না স্কুলে।

যদুবাবুর মুখ অপ্রত্যাশিত আনন্দে উজ্জ্বল দেখাইল। এও কি সম্ভব হইবে? আজ কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলেন? স্ট্রাইক হওয়ার অর্থ সারাদিন ছুটি! এখনই বাসায় ফিরিয়া দুপুরে দিবানিদ্রা দিবেন, তারপর বিকালের দিকে উঠিয়া তাঁহার এক বন্ধুর বাড়ি আছে মলঙ্গা লেনে, সেখানে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত দাবা খেলিবেন। মুক্তি।

এই সময় শ্রীশবাবু ও মিঃ আলম একসঙ্গে গেটের কাছে আসিয়া দাঁড়াইতে ছেলেরা তাঁহাদের ঘিরিয়া দাঁড়াইল। আজ রামতারক মিত্র গ্রেপ্তার হওয়ার দরুন—দেশবিখ্যাত নেতা রামতারক মিত্র—কলিকাতার সমগ্র ছাত্রসমাজে দারুণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছে, স্কুল-কলেজের ছাত্রদল মিলিয়া বিরাট শোভাযাত্রা বাহির করিবে ও-বেলা।

মিঃ আলম বলিলেন, আমাদের যেতে হবেই। আর তোমাদেরও বলি, আমি চাই না যে, এ স্কুলের ছাত্রেরা কোনো পলিটিক্যাল আন্দোলনে যোগ দেয়। চলুন যদুবাবু, শ্রীশবাবু—

যদুবাবু মনে মনে ভাবিলেন, গিয়ে সইটা করেই ছুটি, কেউ আসছে না স্কুলে।

হেডমাস্টার স্ট্রাইকের কথা জানিতেন না। তিনি সকালে উঠিয়া খয়রাগড়ের রাজবাড়িতে টুইশানিতে গিয়াছিলেন, ফিরিয়া সব শুনিলেন। নিজে গেটে দাঁড়াইয়া ছেলেদের বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন অনেক—তাঁহার কথা কেহ শুনিল না। টিচার্স-রুমে বসিয়া বসিয়া মাস্টারেরা উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। যদুবাবু বলিলেন, হ্যাঁঃ, শুনছে আজ ক্লার্কওয়েল সাহেবের কথা। তুমিও যেমন! কোথায় রামতারক মিত্তির—অত বড় লিডার আর কোথায় ক্লার্কওয়েল—ফোতো স্কুলের ফোতো হেডমাস্টার!

কিন্তু মাস্টারদের আশা পূর্ণ হইল না। একটু পরেই হেডমাস্টারের স্লিপ লইয়া মথুরা চাপরাসী আসিল, নিচু দিকের ক্লাসে ছোট ছোট ছেলেরা অনেক সকালেই আসে—বিশেষত তাহারা দেশনেতা রামতারক মিত্রের বিরাট ব্যক্তিত্বের বিষয়ে কিছুই জানে না; সুতরাং মাস্টার ও অভিভাবকের ভয়ে যথারীতি ক্লাসে আসিয়াছে। তাহাদের লইয়া ক্লাস করিতে হইবে।

উপরের দিকের ক্লাসের মাস্টার যাঁহারা, এ আদেশে তাঁহাদের কোনো অসুবিধা হইল না; কেননা উপরের কোনো ক্লাসে একটি ছাত্রও আসে নাই। ধরা পড়িয়া গেলেন শ্রীশবাবু প্রভৃতি, যাঁহাদের প্রথম ঘণ্টায় নীচের দিকে ক্লাস আছে।

যদুবাবু চতুর্থ শ্রেণীতে ঢুকিয়া দেখিলেন, জন-পাঁচ-ছয় ছোট ছেলে বসিয়া আছে। ও-পাশে ক্লাস সেভেন-এ জনপ্রাণীও আসে নাই, সুতরাং প্রথম ঘণ্টার শিক্ষক হেডপণ্ডিত দিব্য উপরের ঘরে বসিয়া আড্ডা দিতেছেন, অথচ তাঁহার—

রাগে দুঃখে যদুবাবু ধপ করিয়া চেয়ারে বসিয়া কটমট করিয়া চারিদিকে চাহিলেন। এই হতভাগাগুলার জন্যই এই শাস্তি—যদি এই বদমাইসগুলা না আসিত, তবে আজ তাঁহার দিবানিদ্রা রোধ করে কে?

কড়া বাজখাঁই সুরে হাঁকিলেন, আজ পুরনো পড়া ধরব—নিয়ে আয় বই—ছাল তুলব আজ পিঠের, যদি পড়া ঠিকমত না পাই—

ছোট ছোট ছেলেরা তাঁহার রাগের কারণ ঠাহর করিতে না পারিয়া গা-টেপাটিপি করিতে লাগিল পরস্পর। একটি ছেলে ভয়ে ভয়ে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আজ তো পুরনো পড়ার কথা ছিল না স্যার!

যদুবাবু দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন, পুরনো পড়া আবার বলা থাকবে কী? ও যে দিন ধরব, সেই দিনই বলতে হবে—দেখাচ্ছি সব মজা, কোনো ক্লাসের ছেলে স্কুলে আসে নি, ওরা এসেছেন—ওঁদের পড়বার চাড় কত! ছাল তুলছি আজ পড়া না পারলে—

দুই-একটি বুদ্ধিমান ছেলে ততক্ষণ তাঁহার রাগের কারণ খানিকটা বুঝিয়াছে। একজন বলিল, স্যার, না এলে বাড়িতে বকে, বলে—ওপরের ক্লাসের ছেলেরা স্ট্রাইক করেছে তা তোদের কী? সেই আষাঢ় মাসে স্ট্রাইকের সময় এরকম হয়েছিল—

আর একটি অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ছেলে বলিল, স্যার, বলেন তো পালাই।

যদুবাবু সুর নরম করিয়া বলিলেন, পালাবি কোথা দিয়ে? ইস্কুলের গেটে হেডমাস্টার তালা দিয়ে রেখেছেন।

ক্লাসসুদ্ধ ছেলে বলিয়া উঠিল প্রায় সমস্বরে, গেটের দরকার কী স্যার? আপনি বলুন, টিনের বেড়া রয়েছে পেছনে, ওর তলা দিয়ে গলে বেরিয়ে যাব।

—তবে তাই যা। কাউকে বলিস নে। রেজেস্ট্রি হয় নি তো এখনও—পালা। একে একে যা।

নীচের তলায় আশপাশের ক্লাসে ছেলে নাই, কারণ সেগুলি বড় ছেলেদের ক্লাস। কেবল পূর্বদিকের কোণে হল-ঘরের পাশের ক্লাসে গুটিকয়েক ছোট ছেলে লইয়া জ্যোতির্বিনোদ বিরক্তমুখে বসিয়া আছেন। যদুবাবু বলিলেন, ওহে জ্যোতির্বিনোদ, ওগুলোকে যেতে দাও না!

জ্যোতির্বিনোদ যেন দৈববাণী শুনিলেন, এরূপভাবে লাফাইয়া উঠিয়া আগ্রহের সুরে বলিলেন, দেব ছেড়ে? সাহেব কিছু বলবে না তো?

যদুবাবু মুখে কোনোদিন খাটো নহেন, ব্যঙ্গের সুরে বলিলেন, ও সব ভাবলে তবে বসে ক্লাস করো সেই বেলা তিনটে পর্যন্ত (ছোট ছেলেদের তিনটার সময় ছুটি হইয়া যায়)। এই তো আমি ছেড়ে দিলাম—

—আপনারা সব বড় বড়, আমরা হলাম চুনোপুঁটি, সবতাতেই দোষ হবে আমাদের।

—কিছু না, ছেড়ে দাও সব। এই, যা সব পালা—টিনের পার্টিশানের তলা দিয়ে পালা। স্ট্রাইকের দিন স্কুল করতে এসেছে! ভারি পড়ার চাড়!

জ্যোতির্বিনোদও সুরে সুর মিলাইয়া বলিলেন, দেখুন দিকি কাণ্ড যত—পড়ে তো সব উল্টে যাচ্ছেন একেবারে! যা সব একে একে। রোতো, গোল করবি তো হাড় ভাঙব মেরে, কেউ টের না পায়—

কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস প্রায় খালি হইয়া গেল।

যদুবাবু উপরে গিয়া বলিলেন, কোথায় ছেলে? দু-একটা এসেছিল, কে কোথা দিয়ে পালিয়ে গেল ধরতেই পারা গেল না—

ক্ষেত্রবাবু ছুটির দিনই রাত্রির ট্রেনে বর্ধমান রওনা হইলেন।

পরদিন সকালের দিকে বর্ধমান স্টেশনে নামিয়া প্ল্যাটফর্মের উত্তর দিকে মালগুদামের ও পার্সেল আপিসের পিছনে দাদার কোয়ার্টারে গিয়া ডাক দিলেন, ও বউদি!

—এস এস ঠাকুরপো! মনে পড়ল এতদিন পরে? তা ভালো আছ বেশ? আমায় শশীবাবুর বউ রোজই বলেন—হ্যাঁ দিদি, তোমার সে ঠাকুরপো কবে আসবেন? আমি বলি—তা কী করে জানব? কলেজে কাজ করেন, বড় চাকরি, ছুটি না হলে তো আসতে পারেন না! তা ছেলেমেয়েদের কোথায় রেখে এলে?

—ওরা তাদের পিসিমার কাছে রইল কালীঘাটে—মেজদিদির কাছে।

—বেশ, এসেছ ভালোই হয়েছে। এবার একটা যা হয় ঠিক করে ফেল। ওঁদের মেয়ে বড় হয়েছে, তোমার ভরসাতেই আছে। আর তোমাকে সংসার যখন করতেই হবে, তখন আর দেরি করা কেন, আমি বলি। ব’সো হাত-পা ধোও, চা করি।

ক্ষেত্রবাবু এইরূপ একটা অস্পষ্ট আশার গুঞ্জনধ্বনি সারারাত ট্রেনের মধ্যে কানের কাছে শুনিয়াছেন—চলমান বাতাসে সে আভাস আসিয়াছিল। বাসায় পা দিতেই এমন কথা শুনিবেন, তাহা কিন্তু ভাবেন নাই। ক্ষেত্রবাবু পুলকিত হইয়া উঠিলেন।

তাঁহার জাঠতুতো দাদা গোবর্ধনবাবু সন্ধ্যার সময় ডিউটি হইতে ফিরিয়া বলিলেন, এই যে, ক্ষেত্র কখন এলে? চা খেয়েছ? স্কুল কবে—কাল বন্ধ হ’ল? বেশ।

গোবর্ধনবাবু পাকা লোক। যে খুড়তুতো ভাই আজ সাত-আট বছরের মধ্যে কখনও ঘনিষ্ঠতা করা দূরের কথা, বছরে দুইখানি পোস্টকার্ডের পত্র দিয়া খোঁজ-খবর লইত কিনা সন্দেহ, সেই ভাই কাল স্কুল বন্ধ হইতে না হইতে কলিকাতা হইতে বর্ধমানে আসিয়া হাজির, এ নিশ্চয়ই নিছক ভ্রাতৃ-প্রেম নয়। গোবর্ধনবাবু মনে মনে হাসিলেন।

চা-জলখাবার-পর্বান্তে ক্ষেত্রবাবু তাঁহারই সমবয়সী শ্রীগোপাল মজুমদার অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন-মাস্টারের বাড়ি বেড়াইতে গেলেন। রেলওয়ে সমাজে পরস্পরকে উপাধি দ্বারা সম্বোধন করাই প্রচলিত।

ক্ষেত্রবাবুকে সেখানেও একদফা চা-খাবার খাইতে হইল। মজুমদার বলিল, তারপর ক্ষেত্রবাবু, শুনছিলাম একটা কথা—

ক্ষেত্রবাবুর বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করিয়া উঠিল। বুঝিয়াও না বুঝিবার ভান করিয়া বলিলেন, কী কথা?

—আমাদের মুখুজ্জের ভাইঝির সঙ্গে নাকি আপনার—

ক্ষেত্রবাবু সলজ্জ হাসিয়া বলিলেন, না না, কই না—আমার তো—

—না, আমি বলি, দ্বিতীয় সংসার করার ইচ্ছে যদি থাকে, তবে এখানেই করে ফেলুন—মেয়েটি বড় ভালো।

ক্ষেত্রবাবু দুই-একবার বলি-বলি করিয়া অবশেষে বলিলেন, মেয়ে? ও দেখেচেন নাকি?

—কে, অনিলা? অনিলাকে ফ্রক পরে বেড়াতে দেখেছি। আমাদের বাসায় আমার ভাগ্নী বিমলার সঙ্গে খুব আলাপ।

—ও।

—বেশ মেয়ে। দেখতে তো ভালোই, ঘরের কাজকর্ম সব জানে। চলুন না, পায়ে পায়ে মুখুজ্জের বাসায় যাই। আপনি এসেছেন, বোধ হয় জানে না।

ক্ষেত্রবাবু জিভ কাটিয়া বলিলেন, আরে তা কখনও হয়? না না। আমি যাব কেন?

—আমরা যে ক’জন আছি স্টেশনের কোয়ার্টারে—সব এক ফ্যামিলির মত। এখানে কুটুম্বিতে করি না কেউ কারও সঙ্গে। সেবারে ওই মল্লিকবাবুর মা মারা গেল, আটাত্তর বছর বয়সে। রাত দেড়টা, আমি এইট্টিন ডাউন সবে পাস করে টিকিটের হিসেব চালানে এনট্রি করেছি, এমন সময় বাসা থেকে লোক গিয়ে বললে—শীগগির চল, এই রকম ব্যাপার। সেই রাত্তিরে মশাই রেলওয়ে কোয়ার্টারের ক’টি প্রাণী, বলি ব্রাহ্মণ আর কায়স্থ কী, হিন্দু তো বটে—ঘাড়ে করে নিয়ে গেলুম শ্মশানে; তা এখানে ওসব নেই। চলুন, যাওয়া যাক।

ক্ষেত্রবাবুর যাওয়ার ইচ্ছা যে না হইয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু দাদা কী মনে করিবেন, এই ভয়ে মজুমদারের কথায় অ-রাজি হইতে পারিলেন না।

পরদিন বেলা দশটার সময় ক্ষেত্রবাবু বাসায় বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন, এমন সময় একটি মেয়ে এক বাটি তেল আনিয়া সামনে রাখিয়া সলজ্জ সুরে বলিল, দিদি বললেন, আপনাকে নেয়ে আসতে।

ক্ষেত্রবাবু চাহিয়া দেখিলেন, সতেরো-আঠারো বছরের মেয়েটি। বেশি ফরসাও নয়, বেশি কালোও না। মুখশ্রী ভালো।

—ও! বউদিদি বললেন?

ক্ষেত্রবাবু যেন একটু থতমত খাইয়া গিয়াছেন, কথার সুরে ধরা পড়িল।

মেয়েটি হাসি চাপিতে চাপিতে বলিল, হ্যাঁ।—এই কথা বলিয়াই সে চলিয়া গেল।

ক্ষেত্রবাবু ভাবিলেন, কে মেয়েটি, কখনও তো দেখেন নাই একে! এ সেই মেয়েটি নয় তো?

স্নান করিয়া খাইতে বসিয়াছেন, সেই মেয়েটিই আসিয়া ভাতের থালা সামনে রাখিল। আবার ফিরিয়া গিয়া ডালের বাটি আনিয়া দিল। খাওয়ার মধ্যে মেয়েটি অনেকবার যাতায়াত করিল। ক্ষেত্রবাবু দুই-একবার মেয়েটির মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, মুখখানি ভালো ছাড়া মন্দ বলিয়া মনে হইল না তাঁহার কাছে। ভালো করিয়া চাহিতে পারিলেন না, দাদা পাশে বসিয়া খাইতেছেন। আহারাদির পর ক্ষেত্রবাবু বিশ্রাম করিতেছেন, সেই মেয়েটিই আসিয়া পান দিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবুর কৌতূহল হইল জানিবার জন্য মেয়েটি কে, কিন্তু কখনও অপরিচিতা মেয়ের সঙ্গে কথা কওয়ার বা মেলামেশার অভিজ্ঞতা না থাকায় চুপ করিয়া রহিলেন। গরিব স্কুলমাস্টার, তেমন সমাজে কখনও যাতায়াত নাই।

এ দিন এই পর্যন্ত। মেয়েটি আর আসিল না সারাদিনের মধ্যে। কিন্তু ক্ষেত্রবাবুর মন যেন তাহার জন্য উৎসুক হইয়া রহিল সারাদিন। মুখখানি বেশ। সেই মেয়েটি নাকি? কী জানি! লজ্জায় কথাটা কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না। পরে আরও দুই দিন গেল, মেয়েটির কোনো চিহ্ন নাই কোনো দিকে। হঠাৎ তৃতীয় দিনে মেয়েটি সকালে চায়ের পেয়ালা রাখিয়া গেল সামনে। ক্ষেত্রবাবুর বুকের মধ্যে কিসের একটা ঢেউ চলকিয়া উঠিল। মেয়েটি দোরের কাছে একটুখানি দাঁড়াইয়া চলিয়া গেল এবং আর কিছুক্ষণ পরে আবার আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনাকে কি আর এক পেয়ালা চা দোব?

—চা! তা বেশ।

—আনব?

—হ্যাঁ।

মেয়েটি এবার চলিয়া যাইতেই ক্ষেত্রবাবু ভাবিলেন, লজ্জা কিসের—এবার তিনি জিজ্ঞাসা করিবেনই। সেই মেয়েটি নয়, ও অন্য কেউ, পাশের কোনো বাসার মেয়ে। কী জাতি, তাহারই বা ঠিক কী। তা হোক, একটু আলাপ করিতে দোষ নাই।

এবার চা আনিতেই ক্ষেত্রবাবু লাজুকতা প্রাণপণে চাপিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি বুঝি পাশের বাসাতেই থাকেন?

মেয়েটি যেন এতদিন ক্ষেত্রবাবুর কথা কহিবার আশায় ছিল, বহুবিলম্বিত ব্যাপারের অপ্রত্যাশিত সংঘটনে প্রথমটা নিজে যেন কিছু থতমত খাইয়া গেল। পরে বেশ সপ্রতিভ ভাবেই আঙুল তুলিয়া অনির্দেশ্য একটা বাসার দিকে দেখাইয়া বলিল, পাশে না, ও-ই দিকে আমাদের বাসা।

—ও।

ক্ষেত্রবাবু আর কথা খুঁজিয়া পান না। মেয়েটি যেন আশা করিয়াই দাঁড়াইয়া আছে, তিনি আবার কথা বলিবেন। ক্ষেত্রবাবু পুনরায় মরীয়া হইয়া বলিলেন, আপনার বাবা বুঝি রেলে কাজ করেন?

—পার্সেল-আপিসে কাজ করেন।

—বেশ।

মেয়েটি তখনও দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া ক্ষেত্রবাবু আকাশ-পাতাল ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি পড়েন বুঝি?

—এখন বাড়িতেই পড়ি, গার্লস স্কুলে থার্ড ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম, এখন বড় হয়েছি তাই আর স্কুলে যাই নে।

মেয়েটি যে কয়টি ইংরেজি কথা বলিল, সবগুলির উচ্চারণ স্পষ্ট ও জড়তাশূন্য, অশিক্ষিত উচ্চারণ নয়। ইংরেজি-জানা মেয়ে ক্ষেত্রবাবু এ পর্যন্ত দেখেন নাই, মেয়েটির প্রতি সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, এখানে বুঝি গার্লস স্কুল আছে?

—বেশ বড় স্কুল তো, আড়াইশো মেয়ে পড়ে।

—হেডমিস্ট্রেস কে?

—আমাদের সময়ে ছিলেন মিস সুকুমারী দত্ত বি-এ, বি-টি। এখন কে এসেছেন জানি নে।

বা রে, মেয়েটি ‘বি-টি’র খবর পর্যন্ত রাখে! স্কুলমাস্টার ক্ষেত্রবাবু প্রশংসায় বিগলিত হইয়া উঠিলেন মনে মনে। যেন কোনো অদৃষ্টপূর্ব কিছু দেখিতেছেন। বেশ মেয়েটি তো?

—আপনাদের স্কুলে পুরুষমানুষ টিচার নেই বুঝি?

—নীচের দিকে একজন আছেন ভুবনবাবু বলে, বুড়োমানুষ। আমরা দাদু বলে ডাকতাম।

—পড়ানো বেশ ভালো হত স্কুলে? অঙ্ক কষাতেন কে?—ক্ষেত্রবাবু এবার কথা কহিবার বিষয় খুঁজিয়া পাইয়াছেন।

—নীহারদি—মিস নীহার তালুকদার, ওঁরা ব্রাহ্ম।

বাঃ, মেয়েটি ব্রাহ্মদের খবরও রাখে! এত বাহিরের খবর জানা মেয়ে সাধারণ গৃহস্থঘরে বড় একটা দেখা যায় না, অন্তত ক্ষেত্রবাবু তো দেখেন নাই। ইচ্ছা হইল, খানিকক্ষণ মেয়েটির সঙ্গে গল্প করেন; কিন্তু সাহসে কুলাইল না। কে কী মনে করিতে পারে!

পরদিন বৈকালে ক্ষেত্রবাবুর বউদিদি বলিলেন, শশীবাবুদের বাসায় তোমার আর ওঁর নেমন্তন্ন।

ক্ষেত্রবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, শশীবাবু কে? সেই তাঁরা?

বউদিদি হাসিমুখে বলিলেন, হ্যাঁ গো, সেই তারাই তো।

—সেখানে কি যাওয়া উচিত হবে?

—কেন?

—একটা আশা দেওয়া হবে, কিন্তু—

—কিন্তু কী? তুমি বিয়ে করবে কিনা, এই তো?

—হ্যাঁ—তা—সেই রকমই ভাবছিলাম—

—কেন, মেয়ে পছন্দ হয় নি?

ক্ষেত্রবাবু আকাশ হইতে পড়িলেন। তিনি তখনই ব্যাপারটা আগাগোড়া বুঝিয়া ফেলিলেন। বউদিদির ষড়যন্ত্র। তাহা হইলে শশীবাবুদের বাসার সেই মেয়েটি! হাসিয়া বলিলেন, সব আপনার কারসাজি! তখন তো ভাবি নি যে, ওই মেয়ে! ও!

—মেয়ে খারাপ?

ক্ষেত্রবাবু দেখিলেন, হঠাৎ নিজেকে অত্যন্ত খেলো করিয়া লাভ নাই, ওজনে ভারী থাকা মন্দ নয়। বলিলেন, মেয়ে? হ্যাঁ—না, তা খারাপ নয়। তবে ‘আহা মরি’ও কিছু নয়।

—মনের কথা বলছ ঠাকুরপো? সত্যি বল, তোমার পছন্দ হয় নি? অনিলার কিন্তু তোমাকে পছন্দ হয়েছে।

ক্ষেত্রবাবুর সতর্কতার বাঁধ হঠাৎ ভাঙিয়া গেল। তিনি তাড়াতাড়ি আগ্রহপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কী, কী, কী রকম?

ক্ষেত্রবাবুর বউদিদি খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, তবে নাকি ঠাকুরপোর মন নেই? আমাদের কাছে চালাকি? সত্যি তা হলে ভালো লেগেছে? তবে আমিও বলছি শোন, অনিলা তোমাকে দেখতেই এসেছিল আসলে। অবিশ্যি ছুতো করে এসেছিল। আমি যেন কিছু বুঝি নি, এইভাবে বললাম, কলকাতা থেকে আমাদের একজন আত্মীয় এসেছে, বাইরে বসে আছে, চা-টা দিয়ে এস—ভাতটা দিয়ে এস। একা পারছিনে। তাই ও গিয়েছিল। বার বার পাঠালে ভালো হয়, এমনি মনে হল। আজকালকার সব বড়সড় মেয়ে। ওদের ধরনই আলাদা। যেয়ো কিন্তু।

রাত্রে সেই মেয়েটিই ক্ষেত্রবাবুদের পরিবেশন করিল। কিন্তু করিলে কী হইবে, দাদা পাশেই বসিয়া। ক্ষেত্রবাবু লজ্জায় মুখ তুলিয়া চাহিতেও পারিলেন না। খাওয়াদাওয়া মিটিয়া গেল। ছোট রেলওয়ে-কোয়ার্টারের বাহিরের ঘরে ক্ষুদ্র তক্তপোশে শতরঞ্জির উপর ক্ষেত্রবাবু আসিয়া বসিলেন। বাড়ির কর্তা হঠাৎ ক্ষেত্রবাবুর দাদাকে কোথায় ডাকিয়া লইয়া গেলেন। অল্প পরেই সেই মেয়েটি একটা চায়ের পিরিচে চারটি পান আনিয়া তক্তপোশের এক কোণে রাখিল। ক্ষেত্রবাবু একটা বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিলেন, ও, এটা আপনাদের বাসা? আমি প্রথমটা বুঝতে পারি নি—

মেয়েটি চুপ করিয়া রহিল। চলিয়া গেল না।

ক্ষেত্রবাবু আর কথা খুঁজিয়া পান না। মেয়েটি যখন সামনেই দাঁড়াইয়া, তখন বেশিক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলে বড় খারাপ দেখায়। চট করিয়া মাথায় কিছু আসেও না ছাই! তখন যে কথাটা আজ দুই দিন হইতে মনে হইতেছে প্রায় সব সময়েই, সেটাই বলিলেন, রেলের বাসাগুলো বড় ছোট, না?

—হ্যাঁ।

—এতে আপনাদের অসুবিধে হয় না?

—আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এই তো রেলে-রেলেই বেড়াচ্ছি কতদিন থেকে—ও সয়ে গিয়েছে। জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত এই রকমই দেখছি।

—এর আগে কোথায় ছিলেন আপনারা?

—আসানসোলে। তার আগে পাকুড়। তার আগে ছিলাম সক্রিগলি জংশন। তখন আমার বয়স সাত বছর, কিন্তু সব মনে আছে আমার—

মেয়েটি বেশ সহজ সুরেই কথা বলিতে লাগিল, যেন ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়।

—আচ্ছা আপনাদের দেশ কোথায়?

—হুগলী জেলায় আরামবাগ সাব-ডিভিশনে। কিন্তু সে বাড়িতে আমরা যাই নি কোনোদিন। রেলের চাকরিতে ছুটি পান না বাবা। আমার ভাইয়ের পৈতের সময় বাবা বলেছেন যাবেন।

মেয়েটি তাঁহাকে কোনো প্রশ্ন করে না, নিজে হইতেও কোনো কথা বলে না; কিন্তু তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিবার জন্য যেন উন্মুখী হইয়া থাকে। এ এমন এক অবস্থা, ক্ষেত্রবাবুর পক্ষে যাহা সম্পূর্ণ নতুন। নিভাননীর সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল, তখন তাঁহার বয়স উনিশ, নিভাননীর দশ। তখন নারীর মনের আগ্রহ বুঝিবার বয়স হয় নাই তাঁহার।

এতকাল পরে—এসব নূতন ব্যাপার জীবনের।

—আচ্ছা, আপনারা অনেক দেশ ঘুরেছেন, পাহাড় দেখেছেন?

—তিনপাহাড়ি বলে একটা স্টেশন আছে লুপ লাইনে। সেখানে বাবা কিছুদিন রিলিভিং-এ ছিলেন, সেখানে পাহাড় দেখেছি।

—আপনি তো দেখেছেন, আমি এখনও দেখি নি!

মেয়েটি বিস্ময়ের সুরে বলিল, আপনি পাহাড় দেখেন নি?

ক্ষেত্রবাবু হাসিয়া বলিলেন, নাঃ, কোথায় দেখব? বরাবর কলকাতাতেই আছি। স্কুলের ছুটি থাকলেও টুইশানির ছুটি নেই। যাতায়াত বড় একটা হয় না। আপনাদের বড় মজা, পাসে যাতায়াত করতে পারেন।

মেয়েটি বিস্ময়ের সুরে বলিল, ওঃ ওঃ! খু-উ-ব!

—গিয়েছেন কোথাও?

—দুমকায় আমার এক পিসেমশায় চাকরি করেন, দুমকা রাজস্টেটে। সেখানে মা’র সঙ্গে গিয়ে মাসখানেক ছিলাম একবার। আর একবার পুরী যাওয়ার সব ঠিকঠাক, আমার ছোট ভাইয়ের অসুখ হল বলে বাবা পাস ফেরত দিলেন। সামনের বছর যাবেন বলেছেন। ও, আপনাকে আর দুটো পান দি—

—না না, আমি বেশি পান খাই নে। বরং খাবার জল এক গ্লাস যদি—

—আনি—বলিয়াই মেয়েটি বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল এবং দুর্ভাগ্যের বিষয় (অখণ্ড সুখ জীবনে পাওয়া যায় না), তখনই বাহির হইতে শশীবাবুর সহিত ক্ষেত্রবাবুর দাদা গোবর্ধনবাবু ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, ক্ষেত্র, তা হলে চল যাই!

একটু পরে জলের গ্লাস হাতে মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া নিঃশব্দে গ্লাসটি তক্তপোশের কোণে রাখিয়া কিঞ্চিৎ দ্রুতপদেই চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু ও তাঁহার দাদাও বিদায় লইয়া আসিলেন।

সেই দিনই রাত্রে ক্ষেত্রবাবু বউদিদির কাছে প্রকারান্তরে বিবাহের মত প্রকাশ করিলেন। পরবর্তী তিন-চারি দিনের মধ্যে সব ঠিকঠাক হইয়া গেল, সামনের অগ্রহায়ণ মাসের দোসরা ভালো দিন আছে। বরপণ একশো এক টাকা নগদ ও দশ ভরি সোনার গহনা। ঠিকুজী কোষ্ঠী মিলিলে কথাবার্তা পাকা হইবে।

ক্ষেত্রবাবু দাদাকে বলিলেন, দাদা, তা হলে কাল যাব।

—এখনই কেন? আর দু-চার দিন থাক না?

—না দাদা, খোকাখুকি রয়েছে পড়ে সেখানে। যাই একবার।

যাইবার পূর্বদিন পুনরায় শশীবাবুর বাড়ি তাঁহার নিমন্ত্রণ হইল। এদিন কিন্তু ক্ষেত্রবাবুর উৎসুক দৃষ্টি চারিদিক খুঁজিয়াও মেয়েটির টিকি দেখিতে পাইল না।

বার্ষিক পরীক্ষা চলিতেছে। হেডমাস্টারের তাড়নায় মাস্টারেরা অতিষ্ঠ। বড় হলে যদুবাবু ও শরৎবাবু পাহারা দিতেছেন, হঠাৎ মিঃ আলম তদারক করিতে আসিয়া ধরিয়া ফেলিলেন, দুইজন ছাত্র টোকাটুকি করিতেছে।

মিঃ আলম বলিলেন, আপনারা কী দেখছেন যদুবাবু! কত ছেলে টুকছে—

যদুবাবু দেখিতেছিলেন না সত্যই—এ স্কুলে উনিশ বৎসর হইয়া গেল তাঁহার। সাহেব আসিবার অনেক আগে হইতে এখানে ঢুকিয়াছেন। নতুন মাস্টার যাহারা, খুব উৎসাহের সঙ্গে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে, তাঁহার সে বয়স পার হইয়া গিয়াছে। তিনি চেয়ারে বসিয়া ঢুলিতেছিলেন।

সাহেবের টেবিলের সামনে দাঁড়াইতে হইল দুইজনকেই। সাহেব ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া দুইজনের দিকে চাহিলেন।

—কী যদুবাবু, আপনার হলে এই দুজন ছাত্র টুকছিল—আপনি দেখেন না, আপনাদের কৈফিয়ত কী?

—দেখছিলাম স্যার।

—দেখলে এরকম হল কেন?

—ছেলেরা বড় দুষ্টু স্যার,—কী ভাবে যে টোকে—

—চেয়ারে বসে পাহারা দেওয়ায় কাজ হয় না। বিশেষ করে যদুবাবু, আপনার আর মনোযোগ নেই স্কুলের কাজে, অনেক দিন থেকে লক্ষ করছি। এ স্কুলে আপনার আর পোষাবে না।

যদুবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।

—আর শরৎবাবু, আপনি নতুন এসেছেন, আজ দু’ বছর। কিন্তু এখনি এমনি গাফিলতি কাজের, এর পরে কী করবেন? আপনাদের দ্বারা স্কুলের কাজ আর চলবে না। এখন যান আপনারা, ছুটির পরে একবার আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

যদুবাবু রাগ করিয়া হলে ঢুকিয়া প্রত্যেক ছাত্রের পকেট খানাতল্লাশ করিলেন, ফলে প্রকাশ পাইল (১) থার্ড ক্লাসের এক ছেলের পকেট হইতে একখানা ইতিহাসের বইয়ের পাতা, (২) ক্লাসের আর একটি ছেলের কোঁচায় লুকানো একখানি আস্ত ইতিহাসের বই, (৩) নারাণবাবুর ছাত্র চুনির খাতার মধ্যে চার-পাঁচখানা কাগজে নানারূপ নোট লেখা, (৪) সেভেনথ ক্লাসের একটি ছেলের ডেস্ক হইতে দুইখানি বই—একখানি ইংরেজি ইতিহাসের বই (এবেলা আছে ইতিহাসের পরীক্ষা), আর একখানি হইল ভূগোল, যাহার পরীক্ষা ওবেলা আছে। বোঝা গেল, ইতিহাসের বই হইতে কিছু আগেও সে টুকিতেছিল।

সব কয়জনকে হেডমাস্টারের কাছে হাজির করা হইল। সাহেবের হুকুমে তাহাদের এবেলা পরীক্ষা দেওয়া রহিত হইয়া গেল। বাড়িতে তাহাদের অভিভাবকদের কাছে পত্র গেল। নারাণবাবুর ছাত্র চুনি বাড়ি যাইতেছিল, নারাণবাবু ডাকিয়া পাঠাইলেন।—হ্যাঁ চুনি, তুমি নোট লিখে এনেছিলে?

চুনি চুপ করিয়া রহিল।

—কেন এনেছিলে? কার কাছ থেকে লিখে এনেছিলে? ও লিখে আনা কি তোমার উচিত হয়েছে?

—না স্যার।

—তবে আনলে কেন?

—আর কখনও আনব না।

—তা তো আনবে না বুঝলাম। এদিকে একটা পেপার পরীক্ষা দিতে পারলে না। পাসনম্বর থাকবে কী করে, তাই ভাবছি।…চুনি, খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি? আয় আমার ঘরে।

নিজের ছোট ঘরটাতে লইয়া গিয়া নারাণবাবু তাহার পিঠে হাত দিয়া কত ভালো ভালো কথা বুঝাইলেন—মিথ্যা দ্বারা কখনও মহৎ কাজ হয় না, ইত্যাদি। গীতার শ্লোক পড়িয়া শোনাইলেন। ছোলা-ভিজা ও চিনি এবং আধখানা পাঁউরুটি খাওয়াইলেন। চুনি যাইবার সময় বলিল, স্যার, একটা কথা বলব? বাড়ি গিয়ে কোনো কথা বলবেন না যেন—

—না, আমার যেচে বলবার দরকার কী! কিন্তু হেডমাস্টারের চিঠি যাবে তোমার বাবার নামে!

চুনির মুখ শুকাইল। বলিল, কেন স্যার?

—তাই সাহেবের নিয়ম।

—আপনি হেডস্যারকে বুঝিয়ে বলুন না। আপনি বললেই—

—যা, বাড়ি যা এখন। দেখি আমি।

চুনি চলিয়া গেলে নারাণবাবু ভাবিতে লাগিলেন, চুনির এ অসাধু প্রকৃতিকে কী করিয়া ভিন্ন পথে ঘুরাইবেন! আজ যেভাবে বলিলেন, ও ঠিক পথ নয়। গীতার শ্লোক বলা উচিত হয় নাই—অতটুকু ছেলে গীতার কথা কী বুঝিবে? তাঁহার নোটবুকে টুকিয়া রাখিলেন—চুনি—মিথ্যা ব্যবহার, হাউ টু কারেক্ট, অনুকূলবাবু হইলে কী করিতেন? নারাণবাবু গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন হইলেন।

চায়ের দোকানে বসিয়া সেদিন যদুবাবু আস্ফালন করিতেছিলেন : এক পয়সার মুরোদ নেই স্কুলের—আবার লম্বা লম্বা কথা! ডিউটি, ট্রুথ। আরে মশাই, পুজোর ছুটির মাইনে দু টাকা এক টাকা করে সেদিন শোধ হল। গরিব মাস্টারেরা কী খায় বল তো?

ক্ষেত্রবাবু হাসিয়া বলিলেন, না পোষায়, চলে যেতে পারেন দাদা। সাহেবের গেট ইজ ওপন—

রামেন্দুবাবু আর নতুন টিচার নন—দু-তিন বছর হইয়া গেল এ স্কুলে, তিনি সব দিন এ মজলিশে থাকেন না, আজ ছিলেন। বলিলেন, জানুয়ারি মাস থেকে মাইনে কাটা হবে, জানেন না বোধ হয়?

সকলেই চমকিয়া উঠিলেন। যদুবাবু ও জগদীশ জ্যোতির্বিনোদ একসঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, কে বললে? অ্যাঁ, আবার মাইনে কাটা!

—জানুয়ারি মাসে ছাত্র ভর্তি না হলে মাইনে কাটা হবেই।

—এই সামান্য মাইনে, এও কাটা হবে! আপনি একটু বলুন হেডমাস্টারকে—

—বলেছিলাম। কিন্তু বাজেট যা, তাতে মাইনে না কাটলে মাস্টারদের মধ্যে দু-একজনকে জবাব দিতে হবে কাজ থেকে। তার চেয়ে সকলকে রেখে মাইনে কাটা ভালো।

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, সে যাকগে, যা হয় হবে। এখন সাহেবের কাছে একটা দরখাস্ত দেওয়া যাক আসুন, যাতে মাসের মাইনেটা ঠিক সময় পাই। আড়াই মাস খেটে এক মাসের মাইনে নিয়ে এভাবে তো আর পারা যাচ্ছে না!

রামেন্দুবাবু বলিলেন, ও করতে যাবেন না। তাতে ফল হবে না। আমি কি ও নিয়ে বলি নি ভাবচেন?

যদুবাবু বলিলেন, না, আপনি যা বলেন, তার ওপর আমাদের কথা কওয়ার দরকার কী। যা ভালো হয় করবেন।

চায়ের দোকান হইতে বাহির হইয়া কে একজন বলিলেন, আজ যে নারাণদাকে দেখছি নে?

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, যখন আসি, ঘরে উঁকি মেরে দেখি, তিনি লিখছেন বসে বসে একমনে। আমি আর ডাকলাম না।

রামেন্দুবাবু বলিলেন, ওই একজন বড় খাঁটি সিনসিয়ার লোক, সেকালের গুরুর মত। ও টাইপ আজকাল বড় একটা দেখা যায় না এ ব্যবসাদারির যুগে। আচ্ছা, আমি এখন চলি—বসুন।

বসিবার সময় নাই কাহারও। সকলকেই এখনই টুইশানিতে যাইতে হইবে।

ক্ষেত্রবাবু চায়ের দোকান হইতে পাশেই শ্রীনাথ পালিতের লেনে বাসায় গেলেন। পনেরো টাকা ভাড়ায় দুইখানি ঘর একতলায়, ছোট্ট রান্নাঘর। এক দিকে সিঁড়ির নিচে কয়লা রাখিবার জায়গা। অন্ধকার কলঘরে একজন লোক দিনমানে ঢুকিলেও বাহির হইতে হঠাৎ দেখিবার জো নাই। তারের আলনায় কাপড় শুকাইতেছে। বাড়িওয়ালি শুচিবেয়ে বুড়ি গামছা পরিয়া ঝাঁটা হাতে উঠানে জল দিয়া ঝাঁট দিতেছে ও ধুইতেছে।

অনিলা বাহিরে আসিয়া হাসিমুখে বলিল, দেরি হল যে?

—কোথায় দেরি? কানু কই?

—সে বল খেলা দেখতে গিয়েছে, ইন্টার-স্কুল ম্যাচ আছে কোথায়। চা খাবে?

—না, এই খেয়ে এলাম দোকান থেকে।

অনিলা হাত-পা ধুইবার জল আনিয়া একটা ছোট টুল পাতিয়া দিল, একখানা গামছা টুলের উপর রাখিল। তারপর একটা বাটিতে মুড়ি মাখিয়া এক পাশে একটু গুড় দিয়া স্বামীকে খাইতে দিল। ক্ষেত্রবাবু হাত মুখ ধুইয়া জলযোগ সমাপনান্তে টুইশানিতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন।

অনিলা বলিল, একটু জিরোবে না?

—না, দেরি হয়ে যাবে।

—অমনি বাজার থেকে ছোট খুকির জন্যে একটা বার্লি কিনে এনো, আর জিরে মরিচ।

—আর কী কী নেই দেখ।

—আর সব আছে, আনতে হবে না।

বড় খুকি এই সময়ে বলিল, বাবা, আমার জন্যে একটা পেন্সিল কিনে এনো—আমার পেন্সিল নেই।

অনিলা বলিল, পেন্সিল আমার কাছে আছে, দেব এখন। মনে করে দিস কাল সকালে।

ক্ষেত্রবাবু মাসখানেক হইল নতুন বাসায় উঠিয়া আসিয়া নতুন সংসার পাতিয়াছেন। মন্দ লাগিতেছে না। নিভাননীর মৃত্যুর পরে দিনকতক বড় কষ্ট গিয়াছিল, এখন আবার একটু সেবাযত্নের মুখ দেখিতেছেন। চিরকাল স্ত্রী লইয়া সংসার-ধর্ম করায় অভ্যস্ত, স্ত্রী-বিয়োগের পর সব যেন ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকিত। অসুবিধাও ছিল বিস্তর, আট বছরের খুকিকে গৃহিণী সাজিতে হইয়াছিল, কিন্তু খুকি যতই প্রাণপণে চেষ্টা করুক, অনভিজ্ঞা শিশু মেয়ে কি তাহার মায়ের স্থান পূর্ণ করিতে পারে?

আবার সংসারে আয়না-চিরুনির দরকার হইতেছে, সিঁদুরের ব্যবস্থা করিতে হইতেছে, স্নো-পাউডার কিনিবার প্রয়োজন তো আসিয়া পড়িল। চিরকাল যে গরুর কাঁধে জোয়াল, ছাড়া পাইলে অনভ্যস্ত মুক্তির অভিজ্ঞতা তাহাকে ব্যাকুল করিয়া তোলে। মনে হয়, সংসার হইল না, কাহার জন্য খাটিয়া মরিব, কে আমার অসুখ হইলে মুখে একটু জল দিবে—ইত্যাদি। যে বলিষ্ঠ ও শক্তিমান মন মুক্তির পরিপূর্ণতাকে ভোগ করিতে পারে, নির্জনতার ও উদাস মনোভাবের মধ্য দিয়া জীবনে নব নব দর্শন ও অনুভূতিরাজির সম্মুখীন হয়—নিরীহ স্কুলমাস্টার ক্ষেত্রবাবুর মন সে ধরনের নয়। কিন্তু না হইলে কী হয়? যে ভাবে যে, জীবনকে ভোগ করিতে পারে, সেই ভাবেই জীবন তাঁহার নিকট ধরা দেয়—ইহাতেই তাহার সার্থকতা। বাঁধা-ধরা নিয়ম কী-ই বা আছে জীবনকে ভোগ করিবার?

ক্ষেত্রবাবু ছাত্রদের একতলা কুঠুরির অন্ধকূপে গিয়া ভীষণ গরমের মধ্যে পাখার তলায় অবসন্নদেহ একখানা ইংরেজি ডিকশনারির উপর এলাইয়া দিয়া পড়ানো শুরু করিলেন। আগে বেশ সময় কাটিত এখানে। এখন মনে হয়, অনিলার সঙ্গে গিয়া কতক্ষণে দুইদণ্ড কথা বলিবেন! ছাত্রও ছাড়ে না, এটা বুঝাইয়া দিন, ওটা বুঝাইয়া দিন, করিতে করিতে রাত সাড়ে নয়টা বাজাইয়া দিল। তারপর আসিল ছাত্রের কাকা। সে এফ-এ ফেল, কিন্তু তাহার বিশ্বাস ইংরেজিতে তাহার মত পণ্ডিত আর নাই, ভুল ইংরেজিতে সে ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে আলোচনা করিতে লাগিল, কী ভাবে ছেলেদের ইংরেজি শিখাইতে হয়। আজকালকার প্রাইভেট মাস্টারেরা ফাঁকিবাজ, পড়াইতে জানে না, কেবল মাহিনা বাড়াও—এই শব্দ মুখে। তারপর সে আবার দেখিতে চাহিল, আজ ক্ষেত্রবাবু ছেলেদের কী পড়াইয়াছেন, কালকার পড়া বলিয়া দিয়াছেন কিনা, টাস্ক দিয়াছেন কিনা।

লোকটার হাত এড়াইয়া রাত দশটার সময় ক্ষেত্রবাবু বাসার দিকে আসিতেছেন, এমন সময়ে রাখাল মিত্তিরের সঙ্গে দেখা। ক্ষেত্রবাবু পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিয়াও পারিলেন না, রাখাল মিত্তির ডাকিয়া বলিল, এই যে! ক্ষেত্রবাবু যে! শুনুন, শুনুন—

—রাখালবাবু যে! ভালো আছেন?

—কই আর ভালো, খেতেই পাই নে, তার ভালো! আপনারা তো কিছু করবেন না! বলিতে বলিতে রাখালবাবু ক্ষেত্রবাবুর দিকের ফুটপাথে আসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, আসুন না, কাছেই আমার বাসা। একটু চা খেয়ে যান। সেদিন আপনাদের স্কুলে গিয়েছিলাম আমার বই দু’খানা নিয়ে। সাহেব তো কিছু বোঝে না বাংলা বইয়ের, আপনারা একটু না বললে আমার বই ধরানো হবে না।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, এ রাত্তিরে আর যাব না রাখালবাবু, এখন চা খায় কেউ? আমি যাই—

—তবে আসুন, এই মোড়েই চায়ের দোকান, খাওয়া যাক একটু!

অগত্যা ক্ষেত্রবাবুকে যাইতে হইল। রাখালবাবু নাছোড়বান্দা লোক, অনেক দিনের অভিজ্ঞতায় ক্ষেত্রবাবু জানেন, ইহার হাতে পড়িলে নিস্তার নাই। চা খাইতে খাইতে রাখালবাবু বলিলেন, এবার মশাই ধরিয়ে দিতে হবে আমার বই দুখানা। আপনাদের মিঃ আলম ভারি বদ লোক, আমায় বলে কিনা—ওসব চলবে না, আজকাল অনেক ভালো বই বেরিয়েচে। আমি বলি, তোমার বাবা আমার বই পড়ে মানুষ হয়েচে, তুমি আজ এসেচ রাখাল মিত্তিরের বইয়ের খুঁত ধরতে!

রাখাল মিত্তিরকে ক্ষেত্রবাবু বহুদিন জানেন। বয়স পঁয়ষট্টি, জীর্ণ অতিমলিন লংক্লথের পিরান গায়ে, তাতে ঘাড়ের কাছে ছেঁড়া, পায়ে সতের-তালি জুতা। রাখালবাবু কলিকাতার স্কুলসমূহে অতি পরিচিত, পনেরো বছর হইল স্কুল-মাস্টারি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া কয়েকখানি স্কুলপাঠ্য বই স্কুলে স্কুলে শিক্ষকদের ধরিয়া চালাইয়া দেন। তাতেই কায়ক্লেশে সংসার চলে।

ক্ষেত্রবাবুর দুঃখ হয় রাখালবাবুকে দেখিয়া। এই বয়সে লোকটা রৌদ্র নাই, বৃষ্টি নাই, টো-টো করিয়া স্কুলে স্কুলে সিঁড়ি ভাঙিয়া উঠানামা করিয়া বই চালানোর তদ্বির করিয়া বেড়ায়। কিন্তু বিশেষ কিছু হয় না। লোকটার পরন-পরিচ্ছদেই তাহা প্রকাশ।

বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দিবার জন্য ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, না না, আপনার বই খারাপ কে বলে! চমৎকার বই!

রাখাল মিত্তির খুশি হইয়া বলিলেন, তাই বলুন দিকি! সকলে কি বোঝে? আপনি একজন সমজদার লোক, আপনি বোঝেন। আরে, এ কালে ব্যাকরণ জানে কে? আমি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষাতে ব্যাকরণে ফার্স্ট হই, আবার মেডেল আছে, দেখাব।

—বলেন কী!

—সত্যি। আপনি আমার বাসায় কবে আসচেন বলুন, দেখাব।

—না, দেখাতে হবে কেন! আপনি কি আর মিথ্যে বলছেন!

—সেদিন অমনি এক স্কুলের হেডমাস্টার বললে—মশাই, আপনার বই পুরনো মেথডে লেখা, ও এখন আর চলে না। এখন কত নতুন অথর বেরিয়েচে, তাদের বইয়ের ছাপা, ছবি, কাগজ অনেক ভালো। আপনার বই আজকাল ছেলেরাই পছন্দ করে না। শুনলেন? আরে, রাখাল মিত্তিরের বই পড়ে কত অথর সৃষ্টি হয়েচে! অথর! আমাকে এসেছেন মেথড শেখাতে! পয়সা হাতে পাই তো ভালো ছাপা ছবি আমিও করতে পারি। কিন্তু কী করব, খেতেই পাই নে, চলেই না। বুড়ো বয়সে লোকের দোরে দোরে ঘুরে বই ক’খানা ধরাই, তাতেই কোনো রকমে—ছেলেটা আজ যদি মরে না যেত, তবে এত ইয়ে হত না। ধরুন পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলে, আজ বাঁচলে চৌত্রিশ বছর বয়স হত। আমার ভাবনা কী!

—আচ্ছা, আমি দেখব চেষ্টা করে। এখন উঠি রাখালবাবু, রাত অনেক হল।

—এই শুনুন, নব ব্যাকরণ-সুধা প্রথম ভাগ—ফোর্থ ক্লাসের জন্যে। নব ব্যাকরণ-সুধা দ্বিতীয় ভাগ থার্ড ক্লাসের উপযুক্ত, আর এবার নতুন একখানা বাংলা রচনা লিখেছি, রচনাদর্শ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। খুব ভালো বই, পড়ে দেখবেন। সব রকমের রচনা আছে তাতে। কী ভাষা! ব্যাটারা সব বই লিখেছে, রচনা হয় কারও? কোনো ব্যাটা বাংলা সেন্টেন্স শুদ্ধ করে লিখতে জানে? নিয়ে আসুন বই, আমি পাতায় পাতায় ভুল বার করে দেব—একবার ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় ‘কৃৎ’ প্রত্যয়ের—চললেন যে, ও ক্ষেত্রবাবু, আচ্ছা! তাহলে শনিবারে বই নিয়ে যাব, শুনুন—মনে থাকবে তো? দেবেন একটু বলে হেডমাস্টারকে। আর শুনুন, বাংলা রচনাও একখানা নিয়ে যাব—যাতে হয়, একটু দেবেন বলে—নমস্কার—

ক্ষেত্রবাবু শেষের কথাগুলি ভালো শুনিতে পাইলেন না, তখন তিনি একটু দূরে গিয়া পড়িয়াছেন।

বাসায় অনিলা তাঁহার ভাত ঢাকা দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। ক্ষেত্রবাবু ভাবেন, ছেলেমানুষ—এত রাত পর্যন্ত জাগিয়া থাকার অভ্যাস নাই, সারাদিন খাটিয়া বেড়ায়। স্ত্রীকে ডাক দেন। অনিলা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসে, স্বামীকে দেখিয়া অপ্রতিভ হয়। বলে, এত রাত আজ?

—ঘুমচ্ছিলে বুঝি?

অনিলা হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ, খোকাখুকিদের খাইয়ে দিলাম, তারপর একখানা বই পড়তে পড়তে কখন ঘুম এসে গিয়েছে—

ক্ষেত্রবাবু আহারাদি করিলেন। অনিলা বলিল, হ্যাঁ গা, রাগ কর নি তো ঘুমুচ্ছিলাম বলে?

—বাঃ, বেশ! রাগ করব কেন?

—আমার বার্লি আর জিরে-মরিচ এনেছ?

—ওই যাঃ! একদম ভুলে গিয়েচি। ভুলব না? যদিবা ছাত্রের কাকার হাত এড়িয়ে বেরুলাম তো পড়ে গেলাম রাখাল মিত্তিরের হাতে। সব স্কুলের সব মাস্টার ওকে এড়িয়ে চলে। একবার পাকড়ালে আর নিস্তার নেই!

—সে কে?

—অথর।

—কী কী বই আছে? কই, নাম শুনি নি তো?

—শুনবে কি—বঙ্কিমবাবু, না রবি ঠাকুর, না শরৎ চাটুজ্জে? স্কুলের—স্কুলের বই লেখে, নব কবিতাপাঠ, বাল্যবোধ—এই সব। বড্ড গরিব, হাতেপায়ে ধরে বই চালায়। ছিনেজোঁক।

—একদিন এনো না বাসায়, দেখব। আমি অথর কখনও দেখি নি—একদিন চা খাওয়াব।

—রক্ষে কর। তুমি চেন না রাখাল মিত্তিরকে। বাসায় আনলে আর দেখতে হবে না। সে কথাই তুলো না।

—বড়লোক?

—খেতে পায় না। বই চলে না। সেকেলে ধরনের বই, একালে অচল। এই যে বললাম, নাছোড়বান্দা হয়ে ধরে-পেড়ে চালায়।

অনিলার লেখাপড়ার উপর খুব অনুরাগ দেখিয়া ক্ষেত্রবাবুর আনন্দ হয়। নিভাননী লেখাপড়া জানিত সামান্যই; অনিলা মন্দ লেখাপড়া জানে না, ইংরেজিও জানে। বই পড়িতে ভালোবাসে বলিয়া শাঁখারিটোলার লাইব্রেরী হইতে ক্ষেত্রবাবু গত মাস হইতে বই আনিয়া দেন, দুইখানা বই একদিনেই কাবার। সম্প্রতি স্কুলের লাইব্রেরী হইতে ছোট ছোট ইংরেজি বই আনেন—অনিলার সেগুলি পড়িতে একটু সময় লাগে।

অনিলা সব সময় সব কথার মানে বুঝিতে পারে না। বলে, হ্যাঁ গা, হপ মানে কী? বইয়েতে আছে এক জায়গায়—

—লাফিয়ে লাফিয়ে চলা।

—উঁহু, লাফানো নয়, কোনো গাছপালা হবে। লাফানো হলে সে জায়গায় মানে হয় না।

—ওহো, ও একরকমের লতা, চাষ হয় ইংলন্ডে, বিশেষ করে স্কটল্যান্ডে। মদ চোলাই হয় ওই লতা থেকে, হুইস্কি বিশেষ করে—

ছোট খুকি ঘুমের ঘোরে ভয় পাইয়া কাঁদিয়া উঠিতে অনিলা ছুটিয়া গেল।

বেলা চারিটা বাজে। হেডমাস্টারের সারকুলার বাহির হইল, ছুটির পরে জরুরি মীটিং, কোনো মাস্টার যেন চলিয়া না যায়। মাস্টারদের মুখ শুকাইল। দুইদিন আগে সাহেব ক্লাসে ঘুরিয়া পড়ানোর তদারক করিয়া গিয়াছেন, আজ সেই সব ব্যাপারের আলোচনা হইবে, কাহার না জানি কী খুঁত বাহির হইয়া পড়িল!

যদুবাবু ফাঁকিবাজ মাস্টার, তাঁহার খুঁত বাহির হইবেই তিনি জানেন। অনেক দিন অনেক তিরস্কার খাইয়াছেন, বড় একটা গ্রাহ্য করেন না।

মীটিংয়ে হেডমাস্টার বলিলেন, সেদিন আপনাদের ক্লাসের পড়ানো দেখে খুব আনন্দিত হওয়ার আশা করেছিলাম; দুঃখের বিষয়, সে আনন্দলাভ ঘটে নি। টিচারদের কর্তব্য সম্বন্ধে আপনাদের অনেকবার বলেছি, কিন্তু তবুও এমন কতকগুলি টিচার আছেন, যাঁদের বার বার সে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, এটা দুঃখের কথা। রামবাবু?

একটি ছিপছিপে ছোকরা গোছের মাস্টার দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, স্যার?

—আপনি ফিফথ ক্লাসে জিওগ্রাফি পড়াচ্ছিলেন, কিন্তু ম্যাপ নিয়ে যান নি কেন?

রামবাবু নিরুত্তর।

—কতবার না বলেছি, ম্যাপ না দেখালে জিওগ্রাফি পড়ানো—

এইবার রামবাবু সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিলেন, স্যার, দেশের কথা পড়ানো হচ্ছিল না, বাংলা দেশের উৎপন্ন দ্রব্য পড়াচ্ছিলাম, তাই—

—ও! উৎপন্ন দ্রব্য পড়ালে ম্যাপ নিয়ে যেতে হবে না? কেন, বাংলা দেশের ম্যাপ নেই?—আর ক্ষেত্রবাবু?

ক্ষেত্রবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

—আপনি রচনা শেখাচ্ছিলেন থার্ড ক্লাসে। কিন্তু শুধু সামনের বেঞ্চিতে যারা বসে আছে, তাদের দিকে চেয়ে কথা বলছিলেন, পেছনের বেঞ্চিতে ছাত্ররা তখন গল্প করছিল। ক্লাসসুদ্ধ ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলে আপনার পড়ানো বৃথা হয়ে গেল, বুঝতে পারলেন না? তাছাড়া ব্ল্যাকবোর্ড আদৌ ব্যবহার করেন নি সে ঘণ্টায়। পাণ্ডিট?

পণ্ডিত বলিতে কোন পণ্ডিত, বুঝিতে না পারিয়া দুই পণ্ডিতই উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

সাহেব জ্যোতির্বিনোদের দিকে আঙুল দিয়া বলিলেন, আপনি বাংলা পড়াচ্ছিলেন ফোর্থ ক্লাসে। আপনি কি ভাবেন, খুব চেঁচিয়ে পড়ালেই ভালো পড়ানো হল! আপনি নিজের প্রশ্নের নিজেই উত্তর দিচ্ছিলেন, নামতা পড়ানোর সুরে চিৎকার করে পড়াচ্ছিলেন, ফলে ইউ ফেলড টু ক্যারি দি ক্লাস উইথ ইউ!

পরে হেডপণ্ডিতের দিকে বক্রদৃষ্টিতে চাহিয়া রহস্যের সুরে বলিলেন, তা বলে ভাববেন না, আপনার পড়ানো নিখুঁত! আপনি এক জায়গায় বসে পড়ান, সামনের বেঞ্চিতে দৃষ্টি রাখেন এবং মাঝে মাঝে অবান্তর গল্প করেন। যদুবাবু?

যদুবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

—আপনার কোনো দোষই গেল না। আমার মনে হয়, আপনার কাজে মন নেই। আপনার দোষের লিস্ট এত লম্বা হয়ে পড়ে যে, তা বলা কঠিন। আপনি কোনোদিন ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করেন না, ক্লাসে ছেলেদের প্রশ্ন করেন না, টাস্ক দেন না—সেদিন বায়ুপ্রবাহের গতিবোঝাচ্ছিলেন, গ্লোব নিয়ে যান নি ক্লাসে! গ্লোব না নিয়ে গেলে—

এমন সময়ে একটি ছাত্রকে মীটিংয়ের ঘরের মধ্যে উঁকি মারিতে দেখিয়া হেডমাস্টার ধমক দিয়া বলিলেন, কী চাই? এখানে কেন?

ছাত্রটি মুখ কাঁচুমাচু করিয়া বলিল, স্যার, ফোর্থ ক্লাসের ধীরেনের চোখে বল লেগে চোখ বেরিয়ে এসেছে—

সকলেই লাফাইয়া উঠিলেন।

হেডমাস্টার বলিলেন, চোখ বেরিয়ে এসেছে, কোথায় সে?

সকলে নীচের তলায় ছুটিলেন। স্কুলের বারান্দায় একটা তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলেকে শোয়াইয়া আরও অনেক ছেলে ঘিরিয়া মাথায় জল দিতেছে, বাতাস করিতেছে। হেডমাস্টারকে দেখিয়া ভিড় ফাঁকা হইয়া গেল। সত্যই চোখ বাহির হইয়া আধ ইঞ্চি পরিমাণ ঝুলিয়া পড়িয়াছে। বীভৎস দৃশ্য!

