প্রেত – প্রথম অংশ–অন্ধকার জগৎ
এক
রুমী বরাবরই একেবারে সাধারণ ছেলে। সাধারণ ছেলেদের মতো তাকে কেমন দেখাচ্ছে সে নিয়ে তার মাথাব্যথার শেষ ছিল না। ক্লাসের ফিটফাট ছেলেদের দেখে তাই তার ভিতরে হীনমন্যতা জেগে উঠতো। ঘুরেফিরে দুটি প্যান্ট পরেই তাকে ক্লাসে আসতে হয়, ব্যাপারটা অন্যেরা লক্ষ করছে কি না সে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার সীমা নেই। টিউশনির টাকা পেয়ে সে যখন হাল ফ্যাশনের চওড়া কলারওয়ালা নতুন একটা শার্ট তৈরি করল তার ভিতরে তখন আনন্দের একটা জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। সে সেই শার্ট পরে দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় সাবধানে দোকানের আয়নায় নিজেকে লক্ষ করতো। তার চেহারা মোটামুটি ভালো এ নিয়ে সে খুব সচেতন, গায়ের রংটা আরেকটু ফর্সা হলে তার আর কোনো দুঃখ থাকতো না। অন্যদের দেখাদেখি সে তার চুলকে কান ঢেকে ঝুলে পড়তে দিয়েছে, তাই সেগুলিকে আগের থেকে বেশি যত্ন করতে হয়। কাছে-পিঠে কেউ না থাকলে আজকাল সে তার পকেট থেকে ছোট একটা চিরুনি বের করে অনেক যত্ন করে চুল ঠিক করে নেয়। তার বয়সী অন্য যে কোনো ছেলেদের মতো রুমীরও মেয়েদের নিয়ে খুব আগ্রহ। রাস্তাঘাটে কোথাও কোনো মেয়ে তাকে আলাদা করে লক্ষ করে কি না সেটা জানার তার খুব কৌতূহল। কখনো কোনো কারণে কোনো মেয়ে ঘুরে দ্বিতীয়বার তার দিকে তাকালে সে সারাদিন ঘটনাটি ভুলতে পারে না। এমনিতে সে খুব মুখচোরা, কোনোদিন যেচে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলবে এরকম সাহস নেই; অথচ প্রায়ই সে কল্পনা করে একটা আধুনিকা। মেয়ে তার জন্যে পাগল হয়ে আছে। প্রতিবার নতুন টিউশনি নেবার আগে সে মনে মনে আশা করে একটি সুন্দরী মেয়েকে পড়াবে, কিন্তু কখনোই তা হয়ে ওঠেনি। কে জানে, সুন্দরী মেয়েদের বাবারা হয়তো উঠতি বয়সের কলেজের একটা ছেলের হাতে মেয়েকে অঙ্ক কষতে দেওয়ার সাহস পান না!
রুমীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তার নিজেকে নিয়ে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে কেউ যেন বুঝতে না পারে সে মফস্বলের ছেলে। ক্লাসের ফিটফাট ইংরেজি কথা বলা ছেলেদের সে মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করে। শুদ্ধ ইংরেজিতে সে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারে কিন্তু মুখে মুখে সে ইংরেজিতে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। চেষ্টা করে দেখেছে, তার গ্রাম্য ক্লাস-টিচারের সুর এসে পড়ে। বৃদ্ধ ক্লাস-টিচারের তাকে নিয়ে যত গর্বই থাকুক না কেন,রুমীর নিজেকে নিয়ে লজ্জার সীমা নেই। একসময় ফিটফাট ছেলেদের সাথে সে মেশার চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু তাদের প্রচ্ছন্ন অবহেলা বুঝতে পেরে সে নিজের মাঝে গুটিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রুমী কল্পনা করে সে বিদেশ থেকে অনেক বিখ্যাত হয়ে ফিরে এসেছে, আর এইসব ফিটফাট ছেলেরা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। সে। যেন বিশুদ্ধ সাহেবি ইংরেজিতে বলছে : তোমাদের দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারলাম না তো।
রুমীর এই ধরনের অনেক কল্পনা, সাধারণ ছেলেদের মতো তার কল্পনাগুলিও সাধারণ। মোহ আর উচ্চাশা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। যা কিছু বিদেশি তাতেই আজকাল তার প্রচণ্ড বিশ্বাস। নিজের দেশের রাজনীতি পর্যন্ত সে বিদেশি সাংবাদিকদের আলোচনা পড়ে শিখতে চেষ্টা করে। দেশকে নিয়ে সে আজকাল সত্যি সত্যি হতাশাগ্রস্ত, বিদেশিরা কীভাবে উন্নতি করে ফেলছে আর এ দেশের লোকেরা কীভাবে নিজেদের সর্বনাশ করছে এ ব্যাপারে আজকাল সে বুদ্ধিজীবীদের সাথে একমত। একবার দেশের বাইরে যেতে পারলে সে আর কোনোদিন ফিরে আসবে
-এরকম একটা ধারণা আস্তে আস্তে তার ভিতরে গড়ে উঠছে। সার্থক জীবনের অর্থ বিদেশে প্রতিষ্ঠা, এ ব্যাপারে তার আজকাল আর কোনো সন্দেহ নেই। এই আশা নিয়েই সে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছিল, কিন্তু একদিন সেটাতে একটা চোট খেয়ে গেল।
তখন পরীক্ষার মাস দুয়েক বাকি, পড়াশোনার খুব চাপ। বিকেলে একটা টিউশনি করে রুমী খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রটার আলাদা পড়ার ঘর নেই, কাজেই মধ্যবিত্তের সংসারের ঠিক মাঝখানে বসে থেকে তাকে পড়াতে হয়। দৈনন্দিন তিক্ত ঘটনাবলির মাঝে বসে থেকে প্রায়-নির্বোধ একটি ছেলেকে এক জিনিস দশবার করে বোঝাতে তার দুই ঘণ্টা সময়কে দশ ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হয়। তার ওপর কোনোদিনই তাকে কিছু খেতে দেয় না, প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে সে উঠে আসে।
চা খেয়ে খিদে নষ্ট করার জন্যে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে যেতো। আজকাল সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসে আড্ডা জমায়। তাদের দেখা একটা মজার কাজ। একজন-দুজন রুমীর মনের মতো বের হয়ে পড়ে, তাদের সে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করে সময় কাটিয়ে দেয়। নিজের অগোচরে সে তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করে-কথাবার্তায়, হাসিতে, পোশাকে, হাঁটার ভঙ্গিতে।
সেদিন বৃষ্টি বলে চায়ের দোকানে ভিড় কম। রুমী জানালার পাশে একটা চা, একটা শিঙ্গাড়া নিয়ে আরাম করে বসেছে। তার ঠিক পাশেই একজন গভীর মনোযোগ দিয়ে গাঁজাভরা একটা সিগারেট নির্বিকারভাবে টেনে যাচ্ছে। সামনের টেবিলে বসে দুজন তর্ক করছে-বিষয়বস্তু রুমীর জ্ঞানের বাইরে, কোনো একজন আমেরিকান অর্থনীতিবিদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের যৌক্তিকতা। তর্ক উত্তপ্ত হতেই কথাবার্তায় ইংরেজি বের হয়ে আসতে থাকে। কি সুন্দর, উচ্চারণ, কি সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি, কি চমৎকার শব্দ চয়ন! রুমী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
দাদা কি করে আপনাদের?
রুমী গলার স্বর শুনে চমকে তাকায়। গাঁজা খাওয়া লোকটি লাল চোখে কিন্তু মুখে একটা হাসি নিয়ে তর্করত ছেলে দুটিকে জিজ্ঞেস করছে। ছেলে দুটি থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। প্রশ্নটি ঠিক বুঝতে পারেনি ভেবে লোকটি গলা উঁচিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, আপনাদের দাদারা কি করতেন?
এক্সকিউজ মি?
আপনার দাদা, মানে আপনার বাবার বাবার বাবা কি করতেন?
কেন?
গরিব ছিলেন কি না? চাষা, কি গোয়ালা, কি মাঝি?
হোয়াট? একজনের ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে, হোয়াট ডু ইউ মিন?
আহা-হা-হা রাগ করেন কেন? আমি শুধু জানতে চাইছি আপনাদের দাদারা কি করতেন?
কেন? ইটস নান অব ইওর বিজনেস। আমার দাদা যা খুশি করুক তাতে আপনার কি?
লোকটার মুখে তখনো হাসি। পান খাওয়া দাঁত বের করে বলল, বলতে না চাইলে বলবেন না। লজ্জা করলে বলবেন কেন?
একটা বড় ঝগড়া লেগে যাবার উপক্রম, অন্য ছেলেটা কোনোমতে থামিয়ে দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল। গাঁজা খাওয়া লোকের সাথে ঝগড়া করে কখনো, কি বলতে গিয়ে কি বলেছে!
রুমী আড়চোখে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করে, এমন অভদ্র লোকও আছে! লোকটা তখনো খিক খিক করে হাসছে যেন একটা ভারি মজার ব্যাপার হয়েছে। রুমীর চোখে চোখ পড়তেই বলল, দশ টাকা বাজি।
রুমী থতমত খেয়ে বলল, বাজি?
হ্যাঁ। ওই দুইটার ভিতরে অন্তত একটার দাদা গয়লা না হয় ধোপা ছিল!
কেন? রুমী একটু উত্তপ্ত হয়ে যোগ না করে পারল না, ধোপা কিংবা গয়লা হওয়া দোষ নাকি?
দোষ কেন হবে? লোকটা সাগ্রহে মাথা এগিয়ে আনে, দাদা ধোপা ছিল তাই বাপ খুব কষ্ট করে বড় হয়েছে। এখন ছেলেদের তাই সাহেব বানাচ্ছে। ভুলতে পারে না তো নিজে ধোপার পোলা! এমন সাহেবের সাহেব যে বাড়িতেও ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না।
রুমী যুক্তিটার মাথামুণ্ড কিছু না বুঝে চুপ করে রইল। লোকটার তাতে নিরুৎসাহিত হবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, নিজের মনে সে মা-বাপ তুলে গালিগালাজ দেওয়া শুরু করে।
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে রুমী তাড়াতাড়ি নিজের চা শেষ করার চেষ্টা করতে থাকে। উঠে পড়া ভালো, কে জানে আবার কখন তাকে ধরে বসবে।
ইংরেজি! ইংরেজি বলেন! লোকটা আবার শুরু করে, জার্মান বলে না কেন? স্প্যানিশ বলে না কেন? ফ্রেঞ্চ বলে না কেন?
প্রশ্নগুলি রুমীকে নয়, তাই রুমী চুপ করে থাকে। তাড়াতাড়ি চা খেতে গিয়ে তার জিব গেছে পুড়ে, রাগটা উঠছে এই লোকটার ওপর। লোকটা হঠাৎ দুই হাত মাথার ওপরে তুলে নাচার ভঙ্গি করল, ইংরেজি বলে কারণ তাদের ব্রিটিশ বাবারা ইংরেজিতে কথা বলেন। তারা তিনশো বছর তাদের পাছায় লাথি মেরে গেছেন, এখন তাদের ভাষায় কথা না বললে চলে কেমন করে? কর্তায় কইছে শালার ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই!
লোকটা হঠাৎ তার দিকে ঘুরে বলল, ওই ব্রিটিশ বাবারা কি তাদের মানুষ বলে জানতো? জালিয়ানওয়ালাবাগে ডায়ার যখন চারশো লোককে কুত্তার মতো গুলি করে মেরে নিজের দেশে ফিরে গেছে তখন তার দেশের লোক কি করেছিল?
রুমীর চা শেষ। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি করেছিল?
ব্রিটিশেরা চাদা তুলে ডায়ারকে ছাব্বিশ হাজার পাউন্ড উপহার দিয়েছিল। আর আমরা এখনো সেই ব্রিটিশের ইয়ে ধরে লাফাই! লোকটা অশ্লীল একটা কথা বলে মাটিতে একদলা থুতু ফেলল।
রুমী আর দাঁড়াল না, পয়সা দিয়ে দ্রুত বের হয়ে এলো। লোকটার পুরোপুরি মাথা খারাপ।
পরের কয়দিন কিন্তু ঘুরেফিরে লোকটার কথাগুলি মনে হতে থাকে রুমীর। বিশেষ করে সেই ইংরেজটার কথা, এ দেশের মানুষকে খুন করেছিল বলে যাকে নিজের দেশের লোকেরা খুশি হয়ে চাদা তুলে টাকা উপহার দিয়েছে। কথাটি কতটুকু সত্যি জানার জন্যে ওর ভিতরটা উশখুশ করতে থাকে। কাউকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবেরা তার মতোই ইতিহাস বইয়ে শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গুণপনা আর বীরত্বের কথা পড়ে এসেছে। সত্যি কথাগুলো কোথাও লেখা নেই। রুমী কথা প্রসঙ্গে ফিটফাট ছেলেগুলিকে জিজ্ঞেস করে একদিন, তারাও কিছু জানে না। একজন শুধু বলল টাগোর নাকি ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ নিজের স্যার উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রুমী স্কুলে শিখেছিল প্রপার নাউনের নাকি ইংরেজি হয় না, কিন্তু ঠাকুরের ইংরেজি কেমন করে টাগোর হলো? রুমী অবাক হলো আগে কখনো ওর এই প্রশ্নটি মনে হয় নি কেন ভেবে।
কয়দিন পর এক বিকেলে কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে সে পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘পাক ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ’ নামে একটা বই বের করে পড়তে বসে যায়। রাতে পরীক্ষার পড়া আছে তাই বেশিক্ষণ পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। এমনিতেও তার পাঠ্যবই এবং পত্রপত্রিকা ছাড়া আর কিছু পড়ার অভ্যাস নেই, একটা কথা তিন-চারবার পড়ে বুঝতে হয়। সন-তারিখ দিয়ে কণ্টকিত ইতিহাস পড়ে কিছু বুঝে ওঠাও মুশকিল। রুমী ঘণ্টা দুয়েক চেষ্টা করে খানিকটা বিরক্ত হয়েই উঠে এলো। প্রথম যে ইংরেজ মোগল বাদশাহদের সুনজরে পড়ার চেষ্টা করেছিল সে ব্যাটা পরিষ্কার জোচ্চোর ছিল, দুই ঘণ্টা পড়ে এইটুকু মাত্র জ্ঞান লাভ হয়েছে। ফিরে যাবার সময় রুমী ঠিক করে এই শেষ, আর সে বাজে সময় নষ্ট করবে না। কবে কখন কোন ইংরেজ কার কি ক্ষতি করেছে তাতে তার কি?
