যবনিকার আড়ে
কদিন ধরেই রাতের দিকে ঠান্ডা পড়েছে জব্বর। উত্তরদিক থেকে হাওয়া বইছে শনশন। মৃণালীনির ঘুম আসছে না। তার স্বামী বীরবাহ গেছে রাত পাহারা দিতে। জমিদার বাড়িতে রাত পাহারা দেয় সে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয় জমিদারের সমস্ত তল্লাট। মৃণালীনি ভাবে, কী জানি এই শীতে মানুষটা কি করছে! বাইরে বাইরে ঘুরে কাজ, ঠান্ডা না লাগে। হাল্কা বৃষ্টি পড়ছে আজ, সঙ্গে লোডশেডিং। হায় ভগবান, মানুষটার শরীরটা যেন ভালো থাকে। অরিন্দমের ঘরে কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। ছেলেটা এখনো পড়ছে। হঠাৎ কানে এলো খুট, খুট,খুট মৃদু শিকল নাড়ার শব্দ। এতো রাতে কে এলো আবার? বাড়ির সদর দরজায় নয়, অরিন্দমের পড়ার ঘরে সম্ভবত! কেরোসিন বাতিকে অনুসরণ করেই এই করাঘাত। আবার, আবার। মৃণালীনি উঠে বসে। মৃণালীনি ভাবে, রাতে কেউ বিপদে পড়ে সাহায্যের জন্য আসেনি তো! মৃণালিনী বুঝতে পারে না, কিসের এই আওয়াজ। অরিন্দম–! অরিন্দম কি জেগে আছে? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে! ও কি শুনতে পারছে না এই আওয়াজ! মৃণালিনী তাড়াতাড়ি উঠে আসে অরিন্দমের ঘরের দিকে।
উঁকি মেরে দেখে অরিন্দম জানলা অল্প খুলে ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, কে এলো এত রাত্রে। শুনতে পেলো, মৃদু স্বরে কে বলছে অরিন্দম জেগে আছিস? একটু দরজাটা খোল, ভীষণ বিপদে পড়েছি , তোর সাহায্য চাই। আমি তোর কলেজের অতনু দা। অরিন্দম আস্তে করে দরজা খুলতেই দুটো ছেলে ঘরে ঢুকে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো। ওরা নকশাল বলে পরিচিত। পুলিশের তাড়া খেয়ে এসেছে।
অরিন্দমের কলেজে পড়তো। যেখানে অন্যায় দেখে সেখানেই গিয়ে প্রতিবাদ করে। প্রয়োজনে খতম করে দিতেও দ্বিধা করে না। এদের মধ্যে একটি ছেলের পাড়ার মেয়ে জমিদার বাড়িতে কাজ করতো। একমাস আগে কুয়োর জলে পড়ে মারা যায়। সকলে বলে আত্মহত্যা করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন, আত্মহত্যা করবে কেন? তাহলে কি অত্যাচারিত হয়েছে সে! সেই উদ্দেশ্যেই তাদের রাতে এ তল্লাটে ঘোরাঘুরি। মৃণালিনী যেই শুনেছে পুলিশের তাড়া খেয়ে এসেছে। অরিন্দমের ঘরে এসে কেরোসিনের আলো একদম কমিয়ে দিয়ে তাদের বলে, “বাবা কেন আমাদের বিপদে ফেলা? এবার তো পুলিশ পিছন পিছন এসে পড়বে।”
ছেলে দুজন বলে, মাসিমা ভয় নেই, এক্ষুনি আমরা চলে যাবো। গোপনে এসেছি গোপনেই পালাবো,কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না। শুধু কিছু কথা জানতে চাই, যদি সত্যিটা বলেন তাহলে উপকৃত হই। আমাদের পাড়ার মেয়ে, আমাদের বোন রাধা খুব সরল, সাধাসিধে মেয়ে। সে আত্মহত্যা করতে পারে না।এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে, যদি কিছু জানেন তো বলুন। মৃণালিনী ভয় পায় । বলে, আমরা তো কিছুই জানিনা, কি করে বলবো! অতনু নামে ছেলেটি বললো, জমিদার বাড়িতে আপনার স্বামী বীরবাহ রাত পাহারা দেয়, কিছু জানেন না, একথা কি বিশ্বাস হয়? আপনার বাড়ির ছেলের যদি এমন দশা হয় সহ্য করতে পারবেন? মৃণালিনীর গলা শুকিয়ে এলো। মনে ভাবলো এরা যদি ছেলের ক্ষতি করে! বললো, শুনেছি গিন্নি মা’র এক ভাই আছে ভীষণ বদমাইশ। ওর জ্বালায় মেয়েরা রাস্তাঘাটে বেরোতে পারে না। বিশেষ করে রাতের বেলায়। যে মেয়ের উপর নজর পড়ে তার সর্বনাশ করে ছাড়ে। ওকে সবাই তাই রাবণ বলে। তোমাদের বোন রাধাকেও খুব বিরক্ত করতো। একদিন ঝড় বৃষ্টিতে সারা গ্ৰাম শুনসান।
গভীর রাতে ওর বাবা পাহারা দিচ্ছে। জমিদারের গোয়াল ধারের পাশের জঙ্গলে গোঙানির আওয়াজ পেয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে লাঠি হাতে এগোতেই দেখে রাবণ দাঁড়িয়ে। কিছু না বলে ফিরে গিয়ে ঘোড়া আস্তাবলে রেখে অন্য পথ দিয়ে সেখানে গিয়ে আড়াল থেকে দেখে সেখানের জঙ্গলে আগুন জ্বলছে। অমনি আগুন আগুন করে চীৎকার করলে লোকজন এসে জমা হয়। কিন্তু অন্ধকারে আগুনের পাশে কাউকে দেখা যায় না। পরদিন ভোরে কুয়োর জলে রাধার দেহ ভাসতে দেখা যায়।
ওর বাবা বীরবাহ একথা কাউকে বলতে বারণ করেছে, তাহলে আমাদের গ্ৰাম ছাড়া হতে হবে। কথা শেষ না হতেই বীরবাহ এসে কড়া নাড়ে। মৃণালিনীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। মৃণালিনী ব্যস্তভাবে ভীত কণ্ঠে বলে ওঠে “ওর বাবা চলে এসেছে, এবার কি হবে?” ছেলে দুটো তক্ষুণি পিছন দরজা দিয়ে বেড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। শুধু বলে গেলো, সাবধানে থাকবেন – ভয়ের কিছু নেই। বীরবাহ ঘরে ঢুকে বললো,পাড়ায় চোর ঢুকেছে। দুটো ছেলে তাড়া খেয়ে এদিকেই এসেছে। সাবধানে থাকবে। ওরা এদিকেই আছে। আমি খুঁজে দেখছি, বলে আবার চলে গেল। দুদিন পর রাবণের গলার নলিকাটা দেহ জমিদারের ধান জমিতে পাওয়া যায়। খুন রহস্য প্রস্তর চাপা হয়ে আজও যবনিকার আড়ে।