জঙ্গলগড়ের চাবি : 03
বাবা ওপরের বারান্দা থেকে শুনতে পেয়ে বললেন, অ্যাঁ? কী বললে? কী সর্বনাশ! সন্তু কোথায়?
সন্তু ততক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে তীরের মতন ছুটুতে আরম্ভ করেছে।
গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা, তারপর ডান দিকে বেঁকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পার্কটায় পৌঁছনো যায়। সন্তু সেখানে পৌঁছে গেল দেড় মিনিটে।
পাৰ্কটা খুব বড় নয়, কিন্তু তার একপাশে একটা কবরখানা। আর একদিকে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে, একটা বারোতলা বাড়ির লোহার কঙ্কাল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে রাশি-রাশি ইট।
সেই ইটের স্তুপের কাছে এক দঙ্গল মানুষের ভিড় দেখেই বোঝা গেল যে, ঘটনোটা সেইখানেই ঘটেছে। সেখানে শোনা যাচ্ছে একটা কুকুরের অবিশ্রান্ত ডাক।
সন্তু ভিড়ের মধ্যে গোঁত্তা মেরে ভেতরে ঢুকে পড়ে দেখল একটা ইটের পাঁজার কাছে কাকাবাবু উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। গুলি লেগেছে। কাঁধের বাঁ দিকে, পাতলা সাদা জামাটায় পাশাপাশি দুটো কালো গোল দাগ, তার চারপাশে রক্ত।
কাকাবাবু সন্তুর কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে আসেন রোজ। সেই রকুকু কাকাবাবুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ডেকে চলেছে, সন্তুকে দেখতে পেয়েই সে পাগলের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ল।
সন্তু কাকাবাবুর গায়ে হাত দিল না, কান্নাকাটিও শুরু করল না। তাকে এখন এক মুহূৰ্তও সময় নষ্ট করলে চলবে না।
সে রকুকুর গলায় চাপড় মেরে বলল, তুই এখানে থোক। দেখিস, কেউ যেন কাকাবাবুর গায়ে হাত না ছোঁয়ায়।
রকুকু সন্তুর সব কথা বোঝে। সে আবার গিয়ে দাঁড়াল কাকাবাবুর কাছে। সন্তু আবার ভিড় ভেদ করে বেরিয়ে ছুটিল।
ডঃ সুবীর রায় তখন চেম্বারে বেরুবার জন্য সবে মাত্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় টাই বাঁধছেন, সন্তু ঝড়ের মতন ঢুকে এল তাঁর ঘরে। এক হাতে তাঁর যন্ত্রপাতির বাক্সটা টপ করে তুলে নিয়ে অন্য হাতে ডঃ সুবীর রায়কে ধরে টানতে টানতে বলল, শিগগির চলুন! ডাক্তার মামা, এক্ষুনি…
ডঃ সুবীর রায় অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
কিছু বলবার সময় নেই। কাকাবাবু—
কাকাবাবু? কোথায়…দাঁড়া জুতোটা পরে নিই।
না, জুতো পরতে হবে না!
খালি পায়েই ডঃ সুবীর রায় ছুটতে লাগলেন সন্তুর সঙ্গে। তাঁর বাড়িও পার্কের কাছেই।
ততক্ষণে সন্তুর বাবা আর মা পৌঁছে গেছেন। আর এসেছে। একজন পুলিশের কনস্টেবল।
ডঃ সুবীর রায় হাঁটু গেড়ে বসলেন কাকাবাবুর দেহের পাশে। আস্তে আস্তে উল্টে দিলেন কাকাবাবুকে। কাকাবাবুর মুখে একটা দারুণ অবাক হবার ভাব।
যে-সমস্ত লোক ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা অনেকেই কাকাবাবুকে চেনে। অনেকেই এখানে সকালে বেড়াতে আসে। সবাই নানান কথা বলাবলি করছে। কিন্তু আগেই যে একজন ডাক্তারকে খবর দেওয়া উচিত সে-কথা কারুর মনে পড়েনি।
দুতিনজন নাকি স্বচক্ষে দেখেছে কাকাবাবুকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে। গুলির আওয়াজ হয়েছিল তিনবার, অর্থাৎ একটা গুলি ফসকে গেছে। কিন্তু কে গুলি করেছে, তা বোঝা যায়নি। কাছাকাছি তো কেউ ছিল না, কিংবা কারুকে পালাতেও দেখা যায়নি।
একজন বলল, নিশ্চয়ই কেউ কবরখানায় লুকিয়ে থেকে গুলি করেছে।
সন্তু বুঝতে পারল না, কাকাবাবু পার্কে বেড়াতে এসে এই ইটের পাঁজার কাছে কেন এসেছিলেন। এখানে বালি আর খোয়া ছড়ানো, এই জায়গাটা তো হাঁটার পক্ষেও ভাল নয়।
ডঃ সুবীর রায় এর মধ্যে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে বললেন, সন্তু, এক্ষুনি ওঁকে নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়ে অপারেশান করাতে হবে। এখনও বেঁচে আছেন।-আমার ড্রাইভার বোধহয় এতক্ষণে এসে গেছে, তুই গিয়ে ডেকে আন বরং!
সন্তু বলল, ঐ যে দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে যদি ট্যাক্সি করে নিয়ে যাই।
সবাই মিলে ধরাধরি করে কাকাবাবুকে তোলা হল ট্যাক্সিতে। রকুকু কী যেন বুঝে আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে, সেও সঙ্গে যেতে চায়।
রকুকুকে জোর করে মায়ের সঙ্গে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
নার্সিং হোমে প্রায় দুঘণ্টা ধরে অপারেশনের পর জানা গেল একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।
ডঃ সুবীর রায় ছাড়া আরও দু জন বড় ডাক্তারও ছিলেন অপারেশনের সময়। তাঁরা কেউ কখনও এরকম কাণ্ড দেখেননি।
কাকাবাবুর শরীরে যে গুলিদুটো ঢুকেছে, সেগুলি মানুষ মারবার জন্য নয়। বাঘ-সিংহের মতন বিশাল শক্তিশালী প্ৰাণীদের এই রকম গুলি মেরে ঘুম পাড়ানো হয়।
তিনজন ডাক্তারই দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এর জন্য তো সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাণ্টিডোট দেবার কথা, নইলে বাঁচানো যায় না। অথচ অনেক সময় কেটে গেছে।
যদিও ভরসার কথা এই যে কাকাবাবুর এখনও নিশ্বাস পড়ছে।
সুন্দরবনে দু একটা বাঘকে গুলি করে ঘুম পাড়াবার কথা অনেকেই শুনেছে, কিন্তু কলকাতা শহরে সকালবেলা পার্কে কোনও মানুষকে এরকমভাবে গুলি করবে। কে? কেন?
ডঃ তিমির বিরাট একবার সুন্দরবনের একটা বাঘকে এই রকম গুলি মেরে অজ্ঞান করার সময় সেখানে ছিলেন। তাঁর পরামর্শ জানিবার জন্য তাঁকে ফোন করা হল পিজি হাসপাতালে।
ডঃ তিমির বিরাট তো ঘটনাটা শুনে প্ৰথমে বিশ্বাসই করতে চান না। তারপর বলতে লাগলেন, পেশেন্ট এখনও বেঁচে আছে? কী বলছেন আপনারা? এ যে অসম্ভব! ঠিক আছে; আমি এক্ষুনি আসছি। আপনারা ততক্ষণে চীফ কনজারভেটার অব ফরেস্ট মিঃ সুকুমার দত্তগুপ্তকেও একটা খবর দিন। তাঁর এ-ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে।
সুকুমার দত্তগুপ্তও টেলিফোনে ঐ একই কথা বলতে লাগলেন। ঘুমের গুলি? আপনাদের ভুল হয়নি তো? সেই গুলি শরীরে গেলে তো কোনও মানুষের পক্ষে এতক্ষণ বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব! মিঃ রায়চৌধুরীকে আমি চিনি, ওঁকে এইরকমভাবে…
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছে গেলেন ওঁরা দুজনে। আর বারবার বলতে লাগলেন, কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
সুকুমার দত্তগুপ্ত বললেন, এই রকম গুলি বিদেশ থেকে আসে, এ তো কোনও সাধারণ লোকের পাবার কথা নয়।
ডঃ সুবীর রায় বললেন, যারা পার্কের মধ্যে সকালবেলা কারুকে গুলি করে, তারা কি সাধারণ লোক?
সমস্ত ডাক্তারদের অবাক করে কাকাবাবু এর পরেও তিনদিন বেঁচে রইলেন অজ্ঞান অবস্থায়।
চতুর্থ দিনে তিনি চোখ মেলে চাইলেন।
তবু আরও দু দিন তাঁর ঘুম-ঘুম ভাব রইল, ভাল করে কথা বলতে পারেন না, কথা বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে যায়।
আস্তে-আস্তে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন বটে, কিন্তু তাঁর হাত দুটো অবশ হয়ে রইল। হাতে কোনও জোর পান না। কোনও জিনিস শক্ত করে ধরতে পারেন না।
অনেক ওষুধপত্র দিয়েও আর হাত দুটো ঠিক করা গেল না। ডাক্তাররা বললেন, আর কিছু করবার নেই। এখন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, যদি আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যায়।
এতদিন পর সন্তু রাত্তিরবেলা তার ছাদের ঘরে শুয়ে-শুয়ে খুব কাঁদল।
কাকাবাবুর হাত দুটো নষ্ট হয়ে যাওয়া তো তাঁর মৃত্যুর চেয়েও খারাপ! কাকাবাবুর একটা পা খোঁড়া, শুধু মনের জোরে আর ঐ লোহার মতন শক্ত হাত দুখানার জোরে তিনি কত পাহাড়ে-পর্বতে পর্যন্ত উঠেছেন। কিন্তু এখন? আর তিনি কোনও অভিযানে যেতে পারবেন না। তিনি এখন অথর্ব।
এর মধ্যে কলকাতার পুলিশের বড় বড় কর্তারা আর দিল্লি থেকে সি বি, আই-এর লোকেরাও কাকাবাবুর কাছে এসে অনেক খোঁজখবর নিয়ে গেছেন।
কাকাবাবু সবাইকেই বলেছেন যে, কে তাঁকে ঐ রকম অদ্ভুত গুলি দিয়ে মারার চেষ্টা করতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই। আততায়ী একজন না কয়েকজন তাও তিনি জানেন না, কারণ কারুকেই তিনি দেখতে পাননি। তাঁকে গুলি করা হয়েছে পেছন দিক থেকে।
সকলেরই অবশ্য ধারণা হল যে, ঘুমের গুলি মারার কারণ একটাই হতে পারে। কাকাবাবুকে কেউ বা কারা অজ্ঞান করে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিশ্চয়ই।
তবে তারা নিয়ে গেল না কেন? সকালবেলা পার্কে কিছু নিরীহ লোক ঘুরে বেড়ায়। তাদের চোখের সামনে দিয়েই যদি তারা কাকাবাবুকে তুলে নিয়ে যেত, কেউই বাধা দিতে সাহস করত না।
মিঃ ভার্গব নামে সি. বি. আই-এর একজন অফিসার কাকাবাবুর কাছে রোজই যাতায়াত করছিলেন। তিনিই বললেন যে স্বাস্থ্য সারাবার জন্য কাকাবাবুর কোনও ভাল জায়গায় গিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম করা দরকার।
সন্তুর বাবা এবং মা দুজনেই এতে খুব রাজি।
ঠিক হল যে সবাই মিলে যাওয়া হবে পুরীতে। সন্তুর মামাদের একটা বাড়ি আছে সেখানে। সুতরাং কোনও অসুবিধে নেই। বাবা ছুটি নিয়ে নিলেন অফিস থেকে। ছোড়দিরও খুব যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ছোড়দিকে ফিরে যেতে হল ভূপালে।
শনিবার দিন রাত নটায় ট্রেন। একটু আগেই বেরুনো হল বাড়ি থেকে।
ট্যাক্সিটা যখন রেড রোড ছাড়িয়ে রেডিও স্টেশনের পাশ দিয়ে বেঁকছে, সেই সময় একটা সাদা রঙের জীপ গাড়ি তীব্ৰ বেগে এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একজন লোক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হুকুম দিল, গাড়িটা বাঁয়ে দাঁড় করাও।
সেই জীপ থেকে নামলেন মিঃ ভার্গব।
তিনি বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনাদের প্ল্যানটা একটু বদল করতে হবে। আপনার পুরী যাওয়া হবে না।
কাকাবাবু কোনও কথা না বলে শুধু চেয়ে রইলেন মিঃ ভাৰ্গবের দিকে।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন, কী ব্যাপার!
মিঃ। ভার্গব বললেন, আমরা খবর পেয়েছি, পুরীতে কয়েকজন সন্দেহজনক লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে মিঃ রায়চৌধুরীর এই ঘটনার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে কি না ঠিক বলা না গেলেও তারা ঠিক এই সময়ই পুরীতে গেল কেন, তা আমাদের জানতে হবে। যদি ওরা মিঃ রায়চৌধুরীর কোনও ক্ষতি করে-সেই জন্য আমরা কোনও কুঁকি নিতে পারি না।
বাবা বললেন, তা হলে কি আমরা ফিরে যাব?
মিঃ ভার্গব বললেন, মিঃ রায়চৌধুরীর জন্য আমরা অন্য ব্যবস্থা করেছি।
আপনারা ইচ্ছে করলে পুরী যেতে পারেন।
সন্তু বলল, আমি কিন্তু কাকাবাবুর সঙ্গেই যাব!
মিঃ ভার্গব হেসে বললেন, তা জানি! সেরকম ব্যবস্থাই হয়েছে। মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে আর-একজন যাবেন। এঁর নাম প্রকাশ সরকার, ইনি একজন তরুন ডাক্তার। সদ্য পাশ করেছেন…
একটুক্ষণ কথা বলেই কাকাবাবুকে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে তোলা হল জিপটায়। সন্তু ভাগ্যিস আলাদা একটা ছোট সুটকেসে নিজের জামা-প্যান্ট গুছিয়ে নিয়েছিল, তাই কোনও অসুবিধে হল না।
জিপটা ছুটিল অন্য দিকে। সোজা একেবারে এয়ার পোর্ট।
সেখানে আমির একটা স্পেশাল ছোট প্লেনে উঠল। ওরা। তখনও কোথায় যাচ্ছে, সন্তু জানে না। নামবার পর দেখল যে, জায়গাটা গৌহাটি।
প্রকাশ সরকার আর সন্তু দুজনে দুদিক থেকে ধরে ধরে নামাল কাকাবাবুকে। এবার উঠতে হবে। আর-একটা জীপে।
এতক্ষণ বাদে কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি একেবারে বাচ্চা ছেলের মতন হয়ে গেছি, না রে? হাঁটতে পারি না, একটা চায়ের কাপ পর্যন্ত ধরতে পারি না। আমায় নিয়ে কী করবি তোরা?