পরদিন বিকেলে কিন্তু রুমী আবার পাবলিক লাইব্রেরিতে ফিরে এসে ঠিক ওই বইটা খুঁজে বের করে।
সেদিন রুমী লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আসে অনেক রাতে, লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবার পর। পরীক্ষার পড়া আর হলো না, কিন্তু তাতে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। সে মাঝে মাঝেই এরকম ছুটি নেয়, বিশেষ করে পরীক্ষার আগে। পড়ার চাপটা মাঝে মাঝে অন্য কিছু করে বের করে দিতে হয়। আজ অবিশ্যি অন্য ব্যাপার। সিপাহি বিদ্রোহের পুরোটা শেষ না করে সে কিছুতেই উঠে আসতে পারছিল ও জানতো না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভুত্ব দূর করার শেষ চেষ্টাকে ইংরেজরা কি নির্মমভাবে দমন করেছিল। বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেই সন্তুষ্ট হয় নি, তাদের মৃতদেহ কানপুর থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত পুরো রাস্তার দুপাশের গাছ থেকে ঝুলিয়ে রেখেছিল। নীলক্ষেতের অন্ধকার রাস্তায় বড় গাছগুলির নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুমীর মনে হয় সে বুঝি কানপুরের রাস্তা ধরে হাঁটছে, আর দুপাশের গাছ থেকে বিদ্রোহী সিপাহিদের মৃতদেহ ঝুলছে–প্রচণ্ড রাগে রুমীর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
রুমীর পরিবর্তন হয় খুব তাড়াতাড়ি। শুধু পাক-ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস পড়েই ওর কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। ইংরেজদের দুইশো বছরের শাসন এ দেশের মানুষের মনোভাবকে কি রকমভাবে নষ্ট করেছে সে প্রথমবার বুঝতে পারে। এখনো কেউ ইংরেজি লিখতে গিয়ে ভুল করলে তার লজ্জায় মাথা কাটা যায়, কিন্তু বাংলা লিখতে ভুল করলে ভিতরে এতটুকু অপরাধবোধ পর্যন্ত জন্মায় না। যে ছেলেদের দেখলে একসময় রুমী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো আজকাল তাদের দেখলে তার ঘেন্নায় বমি আসতে চায়। আরও অনেক ব্যাপারেই রুমীর ধারণা আজকাল স্পষ্ট হয়ে আসছে। আগে রাজনীতি নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় নি, ক্লাসের যে কয়টা ছেলে রাজনীতি করতো তাদের জন্যে ওর অনুকম্পা হতো, আজকাল তাদের সে রীতিমতো শ্রদ্ধা করা শুরু করেছে। ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক, তারা দেশের জন্যে নিজেদের সময়, শক্তি, সামর্থ্য এমনকি ভবিষ্যৎ পর্যন্ত নষ্ট করতে প্রস্তুত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়সী ছেলেরা কীভাবে দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছে সে খানিকটা বুঝতে পারে। নিজের দেশকে নিয়ে তার ভিতরে গর্ব হতে থাকে, গোপন প্রেমের মতো সেটা ওকে আশ্চর্যভাবে আনন্দ দেয়।
আবার একদিন সেই অভদ্র মাথা খারাপ লোকটির সাথে দেখা হলো রুমীর। দেখা হলো সেই একই জায়গায়, একইভাবে, লোকটা গম্ভীর মুখে নির্বিকারভাবে গাঁজা ভরা সিগারেট টানছে। আজকে কেন জানি রুমীর লোকটাকে এতটা খারাপ লাগল না, সামনে বসে বলল, ভালো আছেন?
মাথা নেড়ে হাসল লোকটি, যেন কতকালের চেনা। রুমী বুঝতে পারে লোকটি তাকে চেনে নি, চেনার কথা না। চায়ে চুমুক দিয়ে রুমী জিজ্ঞেস করল, মনে আছে একদিন দুজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের দাদারা কি করে?
মনে পড়ার সাথে সাথে কৌতুকে লোকটার চোখ নেচে ওঠে, দশ টাকা বাজি। অন্তত একটার বাবা গয়লা না হয় ধোপা…
রুমী একটু হেসে প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্যে বলে, আপনি ডায়ারের কথা বলেছিলেন মনে আছে? যে জালিয়ানওয়ালাবাগে…
বলেছিলাম নাকি?
হ্যাঁ। ডায়ারকে তো লন্ডনে গুলি করে মেরেছিল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। উধম সিং, উধম সিং! অন্য ডায়ারকে মারতে পারে নি ওই ব্যাটা আগেই মরে গেছে। একই সময়ে একই জায়গায় দুই কুত্তার বাচ্চা দুইটার নামই এক। লোকটা হঠাৎ কথা বন্ধ করে ঘুরে ভালো করে রুমীকে দেখল, তোমার কি ইতিহাসে খুব উৎসাহ?
না, খুব নয়। আসলে সেদিন আপনার মুখে জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা শুনে একটু পড়ে দেখছিলাম।
লোকটার মুখ খুশিতে ছেলেমানুষের মতো হয়ে ওঠে, আমার কথা শুনে? সত্যি? তুমি আরও পড়তে চাও? কি পড়বে বলো?
এইভাবে কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে পরিচয় রুমীর। কিবরিয়া ভাইয়ের কোনো ভালো গুণ নেই, তিনি স্বার্থপর এবং হিংসুটে। পৃথিবীর কোনো লোককে তিনি পছন্দ করেন না। তিনি ভীষণ সাম্প্রদায়িক। বয়স্ক লোকদের মাঝে হিন্দুবিদ্বেষ বিচিত্র নয়, কিন্তু কিবরিয়া ভাইয়ের ভিতর এই বয়সে এত হিন্দুবিদ্বেষ কীভাবে গড়ে উঠেছে বোঝা মুশকিল। তিনি যে শুধু সাম্প্রদায়িক তাই নয় তার প্রখর আঞ্চলিকতাবোধ! কোনো কোনো জেলার লোকজনের সাথে তিনি কথা পর্যন্ত বলতে রাজি নন। দেশের প্রায় সব কজন বুদ্ধিজীবীকে তিনি উঠতে-বসতে মুখ খারাপ করে গালি দেন। কে কবে কখন কি ধরনের নোংরামি করেছিল সব তার নখদর্পণে। নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কাজেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক শিক্ষকদের দুবেলা মুণ্ডুপাত করার অধিকার আছে তার। সব সময়েই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেন, তাই কেউ প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারে না। এমনিতে খিটখিটে এবং বদমেজাজি, সাধারণ লোকজনের জন্যে কোনো সম্মানবোধ নেই। রুমী নিজে কিবরিয়া ভাইকে এক রিকশাওয়ালার সাথে কথা কাটাকাটি করে চড় মারতে দেখেছে। তারপর সমস্ত রিকশাওয়ালা একত্র হয়ে উল্টে কিবরিয়া ভাইকে সে কি মার! রুমী কোনোমতে সেবার প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। এরপর থেকে তিনি রিকশাওয়ালাদের দুই চোখে দেখতে পারেন না। কিবরিয়া ভাইয়ের বয়স খুব কম নয়, কিন্তু এখনো বিয়ে করেন নি, রুমীর ধারণা কোনো মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। জগৎ সংসারের ভালোমন্দ সবকিছুর ওপর এরকম খেপে থাকা লোক রুমী আগে কখনো দেখে নি।
কিবরিয়া ভাইয়ের একটি ব্যাপার অবিশ্যি প্রশংসা করার মতো, সেটি হচ্ছে তার পড়াশোনা। গল্প, কবিতা এবং উপন্যাস ছাড়া আর সব ধরনের বই পড়ায় তার সমান উৎসাহ। এমন কোনো বিষয় নেই যা সম্পর্কে তিনি পড়েন নি এবং তার বেশ ভালো ধারণা নেই। এতে অবিশ্যি লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি, তর্কবিতর্ক কথা কাটাকাটিতে তিনি প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে তার সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার এত নির্দয়ভাবে ব্যবহার করেন যে প্রতিপক্ষ কখনো তাকে ক্ষমা করতে পারে না। রুমী এখন পর্যন্ত একটি লোকও খুঁজে পায় নি যে কিবরিয়া ভাইকে পছন্দ করে বা যাকে কিবরিয়া ভাই পছন্দ করেন। সে নিজে তার থেকে অনেক ছোট বলে কিবরিয়া ভাই কখনো তার সাথে লাগেন নি। রুমী যে কিবরিয়া ভাইকে খুব পছন্দ করে তা নয়, কিন্তু একজন মানুষকে ভালোভাবে বুঝে নিলে তখন তার খারাপ আর ভালো কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তাছাড়া কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে কথা বলায় একটা আনন্দ আছে, অনেকটা পরচর্চার আনন্দের মতো। কখন কি পড়তে হবে এবং কোন্ বইয়ে কি পাওয়া যাবে কিবরিয়া ভাই খুব ভালো বলে দিতে পারেন। তিনি নিজে রুমীকে অনেক বই জোগাড় করে দিয়েছেন যেগুলি তার পক্ষে পাওয়া অসম্ভব ছিল।
কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর রুমী অনেক যত্ন করে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়াশোনা শুরু করেছে। পৃথিবী সম্পর্কে ওর ধারণা আজকাল পাল্টে গেছে। আগে মনে করতো যা ছাপা হয় বিশেষ করে বিদেশি পত্রপত্রিকায় সব বুঝি সত্যি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সংবাদপত্রগুলি যে খুব যত্ন করে পৃথিবীর খবর নিজেদের মনমতো করে পরিবেশন করে সাধারণ মানুষদের একটা ঘঁচের ভিতর ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে তা বোঝার পর সে তাদের অবিশ্বাস করা শুরু করল। বিদেশিরা ভালো বললে ভালো এবং বিদেশিরা খারাপ বললে খারাপ-এই ধরনের মতাবলম্বী লোকজনের সংখ্যা দেখে রুমী এই প্রথমবার বুঝতে পারে এ দেশের সত্যিকার সমস্যা কাদের মাঝে।
দুই
পরীক্ষার আর ঠিক দশ দিন বাকি। রুমী নিজের পড়াশোনাতে খুব সন্তুষ্ট। অন্যদের মতো সে নির্দিষ্ট কয়টা প্রশ্নের উত্তর না শিখে পুরো বই পড়ছে। যদিও আজকাল সে প্রচুর বাইরের জিনিস পড়াশোনা করে, সপ্তাহে চারদিন দুটি করে টিউশনি করে তবু তার সময়ের অভাব হয় নি। পড়াশোনা একেবারে নেশার মতো হয়ে। গিয়েছে। সবকিছু প্রথমবার পড়ে শেষ করতে অনেক সময় নেয়, দ্বিতীয়বার পড়তে আর তত সময় নেয় না। তৃতীয়বার পড়তে শুধু যেসময় আরও কম লাগে তাই নয় পড়ে প্রচণ্ড একটা আনন্দ হয়। রুমী ছোট একটা নোটবইয়ে বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন অংশের নাম লিখে তার পাশে তারকা চিহ্ন দিয়ে পড়াশোনার হিসাব রাখছে। তিন তারকা মানে ভালো পড়া হয়েছে, দুই তারকা মানে মাঝারি, এক তারকা মানে খারাপ। তার নোটবইয়ে তিন তারকা খুব বেশি, দুই তারকা খুব কম, এক তারকা নেই বললেই চলে। বাকি দশ দিনে সে তিন তারকাগুলিকে চার তারকা করে ফেলবে, না দুই এবং এক তারকাকে তিন তারকাতে নিয়ে আসবে ঠিক করতে পারছিল না। গত কয়েক বছরের প্রশ্ন যাচাই করলেই বোঝা যায় কোনো কোনো পরিচ্ছেদ না পড়লেও চলে, রুমীর নোটবইয়ে সেগুলিই দুই এবং এক তারকা হিসেবে রয়েছে–অন্যেরা সেগুলি মোটেও পড়ছে না। রুমীর নীতিবোধ আজকাল প্রখর হয়ে উঠছে, প্রশ্ন বেছে পড়ে ভালো করাকে সে জোচ্চুরি মনে করে। একটা ভালো স্কলারশিপ ছাড়া আর কিছুতে তার আকর্ষণ নেই, অন্তত সেটাই সে নিজেকে বোঝায়।
আজ তাই সে একেবারে নতুন একটা জিনিস পড়া শুরু করেছে। কিন্তু খানিকক্ষণ পড়েই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে–গত কয়েক দিন পরিশ্রম একটু বেশি হয়ে গেছে। একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে রুমী ঘর থেকে হাঁটতে বের হয়। সে নতুন সিগারেট খাওয়া শিখছে, এখনো সিগারেট ভালো লাগা শুরু হয় নি, খেতে বেশ কষ্টই হয়। সাধারণত ভাত খাবার পর সে সিগারেট খেতে চেষ্টা করে, আজ কি মনে করে এখনই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। প্রথম দু-তিন টান ওর খারাপ লাগে না, কিন্তু তারপরই গা গুলিয়ে ওঠে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে শুরু করল। কারো বাসায় যাওয়া যায় কি না ভাবল, কিন্তু পরীক্ষার পড়া নিয়ে সবাই ব্যস্ত এখন, যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ঠিক তক্ষুনি তার বিখ্যাত জ্যোতিষী জোয়ারদারের কথা মনে পড়ল বেশ অনেকদিন থেকেই খবরের কাগজে প্রেম-ভালোবাসা, মামলা-মোকদ্দমা, শিক্ষা-সাফল্য, বিদেশ-ভ্রমণ সম্পর্কে জানার “ অপূর্ব সুযোগের” বিজ্ঞাপন দেখে আসছিল। সে কোনো দিন এসব ব্যাপারে উৎসাহী নয়, কিরোর হাত দেখার বই বারবার পড়েও কোনটা আয়ু রেখা কোনটা হৃদয় রেখা সে মনে রাখতে পারে না। কিন্তু এই জ্যোতিষীর কথা ভিন্ন, তার এক বন্ধু বলেছে মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে জ্যোতিষী নাকি সবকিছু বলে দিতে পারে। রুমীর বিশ্বাস হয় নি, কিন্তু তার বন্ধুটি খোদার কসম খেয়ে বলেছে যে ছেলেবেলায় তার অ্যাপেনডিসায়টিস অপারেশনের কথাটিও নাকি জ্যোতিষী দিন-তারিখসহ বলে দিয়েছে। সেই থেকে ওর ইচ্ছে ব্যাপারটি নিজে গিয়ে দেখে, কিন্তু যাওয়া হয় নি। এখন, হঠাৎ করে, সেখানে যাওয়ার কথা মনে হলো। পকেটে কিছু টাকা আছে, পড়ায় মন বসছে না–এর থেকে ভালো সময় আর হবে না। বাসস্টপে এসে দাঁড়াল রুমী।
জোয়ারদারের নাম এবং বিজ্ঞাপনের ধরন দেখে রুমীর ধারণা হয়েছিল সাদাসিধে একজন বুড়োমানুষ নিজের বসার ঘরে লোকজনের হাত দেখে কিছু বাড়তি পয়সা রোজগারের চেষ্টা করে, তাই ঠিকানা খুঁজে বের করে জোয়ারদারের ঘর দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। মতিঝিলের এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় চৌদ্দ তলা দালানের সাত তলায় চমৎকার একটা ঘর আর ছোট একটা বারান্দা নিয়ে জোয়ারদারের হাত দেখার জায়গা। বারান্দায় বসে জোয়ারদার হাত দেখে। একটা পর্দা দিয়ে সেটা ঘর থেকে আলাদা করে রাখা। ঘরটিতে একটা ছোট টেলিভিশন চলছে। এক কোনায় চায়ের সরঞ্জাম এবং কেতলিতে ফুটন্ত পানি; যারা চায় চা তৈরি করে নেবে। চমৎকার সোফা এবং টেবিলে দেশি-বিদেশি রংচঙে পত্রপত্রিকা। ঘরে হালকা আলো। টেলিভিশনের শব্দ কমে এলেই শোনা যায় কোথা থেকে যেন মিষ্টি সেতারের শব্দ ভেসে আসছে। দেখেশুনে রুমী মুগ্ধ হয়ে যায়। যে লোক হাতদেখা পয়সা দিয়ে এতসব আয়োজন করে ফেলতে পারে সে হয়তো সত্যিই হাত দেখতে পারে। এই প্রথম রুমীর লোকটার প্রতি একটু বিশ্বাস জন্মাল।
বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘরের ভিতর এখন রুমী ছাড়া আরও দুজন। তারা ওর পরে এসেছে। রুমীর ঠিক আগে যে এসেছে সে এখন পর্দার ওপাশে হাত দেখাচ্ছে, এর পরেই রুমী। একজন কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট করে সময় নেয়। রুমীর ঘণ্টাখানেক সময় এর মাঝে নষ্ট হয়ে গেছে, হাত দেখিয়ে ফিরে যেতে আরও দুই ঘণ্টা। ওর বাসা অনেকটা দূর, একবার বাস বদলাতে হয়। পরীক্ষার আগে এভাবে এতটা সময় নষ্ট করা ভালো হলো কি না রুমীর সন্দেহ হতে থাকে।
পাশের ঘর থেকে জ্যোতিষী জোয়ারদার এবং তার সাথে রুমীর আগের লোকটি বের হয়ে আসে। লোকটির মুখ একটু বিমর্ষ, কে জানে ভাগ্য গণনায় কি বের হয়েছে। জোয়ারদার রুমীর দিকে তাকিয়ে বলল, এরপর কে, তুমি?
রুমী মাথা নাড়ল। এসো, বলে জোয়ারদার পর্দা তুলে ওকে ভিতরে ডাকল।
কি হলো কে জানে হঠাৎ রুমী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। ওর মনে হতে লাগল পর্দার ওপাশে একটা ভয়ানক অশুভ কিছু অপেক্ষা করে আছে। ওর ভিতর থেকে কে যেন ওকে বলছে, পালা পালা বাঁচতে হলে পালা…
রুমীর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, হঠাৎ সে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। জোয়ারদার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠাণ্ডা স্বরে বলল, এসো। রুমীর সারা শরীর আবার কাটা দিয়ে ওঠে, কি নিষ্করুণু তীব্র দৃষ্টি। শুকনো গলায় টোক গিলে বলল, আমি আজ বরং যাই, আরেক দিন আসব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
জোয়ারদার এগিয়ে এসে ওর হাতে ধরে। শক্ত লোহার মতো হাত, কিন্তু মরা মানুষের মতো ঠাণ্ডা। রুমীকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, সে কী চলে যাবে কেন? বেশিক্ষণ লাগবে না-এসো।
পর্দার এপাশে ছোট বারান্দা, মাঝখানে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার টেবিলের ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প, একটা টেলিফোন আর একটা বড় ম্যাগনিফাইং গ্লাস, আর কোথাও কিছু নেই। বারান্দায় রেলিঙের ওপর দিয়ে ঢাকা শহর দেখা যায়। নিওন লাইট জ্বলছে-নিভছে, মাঝে মাঝে গাড়ির শব্দ। মতিঝিলের এ এলাকাটা সন্ধ্যার পর এমনিতে খুব চুপচাপ হয়ে পড়ে।
জোয়ারদার একটা চেয়ারে বসে তাকে অন্যটাতে বসতে ইঙ্গিত করে। রুমী যন্ত্রের মতো চেয়ারে বসে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। খামোখা আমি ভয় পাচ্ছি, রুমী নিজেকে বোঝাতে শুরু করে, এই লোক আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে বাইরে আরও দুজন লোক বসে আছে, আমার ভয় কিসের? লোকটার বিজনেস হাতদেখা, হাত না দেখে ছাড়তে চাইবে কেন? রুমী ঘামে ভেজা ডান হাতটা টেবিলের ওপর মেলে দেয়।
জোয়ারদার বলল, বাম হাতটাও দেখি। রুমী তার বাম হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
রুমীর মেলে রাখা দুই হাত নিজের দিকে টেনে এনে এক পলক দেখে জোয়ারদার হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা তুলে নেয়। রুমী জানতেও পারল না জোয়ারদার যে রেখাটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখে নিঃসন্দেহ হয়ে নিল সেটি তার পুরো ভবিষ্যৎকে সেই মুহূর্তে কি ভয়ানকভাবে পাল্টে দিল।
অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাত দুটি দেখল জোয়ারদার। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, কি নাম তোমার?
রুমী নিজের নাম বলে।
হাত দেখাতে এসেছ কেন?
এটা আবার কোনো প্রশ্ন হয় নাকি? লোকজন হাত দেখাতে এলে ওর ব্যবসা চলবে কেমন করে? মুখে বলল, এমনি এসেছি, সবাই যেজন্যে আসে।
ও! জোয়ারদার আবার চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি ভয়ানক নিষ্করুণু দৃষ্টি। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা লালচে দাড়ি, শুকনো টেনে থাকা মুখ ঝাঁকড়া লালচে চুল ঝকঝকে সাদা দাঁত আর সবকিছু ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ দুটি।
জোয়ারদার হঠাৎ টেলিফোনটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে রিসিভার তুলে সাবধানে আস্তে আস্তে ডায়াল করে রুমীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই টেলিফোনটা শেষ করেই শুরু করছি।
ওপাশ থেকে একটা মেয়ে টেলিফোন ধরল বলে মনে হলো। জোয়ারদার গলা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করে, রুমী চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পায় না। কথা বলার ভঙ্গি শুনে মনে হয় কাউকে যেন কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছে। রুমীর খুব অস্বস্তি বোধ হতে থাকে, কেন জানি ওর মনে হয় ওকে নিয়েই কথা বলছে ওরা।
টেলিফোন শেষ করেও জোয়ারদারের শুরু করার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, অন্যমনস্কভাবে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। রুমী একটু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি দেখলেন হাতে?
ও, আচ্ছা। একটু নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, তোমার জন্ম-তারিখ কত?
ডিসেম্বরের কত তারিখ?
তেইশ।
বয়স কত?
রুমী নিজের বয়স বলে।
জোয়ারদার মাথা নেড়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে শুরু করে। অদ্ভুত একটা গলার স্বর, একঘেয়ে ক্লান্ত আবেগহীন। কথা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে, অনেকটা দৈববাণীর মতো, থেকে থেকে রুমী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
খুব ছেলেবেলায় তোমার বাবা মারা গেছেন। তাকে খুন করা হয়েছিল… হ্যাঁ, ওর বাবাকে খুন করা হয়েছিল। সবাই জানে ওর বড় চাচা খুন করিয়েছিলেন লোক লাগিয়ে।
কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু সবাই জানে। জমি নিয়ে গোলমাল ছিল অনেকদিনের। হাজীপুরের আলিমুল্লা হাজার টাকা পেলে এক কোপে গলা নামিয়ে দেয়। বড় চাচা পাঁচশো দিয়ে বায়না করেছিলেন, কাজ শেষ হবার পর বাকি পাঁচশো। কাজ শেষ করে সেই রাতেই আলিমুল্লা বড় চাচাকে ডেকে তুলল। হাতে লম্বা দা, তখনো রক্ত লেগে আছে। বড় চাচা তাড়াতাড়ি বাকি টাকা দিয়ে দিলেন। আলিমুল্লা তিন মাসের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তিন মাস পরে সবাই ভুলে গেলে সে আবার ফিরে এলো। শুকনো গিরগিটির মতো চেহারা, কালো কুচকুচে গায়ের রং, পান খেয়ে দাঁত লাল। সবাই জানে হাজার টাকা দিলে আলিমুল্লা গলা নামিয়ে দেয়। রাতের অন্ধকারে ওর বাবার গলা নামিয়ে দিয়েছিল আলিমুল্লা। কি নিখুঁত হাত, পাশে ওর মা শুয়ে ছিলেন, তার গায়ে আঁচড়টিও লাগে নি। সারা শরীর শুধু রক্তে ভিজে গিয়েছিল। মা চিৎকার করে উঠে বসেছিলেন, আর ঘুম ভেঙে উঠে রুমী দেখেছিল, ওর মায়ের সারা শরীর রক্তে লাল। ও ভেবেছিল ওর মাকে কেউ কেটে ফেলেছে, কিন্তু ওর মায়ের কিছু হয় নি। ওর বাবাকে কেটে ফেলেছিল। নিখুঁত নিশানা, ঠিক গলাটা এক কোপে দুই ফাঁক। রুমী অনেকদিন ভেবেছিল ওর হাজার টাকা হলে আলিমুল্লাকে দিয়ে বলবে বড় চাচার গলা নামিয়ে দিতে। ও ঠিক নামিয়ে দিত। কিন্তু বড় চাচা মরে গেলেন, এমনিতে ভুগে ভুগে মরে গেলেন। শরীরের মাংস পচে খসে খসে পড়তো আর সারা রাত যন্ত্রণায় কাটা মাছের মতো লাফাতেন। সবাই বলতো বদ দোয়া লেগেছে, এতিমের বদ দোয়া..
তোমার মায়ের সাথে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে খুব ছেলেবেলায়।
… মায়ের চেহারা হয়ে গেল ডাইনির মতো। রুমী কাছে যেতে ভয় পেতো। দাঁতে দাঁত ঘষে ফিট হয়ে যেতেন, সবাই বলতো জিনে ধরেছে। এত এত তাবিজ দিল গলায়, মা টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতেন। একদিন নানা নৌকো করে এসে তার মাকে নিয়ে গেলেন। শুধু মাকে, রুমীকেও না শানুকেও না। রুমীর কি কান্না, শানু তখন কিছু বোঝে না, কিন্তু রুমীর কান্না দেখে তারও চিৎকার করে কান্না। নৌকো করে নানা মাকে নিয়ে গেলেন, মা পাথরের মূর্তির মতো নৌকোয় বসে রইলেন, একবার ঘুরেও তাকালেন না। রুমী নৌকোর সাথে সাথে নদীর তীরে তীরে চিৎকার করে ছুটে যেতে লাগল। ওর ছোট চাচা ওকে ধরে নিয়ে এলেন, বললেন ওর মা আবার ফিরে আসবেন। রুমী কিন্তু জানতো আর আসবেন না। ওর মা আসলেও আর আসেন নি। অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ বলে নি, কিন্তু রুমী জানে..
তোমার কোনো আপনজন নেই?
…কে বলেছে নেই? নিশ্চয়ই আছে, শানু আছে! শানু-শানু-শানু গুটি গুটি হাঁটতো উঠানের নেড়ে দেওয়া ধানের মাঝে। মোরগগুলিকে তাড়া করতো, মোরগুলিও বুঝতো ও শানু, তাই ভয় পেতো না মোটেই। শানুর গা ঘেঁষে এসে ধান খেয়ে যেতো। শানু কিছু বুঝতো না, ওর মা ওদের ছেড়ে চলে গেছেন তাও বুঝতো না। থালা উল্টে ভাত ছড়িয়ে দিতো মাটিতে, তারপর খুঁটে খুঁটে খেতো মাটি থেকে তুলে। শুধু হাসততা ফোকলা দাঁত বের করে। কিছু বুঝতো না শানু, এত দুঃখ ওদের তাও বুঝতো না। তারপর একদিন শানুর বিয়ে হয়ে গেল। রুমী জানতেও পারে নি কখন শানু বড় হয়ে গেছে, শান্ত হয়ে গেছে, দরজার আড়ালে পঁড়িয়ে চুপচাপ ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বিয়ের রাতে শানু ওকে সালাম করতে এলো। বড় ফুফু বললেন, ভাইরে শেষবার সালাম করে নে রে, শানু। শুনে হঠাৎ রুমীর বুকটা হা হা করে ওঠে। শানু ওকে জরিয়ে ধরে কি কান্না! বলতে চাইছিল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও দাদা, আমি বিয়ে করব না। রুমী জানে তাই বলতে চাইছিল, কিন্তু বলে নি। কেন বলবে? ভালো প্রস্তাব, ভালো বংশের ছেলে, দোকান আছে সদরে। কতদিন আর চাচাঁদের সংসারে থাকবে? শানু চলে গেল। কেমন আছে এখন শানু? কতদিন যোগাযোগ নেই-কতদিন! তিন বছর? চার বছর?…
অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছো তুমি। কারো কোনো সাহায্য ছাড়া, একা একা।
একা একা? হবে হয়তো। বড় ফুফু বললেন, ঢাকা যাবি আমার সাথে? নাইট কলেজে পড়বি। আমার বাজারটা, ইলেকট্রিক বিলটা করে দিবি, তোর ফুপা পারলে প্রেসে একটা চাকরি খুঁজে দেবে। বিলু রীতার পড়াশোনাটা দেখবি। রুমী রাজি হলো। ফুফু এসে কাজের ছেলেটা ছাড়িয়ে দিলেন। রুমী চরকির মতো ঘুরতে থাকে, শখ ছিল পড়াশোনা করে বড় হবে কিন্তু ও কাজের ছেলে হয়ে গেল। বাজার করে, বাসন মাজে, কাপড় ধোয়। ময়লা কাপড় পরে, উচ্ছিষ্ট তরকারি দিয়ে একগাদা ভাত খায়, রাতে রান্নাঘরে মাদুর পেতে ঘুমায়। তখন ওর পরীক্ষার ফল বের হলো। স্টার মার্ক পেয়েছে, চার বিষয়ে লেটার। ক্লাস টিচার সেই গ্রাম থেকে দেখা করতে এলেন একটা নতুন এ সি দেবের ডিকশনারি নিয়ে। ওর অবস্থা দেখে একেবারে চুপ মেরে গেলেন, এমন কি ডিকশনারিটা দেওয়ার কথা পর্যন্ত মনে থাকল না। বসার ঘরে সারাদিন বসে রইলেন কিছু না খেয়ে। সন্ধ্যায় ফুপা এলে তার সাথে কথা বললেন, কি বললেন কে জানে। ওর ক্লাস টিচার চলে যেতেই ফুপা চিৎকার করে গালি দিতে শুরু করলেন ফুফুকে, তোমার চোদ্দগুষ্ঠির কেউ প্রাইমারি পর্যন্ত পাস করে নাই, আর তুমি আমাকে বলো নি পর্যন্ত যে রুমী ম্যাট্রিক পাস করেছে, স্টার মার্ক, চার সাবজেক্ট লেটার। ওকে দিয়ে তুমি বাসন মাজাও, বাজার করাও। তোমার বাপের গোলাম নাকি? স্কলারশিপ পাবে মাসে দেড়শো টাকা, কয়দিন পরে তোমাকে বাঁদী রাখবে সেটা খেয়াল আছে? ফুপু প্রথমে একটা দুটো কথা বলে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন তারপর ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগলেন। অবস্থা পাল্টে গেল রুমীর, নতুন কাপড় কিনে দিলেন ফুপা, বাইরের ঘরে ওর জন্যে বিছানা পাতা হলো, ঢাকা কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হলো তাকে। লোকজন এলে ফুপা পরিচয় করিয়ে দিতেন, আমার মেজোশালার ছেলে, চার সাবজেক্টে লেটার, স্টার মার্ক। রুমী অবিশ্যি তবু বাজার করে দিতো, বিলু রীতার অঙ্ক দেখে দিতো। স্কলারশিপের টাকা পেয়ে ফুপুকে একটা শাড়ি কিলে দিল, ফুপাকে প্যান্টের কাপড়। তাই পেয়ে কি খুশি! টিউশনি নিল রুমী…
কতক্ষণ ধরে জোয়ারদার কথা বলছিল রুমীর মনে নেই। অন্যমনস্কভাবে একঘেয়ে আবেগহীন গলার সুরে রুমীর ভাবনা-চিন্তা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুর্বলতা, আক্রোশ, গোপন কামনা-বাসনার কথা এত অনায়াসে বলে গেল যে রুমীর মনে হতে থাকল জোয়ারদার নয়, সে নিজেই যেন নিজের কথা বলছে। জোয়ারদার কথা বলে সুন্দর ভারি গলায়, নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসে। রুমীর ভিতরটা যেন খোলা বইয়ের মতো পড়ে গেল। কখনো কখনো থেমে যাচ্ছিল ঠিক জুতসই শব্দটা না পেয়ে। তখন ধৈর্য ধরে একটার পর একটা শব্দ ব্যবহার করতে থাকে যতক্ষণ না ঠিক শব্দটা খুঁজে পায়।
আস্তে আস্তে রুমী যেন সম্মোহিতের মতো হয়ে গেল। জোয়ারদারের গলার স্বর যেন ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে। সাগরের ঢেউয়ের মেতো অর্থহীন কিছু শব্দ ওকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। জোয়ারদারের চেহারা অস্পষ্ট হয়ে গেল ওর সামনে, কি বলছে কিছু সে বুঝে উঠতে পারছে না। একটি একটি শব্দ সে শুনছে, কিন্তু সব মিলিয়ে তার যেন কোনো অর্থ নেই। যুগ যুগ যেন সে বসে আছে এখানে, এর যেন শুরু নেই, শেষ নেই।
রুমীর চমক ভাঙলো তীব্র একটা আলোর ঝলকানিতে। পর্দা সরিয়ে একটি মেয়ে এসে ঢুকে ছবি তুলেছে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে রুমীর। কিসের ছবি তুলেছে মেয়েটি? রুমী ঠিক বুঝতে পারল না। মেয়েটি ভিতরে এলো না, জোয়ারদারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বাইরে আছি। তোমার কাজ শেষ হলে ডেকো।
আমার কাজ শেষ।
রুমী উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে মানিবাগ বের করে একটা দশ টাকার নোট কীভাবে দেবে বুঝতে না পেরে টেবিলের ওপরে রাখলো। কাউকে টাকা দিতে বা কারো কাছ থেকে টাকা নিতে সব সময়েই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। প্রত্যেক মাসে টিউশনির টাকা নেওয়ার সময় ওর এই রকম হয়।
জোয়ারদার কিন্তু বেশ সপ্রতিভভাবে নোটটা নিয়ে পকেটে রাখল। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ বের করে রুমীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার নাম-ঠিকানাটা লিখে দেবে? আমি সবার নাম-ঠিকানা রাখছি রেফারেন্সের জন্যে। তোমার যদি কোনো আপত্তি থাকে তাহলে দরকার নেই।
রুমীর আপত্তি ঠিকই ছিল কিন্তু কেউ এভাবে বললে না করা মুশকিল। একবার ইচ্ছা হলো একটা ভুল ঠিকানা দিয়ে দেয়, কিন্তু জেনেশুনে এত বড় মিথ্যা কাজ কীভাবে করে। নাম-ঠিকানা লিখে সে উঠে দাঁড়ায়, জোয়ারদার খুব আন্তরিকভাবে তার সাথে হাত মিলিয়ে বলে, তুমি বলছিলে তোমার দেরি হয়ে গেছে। তুমি যদি চাও ইভা তোমাকে পৌঁছে দিতে পারে।
না, না-রুমী ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি একাই যেতে পারব। মেয়েটি, যার নাম নিশ্চয়ই ইভা রুমীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় বাসা তোমার?
মালিবাগ।
ওঃ কি সুন্দর করে হেসে উঠল মেয়েটি, আমি এমনিতে রাজারবাগ যাচ্ছিলাম, চলো তোমাকে পৌঁছে দিই।
চমৎকার চেহারা ইভার, চমৎকার শরীরে আরও চমৎকার একটা শাড়ি পরে আছে। কেমন একটা আকর্ষণ আছে মেয়েটার শরীরে। একবার চোখ পড়লে আর চোখ সরানো যায় না। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ধারালো, মোটেই মেয়েদের চোখের মতো নয়, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে।
চলো যাই, ইভা রুমীকে নিচে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে সে রুমীর জন্যে দরজা খুলে দেয়। রুমী তার জীবনে গাড়ি চড়েছে খুব কম, হাতে গুনে বলা যায় কয়বার। বড় হয়ে ছাদ খুলে ফেলা যায় এরকম একটা গাড়ি কিনবে-কালো রঙের-এরকম একটা স্বপ্ন ওর বহুদিনের।
ফাঁকা রাস্তায় গাড়িটা ঘুরিয়ে ইভা রুমীকে নিয়ে রওনা দেয়। গাড়িতে মিষ্টি একটা গন্ধ, সুন্দরী মেয়েদের গায়ে বুঝি সুন্দর একটা গন্ধ থাকার নিয়ম! রুমী আড়চোখে ইভাকে দেখার চেষ্টা করে।
কি পড় তুমি? তুমি বলে বলছি বলে কিছু মনে করছো না তো? ইভা একটু হেসে বলে, বয়সে তুমি আমাদের থেকে অনেক ছোট হবে।
না, না মনে করার কি আছে-ভদ্রতার খাতিরে রুমীকে বলতেই হলো। এমনিতে কেউ সোজাসুজি তাকে তুমি বলে সম্বোধন করলে তার মোটেই পছন্দ হয় না। চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ পড়ে নি, গোঁফটা একটু ঘন হলে সে রাখার চেষ্টা করে দেখতো।
কি পড়ছো বললে না?
রুমী বলল সে কি পড়ছে। পরীক্ষা দেবে তাও বলল।
কবে পরীক্ষা তোমার?
এই মাসের আঠারো তারিখ।
তাই? পরীক্ষা তো এসে গেল।
হুঁ।
ইভা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে, রুমী অবাক হয়ে তাকায় ইভার দিকে। পড়াশোনা করো নি বুঝি, তাই হাত দেখাতে গিয়েছিলে?
রুমীও হেসে ফেলে, বলে, না তা নয়। পড়া আমার ঠিকই হয়েছে, এমনি খেয়াল হলো তাই গেলাম।
গাড়ি চালাতে চালাতে ইভা ঘুরে রুমীকে দেখল, কিছু বলল না। বেশ অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে অনেকটা আপনমনে বলল, খেয়াল হলো তাই গেলে। আশ্চর্য!
এর মাঝে আশ্চর্য কোন ব্যাপারটা রুমী বুঝতে পারে না।
রুমীকে ইভা ওর বাসার কাছে নামিয়ে দেয়। রুমী একটু আগেই নেমে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ইভা ওকে ঠিক বাসার সামনে না নামিয়ে ছাড়বে না। শুধু তাই নয় ইভা গাড়িতে বসে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত রুমী তার বাসায় গিয়ে না ঢুকছে। এত রাতে এরকম একটা সুন্দরী মেয়ের গাড়ি থেকে নামছে, ব্যাপারটা কেউ দেখে ফেলছে কি না এ নিয়ে শঙ্কিত ছিল বলে ও তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকে পড়েছে, তা নইলে ও নিশ্চয়ই লক্ষ করতো যে ইভা কাগজ বের করে ওর বাসার নম্বরটা টুকে নিয়েছে।
কেউই খেয়াল করল না গত ছয় মাস থেকে জ্যোতিষী জোয়ারদারের ভাগ্য গণনার যে বিজ্ঞাপনটি দৈনিক পত্রিকাগুলিতে ছাপা হচ্ছিল সেটি পরদিন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।
পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে রুমী হেঁটে হেঁটে নীলক্ষেতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। ওর এক বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা, নিউমার্কেট থেকে বাস ধরবে। ওর গাঘেঁষে একটা হালকা নীল রঙের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে ও লক্ষও করে নি। গাড়ি থেকে মাথা বের করে একটা মেয়ে উচ্চকণ্ঠে ডাকল, রুমী-রুমী!
রুমী ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইভা। অবাক হয়ে কাছে এগিয়ে যায়।
কি খবর তোমার? ইভা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কোথায় চলেছ?
রুমী একটু থতমত খেয়ে বলল, এই এসেছিলাম একটু লাইব্রেরিতে।
এখন কোথায় যাচ্ছ? কলেজ গেটের দিকে এক বন্ধুর বাসায়।
চলো পৌঁছে দিই রুমী কিছু বলার আগেই দরজা খুলে দেয় ইভা। বাসে যেতে ওর আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগতো, ইভা সেখানে ওকে দশ মিনিটে পৌঁছে দিল। অল্প সময়ে বেশি কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ নেই। এর মাঝেই ইভা তার পড়াশোনোর খবর নিয়েছে। কবে কোথায় পরীক্ষা তাও জেনে নিয়েছে। রুমী মেয়েদের সাথে কথা বলে অভ্যস্ত নয়, তাই পুরো সময়টুকু একটু আড়ষ্ট হয়েই বসেছিল, কথা যা বলার ইভাই বলেছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মোড়ে ওকে নামিয়ে দেওয়ার পর ও যেন স্বস্তি ফিরে পেয়েছে।
সে-রাতে ঘুরেফিরে ওর অনেকবার ইভার কথা মনে পড়ল।
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে রুমী ওর ক্লাসের কজন ছেলের সাথে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। ও খেয়াল করে নি, করলে দেখতে পেতো একটু দূরে গাড়ি নিয়ে বসে আছে ইভা। রুমীকে অন্যদের সাথে বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে দেখে ইভা গাড়ি ঘুরিয়ে উলটোদিকে চলে গেল। একা থাকলে হয়তো আবার রুমীকে গাড়িতে তুলে নিত।
নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে উবু হয়ে বসে রুমী বই দেখছিল, কে যেন ওর খুব কাছে মাথা এনে ডাকল, রুমী!
রুমী ঘুরে দেখে ইভা। কি খবর-ইভা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, ভালো?
হ্যাঁ, এই আর কি।
পরীক্ষা কেমন হলো তোমার?
ভালো।
কি করছো এখানে? যাবে নাকি কোথাও?
নাহ। সাতটার সময় ওর একটা টিউশনি আছে, এখনো খানিকক্ষণ বাকি সাতটা বাজতে, তাই সময় কাটাচ্ছিল। ইভাকে টিউশনির কথা বলতে ওর লজ্জা করল, বলল,অন্য কাজ আছে। শুনে ইভা আর অপেক্ষা করল না। মিষ্টি করে হেসে বলল, আসি তাহলে, আবার দেখা হবে।
দেখা হোক কি না হোক বিদায় নেওয়ার সময় অনেকেই বলে, আবার দেখা হবে, ওটা একটা কথার কথা।
কিন্তু ইভার কথাটা কথা ছিল না। ও সত্যিই জানতো আবার দেখা হবে। শুধু ইভা নয় আরও অনেকে জানতো আবার দেখা হবে। বহুদিন থেকে ওকে ওরা চোখে চোখে রাখছে। অনেক খুঁজে ওরা রুমীকে পেয়েছে, এখন ওকে কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না।
রুমী যখন সেটা জানতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তিন
রুমী বহুদিন হলো শানুকে দেখে নি। সেই কবে শানুর বিয়ে হয়ে গেছে তারপর মাত্র একবার দেখা হয়েছে। কদিন আগে শানুর স্বামী ঢাকা এসেছিলেন গুড়ের একটা চালান নিয়ে। ছোটখাটো মানুষ, মুখে সব সময়ই ভালো মানুষের মতো একটা হাসি। সদরঘাটের কাছে কি একটা ঘিঞ্জি হোটেলে ছিলেন সপ্তাহখানেক। রুমীকে খুব যত্ন করে হোটেলে নিয়ে শিককাবাব খাইয়েছিলেন। যাবার সময় খুব করে বলেছেন যেতে। রুমী কথা দিয়েছিল পরীক্ষা শেষ হলে যাবে। তখন ভদ্রলোককে শান্ত করার জন্যেই বলেছিল, কিন্তু পরীক্ষা শেষ হবার পর ও সত্যিই ঠিক করল যাবে। হকার্স মার্কেট ঘুরে ঘুরে সে শানুর জন্যে একটা শাড়ি কিনল, শানুর বাচ্চার জন্যে একটা খেলনা গাড়ি। শানুর স্বামীর জন্যে একটা দামি সিগারেট লাইটার, ভদ্রলোক শৌখিন মানুষ কিন্তু প্রাণে ধরে বিলাসিতার জিনিস পয়সা খরচ করে কিনতে পারেন না।
রাত আটটায় ট্রেন। রুমী ছটার মধ্যে রওনা দিল। সকাল সকাল গেলে ট্রেনে একটু ভালো জায়গা পাওয়া যাবে। সাথে ছোট একটা ব্যাগ, খামোখা রিকশা করে না গিয়ে সে বাসেই চলে যাবে ভাবছিল, তাতে অনেক পয়সা বাঁচে। বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করে নি, ওর পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ইভা বলল, কি খবর রুমী, কোথায় যাচ্ছ?
রুমী একটু অবাক হয়ে এগিয়ে যায়, কমলাপুর স্টেশন।
তাই নাকি? চলো তোমাকে পৌঁছে দিই।
বাসে করে যাবার বদলে গাড়িতে করে যেতে আজ ওর কোনো আপত্তিই ছিল না, কিন্তু ও দেখল গাড়ির ভিতরে আরও দুজন লোক বসে আছে। একজন সামনে ইভার পাশে, আরেকজন পেছনে। অপরিচিত লোকজনের সাথে প্রায়-অপরিচিত আরেকজন মেয়ের গাড়িতে ওঠা কোনো সুখকর ব্যাপার নয়। কিন্তু ততক্ষণে পেছনের লোকটা পিছনের দরজা খুলে দিয়ে সরে বসে তাকে জায়গা করে দিয়েছে। রুমী একটু ইতস্তত করে উঠে বসে, ইভা সাথে সাথে গাড়ি ছেড়ে দেয়। হঠাৎ করে কেন জানি রুমীর ইচ্ছে হলো নেমে পড়ে, গাড়ির ভিতরে যেন কি একটা অশুভ জিনিস অপেক্ষা করে আছে। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে ঠাণ্ডা কি যেন একটা নেমে যায়।
কোথাও যাচ্ছ নাকি? ইভা জিজ্ঞেস করে।
হুঁ।
কটায় ট্রেন তোমার? ভারী গলার স্বর শুনে সে পাশে তাকায়, লোকটিকে সে আগে দেখেছে, জোয়ারদার… সেই জ্যোতিষী।
রুমী শুষ্ক গলায় বলল, আটটায়।
ও। বলে জোয়ারদার কোথা থেকে যেন একটা পকেট ঘড়ি বের করল। লম্বা চেন লাগানো সাথে। সোনালি রঙের চমৎকার একটা ঘড়ি। ওপরে কারুকাজ করা ঢাকনা। ঢাকনা খুলে সময় দেখে বলল, এখনো অনেক সময় আছে।
ঢাকনাটা বন্ধ করে চেনটা ধরে রেখে জোয়ারদার আস্তে আস্তে ঘড়িটাকে ঝুলে পড়তে দিল। গাড়ির অল্প কাঁপুনির সাথে ঘড়িটা চেনের মাথা থেকে দুলছে, এত চমৎকার কাজ, রুমী চোখ ফেরাতে পারে না ঘড়ি থেকে।
ঘড়িটা আস্তে আস্তে দুলছে জোয়ারদারের হাতে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। তাকিয়ে থেকে থেকে রুমীর কেমন যেন মাথা গুলিয়ে আসে, চোখ সরাতে পারে না সে ঘড়ি থেকে। ভয় পেয়ে যায় হঠাৎ। লাফিয়ে উঠে বসতে চায় সে, কিন্তু আবিষ্কার করে ওর কোনো শক্তি নেই, ওর চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে।
ঘুমাও তুমি, ঘুমাও–কে যেন ওকে বলছে অনেক দূর থেকে।
না, না, না, রুমী প্রাণপণ চেষ্টা করে জেগে থাকতে, ভয়ের একটা শীতল স্রোত ওর চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু পারে
ঘুমাও, ঘুমাও তুমি, ঘুমাও!
রুমীর চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসে। গাড়ির সিটে মাথা রেখে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
গাড়ি মতিঝিল কলোনির সামনে এসে ঘুরে গেল তারপর ছুটে চলল উলটোদিকে।
রুমীর ঘুম মাঝে মাঝে হালকা হয়ে এসেছে, কিন্তু একবারও ভাঙে নি। স্বপ্নে দেখছিল উত্তপ্ত মরুভূমির ওপর দিয়ে সে প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছে আর ওর পিছু পিছু ছুটে আসছে বুনো কুকুরের দল, একটি দুটি নয় হাজার হাজার, অন্ধকারেও তাদের সাদা দাঁত আর হিংস্র চোখ স্পষ্ট দেখা যায়। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে রুমীর, কিন্তু তবু ও থামতে পারছে না, থামলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বুনো কুকুরের দল, মুহূর্তে ওকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ধারালো দাঁত দিয়ে। কিন্তু আর পারছে না রুমী, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল বালিতে, কোনোমতে উঠে দাঁড়াল সে, কিন্তু পা যেন গেঁথে গেছে, কিছুতেই নড়তে পারছে না।
লক্ষ লক্ষ বুনো কুকুর ছুটে আসছে-আরও কাছে আরও কাছে-তাদের হিংস্র চিৎকারে কানে তালা লেগে যায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে রুমী, সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায় ওর। অনেকক্ষণ লাগল ওর বুঝতে ব্যাপারটা কি। ধ ধ করে তখনো ওর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড শব্দ করছে, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, সে শুয়ে আছে একটা অন্ধকার ঘরে আর ঘরের বাইরে সত্যি সত্যি অসংখ্য কুকুর তখনো গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করল রুমী। কি হয়েছে ওর! আবছা, মনে পড়ল শানুর কাছে যাবার কথা ছিল, কমলাপুর স্টেশনে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ-ইভা!
এক মুহূর্তে সবকিছু মনে পড়ে যায় রুমীর, সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বসে বিছানায়। কোথায় নিয়ে এসেছে ওকে? অন্ধকার ঘর, ভালো করে কিছু দেখা যায় না। ঘরে আর কেউ আছে কি? কান পেতে শোনার চেষ্টা করল রুমী, কিছু বুঝতে পারল না। ছোট ঘর, দরজা-জানালা সব বন্ধ, ঘরের একপাশে কি সব জিনিস রাখা। সাবধানে বিছানা থেকে নামে রুমী, হাতড়ে হাতড়ে দেয়াল স্পর্শ করে দরজা খুঁজতে থাকে সে। ঘরটা নোংরা এবং মাঝে মাঝেই ভিজে, ওর পায়ের নিচে কাঠকুটো পাথর-চাপা পড়ছে। খুঁজে খুঁজে দরজা পেল শেষ পর্যন্ত, কিন্তু বাইরে থেকে তালা মারা, ও ফাঁক করে দেখতে পায় দরজার কড়ায় মাঝারি গোছের একটা তালা ঝুলছে।
প্রচণ্ড ভয় পেল রুমী, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর, মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তাকে একটা অন্ধকার ঘরে তালা মেরে আটকে রেখেছে। কি করবে তাকে? মেরে ফেলবে? নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে! কিন্তু কেন মেরে ফেলবে? ইভার কথা মনে পড়ে ওর, জোয়ারদারের কথা। গাড়িতে নিশ্চয়ই তাকে সম্মোহিত করেছিল জোয়ারদার। কি আশ্চর্য ব্যাপার, সে ওই ঘড়িটা থেকে চোখ সরাতে পারছে না আর জোয়ারদার তাকে বলে চলছে ঘুমিয়ে পড়তে, কিছুতেই সে জেগে থাকতে পারছে না। কত চেষ্টা করল জেগে থাকতে অথচ সে ঘুমিয়েই পড়ল শেষ পর্যন্ত। রুমীর সারা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, ভুরু বেয়ে ঘাম গালের ওপর দিয়ে গলার দিকে নেমে যায় স্রোতের মতো।
একটুক্ষণ বসে থাকে সে, তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়, হাতড়ে হাতড়ে ঘরটা দেখতে থাকে। কোনো আসবাবপত্র নেই, কোনো জানালা নেই, একটা মাত্র দরজা, তাও বাইরে থেকে তালা মারা। ঘরময় নানা আবর্জনা, ইট, গাছের ডাল, মাটি, ভেজা মতন কি সব জিনিস। এক কোনায় ওর পায়ে গোল মতো কি একটা লাগল। হাত দিয়ে দেখে বেশ মসৃণ, সাবধানে হাতে তুলে নিল সে। ভিতরটা ফাপা, জিনিসটা যত বড় ওজন তার তুলনায় বেশ কম। সে চোখের কাছে নিয়ে দেখার চেষ্টা করল, কিছু দেখা যায় না। সাদা মতন একটা কিছু হবে, বোটকা গন্ধ রয়েছে মনে হয়। দরজার ফাঁক দিয়ে নক্ষত্রের একটু আলো এসে ঢুকছে, রুমী জিনিসটা সেখানে নিয়ে গেল। সে আলোতেও ভালো দেখা যায় না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ জিনিসটা চিনে ফেলল। সারা শরীর শিউরে উঠল ওর। হাতে একটা মরা মানুষের করোটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। যেটুকু আলো আসছে তাতে স্পষ্ট দেখা যায়, ও চিনতে পারছিল না কারণ ও কল্পনাও করে নি এটা একটা করোটি হতে পারে।
জন্তুর মতো গোঙানোর আওয়াজ করে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল করোটিটা, সশব্দে পড়ে
সেটা গড়িয়ে গেল কোনার দিকে। সারা শরীর কাঁপছে রুমীর, ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে পৃথিবীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, দরজা ভেঙে ছুটে পালিয়ে যায় এই অশুভ ঘর থেকে।
কিন্তু ওর কিছু করার নেই, টলতে টলতে বিছানার ওপর উঠে বসে, করোটির স্পর্শ মুছে ফেলার জন্যে বিকারগ্রস্তের মতো বারবার হাত দুটি বিছানার চাদরে ঘষতে থাকে।
খুব ধীরে ধীরে ভোর হলো। দরজার ফাঁক দিয়ে আলো এসে ঘরের ভিতরকার
অন্ধকার তরল করে দিল, আস্তে আস্তে আর একটি একটি করে ঘরের সবকটা জিনিস
স্পষ্ট হয়ে উঠল। রুমী অবাক হয়ে গেল এতক্ষণে কেন পাগল হয়ে যায় নি ভেবে। ঘরের মেঝেতে রয়েছে কাপড়ে জড়ানো একটা শিশুর মৃতদেহ, এমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে যে দেখেই বোঝা যায় শিশুটি মৃত। রাতে রুমী কীভাবে শিশুটির মৃতদেহে পা দেয় নি সেটাই আশ্চর্য। ঘরের চারদিকে অসংখ্য বাদুড়, সব কয়টির গলা দুভাগ করে কাটা, কুঁকড়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে বাদুড়গুলি। এক কোণে মাটিমাখা মৃত মানুষের হাড়গোড়। দেখে মনে হয় কেউ গোর খুঁড়ে তুলে এনেছে, রাতের সেই করোটিটাও এক কোনায় পড়ে আছে। ঘরে মাঝামাঝি রয়েছে কিছু বড় বড় পাত্র, নানা ধরনের তরল পদার্থ সেখানে, বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে। এসব বীভৎস জিনিসের মাঝে খুব বেমানান লাগছে একগোছা ফুল-এত সুন্দর জবা ফুল সে জীবনে দেখে নি।
সবকিছু দেখে রুমী খুব আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে যায়। কাপড়ে জড়ানো শিশুর
মৃতদেহটিও তাকে আর বিচলিত করছে না, মৃত মানুষের হাড়গোড় তার মনে হতে থাকে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ঘরভরা এসব বীভৎস জিনিসের ভিতর বসে থেকে তার খিদে পেতে থাকে। সে হাঁটুতে মুখ রেখে অপেক্ষা করতে থাকে কি হয় দেখার জন্যে।
অনেক বেলা করে একজন লোক তালা খুলে এসে ঢোকে। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, হাসি-খুশি চেহারা। চোখ দুটির দিকে না তাকালে মনে হয় বুঝি খুব আমুদে মানুষ, চোখ দুটি স্থির, মনে হয় মৃত মানুষের। লোকটা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাসনপত্র টানাটানি করতে থাকে। ঘরে যে রুমী বসে আছে সেটা যেন ওর চোখেও পড়ছে না। রুমী আস্তে আস্তে বলল, আমি একটু পানি খাব।
লোকটা কথা শুনেছে কি না বোঝা গেল না, একমনে নিজের কাজ করতে থাকে।
কয়টা বাসন নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় রুমী আরেকবার একটু জোরে বলল, আমি একটু পানি খাব।
লোকটা না শোনার ভান করে ঘরে তালা মেরে চলে গেল। একটু পরে কিন্তু সত্যি এক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরে আসে। গ্লাসটা পরিষ্কার, রুমী এক নিঃশ্বাসে ঢক্ করে পুরো পানিটুকু খেয়ে নিল। গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমি এখান থেকে যাবো।
লোকটার মুখ দেখে মনে হলো সে যেন ভারি মজার একটা কথা শুনেছে।
খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, তাই নাকি? চেষ্টা করে দেখ না, ভুড়ি কীভাবে ফাঁসিয়ে দিই দেখবে না? লোকটা রুমীর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। কি নিষ্করুণু দৃষ্টি। রুমীর সারা গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। সে আর কোনো কথা না বলে বিছানায় বসে থাকে, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল, এখন সেটাও কেমন ভোতা হয়ে বমি বমি লাগছে।
ঘর থেকে সবকিছু বাইরে নিয়ে সামনের ফাঁকা মতো জায়গাটাতে বেশ কয়েকজন লোক মিলে কি কি করতে শুরু করে। দু’একজন বিভিন্ন বয়সী মেয়েও আছে। একে একে সবাই এসে রুমীকে উঁকি মেরে দেখে গেছে, কেউ কিন্তু একটা কথাও বলে নি। রুমীর নিজেকে মনে হতে লাগল খাঁচায় আটকে রাখা একটা অদ্ভুত জন্তু। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে বাইরে কি হচ্ছে। একটা বড় আগুন জ্বালানো হয়েছে, চারপাশে ইট সাজিয়ে একটা চুলার মতন তৈরি করে সেখানে একটা বড় ডেকচি বসানো হয়েছে। একজন খালি গায়ে ঘর্মাক্ত শরীরে মস্ত বড় একটা হাতা দিয়ে প্রাণপণে ডেকচির ভিতরের ফুটন্ত তরল জিনিসটা নেড়ে যাচ্ছে। এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন নানা কাজে ব্যস্ত। কথাবার্তা শুনে মনে হয় একটা বড় উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। রুমীর দিকে পেছন দিয়ে ক’টা লোক কি যেন কাটাকাটি করছে, একজন একটু সরতেই রুমী দেখতে পেল শিশুর মৃতদেহটি। গা গুলিয়ে বমি এসে গেল ওর, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কোনোমতে সরে আসে সে। কি ভয়ানক ব্যাপার! এ কাদের পাল্লায় পড়েছে সে? রুমী চোখ বুজে বসে থাকে, কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই–কথাবার্তা ভেসে আসে তখন। সব সে বুঝতে পারে না কিন্তু একটি-দুটি যা শুনতে পায় তাতে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
উলটাপাল্টা কোপ দিয়ে নষ্ট করিস না।
সবার কি আর তোর মতো মরা কাটার ডিগ্রি আছে!
ডিগ্রি লাগে না, একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই হয়। কোথায় রাখব?
এইখানে এইখানে। এইটুকু মাত্র চর্বি?
দুই বছরের একটা বাচ্চার কতটুকু চর্বি থাকবে? আধমণ?
ভালো বলেছিস… হি হি হি…
দেখো তো রংটা কেউ, পানসে লাগছে না?
ঠিক হয়ে যাবে, বাদুড়ের রক্তটুকু দিলেই ঠিক রং চলে আসবে।
মনে আছে, গতবার কিছুতেই বাদুড় পাওয়া গেল না, শেষে কয়টা চামচিকে ধরে এনে-হি হি হি…
চামচিকে আর বাদুড়ের মাঝে তফাত কি? একটা ছোট আরেকটা বড়, এ ছাড়া
আর কি তফাত?
আরে দুর–দুটো একেবারে ভিন্ন জিনিস!
সে কি রক্ত জমে গেছে যে?
ও কিছু হবে না। ঢেলে দাও।
বোতলটা কার কাছে?
কখন শেষ হয়ে গেছে! তুমি আছ কোন দুনিয়ায়?
আরেকটা বের করো না কেউ!
বেশি খেয়ো না, তোমার তো লেমনেড খেলেই নেশা হয়ে যায়।
হি হি হি…
একটু পরে বাইরে কথাবার্তা কমে আসে। একজন শুধু বসে বসে বড় ডেকচিতে একটা হাতা দিয়ে নাড়ছে। ঝাঁজালো কটু গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে। রুমীর কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার, কিন্তু কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। এমন সময় হঠাৎ সে ইভার গলার স্বর শুনতে পায়। এই সর্বনাশী মেয়েটার ওপরে তার যত আক্রোশই থাকুক না কেন এখন সে-ই হচ্ছে একমাত্র পরিচিত। রুমী দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকল, ইভা এই ইভা!
ইভা একজনের সাথে কথা বলছিল, ঘুরে ওর দিকে তাকাল, কিন্তু তাকে চিনতে পেরেছে সেরকম ভাব দেখাল না। রুমী রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে আবার ডাকে, এবারে কাছে এগিয়ে আসে ইভা, কি হয়েছে?
রাগ দুঃখ হতাশা সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো রুমীর। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর, কোনোমতে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কি হয়েছে?
ইভা নিস্পৃহাভাবে হাত উল্টিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করে, রুমী ওকে থামানোর চেষ্টা করে, আমাকে এখানে এনেছ কেন?
কাজ আছে।
কি কাজ?
সময় হলেই দেখবে।
আমাকে কেন?
তোমার মতই একজন দরকার, ভালো মিডিয়াম।
মানে?
ইভা কঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়, তুমি বুঝবে না।
রুমী আর কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইভা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার চলে যাচ্ছিল, রুমী আবার তাকে থামায়, আমার খুব খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দেবে?
সে কি! তোমাকে কেউ খেতে দেয় নি? ইভা হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। এইটুকু সমবেদনাতেই হঠাৎ করে কেন জানি রুমীর চোখে পানি এসে পড়ে।
ইভা কিছুক্ষণের মাঝেই এক প্লেটবোঝাই খাবার এনে দরজার ফাঁক দিয়ে সাবধানে ঘরের ভিতর গলিয়ে দেয়। রুটি, মাখন,ডিম, মাংসের তরকারি, সবজি এমন কি একটা পেট মোটা বোতলে আধ বোতল মদ। রুমী বুভুক্ষের মতো খাওয়া শুরু করে। ভীষণ খিদে পেয়েছিল ওর, কিন্তু বেশি খেতে পারল না। হঠাৎ করে ওর পেট ভরে বমি বমি লাগতে থাকে। পান খেতে পারলে হতো একটা, মিষ্টি সুপারি দিয়ে সুগন্ধি একটা পান!
রুমী বাড়তি খাবারটুকু বিছানার নিচে রেখে দিল। আবার কখন ওরা খেতে দেবে কে জানে। মদের বোতলটা ফিরিয়ে দিতে দরজার কাছে এসে দেখে ইভা অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখের ভাব দেখে মনে হয় যেন একটু বিচলিত। যত আক্রোশই থাকুক, এই সর্বনাশী মেয়েটার অস্বাভাবিক সৌন্দর্যকে অস্বীকার করা যায় না। রুমী ওকে ডেকে বোতলটা ফিরিয়ে দেয়।
খাও না বুঝি তুমি?
রুমী মাথা নাড়ল। ইভা ছিপি খুলে বোতলে মুখ লাগিয়ে এক ঢোক খেয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়। রুমী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, সে আগে কখনো কাউকে মদ খেতে দেখে নি।
তোমরা কারা?
রুমীর প্রশ্ন শুনে ইভা কেমন যেন একটু চমকে ওঠে। উত্তর দেবে, রুমী আশা করে নি। কিন্তু ইভা বোতলটা হাতে নিয়ে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়, আমরা ডেভিল বা শয়তানের উপাসক। ইংরেজিতে আমাদের বলে উইচ। বাংলায় ডাইনি। কিন্তু ডাইনি কথাটা আমার একেবারে পছন্দ হয় না, আমাকে কি ডাইনির মতো দেখায়?
রুমীকে স্বীকার করতেই হয় ইভাকে ডাইনির মতো দেখায় না।
কখনো ব্ল্যাক আর্টের নাম শুনেছ?
রুমী মাথা নাড়ে, না।
ব্ল্যাক আর্ট হচ্ছে…
ইভার কাছে পরের এক ঘণ্টা রুমী আশ্চর্য এক জগতের খবর শুনল।
মানুষ একই সাথে ঈশ্বর এবং শয়তানের অস্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়েছিল। বেশিরভাগ মানুষ ঈশ্বরের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু এর উল্টোটাও হতে পারতো, সৌভাগ্যবশত হয় নি, হয়তো সেটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। কিন্তু ঈশ্বরের প্রভুত্বকে অস্বীকার করে শয়তানের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছে সেরকম মানুষ একেবারে নেই। তা সত্যি নয়। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে সারা ইউরোপ এ ধরনের মানুষে ছেয়ে গিয়েছিল। তাদের এই শয়তান বা ডেভিলের কাছে বশ্যতা স্বীকার করার এবং তার উপাসনা করার বিভিন্ন পদ্ধতিতে বলে ব্ল্যাক আর্ট বা ব্ল্যাক ম্যাজিক। সাধারণ সমাজ কখনো এদের ভালো চোখে দেখে নি, দেখার কথাও নয়। যুগ যুগ ধরে মানুষ যেসব নীতি এবং বিশ্বাস নিয়ে গড়ে উঠেছে সেসব কিছুকে অস্বীকার করে এরা অদ্ভুত একটা বিকৃত ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকে। শুধু ধর্ম নয়, সত্য-ন্যায় এবং যে কোনো ভালো জিনিসের সাথে এদের যুদ্ধ। শয়তানের প্রভুত্ব স্বীকার করে নেওয়ার পর শয়তান এদের অনেক আশ্চর্য ক্ষমতা দিতে পারে বলে এরা বিশ্বাস করে। এর জন্যে এরা এমন কোনো বিকৃত কাজ নেই যা করতে পারে না। এদের নানা ধরনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, বিশেষ করে ধর্মের বিরুদ্ধে লেগে থাকার জন্যে ধর্মযাজকরা খুব খেপে ওঠে এদের ধরে পুড়িয়ে মারা শুরু করে। সেই সময়ে সারা ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ডের হাজার হাজার শয়তান উপাসক নর-নারীকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয়। অনেক নির্দোষ মানুষ যে মারা যায় নি তা নয়, কিন্তু এদের সংখ্যা সত্যিই কমে গিয়েছিল।
বহুকাল পরে বিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন অনেক কিছু সহ্য করতে শিখেছে এরা আবার তখন আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। খানিকটা নিষিদ্ধ কৌতূহল, খানিকটা বিশ্বাস, খানিকটা লোভ নিয়ে অনেকে আবার সেই পুরাতন শয়তান উপাসনায় ফিরে গিয়েছে। পাশ্চাত্য দেশে জাতি-দ্বেষ, নাৎসিবাদ, সমকাম কোনো কিছুই আর বেআইনি নয়, তাই শয়তান উপাসনাতে আপত্তি কিসের? আগের মতো এটা আর ছড়িয়ে পড়বে না কারণ পাশ্চাত্যের লোকজন এখন পুরোপুরি পার্থিব জগতের বাইরে যেতে চায় না। এ দেশের খেটে খাওয়া একজন চাষির যে পরিমাণ আধ্যাত্মিক জগৎ রয়েছে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে শিক্ষিত লোকটিও তা কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না।
ইভা এবং তাদের দলের কিছু লোকজন আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে শয়তানের উপাসনা শিখে এসেছে। পাশ্চাত্যের শয়তান বা ডেভিলের উপাসক আর এ দেশের প্রেতসাধক কাঁপালিকেরা মিলে এরা নতুন ধরনের ব্ল্যাক আর্ট শুরু করার চেষ্টা করছে। বছর দুয়েক হলো ওরা এখানে-সেখানে শয়তান উপাসনার অনুষ্ঠান শুরু করেছে। চেষ্টা করলে শয়তান বা ডেভিলকেও অনুষ্ঠানে হাজির করা যায়, কিন্তু তার জন্যে বিশেষ গুণসম্পন্ন একটা মানুষ দরকার, সেই ধরনের মানুষকে ওরা মিডিয়াম বলে। গত ছয় মাস থেকে জোয়ারদার হাত দেখার ভান করে মিডিয়াম খুঁজে যাচ্ছিল। একটা মোটামুটি ভালো মিডিয়াম পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু রুমী তার থেকে অনেক ভালো, ওর হাতে নাকি তার স্পষ্ট চিহ্ন আছে। সেজন্যেই রুমীকে এভাবে ধরে এনেছে, এমনিতে সে কখনোই রাজি হতো না।
ইভা রুমীকে বারবার বোঝালো, এতে কোনো ভয় নেই, রুমী কিছু জানতেও পারবে না, প্লানচেট করে আত্মা আনার ব্যাপার। রুমীর বিশ্বাস হয় নি, সব শুনে ওর আত্মা শুকিয়ে গেছে।
ইভা বলেছে সাধারণ লোকজন কখনো তাদের কাজকর্ম ভালো চোখে দেখে না বলে তারা মফস্বলের এই নির্জন জায়গায় চলে এসেছে। আজ রাতে অমাবস্যা, রাত বারোটার পর তাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সব মিলিয়ে তেরোজন, রুমীকে নিয়ে চৌদ্দ। এক জোড়া স্বামী-স্ত্রী তাদের শিশুসন্তানকে নিয়ে আসবে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করার জন্যে। তারা স্বামী-স্ত্রী এই ধরনের ধারণায় বিশ্বাস করে না, কিন্তু সমাজে থাকতে হয় বলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সাধারণ মানুষজন সবাই জানে জোয়ারদার তার স্বামী, কিন্তু ইভার সাথে জোয়ারদারের কোনো সম্পর্ক নেই।
অনুষ্ঠান বেশ লম্বা। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হলে সবাইকে গায়ে বিশেষ এক ধরনের তেলজাতীয় জিনিস মাখতে হয়। আজ সারাদিন ধরে সেটা তৈরি হচ্ছে। খাওয়ার জন্যে রয়েছে বিশেষ এক ধরনের পানীয়, তাতে অ্যালকোহল ছাড়াও আরও অনেক কিছু মেশানো হয়। তাদের অনুষ্ঠানে গায়ে কোনো কাপড় না রেখে যোগ দেওয়ার কথা, কিন্তু যারা বিদেশে যায় নি তাদের লজ্জা একটু বেশি বলে অনেক সময়ে একটু কাপড় পরে থাকে। ইভার কাছে। কেন যেন এ ব্যাপারটা খুব কৌতুককর মনে হওয়াতে সে খিল খিল করে হাসতে শুরু করে। তার সুন্দর মুখে এই মিষ্টি হাসি দেখে কে তাকে কোনো কিছুতে সন্দেহ করবে? হাসি থামিয়ে ইভা রুমীকে অভয় দেয়, তাকে কাপড় ছাড়া থাকতে হবে না, সে তো আর তাদের দলের কেউ নয়–সে হচ্ছে মিডিয়াম। আর গায়ে অবিশ্যি সেই বিশেষ তেলটি মাখতে হবে আর সেই পানীয়টা তাকেও খেতে হবে। পানীয়টা নাকি খুব সুস্বাদু, খেতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রুমী ওদের মাঝখানে বসে থাকবে, সময় হলে ডেভিল তার ওপরে ভর করে অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। সারারাত ধরে অনুষ্ঠান চলার পর ভোর রাতে ওরা ঘুমাতে যাবে। তখন রুমীর কাজ শেষ, সে যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে।
ওর কাজ শেষ হলে ও যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে কথাটা রুমী প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিল, মানুষ সব সময়েই ভালো জিনিসটা বিশ্বাস করতে চায়, দৈনন্দিন জীবনে সেটা একটা আশীর্বাদের মতোই। কিন্তু অঘটনের আগে মানুষ যেসব খারাপ ব্যাপার ঘটতে পারে সেগুলি ইচ্ছা করে না দেখার ভান করে বলেই এতে অঘটন ঘটে। এ সত্যটা রুমী সব সময় মনে রেখেছে, এবারেও সে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বুঝতে পারল আসলে এরা তাকে ছেড়ে দেবে না। অন্য কোনো কারণে না হোক, সে ঘরে একটা শিশুর মৃতদেহ দেখেছে, তার সামনে আজ রাতে আরেকটা শিশুকে উৎসর্গের নামে হত্যা করা হবে, এই দুই ঘটনার সাক্ষীকে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা কিছুতেই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে না। এদের কোনো কোমল অনুভূতি নেই, কাজ শেষ হওয়ার পর তাকে ওরা অবলীলায় হত্যা করবে।
মৃত্যু-ভয়ের চেয়ে বড় ভয় কিছু নেই, রুমী পায়ে দাঁড়ানোর জোর পাচ্ছে না। বিছানায় বসে দরদর করে ঘামতে শুরু করে। কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না সে। ছাড়াছাড়া ভাবে ছেলেবেলার ঘটনা, বন্ধুদের চেহারা, শানুর কথা, বহুকাল আগে শোনা মায়ের গলার স্বর এসব মনে হতে থাকে ওর। রুমী প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত করতে। তাকে মেরে ফেলবেই, এটা কোনো অবধারিত সত্য নয়, কাজেই ওকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কত মানুষ আরও কত বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে, কাজেই ওর কোনো আশা নেই এটা ঠিক নয়। রুমী ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে বসে। ওর বারবার মনে হয় এটা বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন, এক্ষুণি ঘুম ভেঙে দেখবে ঘরে তার পরিচিত বিছানায় শুয়ে আছে।
কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন থেকে অনেক ভয়াবহ সেটা বুঝল অনেক পরে।
চার
রাত ঠিক বারোটা বেজেছে। রুমী উঁচু একটা জায়গায় কালো কাপড়ে ঢাকা একটা চেয়ারে বসে আছে। অদ্ভুত একটা কালো আলখাল্লা পরানো হয়েছে তাকে, মাথায় কালো লম্বা সুচালো একটা টুপি। টুপির দুপাশে শিঙের মতো খানিকটা বের হয়ে আছে। আলখাল্লার বুকে সাদা চাকার মতো কি যেন আঁকা, তাতে নানারকম উদ্ভট চিহ্ন। ইভা, আরও দুটি মেয়ে এবং একজন নির্লজ্জা বুড়ি তার সারা গায়ে খুব ভালো করে সেই বিশেষ লাল রঙের তেলটি মাখিয়েছে। ইভার কাছে শোনার পর থেকে রুমীর সন্দেহ হচ্ছিল যে এই তেলটিতে কোনো ধরনের ওষুধ থাকতে পারে যা তার লোমকূপের ভিতর দিয়ে শরীরে ঢুকে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো করে ফেলবে। সেটা যতটুকু সম্ভব বন্ধ করার জন্যে সে তার বুকে-পিঠে আর মুখে ধুলোবালি আর দুপুরের অবশিষ্ট খাবারের মাখনটুকু মেখে নিয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়েছে কি না বলা কঠিন, কারণ তেলটুকু মাখানোর পর থেকে তার সারা শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠছে। শুধু তা-ই নয়, তার প্রচণ্ড ভয়টুকু কমে গিয়ে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে একটু একটু খুশি খুশি লাগা শুরু হয়েছে। সারাক্ষণ গ্লাসে করে তাকে কি একটা খেতে দিচ্ছে, খেতে সেটা সত্যিই খুব ভালো। রুমী সেটা ঠোঁটে লাগিয়ে খাওয়ার ভান করে সাবধানে নিজের আলখাল্লায় ঢেলে ফেলছে। কালো আলখাল্লা ভিজে গেলেও বোঝা যায় না, তাছাড়া জায়গাটা বেশ অন্ধকার, আলো বলতে মশালের মতো বড় একটা মোমবাতি, একটি করোটির ওপর সেটা বসানো। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে বলে এই আলোতে বেশ দেখা যায়। রুমীর পায়ের কাছে তাকে পেছন দিয়ে একটা বৃদ্ধ লোক হাঁটু মুড়ে বসে আছে। তার সামনে একে একে এগারোজন নর-নারী এসে গায়ে গায়ে ঘেঁষে চুপ করে বসে আছে। একপাশে মাটিতে একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে, সকাল থেকেই তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হয়েছে। একে উৎসর্গ করার নামে হত্যা করা হবে ভেবে একটু পর পরই রুমীর সারা শরীর শিউরে উঠছে।
কোনো কথাবার্তা নেই, শুধু মোমবাতির শিখাঁটি একটু একটু শব্দ করে পুড়ছে। মোম গলে করোটির একটা চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে। দূরে কোথাও প্রথমে একটা তারপর অনেক শেয়াল ডেকে উঠল, তাই শুনে হঠাৎ রুমীর বুকের ভিতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।
বৃদ্ধ লেকাটি উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি পড়তে শুরু করে দিল, হঠাৎ শুনলে মনে হয় খিস্তি করছে। আসলেও তাই। ঈশ্বরকে, সকল ধর্মকে, সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাকে, পৃথিবীতে যা কিছু ভালো আছে সবকিছুকে অভিশাপ দিয়ে এই অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়। বৃদ্ধের সাথে গলা মিলিয়ে অন্যেরাও বিড়বিড় করে কি সব বলতে শুরু করে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মন্ত্র পড়ার মতো বেশ অনেকক্ষণ চলল এই রকম। একসময় সবাই থেমে পড়লে বৃদ্ধটি কেশে গলা পরিষ্কার করে অনেকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করে। প্রথমে সে সবাইকে ধন্যবাদ দেয় এখানে আসার জন্যে, তারপর তারা যে কত ভাগ্যবান সে নিয়ে একটু বিস্ময় প্রকাশ করে। নতুন যারা এসেছে তারা যদিও সবারই পরিচিত তবু তাদের আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। তারা উঠে এসে বৃদ্ধটি যে জায়গায় মুখ লাগিয়ে চুমু খাওয়ার ভান করল সেটি না দেখলে রুমী কখনো বিশ্বাস করতো না। একজন একজন করে সবাই স্পষ্ট ভাষায় বলল তারা নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছে। তারা সজ্ঞানে এখন থেকে খোদার ওপর থেকে বিশ্বাস সরিয়ে শয়তান বা প্রেতকে নিজেদের ভবিষ্যতের প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে। এরপর প্রত্যেককেই দু-তিন মিনিট করে সময় দেওয়া হলো কিছু বলার জন্যে। তারা প্রথমে এখন পর্যন্ত কি কি অসামাজিক কাজ করেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে ঈশ্বর, সমাজ এবং ধর্মকে এমন জঘন্য ভাষায় গালাগাল শুরু করে দিল যে তাদের থামানো মুশকিল হয়ে পড়ল। এরপর এদের প্রত্যেকের নাম পাল্টে নতুন নাম দেওয়া হলো। এখন থেকে নিজেদের মাঝে তারা এ নামেই পরিচিত হবে। একজনের নাম মড়াখাগী’, একজন রক্তচোষা’ অন্যগুলি এত অশ্লীল যে মুখে উচ্চারণ করা যায় না।
দলের নতুন সভ্যেরা বৃদ্ধটির সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। বৃদ্ধটি আবার বক্তৃতার মতো শুরু করে, আমাদের সাথে আজকে আরও পাঁচজন এসে যোগ দিতে পেরেছে এজন্যে আমরা সবাই আনন্দিত। আজকে এজন্যে অনেক রকম আনন্দের ব্যবস্থা আছে। অনুষ্ঠান শুরু করার আগে তোমাদের নতুন পাঁচজনের প্রভু শয়তানের কাছে সারা জীবনের জন্যে অঙ্গীকার লিখে দিতে হবে। প্রভু তাহলে তোমাদেরও নিজের কাছে টেনে নেবেন। তোমাদের ভাগ্য আমাদের ভাগ্য থেকে অনেক ভালো, অঙ্গীকারে আজকে স্বয়ং প্রভু শয়তান নিজে এসে স্বাক্ষর করবেন। এই সময় সবাই ঘুরে রুমীর দিকে তাকায়, রুমী অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে।
বৃদ্ধটি কোথা থেকে কাগজ বের করে পাঁচজনের হাতে দিয়ে ইংরেজিতে বলে দিতে থাকে কি লিখতে হবে। মোমবাতির কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে ওরা লিখতে শুরু করে। একজন ইংরেজি জানে না বলে তাকে বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হলো। প্রভু শয়তানের স্পষ্টতই ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সবাই লিখল যে ওরা প্রতিজ্ঞা করছে আজীবনের জন্যে সবাই প্রভু শয়তানের দাসত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে। তার বিনিময়ে প্রভু শয়তান তাদের ঈশ্বরের কোপানল থেকে রক্ষা করবেন এবং নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার প্রচণ্ড ক্ষমতার একটা ক্ষুদ্র অংশ তার মাঝে সঞ্চারিত করে দেবেন। সবাই স্পষ্ট করে লিখল যদি তারা কোনোভাবে তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে প্রভু শয়তান তার এবং তার বংশধরের আত্মাকে ইহকাল ও পরকালে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নিপীড়ন করতে পারেন।
অঙ্গীকার লেখা শেষ হবার পর ওরা উঁচ দিয়ে আঙুল ফুটিয়ে রক্ত বের করে সাবধানে কাগজের নিচে স্বাক্ষর করে। বৃদ্ধটি সবার হাত থেকে কাগজগুলি নিয়ে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে বলল, প্রভু শয়তান অঙ্গীকারপত্র স্বাক্ষর করে তাদের শরীরে একটা চিহ্ন দিয়ে দেবেন, এরপর থেকে তারা পুরোপুরি নিজেদের লোক হিসেবে গণ্য হবে।
বৃদ্ধ লোকটি কি বলতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। একজনকে, দেখে ঠিক চেনা যায় না কিন্তু রুমীর মনে হলো, জোয়ারদারই হবে, একটু সরে গিয়ে কি একটা যেন চালিয়ে দিয়ে গেল। একটু পরেই আস্তে আস্তে ঢাকের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। গমগমে অদ্ভুত একটা শব্দ, কখনো সামনে কখনো পেছনে আবার কখনো ডান পাশ আর বাম পাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে। রুমী স্পিকারগুলি দেখার চেষ্টা করে কিন্তু অন্ধকারে দেখা যায় না। ঢাকের শব্দ এত জীবন্ত যে রুমীর মনে হতে থাকে ভালো করে তাকালে দেখবে ওকে ঘিরে আদিবাসীরা নাচের তালে তালে ঢাক বাজিয়ে চলছে। অদ্ভুত রহস্যময় ঢাকের শব্দ, বুকের ভিতরে যে আদিম অনুভূতি লুকিয়ে রয়েছে সেটা টেনে বের করে নিয়ে আসতে চায়। রুমীর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে।
সবাই নিজেদের গ্লাসভর্তি করে নিয়ে সেই সুস্বাদু পানীয়টুকু খেতে শুরু করে। ঢাকের শব্দের তালে তালে সবাই মেঝেতে পা ঠুকছে, ওদের মাথা দুলছে, কেউ কেউ আবার তালে তালে হাত দোলাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবাই একজন আরেকজনের পেছনে দাঁড়িয়ে লম্বা সারি করে রুমীকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। ঢাকের শব্দের তালে তালে ওদের পা পড়ছে, হাত নড়ছে, মাথা দুলছে। বৃদ্ধ লোকটি হাত থেকে কি যেন ছুঁড়ে দিল আগুনে, দপ্ করে বড় একটা শিখা জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল, আর সাথে সাথে সারাঘর অদ্ভুত একটা গন্ধে ভরে গেল, মাতৃগর্ভে বুঝি এরকম গন্ধ থাকে।
রুমীর আশ্চর্য এক অনুভূতি হচ্ছে, সবকিছুকে মনে হচ্ছে অবাস্তব ঘোরের মতো। হাত-পা হঠাৎ করে ওর শিথিল হয়ে ওঠে, পর মুহূর্তে আবার টানটান হয়ে উঠতে চায়। মনে হতে থাকে ওর পা দুটি যেন পেছন দিকে ঘুরে যেতে চাইছে। মাথাটা কেন জানি বুকের ওপর ঝুঁকে পড়তে চায়, ও চেষ্টা করেও সোজা রাখতে পারে না। ঠোঁট, গলা শুকিয়ে ওর প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেতে থাকে, হাতের গ্লাসের পানীয়টুকু ঢক ঢক্ করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করেও তৃষ্ণা কমে না, বুকটা শুকনো মরুভূমির মতো মনে হয়।
ঢাকের শব্দ দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে। ওকে ঘিরে সবাই তখন আরও দ্রুত ঘুরে চলেছে, নাচের ভঙ্গিতে হাত-পা নড়ছে, মাথা দুলছে, দেহ নড়ছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে সবাই আদিম উল্লাসে ঘুরে চলেছে। একে একে ওদের দেহ থেকে কাপড় খসে পড়ে। মোমবাতির ম্লান আলোতে ওদের ঘর্মাক্ত নগ্ন দেহ চকচক করতে থাকে। ঢাকের দ্রুত লয়ের শব্দের সাথে সাথে ওদের অঙ্গভঙ্গি অশ্লীল হতে শুরু করে, ওরা যেন মানুষ নয়, বোধশক্তিহীন হিংস্র পশু। নাচতে নাচতে ওরা আহত পশুর মতো দুর্বোধ্য শব্দ করতে তাকে, দেহ দুলিয়ে হাত নেড়ে ওরা রুমীকে আহ্বান করতে থাকে নিজেদের দিকে।
নিজের ভিতর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন টের পায় রুমী। ওর হাত-পা যেন অনেক বড় বড় হয়ে গেছে, শরীর থেকে খুলে বেরিয়ে যেতে চায়। সমস্ত শরীরে যেন কাটা ফুটছে, সেই সাথে কুলকুল করে ঘামছে সে। প্রচণ্ড গরমে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে রুমী, তবু কিছুতেই যেন ও বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে না। মুখ খুলে গিয়ে দাঁত বের হয়ে পড়ে হাসির ভঙ্গিতে, চোখ বড় বড় করে তাকায়। মাথাটা ঘুরে যেতে থাকে অদ্ভুতভাবে কখনো ডান দিকে, কখনো বাম দিকে-চেষ্টা করেও সোজা রাখতে পারে না। ঢাকের শব্দ দ্রুত লয়ে বেজে চলেছে, ওকে ঘিরে সবাই পাগলের মতো নাচছে, মুখে চিৎকার করে বলছে, আয়-আয়-আয়রে! আয়-আয়-আয়রে!!
রুমীর ভিতরে বহুদূর থেকে কে যেন বলতে থাকে, আসছি! ওর চেতনা আস্তে আস্তে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির আলোতে আদিম উল্লাসে নৃত্যরত উলঙ্গ নর-নারী ওর চোখের সামনে আবছা হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে। কুৎসিত একটা মুখ সে দেখতে পায়, বীভৎস তার চেহারা। সে মানুষ নয় কিন্তু মানুষের মতো, সে কোনো পশু নয় কিন্তু পশুর মতো। লাল সরু একটা জিব একবার বের হচ্ছে একবার বড় মুখের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। চোখ দুটি নির্বোধ ছাগলের চোখের মতো নিষ্প্রভ, একদৃষ্টে যে রুমীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভয় পেল রুমী, ভয়, প্রচণ্ড ভয়। এ ভয়ের কোনো সীমা নেই, শেষ নেই। জীবন শেষ হয়ে গেলেও এই ভয় রক্তের মাঝে রয়ে যায়, যুগ যুগ ধরে রক্তের ভেতর দিয়ে এই ভয় বংশধরের মাঝে সঞ্চারিত হয়ে যায়।
চিৎকার করে ওঠে রুমী, যত জোরে সম্ভব, ওর গলার শিরা বুঝি ছিঁড়ে যাবে, তবু থামতে পারে না সে।
কানের কাছে কে যেন বলল, লুসিফার! লুসিফার!!
আর কিছু মনে নেই রুমীর।
ভাগ্যিস মনে নেই। অন্য সবকিছু ছেড়ে দিলেও চৌদ্দ মাসের যে শিশুটিকে নিজের বাবা-মায়ের হাতে এক অন্ধকার জগতের উপাসনায় প্রাণ দিতে হলো সে ঘটনাটি নিজের চোখে দেখতে হলো রুমী কোনোদিন জানতেও পারবে না শিশুটির রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে সে যখন খনখনে গলায় অট্টহাসি দিয়ে উঠেছিল, শয়তানের উপাসক ওই বারোজন নর-নারী পর্যন্ত আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল। কিন্তু রুমীর কিছু মনে নেই।
রুমীর খুব ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এসেছে। ওর নিজেকে প্রচণ্ড জ্বরে বিকারগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছিল। অনেকক্ষণ লাগল ওর সবকিছু মনে করতে। ওর ইচ্ছে করছিল আবার অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু বুকের ভিতর কে যেন তাকে জোর করে জাগিয়ে রাখল। বারবার কে যেন মনে করিয়ে দিতে থাকে : ওকে বাঁচতে হবে, আর বাঁচতে হলে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। বারবার ওর বোধশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছিল, যা হয় হোক, এ ধরনের একটা অনুভূতি ওকে দখল করে নিতে চাইছিল, কিন্তু জোর করে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখল। সাবধানে চোখ খুলে তাকিয়ে পরিবেশটা বুঝতে চেষ্টা করল সে।
একটা বিছানায় শুয়ে আছে রুমী। ও একা নয়, ওকে জড়িয়ে ধরে ওর পাশে আরও কেউ শুয়ে আছে, ওর বুকের ওপর তার একটা হাত। সাবধানে সে হাতটা সরিয়ে দিয়ে মানুষটাকে দেখতে চেষ্টা করে, অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু রুমী বুঝতে পারে: একটি মেয়ে। রুমী আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রচণ্ড ব্যথায় ওর মাথাটা ছিঁড়ে পড়তে চাইল। শব্দ করবে না করবে না করেও গলা দিয়ে ব্যথার একটা আর্তধ্বনি বের হয়ে গেল। পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটি ঘুমের ঘোরে কি একটা বলে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, গলার স্বরে মেয়েটিকে চিনতে পারে রুমী, ইভা। কিন্তু এ নিয়ে রুমীর এখন বিস্মিত হওয়ার মতো অবস্থা নেই। সাবধানে সে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ায়, মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো অবস্থা তার, কোনোমতে একটু স্থির হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, অন্ধকারেও জায়গাটি বেশ বোঝা যাচ্ছে। শব্দ না করে ছিটকিনি খুলে সে বের হয়ে আসে, একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ওর সারা শরীর জুড়িয়ে দেয় সাথে সাথে। বাইরে অন্ধকার রাত, পরিষ্কার আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র ঝক্ঝক্ করছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে। ও নক্ষত্র চেনে না, চিনলে বলতে পারতো এখন ভোর রাত চারটা। রুমী সাবধানে বারান্দা দিয়ে হেঁটে উঠানে নেমে পড়ে। ঘেউ ঘেউ করে একটা কুকুর ডেকে উঠল কোথাও, রুমী ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। একটা বিরাট মাঠের মতো ফাঁকা জায়গা, দূরে উঁচু সড়ক আবছা বোঝা যায়। রুমী সেদিকে ছুটতে থাকে। খালি পায়ে হাঁটার অভ্যাস নেই অনেকদিন, লম্বা আলখাল্লা পায়ে জড়িয়ে যায়, প্রতি পদক্ষেপে ওর মাথা প্রচণ্ড ব্যথায় শরীর থেকে ছিঁড়ে পড়তে চায়, কিন্তু রুমীর কিছু করার নেই। দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটতে থাকে ও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর এখান থেকে সরে পড়তে হবে। মাঠটা পার হয়ে উঁচু সড়কে উঠে ও পেছন ফিরে তাকায়, দূরে ওই ভুতুড়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা দুটি তালগাছ বাড়ির পেছনে, এখান থেকে আবছা আবছা দেখা যায়। জায়গাটা চিনে রাখতে পারলে হতো, কিন্তু রুমীর এখন থামার সাহস নেই। সে রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে, চেষ্টা করে মনে রাখতে রাস্তায় কি পড়ছে। কোনো লোকালয় নেই, একটা গোরস্তান, বহুদূর ফাঁকা রাস্তা তারপর একটা বড় বটগাছ আবার ফাঁকা রাস্তা, রুমী প্রাণপণে ছুটতে থাকে। ওর গায়ে জোর নেই, পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে, প্রচণ্ড ব্যথায় মাথা ছিঁড়ে পড়তে চাচ্ছে কিন্তু তবু সে থামে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে পারলে বাঁচে।
স্থানীয় থানায় পৌঁছাল রুমী ঘণ্টাখানেক পরে। পথে ছোট একটা দোকান পেয়ে সে দোকানিকে ডেকে তুলেছে। দোকানি দরজার ফাঁক দিয়ে ওকে এই অদ্ভুত পোশাকে এরকম অবস্থায় দেখে প্রথমে কিছুতেই ঝাঁপ খুলতে চায় না। রুমী অনেক কষ্ট করে বুঝিয়েছে নিজের অবস্থা, তখন দোকানি পৌঁছে দিয়েছে ওকে থানায়। থানার বৃদ্ধ এসআই কিছুতেই রুমীর কথা বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না। চোখ লাল, কথাবার্তা অসংলগ্ন, শরীর থেকে পরিষ্কার মদের গন্ধ বের হচ্ছে, কম বয়সী নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলে তিনি আগেও অনেক দেখেছেন। এর কথা বিশ্বাস করে এখন কে যাবে ভূতের সাধনা দেখতে? গায়ের লাল রং আর অদ্ভুত আলখাল্লাটি দেখে অবিশ্যি কেমন যেন একটু সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু তবুও তিনি ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করাই স্থির করলেন। রুমীকে রাতটা লক-আপে রাখতে বলে তিনি গেলেন অজু করতে, ফজরের আজান পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।
রুমীর কথা পুলিশের বিশ্বাস না হওয়ায় তার খুব আশা ভঙ্গ হলো। এতক্ষণ যে শক্তিটি তাকে চালিয়ে এনেছে সেটি এখন ফুরিয়ে গেছে। বসে থাকার ক্ষমতা নেই। ওকে নিয়ে হাজতে রাখবে রাতটা, কিন্তু তাতে ওর কিছু আসে যায় না। ও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল একটা বেঞ্চের ওপর। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে, শরীরটা কাঁপছে অল্প অল্প। চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল ওর, অচেতন হয়ে পড়ছিল সে। হঠাৎ রুমীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে খুলে যায়-ও স্পষ্ট দেখতে পায় সেই বীভৎস কুৎসতি মুখটি ওর মুখের ওপর ঝুঁকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, লাল জিবটি বারবার লক লক করে বের হয়ে আসছে মুখ থেকে। ছাগলের চোখের মতো দুটি স্থির চোখ সোজা ওর দিকে তাকিয়ে রুমীর সারা শরীর কুঁকড়ে গেল ভয়ে, চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল সে, অমানুষিক সে চিৎকার। চিৎকার বন্ধ করতে পারে না রুমী, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় ওর, একসময় গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। বেঞ্চ থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় সে, প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে বেঞ্চের তলায় অন্ধকারে ঢুকে পড়তে।
বৃদ্ধ এসআই অজু শেষ না করেই ছুটে এলেন ভিতরে, রুমীর ওপর ঝুঁকে পড়ে ভয় পাওয়া গলায় ডাকলেন তাকে, এই ছেলে, এই ছেলে কি হয়েছে তোমার? আস্তে আস্তে রুমীর সারা শরীর শিথিল হয়ে আসে, সে মেঝেতে লম্বা হয়ে পড়ে থাকে স্থির হয়ে। বৃদ্ধ এসআই ওকে টেনে বের করলেন বেঞ্চের তলা থেকে, মাথাটা ঘুরে গেছে অদ্ভুতভাবে, টেনে সোজা করার চেষ্টা করলেন তিনি। আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল রুমীর, আশ্চর্য স্থির একটা দৃষ্টি তার চোখে। সে দৃষ্টি বৃদ্ধ এসআইয়ের চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকে তার হৃৎপিণ্ড যেন টেনে-হিঁড়ে বাইরে নিয়ে এলো। আতঙ্কে শিউরে উঠে লাফিয়ে পিছিয়ে গেলেন তিনি ইয়া আল্লাহ! কঁপা গলায় আয়তুল কুরসি পড়তে লাগলেন বুকে হাত দিয়ে খন্ খন গলায় অট্টহাসি হেসে ওঠে রুমী, ওর গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে আবার। বৃদ্ধ এসআইয়ের মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল, হাত বাড়িয়ে একটা টেবিল ধরে কোনোমতে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ইদরিস মিয়া তাড়াতাড়ি দশজনকে বলো রাইফেল নিয়ে তৈরি হতে। ড্রাইভারকে ডেকে তোলো-জলদি!
থানার মেঝেতে শুয়ে অট্টহাসি হাসতে থাকে রুমী, কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। হাসপাতালে খবর দেওয়া হয়েছে, লোকজন ওকে নিতে আসছে। বৃদ্ধ এসআই দশজন সশস্ত্র পুলিশকে পুরোনো একটা জিপে গাদাগাদি করে তুলে সেই ভুতুড়ে বাড়িটি ঘিরে ফেললেন ভোর রাতেই। ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেল তার বহুদিন পর।
পাঁচ
কিবরিয়া ভাইয়ের অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস, তাই সাতসকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে খুব বিরক্ত হলেন তিনি। নিশ্চয়ই খবরের কাগজের ছেলেটা টাকা নিতে এসেছে, খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন চলে যাবে ভেবে, কিন্তু চলে যাবার কোনো লক্ষণ নেই, কড়া নাড়া বন্ধ হয়ে বরং দরজায় লাথি মারার মতো শব্দ হতে থাকে। বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলতেই তার খাবি খাবার মতো অবস্থা! বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, আপনার নাম কিবরিয়া চৌধুরী? টোক গিলে কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি, কি হয়েছে?
হুঁ। আমার সাথে যেতে হবে আপনাকে, চলুন। পুলিশটি পারলে তাঁকে সেভাবেই নিয়ে যায়।
কিবরিয়া ভাই মিনমিন করে বললেন, একটু বাথরুম থেকে… তাড়াতাড়ি… পুলিশটা প্রায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।
বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কিবরিয়া ভাই জানালা গলে পালিয়ে যাবেন কি না ভাবলেন। নিশ্চয়ই তাঁর ইদানীংকার রাজনীতি নিয়ে একটা কিছু হয়েছে। কেন মরতে ওই সব উগ্র বামপন্থি রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন, রাগে-দুঃখে তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে।
এমনিতে তার কোষ্ঠকাঠিন্যের দোষ, প্রতিদিন বাথরুমে পাকা এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ভয়ের চোটে আজ পাঁচ মিনিটেই সব সমাধান হয়ে গেল। যত্ন করে দাড়ি কামিয়ে একেবারে সুট-টাই পরে নিলেন। ভালো কাপড় পরা থাকলে লোকজন ভালো ব্যবহার করে, সমাজব্যবস্থার এই জঘন্য প্রচলিত নিয়ম মানতে আজ তাঁর। এতটুকু দ্বিধা হলো না।
তাঁর চকচকে পোশাক দেখে সত্যি সত্যি পুলিশটা পঁড়িয়ে পড়ে, ভদ্রভাবে বলে, চলুন স্যার, বাইরে জিপ আছে।
জিপে ওঠার সময় কিবরিয়া ভাই দেখলেন আশেপাশে লোকজন উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে-বাড়িওয়ালা আবার একটা ঝামেলা না বাধিয়ে ছাড়বে না।
কিবরিয়া ভাইকে থানায় না নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের তিন তলা একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে পুলিশ পাহারা, ভিতরে বেশ কজন ডাক্তার, পুলিশের বড় বড় অফিসার। কিবরিয়া ভাইকে দেখে একজন এগিয়ে এলো, আপনি কিবরিয়া চৌধুরী?
জি।
একে চেনেন আপনি?
কিবরিয়া ভাই দেখলেন বিছানায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে রুমী। মাথায় ব্যান্ডেজ, নাকে অক্সিজেন টিউব, হাতে স্যালাইন, বুকে-হাতে-কপালে নানা ধরনের মনিটর, দেখে বোঝা যায় না আদৌ বেঁচে আছে কি না।
চেনেন একে?
চেনেন বলে কি বিপদে পড়বেন কে জানে, মিথ্যা বললে বিপদ হয়তো আরও বেড়ে যাবে। দুর্বল গলায় আমতা আমতা করে বললেন, হ্যাঁ চিনি। কেন?
পুলিশ অফিসারটি সংক্ষেপে তাকে পুরো ব্যাপারটি খুলে বলতেই মুহূর্তে তিনি সাহস ফিরে পেলেন। সেই ভুতুড়ে বাড়িতে রুমীর ব্যাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির একটা বই পাওয়া গেছে, লাইব্রেরিতে খোঁজ করে দেখা গেছে এটি কিবরিয়া ভাই নিয়েছেন। সে রাতের পর রুমীর আর জ্ঞান ফেরে নি, তাই তার পরিচয় জানার জন্যে কিবরিয়া ভাইকে আনা হয়েছে। রুমীকে যখন ঢাকায় আনা হয় তখন তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, নিউরো সার্জনরা ছয় ঘণ্টা অপারেশন করেছেন, তারা বলেছেন এ যাত্রা সে বেঁচেও যেতে পারে। পাঁচ দিন হয়ে গেছে এখনো জ্ঞান ফেরে নি, আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে হবে। কিবরিয়া ভাই রুমীর আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়ার ভার নিলেন। পুলিশ অফিসারটি তাঁকে অনুরোধ করলেন ব্যাপারটি গোপন রাখতে, খবরের কাগজে পর্যন্ত ঘটনাটি ছাপতে দেওয়া হয় নি।
রুমীর জ্ঞান ফিরল কুড়ি দিন পর। এই কুড়ি দিন কিবরিয়া ভাই প্রেতচর্চা এবং ব্ল্যাক আর্ট সম্পর্কে দেশি-বিদেশি যতগুলি বই পেয়েছেন সব পড়ে ফেলেছেন। যত পড়েছেন তত তিনি অবাক হয়েছেন এই বিংশ শতাব্দীতেও যে ধরনের ব্যাপারটা ঘটতে পারে তিনি নিজের চোখে রুমীর অবস্থা না দেখলে বিশ্বাস করতেন না। রুমীর জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকদিন তিনি ওকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন, শেষের দিকে ডাক্তাররা সন্দেহ করছিলেন রুমীর জ্ঞান হয়তো আর নাও ফিরে আসতে পারে, এভাবেই অনির্দিষ্টকাল অচেতন হয়ে থাকবে। তাই যেদিন রুমীর জ্ঞান ফিরে এলো সেদিন কিবরিয়া ভাইয়ের আনন্দের সীমা ছিল না, পরিচিতদের ভিতর রুমীর জন্যেই তাঁর খানিকটা স্নেহ রয়েছে।
জ্ঞান ফিরে আসার পর রুমীর মুখে পুরো ঘটনা শুনে তিনি প্রেত উপাসকদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলেন। তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করেন কাজেই ঈশ্বর বা শয়তান যাকে খুশি প্রভু হিসেবে দাবি করায় তার কিছু আসে যায় না, কিন্তু উপাসনার নামে নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা বা নিরীহ ছেলেদের মেরে ফেলার আয়োজন করাটা মেনে নেওয়া যায় না। ওদের প্রত্যেককে ফাঁসিতে ঝোলানো পর্যন্ত তিনি শান্তি পাবেন বলে মনে হয় না। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে ওদের বিচারের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেত উপাসকদের কোনো বিচার হলো না। রুমী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার আগেই প্রেত উপাসকের দল ছাড়া পেয়ে গা ঢাকা দিল, কেন এমন হলো ঠিক জানা গেল না। কিবরিয়া ভাই অনেক চেষ্টা করে শুধু জানতে পারলেন, দেশের খুব একজন বড় হর্তাকর্তার ছেলে প্রেত উপাসকদের সাথে ধরা পড়েছিল, পুরো ব্যাপারটি তাই এত তাড়াহুড়া করে চাপা দেওয়া হয়েছে। ছেলেটিকে পরদিনই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে এখন ইংল্যান্ড না আমেরিকা কোথায় যেন আছে। দণ্ডমুণ্ডের মালিক একেবারে পাষণ্ড নন, রুমীর যেন ভালো চিকিৎসা হয়, এবং চিকিৎসার সব খরচ যেন সরকার বহন করে তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এটুকু না করলেও চলতো, কারণ কিবরিয়া ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছেন প্রেত উপাসকের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই, রুমীর একার বক্তব্য ধোপে টিকবে না। সাক্ষী-প্রমাণ বের করার দায়িত্ব পুলিশের কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে আঙুলও নাড়াবে না, বলা যেতে পারে নাড়াতে পারবে না।
পরের কয়দিন কিবরিয়া ভাই আগুন খেয়ে অঙ্গার বাহ্যি করার যন্ত্রণা বয়ে বেড়ালেন।
রুমী অনেক পাল্টে গেছে। তার মস্তিষ্কের অপারেশনের পর অনেক কিছু সে একেবারে ভুলে গেছে, মাঝে মাঝে অনেক ছোটখাটো ব্যাপার চট করে মনে করতে পারে না। একটু বেশি রাত জাগলে কিংবা কোনো ব্যাপারে একটু বেশি চাপ পড়লেই তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে থাকে, কোনো পেনকিলার দিয়ে সেটা বন্ধ করা যায় না। ডাক্তার বলেছেন আস্তে আস্তে নাকি সেরে যাবে। আজকাল সে একটু ভীতু হয়ে গেছে, একা ঘরে ঘুমোতে ভয় পায়।
সে আর কাউকে তার সে রাত্রির অভিজ্ঞতা খুলে বলে নি। পুরো ব্যাপারটি খুঁটিনাটিসহ ডাক্তার এবং পুলিশ ছাড়া শুধু কিবরিয়া ভাই শুনেছেন। ডাক্তার এবং কিবরিয়া ভাই দুজনেই তাকে বুঝিয়েছেন যে প্রেত বা শয়তান সবকিছু বাজে কথা, তার পুরো অভিজ্ঞতার মূলে রয়েছে কয়টি মারাত্মক ড্রাগ। তার রক্তে নাকি কোকেন পাওয়া গিয়েছিল। তাকে যে পরিমাণ ড্রাগ দেওয়া হয়েছিল তাতে তার মস্তিষ্ক পাকাপাকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারতো। কেন হয় নি সেটা একটা বিস্ময়। হতে পারে সে বুকে পিঠে কপালে মাখন লাগিয়ে নিজেকে খানিকটা রক্ষা করেছে, মদের সাথে মিশিয়ে যা খেতে দিয়েছিল সেটাই সে কম খেয়েছে। ঠিক কি হয়েছে বলা মুশকিল, কিন্তু ডাক্তার বারবার বলেছেন তার ভাগ্য খুবই ভালো।
রুমীও নিজেকে তাই বোঝায়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছে সে। সে রাতের পর ওই কুৎসিত মুখটিকে লক্ লকে জিব বের করে এগিয়ে আসতে দেখে নি। অনেক কিছু ভুলে গেছে সে, কেন ওই মুখটিও ভুলে গেল না ভেবে ওর খুব দুঃখ হয়। কে জানে ওই মুখ হয়তো ভোলা যায় না, ওর স্মৃতি হয়তো রক্তে মিশে থাকে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকার জন্যে।
ঠিক রুমীর গাঘেঁষে একটা গাড়ি এসে থামে। এ ধরনের ব্যাপার ওর আগে ঘটেছে, কিন্তু রুমী কিছুতেই মনে করতে পারে না কবে কোথায় কীভাবে। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা মেয়ে ওকে ডাকে, রুমী।
সাথে সাথে রুমীর সব মনে পড়ে যায়, ইভা! রুমীর বুক ধক্। করে ওঠে। পালিয়ে যাবে সে? কিন্তু কোথায় পালাবে?
রুমী।
রুমী ইভার দিকে তাকায়, হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এই প্রকাশ্য দিনের বেলায় কি করবে ইভা? গাড়িতে আর কেউ নেই, রুমী একটু এগিয়ে যায়, কি?
কেমন আছ?
ন্যাড়া মাথায় গজানো অল্প অল্প চুল মস্তিষ্কের সেই অপারেশনের দাগ এখনো ঢাকতে পারে নি, আর তাকে কি না জিজ্ঞেস করছে সে কেমন আছো রুমীর ইচ্ছে হলো সে শব্দ করে হেসে ওঠে, কিন্তু ওর হাসি আসতে চায় না। অবাক হয়ে সে ইভার দিকে তাকিয়ে থাকে, এ কি মানবী?
আমি কাল চলে যাচ্ছি। নিউ ইয়র্কেরুমী চুপ করে তাকিয়ে থাকে, এত সুন্দর একটা মুখ, অথচ…
ভয় নেই, আমি আর আসব না। মিষ্টি করে হেসে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, জানো? আমার বাচ্চা হবে?
রুমীর কি আসে যায় তাতে? ওকে বলছে কেন?
বাচ্চার বাবা কে জানো?
চমকে ওঠে রুমী কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে কে?
লুসিফার! লুসিফার আর তুমি! খিলখিল করে হেসে ওঠে ইভা। হাসি আর থামতে চায় না কিছুতেই। হাসতে হাসতেই হাত নেড়ে গাড়ি ছেড়ে দেয় ইভা, রাজারবাগের মোড়ে ডান দিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যায়।
রাস্তার ধারে অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে রইল রুমী, নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেছে মেয়েটা, নিশ্চিয়ই মিথ্যা বলেছে! রুমীর বিশ্বাস হয় না। ওটা মেয়ে নয় ওটা রাক্ষুসী, ও সব পারে। আবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন এরকম বলল।
কিন্তু রুমীর সাথে ইভার আর কোনোদিন দেখা হয় নি।