সহযাত্রী
অসহ্য হয়ে উঠেছে ক্রমশ! আর পারছেনা!
পুরুলিয়া লোকালের লেডিস কামরার নিত্যযাত্রী মিতালী। অভদ্র কিছু মানুষের অবাঞ্ছিত আচরণ এড়াতে এই লেডিসে নিত্য দিনের রুটিন মাফিক যাওয়া আসা। পুরুলিয়া থেকে বার্নপুর তার গন্তব্য। সেখানের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। ছুটির পর আবার ফিরে আসে পুরুলিয়ায়।
যাতায়াতের এই পথটুকু, যদিও পথ অনেকটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে ক্রমশ । এক তো কখনো পাকা কুলের গন্ধের সঙ্গে মাছের গন্ধ, কখনো পাকা তালের কিংবা কাঁঠালের মিশ্রিত গন্ধে গা ঘুলিয়ে উঠে।
একটা রুমালে সেন্ট মাখিয়ে হাতে রাখে। নাকচাপা দিতে কাজে লাগে। যদিও বা কোনমতে সহ্য করা যায়,কিন্তু কামরা জুড়ে হাট বসিয়ে দিতে কার্পণ্য তো করেই না ,কখনো আবার উচ্চ কণ্ঠে ঝগড়ার জ্বালায় প্রাণ ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়।
– চৈখ থাকত্যেও কানার
মতন চইল্যছিস,পা ট যে মাড়াই্যন দিলি,
– হাঁ, ভাল, চৈখ গতর তুইল্যে কথা বই্যলবি নাই বই্ল্যে দিলাম!
দ্বিগুণ তোড়ে উত্তর কানে আসে-
– কী কই্যরবি তুই! অ্যাঁ, কী কই্যরবি!
– কী আর কই্যরব,সবোই আমার লল্যাটের লিখন।
সোয়ামী টই আমাকে জ্বলাই খ্যালেক।
– সেই ক্যুন কাঁচা বয়েস হৈত্যে –
গায়ের রক্ত জল কৈরে-
গটা জীবনট কাট্যাই দিলি !
আর এই বুড়ান্তি কালে ঘাড় ধৈরে খেদাড়্যে দিছ্যা!
– কার কন্হ পিতিবাদ নাই, সাইধ্যে কি সোব ছাড়্যে এই বুড়ান্তি কালে……
– উয়ার কি এমন বেহদ্দ কৈরেছ্য শুনি?
আরেকজন বলে ওঠে। উত্তরে মিনুর মা বলে একজন বলে
– উয়াকে মাইরে ধৈরে ডাঙ করে দিল্যক ন,
– শুয়্যে বৈস্যে আর মদ খাই্যয়েঁই কাট্যাই দিল ন !
এমনি করে প্রায় প্রতিদিনই বুলির মা আর গেনিদিদির মধ্যে কথা কাটাকাটি ঝগড়া দিয়ে শুরু হয়ে মন্দ বরাতের আক্ষেপে শেষ হয়। গেনিদিদির স্বামী এখন খাটতে পারে না বলে তাকেই এখন রোজগারের তাগিদে পথে নামতে হয়েছে। বুলির মা এক বছরের বুলিকে নিয়ে বিধবা হলে, গাঁয়ের এর তার ঘরে কাজকর্ম করে বুলিকে বড়ো করেছে, বিয়ে দিয়েছে ধার দেনা করে। সেই ধার শোধ করতেই হাটে আনাজপাতি বেচতে যায়।
এমনি করেই তারস্বরে চলতে থাকে ওদের সুখ দুঃখের আলাপ আলোচনা , কথায় কথায় ওদের গন্তব্য মুরারডিও এসে যায় একসময়। নেমে পড়ে ওরা, ঝুড়ি ডালা ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে নেমে পড়ে সব।
ফেরার সময় আবার সেই এক চিত্র।মুরারডি এলেই খালি ঝুড়ি ডালা নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে সব উঠে পড়ে, আবার সেই রকম উচ্চ স্বরে সুখ দুঃখের ভাব বিনিময় চলতে থাকে পুরুলিয়া না পৌঁছানো অবধি।
এর মধ্যেই মিতালী ওদের কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছে ওদের কার কী নাম। কেউ আবার ছেলে মেয়ের মা হিসাবেও পরিচিত। কম বয়সী যে মেয়েটি কয়েকদিন হলো আসছে তার নাম বাসন্তী, এরা ডাকে বাসি। ওর স্বামী ওকে এই বয়সে বাইরে আসতে দিতে চায়নি, কিন্তু বিয়ের চার বছরেও সন্তানের মুখ না দেখতে পেয়ে ওর স্বামী দুঃখ ভুলতে মদ ধরলো।সেই হলো কাল! এখন ঠিকমতো কাজে পর্যন্ত যায় না। একদিন এসব কথা ওকে বলতে শুনেছিল মিতালী।
শ্যামল বলে -‘আর কিছুদিন কষ্ট করো, বিয়েটা হয়ে গেলে এখানেই থাকছো। ডেলি প্যাসেঞ্জারির আরঝামেলা থাকবে না। পুরো সময়টা তখন আমাকেই দিও না হয়!’
শ্যামলের সঙ্গে বছর দেড়েক আগে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেমে পৌঁছাতে দেরী হয়নি, হবেই বা কেন দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাবলম্বী । নিজস্ব অধিকার বলতে এটুকু তো থাকবেই।
শনিবার একবেলা,তাই সেদিনই যত আব্দার শ্যামলের। কখনো পার্কে বসে হাতে হাত রেখে স্বপ্ন দেখেছে অনাগত ভবিষ্যতের, আবার কতদিন শপিংমলে গিয়ে দুজনে একসাথে শপিংও করেছে।
প্রায় প্রতিটা শনিবারই বলতে গেলে শ্যামলের সান্নিধ্যে কাটায় মিতালী। সেই সান্নিধ্যের রেশটুকু বুকের মধ্যে গুঞ্জরিত হতে থাকে। সেই রেশ নিয়ে ফেরার সময়টুকু আপনমনেই থাকে মিতালী ।
ঘর সাজানোর টুকিটাকি কতরকম জিনিস কেনে মিতালী। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এখন তো শুধু কল্পনার জালবোনা! শ্যামল বলেছে মাসতিনেকের মধ্যেই ওর প্রমোশনটা হয়ে যাবে, তারপরেই বাড়ীর লোকজনের সঙ্গে বসে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলবে।
ওটুকু অপেক্ষা আবার কোন ব্যাপার ! তিনটে মাস তো দেখতে দেখতেই পার হয়ে যাবে।
আসা যাওয়ার পথে নিত্য নূতন গল্প শুনতে শুনতে সময় কাটতে থাকে। ইতিমধ্যে একমাসের বেশী পার হয়ে গেছে।
শ্যামলের কাজের চাপ বেড়েছে বোধহয়, ফোন করলেও ধরে না প্রায় সময়ই।মেসেজ করেও দেখেছে মিতালী….
কি জানি ব্যস্ত আছে ভেবে মিতালীও খুব একটা ফোন করে না আজকাল।
কয়েকটা শনিবার দেখা করার সময় হয়নি ,এই শনিবার দেখা করতে বলেছে। সুন্দর একটা মলমলের ছাপা শাড়ী পরেছে মিতালী, সুন্দর করে সেজেছে আজ! কী যেন একটা খুশীর ছোঁয়ায় মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার। বুকের ভেতর অনাগত ভবিষ্যতের ছবি।
হায়রে ভাগ্য মিছে নারীর ছলনাময়ী বদনাম! ছলনা সইতে সইতে যখন ছলনার চক্রব্যূহে আটকে ছটফটিয়ে মরে ,সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে যখন উপায় খুঁজে বের করতে চায় তখনই তাকে ছলনাময়ী বলে প্রতিপন্ন করা হয়। আসল ছলনা তো করে পুরুষ!
পুরুষের সে ছলনা তো সর্বজনবিদিত। তবুও তা আলোচনায় উল্লেখ্য হয়না। আসলে পুরুষের ছলনা এতটাই স্বাভাবিক আর ছলনার সংখ্যা অঙ্কের হিসাবেও এত বেশি যে সেটাই সাধারণ নিয়ম বলে লোকে মেনে নেয়। যারা বোঝেনা তাদের কে বুঝিয়ে দেবার জন্য কতনা উপমার সৃষ্টি হয়েছে সমাজে, সাহিত্যে। ‘ সোনার আংটি আবার বাঁকা! ‘
বাঁকা হলে সেটা যে আঙুলে পরা যায় না সেটুকু বুঝতে দেওয়া হয় না।
শ্যামল যথাসময়ে এসেওছিল কিন্তু ত্রস্ত ভাব দেখে মনে হলো কিছু একটা বলতে চাইছে ও । মিতালিকে এতদিন পরে দেখা করতে বলায় ভেবেছিল হয়তো বিয়ের ব্যাপারে শ্যামল কিছু বলতে চায়! কোথায় কী! আসলে এই সম্পর্কটাই আর রাখতে চায় না শ্যামল, যদিও মুখে বলেছে বাড়ীর পরিস্থিতির কারণে এখন বিয়ে করার অসুবিধা আছে।কাজের চাপ বেড়েছে তাই ফোন টোনও এখন সম্ভব নয়।
– মিতালীর মনটা ভালো নেই।ট্রেনে উঠে অবধি সেই যে বইয়ে মুখ গুঁজে বসেছে ,আর মুখ তোলেনি। চশমার আড়ালে চোখের জল লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ।
আদ্রায় আধঘন্টা ট্রেন থেমে থাকে, সেসময় সবাই যে যেমন পারে টুকটাক কেক, বিস্কুট কিংবা চপ, সিঙাড়া কিনে খেতে থাকে। লেডিসে তো এসবেরই রমরমা বেশী।
আজ কেনাকাটা বা অন্য কোনদিকে মন নেই মিতালীর, হঠাৎ করেই একটা হৈ হৈ শব্দে চমক ভাঙে, দেখে বুলির মা ট্রেনের হাতলটা ধরে ঝুলছে, এদিকে গেনিদিদি একহাতে দরজার হাতল ধরে অন্যহাতে বুলির মায়ের আরেকটা হাত ধরে প্রাণপণ জোরে হ্যাঁচকা টান দিয়েছে ।দুজনেই একসাথে সবেগে আছড়ে পড়েছে কামরার ভেতরে। বাকীদের কেউ কেউ কান্না শুরু করে দিয়েছে, কেউ ভগবানকে ডাকছে।
কী হয়েছে ভালোমতো বোঝার আগেই ঘটে গেছিল ঘটনাটা। আদ্রা স্টেশনে ট্রেন থামতে ট্রেন থেকে নেমে কিছু কিনে টিনে জল ভরতে গেছিল, ওখানেই দেরী হওয়াতে দেখে ট্রেনের বাঁশী বেজে উঠেছে শুনে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ট্রেনের কামরায় উঠতে যাবার মুহূর্তে ট্রেন ছেড়ে দেওয়াতে এই বিপত্তি!
কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না, অসম সাহসী গেনিদিদি যতই ঝগড়া করুক না কেন অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো মহৎ গুণের অধিকারীও বটে। এদের মধ্যে যতই ঝগড়া ঝাঁটি বলা কওয়া যাই থাকুক না কেন বিপদে আপদে এরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেও অন্যকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
পরের কয়েকটা দিন ছুটি নিল মিতালী, ঘূর্ণাবর্ত আর প্রবল বৃষ্টির জন্য বাড়ীতে থাকতে বাধ্য হলো।তারপর পার হয়ে গেছে অনেক ঘূর্ণাবর্ত অনেকগুলো দিন…..
আজো সেই লেডিসের যাত্রাপথেই রয়ে গেছে মিতালী। রুমালে পারফিউম মাখিয়ে সযত্নে ব্যাগে রেখে দেওয়াটা এখন শুধুই অভ্যাস মাত্র। নাকে চাপা দিতে ভুলে যায় প্রায়ই। ওদের গল্প শুনতে শুনতে সময় কেটে যাওয়ার অভ্যাসটাও কেমন করে যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। মিতালীও মাঝে মাঝেই অন্তরঙ্গ হয়ে দুটো একটা কথাও বলে। এটাই বুঝি ভালো,এখন আর কারো জন্যই কোন অপেক্ষা নেই। নিত্য যাওয়া আসার পথে ওদের এক শরিক বুঝি আজ মিতালীও।