তখনই মেমসাহেব খবর পাইয়া আসিয়া ছেলেটিকে কোলে লইয়া বসিল। সাহেব দারোয়ানকে ছেলের বাড়িতে পাঠাইয়া দিলেন। বড়লোকের ছেলে, বাড়িতে মোটর আছে। মোটর আসিতে দেরি দেখিয়া সে স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে বল খেলিতেছিল, তাহার ফলেই এ দুর্ঘটনা।

দেখিতে দেখিতে ছেলের বাড়ির লোক মোটর লইয়া ছুটিয়া আসিল। তাহার পূর্বেই স্কুলের পাশের ডাঃ বসু হেডমাস্টারের আহ্বানে আসিয়া ছেলেটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা করিতেছিলেন। ছেলের বাবা হেডমাস্টার ও ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া ছেলেকে মোটরে মেডিক্যাল কলেজে লইয়া গেল। হেডমাস্টার সঙ্গে দুইজন মাস্টার দিলেন, শরৎবাবু ও গেম-মাস্টার বিনোদবাবুকে যাইতে হইল।

পরের কয়দিন হেডমাস্টার নিজে এবং আরও তিন-চারজন মাস্টার হাসপাতালে গিয়া ছেলেটিকে দেখিতে লাগিলেন। যে চোখে চোট লাগিয়াছিল, সে চোখটা অস্ত্র করিয়া বাহির করিয়া ফেলিতে হইল, তবুও কিছু হইল না। ছেলেটির অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যায়। মেমসাহেব প্রায়ই গিয়া বসিয়া থাকে, সাহেবও এক-আধ দিন অন্তর যান, নারাণবাবু টুইশানি ফেরতা প্রায় রোজই যান।

একদিন বিকালে হেডমাস্টারকে দেখিয়া ছেলেটি কাঁদিয়া ফেলিল। তখনও তাহার বাড়ি হইতে লোকজন আসে নাই। সাহেব গিয়া বসিয়া বলিলেন, ডোণ্ট ইউ ক্রাই মাই চাইল্ড—দেয়ার ইজ এ লিটল ডিয়ার—বি এ হিরো—এ লিটল হিরো।

মুশকিল এই যে, সাহেব বাংলা বলিতে পারেন না ভালো, ছোট ছেলে তাঁহার ইংরেজি বুঝিতে পারে না। মুখে কথা বলিতে বলিতে হেডমাস্টার বিপন্ন মুখে ছেলেটির মাথায় ও পিঠে সান্ত্বনাসূচক ভাবে হাত বুলাইতে লাগিলেন : কান্না করে না, কান্না লজ্জার কঠা আছে—ইট ইজ এ শেম ফর এ বয় টু ক্রাই, বুঝেছ? ভালো বালক আছে, সারিয়া যাইবে। কিচ্ছু হইবে না—

এমন সময় ছেলের মা ও বাড়ির মেয়েদের আসিতে দেখিয়া সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে বলিলেন, টোমার মার সামনে কান্না করে না। দেয়ার ইজ এ গুড বয়—আমার স্কুলের বালক কাঁদিবে না—আই নো ইউ উইল কিপ আপ দি প্রেস্টিজ অফ ইওর স্কুল—আই ব্লেস ইউ মাই চাইল্ড—

ছেলেটি খানিকটা বুঝিল, খানিকটা বুঝিল না; সে কান্না বন্ধ করিল, আর কখনও কাহারও সামনে কাঁদে নাই। এমন কি, মৃত্যুর দুই দিন পূর্বে তাহার সংজ্ঞা লোপ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভয় কি দুর্বলতাসূচক একটি কথাও তাহার মুখে কেহ শোনে নাই।

মাস্টারদের বেতন আরও কমিয়া গিয়াছে; কারণ জানুয়ারি মাসে নতুন ছেলে ভর্তি হয় নাই আশানুরূপ। এই মাসের মাহিনা লইতে গিয়া মাস্টারেরা ব্যাপারটা জানিতে পারিলেন।

চায়ের আসরে যদুবাবু বলিলেন, আর তো চলে না হে, একে এই মাইনে ঠিকমত পাওয়া যায় না, তাতে আরও পাঁচ টাকা কমে গেল! কলকাতা শহরে চালাই কী করে?

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তবুও তো দাদা, আপানি বউদিকে পাড়াগাঁয়ে রেখেছেন আজ দু’ বছর। আমি আর-বছর বিয়ে করে কী মুশকিলেই পড়ে গিয়েছি, বাসার খরচ কখনও চলত না, যদি টুইশানি না থাকত।

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, খোকার অন্নপ্রাশন দেবে কবে ক্ষেত্রবাবু?

—আর অন্নপ্রাশন! খেতে পাই নে তার অন্নপ্রাশন! বাসা-খরচ চলে না, বাসাভাড়া আজ তিন মাস বাকি।

—আমার কথা যদি শোনেন, তবে অবাক হয়ে যাবেন। স্কুলের ঘরে থাকি,—ঘরভাড়া লাগে না, তাই রক্ষে। আজ ছ’ মাস বাড়িতে পাঁচটা করে টাকা মাসে, তাও পাঠাতে পারি নে। পঁচিশ ছিল, হল বাইশ। এখানেই বা কী খাই, বাড়িতেই বা কী দিই?

যদুবাবু বলিলেন, আমার ভাবনা কিসের শুনবে? বউটাকে এক জ্ঞাতি শরিকের বাড়ি ফেলে রেখেছি দেশে। সেখানে তার কষ্টের সীমা নেই। কতবার লিখেছে, কিন্তু আনি কোথায় বলো? বত্রিশ থেকে আটাশ হল। মেসে খাই তাই কুলোয় না!

শরৎবাবু বলিলেন, কোথাও চলে যাই ভাবি, কিন্তু এ বাজারে যাই-ই বা কোথায়?

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আচ্ছা শরৎ, তেমায় একটা কথা বলি। আমাদের না হয় বয়েস হয়েছে, স্কুল-মাস্টারি ধরেচি অনেক দিন থেকে, কোথায় আর এ বয়েসে যাব! কিন্তু তুমি ইয়ং ম্যান, কেন মরতে এ লাইনে পচে মরবে? স্কুল-মাস্টারি কি কেউ শখ ক’রে করে? সমস্ত জীবনটা মাটি। এখনও সময় থাকতে অন্য পথ দেখে নাও—তুমি, কি ওই গেম-টিচার বিনোদবাবু, কেন যে তোমরা এখানে আছ! পিওর লেজিনেস—

শরৎবাবু বলিলেন, লেজিনেস নয় দাদা। এখানে পঁচিশ পেতাম, হল বাইশ। অনেক চেষ্টা করেছি, হেন আপিস নেই যেখানে দরখাস্ত-হাতে যাই নি, হেন লোক নেই যাকে ধরি নি। আমরা গরিব, নিজের লোক না থাকলে হয় না! আমাদের কে ব্যাক করচে, বলুন না দাদা?

—কিন্তু তা তো হল, এ স্কুলের অবস্থা দিন দিন হয়ে দাঁড়াল কী?

—কে জানে কেমন! সাহেবের অত কড়াকড়ি, অমন পড়ানোর মেথড—কিছুতেই কিছু হচ্ছে না!

যদুবাবু বলিলেন, তা নয়, কী হয়েছে জান? পাশের স্কুলগুলো ছেলে ভাঙিয়ে নেয়, ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলে যোগাড় করে। হেডমাস্টার মাস্টারদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায়।

—আমাদেরও যেতে হবে।

—হেডমাস্টার যে রাজি নন। ওতে মাস্টারদের প্রেস্টিজ থাকে না, ওসব ব্যবসাদারি করে স্কুল রাখার চেয়ে না রাখা ভালো—এ সব বিলিতি মত এখানে খাটবে না। আমি জানি, লালবাজারে একটা স্কুল থেকে ছেলে ট্রান্সফার নেবে বলে দরখাস্ত দিলে—হেডমাস্টার দু’জন টিচার নিয়ে তাদের বাড়ি গিয়ে পড়ল, গার্জেনকে বোঝালে—কেন ট্রান্সফার নেবেন, কী অসুবিধে হচ্ছে বলুন—কত খোশামোদ! কিছুতেই ছেলেকে নিতে দিলে না।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমাদের স্কুলে যেমন ট্রান্সফারের দরখাস্ত পড়েছে, আর সাহেব অমনি তখনই ক্লার্ককে ডেকে বলবে—কত বাকি আছে দেখ, দেখে ট্রান্সফার দিয়ে দাও।

—এ রকম করে কি কলকাতায় স্কুল চলে? সাহেবকে বোঝালেও বুঝবে না!

—প্রেস্টিজ যাবে! প্রেস্টিজ ধুয়ে জল খাই এখন!

পরদিন স্কুলে মিঃ আলম টিচারদের লইয়া এক গুপ্ত-সভা করিলেন, স্কুলের ছুটির পর তেতলার ঘরে। উদ্দেশ্য, এ হেডমাস্টারকে না তাড়াইলে স্কুলের উন্নতি নাই। একা দুই শত টাকা মাহিনা লইবে, তাহার উপর ছেলে আসে না স্কুলে। মাস্টারদের এই দুর্দশা। হেডমাস্টার ও মেম বিতাড়ন না করিলে স্কুল টিকিবে না।

যদুবাবু বলিলেন, কী উপায়ে সরানো যায় বলুন? হিমালয় পর্বত কে সরায়?

—কমিটির কাছে দরখাস্ত পেশ করি সবাই মিলে। আমাদের ভিউজ আমরা লিখি।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কিছু হবে না মিঃ আলম। কমিটি ওতে কানও দেবে না, উলটো বিপত্তি হবে।

মিঃ আলম বলিলেন, দেখুন, কী হয়! আমি বলছি, ওতে ফল হতেই হবে!

এ মীটিংয়ে নারাণবাবু ছিলেন না, কিন্তু রামেন্দুবাবু ছিলেন। তিনি বলিলেন, আমি এ অপোজ করছি। হেডমাস্টার বিতাড়ন করে ফল ভালো হবে কে বলেছে? সেটা উচিতও নয়।

মিঃ আলম বলিলেন, তবে কিসে ফল ভালো হবে?

—তা আমি জানি নে, তবে হেডমাস্টার কড়া বটে, কিন্তু এ ভেরি গুড টিচার। অমন লোককে বুড়া বয়সে তাড়ালে ধর্মে সইবে না, আর তাড়াতে পারবেনও না।

—কেন?

—কমিটির কাছে হেডমাস্টারের পোজিশন খুব সিকিওর। তারা ওঁকে মেনে চলে, শ্রদ্ধা করে।

—শত্রুও আছে, যেমন ডাক্তার গাঙ্গুলী, সাতকড়ি দত্ত, মিঃ সেন—এঁরা স্বদেশী কিনা, সাহেবকে দেখতে পারেন না। আপনারা বলুন, আমি তদ্বির-তদারক আরম্ভ করি, মেম্বারদের—বিশেষ করে স্বদেশী মেম্বারদের বাড়ি যাই!

রামেন্দুবাবু বলিলেন, আমি এর মধ্যে নেই। তবে আমি সাহেবকেও কিছু বলব না। আপনাদের এর মধ্যেও থাকব না, আপনারা যা হয় করুন।

মিঃ আলম বলিলেন, একটা কথা আছে এর মধ্যে!

—কী?

—আপনারা সবাই কিন্তু বলুন, এর পরে আমাকে হেডমাস্টার করবেন আপনারা!

মাস্টারেরা দণ্ডমুণ্ডের মালিক নহেন, বেশ ভালো রকমই তাহা জানেন, তবুও ঘাড় নাড়িয়া কেহ সায় দিলেন, কেহ উৎসাহের সহিত বলিলেন, বেশ, বেশ।

অর্থাৎ যে ক্ষমতা তাঁহাদের নাই, অপর একজনের মুখে তাহা তাঁহাদের আছে শুনিয়া মাস্টারের দল খুশি ও উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন।

রামেন্দুবাবুর দলের দুই-একজন মাস্টার নিজেদের মধ্যে বলাবলি করিলেন, তাঁহারা রামেন্দুবাবুকে হেডমাস্টার করিবেন।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, মিঃ আলম, তবে আপনাকে মাইনে কম নিতে হবে।

—কত বলুন?

—একশোর বেশি নয়—

—সে আপনাদের বিবেচনা, যা ভালো হয় করবেন।

যদুবাবু বলিলেন, আচ্ছা আপনাকে যদি আর পঁচিশ বেশি দেওয়া যায়, তবে আপনি আমাদের মাইনের বিষয়টাও দেখবেন! এই স্কেল করুন না, গ্র্যাজুয়েট পঞ্চাশ টাকা, আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট চল্লিশ—

মাহিনার কত স্কেল হইবে, তাহা লইয়া কিছুক্ষণ মাস্টারদের তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল, যদুবাবুর প্রস্তাব গ্র্যাজুয়েটদের পক্ষে ঠিকই রহিল তবে আন্ডার-গ্রাজুয়েটদের ত্রিশের বেশি আপাতত দেওয়া চলিবে না।

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, পণ্ডিতদের সম্বন্ধে একটা বিবেচনা করুন।

মিঃ আলম বলিলেন, আপনারা কত হলে খুশি হন?

যদুবাবু বিষম আপত্তি উঠাইলেন। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট আর পণ্ডিত এক স্কেলে মাহিনা পাইবে, তাহা হয় না। হেডপণ্ডিত পঁয়ত্রিশ, অন্য পণ্ডিত ত্রিশ ও পঁচিশ।

হেডমাস্টার হওয়ার আসন্ন সম্ভাবনায় উৎফুল্ল মিঃ আলম যদুবাবুর প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজি হইয়া গেলেন। মাস্টারেরা বলাবলি করিতে লাগিলেন, ব্যবস্থা ভালোই হইয়াছে।

যদুবাবু বলিলেন, আজ দু’ বছর ধরে আড়াই মাস খেটে এক মাসের টাকা পাচ্ছি—আজ এক টাকা, কাল দু’ টাকা, এ আর সহ্য হয় না। তার ওপর মাইনে গেল কমে। ইনক্রিমেন্ট তো হলই না আধ পয়সা আজ চোদ্দ বছরের মধ্যে—

হেডপণ্ডিত বলিলেন, আমার উনিশ বছরের মধ্যে—

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, আমার সতেরো বছরের মধ্যে—

বোঝা গেল, সকলেই বর্তমান ব্যবস্থার উপর অসন্তুষ্ট। নতুন কিছু হইলেই খুশি। সকলেরই উন্নতি হইবে, বাজার-খরচ সচ্ছলভাবে করিতে পারিবেন, বাসায় ফিরিয়া পরোটা জলখাবার খাইতে পারিবেন, দুই-একটা জামা বেশি করাইতে পারিবেন, বাড়িতে অনেকেরই বাসনপত্র কম—কিছু থালা বাটি কিনিবেন, কন্যার বিবাহের দেনা কেহ বা কিছু শোধ করিতে পারিবেন।

কাল হইতে স্কুলে ছেলেদের জন্য টিফিনের বন্দোবস্ত হইবে। ‘ডি.পি.আই’-এর সারকুলার অনুযায়ী ছেলেদের নিকট হইতে কিছু কিছু খরচা লইয়া স্কুল ছেলেদের টিফিনের সময় জলখাবারের আয়োজন করিবে। সাহেব ঠিক করিয়াছেন—লাল আটার রুটি আর ডাল, ঠাকুর রাখিয়া তৈরি করানো হইবে, প্রত্যেক ছেলেকে দুটি পয়সা দিতে হইবে খাবার বাবদ—দুইখানা রুটি ও ডাল মাথা-পিছু।

মিঃ আলম বলিলেন, শুনুন, মীটিং ভাঙবার আগে আর একটা কথা আছে। কাল থেকে টিফিন দেওয়া হবে ছেলেদের, ওর হিসেবপত্র আর ছেলেদের দেওয়া-থোওয়ার তদারক করতে হবে একজন টিচারকে, আপনাদের মধ্যে কে রাজি আছেন? সাহেব আমাকে লোক ঠিক করতে বলেচেন।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কে আবার ওই হাঙ্গামা ঘাড়ে নেবে, থাকি টিফিনের সময় একটু শুয়ে—

হেডপণ্ডিত বলিলেন, আমাদের শরৎ-ভায়া বরং করো—ইয়ং ম্যান। তুমি কি বিনোদ—

হিসাবপত্র করিতে হইবে এবং তিনশো ছেলেকে ডাল রুটি দেওয়ার ঝঞ্ঝাট পোহাইতে হইবে বলিয়া কেহই রাজি হয় না। মিঃ আলম বলিলেন, তাই তো, একটা যা হয় ঠিক করে ফেলতে হবে!

যদুবাবু চুপ করিয়া ছিলেন। বলিলেন, তা, তবে—যখন কেউ রাজি হয় না, তখন আর কী হবে, আমাকেই করতে হবে। সাহেবের অর্ডার, না মেনে তো উপায় নেই।

—আপনি নেবেন তা হলে?

—তাই ঠিক রইল মিঃ আলম। কী আর করি, একটু কষ্ট হবে বটে কিন্তু চাকরি যখন করছি—

কর্তব্যকার্যে এতখানি অনুরাগ যদুবাবুর বড় একটা দেখা যায় না, সুতরাং অনেকে বিস্মিত হইলেন।

মিঃ আলম বলিলেন, আপনারা নির্ভয়ে নেমে যান। সাহেব টুইশানিতে বার হয়েছে, মেমসাহেবও নেই। কেউ টের পাবে না।

সকলে ভয়ে ভয়ে নীচে নামিয়া গেল।

চায়ের মজলিশে রামেন্দুবাবু বলিলেন, আমাকে আপনারা এর মধ্যে কিন্তু টানবেন না।

সকলে বলিলেন, কেন, কেন, কী বলুন?

—মিঃ আলম হেডমাস্টার হোন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সাহেবের বিরুদ্ধে এ ধরনের ষড়যন্ত্র আমি পছন্দ করি নে। এ ঠিক নয়।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তা ছাড়া আপনি কি ভেবেছেন, এ কখনও হবে? এ হল ‘কালনেমির লঙ্কাভাগ’!

বাহিরে আসিয়া সকলেরই মন হাওয়া-বার-হওয়া বেলুনের মত চুপসিয়া গিয়াছিল। এতক্ষণ বড় বড় কথা, প্রস্তাব গ্রহণ প্রত্যাখ্যান প্রভৃতি ব্যাপারের মধ্যে থাকিয়া নিজেদের পার্লামেন্টের মেম্বরের মত পদস্থ বলিয়া মনে হইতেছিল। সাহেব তাড়ানো, সাহেব বাঁচানো প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ কর্মে ডিক্রি-ডিসমিসের মালিক বুঝি তাঁহারাই—বর্তমানে ওয়েলেসলি স্ট্রীটের কঠিন পাষাণময় ফুটপাথে পা দিয়াই সে ঘোর তাঁহাদের কাটিতে শুরু করিয়াছে।

যদুবাবু, যিনি অতগুলি প্রস্তাব আনয়নকারী উৎসাহী মেম্বর, তিনিও টানিয়া টানিয়া বলিলেন, হয় বলে তো বিশ্বাস হচ্ছে না, তবে দেখ—সাহেবকে তাড়াবে কে!

শরৎবাবু বলিলেন, আপনি কখন কোন দিকে থাকেন যদুদা, আপনাকে বোঝা ভার। এই মিঃ আলমকে গালাগাল না দিয়ে জল খান না, আবার দিব্যি ওঁকে হেডমাস্টার করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন! কেন, আমরা সকলে ঠিক করেছি রামেন্দুবাবুকে ছাড়া আর কাউকে হেডমাস্টার করা হবে না!

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, আমিও তাই বলি।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমারও তাই মত।

যদুবাবু রাগিয়া বলিলেন, বেশ তোমরা! আমিও বলি, রামেন্দুবাবুই উপযুক্ত লোক। আমি ওখানে না বলে করি কী? আলম যখন ও-রকম করে বললে, না বলি কী করে?

রামেন্দুবাবু বলিলেন, আপনাদের কারও লজ্জা বা কিছুর কারণ নেই। ক্ষেত্রবাবু ঠিক বলেছেন, এসব কালনেমির লঙ্কাভাগ হচ্ছে। ক্লার্কওয়েল সাহেব যথেষ্ট উপযুক্ত লোক, যদি তিনি চলে যান, তা হলে যে-কেউ হতে পারেন, আমার কোনো লোভ নেই ওতে।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তা নিয়ে এখন আর তর্কাতর্কি করে কী হবে? তবে আমার এই মত, সাহেবের জায়গায় যদি কেউ হেডমাস্টার হওয়ার উপযুক্ত থাকেন স্টাফের ভেতর, তবে রামেন্দুবাবু আছেন।

যদুবাবু বলিলেন, আমি কি বলেচি নয়?

—বলছিলেন তো দাদা, আমি সোজা কথা বলব!

—না, এ তোমার অন্যায় ক্ষেত্রভায়া। তুমি আমার কথা না বুঝে আগেই—

রামেন্দুবাবু হাসিয়া উভয়ের বিবাদ থামাইয়া দিলেন।

সেদিনকার চায়ের মজলিশ শেষ হইল।

দিনতিনেক পরে জ্যোতির্বিনোদ ছুটির ঘণ্টা পড়িতেই বাহিরে যাইতেছেন, যদুবাবু ফোর্থ ক্লাস হইতে ডাক দিয়া বলিলেন, কোথায় যাচ্ছ, ও জ্যোতির্বিনোদ ভায়া?

—একটু কাজ আছে। কেন দাদা?

—না তাই বলছি, এখনই ফিরবে?

—ফিরতে দেরি হবে। শ্যামবাজারে যাব একবার।

—ও!

কিন্তু কী কারণে ওয়েলেসলির মোড় পর্যন্ত গিয়া জ্যোতির্বিনোদের শ্যামবাজার যাওয়ার প্রয়োজন হইল না। সুতরাং তিনি ফিরিয়া তেতলায় নিজের ঘরে ঢুকিলেন। টিচার্স-রুমের পাশেই ছোট ঘর, যাইবার সময় দেখিলেন, যদুবাবু টিচার্স-রুমে কী করিতেছেন। কৌতূহলী হইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, কী, একা এখানে বসে এখনও দাদা?

