জঙ্গলগড়ের চাবি : 20
ঘরের মধ্যে ঢুকে রাজকুমার মেজর-কে বলল, যাও, জলদি কাগজ আর কলম নিয়ে এসো!
মেজর যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখ বড় বড় করে বলল, কাগজ? কলম? সে আমি পাব কোথায়?
রাজকুমার বিরক্ত হয়ে বলল, কেন, তোমার কাছে কাগজ কলম নেই? জোগাড় করে রাখোনি কেন?
মেজর হে-হে করে হেসে বলল, কী যে বলেন, রাজকুমার! আমরা যে কাজ করি, তাতে কি কখনও কলমের দরকার হয়? আপনি আগে তো জোগাড় করে রাখার কথা বলেও যাননি।
রাজকুমার তখন দরজার কাছে দাঁড়ানো কর্নেল আর অন্য দুজন লোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কারুর কাছে কলম আছে?
কর্নেল কোনও উত্তর দেবার বদলে ঘোঁত করে একটা শব্দ করল। যেন কলম কথাটি সে আগে কখনও শোনেইনি। অন্যরাও কেউ কোনও কথা বলল না। রাজকুমার আবার মুখ ফিরিয়ে মেজর-কে বলল, তুমি অন্য ঘরগুলিতে খুঁজে দেখে এসো!
মেজর বলল, আমি তিন দিন ধরে এ বাড়িতে আছি। সব ঘর ঘুরে দেখেছি। এক টুকরো কাগজও দেখিনি, কলমও দেখিনি!
রাজকুমার নিজের বাঁ হাতের তালুতে ডান হাত দিয়ে একটা ঘুসি মেরে বলল, সামান্য কাগজকলমের জন্য সময় নষ্ট করতে হবে? এখন সময়ের কত দাম জানো? যা হোক, একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে কালকের মধ্যে! একটা চিঠি লেখার ব্যবস্থা রাখতে পারোনি?
মেজর বলল, পাশের ঘরে একটা পুরনো ক্যালেন্ডার আছে, তার একটা পাতা ছিড়ে উল্টো পিঠে লেখা যেতে পারে। কিন্তু কলম কোথায় পাওয়া যাবে?
কর্নেল বলল, আমি গাছের ডাল কেটে কলম বানিয়ে দিতে পারি।
এই বলে সে কোটের পকেট থেকে একটা বড় ছুরি বার করল।
রাজকুমার ভেংচিয়ে বলল, গাছের ডাল কেটে কলম বানালেই চলবে? শুধু কলম দিয়ে লেখা যায়? কালি কোথায় পাওয়া যাবে?
কর্নেল বলল, কাঠকয়লা নেই বাড়িতে? কাঠকয়লা গুঁড়ো করে কালি বানানো যায়।
রাজকুমার এবার একটা হুংকার দিয়ে বলল, তবে যাও! শিগগির কালি আর কলম বানিয়ে এসো!
মেজর আর কর্নেল দৌড়ে বেরিয়ে গেল। রাজকুমার দুই কোমরে হাত দিয়ে কটমট করে তাকিয়ে রইল সন্তুর দিকে।
সন্তুর বেশ মজা লাগছে। এতগুলো লোক, কারুর কাছে একটা ডট পেন পর্যন্ত নেই। এই যে রাজকুমার এত চ্যাঁচামেচি করছে, সে-ও তো খুব সেজেগুজে রয়েছে, সে-ও পকেটে একটা কলম রাখে না? এতেই বোঝা যায়, এরা কী রকম ধরনের মানুষ!
রাজকুমার এগিয়ে গিয়ে বাইরের দিকের জানলাটা খুলে দিল। তারপর জানলার শিকগুলো টেনে টেনে দেখল, সেগুলো ঠিক শক্ত আছে কি না।
সন্তুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমার কথা আমি জানি। নেপালে আর আন্দামানে তুমি অনেক রকম খেল্ দেখিয়েছ! এখানে যেন সে রকম কিছু করতে যেও না। এটা শক্ত ঠাঁই।
সন্তু কোনও উত্তর দিল না। এই রাজকুমারকে গোড়া থেকেই তার খুব গোঁয়ার বলে মনে হয়েছে। এই রকম লোকের পক্ষে ফট করে গুলি চালিয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু না।
একটু বাদেই মেজর আর কর্নেল ফিরে এল। একটা চায়ের কাপে কালি গুলে এনেছে, আর গাছের ডাল কেটে একটা কলমও বানিয়েছে। মেজর নিয়ে এসেছে পুরনো ক্যালেন্ডারটা।
তার একটা পাতা ছিড়ে সন্তুর সামনে ফেলে দিয়ে রাজকুমার বলল, নাও, এবারে লেখো।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকে লিখতে হবে? প্রধানমন্ত্রীকে?
রাজকুমার চোখ পাকিয়ে বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে? তোমার কাকাবাবুকে চিঠি লেখো। আমি যা বলছি, তাই লিখবে!
সন্তু প্রথমে লিখল। পূজনীয় কাকাবাবু। তারপর রাজকুমারের মুখের দিকে তাকাল।
রাজকুমার বলল, লেখো। আমি বেশ ভাল আছি।
সেই ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ার সময় সন্তু ডিকটেশান লিখেছে, তারপর আর কারুর কথা শুনে শুনে তাকে চিঠি লিখতে হয়নি। যাই হোক, রাজকুমারের এই। কথাটায় আপত্তির কিছু নেই বলে সে লিখে ফেলল।
রাজকুমার বলল, তারপর লেখো, এখনও পর্যন্ত ইহারা আমার উপর কোনও অত্যাচার করে নাই।
সন্তু বলল, আমি সাধু ভাষা লিখি না। আমি চলতি ভাষায় চিঠি লিখি।
রাজকুমার প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, যা বলছি, তাই লেখো!
সন্তু লিখল, এখনও পর্যন্ত এরা আমার ওপর কোনও অত্যাচার করেনি।
কর্নেল, মেজর ও অন্য দুজন সন্তুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে দেখল সন্তুর চিঠি লেখা।
রাজকুমার বলল, হয়েছে? এবারে লেখো, তবে, আপনার উপরেই আমার জীবনমরণ নির্ভর করিতেছে। আপনি জঙ্গলগড়ের গুপ্তধনের সন্ধান ইহাদের না দিলে ইহারা আর আমায় জীবন্ত ফিরিয়া যাইতে দিবে না।
সন্তু বলল, একথা আমি লিখব না?
রাজকুমার বলল, লিখব না মানে? তোর ঘাড় ধরে লেখাব। হতচ্ছাড়া, যা বলছি তাই লেখ শিগগির!
সন্তু বলল, আমায় দিয়ে জোর করে কেউ কিছু লেখাতে পারবে না।
রাজকুমার বলল, তবে রে? আচ্ছা, দ্যা একটুখানি নমুনা। কর্নেল, ওর বাঁ হাতে একটু অপারেশান করে দাও তো।
কর্নেল অমনি খপ করে সন্তুর বাঁ হাতটা চেপে ধরে টেনে নিল নিজের কাছে। তারপর তার ছুরিটা সন্তুর কনুইয়ের খানিকটা নীচে একবার চুঁইয়ে দিল শুধু। মনে হল ঠিক যেন পালক বুলিয়ে গেল একটা। তবু সেই জায়গাটায় একটা লম্বা রেখায় ফুটে উঠল রক্ত। টপ করে এক ফোঁটা রক্ত পড়ল ক্যালেণ্ডারের পাতাটার ওপর।
রাজকুমার নিষ্ঠুরভাবে হেসে বলল, এইবার দেখলি? লেখ যে, এই রক্তের ফোঁটাটা আমার। কাকাবাবু, আপনি আমার কথা না শুনিলে ইহারা আমার মুণ্ড কাটিয়া ফেলিবে। তারপর সেই রক্তে আমার জামা কাপড় চুবাইয়া তাহা আপনার নিকট পাঠাইবে।
সন্তু বলল, এ রকম বিচ্ছিরি ভাষা আমি কিছুতেই লিখব না। আমাকে মেরে ফেললেও না।
রাজকুমার পকেট থেকে রিভভারটা বার করে উল্টো করে ধরল। ওর বাঁট দিয়ে সন্তুর মাথায় মারতে চায়।
কিন্তু সে মারবার আগেই মেজর হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দিয়ে বলল, রাজকুমার, একটা কথা বলব? আমি একটু একটু লেখাপড়া করেছি। গুম-খুনের কিছু বইও পড়েছি। এই রকম সময় কী রকম চিঠি লিখতে হয়, তা খানিকটা জানি। আমি ওকে বলে দেব?
রাজকুমার বলল, তুমি কী রকম লেখাতে চাও, শুনি?
মেজর বলল, যেটুকু লেখা হয়েছে, তারপর লিখুক, কাকাবাবু, আপনি জঙ্গলগড়ের গুপ্তধনের জায়গাটার একটা নকশা এঁকে যদি এদের কাছে পাঠান, তবেই এরা আমাকে ছাড়বে বলেছে। তবে এ সম্পর্কে আপনি যা ভাল বুঝবেন, তা-ই করবেন। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমার প্রণাম নেবেন। ইতি–।
সন্তুর দিকে ফিরে মেজর বলল, দ্যাখো ভাই, চিঠি তো তোমায় একটা লিখতেই হবে। নইলে আমরা তোমায় ছাড়ব না। শুধু শুধু কেন মারধোর খাবে? আমি যা বললুম, তা লিখতে তোমার কি আপত্তি আছে?
কথা বলতে বলতে সকলের অলক্ষিতে মেজর সন্তুর দিকে একবার চোখ টিপে দিল। যেন সে বলতে চাইল, এই কথাগুলো লিখতে রাজি হয়ে যাও, তাতে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।
গাছের ডালের কলম দিয়ে বড় বড় অক্ষরে সন্তু লিখে দিল এই কথাগুলো।
রাজকুমার কাগজটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর বলল, রায়চৌধুরী তোমার এই হাতের লেখা দেখে চিনতে পারবে?
সন্তু বলল, হাঁ, আমার সই দেখে ঠিক চিনবেন।
রাজকুমার বলল, পুনশ্চ দিয়ে আবার লেখো, ঠিক চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এর উত্তর চাই।
সন্তু বলল, আর আমি কিছু লিখতে পারব না।
মেজর বলল, দিন, সেটা আমি লিখে দিচ্ছি। আমার হাতের লেখা কেউ চিনতে পারবে না, আমি সাত-আট রকমভাবে লিখতে পারি।
মেজর সন্তুর চিঠির নীচে লিখল, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এর উত্তর আর নকশা না পেলে সব শেষ। তোমার ভাইপোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুলিশে খবর দিলে কোনও লাভ হবে না।
এর নীচে সে আবার একটা মড়ার মাথার খুলি এঁকে দিল।
রাজকুমার আবার চিঠিখানা নিয়ে একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইল। তারপর বলল, ঠিক আছে। এটাই পাঠিয়ে দাও! কর্নেল তোমার একজন লোককে বলো ঘোড়া নিয়ে আগরতলায় চলে যেতে, ভোরের আগেই যেন পৌঁছে যায়। সেখানে গিয়ে জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। জেনারেলই চিঠি ডেলিভারি দেবার ব্যবস্থা করবেন!
কর্নেল বলল, কিন্তু আমার লোক যদি রাস্তায় ধরা পড়ে যায়?
রাজকুমার হুংকার দিয়ে বলল, কে ধরবে? কেউ ধরবে না, যাও! ধরা পড়লেও চিঠি পৌঁছে যাবে ঠিক জায়গায়। আর যে ধরা পড়বে, তাকে আমি একদিন পরেই ছাড়িয়ে আনব। আমি রাজকুমার, ভুলে যেও না!
এরপর রাজকুমার সদলবলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সন্তুকে রেখে দরজাটা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে। সন্তু আর সে দরজা টানাটানির চেষ্টা করল না।
সে এসে দাঁড়াল খোলা জানলার ধারে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গেটের কাছে ঘোড়র ক্ষুর ঠেকার আর বড় বড় নিশ্বাসের শব্দ হচ্ছে। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে এক ঝাঁক জোনাকি। টি ট্রি টি ট্রি করে দূরে একটা রাত পাখি ডাকছে। এরই মধ্যে কপাক শব্দ তুলে একটা ঘোড়া ছুটে চলে গেল।
যদিও কাছেই বিছানা পাতা, কিন্তু সন্তু বসে পড়ল ওই জানলার পাশেই। তারপর জানলার শিকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়। সকাল হয়ে রোদ এসে তার মুখে পড়াতেও তার ঘুম ভাঙল না।
দড়াম করে দরজাটা খুলে যেতেই সন্তু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল।