মহান সন্ত-কবি কবীর ও তাঁর কিছু দোঁহা
কবীরের জন্ম কবে কোথায় হয়েছিল তা ঠিক জানা যায়নি। লহরতালাব নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। তবে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাঁর মৃত্যও কবে কোথায় হয়েছিল তাও আমাদের অজানা।
তবে যা জানা গেছে তা হ’ল সমাজের এক নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মুসলমান তাঁতীর সন্তান ছিলেন তিনি। কবীর বড় হয়েছিলেন তাঁত শিল্পের পরিবেশের মধ্যে। তাই বুনন শিল্পের কথা তাঁর লেখার মধ্যে বারবার উঠে এসেছে। তাঁর লেখার মধ্যেও নিজের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে। কবীর শুধুমাত্র একজন লেখক ছিলেন না কেবল, তিনি ছিলেন একজন সাধক এবং সন্ন্যাসী(গৃহস্থ) ।
কবীরের বাণী তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে লোকের কাছে মুখে মুখে ছড়িছে পড়েছে যুগ থেকে যুগান্তরে। তাঁর গান কাশী, দিল্লী, পাঞ্জাব, রাজাস্থান, গুজরাট, বিহার, বাংলা হয়ে ওড়িশা অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। কবীরের গানে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন গুরু নানক। ১৫৭০ থেকে ১৫৭২ সালে কবীরের বেশ কিছু কবিতা একত্রিত হয়ে “গবিন্দাল পথি” নামে প্রকাশিত হয়।
কবীরের লিখিত পান্ডুলিপি তিনটি পথে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
যেমন- উত্তরের শাখা– গুরু নানক, গুরু গবিন্দ সিংহের হাত ধরে ক্রমে শিখদেন মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমের শাখা মূলতঃ রাজস্থান অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে দাদূ দয়াল এবং নিরঞ্জন সম্প্রদায়ের মাধ্যমে তা বিকশিত হয়েছে। দাদূ পন্থীরা নির্গুণের উপাসক ছিলেন। পূর্বের শাখা– কবীর পন্থাকে নিয়ে কাজ করে গেছে। ‘কবীর বীজক’ এই শাখার একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এখানে গানের ধারা কম, বরঞ্চ লক্ষ্য করা যায় মৌখিক কথপোকথনের ধারাটাকে লেখার মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করা যায়। যা কেবল হাতে লেখাই নয়, ছাপাখানা অবধি পৌঁছে গেছে উনিশ শতকে। এই পথে সহজ গানের পরিবর্তে তত্ত্ব কথা প্রাধান্য পেয়েছে।
বহু ভাষায় কবীরের অনুবাদে করা হয়েছে। মৌখিক ধারায় যা একসময় প্রচলিত ছিল, সেগুলোকে যখন লিখিত আকারে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, তখন তার মধ্যে অন্য ভাষার ঝোঁক ঢুকে পড়েছে। যুক্ত হয়ে গেছে সেই সসয়ের প্রেক্ষাপটও। শিখদের ক্ষেত্রে পাঞ্জাবী ভাষার অংশ জুড়ে গেছে তা লক্ষ্য করা যায়। আবার রাজস্থানে কবীরের অনুবাদ ভিন্ন স্বাদের। আগেই বলেছি, তার কবিতার মধ্যে বুনন শিল্পের কথা পাওয়া গেছে। শাড়ি, কাপড় বোনা- এই লোকজ উপাদানগুলো কবীরের কবিতায় বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। আপামর জনসাধারণের কাছে পোঁছানোর জন্য কবীর খুব সহজ সরল ভাষায় লোকায়ত উপাদানগুলি ব্যবহার করেছিলেন তার কবিতার মধ্যে, ফলে হিন্দু, মুসলমান এই ভেদভেদগুলো ছাপিয়েও তিনি সকল মানুষের কাছে আপন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই কবীরের গান এবং দোঁহা ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে সমগ্র ভারতে। সুফিবাদের ধারণার কাছাকাছি ভাবনা লক্ষ্য করা যায় কবীরের লেখার মধ্যে।
কবীরের মতবাদ শিখদের ভাবনাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। কবীরের মতবাদের বর্তমান উত্তরসূরি হল ‘কবীর পন্থ’ নামে পরিচিত একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, যেটি সন্ত মৎ সম্প্রদায়গুলির অন্যতম।
১৯০১ সালের জনগণনায় দেখা গেছে “কবীরপন্থী”-দের সংখ্যা ছিল ৮,৪৩,১৭১ জন। বর্তমানে এঁদের সংখ্যা প্রায় ৯৬,০০,০০০। এঁরা ছড়িয়ে আছেন মূলত উত্তর ও মধ্যভারতে এবং বহির্ভারতে বসবাসকারী অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে।
কবীরের কবিতা-
১). পানী বিচ মীন পিপাসী।
২). কোই রহীম কোই রাম বখানৈ।
বিনয় দারভেদকারের ‘কবীরের’ কবিতার অনুবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কবীরকে নিয়ে রচিত কিছু আদি গ্রন্থ হল –
১). স্বামী যুগলানন্দের রচনা ‘কবীর সাগর’
২).পূর্ণদাস সাহেবের রচনা ‘বীজক কবীর সাহবকা’
৩).খেমরাজ কৃষ্ণদাসের রচনা ‘বীজকমূল’,
৪).প্রমাণন্দজী, মকনজী কুবেরের রচনা ‘কবীর মনশূর’
৫).শিবহরের লেখা ‘সত্য কবীরকী সাথী’
৬).সাধু কাশীদাসের রচনা ‘পরমার্থ রাজনীতি ধর্ম’ বম্বে থেকে প্রকাশিত হয়।
৭). ‘কবীর শব্দাবলী’– এটি তাঁর একত্রিত রচনা এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়।
এছাড়াও
৮). ‘পংচ গ্রন্থী’,
৯). ‘সংজ্ঞা পাঠ’,
১০). ‘কবীরোপাসনা পদ্ধতি’,
১১). কবীর কাসৌটী’,
১২). কবীর বাণী’ বইগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কবিরের পঁচিশটি নির্বাচিত দোঁহা দেওয়া হ’ল এখানে।
(দোঁহা মানে হচ্ছে অপভ্রংশে ও মধ্যযুগের হিন্দিতে প্রচলিত ছন্দোবিশেষ অথবা উক্ত ছন্দের দুই চরণবিশিষ্ট পদ (কবিরের দোঁহা)।
দোঁহাগুলি বাংলায় অনুবাদ করেছেন – জাভেদ হুসেন।
————————————————————–
১).
জগত জানায়ো জিহি সাকাল সো জাগ জানিয়ো নাহি
জিয়ো আঁখি সব দেখিয়ে আঁখি না দেখি জাহি
(জগতের সকল কৃপার আধার যিনি জগত জানে না তাঁকে
যেমন চোখ দিয়ে সব দেখেও নিজ চোখকে দেখতে পাও না তুমি)
*
২).
লালি মেরে লাল কি জিত দেখো তিত লাল
লালি দেখন ম্যায় গ্যায়ি ম্যায় ভি হো গ্যায়ি লাল
(আমার প্রিয়র লাল রঙ, যে দিকে তাকাই সব লাল
আমিও তার রঙে রাঙা হলাম সেই রঙ দেখতে গিয়ে)
*
৩).
সবয় রাসায়ন ম্যায় কিয়া প্রেম সমান না কোয়
রতি ইক তান মে সনচারে সব তন কাঞ্চন হোয়
+সব রসায়ন চেখে দেখেছি, প্রেমের সমান কিছু নেই
রতি পরিমাণ শরীরে গেলে পুরো শরীর স্বর্ণ হয়)
*
৪).
পোথি পঢ় পঢ় জগ মুয়া পণ্ডিত ভায়া না কোয়
ঢাই অকশর প্রেম কা পঢ়ে সো পণ্ডিত হোয়
(পুঁথি পড়ে পড়ে মরলো জগত, পণ্ডিত হলো না কেউ
আড়াই অক্ষর প্রেমের পড়ে যে পণ্ডিত হলো সে-ই)
*
৫).
নয়না অন্তর আও তু তিউহি ন্যায়ন ঝাপেউঁ
না হউ দেখুঁ অওর কু না তুঝে দেখন দেউঁ
(আমার চোখের মাঝে এসো, চোখ বুজে নেই তার পর
আর দেখব না কাউকে, না কাউকে দেখতে দেব তোমায়)
*
৬).
দস দুয়ারে কা পিনজরা তা মে পনছি পওন
রহিবে কো আচরজ হ্যায় জায়ে তো আচরজ কওন
(দশ দুয়ারের এই পিঞ্জরায় থাকে পবনের পাখি
থাকলেই বড় আশ্চর্য কথা, চলে গেলে আশ্চর্য কিসের)
*
৭).
বিরহা ভুজঙ্গম প্যায়ঠি কারি কিয়া কলেজা ঘাও
সাধু অংগ না মোড়হি জিউ ভাওয়ে তিও খাও
(বিরহের বিষধর সাপ শরীরে ঢুকে হৃদয় করেছে ঘা
সাধু তাতে তিলমাত্র অঙ্গ নাড়ে না, যা খুশি সে করুক)
*
৮).
সব রংগ তন্ত রাবাব তান বিরহা বাজাওয়ে নিত
অওর কোয় না সুন সাকে কায়ি সাই কায়ি চিত
(সব রঙের বীণা এই শরীর, প্রিয়র বিরহ বাজায় তাকে রাত দিন
কেউ শোনে না সেই বীণার সুর, শোনে আমার হৃদয় আর প্রিয়)
*
৯).
আয়ে সাকুঁ না তুঝ পে সাকুঁ না তুঝ বুলায়ে
জিয়ারা য়ুঁহি লেহুংগে বিরহা তাপায়ে তাপায়ে
(না পারি যেতে তোমার মাঝে, না পারি ডাকতে আমার মাঝে
নিরুপায় আমাকে এমন করেই বিরহ আগুনে পুড়ে মরতে দেবে!)
*
১০).
বিরহা জলন্তি ম্যায় ফিরুঁ মো বিরহন কো দুখ
ছা না ব্যায়ঠু দারপতি মাটি জ্বল উঠে ভুক
(বিরহ আগুনে জ্বলে দ্বারে দ্বারে ঘুরে মরি এই আমি
তরুর ছায়ায় বসতে পারি না, আমার আগুনে তরুও জ্বলে উঠে)
*
১১).
বিরহা জলন্তি ম্যায় ফিরুঁ জলত জলহারি জাউঁ
মো দেখয়া জলহারি জ্বলে সন্তোঁ কাহাঁ বুঝাউঁ
(বিরহে জ্বলে ঘুরে মরি, নেভাতে যাই নদীর কাছে
আমায় দেখে নদীই জ্বলে, সন্ত, বলো এ আগুন কোথায় নেভাই?)
*
১২).
অগিনি আঁচ সাহনা সুগম সুগম খড়গ কি ধার
নেহ নিবাহান একরস মাহা কঠিন ব্যওহার
(আগুনে হাঁটা সহজ, সহজ খড়গের ধার
কঠিন সমান ভালোবাসা, ভালোবেসে যাওয়া একইভাবে)
*
১৩).
দিপক দিয়া তেল ভরি বাতি দেয়ি আঘাত
পুরা কিয়া বিসাহুনা বহুরি না আউঁ হাট
(সে দিয়েছে তেলভর্তি দীপ আর সলতে অনিঃশেষ
জগতের কারবার শেষ আমার, আর আসব না এই হাটে)
*
১৪).
মায়া তো ঠগিনে বানি ঠগত ফিরে সব দেস
জা ঠগ য়া ঠগিনে ঠগি তা ঠগ কো আদেস
(এই মায়া বড় প্রবঞ্চক, ভোলায় পুরো জগত
এই মায়াকেও যে ভোলায় ধন্য সেই প্রবঞ্চক)
*
১৫).
মায়া গ্যায়ি তো কেয়া হুয়া মান ত্যাজা নাহি জায়ে
মান বড়ে মুনিবর গিলে মান সবন কো খায়ে
(মায়া গেল তো কী! মান তো ত্যাগ সহজ নয়
বহু মুনি ঋষিকে খেল এই মান, মান সবাইকে খায়)
*
১৬).
হাম নে মরে মরিহে সনসারা
হাম কো মিলে জিবনহারা
(জগত মরলেও আমি মরি না
আমি পেয়েছি সেই অমর জীবনদাতা)
*
১৭).
হদ গ্যায়ি অনহদ গ্যায়া রাহা কবিরা হোয়
বেহদি ম্যায়দান মে রাহা কবিরা সোয়
(সীমা আর অসীমের সীমা পার হয়ে কবীর হয়ে উঠেছে
দেখ অসীমের ময়দানে কবীর শুয়ে আছে)
*
১৮).
কয়ি বিরহান কো মিচ দে কয়ি আপ দিখলায়ে
আঠ পেহের কা দঝনা মোপে সাহা না জায়ে
(হয় বিরহিকে মৃত্যু দাও, নয়তো দেখা দাও
অষ্ট প্রহরের এই দহন আর সহ্য হবার নয়)
*
১৯).
হাঁসি হাঁ কান্ত না পাইয়া জিন পায়া তিন রোয়
হাসেঁ খেলে হরি মিলে কওন সুহাগন হোয়
(হেসে কেউ পায়নি প্রিয়, পেয়েছে চোখের জলে
হেঁসে খেলে পাওয়া গেলে কে আর চাইতো তাকে)
*
২০).
হিরদে ভিতর দও জ্বলে ধুয়াঁ না পরগট হোয়
জাকে লাগি সোয় লখে কয়ি জিন লাজ সোয়
(হৃদয়ের ভেতর দাবানল ধোঁয়া যায় না দেখা
যার জ্বলে সে দেখে নয়তো দেখে যে জ্বালায় আগুন)
*
২১).
চাকাই বিছুড়ি র্যায়ন কি আই মিলি পরবকাতি
জে জান বিছুড়ে রাম তে তে দিন মিলে না রাতি
(রাতের বিরহের অভিশাপ পার হয়ে পাখি ভোরে দেখা পায় সঙ্গীর
কিন্তু যে বিরহ পেল রামের, সে পায় না দেখা তার দিন রাত্রি)
*
২২).
মুয়ে পিছে মাত মিলো কহে কবিরা রাম
লোহা মাটি মিল গ্যায়া তব পারস কেহি কাম
(মৃত্যুর পর প্রভুর দেখা পাওয়ার কথা ভেবে কী হবে
কবীর বলে—লোহা মাটিতে মিশলে পরশপাথর দিয়ে কী হবে?)
*
২৩).
কবিরা ব্যায়দ বুলাইয়া পাকড়ি কে দেখি বাঁহি
ব্যায়দ না বেদন জানায়ি কড়ক কলিজে মাহি
(বৈদ্য ডাকা হলে সে দেখে ধরে কবীরের নাড়ি
বৈদ্য কী জানবে, আমার বেদনা যে হৃদয়ের অনেক গভীরে)
*
২৪).
মন পরতিত না প্রেমরস না ইস তন মে ঢংগ
না জানো উস পিও সু ক্যায়সে রাহাসি সংগ
(না আছে নিজ হৃদয়ে আস্থা না জানি প্রেম কারে কয়
না জানি প্রেমের প্রথা, কী করে রইবো প্রিয়র সাথে)
*
২৫).
তুম তো সমর্থ সাইয়াঁ দৃঢ় কর পাকড়ো বাঁহি
ধুরাহি লে পহুঁচাইয়ো মার্গ মে ছোড়ো নাহি
(ওগো সাঁই! তুমি তো সব পারো, শক্ত করে ধরো আমার হাত
নিয়ে যাও পরমধামে, ছেড়ো না মাঝ পথে)