যদুবাবু চমকিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কী যেন একটা ঢাকিতে চেষ্টা করিলেন, এবং পরে কথা বলিবার প্রাণপণ চেষ্টায় চোখ ঠিকরাইয়া অস্পষ্টভাবে গোঙরাইয়া কী যেন বলিতে গেলেন।

জ্যোতির্বিনোদ দেখিলেন, যদুবাবুর সামনে টেবিলের উপর শালপাতায় খান পাঁচ-ছয় লাল আটার রুটি ও কিছু ডাল—যদুবাবুর মুখ রুটি ও ডালে ভর্তি। আশ্চর্য নয় যে, এ অবস্থায় তাঁহার মুখ দিয়া স্পষ্ট কথা উচ্চারিত হইতেছে না! যদুবাবু ভীষণ আয়াসে ডালরুটির দলাকে জব্দ করিয়া কোনো রকমে গিলিয়া ফেলিলেন এবং স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রাপ্ত হইয়া অপ্রতিভ মুখে বলিলেন, এই টিফিনের পরে এক-আধখানা বাড়তি রুটি ছিল, তাই বলি ফেলে দিয়ে কী হবে! ঠাকুরকে বললাম, দাও ঠাকুর—

বেশ বেশ, খান না।

—তা ইয়ে—তুমি যদি খাও, কাল থেকে যদি বাড়তি থাকে, তোমার জন্যেও না হয়—

জ্যোতির্বিনোদ কী ভাবিয়া বলিলেন, কেউ আবার লাগাবে মিঃ আলমের কানে!

যদুবাবু ষড়যন্ত্র করিবার সুরে ও ভঙ্গিতে নিচু গলায় চোখ টিপিয়া বলিলেন, কেউ টের পাবে! তুমিও যেমন! যেখানে আধ মণ ময়দা মাখা হয় ডেলি, সেখানে ছ’খানা কি আটখানা রুটির হিসেব কে রাখছে? আর আমার হাতেই তো হিসেব! তুমি নাও!

জ্যোতির্বিনোদও নির্বোধ নন। তিনি বুঝিলেন, যদুবাবুর এ রুটি খাইতে হইলে ছুটির পরে নির্জন টিচার্স-রুম ভিন্ন আর স্থান নাই। সে রুমের পরেই জ্যোতির্বিনোদের থাকিবার ক্ষুদ্র কুঠুরি, তাঁহাকে অংশীদার না করিলে যদুবাবু উহা একা একা আত্মসাৎ কি করিয়া করিবেন? সেই জন্যই যদুবাবু অত আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, জ্যোতির্বিনোদ কোথায় যাইতেছে, অর্থাৎ এখনই ফিরিবে কিনা!

ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিলেন, তা যদি বাড়তি থাকে, তবে না হয়—

যদুবাবু উৎসাহের সঙ্গে বলিলেন, বাড়তি আছে—বাড়তি আছে—হয়ে যাবে। খান আষ্টেক করে রুটি তোমার জন্যে, তা সে এক রকম হবে এখন। জলখাবারটা বিকেলবেলার, বুঝলে না? পেটে খিদে মুখে লাজ—না ভায়া, ও কোনো কথা নয়।

তিন-চার দিন বেশ খাওয়া-দাওয়া চলিল দুইজনের।

জ্যোতির্বিনোদ দেখিলেন, যদুবাবু ক্রমশ রুটির সংখ্যা ও ডালের পরিমাণ বাড়াইতেছেন। একদিন শালপাতা খুলিলে দেখা গেল, বাইশখানা রুটি ও প্রায় সেরখানেক ডাল তাহার ভিতরে।

জ্যোতির্বিনোদ ভয় পাইয়া বলিলেন, এ নিয়ে কথা হবে দাদা! এত কেন?

—আরে, নাও না খেয়ে। রাতের খাওয়াটাও এই সঙ্গে না-হয়—সে পয়সাটা তো বেঁচে গেল—এ পেনি সেভড ইজ এ পেনি গট, অর্থাৎ—

—কিন্তু দাদা, আমার শরীর খারাপ, আমি এত খেতে পারব না যে!

—বেশ, বেশ, যা পার খাও। না-হয় যা থাকবে, আমিই খাব—ফেলা যাচ্ছে না।

এদিকে মিঃ আলমের ষড়যন্ত্র বেশ পাকিয়া উঠিল। মিঃ আলম কয়েকজন মেম্বরের বাড়ি গিয়া তাঁহাদের বুঝাইলেন, সাহেবকে না তাড়াইলে স্কুলের উন্নতি সম্ভব নয়। মীটিংয়ের দিন পর্যন্ত ধার্য হইয়া গেল। স্থির হইল, ডাক্তার গাঙ্গুলী সেদিন সাহেবকে সরাইবার প্রস্তাব কমিটিতে উঠাইবেন; কমিটির অন্যতম স্বদেশী মেম্বর সাতকড়ি দত্ত, জনৈক লোহাপট্টির দালাল সে প্রস্তাব সমর্থন করিবে।

রামেন্দুবাবু গোপনে ক্ষেত্রবাবুকে বলিলেন, মিঃ আলম একদিকে বেশ হেসে কথা বলে হেডমাস্টারের সঙ্গে, আর একদিকে এ রকম ষড়যন্ত্র করে—এ অত্যন্ত খারাপ। আমার মনে হয়, হেডমাস্টারকে ওয়ার্নিং দিয়ে দিলে ভালো হয়।

—কে দেবে?

—আমি দিতে পারতাম, কিন্তু আমার উচিত হবে না। আমি মিঃ আলমের মীটিংয়ে প্রথম দিন ছিলাম।

—তাই কী? আর তো ছিলেন না। আপনিই গিয়ে বলুন।

—সেটা ভদ্রলোকের কাজ হয় না। আর কাউকে দিয়ে বলাতে পারেন তো বলান।

—আর কে যাবে? এক আপনি, নয়তো নারাণবাবু!

—বুড়োমানুষকে আর এর মধ্যে জড়িয়ে লাভ নেই। হি ইজ টু গুড এ ম্যান ফর অল দীজ—নিরীহ বেচারি, ওঁকে আর এ বয়সে কেন এর মধ্যে?

—আমি বলব?

—আপনার উচিত হবে না। দু-মুখো সাপের কাজ হবে।

—তবে লেট ফেট টেক ইটস কোর্স—

—তাই হোক।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্রবাবু ও জ্যোতির্বিনোদ রাত দশটার পরে হেডমাস্টারের দোরে ঘা দিলেন।

সাহেব খয়রাগড়ের রাজকুমারকে পড়াইয়া সবে ফিরিয়াছেন। বলিলেন, কে, নারাণবাবু? ক্ষেত্রবাবু কাশিয়া বলিলেন, না স্যার, আমি ক্ষেত্রবাবু।

—ও! ক্ষেত্রবাবু? এস এস। এত রাত্রে?

ক্ষেত্রবাবু ঘরে ঢুকিয়া সামনের চেয়ারে মেমসাহেবকে দেখিয়া বলিলেন, গুড ইভনিং মিস সিবসন!

বুদ্ধিমতী মেমসাহেব প্রীতিসম্ভাষণ-বিনিময়ান্তে অন্য ঘরে চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু সাহেবকে সব খুলিয়া বলিলেন।

সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বলিলেন, এই! তা আমি রিজাইন দিতে প্রস্তুত আছি, তাতে যদি স্কুল ভালো হয়—হোক।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, না স্যার, তা হলে স্কুল একদিনও টিকবে না।

—না, যদি মেম্বরেরা আমার কাজে সন্তুষ্ট না হন, তবে আমার থাকার দরকার নেই।

—স্যার, আপনি যদি বলেন, তবে আমরাও অন্য অন্য মেম্বরের বাড়ি গিয়ে উলটো তদ্বির করি, আপনাকে পছন্দ করে এমন মেম্বর সংখ্যায় কম নয় কমিটিতে।

সাহেব নিতান্ত উদাসীন ভাবে বলিলেন, আমি এই স্কুল গড়ে তুলেছি, যখন এ স্কুলের ভার আমি নিই, তখন স্কুলে দেড়শো ছেলে ছিল। আমি হাতে নিলে চারশো দাঁড়ায় ছাত্রসংখ্যা। তারপর আবার কমে গেল। নতুন প্রণালীতে স্কুল চালাব ভেবেছিলাম, অক্সফোর্ড থেকে শিখে এসেছিলাম, আমার সব নোট করা আছে। একগাদা নোট—দেখতে চাও দেখাব একদিন। কিন্তু যদি কমিটি আমাকে না চায়, রিজাইন দিয়ে চলে যাব। এই অঞ্চলে সবাই আমার ছাত্র—চোদ্দ বছর ধরে এই স্কুলে কত ছাত্র আমার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। বুড়ো বয়সে খেতে না পাই, এর বাড়ি একদিন ব্রেকফাস্ট খেলাম, আর-এক ছাত্রের বাড়ি একদিন ডিনার খাওয়ালেও এই রকম করে চলে যাবে। নারাণবাবু কোথায়?

—বোধ হয় এখন টুইশানিতে।

—ওই একজন সাধুপ্রকৃতির মানুষ। এ সব কথা নারাণবাবু জানে?

—আমাদের মনে হয় শোনেন নি। ওঁর কাছে এ কথা কেউ ইচ্ছে করেই ওঠায় না।

—দেখে এস তো! যদি এসে থাকে, ডেকে নিয়ে এস—

নারাণবাবু কিছুক্ষণ পরে জ্যোতির্বিনোদের সঙ্গে ঘরে ঢুকিলেন।

সাহেব বলিলেন, শুনেছেন নারাণবাবু, আমাকে কমিটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ হচ্ছে!

নারাণবাবু বিস্মিত মুখে অবিশ্বাসের সুরে বলিলেন, কে বললে স্যার?

—জিজ্ঞেস করুন এঁদের। আমার বিশ্বস্ত লেফটেনান্ট মিঃ আলম এই চক্রান্ত করছে। এত তু ব্রুতি!

নারাণবাবু হাসিয়া বলিলেন, জগতে ব্রুটাসের সংখ্যা কম নেই স্যার! কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি যে, এতদিন আমি কিছুই শুনি নি এ কথা!

—কোথা থেকে শুনবেন? আপনি থাকেন আপনার কাজ নিয়ে।

—স্যার, আপনি নির্ভয়ে থাকুন। আপনার কিচ্ছু হবে না।

—ভয় কিসের? আমি রিজাইন দিতে রাজি আছি এই মুহূর্তে!

—আমার মত শুনুন। কাউন্টার প্রোপ্যাগান্ডা একটা করতে হয়—

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমি তা বলেছি। আসুন—আপনি, আমি, শরৎবাবু, গেম-টিচার সব মেম্বরদের বাড়ি বাড়ি যাই—

—আমার আপত্তি নেই।

হেডমাস্টার বলিলেন, না, নারাণবাবুকে আমি কোথাও নিয়ে যেতে বলি নে। লিভ হিম এলোন। আমি আপনাদেরও যেতে বলি নে। আমি ও-সব জিনিসকে বড় ঘৃণা করি। এটা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, রাজনীতির আসর নয়, এর মধ্যে দল-পাকানো, ষড়যন্ত্র—এ সবের স্থান নেই। না হয় চলেই যাব।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, স্যার, আমাদের অনুমতি দিন। আমরা দেখি—

নারাণবাবু বৃদ্ধ বটে কিন্তু বেশ তেজি লোক, তাহা বোঝা গেল। তিনি চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া বলিলেন, একটা কথা বলে যাচ্ছি স্যার, আপনাকে কেউ তাড়াতে পারবে না এ স্কুল থেকে। কিন্তু একটা ভবিষ্যদ্বাণী করি, মিঃ আলম এ স্কুলে আর বেশিদিন নয়।

সাহেব বলিলেন, ভালো কথা, রামেন্দুবাবুর কী মত?

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তিনি নিরপেক্ষ। তিনি কোনো দলেই যেতে রাজি নন।

—হি ইজ এ বর্ন জেন্টলম্যান—দুজন লোক দেখলাম এ স্কুলে, একজন সামনেই বসে, আর একজন ওই রামেন্দুবাবু।

পরে হাসিয়া ক্ষেত্রবাবুদের দিকে চাহিয়া বলিলেন, মাই অ্যাপোলজি টু ইউ, আপনাদের ওপর কোনো মন্তব্য করি নি এতদ্বারা।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, স্যার, আমাকে তিনটে টাকা দিন—আমি একবার এই রাত্রেই দু-একজন মেম্বরের বাড়ি যাই—ডাঃ সেনের বাড়ি যাওয়া বিশেষ দরকার। সেক্রেটারি বিপিনবাবু আমাদের দিকে আছেন। মীটিংয়ের দেরি নেই, একটু চটপট চেষ্টা করা দরকার।

সাহেব টাকা বাহির করিয়া দিলেন।

ক্ষেত্রবাবু বাহিরে আসিয়া নারাণবাবুকে ইঙ্গিতে তাঁহার সঙ্গে আসিতে বলিলেন।

হেডমাস্টার তখনই দোরের কাছে দাঁড়াইয়া তিরস্কারের সুরে বলিলেন, ক্ষেত্রবাবু, আশা করি আপনি আমার আদেশ শুনবেন, আমি এখনও এ স্কুলের হেডমাস্টার মনে রাখবেন। নারাণবাবুকে কোথাও নিয়ে যাবেন না, আমার ইচ্ছা নয়, এই সরল-প্রাণ বৃদ্ধকে আপনারা এ সব কাজে জড়ান। আপনি একা চলে যান—

মীটিংয়ের আগে ক্ষেত্রবাবুর দল মেম্বরদের বাড়ি বাড়ি গেলেন। যেখানেই যান, সেখানেই শোনা যায়, অপর পক্ষ কিছুক্ষণ আগে সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে।

স্বদেশীভাবের লোক গাঙ্গুলীর কাছে ক্ষেত্রবাবুর দল অপমানিত হইলেন।

ডাঃ গাঙ্গুলী বলিলেন, মশাই, আপনারা কী রকম লোক জিজ্ঞেস করি? পান তো পঁচিশ-ত্রিশ মাইনে। সাহেবের খোশামুদি করতে ইচ্ছে হয় এতে? একেবারে অপদার্থ সব! কী শিক্ষা দেবেন আপনারা ছেলেদের? নিজেদের এতটুকু আত্মসম্মান জ্ঞান নেই? সাহেবের হয়ে তদ্বির করতে এসেছেন, লজ্জা করে না? সাহেবকে এ মীটিংয়ে তাড়াবই—তারপর আপনাদের মত অপদার্থ দু-একজন টিচারকেও সরাতে হবে, তবে যদি এবার স্কুলটা ভালো হয়, ইত্যাদি।

মীটিংয়ের দিন ক্ষেত্রবাবু দল লইয়া আর-একবার দুই-একজন মেম্বরের বাড়ি গেলেন। মেম্বরদের বিশ্বাস নাই, হয়তো ভুলিয়া বসিয়া আছে, ঘন ঘন মনে না করাইয়া দিলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। সকলেই বলিল, তাহাদের মনে করাইয়া দিতে হইবে না।

ছয়টার সময় মীটিং। বেলা চারটার সময় হইতে উভয় দল আসিয়া স্কুলে বসিয়া রহিল; অথচ কেহ কাহারও প্রতি অসম্মান দেখাইল না। মিঃ আলম হেডমাস্টারের ঘরে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, খাতাপত্র কী কী দরকার আছে মীটিংয়ে নিয়ে যাবার জন্য, বলুন।

—বোস মিঃ আলম, চা খাবে এক পেয়ালা?

—থ্যাঙ্কস, এখন আর থাক।

মীটিং বসিল। সাহেবের অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। মিঃ আলমের দলের অত তদ্বির, অত অনুরোধ, অত ধরাধরি সব বুঝি ভাসিয়া যায়। সাহেবকে সরাইবার সম্বন্ধে কোনো প্রস্তাব কেহ আনে না—কার্য-তালিকার মধ্যে এ প্রস্তাব নাই; সুতরাং ‘বিবিধ’ কতক্ষণে আসে, সেই অপেক্ষায় উভয়দল দুরুদুরু বক্ষে প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। ডাক্তার গাঙ্গুলী, যিনি অত লম্ভঝম্প করিয়াছিলেন সাহেব তাড়ানোর জন্য, তিনি মীটিংয়ের গতিক বুঝিয়া সরু মিহি সুরে প্রস্তাব আনিলেন যে সাহেবকে অত বেতন দিয়া এই গরিব স্কুলে রাখা পোষাইতেছে না, বিশেষত নতুন ছাত্র যখন আশানুরূপ ভর্তিও হইতেছে না। অতএব সাহেবের বেতন কমানো হউক।

সে প্রস্তাব সমর্থন করিলেন অন্যতম স্বদেশী নৃপেন সেন। সভাপতি প্রস্তাব ভোটে ফেলিতে দেখা গেল, ডাঃ গাঙ্গুলী আর নৃপেনবাবু ছাড়া প্রস্তাবের পক্ষে আর কাহারও মত নাই; এমন কি শিক্ষকদের প্রতিনিধি মিঃ আলম পর্যন্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন।

ডাঃ গাঙ্গুলী মিঃ আলমকে ডাকিয়া আড়ালে বলিলেন, এটা কী রকম হল মশাই? আপনি আমাদের নাচালেন, শেষে কিনা আপনি নিজে—

মিঃ আলম বিনীতভাবে যাহা বলিলেন, তাহা সত্যই অসঙ্গত নয়। তিনি এখনও ক্লার্কওয়েল সাহেবের অধীনে চাকুরী করেন, প্রকাশ্যে তিনি কোনো মতেই তাঁহার বিরুদ্ধে যাইতে পারেন না; বরং শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিসাবে শিক্ষকদের স্বার্থ বজায় রাখিয়া তিনি কর্তব্য পালনই করিয়াছেন।

নৃপেন সেন বলিলেন, জানি জানি, আপনাদের এই রকমই মর্যাল কারেজ! ঘেন্না হয়, বাঙালি জাতটা এই রকমেই উচ্ছন্নে গেল। আপনারা কী শেখাবেন ছেলেদের? ছ্যাঃ ছ্যাঃ—

মীটিং-অন্তে যে যাহার ঘরে চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবুর দলকে সাহেব ডাকাইয়া বলিলেন, কই যত শুনলাম তোমাদের মুখে, তার কিছুই তো নয়?

ক্ষেত্রবাবুও একটু আশ্চর্য হইয়াছেন। বলিলেন, তাই তো! কিছু বুঝতেও পারলাম না স্যার।

—যত শুনেছিলে তোমরা, আমার মনে হয় অতখানি সত্যি নয়। মিঃ আলম অত খারাপ মানুষ নয়।

—স্যার, আমাকে মাপ করবেন, আপনি অবিশ্যি মিঃ আলমকে সন্দেহ করেন না, সে খুব ভালো কথা। তবে আমার স্বচক্ষে দেখা এবং স্বকর্ণে শোনা স্যার।

—যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো। নারাণবাবুর কথাই খাটল। বলেছিল, অপর পক্ষের চেষ্টা ব্যর্থ হইবে।

কমিটির মেম্বরদের মধ্যে অনেকেই এই মীটিংয়ের পরে আলমের উপর চটিয়া গেলেন। ফলে এক মাসের মধ্যে মিঃ আলমের মাহিনা আরও কাটিবার প্রস্তাব উত্থাপিত হইল। কমিটিতে এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কোনো বাধা ছিল না, কিন্তু সাহেব এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যথেষ্ট আপত্তি করিলেন।

সেদিন সন্ধ্যায় মীটিংয়ের পরে ক্ষেত্রবাবু হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকিলেন।

সাহেব বলিলেন, বসুন, ক্ষেত্রবাবু। কী খবর?

—আর স্যার, আপনি মিঃ আলমের পক্ষে অতটা না দাঁড়ালেও পারতেন!

—কেন বল তো?

—আপনার খুব বন্ধু নয় ও।

সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ও! তা বলে আমি কি তার প্রতিশোধ নেব ওভাবে? ওসব কাজ আমাদের দ্বারা হবে না। আমরা শিক্ষক—আমি চাই না ক্ষেত্রবাবু যে, স্কুলের মধ্যে এ ধরনের দলাদলি হয়। আমি চেয়েছিলাম স্কুলটাকে ভালো করতে। অক্সফোর্ড থেকে অনেক কিছু শিখে এসেছিলাম, নতুন প্রণালীতে শিক্ষা দেব ছেলেদের। এখানে এসে সব মিথ্যে হতে চলেছে দেখছি। এখানকার হাওয়াতে দলাদলি ভাসে।

এই সব ঘটনার পর কিছুদিন দলাদলি ও ষড়যন্ত্র ক্ষান্ত রহিল। আবার মাস দুই পরে মিঃ আলম নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করিল। এবার মেমসাহেবের বিরুদ্ধে। স্কুলে অত টাকা খরচ করিয়া মেম রাখিবার কোনো কারণ নাই। বিশেষত ছেলের স্কুলে মেয়েমানুষ শিক্ষয়িত্রী কেন? এবার মিঃ আলমের ষড়যন্ত্র সফল হইল। মেম্বরের দল টেবিল চাপড়াইয়া লম্বা বক্তৃতা করিল। ফলে মিস সিবসনের চাকরি গেল। ছেলেরা মিলিয়া চাঁদা তুলিয়া মেমসাহেবের বিদায়-অভিনন্দনজ্ঞাপক সভা করিল। মিস সিবসন ছোট ছোট ছেলেদের সত্যই ভালোবাসিত, বিদায়-সভায় বেচারি প্রীতিভাষণ দিতে উঠিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

মেমসাহেব চলিয়া যাওয়াতে সাহেবের কষ্ট হইল খুব বেশি। সকলে বলে, বিলাত হইতে আসিবার সময় সাহেব মিস সিবসনকে সঙ্গে করিয়া আনেন, গরিবের ঘরের মেয়ে, ইন্ডিয়ায় একটা চাকুরি জুটিয়া যাইবে—ইহাই ছিল উদ্দেশ্য।

এই স্কুলের ভার সাহেব যতদিন হইতে লইয়াছেন, মেমসাহেবেরও চাকরি এখানে ততদিন।

চায়ের মজলিশে সেদিন মাস্টারদের সংখ্যা কিছু বেশি ছিল।

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, আজ আলমের মনস্কামনা পূর্ণ হল।

ক্ষেত্রবাবু যতখানি সাহেবের পক্ষ হইয়া তদ্বির করিয়াছিলেন, মিস সিবসনের পক্ষ হইয়া তাহার অর্ধেকও করেন নাই। মেমসাহেব যাওয়াতে তিনি ততটা দুঃখিত হন নাই, ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইবার কথা। তিনি বলিলেন, তা বটে, তবে আমার মত যদি জিগ্যেস কর—এ চালটা ওদের খুব গভীর।

শরৎবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কী রকম?

—এতে সাহেবকেও তাড়ানো হল!

সকলে একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন? কেন?

—সাহেব একা এখানে থাকতে পারবে না।

—তা ছাড়া মেম বেচারিই বা যায় কোথায়? ও তো খুব গরিব ছিল শুনেছি।

—শুনচি মেম দার্জিলিং গিয়ে থাকবে।

—খরচ?

—দার্জিলিং ল্যাঙ্গোয়েজ স্কুলে টিচার হবে। মিশনারি সোসাইটিকে সাহেব লিখেছিলেন ওর জন্যে, তারা সব ঠিক করে দিয়েছে।

মেমসাহেব যে খুব ভালো টিচার ও ভালো লোক এ বিষয়ে সকলেই দেখা গেল একমত! স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মিস সিবসনকে খুব ভালোবাসে, তাহারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলিয়া নিজেদের ক্লাসের এক গ্রুপ ফোটো মেমসাহেবকে উপহার দিয়াছে।

একজন কে বলিল, ও ভালোই হয়েছে, আমাদের মাইনে পঁচিশ-ত্রিশ—আর মেমসাহেবের মাইনে আশি! অথচ তিনি ইনফ্যান্ট ক্লাসে পড়াবেন? কেন, আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেচি! তোমাদের স্লেভ-মেন্টালিটি কতদূর হয়েচে, তা বুঝতে পারছ না। এ কাজটা মিঃ আলম ঠিকই করেচে।

ক্ষেত্রবাবু বোধ হয় এইটুকুর অপেক্ষা করিতেছিলেন। বলিলেন, আমারও তাই মত। এবার মিঃ আলমের এতটুকু অন্যায় হয় নি। তাই বুঝে এবার তদ্বিরও করি নি। এটা আলমের ন্যায্য কাজ।

চায়ের দোকান হইতে ক্ষেত্রবাবু বাসায় ফিরিলেন। অনিলা স্বামীকে চা করিয়া দিয়া বলিল, কী খাবার যে দেব! মুড়ি রোজ রোজ খেতে পার কি? ভেবেছিলাম একটু হালুয়া—

—হ্যাঁ, হালুয়া! ঘিটুকু সব খরচ করে না ফেললে তোমার—

—তুমি তো আধ সের করে মাসে দেবে বলেছ, তার মধ্যেই আমি—

—গত মাসের মাইনের মধ্যে দশটি টাকা আজ পাওয়া গেল, এতে তুমি কত ঘি খাবে আর কী করবে?

অনিলা দুঃখ ও রাগের সুরে বলিল, আমি কি তোমার ঘি খাই! ছেলেমেয়েরা মুড়ি চিবুতে পারে না রোজ, তাও কোনোদিন ওদের জন্যে একটু হালুয়া, কি দুখানা পরোটা—

ক্ষেত্রবাবু ঝাঁঝের সঙ্গে বলিলেন, না, কেন মুড়ি খেতে পারবে না? বিদ্যাসাগর মশায় যে না খেয়ে পরের বাসায় থেকে লেখাপড়া শিখেছিলেন! তবে ওসব হয়—যখন যেমন অবস্থা, তখন তেমনি থাকবে।

—আধ সের ঘি তুমি বরাদ্দ করেছ কিনা মাসে, আমি তাই শুনতে চাই।

—করেছিলাম। এ মাস থেকে হয়তো খরচ কমাতে হবে। পাচ্ছি কোথায়? ঘি’র আইটেমই হয়তো তুলে দিতে হবে!

অনিলা সামনে গালে হাত দিয়া বসিয়া পড়িয়া বলিল, হ্যাঁগা, সেই সাড়ে নটায় খেয়ে বেরোও আর সাড়ে পাঁচটায় ফেরো! যদি কিছু না হয় ওতে, তবে ও ছাইপাঁশ চাকরি কেন ছেড়ে দাও না!

—ছেড়ে তো দেব, তার পর?

—ছেলে পড়াও যেমন পড়াচ্ছ—তাতে হয় না? আর নয়তো চল বাবার কাছে, ওদিকে অনেক কিছু জুটে যাবে। ডিহিরি-অন-সোনে আমার সেই শৈলেনকাকা থাকেন, দেখেছ তো তাঁকে? এক মাড়োয়ারির ফার্মে কাজ করেন। ধরে-পেড়ে বললে—সেখানে চাকরি হতে পারে। যদি বল তো বাবাকে লিখি!

—তা না হয় হল। কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে মন সরে না। এতদিন এখানে আছি—আর কি জান, স্কুলের ওপরও বড় মায়া। আমার বলে নয়, সব মাস্টারেরই। সুখে-দুঃখে আজ বারো ষোলো বিশ বছর এক জায়গায় আছি। ওই কেমন একটা নেশা—স্কুলবাড়িটা, ছেলেগুলো, ওই চায়ের দোকানের মজলিশটা, হেডমাস্টার—বেশ লাগে। যত কষ্টই পাই, তবুও যেতে পারি নে কোথাও যে, তাই এক এক সময় ভাবি—

—ভাবাভাবির কোনো দরকার নেই, চল বেরুই। কলকাতার খরচ বেশি অথচ খাওয়া হচ্ছে কী, একটু দুধ তোমার পেটে পড়ে না, একটু ঘি না। আমাদের গয়ায় এগারো সের করে খাঁটি দুধ—

—বুঝি সবই। কিন্তু কোথাও গিয়ে থাকতে পারি নে যে। তোমাদের গয়া কেন, আমার নিজের পৈতৃক গ্রামে চোদ্দ সের করে দুধ টাকায়। পাঁচসিকে উৎকৃষ্ট গাওয়া ঘিয়ের সের—কিন্তু সেবার তোমার দিদি থাকতে নিয়ে গেলুম—মন টেঁকে না মোটে। ছেলেমেয়েদের মন মোটে টেঁকে না—সব কলকাতায় মানুষ। তোমার দিদি তো ছটফট করতে লাগল দেশে। তা ছাড়া ম্যালেরিয়াও আছে—

এই সময় বাহির হইতে কে ডাকিল, ক্ষেত্রবাবু আছেন?

—কে ডাকচে দেখ তো জানলা দিয়ে?

অনিলা দেখিয়া আসিয়া বলিল, একটা ছেলে। তোমার স্কুলের ছেলে নাকি, দেখ না!

ক্ষেত্রবাবু বাহিরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে আবার ঢুকিয়া বলিলেন, সেই তোমার অথর গো, সেই যে সেদিন বলেছিলাম—অথর রাখাল মিত্তির! তিনি তাঁর ছেলের হাত দিয়ে চিঠি দিয়াছেন, তাঁর অসুখ, বড় কষ্ট পাচ্ছেন, আমি যেন গিয়ে দেখা করি—

অনিলা ব্যগ্রভাবে বলিল, আহা, তা যাও! কষ্ট পাচ্ছেন, সত্যি তো—অথর একজন—যাও—

ক্ষেত্রবাবু ছেলেটির পিছু পিছু ইটিলি সাউথ রোডের মধ্যে এক অন্ধ গলির ভিতরে গিয়া পড়িলেন। ছেলেটি তাঁহাকে একটা দরজার সামনে দাঁড় করাইয়া বলিল, আপনি দাঁড়ান, দরজা খুলে দি।

সে কোন দিক দিয়া চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু ভাবিলেন, আমি নিজেও ঠিক চৌরঙ্গীতে থাকি নে, কিন্তু এ কী গলি, বাপ।

দরজা খুলিল। দরজার পাশে ক্ষুদ্র একটা রোয়াকের সামনে অন্ধকার এক ঘরে ছেলেটি তাঁহাকে লইয়া গেল। এত অন্ধকার যে প্রথমে বোঝা যায় না, ঘরের মধ্যে কিছু আছে কিনা! অন্ধকারের ভিতর হইতে একটা ক্ষীণ স্বর তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, কে? ক্ষেত্রবাবু এসেচেন?

ক্ষেত্রবাবু দেখিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া চোখ ঠিকরাইয়া একটা বিছানা বা কিছুর অস্পষ্ট আভাস ও একটি শায়িত মনুষ্যমূর্তি-গোছের যেন দেখিতে পাইলেন। আর অগ্রসর না হইয়া দাঁড়াইলেন, কিছু বাধিয়া ঠোকর খাইয়া পড়িয়া না যান।

ক্ষীণ স্বরে চিঁ-চিঁ করিয়া বলিল, ওই জানালার ওপরটাতে বসুন। ওরে, একটা কিছু পেতে দে না! ও রাধু—

—থাক থাক, পেতে দিতে হবে না। আপনার কী হয়েছে?

—আর কী হবে! জ্বর আর কাশি আজ পনেরো দিন। পড়ে আছি। উত্থানশক্তিরহিত—

—তাই তো দেখতে পাচ্ছি। বড় কষ্ট পাচ্ছেন তো!

এইবার ক্ষেত্রবাবু ঘরের ভিতরটা বেশ স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। ওই যে রাখালবাবু তাকিয়া ঠেস দিয়া মলিন বিছানায় কাত হইয়া আছেন, পাশে একটা ততোধিক মলিন লেপ, বিছানার এক পাশে দড়ির আলনাতে দু-চারখানা ময়লা ও আধময়লা কাপড় ঝুলিতেছে, বিছানার সামনে একটা তাক, তাকের উপর অনেক বই কাগজ। এক পাশে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন। দেওয়ালে কয়েকখানি সস্তা ধরনের ক্যালেন্ডার—বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক বিক্রেতাদের নাম ও বিজ্ঞাপন ছাপানো। ঘরের আসবাবপত্রের বীভৎস দারিদ্র্যে গরিব স্কুলমাস্টার ক্ষেত্রবাবুও যেন শিহরিয়া উঠিলেন।

—কতদিন অসুখ বললেন?

—তা আজ দিন পনেরো।

—কেউ দেখচে?

—না, দেখে নি। পয়সা নেই, সত্যি কথা বলতে কি ক্ষেত্রবাবু, আজ তিন দিন ঘরে এক পয়সাও নেই। ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম রাধাকৃষ্ণ কর অ্যান্ড সন্সের দোকানে। আমার সেই—সেই—সেই—(রাখালবাবু একটু হাঁপ জিরাইলেন) রচনার বইখানা দশ কপি পাঠিয়ে দিয়ে একখানা চিঠি লিখে দিলাম, বলি—এখন বইগুলো রেখে দাম দাও, আমি পঁয়ত্রিশ পার্সেন্ট কমিশন দেব, এখন আমার হাত বড্ড টানাটানি যাচ্ছে—তা ব্যাটারা বই ফেরত দিয়েছে। ও বই নাকি কম বিক্রি—ও এখন বিক্রি হবে না! আপনি তো জানেন, চেতলা স্কুলের হেডমাস্টার—নব ব্যাকরণ সুধা প্রথম ভাগ—

—আচ্ছা, আপনি একটু বিশ্রাম করুন।

—বিশ্রাম আমি করছি সারাদিনই। কিন্তু আমি বলি, দেখুন ক্ষেত্রবাবু, যারা জিনিস চেনে, তাদের কাছে জিনিসের কদর! চেতলা স্কুলের হেডমাস্টার নব ব্যাকরণ সুধা দেখে বললে, মিত্তির মশাই, এমন বই একালে কে লিখছে আপনি ছাড়া? আপনাকে বলেছি বোধ হয় ক্ষেত্রবাবু, ব্যাকরণে ছাত্রবৃত্তিতে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করি, মেডেল আছে। দেখতে চান তো দেখাতে পারি।

—না, দেখাতে হবে কেন? আপনি ঠিকই বলছেন। তা চেতলা স্কুলে বই ধরালে আপনার?

—না। বললে—আগে যদি আসতেন! কাকে বুঝি কথা দিয়ে ফেলেছে! আসছে বারে প্রমিস করেছে ধরিয়ে দেবে। আর ওই শাঁকারিটোলা হাই স্কুলে রচনাদর্শখানা পাঠাতে বলেছিল—নমুনা।—কিন্তু নমুনা পাঠিয়ে পাঠিয়ে হয়রান। বই ধরাবেন না, নমুনা পাঠাও—

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, ওসব আমরাও জানি। বই ধরাবার ইচ্ছে নেই, বই পাঠান—

রাখালবাবু উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিয়া পাশের তাকে হাত বাড়াইতে গেলেন।

—আপনাকে দেখাই, আর একখানা নীচের ক্লাসের ব্যাকরণ লিখচি—আপনাকে দেখাই—খাতাখানাতে লিখছিলাম—

কাশির বেগে রাখালবাবুর খাতা বাহির করিবার চেষ্টা ব্যর্থ হইল। ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, থাক থাক, এখন রাখুন।

—বড় কষ্ট পাচ্ছি। কেউ নেই, কাকে বলি! তাই ছেলেটাকে প্রথমে আপনার স্কুলে পাঠাই, সেখানে দরোয়ান আপনার বাসার ঠিকানা বলে দিয়েছে, তাই বাসায় গিয়েছিল। এখন কী করি, একটা পরামর্শ দিন দিকি ক্ষেত্রবাবু।

—তাই তো! খুবই বিপদ। বাসাতে কে কে আছেন?

—আমার স্ত্রী, দুটি ছোট ছোট ছেলে, এক বিধবা ভগ্নী, তাঁর একটি মেয়ে—এই। রোজ দুটি করে টাকা হলে তবে সংসার বেশ চলে। এক পয়সা আয় নেই, তার দু’ টাকা—কী করা যায় বলুন! খেতে পায় নি বাড়িতে আজ দু’দিন। আপনার কাছে খুলে বলতে লজ্জা নেই—

ক্ষেত্রবাবুর মনে যথেষ্ট দুঃখ ও সহানুভূতির উদ্রেক হইল। নিজেকে তিনি ওই অবস্থায় ফেলিয়া দেখিলেন কল্পনায়। কিন্তু তিনি কী করিবেন! তাঁহার হাতে বাড়তি পয়সা এমন নাই, যাহা দিয়া তিনি এই দুঃস্থ বৃদ্ধ গ্রন্থকারকে সাহায্য করিতে পারেন। পরামর্শই বা তিনি কী দিবেন? একমাত্র পরামর্শ হইতেছে পয়সাকড়ির পরামর্শ। কিন্তু কে এই বৃদ্ধকে অর্থসাহায্য করিবে, সে কথাই বা তিনি কী করিয়া জানিবেন? বাধ্য হইয়া দুঃখের সঙ্গে ক্ষেত্রবাবু সে কথা জানাইলেন। তাঁহার এ ক্ষেত্রে করিবার কিছু নাই। কোনো পথই তিনি খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিতেছেন না।

মুশকিল হইল যে, এই সময় রাখাল মিত্তিরের ছেলেটি ভাঙা পেয়ালায় চা আনিয়া ক্ষেত্রবাবুর হাতে দিল। রাখালবাবুর স্ত্রী শুনিয়াছেন, তাঁহার স্বামীর একজন বিশিষ্ট প্রতিপত্তিশালী বন্ধু আসিবেন। চিঠি লইয়া ছেলে তাঁহার কাছে গিয়াছে। তিনি আসিলে দুঃখের একটা কিনারা হইবেই। এখন সেই ভদ্রলোকটি আসিয়াছেন শুনিয়া গৃহিণী তাড়াতাড়ি যথাসাথ্য অতিথিসৎকার করিয়াছেন। গরিবের ঘরে এই ভাঙা পেয়ালায় একটু চায়ের পিছনে যে কত ভরসা নির্ভরতা আবেদন নিহিত, ক্ষেত্রবাবু তাহা বুঝিলেন বলিয়াই চায়ের চুমুক যেন গলায় বাধিতেছিল। এখানে না আসিলেই হইত। পকেটে আছে মাত্র আট আনা পয়সা। তাই কি দিয়া যাইবেন! সে-ই বা কেমন দেখাইবে!

রাখালবাবু স্বয়ং এ দ্বিধা ঘুচাইয়া দিলেন : তা হলে উঠবেন? আচ্ছা, কিছু কি আপনার পকেটে আছে? যা থাকে! বাড়িতে খাওয়া হয় নি ও-বেলা থেকে—দুটো একটা টাকা—এমন বিপদে পড়ে গিয়েছি!

ক্ষেত্রবাবু ছেলেটির হাতে একটা আট-আনি দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন।

সমস্ত সন্ধ্যাটা যেন বিস্বাদ হইয়া গেল। সামনেই একটা ছোট পার্ক, ছেলেমেয়েরা দোলনায় দোল খাইতেছে, লাফালাফি করিতেছে, আনন্দকলরবমুখর পার্কের সবুজ ঘাসের উপর দুই-একটি অফিস-প্রত্যাগত কেরানি বসিয়া বিড়ি টানিতেছে, সোঁদালি ফুলের ঝাড় দুলিতেছে রেলিংয়ের ধারের গাছে, আলু-কাবলির চারিপাশে উৎসাহী অল্পবয়স্ক ক্রেতার ভিড় লাগিয়াছে। ক্ষেত্রবাবু একখানা বেঞ্চের এক কোণে গিয়া বসিলেন। বেঞ্চির উপর দুইটি লোক বসিয়া ঘরভাড়া আদায় করার অসুবিধা সম্বন্ধে কথাবার্তা বলিতেছে।

ক্ষেত্রবাবু ভাবিলেন, রাখালবাবুও তাঁহার মত স্কুলমাস্টার ছিলেন একদিন। আজ অক্ষম ও পীড়াগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তাই এই দুর্দশা। বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন, টুইশানিও জোটে না আর। স্কুলমাস্টারের এই পরিণাম!

বেশি দূর যাইতে হইবে না, তাঁহাদের স্কুলেই রহিয়াছেন নারাণবাবু—তিন কুলে কেহ নাই, আজীবন পূতচরিত্র, আদর্শ শিক্ষক, কিন্তু স্কুলের চোর-কুঠুরির ঘরে নির্জন আত্মীয়হীন জীবনযাপন করিতেছেন আজ আঠারো বছর কি বাইশ বছর, কে খবর রাখে? আজ যদি চাকুরি যায়, কাল আশ্রয়টুকুও নাই। ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনস্ক অবস্থায় ক্ষেত্রবাবু টুইশানিতে চলিয়াছেন, কে পিছন হইতে বলিল, স্যার, ভালো আছেন?

ক্ষেত্রবাবু পিছন ফিরিয়া চাহিলেন, একটি সুবেশ তরুণ যুবক। বেশ দামি সুট পরনে, চোখে কাঁচকড়ার চশমা। মৃদু হাসিয়া বলিল, চিনতে পারছেন না স্যার?

—না, কই, ঠিক—তুমি আমাদের স্কুলের?

—হ্যাঁ, স্যার। অনেক দিন আগে, এগারো বছর আগে—পাস করি। আমার নাম সুরেশ।

—সুরেশ বসু?

—না স্যার, সুরেশ মুখার্জি। সেবার সেই সরস্বতীপুজোর সময়ে আমাদের বারে ভাঁড়ার লুঠ করে ছেলেরা, মনে আছে? হেডমাস্টার ফাইন করেছিলেন সব ছেলেদের, মনে হচ্ছে স্যার?

—হ্যাঁ, একটু একটু মনে হচ্ছে যেন। তোমাদের ছেলেবেলার কথা হিসেবে এসব যত মনে থাকে, আমাদের তত মনে রাখবার ব্যাপার নয় বাবা। বুঝতেই পারচ! কী কর এখন?

—আজ্ঞে স্যার, রাঁচিতে চাকরি করি, ইঞ্জিনীয়ার।

—ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করেছিলে বুঝি বাবা?

—আজ্ঞে, শিবপুর থেকে পাস করে বিলেত যাই। আজ তিন বছর বিলেত থেকে ফিরে গভর্মেন্ট সার্ভিস করছি রাঁচিতে—পি, ডবলিউ. ডি.-তে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার।

—কী নাম বললে, সুরেশ মুখার্জি? এখন চেনা-চেনা মুখ বলে মনে হচ্ছে। অনেক দিনের কথা—আর কত ছেলে আসে-যায়, কাজেই সব মনে রাখা—

—নিশ্চয় স্যার, ঠিক কথা। পুরনো মাস্টারদের মধ্যে কে কে আছেন স্যার? যদুবাবু আছেন?

—হ্যাঁ, শ্রীশবাবু, থার্ড পণ্ডিত আছেন, নারাণবাবু আছেন—

—নারাণবাবু আজও আছেন স্যার? উঃ, অনেক বয়স হল তাঁর! তিনি কি স্কুলের সেই ঘরেই থাকেন—আচ্ছা, একবার দেখা করে আসব। বড্ড ইচ্ছে হয়। চাকরটা আছে, কেবলরাম?

—হ্যাঁ, আছে বইকি। যেয়ো না একদিন স্কুলে।

যুবকটি পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু সগর্বে একবার চারিদিকে চাহিলেন—লোকে দেখুক, এমন একজন সুট-পরা তরুণ যুবক তাঁহার পায়ের ধূলা লইতেছে। তাহাকে বেশ সুন্দর দেখিতে, সাহেবের মত চেহারা। কবে হয়তো ইহাকে পড়াইয়াছিলেন মনে নাই, তবুও তো তাঁহাদের স্কুলের ছাত্র। আজ দু পয়সা করিয়া খাইতেছে। বিলাতফেরত অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার—এরকম হয়তো কত ছাত্র কত দিকে আছে, সকলের সন্ধান তো জানা নাই।

এইটুকু ভাবিয়াই সুখ। এই ছাত্রের দল তাহাদের বাল্যজীবনের শতসুখস্মৃতির আধার, তাহাদের স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকদের ভুলে নাই; কেহ আছে বর্মায়, কেহ আছে সিমলায়, কেহ বা কুমায়ুন, শিলং, মসলিপত্তনে। তবুও দেশের আশা-ভরসাস্থল পুত্রপ্রতিম এই সব তরুণ দল একদিন তাঁহাদেরই হাতে চড়টা-চাপড়টা খাইয়া ইংরেজি ব্যাকরণের নিয়ম শিখিয়াছে, বীজগণিতের জটিল রহস্য বুঝিয়াছে—ভাবিয়াও আনন্দ হয়।

ক্ষেত্রবাবু পাশের গলিতে ঢুকিয়া টুইশানি-পড়া ছাত্রের বাড়ি কড়া নাড়িলেন।

.

চৈত্র মাস। ইস্টারের ছুটি আজই হইয়া গেল। যদুবাবু মেসে ফিরিয়া দেখিলেন, অবনী চিঠি লিখিয়াছে—তিনি যদি এই মাসের মধ্যে বউদিদিকে এখান হইতে লইয়া না যান, তবে সে বউদিদিকে কলিকাতায় আনিয়া যদুবাবুর মেসে রাখিয়া যাইবে।

মাত্র পাঁচটি টাকা হাতে—স্কুলের টাকা এ মাসে সামান্যই পাওয়া গিয়াছিল, কোন কালে খরচ হইয়া গিয়াছে মেসের দুই মাসের দেনা মিটাইতে। সামান্য কিছু স্ত্রীকে পাঠাইয়াছিলেন, এ পাঁচটা টাকা টুইশানির অগ্রিম আদায়ী আংশিক মাহিনা। স্ত্রীকে রাখিবার কোনো অসুবিধা হইত না বেড়াবাড়ি, যদি নিজের বাড়িঘর সেখানে থাকিত। কিন্তু পৈতৃক বাড়ি ভূমিসাৎ হওয়ার পরে যদুবাবু সেখানে আর যান নাই, সেই হইতেই পথে পথে, বাসায়। আজ দেড় বৎসরের উপর স্ত্রীকে বেড়াবাড়ি পরের সংসারে ফেলিয়া রাখিয়াছেন,—ইচ্ছা করিয়া কি? তাহা নয়। নিরুপায় হিসাবে।

এখন স্ত্রীকে গিয়া ওখান হইতে সরাইতে হইবে।

নতুবা ইতর অবনীটা সত্যসত্যই হয়তো স্ত্রীকে একদিন মেসে আনিয়া হাজির করিবে। লোকটা কাণ্ডাকাণ্ড-জ্ঞানহীন কিনা।

সাত-পাঁচ ভাবিয়া যদুবাবু টিকিট কাটিয়া সিরাজগঞ্জ-প্যাসেঞ্জারে রাত্রে রওনা হইলেন এবং শেষরাত্রে বগুলায় নামিয়া, স্টেশনে রাত কাটাইয়া, পরদিন সকালে সাত ক্রোশ হাঁটিয়া বেলা আড়াইটার সময় গলদঘর্ম ও অভুক্ত অবস্থায় বেড়াবাড়ি পৌঁছিলেন।

অবনী বলিল, আসুন দাদা, তা একেবারে ঘেমে—এঃ, ওরে নিতে কাপালীকে ডেকে এনে গাছ থেকে দুটো ডাব পাড়ার ব্যবস্থা কর। হাত-পা ধুয়ে নিন—তারপর ভালো সব?

যদুবাবু ঠাণ্ডা হইলেন। স্ত্রীকে দেখিয়া কিন্তু চমকিয়া উঠিলেন। অবনীর বিধবা দিদি ক্ষান্ত বলিল, বউ প্রায় কেবল জ্বরে ভুগচে ওদিকে—এই মাসখানেক ফাগুনে হাওয়া পড়ে একটু ভালো আছে। তাও দুবার পড়ল। ঘোর মেলেরিয়া এসব দিকে। দেখ না, ওই অবনীর ছেলেমেয়েগুলো ভুগে ভুগে হাড্ডি-সার। না একটু ওষুধ, না চিকিচ্ছে—কোথায় পাবে? সামান্য আয়, এদিকে সকালে উঠে দু কাঠা চালের খরচ। বোস, একটা ডাব কেটে আনি ভাই—

যদুবাবুর স্ত্রী কাঁদিতে লাগিল। বেচারির ভাগ্যে আজ প্রায় এক বছর পরে তাঁহার দর্শনলাভ ঘটিল।

যদুবাবু বলিলেন, কেঁদো না। এঃ, তোমার চেহারা দেখতে বড্ডই—

—হ্যাঁ, বড্ডই! মরে যাচ্ছিলাম কার্তিক মাসে। মরে বেঁচে উঠেছি। আচ্ছা, মানুষ কী করে এমন হতে পারে? এত করে চিঠি দিলাম, একবার চোখের দেখা—

—তুমি তো বললে চোখের দেখা! হাতে পয়সা না থাকলে তো আর—

—হ্যাঁ গো, যদি মরেই যেতাম, তা হলে একবার তোমার সঙ্গে দেখাটাও যে হত না!

—সে সবই বুঝলাম। আমার অবস্থাটা তোমরা দেখবে না তো? তোমাদের কেবল—

যদুবাবুর স্ত্রী ঝাঁজের সহিত বলিল, অমন কথা বলো না, মুখে পোকা পড়বে। আমি যেমন নীরবে সয়ে গেলাম এমন কেউ সহ্যি করবে না, তা বলে দিচ্ছি। রাত্রে জ্বরে পুড়েচি, শুধু মন হাঁপিয়েচে—মরে গেলে তোমাকে একটিবার চোখের দেখাটা হল না বুঝি, তাও কাউকে আমি বিরক্ত করি নি। চারিদিকে চাহিয়া সুর নিচু করিয়া বলিল, আর এমন চামার! এমন চামার! এক পয়সার সাবু না, এক পয়সার মিছরি না। বরং তুমি যে টাকা পাঠাতে মাসে মাসে, তা থেকে কেবল আজ দাও এক টাকা, কাল দাও আট আনা—ওই অবনী ঠাকুরপো! না দিলেও চক্ষুলজ্জা, ওদের বাড়ি, ওদের ঘরে জায়গা দিয়েচে। জায়গা দিয়েচে কি অমনি! ওই টাকা সিকেটা তো আছেই—আর এদিকে বাক্যির জ্বালা কী! এক-একদিন ইচ্ছে হত—এই সত্যি বলচি দুপুরবেলা— ব্রাহ্মণের সামনে মিথ্যে বলি নি যে, গলায় দড়ি দিয়ে মরি—

এই সময়ে অবনীর বিধবা দিদি (তিনি যদুবাবুরও বড়) ডাব কাটিয়া আনিয়া বলিলেন, বউ, এক গ্লাস জল নিয়ে এস, আর এই রেকাবিতে দুখানা বাতাসা—কোথায় কী পাব বল ভাই! বাতাসা দুখানা খেয়ে একটু জল —আমি গিয়ে ভাত চড়াই।

যদুবাবুর স্ত্রী জলহাতে আসিয়া বলিল, ঠাকুরঝি লোকটা এই বাড়ির মধ্যে ভালো লোক। নইলে বউ—ও বাবাঃ—খুরে খুরে নমস্কার! বলিয়া উদ্দেশে প্রণাম করিয়া জলের গ্লাসটা যদুবাবুর সম্মুখে নামাইয়া রাখিল।

বৈকালের দিকে অবনী বলিল, দাদার কি এখন গুডফ্রাইডের ছুটি?

—হ্যাঁ।

—কদিন?

—মঙ্গলবার খুলবে। ওই দিই ওকে নিয়ে যাব ভাবচি।

—তাই নিয়ে যান। এখানে বউদিদির শরীরও টিকছে না, মনও টিকছে না। তাই কখনও টেকে? আপনি রইলেন পড়ে কলকাতায়, উনি রইলেন এখানে। ছেলে নেই, পিলে নেই—আপনার বউমার কাছে কেবল কান্নাকাটি করেন, দুঃখ করেন। নিয়ে যান, সেই ভালো। তা ছাড়া আমাদের এখানে অসুবিধে। ঘরদোর নেই—দু’খানি মাত্র ঘর। আবার আমার ছোট ভগ্নীপতি শিশির নাকি আসবে শুনছি ছেলেমেয়ে নিয়ে—কতদিন আসে নি, তারা এলেই বা কোথায় থাকে? তাই বলি দাদাকে চিঠি লিখি দাদা এসে ওঁকে নিয়েই যান।

—না, তুমি যা করেছ, যথেষ্ট উপকার করেছ। এতদিন কে রাখে! যাই, একটু বেড়িয়ে আসি—

এ বেড়াবাড়ি গ্রামের বাহিরে খুব বড় বড় মাঠ—আধ মাইল কি তারও কম দূরে চুর্ণী নদী। নদীর ধারে খেজুরগাছ, নিমগাছ ও ভাঁটসেওড়ার বন। এখন নিমফুলের সময়, চৈত্রের তপ্ত বাতাসে নিমফুলের সুবাস মাখানো। ঘেঁটুফুলের দল কিছুদিন আগে ফুটিয়া শেষ হইয়া গিয়াছে—এখন শুধু রাঙা রাঙা সুঁটির মেলা ভাঁটগাছের মাথায় মাথায়। উত্তর দিকের মাঠে প্রকাণ্ড একটা কচিপাতা-ভরা বটগাছের শীর্ষদেশ মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া। কিছুদিন আগে সামান্য বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, চষা- ক্ষেতের মাঝে মাঝে জল জমিয়া ছিল, এখনও আধশুকনো কাদায় তার চিহ্ন আছে। একটা তুঁতগাছের তলায় অনেক শুকনো তুঁতফল পড়িয়া আছে। যদুবাবু একটা তুঁতফল কুড়াইয়া মুখে দিলেন—মনে পড়িল, বাল্যকালে এই সময় তুঁতফল খাওয়ার সে কত আগ্রহ! কোথায় গেল সে সব সুখের দিন! বাবা গোয়াড়ী কোর্টে কাজ করিতেন, শনিবারে শনিবারে গ্রামের বাড়িতে আসিতেন, হাঁড়ি-ভর্তি খাবার আনিতেন ছেলেমেয়ের জন্য। তাঁদের বাড়িতে মোংলা বলিয়া এক গোয়ালা-ছোঁড়া থাকিত। সরভাজা খাইবার লোভে সে ছুটিয়া গিয়া দাঁড়াইত—কর্তা হাঁড়ি হাতে আসিতেছেন, না শুধু হাতে আসিতেছেন দেখিবার জন্য।

নদীতে ডিঙি-নৌকায় জেলেরা মাছ ধরিতেছে। যদুবাবু বলিলেন, কী মাছ রে?

—আজ খয়রা আছে কর্তা।

—দিবি চার পয়সার, যাব? অনেকদিন দেশের খয়রা মাছ খাই নি। টাটকা খয়রা মাছটা—

যদুবাবু অবনীর দিদির হাতে মাছ দিয়া বলিলেন, ও দিদি, এই নাও। দেশের খয়রা মাছ কত কাল খাই নি!

রাত্রে পাড়ায় এক জায়গায় সত্যনারায়ণের সিন্নি উপলক্ষে যদুবাবু অবনীর সঙ্গে তাহাদের বাড়ি গেলেন। বাড়ির কর্তা যদুবাবুকে যথেষ্ট খাতির করিয়া বসাইল, তামাক সাজিয়া আনিল নিজের হাতে। তাহার বড় ছেলের একটা চাকরি হইতে পারে কিনা কলিকাতায়? ছেলেটিকে ডাকিয়া আনিয়া পরিচয় করাইয়া দিল। ম্যাট্রিকে দুইবার ফেল করিয়া সম্প্রতি আজ বছরখানেক বসিয়া আছে। পূর্বেকার অভিজ্ঞতা হইতে যদুবাবু সাবধান হইয়াছিলেন, আবার কলিকাতার মেসে কি বাসায় জুটিয়া উৎপাত করিতে শুরু করিলেই চক্ষুস্থির। পাড়াগাঁয়ের লোককে বিশ্বাস নাই। সুতরাং তিনি বলিলেন, তিনি চেষ্টা করিবেন, তবে এখন কিছু বলিতে পারেন না— আজকাল কত বি. এ. এম. এ. পাস ফ্যা-ফ্যা করিতেছে, তা ম্যাট্রিক!

রাত্রে স্ত্রীকে বলিলেন, তা হলে আর একটা মাস এখানে—

—না, তা হবে না। আমায় নিয়ে যাও এবার।

—কিন্তু কোথায় নিয়ে যাই বল তো?

—তা তুমি বোঝ।

যদুবাবু মুখ ভ্যাংচাইয়া বলিলেন, তুমি বোঝ! বুঝি। কী, সেটা আমায় দেখিয়া দাও! কলকাতায় কি বাসা ঠিক করে রেখে এসেছি যে তোমায় নিয়ে ওঠাব? উঠবে কোথায়? শেয়ালদা ইস্টিশানে বসে থাকবে?

যদুবাবুর স্ত্রী কাঁদিতে লাগিল।

—আঃ, কী মুশকিলেই পড়েছি বিয়ে করে! ঝাড়া-হাত-পা থাকলে আজ আমার ভাবনা কি? তোমার ভাবনা ভাবতে ভাবতেই প্রাণ গেল।

যদুবাবুর স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, আমার ভাবনা কী ভাবতে হচ্ছে তোমায়? ফেলে রেখেছ এখানে আজ দেড় বছর—জ্বরে ভুগে ভুগে আমার শরীরে কিছু নেই, তাও তোমাকে কি কিছু বলেছি? মুখনাড়া আর খোঁটা দুটি বেলা হজম করতে হত যদি আমার মত, তবে বুঝতে! এততেও তোমার কাছে ভালো হলাম না। তার চেয়ে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরি, তুমি ঝাড়া-হাত-পা হও, আপদ চুকে যাক।

—আচ্ছা থাম থাম, রাত-দুপুরে কান্নাকাটি ভালো লাগে না। ঘুম আসচে। ওরা শুনতে পাবে—এক ঘর, এক দোর, দেখি যা হয়—

—তুমি এবার না নিয়ে গেলে অবনী ঠাকুরপো শুনবে নাকি? স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ হয়েছে এবার আমাকে তোমার সঙ্গে ওরা পাঠিয়ে দেবেই। ওদের বাড়িতে জায়গা হচ্চে না—ওর ভগ্নীপতি নাকি আসবে শুনছি এ মাসের শেষে। সত্যিই তো, ওদের অসুবিধে হয় বইকি। এতদিন তো রাখলে।

—হ্যাঁ, রেখেছে তো মাথা কিনেচে কিনা! ভারি করেচে! আর আমার মেসে গিয়ে যে সাত দিন থেকে এল, আজ সিনেমা রে, কাল ইয়ে রে, তখন?

—তুমি বুঝি অবনী ঠাকুরপোকে টাকা দাও নি সেবার, সে কী খোঁটা আর তোমার নামে কী সব কথা আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে দিনরাত! আমি বলি, আর তো আমার সহ্যি হয় না, এক দিকে চলেই যাই কি, কী করি! এত কষ্ট গিয়েছে সে সময়—

—আচ্ছা, থাক সে-সব কথা এখন। রাত হয়েছে ঘুম আসচে—সারাদিন খাটুনি আর রাত্তিরকালে ভ্যাজর-ভ্যাজর ভালো লাগে না।

যদুবাবু বোধ হয় ঘুমাইয়া পড়িলেন। তাঁহার স্ত্রী নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল। কিছুকাল পরে বলিল, ঘুমুলে নাকি? ওগো!

যদুবাবু বিরক্তির সুরে বলিলেন, আঃ, কী?

—তোমার পায়ে পড়ি, আমায় এবার এখানে রেখে যেয়ো না। আমি আর সহ্যি করতে পারছি নে—তুমি বোঝ, কখনও তো তোমায় এমন করে বলি নি— কেবল ওই ঠাকুরঝির জন্যে এখানে এতদিন থাকতে পেরেচি। নইলে কোন কালে এতদিন—একবার রটিয়ে দিলে, তুমি নাকি বিয়ে করেছ, আমার ছেলেপিলে হল না বলে। বলে, দাদা সেইজন্যেই বউদিদিকে ত্যাগ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে রেখে গিয়েছে। সে কত কথা! আমি ভেবে কেঁদে মরি। শুধু ঠাকুরঝি আমায় বোঝাত, বউ, তার কি এখন বিয়ের বয়স আছে যে বিয়ে করবে? তুমি ওসব শুনো না।

—তুমিও কি ভাব নাকি আমার বিয়ের বয়স নেই?

—বয়েস থাকলে কী হবে, একটা বিয়ে করে তাই খেতে দিতে পার না, দুটো বিয়ে করে তোমার উপায় হবে কী? কুঁজোর সাধ হয় চিত হয়ে শুতে—

এই কথায় যদুবাবুর পৌরুষের অভিমান ভীষণভাবে আহত হওয়ায় তিনি আর কোনো কথা না বলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন এবং বোধ হয় খানিকক্ষণ পরেই গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন।

চুনি এবার থার্ড ক্লাসে উঠিল। চেহারা আরও সুন্দর হইয়াছে, ওষ্ঠে গোঁফের ঈষৎ রেখা দেখা দিয়াছে।

নারাণবাবু পড়াইতে গিয়া তাহার সঙ্গে গল্প করেন নানা বিষয়ে—চুনিকে ছাড়িয়া যেন উঠিতে ইচ্ছা হয় না। চুনির মধ্যে একটি সুদুর্লভ রহস্য ও বিস্ময়ের ভাণ্ডার যেন গুপ্ত আছে, নারাণবাবু নানা কথায় ও প্রশ্নে সেই রহস্যভাণ্ডারের সন্ধান খুঁজিয়া বেড়ান। চুনি আসিবামাত্র নারাণবাবু কেমন আত্মহারা হইয়া যান—ভালো করিয়া পড়াইতেও যেন পারেন না, কেবল তাহার সহিত গল্প করিতে ইচ্ছা করে। অথচ চুনি তাঁহাকে কী দিতে পারে? তাঁহাকে সে রাজা করিয়া দিবে না, নারাণবাবু তাহা ভালোই জানেন; তবুও কেন এমন হয়, কে জানে? মাস্টার পড়াইতে আসিয়া ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকায়, উঠিতে পারিলে বাঁচে; অথচ নারাণবাবুর উঠিতে ইচ্ছা করে না, রাত্রি বেশি হইয়া যায়, চুনি পান্না ঘুমে ঢুলিয়া পড়ে, কলিকাতার কলকোলাহল নীরব হইয়া আসে। নারাণবাবু ধমক দিয়া বলেন, এই চুনি পান্না, ঢুলছিস নাকি? পান্না চমকিয়া উঠিয়া বইয়ের পাতায় মন দিবার চেষ্টা করে, নিচু সলজ্জ সুরে বলে, ঘুম আসছে স্যার, রাত অনেক হল—

চুনির মায়ের সুর খোলা দ্বারপথে ভাসিয়া আসে : আজ তোদের কি হবে না নাকি? সারারাত বসে ভ্যাজর ভ্যাজর করলেই বুঝি ভালো পড়ানো হয়?

পরে ঈষৎ নেপথ্য হইতে শ্রুত হইল সেই একই কণ্ঠের সুর : বুড়ো মাস্টারটা বসে বসে করে কী এত রাত পর্যন্ত? এত করে বলি ওঁকে, বুড়ো মাস্টার বদলে ফেল—বুড়ো দিয়ে কি নেকাপড়া হয়?

চুনি লাফাইয়া উঠিয়া বাড়ির মধ্যে মাকে হয়তো বা মারিতে ছোটে।

নারাণবাবু ধমক দিয়া চিৎকার করিয়া বলেন, এই চুনি, কোথায় যাস? পান্না যা তো, তোর দাদাকে ধরে নিয়ে আয়।

কিছুক্ষণ পরে চুনি ছুটাছুটিতে ঘর্মাক্ত রাঙা মুখে আসিয়া বসিয়া হাঁপাইতে থাকে।

—কোথায় গিয়েছিলি?

—কোথাও না স্যার।

—এই সব জ্ঞান হচ্চে তোমার, না?

—না স্যার। আপনি তাই সহ্য করেন, আপনার খেয়াল নেই কোনো দিকে। আমাদের বাড়িতে আসেন, তা আমাদের কত ভাগ্যি। রোজ রোজ মা এরকম করবে আমি—

—ছিঃ, মার সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে নেই ছেলের। মায়ের বিচার কি ছেলে করবে? আমারই দেরি হয়ে গিয়েছে আজ, উঠি বরং—

—না স্যার, বসুন না আপনি।

চুনির মার কণ্ঠস্বর পুনরায় দ্বারপথে শ্রুত হইল : খাবি নে পোড়ারমুখো ছেলে? বামনী কি এত রাত পর্যন্ত তোমাদের ভাত নিয়ে বসে থাকবে নাকি?

নারাণবাবু লজ্জিত কৈফিয়তের সুরে অন্তরালবর্তিনীকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, হ্যাঁ বউমা, আমি এই যে যাই—যাচ্ছি—একটু দেরি হয়ে গেল আজ—

ঈষৎ নম্রসুরে উদ্দেশে উত্তর আসিল, ভাত নিয়ে থাকতে হয় ঠাকুরঝি, তাই বলি। নইলে মাস্টার পড়াচ্ছে, পড়াক না—আমি কি বারণ করি?

নারাণবাবু গলির ভিতর দিয়া চলিয়া আসিলেন, মনে অভূতপূর্ব আনন্দ। চুনি তাঁহার দিকে হইয়া মাকে মারিতে গিয়াছিল, তাঁহাকেই চুনি তবে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, ভক্তি করে! কেন এ আনন্দ রাখিবার জায়গা নাই, বৃদ্ধ নারাণবাবু তা বুঝিতে পারেন। তাঁহার কেহ আপনার জন নাই এ বিশাল দুনিয়ায়; তবু চুনি আছে, বড় হইলে তাঁহাকে দেখিবে।

স্কুল-বাড়ির বড় ছাদে রাত্রে আহারাদির পর নারাণবাবু পায়চারি করেন—বহুকালের অভ্যাস। আকাশের নক্ষত্ররাজি এই তেতলার ছাদ হইতে বেশ দেখা যায় বলিয়াই নারাণবাবু এই সময়ে উন্মুক্ত আকাশতলে বেড়াইতে ভালোবাসেন। ডাকিলেন, ও জগদীশ ভায়া, খাওয়াদাওয়া হল?

টিচারদের ঘরের পাশে ক্ষুদ্র টিনের একখানি চালায় জ্যোতির্বিনোদ মাছ ভাজিতেছিলেন, উত্তর দিলেন, না দাদা, এই ছেলে পড়িয়ে এসে রান্না চড়িয়েছি। ও দাদা, আজ কী হয়েছিল জানেন?—বলিতে বলিতে জ্যোতির্বিনোদ বাহিরে আসিলেন :—আজ এই লালবাড়ির সেই যে ছেলেটা ছাদে উঠে ডন কষত, সে আজ নতুন বউ নিয়ে বাড়ি এসেছে—পাড়াগাঁয়ের বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল, আজ বউ নিয়ে এল।

নারাণবাবু আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন বউ হল?

—খাসা বউ হয়েছে—ওরই মত ফরসা, দু’জনে ছাদে বেড়াচ্ছিল, খুব হাসিখুশি—

—আহা, তা হোক, তা হোক—

—যাই দাদা, মাছ পুড়ে গেল কড়ায়।

কী জানি কেন, নারাণবাবুর হঠাৎ মনে পড়িল একটা ছবি। চুনি বিবাহ করিয়া বউ আনিয়াছে, যেমন চমৎকার রূপবান ছেলে, তেমনি লক্ষ্মী-প্রতিমার মত বধূ। পুত্রবধূর সাধ তাঁহার মিটিয়াছে। চুনি বলিতেছে, আমার বউ স্যার, আপনার সেবা করবে না তো কার সেবা করবে? চুনি পুরীতে বউ লইয়া বেড়াইতে গিয়াছে, সঙ্গে তাঁহাকে লইয়া গিয়াছে, কারণ তাঁহার শরীর খারাপ। পুত্রের কর্তব্য করিয়াছে সে।

চুনির বউ বলিতেছে, বাবা, আপনার পায়ে কি এ বেলা মালিশ করতে হবে?

স্বপ্নাচ্ছন্ন অতীত দিবসগুলির কুয়াশা ভেদ করিয়া কত অস্পষ্ট মুখ উঁকি মারে! দুপুরের সময় টিফিনের ছুটিতে কিংবা বেলা পড়িলে কতবার তিনি এই রকম ছাদে বেড়াইতেন, এই ছাদটিতে উঠিলেই সেই পুরনো দিন, তাহাদের সঙ্গে জড়িত কত মুখ মনে পড়ে!

একখানি মুখ মনে পড়ে—সুন্দর মুখখানি, ডাগর চোখে নিষ্পাপ দৃষ্টি, আট-ন’ বছরের ছেলে, নাম ছিল সুদেব। মুখের মধ্যে লেবেনচুষ পুরিয়া দিত, তখন নারাণবাবুর মাথার চুলে সবে পাক ধরিয়াছে, টিফিনের সময় রোজ পাকা চুল আটগাছি দশগাছি তুলিয়া দিত। বলিত, আপনাকে ছেড়ে কোনো স্কুলে যাব না স্যার।

তারপর আর ভালো মনে হয় না—অগণিত ছাত্রসমুদ্রে দূর হইতে দূরান্তরে তাহাদের অপস্রিয়মাণ মুখ কখন যে হঠাৎ অদৃশ্য হইয়া গিয়াছিল, তার হিসাব মনের মধ্যে খুঁজিয়া মেলে না আর। জীবনের পথ বহু পথিকের আসা-যাওয়ার পদচিহ্নে ভরা, কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট।

ঘরে আসিয়া শুইবার ইচ্ছা হইল না, নারাণবাবু আবার ডাকিলেন, ও জগদীশ, কী করলে রান্নাবান্না?

জ্যোতির্বিনোদ অন্নপিণ্ডরুদ্ধ-স্বরে বলিলেন, খেতে বসেচি দাদা।

—আচ্ছা, খাও খাও—

এই স্কুলবাড়ির ছোট ঘরটিতে কত কাল বাস! কত সুপরিচিত পরিবেশ, কত দূর অতীতের স্মৃতিভরা মাস, বৎসর, যুগ! আশপাশের বাড়ির গৃহস্থজীবনের কত সুখ, আনন্দ, সঙ্কট তাঁহার চোখের উপর ঘটিয়া গিয়াছে। মনে মনে তিনি এই অঞ্চলের পাড়াসুদ্ধ ছেলে-মেয়ে তরুণী কন্যা-বধূদের বুড়ো দাদু, যদিও তাহাদের মধ্যে কেহই তাঁহাকে জানে না, চেনে না। আদর্শ শিক্ষক অনুকূলবাবুর স্মৃতিপূত এই বিদ্যালয়গৃহ, এ জায়গা যে কত পবিত্র—কী যে এখানে একদিন হইয়া গিয়াছে, তার খোঁজ রাখেন শুধু নারাণবাবু।

আজ মনে এত আনন্দ কেন?

কী অপূর্ব আনন্দ, একটা তরুণ মনের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি আজ তিনি আকর্ষণ করিতে পারিয়া ধন্য হইয়াছেন। অনুকূলবাবু বলিতেন, দেখ নারাণ, একটা বেলগাছে বছরে কত বেল হয় দেখেচ? একটা বেলের মধ্যে কত বিচি থাকে, প্রত্যেক বিচিটি থেকে এক হাজার মহীরূহ জন্মাতে পারে। কিন্তু তা জন্মায় না। একটা বেলগাছের ষাট-সত্তর বৎসরব্যাপী জীবনে অত বিচি থেকে গাছ জন্মায় না—অন্তত দুটি বেলচারা মানুষ হয়, বড় হয়, আবার বহু বেল ফল দেয়। বহু অপচয়ের হিসেব কষেই এই পুষ্টির ইঞ্জিনীয়ারিং দাঁড় করিয়ে রেখেছেন ভগবান। তার মধ্যেই অপচয়ের সার্থকতা। স্কুলের সব ছেলে কি মানুষ হয়? একটা স্কুল থেকে ষাট বছরে দুটো-একটা মানুষ বার হলেও স্কুলের অস্তিত্ব সার্থক। এই ভেবেই আনন্দ পাই নারাণ। প্রত্যেক শিক্ষক, যিনি শিক্ষক নামের যোগ্য—এই ভেবেই তাঁর আনন্দ ও উৎসাহ। দেশের সেবায় সব চেয়ে বড় অর্ঘ্য তাঁরা যোগান—মানুষ।

জ্যোতির্বিনোদ নারাণবাবুর সামনে বিড়ি খান না। আড়ালে দাঁড়াইয়া ধূমপান শেষ করিয়া ছাদের এধারে আসিয়া বলিলেন, দাদা, এখনও খান নি? রাত অনেক হয়েছে।

—না, খাব না, শরীরটা আজ তেমন ভালো নেই

—কী হয়েছে দাদা? দেখি, হাত দেখি? তাই তো, আপনার যে জ্বর হয়েছে। ছাদে ঠাণ্ডা লাগিয়ে বেড়াবেন না, বেশ গা গরম। চলুন, নীচে দিয়ে আসি।

—বোস বোস। এ একটু-আধটু গা-গরমে কিছু আসবে-যাবে না। আকাশের নক্ষত্র চেন? তুমি তো জ্যোতিষ নিয়ে ব্যবসা কর, অ্যাস্ট্রনমি জান? ওই যে এক-একটা নক্ষত্র দেখছ—এক-একটা সূর্য। আমি যদি বলি, এই পৃথিবীর মত বহু হাজার পৃথিবী ওই সব নক্ষত্রের মধ্যে আছে, তা হলে তুমি কি তার প্রতিবাদ করতে পার?

—আজ্ঞে না দাদা, প্রতিবাদ তো দূরের কথা—আমি কথাটি বলব না, আপনি যত ইচ্ছে বলে যান। যখন ও নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি—আপনি যেমন জ্যোতিষ আলোচনা করেন নি কখনও, বলেন ওসব মিথ্যে—

—মিথ্যে বলি নে, আনসায়েণ্টিফিক বলি।

—ওই একই কথা দাদা। দু পয়সা করে খাই, কাজেই বিশ্বাস করি।

নারাণবাবু ঘরে আসিয়া শুইয়া পড়িলেন। রাত্রে ভয়ানক পিপাসা। সমস্ত গায়ে ব্যথা। ঘুমের ঘোরে আজ জ্বরের ঘোরে কত কী অস্পষ্ট স্বপ্ন দেখিলেন—চুনির মুখ, তাঁহার ছেলে নাই, কেহ কোথাও নাই। কেন! এত ছাত্র আছে, চুনি আছে, শিয়রে চুনি বসিয়া তাঁহার সেবা করিতেছে।

পরদিন নারাণবাবু সকালে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারিলেন না। দুই-চার দিন গেল, তবুও জ্বর কমে না। ক্ষেত্রবাবু ও রামেন্দুবাবু প্রায়ই আসিয়া বসিয়া থাকেন। হেডমাস্টার প্রথমে নিজের ঔষধের বাক্স হইতে বাইওকেমিক দিলেন, তারপর ডাক্তার ডাকাইলেন। জ্যোতির্বিনোদ কোথা হইতে নিজের দেশের এক কবিরাজ আনিলেন। ছাত্রেরা কেহ কেহ দেখিয়া গেল। পালা করিয়া রাত জাগিতেও লাগিল।

সকালে স্কুলের মাস্টারেরা দেখিতে আসিয়া খবরের কাগজে একটা খুনের সংবাদ শুনাইয়া গিয়াছিল। নারাণবাবু শুইয়া ভাবিতেছিলেন, মানুষে কী করিয়া খুন করে? একবার তিনি এই স্কুলের ঘরেই রাত্রে আলো জ্বালিয়া পড়িতেছিলেন, ডেয়ো-পিঁপড়ের দল আসিয়া জুটিল লণ্ঠনের আশেপাশে—চাপড় মারিয়া গোটাতিনেক ডেয়ো-পিঁপড়ে মারিয়াছিলেন। তারপর সে কী দুঃখ তাঁহার মনে! একটা ডেয়ো-পিঁপড়ে আধ-মরা অবস্থায় ঠ্যাং নাড়িয়া চিত হইয়া ছটফট করিতেছিল, সেটাকে বাঁচাইবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু শেষ পর্য়ন্ত কিছুতেই সেটাকে বাঁচানো গেল না। নারাণবাবুর মনে হইল, তিনি জীবহত্যা করিয়াছেন—দুঃখ ও অনুতাপে নিজেকে অতি নীচ বলিয়া বিবেচনা হইল। কী জানি, মানুষকে বিচার করার ভার মানুষের উপর নাই। তিনি যে খুনি নহেন, তাহা কে বলিবে?

নারাণবাবু শুইয়া যেন সমস্ত জীবনের একটা ছবি চোখের সামনে খেলিয়া যাইতে দেখিতে পান। তারাজোল গ্রামের উত্তরে প্রকাণ্ড তালদিঘি, তাহার পাড়ে ঘন তালের বন, কোনকালে রাঢ় অঞ্চলের ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতেরা সেই দিঘির পাড়ে মানুষ মারিত। কাঁটাজঙ্গলের ঝোপ, আঁচোড়বাসক ফুলের গাছ নিবিড় হইয়া উঠিয়া মানুষের উগ্র লোলুপতার লজ্জা শ্যামল শান্তি ও বনকুসুমের গন্ধে ঢাকিয়া দিয়াছে। চীনা পর্যটক আই সিং যেমন বলিয়াছেন—মন ও অন্তঃকরণের তৃষ্ণা হইতেই দুঃখ আসে, পুনর্জন্ম আসে। কিন্তু তৃষ্ণা দূর কর, লোভকে ঢাকিয়া মনে শান্তি স্থাপন কর—ভ্রমণসমুদ্রে মানবাত্মার পরিভ্রমণ শেষ হইবে। না, কী যেন ভাবিতেছিলেন—তারাজোল গ্রামের তালদীঘির কথা। মনের মধ্যে উলটা-পালটা ভাবনা আসিতেছে।

পঁয়তাল্লিশ বৎসর পূর্বের সেই হুগলী জেলার অন্তঃপাতী ক্ষুদ্র গ্রামখানি আজ আবার স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, মুখুজ্জেবাড়ির ছেলে ছুনু ছিল সঙ্গী, ছুনুর সঙ্গে বাঁশতলায় বাঁশের শুকনা খোলা কুড়াইয়া আনিয়া নৌকা করিতেন। একবার তেঁতুলগাছে উঠিয়া তেঁতুল পাড়িতে গিয়া হাত ভাঙিয়াছিলেন, সাত ক্রোশ হাঁটিয়া দামোদরের বন্যা দেখিতে গিয়া পথে এক গ্রামে কামারবাড়ি। রাত্রে তিনিও তাঁহার দুইজন বালক সঙ্গী চিঁড়া-দুধ খাইয়া তাহাদের দাওয়ায় শুইয়াছিলেন—যেন কালিকার কথা বলিয়া মনে হইতেছে। কতকাল তারাজোল যাওয়া হয় নাই!

কেহ নাই আপনার লোক সে গ্রামে। বহুদিন আগে পৈতৃক বাড়ি ভাঙিয়াচুরিয়া লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। আজ প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে তিন দিনের জন্য তারাজোল গিয়া প্রতিবেশীর বাড়ি কাটাইয়া আসিয়াছিলেন, আর যান নাই। তখনই বাল্যদিনের সে বাড়িঘর জঙ্গলাবৃত ইষ্টকস্তূপে পরিণত হইয়াছে দেখিয়াছিলেন—হ্যাঁ, প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে।

নারাণবাবু মনে মনে হিসাব করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিলেন।

জ্যোতির্বিনোদ ও যদুবাবু একসঙ্গে ঘরে ঢুকিলেন।

যদুবাবু বলিলেন, কেমন আছেন দাদা? এই দুটো কমলালেবু—ওহে জ্যোতির্বিনোদ, দাও না রস করে।

শ্রীশবাবু উঁকি মারিয়া বলিলেন, কে ঘরে বসে?

যদুবাবু বলিলেন, এই আমরাই আছি। এস শ্রীশ ভায়া।

—দাদা কেমন?

—এই একটু কমলাবেবুর রস খাওয়াচ্ছি।

নারাণবাবুর তৃষিত দৃষ্টি দোরের দিকে চাহিয়া থাকে। দুই দিন, তিন দিন, কোনো দিনই চুনিকে দেখিতে পান না। চুনি আসে না কেন? বোধ হয় সে শোনে নাই তাঁহার অসুখের কথা।

সকলে চলিয়া যায়। গভীর রাত্রি। টিমটিম করিয়া আলো জ্বলিতেছে।

উত্তর মাঠে গ্রামের বাঁশবনের ও-পারে দুইটি লোক আকন্দ গাছের পাকা ও ফাটা ফল সংগ্রহ করিয়া বেড়াইতেছে—তুলা বাহির করিয়া খেলা করিবে। তিনি আর ছুনু। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বের তারাজোল গ্রাম। ছুনু বাঁচিয়া নাই—প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে মারা গিয়াছে।…

—কে?

—আমি কমলেশ স্যার, আমাদের নাইট-ডিউটি আজ। বিমলও আসছে।

—নারাণবাবু বলিলেন, হ্যাঁ কমলেশ, চুনিকে চিনিস?

—না স্যার।

—থার্ড ক্লাসে পড়ে—ভালো নামটা কী যেন! দীপ্তি বোধ হয়—

—হ্যাঁ স্যার।

—কাল একবার বলবি বাবা—

নারাণবাবু হাঁপাইতে লাগিলেন। কথা বলিবার শ্রম সহ্য হয় না।

—বলব স্যার, আপনি বেশি কথা বলবেন না—গরমজলটা করি। মালিশটা—

পরদিন সকাল হইতে নারাণবাবু আর মানুষ চিনিতে পারেন না।

কমলেশ ও বিমল চুনিকে গিয়া বলিল। চুনি মহাব্যস্ত, আজ তাহাদের পাড়ার ম্যাচ, তাহাকে ব্যাকে খেলিতে হইবে। আচ্ছা, খেলার পর বরং—রাত্রেই সে চেষ্টা করিয়া দেখিবে।

চুনি আসিয়াছিল, কিন্তু নারাণবাবু আর তাহাকে চিনিতে পারেন নাই। লোকে বলিতেছিল, তাঁহার জ্ঞান নাই। সে কথা আসলে ঠিক নয়। তিনি তখন তারাজোল গ্রামের মাঠে, বনে, দামোদরের বাঁধে বাল্যসঙ্গী ছুনু আর গদাই নাপিতের সঙ্গে আকন্দগাছের ফলের তুলা সংগ্রহ করিতে ব্যস্ত ছিলেন, পঞ্চাশ বৎসর আগের দিনগুলির মত। চুনির কণ্ঠস্বরও তাঁহাকে সেখান হইতে ফিরাইতে পারিল না।

কখনও বা অনুকূলবাবু তাঁহাকে বলিতেছিলেন, নারাণ, মানুষ তৈরি করতে হবে। তুমি আর আমি দুজনে যদি লাগি—।…বউবাজারে এই স্কুলের একটা ব্রাঞ্চ খুলব সামনের বছর থেকে। তুমি হবে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। সব বেলফলের বিচি থেকে কি চারা হয়? বহু অপচয়ের অঙ্ক হিসেবে ধরেই ভগবানের এই সৃষ্টি। ভগবানের গৃহস্থালী কৃপণের গৃহস্থালী নয় নারাণ।…

স্কুল-মাস্টারের মধ্যে সবাই তাঁহার খাটিয়া বহন করিয়া নিমতলায় লইয়া গেল। হেডমাস্টার নিজের পয়সায় ফুল কিনিয়া দিলেন। অনেক ছাত্রও সঙ্গে গেল। শুধু ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল নয়, আশেপাশের দুই-তিনটি স্কুলও এই আদর্শ শিক্ষাব্রতীর মৃত্যুতে একদিন করিয়া বন্ধ রহিল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress