জঙ্গলগড়ের চাবি : 04
প্লেনের সিঁড়ি থেকে কাকাবাবুকে ধরাধরি করে নামিয়ে আনা হল।
কাছেই টারম্যাকের ওপর অপেক্ষা করছে একটা বেশ বড় জিপ। তার পেছন দিকে দুই সীটের মাঝখানে বিছানা পাতা। প্রকাশ সরকার আর সন্তু দুজনে মিলে কাকাবাবুকে সেখানে শুইয়ে দিল খুব সাবধানে।
সন্তু সেখানেই বসল। আর প্রকাশ সরকার গিয়ে বসল। সামনের দিকে। সেখানে ড্রাইভারের পাশে আর-একজন লোক বসে ছিল।
সেই লোকটি প্রকাশ সরকারকে নিচু গলায় কিছু বলবার পরই চলতে শুরু করল গাড়ি।
সন্তু এর আগে কখনও অসমে আসেনি। কিন্তু অসমের পাহাড় আর জঙ্গল সম্পর্কে অনেক গল্পের বই পড়েছে। হাতি, গণ্ডার, বাঘ-কী নেই অসমে! সেইজন্য অসমের নাম শুনলেই তার রোমাঞ্চ হয়।
সে কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। কিন্তু চারপাশে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না।
সন্তু ভেবেছিল, এয়ারপোর্টে যখন নেমেছে, তখন নিশ্চয়ই কাছাকাছি শহর থাকবে। আলো দেখা যাবে।
কিন্তু গাড়িটা শহরের দিকে গেল না। মাঝে-মাঝে দুটো একটা আলো দেখা গেলেও বোঝা যায়, গাড়িটা চলে যাচ্ছে লোকালয়ের বাইরে। একটা ব্রিজ পেরিয়ে গাড়িটা আবার ছুটিল অন্ধকারের মধ্য দিয়ে।
ঘণ্টাখানেক পরে সন্তু অবাক হয়ে দেখল, তাদের গাড়ি আবার একটা এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে টারম্যাকের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
কাকাবাবু ঘুমোননি, চুপচাপ শুয়ে ছিলেন।
এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আবার কোথায় এলুম, বল, তো, সন্তু?
সন্তু বলল, আর-একটা এয়ারপোর্ট…নামটা পড়তে পারিনি!
কাকাবাবু বললেন, বুঝতে পারলি না? আবার সেই আগের এয়ারপোর্টেই ফিরে এলুম! ঐ যে পাশাপাশি দুটো আলো, তার মধ্যে একটা দীপ দপ করছে!
সন্তু দেখল, তাই তো! ঠিকই। অসুস্থ, শোয়া অবস্থাতেও কাকাবাবু এটা লক্ষ করেছেন ঠিক।
প্ৰকাশ সরকার। এদিকে এসে বিনীতভাবে বলল, স্যার, আপনাকে আবার একটু কষ্ট করে নামতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, ব্যাপার কী? এত সাবধানতা কিসের? আমি তো একেবারে অথর্ব হয়ে গেছি, হাঁটতে পারি না, কোনও কিছু ধরতে পারি না, আমায় নিয়ে আর কার মাথা ব্যথা থাকবে?
প্রকাশ সরকার বলল, আমাদের দেশের পক্ষে আপনার জীবন খুবই মূল্যবান। আপনার যদি কোনও বিপদ হয়–সে কুঁকি আমরা নিতে পারি না।
কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলতো, সন্তু?
সন্তুও তো কিছুই বুঝতে পারছে না। অন্য-অন্য বার কাকাবাবু নিজেই প্রথম দিকে সন্তুর কাছে অনেক কথা গোপন করে যান। এবার কাকাবাবু নিজেই জানেন না। কী হচ্ছে! একই এয়ারপোর্টে দুবার তাঁকে কেন আনা হল? কারুর চোখে ধুলো দেবার জন্য? কিন্তু তারা যে প্লেনে অসমে চলে আসবে, সে-কথা তো সন্ধের আগে কেউ জানতই না।
কাকাবাবুকে আবার নামানো হল জিপ থেকে।
সেই সেনাবাহিনীর বিমানটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। একই জায়গায়। সেটাতেই আবার উঠতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, একটু টাট্কা হাওয়া খেয়ে নিই। অসমের হাওয়া খুব ভাল।
সত্যি-সত্যি তিনি মুখটা হাঁ করে হাওয়া খেতে লাগলেন।
এক দিকে প্ৰকাশ সরকার, আর-এক দিকে সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি। সন্তু একটু লম্বায় ছোট বলে কাকাবাবুকে একদিকে ঝুঁকে পড়তে হয়েছে।
সেই অবস্থায় প্রায় প্রকাশ সরকারকে শুনিয়ে-শুনিয়েই কাকাবাবু সন্তুকে ফিসফিস করে বললেন, মনে কর, এরাই যদি গুণ্ডা হয়, এরাই হয়তো ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমাদের কোথাও গুম করতে নিয়ে যাচ্ছে, তা হলে কী করবি?
সন্তু আড়াচোখে প্রকাশ সরকারের দিকে তাকাল।
প্ৰকাশ সরকার ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, এ কী বলছেন, স্যার? এরা সব আমির লোক, এটা আমির জিপ, ওইটা আমির প্লেন…দিল্লি থেকে স্পেশাল অর্ডার এসেছে বলেই আপনাকে…
কাকাবাবু বললেন, হুঁঃ! কিছুই বলা যায় না!
প্ৰকাশ সরকার এবার রীতিমত আহত হয়ে বলল, স্যার, আপনার এখনও অবিশ্বাস হচ্ছে? মিঃ ভার্মার চিঠি আছে আমার কাছে। যদি দেখতে চান…
যাব! চলো!
আবার ওঠা হল সেই ছোট বিমানের মধ্যে। কাকাবাবু তাঁর সীটে বসবার পর তিনি চোখ বুজে রইলেন।
প্রকাশ সরকার সন্তুত পাশে বসে পড়ে বলল, তোমার সঙ্গে আমার ভাল করে আলাপ হয়নি। কিন্তু আমি তোমাদের সব কটা অ্যাডভেঞ্চারের কথা পড়েছি। সেই আন্দামানে–কিংবা নেপালে, এভারেস্টের কাছে, আর একবার সেই কাশ্মীরে…তুমি তো দারুণ সাহসী ছেলে!
এই রকম কথা শুনলে সন্তু লাজুক-লাজুক মুখ করে থাকে। কী যে উত্তর দেবে তা বুঝতে পারে না।
প্রকাশ আবার বলল, আর তোমার কাকাবাবু, উনি তো জীনিয়াস! একটা পা নেই বলতে গেলে-তবু শুধু মনের জোরে উনি কত অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। উনি কোনও বিপদকেই গ্ৰাহ্য করেন না!
সন্তু এবার বলল, কিন্তু কাকাবাবুর এখন হাতেও জোর নেই।
ও ঠিক হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার, আমি সঙ্গে রয়েছি, কোনও চিন্তা নেই। আমার ওপর নির্দেশ আছে, উনি যখন যা চাইবেন, তক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অন্তত এক মাস যদি বিশ্রাম নিতে পারেন…
এক মাস?
তা তো লাগবেই। আরও বেশি হলে ভাল হয়। কেন, তুমি সঙ্গে থাকতে পারবে না?
আমার যে কলেজ খুলে যাবে।
তুমি কলেজে পড়ো বুঝি?
সন্তু আবার লজ্জা পেয়ে গেল। সে এখনও ঠিক কলেজের ছাত্র হয়নি। তবু কলেজ কথাটা উচ্চারণ করতে তার বেশ ভাল লাগে।
এই সময় কাকাবাবু চোখ খুলে বললেন, এই যে বৈজনাথ, শোনো?
প্ৰকাশ একবার এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাকে ডাকছেন?
হ্যাঁ!
আসছি, স্যার! ইয়ে, মানে স্যার, আমার নাম তো বৈজনাথ নয়, এখানে বৈজনাথ বলে কেউ নেই। আমার নাম প্ৰকাশ, প্ৰকাশ সরকার।
কাকাবাবু খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, তুমি বৈজনাথ নাও! ঠিক বলছ? ভারী আশ্চর্য তো?
বৈজনাথ কে স্যার? সন্তু তুমি ওই নামে কারুকে চেনো?
সন্তু দুদিকে ঘাড় নাড়ল।
কাকাবাবু আবার বললেন, ঠিক আছে। তোমার কী নাম বললে যেন? প্ৰকাশ? শোনো প্ৰকাশ, আমার তেষ্টা পেয়েছে। আমি একটু ডাবের জল খাব।
ডাবের জল? এখানে কি ডাবের জল পাওয়া যাবে? কোন্ড ড্রিংকস আছে। বোধহয়।
আমি ডাবের জল ছাড়া অন্য কিছু খাই না!
কিন্তু স্যার, রাত্তিরবেলা ডাবের জল খাওয়াটা বোধহয় ঠিক নয়!
কেন, কী হয়?
কেউ খায় না। খেলে গলা ভেঙে যায়?
তোমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে এমন কথা লেখা আছে? যাই হোক, আমি রাত্তিরেও ডাবের জল খাই, আমার গলা ভাঙে না।
প্লেনের মধ্যে তো ডাবের জল দেবার উপায় নেই।
তা হলে সামনের স্টেশানে থামাও! সেখান থেকে ডাবের জল জোগাড় করো। এই যে বললে, আমি যখন যা চাইব, তুমি তা-ই দেবার ব্যবস্থা করবে!
প্ৰকাশ অসহায়ভাবে সন্তুর দিকে তাকাল।
সন্তুও প্রায় নির্বাক হয়ে গেছে। কাকাবাবু এ কী রকম ব্যবহার করছেন? কাকাবাবু কোনওদিন কারুর নাম ভুলে যান না। অথচ প্রকাশকে ডাকলেন বৈজনাথ বলে। ডাবের জল খাওয়ার জন্য আবদার, এ তো কাকাবাবুর চরিত্রের সঙ্গে একদম মানায় না! তারপর উনি বললেন, সামনের স্টেশান! উনি কি প্লেনটাকে ট্রেন ভেবেছেন নাকি?
প্ৰকাশ বলল, স্যার, আমরা আর আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব। সেখানে খুব চেষ্টা করব যদি ডাবের জল পাওয়া যায়। তার আগে কি একটা কিছু কোন্ড ড্রিংকস কিংবা এমনি জল খাবেন?
নাl
কাকাবাবু আবার চোখ বুজিলেন। একটু পরে সন্তু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
প্রকাশ বলল, একটু বাদেই তো নামব। তখন দেখতে পাবে।
চোখ না খুলেই কাকাবাবু বললেন, আগরতলা, তাই না? একে বলে ঘুরিয়ে নাক দেখানো!
প্ৰকাশ দারুণ চমকে উঠল। কোথায় যাওয়া হবে, তা একজন আমি অফিসার শুধু তার কানে-কানে বলেছে। কাকাবাবুর তো কোনও ক্রমেই জানবার কথা নয়। উনি কি হিপূনোটিজম জানেন নাকি! তাও তো চোখ বুজে আছেন।
অসম ছেড়ে চলে যাচ্ছে শুনে সন্তু একটু নিরাশই হল। সে আরও ভাবতে লাগল, কাকাবাবু ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কথা বললেন কেন? কে কাকে ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছে?
প্লেনের আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়, কখন সেটা নামবার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু পরেই প্লেনটি একটি ঝাঁকুনি খেয়ে মাটি ছুঁল।
নামবার সময় এবারে আর কাকাবাবু কোনও কথা বললেন না। প্রকাশ খানিকক্ষণ ছুটোছুটি করে ফিরে কচুমাচু হয়ে বলল, স্যার, এত রাত্রে তো এখানে ডাব কোথাও নেই, কিছুতেই পেলুম না।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে।
এবারে জিপ নয়, একটা সাদা রঙের গাড়ি। প্রত্যেকবারই কাকাবাবুকে ধরে-ধরে নিয়ে গিয়ে বসাতে হচ্ছে। অথচ, কাকাবাবু কক্ষনো পরের সাহায্য নেওয়া পছন্দ করেন না। খোঁড়া পায়েই ক্রাচ্ বগলে নিয়ে উনি একা পাহাড়ে পর্যন্ত উঠতে পারেন। কিন্তু এখন হাতেও জোর নেই, ক্রাচও ধরতে পারছেন না।
গাড়ি এসে থামল আগরতলার সার্কিট হাউসে।
খুবই সুন্দর ব্যবস্থা। পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘর কাকাবাবুর জন্য, অন্য ঘরটিতে প্ৰকাশ আর সন্তু থাকবে।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও তৈরিই ছিল। প্ৰকাশ বলল, আজ অনেক ধকল গেছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়া যাক।
কাকাবাবু এখন নিজে খেতেও পারেন না, তাঁকে খাইয়ে দিতে হয়। চামচে করে যে খাবার তুলবেন, তাতে সেই জোরটুকুও নেই। এই কদিন বাড়িতে ছোড়াদিই খাইয়ে দিয়েছে কাকাবাবুকে। আজ সন্তু বসল কাকাবাবুকে খাওয়াতে।
কিন্তু তার তো অভ্যোস নেই, সে ঠিকঠাক পারবে কেন? ভাত তুলে কাকাবাবুর মুখে দিতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে।
প্রকাশ বলল, তুমি সরো, সন্তু, আমি দিচ্ছি। আমরা তো নার্সিং করতে জানি।
কাকাবাবু দু তিনবার ঠিকঠাক খেলেন। তারপর একবার কটু করে চামচটাকেই কামড়ে ধরে এক ঝটিকায় ছাড়িয়ে নিলেন প্রকাশের হাত থেকে। তারপর সেই চামচটাকে চিবুতে লাগলেন কচর-মচর করে।
প্ৰকাশ আঁতকে উঠে বলল, স্যার, স্যার, ও কী করছেন? ও কী?
কাকাবাবু কট্মট্ করে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমায় স্যার স্যার বলছ কেন! আমার নাম রামনরেশ যাদব। আমি বিহারের একজন গোয়ালা। আমার একশো সাতান্নটা গোরু আছে। তুমি কি সেই একটা গোরু?
সন্তুর বুকের মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হতে লাগল।