Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay » Page 5

জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay

প্রকাশ সরকার কাকাবাবুকে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর সন্তুর সঙ্গে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে নিজেদের ঘরে এসে বসল।

সন্তুর মুখখানা শুকিয়ে গেছে। একেবারে। সে যেন বুঝতে পারছে কাকাবাবুর একটা ভীষণ বিপদ আসছে। এই অবস্থায় বাড়ি থেকে এত দূরে থাকা কি ঠিক?

প্ৰকাশ জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার হল বলে তো, সন্তু? উনি একবার বৈজনাথ বলে ডাকলেন আমাকে। তারপর নিজের নাম বললেন রামনৱেশ যাদব। এরা করা?

সন্তু বলল, কোনওদিন আমি এই সব নাম শুনিনি!

তুমি তো ওঁর সঙ্গে সবকটা অভিযানেই গেছ, তাই না? সুতরাং যে-সব ব্যাড ক্যারেকটারদের উনি দেখেছেন, তুমিও তাদের দেখেছ?

তার কোনও মানে নেই। আমি তো মোটে চার-পাঁচ বার গেছি। কাকাবাবুর সঙ্গে। তার আগে কাকাবাবু আরও কত জায়গায় গেছেন। পাটা ভেঙে যাবার আগে তো উনি আমাকে সঙ্গে নিতেন না।

আগেকার কথা বাদ দাও। গত পাঁচ-ছ বছর ধরে তো তুমি ওঁর সঙ্গেই থেকেছ–

একটু চিন্তা করে সন্তু বলল, না, তাও ঠিক বলা যায় না। গত বছর আমার যখন পরীক্ষা ছিল, সেই সময় কাকাবাবু একাই যেন কোথায় গিয়েছিলেন–

কোথায়?

তা আমি ঠিক জানি না। তবে মনে হয় যেন অসমের দিকেই।

কেন তোমার অসমের কথা মনে হল? উনি কি তোমায় কিছু বলেছিলেন?

না। তা বলেননি। তবে, উনি মার জন্য একটা বেশ সুন্দর নানা রঙের কম্বলের মতন জিনিস। এনেছিলেন, তার নাম খেস। মা বলেছিলেন, ঐ জিনিস অসমেই ভাল পাওয়া যায়।

কিন্তু অসমে এসে বৈজনাথ কিংবা রামনরেশ যাদব টাইপের নামের ক্যারেকটারদের উনি মিট করবেন, এটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। বিহার, উত্তরপ্রদেশেই এই ধরনের নামের লোক থাকে।

আচ্ছা ডাক্তারবাবু—

আমায় ডাক্তারবাবু বলার দরকার নেই। আমায় তুমি প্রকাশন্দা বলতে পারো।

আপনার কি মনে হয়, কাকাবাবুর স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে?

কিছু একটা গণ্ডগোল যে হয়েছে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। উনি নিজেকেও অন্য মানুষ ভাবছেন। অবশ্য এটা খুব টেমপোরারিও হতে পারে। দেখা যাক, কাল সকালে কেমন থাকেন?

আপনি সত্যি করে বলুন, কাকাবাবু আবার ভাল হয়ে যাবেন তো?

নিশ্চয়ই! যে-কোনও ভাবেই হোক, ওঁকে ভাল করে তুলতেই হবে। ওঁর মাথাটাই তো একটা অ্যাসেট! তা হলে এবার শুয়ে পড়া যাক?

পাশাপাশি দুটো খাটে ওদের বিছানা। মাঝখানে একটা টেবল ল্যাম্প। প্রকাশ সরকার সেই আলো নিভিয়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু সন্তুর ঘুম আসছে না। সে আকাশ-পাতাল ভাবছে শুধু। কাকাবাবুর কথা মনে করলেই তার কান্না এসে যাচ্ছে। কাকাবাবু যদি পাগল হয়ে যান? না, না, তা হতেই পারে না! কাকাবাবুর মতন সাহসী মানুষ এরকমভাবে নষ্ট হয়ে যাবেন?

যদি সত্যি-সত্যি কাকাবাবুর কিছু হয়, তা হলে সন্তু ছাড়বে না। যারা কাকাবাবুকে ঘুমের গুলি দিয়ে মেরেছে, তাদের সন্তু দেখে নেবে, যদি তারা পৃথিবীর শেষপ্রান্তে গিয়েও লুকোয়, তা হলেও সন্তু প্রতিশোধ নেবেই।

কিন্তু তারা কারা?

কাপুরুষের মতন তারা কাকাবাবুকে পেছন থেকে গুলি করে পালিয়েছে। কাকাবাবুকে তারা পুরোপুরি মেরে ফেলতেও চায়নি, শুধু তাঁর মাথাটাকে নষ্ট করে দিতে চেয়েছে। এটা তো মৃত্যুর চেয়েও খারাপ।

এই সব ভাবতে-ভাবতে কত রাত হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। একটু বোধহয় তন্দ্রার মতন এসেছিল, হঠাৎ একটা আওয়াজে চমকে উঠল সন্তু।

একটা গাড়ি ঢুকেছে কম্পাউণ্ডের মধ্যে। ইঞ্জিনের শব্দটা খুব জোর। কয়েকজন লোকের কথাও শোনা গেল এর পরে।

সন্তু তড়াক করে খাট থেকে নেমে এসে দাঁড়াল জানলার পাশে।

সার্কিট হাউসের বারান্দার আলো সারা রাত জ্বালাই থাকে। সেই আলোয় দেখা গেল, একটা জোঙ্গা জিপ এসে দাঁড়িয়েছে, তার থেকে দুতিন জন লোক নেমে কথা বলছে নাইট গার্ডের সঙ্গে।

তাদের মধ্যে একজন লোক এগিয়ে এল এদিকে। ঠিক যেন সন্তুর সঙ্গে কথা বলতেই আসছে। সোজা এসে তারপর লোকটি কিন্তু চলে গেল পাশের ঘরের দিকে।

সন্তুর তক্ষুনি মনে পড়ল কাকাবাবুর ঘরের দরজা খোলা আছে। কারণ, কাকাবাবু তো নিজে দরজা বন্ধ করতে পারবেন না, দরজাটা ভেজিয়ে রাখা হয়েছিল। ঐ লোকটা কাকাবাবুর ঘরের দিকেই গেল।

প্ৰকাশ সরকারকে ডাকবারও সময়। পেল না। সন্তু। সে অন্ধকারেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।

ঠিক যা ভেবেছিল তাই। লোকটা নেই। কাকাবাবুর ঘরের একটা পাল্লা খোলা।

সন্তু সেই দরজার কাছে আসতেই তীব্ৰ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। সঙ্গে-সঙ্গে মাটিতে বসে পড়ল সন্তু। তার ধারণা হল, এইবার কেউ তাকে গুলি করবে।

কিন্তু সেরকম গুলি ছুটে এল না।

তার বদলে একজন কেউ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কে?

মানুষের গলার আওয়াজ শুনে অনেকটা ভয় কেটে যায়। সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি কে? আমাদের ঘরে ঢুকেছেন কেন?

লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে টর্চের আলোটা ঘুরিয়ে ফেলল খাটের ওপর কাকাবাবুর মুখে।

ততক্ষণে সন্তু দরজার পাশের সুইচ টিপে আলো জেলে ফেলেছে।

কালো রঙের প্যান্ট ও কালো ফুল শার্ট পরা একজন ঢাঙা লোক ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বড় চৌকো ধরনের টর্চ। সন্তু আগে কোনও লোককে এরকম টর্চ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেনি।

লোকটা বলল, এই চার নম্বর ঘর আমাদের নামে বুক করা ছিল। নাইট গার্ড বলল, আমাদের রিজার্ভেশান ক্যানসোলড হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস হয়নি। এখন দেখছি, সত্যি এখানে একজন লোক শুয়ে আছে।

প্ৰকাশ সরকারও এর মধ্যে উঠে এসেছে।

সে বলল, আপনি কে? কিছু জিজ্ঞেস না-করে হুট করে এ-ঘরে ঢুকে এসেছেন কেন?

লোকটি বলল, কেন, তাতে কী হয়েছে? এ ঘর আমাদের নামে বুকিং…

প্রকাশ বলল, তা হতেই পারে না। একই ঘর কখনও দুজনের নামে বুক হয়? আপনার বুকিং আছে কি না তা আপনি অফিসে গিয়ে খোঁজ করুন।

লোকটি বলল, আপনারা যখন শুয়ে পড়েছেন, তখন আপনাদের এখন এখান থেকে তুলে দেব না নিশ্চয়ই। দেখি অন্য কী ব্যবস্থা করা যায়।

সন্তু আর প্রকাশকে পাশ কাটিয়ে লোকটা চলে গেল বাইরে। প্রকাশ কাকাবাবুর কাছে এসে একটা চোখের পাতায় সামান্য আঙুল ছুয়ে বলল, উনি অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, কিছুই টের পাননি। তা হলেও-এত রাত্রে একটা লোক হুট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বে…

সন্তু বলল, ওরা দেখে গেল।

প্ৰকাশ বলল, ওরা মানে?

সন্তু বলল, যাদের চোখে ধুলো দেবার জন্য প্রথমে গৌহাটি যাওয়া হল, তারপর আগরতলায়–সেই তারাই এসে দেখে গেল। কাকাবাবু এখানেই এসেছে কি না।

প্রকাশ হেসে বলল, আরে না, না। ও লোকটা একটা উটুকো লোক। ওদের বুকিংয়ে বোধহয় কিছু গোলমাল হয়েছে। তাছাড়া, আমরা তো ঠিক কারোর চোখে ধুলো দিতে চাইনি, এমনিই সাবধানতার জন্য…

কিন্তু যে লোকটা এই ঘরে ঢুকেছিল, সেই লোকটা মোটেই ভাল না।

তুমি কী করে বুঝলে?

ও কালো প্যান্ট আর কালো শার্ট পরে ছিল। আমি কালো রঙের জামা পরা লোক আগে দেখিনি।

ওঃ হো! এই জন্য। ঠিক কালো নয় তো, খুব গাঢ় খয়েরি। এক রঙের প্যান্ট-শার্ট পরা আজকাল ফ্যাশান হয়েছে।

ঐ রকম চৌকো টর্চ…

গোল আর লম্বা টর্চ হাতে থাকলেই লোকটা ভাল হয়ে যেত?

লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলে।

তোমার দেখছি বড় বেশি বেশি সন্দেহ। শোনো, আমরা যে আজ আগরতলা এসেছি, তা বাইরের কারুর পক্ষে জানা অসম্ভব।

কেন, আমরা কি এখানে মিথ্যে নাম লিখিয়েছি? সার্কিট হাউসের লোকেরা তো জানে। যাই বলুন, ঐ লোকটার মুখ দেখে মনে হল, ও কাকাবাবুকে চিনতে পেরেছে।

যাঃ, কী যে বলে! কাল সকালেই আমি খবর নেব ওরা কারা। এখন চলো, শুয়ে পড়া যাক।

আমি কাকাবাবুর সঙ্গে এ-ঘরেই শোব। প্রথম থেকেই আমার তাই করা উচিত ছিল। আপনি বললেন বলে পাশের ঘরে চলে গেলুম।

বেশ তো, থাকো না।

সন্তু চট করে পাশের ঘর থেকে জামা কাপড় নিয়ে এল। এ-ঘরেও দুটো খাট। কাকাবাবুর পাশের খাটে কিছু জিনিসপত্র রাখা ছিল। সেগুলো নামিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল সন্তু।

এবারেও তার ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। তার বারবার মনে হচ্ছে, ঐ লম্বা লোকটা জোরালো টর্চ নিয়ে কাকাবাবুকে দেখতেই এসেছিল। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু এসে পড়ায় কাকাবাবুর কোনও ক্ষতি করতে পারেনি।

সার্কিট হাউসে জায়গা না পেয়ে ওদের জোঙ্গা জিপটা একটু আগেই চলে গেছে। তা যাক। ওরা যদি শক্ৰ পক্ষের লোক হয়, তা হলে একজনের চেহারা তো সন্তুর জানা রইল। কাকাবাবুর কোনও ক্ষতি হলে ঐ লোকটাকে সন্তু ঠিক খুঁজে বার করবেই।

পরদিন সন্তুর ঘুম ভাঙল অনেক দেরিতে। দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে।

সন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। একজন বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে।

কাকাবাবু জেগে উঠেছেন এর মধ্যেই। চোখ মেলে। ঘরের ছাদ দেখছেন।

সন্তু কাছে গিয়ে বলল, কাকাবাবু, চা খাবে?

কাকাবাবু কোনও উত্তর না দিয়ে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন সন্তুর দিকে। কেমন যেন ঘোলাটে দৃষ্টি।

সন্তু কাকাবাবুর মাথার পেছনে হাত দিয়ে তাঁকে আস্তে-আস্তে বসিয়ে দিল। তারপর কাপে চা ঢেলে নিয়ে এল। কাকাবাবুর মুখের সামনে।

কাকাবাবু একটা চুমুক দিলেন।

তারপর অদ্ভুত খসখসে গলায় বললেন, এটা চা নয়। ষাঁড়ের রক্ত। এ জিনিস বাঘে খায়। মানুষে খায় না।

সন্তু বলল, চা-টা ভাল হয়নি বুঝি। আচ্ছা, আমি আবার অন্য চা দিতে বলছি।

তখন ফিরে সন্তু সেই চায়ের কাপে নিজে একটা চুমুক দিয়ে দেখল। তার তো কিছু খারাপ লাগল না।

কাকাবাবু আবার বললেন, আজ কি ফেব্রুয়ারি মাসের তিন তারিখ?

সন্তু বলল, না তো! এখন তো জুন মাস, আজ আর্ট তারিখ।

কাকাবাবু বললেন, এলতলা বেলতলা, কে এল আগরতলা?

সন্তু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী বললে?

কাকাবাবু বললেন, বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা, হরিণ বলে কোথায় যাই!

সন্তুর আবার ভয় করতে লাগল। কাকাবাবু ভুল বকতে শুরু করেছেন। এক্ষুনি প্রকাশ সরকারকে ডাকা দরকার।

সে চলে গেল পাশের ঘরে। সে-ঘর ফাঁকা। প্ৰকাশ নেই। বাথরুমেও নেই। বাইরে উঁকি দিয়েও দেখা গেল না। সকালবেলা সে কোথায় চলে গেল?

অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না প্রকাশ সরকারকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *