০১-২. সিনেমা দেখতে গিয়েছিল টুপুর
অনেক দিন পর আজ একটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিল টুপুর। মিতিনমাসি আর বুমবুমের সঙ্গে। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের জলদস্যুদের নিয়ে গল্প। ছবির শুরু থেকে শেষ অবিরাম টিসুম ঢাসুম, তলোয়ারের ঝনঝনি, আর মাস্তুলতোলা জাহাজে বিকট চেহারার দাড়িওয়ালা মানুষজনের বিস্তর লাফঝাঁপ। উপরি পাওনা, সুন্দর সুন্দর সিনারি। সমুদ্রে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, নীল সাগরের বুকে সবুজসবুজ পাহাড়ি দ্বীপ…আহা, চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। টানা আড়াই ঘণ্টা জমজমাট সব দৃশ্য দেখে টুপুর যখন সিট ছেড়ে উঠল, গত এক মাসে পরীক্ষার চাপে জেরবার হয়ে যাওয়া মাথা দিব্যি ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে।
হল থেকে বেরোতে না-বেরোতেই মিতিনমাসির মোবাইল ফোনে সুরেলা ঝংকার। নম্বরটা দেখে নিয়ে, দুচারটে হুঁ-হ্যাঁ আচ্ছা বলে ফের ভ্যানিটিব্যাগে চালান করে দিল ফোন।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, কে গো? তোমার কোনও ক্লায়েন্ট?
উহুঁ, তোর মেসো। আজ শনিবার তো, তাড়াতাড়ি ফিরেছে প্রেস থেকে। আর ফিরেই হাঁকাহাঁকি শুরু করেছে।
কেন?
কী যেন এক জব্বর খবর আছে।
কী খবর?
ভাঙল না তো। বলল, সাসপেন্স। বাড়ি গেলে তবে জানাবে।
তা হলে ফোনটা করল কেন?
ওটাই তো তোর মেসোর ট্যাকটিক্স। ভেবেছে কৌতূহলে পেট ফুলবে, দৌড়তে-দৌড়তে আমরা বাড়ি চলে যাব।… যাক গে যাক, খাবি কিছু?
বুমবুম বেশ একটা বড় বড় হাবভাব নিয়ে পাশে-পাশে হাঁটছিল। খাওয়ার কথা কানে যেতেই লাফিয়ে উঠেছে, চিপস খাব, চিপস।
মিতিন মাথা নেড়ে বলল, এখন নো চিপস।
তা হলে আইসক্রিম?
চলতে পারে। তবে পেটে সলিড কিছু পড়ার পর… গরম গরম মোমো খেলে কেমন হয়?
আহারের ব্যাপারে বুমবুমের অজস্র ফ্যাঁকড়া। তবে মোমোর প্রস্তাবটা তার মনে ধরেছে। টুপুরেরও। এলগিন রোডের ফুটপাত ধরে এগোচ্ছিল তিনজনে, পথ বদলে চলে এসেছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হসপিটালের সামনে। ছোট্ট তিব্বতি রেস্তরায় ঢুকে অর্ডার দেওয়া হল স্টিমড মোমোর। সঙ্গে টুপুরের জন্য তার প্রিয় থুপকাও।
খেতেখেতে সিনেমাটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বুমবুম বলল, মা, জলদস্যুরা বড় বেশি নিষ্ঠুর হয়, তাই না?
হুম। খুব মারপিট করে। লুটপাটের সময় ওরা কোনও বাধা মানে না, ঘ্যাচাং-ঘ্যাচাং মাথা কাটে।
আমাদের দেশে জলদস্যু নেই?
আগে অনেক ছিল। এখনও আছে কিছু। তারা মাঝে-মাঝে সুন্দরবনের নদীগুলোতে লঞ্চ বা নৌকোর যাত্রীদের উপর হামলা চালায়।
অবশ্য আমরা ওদের জলদস্যু বলি না, টুপুর এবার নিজের জ্ঞান জাহির করল, আমরা ওদের নাম দিয়েছি হার্মাদ।
দুর বোকা, এখনকার ওই ডাকাত-লুঠেরাগুলো হার্মাদ হতে যাবে কেন? হার্মাদ তো পর্তুগিজ জলদস্যু। স্পেন-পর্তুগালের নৌবহরের নাম একসময় ছিল আর্মাডা। পর্তুগিজ জলদস্যুরা বিরাট বিরাট জাহাজ নিয়ে আসত বলে কীভাবে যেন ওই আর্মাডা শব্দটা লোকের মুখে মুখে হার্মাদ হয়ে গিয়েছিল।
বুঝেছি, যেমন মরাঠা দস্যুদের বলা হত বর্গি।
রাইট। বর্গ মানে শ্রেণি বা দল। মরাঠিরা দল বেঁধে আক্রমণ করত তো, তাই বর্গ থেকে বর্গি। কিংবা ধর, মগ। ব্ৰহ্মদেশ, অর্থাৎ বর্মা.. এখন কিনা যার নাম মায়ানমার.. সেখানকার লোকরা নামের আগে লিখত মং, আমাদের যেমন শ্রী বা শ্রীমান। ওই মং থেকেই বর্মার লোকের নাম হয়েছিল মগ।
তাই নাকি? টুপুরের চোখ বড় বড়, আমরা যে তা হলে কথায় কথায় মগের মুলুক বলি, সেটা আসলে বৰ্মাদেশ?
ইয়েস ম্যাডাম। এককালে ওখানে ভীষণ অরাজক অবস্থা ছিল। কেউ আইনকানুনের তোয়াক্কা করত না। খুন-জখম, চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই লেগেই থাকত। তাই যে দেশে কেউ কোনও নিয়মকানুন মানে না, সেটাকে আমরা বলি মগের মুলুক।
এত সব জ্ঞানগর্ভ বিষয় বুমবুমের বুঝি একটুও পছন্দ হচ্ছিল না। মাত্র দুখানা চিকেন মোমোতে তার পেট ভরে গিয়েছে, এখন সে আইসক্রিম চায়। অগত্যা চটপট প্লেট শেষ করে টুপুরদের উঠতেই হল। বাইরে এসে ছেলেকে একটা স্ট্রবেরি কাপ কিনে দিয়ে মিতিন ট্যাক্সি ধরেছে। জানলার ধারে বসে আইসক্রিম চাটতে-চাটতে চলেছে বুমবুম, মাসি আর বোনঝি কথা বলছে টুকটাক। ট্যাক্সি যখন বাড়ির সামনে পৌছল, তখনও বুমবুমের কাপ চাটা শেষ হয়নি।
তিনতলায় উঠে ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতে হল না, তার আগেই পার্থ দরজা খুলেছে। সম্ভবত ব্যালকনিতে ছিল, দেখতে পেয়েছে ট্যাক্সি। উত্তেজিত মুখে বলল, তোমরা এত দেরি করলে?
মিতিন সেভাবে আমল দিল না। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, তো? হয়েছেটা কী?
খবরটা দেব বলে কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি.. এমন একটা গ্র্যান্ড নিউজ়…
হুঁ। বুঝলাম। তা প্রাইজটা কী?
পার্থ থতমত খেল একটু ঢোক গিলে বলল, কী করে বুঝলে প্রাইজ পেয়েছি?
সিম্পল। তোমার উচ্ছাস দেখে, মিতিন চটি ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসল। ভুরু বাঁকিয়ে বলল, এটুকু আন্দাজ করতে পারি বলেই তো আমি ডিটেকটিভ হয়েছি, নয় কি?
তা বটে! পাৰ্থ হেসে ফেলল, এবার তা হলে প্রাইজটাও গেস করে ফ্যালো।
হবে হাঁড়িকড়া গোছের কিছু। কিংবা স্যান্ডউইচ-টোস্টার। অথবা ইলেকট্রিক ইস্ত্ৰি।
ঢিলটা মোটেই লাগল না ম্যাডাম! পার্থর হাসি চওড়া হল, সুডোকু মেলানো নিয়ে খুব আওয়াজ দিতে না আমায়? ওই সুডোকুর কল্যাণেই একটা ফ্যান্টাস্টিক অফার পেয়েছি।
কীরকম?
ফুল ফ্যামিলি বিদেশ ভ্ৰমণ। প্রায় নিখরচায়।
এবার মিতিনও চমকেছে। টুপুরের তো চক্ষুস্থির হওয়ার দশা। এমনও হয় নাকি?
আস্তে আস্তে ব্যাপারটা খোলসা হল। ইদানীং শব্দছকের পাশাপাশি নতুন একটা নেশায় মেতেছে পার্থ। সুডোকু। খবরের কাগজ হোক, ম্যাগাজিনই হোক, যেখানেই ওই ন ঘরের সংখ্যাছক চোখে পড়ে, অমনই বসে যায় মেলাতে। খুচরো প্রাইজের আশায় পোস্ট করে দেয় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। অবশ্য একটা আলপিনও জোটেনি কখনও। কিন্তু এবার সত্যি-সত্যি কপালে শিকে ছিঁড়েছে। গত তিন মাস ধরে, ফি রোববার, ইংরিজি খবরের কাগজের সঙ্গে একটা হ্যান্ডবিল আসছিল বাড়িতে। সুডোকুর ছকসহ। দিল্লির কোন এক পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনালের পাঠানো। হ্যান্ডবিলে ঘোষণা থাকত, ঠিকঠাক ছক মিলিয়ে অমুক পোস্টবক্সে পাঠিয়ে দিন। প্রথম সঠিক উত্তরদাতার জন্য রয়েছে এক আকৰ্ষক পুরস্কার। তা পার্থ প্রতিবারই তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দেয়, তবে কিছুতেই ফার্স্ট হতে পারে না। অবশেষে নবম চেষ্টায় সফল হয়েছে সে। এবং পুরস্কারটাও সত্যিই লোভনীয়। স্বামী-স্ত্রী আর একটি বাচ্চার সিঙ্গাপুর যাতায়াতের প্লেনভাড়া দিচ্ছে পেঙ্গুইন ইন্টারন্যাশনাল। সঙ্গে সিঙ্গাপুরের কোনও একটি বিশেষ হোটেলে তিন দিন, দু রাত থাকার খরচাও।
বলতে বলতে পার্থ উল্লাসে ফুটছিল। প্রায় হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ব্যাপারটা বুঝলে তো? যাতায়াত ফ্রি, থাকা ফ্রি। শুধু খাওয়াদাওয়ার খরচটা যা লাগবে। আর এদিক-ওদিক বেড়ানো, কি কিছু কেনাকাটার। একটা বিদেশি শহরে ঢুঁ মেরে আসার কেমন সুন্দর সুযোগ এসে গেল, বলো?
কিন্তু… মিতিনের তবু যেন ধন্দ যায় না। চোখ কুঁচকে বলল, যত দূর জানি, এই ধরনের প্রাইজে শুধু হোটেলের খরচটাই দেয়। এরা প্লেনফেয়ারও দেবে?
দিচ্ছে তো। এটাই হয়তো পেঙ্গুইন রিসর্টসের মার্কেটিং স্টাইল। ওখানকার যে হোটেলে রাখবে, তাদের সঙ্গে এদের হয়তো কোলাবরেশন আছে। সিঙ্গাপুরে টুরিজম প্রোমোট করার এটাই হয়তো নতুন কায়দা।
হুম, হতে পারে! মিতিন মাথা নাড়ল, কই, চিঠিটা দেখি।
চিঠি তো কম্পিউটারে। আমার মেল বক্সে।
তোমার ই-মেল অ্যাড্রেস ওদের দিয়েছিলে বুঝি?
অবশ্যই। জলদি চিঠি চালাচালি করতে এখন ই-মেলই তো ভরসা। সেকেন্ডের মধ্যে দুনিয়ার যে-কোনও প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়, পার্থ সোফায় বাবু হয়ে বসল, যাক গে, কাজের কথা শোনো। আমাদের যাত্রার সম্ভাব্য তারিখটা ওরা জানতে চেয়েছে। সেই অনুযায়ী প্লেনের টিকিট পাঠাবে। বেশি দেরি করা যাবে না, কারণ অফারটার মেয়াদ মাত্র এক মাস। আজ ২৪ মার্চ, ২৪ এপ্রিলের মধ্যে আমাদের ঘুরে আসতে হবে।
অসুবিধের কী আছে? বুমবুমের তো পরীক্ষা হয়েই গিয়েছে, আমারও এই মুহূর্তে হাতে কোনও কাজ নেই, আমরা নেক্সট উইকেই যেতে পারি, মিতিন যেন এতক্ষণে বেশ খুশি খুশি।
আমাদের তিনজনেরই তো পাসপোর্ট আছে। সিঙ্গাপুরের ভিসা পাওয়াও এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। এখন তো শুনি, সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে নেমেও ভিসা করিয়ে নেওয়া যায়। দু-তিন দিন বেড়িয়ে এলেও মাথাটা বেশ ফ্রেশ হয়ে যাবে।
বটেই তো তোমার তো এখন যা ঘোরাঘুরি, সব কাজের জন্য। স্রেফ আরাম করে বেড়ানো তোমার আর হয় কোথায়? কী রে টুপুর, ঠিক বলছি কিনা বল?
টুপুরের বুকটা কেমন ভার-ভার ঠেকছিল। মাসি, মেসো আর বুমবুম তিন-চার দিনের জন্য বেড়াতে যাবে, এতে তো তার হিংসে জাগা উচিত নয়, তবু মনটা কেমন খচখচ করছে। উদাস গলায় টুপুর বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, যাও। তোমাদের সকলেরই ভাল লাগবে। খুব মজা করতে পারবে।
পার্থ চোখ পিটপিট করল, তুই যাবি নাকি সঙ্গে?
আমি কী করে যাব? ওরা তো শুধু তোমাদের তিনজনকেই…
সো হোয়াট? তুইও যেতে পারিস। তোর খরচ আমি দেব। পাসপোর্টও তো আছে তোর। তাই না?
টুপুর খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ল। গত বছর টুপুরের বাবা একটা সেমিনারে যোগ দিতে ঢাকা গিয়েছিলেন, তখনই টুপুর আর টুপুরের মার মার পাসপোর্টটাও করিয়ে রেখেছিলেন। অবনীর সঙ্গে যদিও টুপুর আর সহেলির বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি, তবে পাসপোর্টটা তো আছে।
ঈষৎ লজ্জালজ্জা মুখে টুপুর বলল, কিন্তু… স্কুল কামাই হবে… আমার সুবিধেমতো ডেটে যদি যাওয়া না হয়…
বকিস না তো! তিন দিন স্কুল ড়ুব মারলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয় না, পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, জানিস, আমি প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে চার দিন স্কুল বাঙ্ক করতাম।
আর রাস্তায়-রাস্তায় ডাংগুলি খেলে বেড়াতে, মিতিন ফোড়ন কাটল।
নো। আই ওয়াজ আ ফুটবলার। পাউরুটি, আলুরদমের বিনিময়ে কত দূর-দূরান্তে খেপ খেটে এসেছি। স্ট্রাইকার হিসেবে আমার যা নাম ছিল… সমস্ত ক্লাব আমায় খেলানোর জন্য ঝুলোঝুলি করত। বারাসত থেকে ডাকছে, উলুবেড়িয়া থেকে ডাকছে… নেহাত কলেজে উঠে ফুটবলটা ছেড়ে দিলাম, নইলে ন্যাশনাল টিমে তো আমার জন্য জায়গা বাঁধা ছিল।
হয়েছে, এবার গুল মারা থামাও, মিতিন দুহাত তুলল, চটপট গিয়ে আগে ই-মেলটার জবাব দিয়ে দাও তো। লিখবে, আমাদের সঙ্গে এক্সট্রা একজন যাচ্ছে, তার এয়ারটিকিট আমরা করে নেব। আর পারলে যেন এমনভাবে ব্যবস্থা করে, যাতে মাঝে শনি-রোববারটা থাকে।
তুমিও তা হলে ততক্ষণে ভাল করে কফি বানিয়ে ফ্যালো। তোমার আরতিরানি কাজ সেরে যাওয়ার সময় এমন এক কাপ চা খাইয়েছে, মুখ তিতকুটে মেরে আছে।
পার্থমেসো কম্পিউটারে বসল। মিতিনমাসি রান্নাঘরে। বুমবুম টিভিতে কার্টুন দেখছে। সিন চ্যাং। ভয়ংকর এক দুষ্টু ছেলের কাহিনি, বেশিক্ষণ তার কাণ্ডকারখানা দেখলে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। টুপুর দু-পাঁচ মিনিটের বেশি বসতে পারল না টিভির সামনে। পায়েপায়ে চলে গেল মিতিনমাসির নিজস্ব চেম্বারটায়।
এই ঘরখানায় ঢুকলেই অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাগে টুপুরের। কত কিছু যে আছে এখানে। সম্প্রতি একটা ল্যাপটপ কিনেছে মিতিনমাসি, বাহারি ছোট্ট কম্পিউটারখানা শোভা পাচ্ছে টেবিলে। দেওয়ালজোড়া র্যাকে থরে থরে বই আর বই। ইতিহাস, ভূগোল, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য, সবই অবস্থান করছে পাশাপাশি। এ ছাড়াও আছে অজস্ৰ ফাইল। নানান কেসের। একএকটা বিষয় ধরে খবরের কাগজের কাটিং জমায় মিতিনমাসি, সেই ফাইলও সংখ্যায় কম নয়। কোনওটায় একের পর এক খুনের খবর। কোনওটায় শুধু কিডন্যাপিং। কিংবা জালিয়াতি, ডাকাতি। গত তিনচার বছরের একটা অপরাধও বোধ হয় মিতিনমাসির তথ্যভাণ্ডারের বাইরে নেই। এত গুছিয়ে কাজ করে বলেই না ঝানু গোয়েন্দা হিসেবে মিতিনমাসির এত নামডাক!
বইয়ের তাক ঘেঁটে টুপুর একটা মানচিত্রের বই বের করল। পাতা উলটে-উলটে থামল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ম্যাপে। সিঙ্গাপুর খুঁজছে।
হ্যাঁ, পেয়েছে। ভারতের পরে বাংলাদেশ, তারপর মায়নমার। তারপর মগের মুলুক পেরিয়ে, আন্দামান সমুদ্র ছুঁয়ে, তাইল্যান্ডকে পাশে রেখে, মালয়েশিয়া অতিক্রম করে সিঙ্গাপুর দ্বীপ। ও-ওইখানে যাবে টুপুর?
ইস, টুপুরের বিশ্বাসই হচ্ছে না। এমন আকস্মিকভাবে সিঙ্গাপুর ভ্রমণটা আকাশ থেকে খসে পড়ল! শেষমেশ যাওয়া হবে তো সত্যিসত্যি? এর মধ্যে দুম করে মিতিনমাসির কোনও কেনা এসে যায়।
.
০২.
নাঃ, কোনও গড়বড় হল না শেষ পর্যন্ত। পার্থ সম্মতি জানানোর তিন দিনের মধ্যেই উত্তর হাজির। এবার আর ই-মেল নয়, কুরিয়ারের মাধ্যমে। সুদৃশ্য খামে, হালকা নীলরঙা পেঙ্গুইনের একটা বড়সড় লোগো বসানো প্যাডে চিঠি পাঠিয়েছে পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনাল। পত্রের বয়ানটি সংক্ষিপ্ত, নেহাতই কেজো। শ্রীপার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় ও তার পরিবারকে এই ভ্ৰমণটি উপহার দিতে পেরে পেঙ্গুইন রিসর্টস কৃতার্থ বোধ করছে। তারা আশা করে, ভ্রমণটি অবশ্যই উপভোগ্য হবে। সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে তাদের প্রতিনিধি যথাসময়ে উপস্থিত থাকবে এবং হোটেলবাসের যথাযথ বন্দোবস্ত করে দেবে।
খামে তিন-তিনখানা বিমান-টিকিটও মজুত। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের। পাৰ্থ, মিতিন, আর বুমবুমের নামে। যাওয়া ৩ এপ্রিল, শুক্রবার। ফেরা সোমবার রাতে। অর্থাৎ ঠিক যেমনটি চাওয়া। হয়েছিল, তেমনটি।
ব্যস, পার্থকে আর পায় কে! আনন্দে প্রায় লাফাতে-লাফাতে কম্পিউটারে বুক করে ফেলল টুপুরের টিকিট। সিঙ্গাপুরে নেমে ভিসা করাতে গিয়ে কী ঝামেলা হয় কে জানে, এখানকার এক ট্র্যাভেল এজেন্ট বন্ধুকে ধরে একদিনেই বের করে ফেলল সিঙ্গাপুরবাসের অনুমতি। টাকা ভাঙিয়ে সিঙ্গাপুর ডলার কিনল বেশ কিছু। খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি, কেনাকাটার খরচ তো নিজেদেরই করতে হবে। দু-তিন দিনের জন্য পাহাড়প্রমাণ জামাকাপড়ও গুছিয়ে নেওয়া হল সুটকেসে। এবার শুধু উড়লেই হয়।
টুপুরও উত্তেজনায় ফুটছিল। জীবনে এই প্রথম বিদেশভ্রমণ বলে কথা! বাবা-মার সঙ্গে নেতাজি সুভাষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে যখন পৌছল, তখন তো টুপুরের রীতিমতো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
ফ্লাইট রাত ১১টা ৫০-এ। টুপুরদের বিদায় জানিয়ে ফিরে গিয়েছেন অবনী আর সহেলি। শুল্কদপ্তর আর নিরাপত্তা বেষ্টনী টপকে দোতলার ঝকঝকে লাউঞ্জে এসে বসল টুপুররা। প্লেন ছাড়তে এখনও খানিক দেরি, একটু একটু করে যাত্রীতে ভরে যাচ্ছে লাউঞ্জ। সাহেব, মেমসাহেব, চিনা, জাপানি, বাঙালি, অবাঙালি,কতরকম যে লোক। কেউ বা একা বসে, কেউ গল্পগুজব করছে, কেউ বা হেঁটে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। চা-কফি ম্যাক্স কোল্ড ড্রিঙ্কসের ছোট্ট-ছোট্ট দোকানগুলো বন্ধ ছিল এতক্ষণ, ঝাঁপ খুলতেই কিয়স্কগুলোর কাউন্টারে খুচরো জটলা। লাউঞ্জে একটা টিভিও চলছে, সেদিকেও চোখ মেলেছে কেউ-কেউ। অনেকেরই কানে মোবাইল, দরকারি কথা সারছে টুকটাক। কোণের বিনা পয়সার টেলিফোন বুথেও হালকা লাইন।
পার্থ হাঁটতে হাঁটতে ওই বুথের দিকেই গিয়েছিল। একবার কফিশপেও ঢুঁ মেরে এসে টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, কী রে, কিছু খাৰি নাকি?
টুপুরের অল্প-অল্প খিদে পাচ্ছিল। নটার মধ্যে এয়ারপোর্টে আসতে হয়েছে, সন্ধেবেলার লুচি-তরকারি হজম হয়ে গিয়েছে মোটামুটি। ঠোঁট কুঁচকে বলল, কী পাওয়া যাবে?
পেষ্ট্রি, স্যান্ডউইচ..
না না, ওসব এখন খেতে হবে না। প্লেনে উঠলেই তো ডিনার দেবে, মিতিন প্রস্তাবে জল ঢেলে দিল, বরং দু-এক প্যাকেট চিপস নাও, কফির সঙ্গে খাই।
বুমবুম চুলছিল এতক্ষণ। চিপসের নাম কান যেতে সে আচমকাই চাঙা। উজ্জ্বল মুখে বলল, আমি কিন্তু একটা গোটা প্যাকেট খাব।
এসে গেল মুচমুচে চিপস। পার্থ আর মিতিনের কফিও। কাগজের কাপে চুমুক দিয়ে মিতিন বলল, কী রে, কেমন দেখছিস লাউঞ্জটা? মনে হচ্ছে না একটা মিনি পৃথিবী?
টুপুর ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, সে তো বটেই।
ইন্টারেস্টিং কিছু চোখে পড়ছে?
টুপুর এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাল, ওই দুজন বুদ্ধিস্ট মঙ্কের কথা বলছ? ন্যাড়া মাথা? গেরুয়া পরা?
না, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এখনও বৌদ্ধদের রমরমা। এঁরা তো থাকবেনই।… আর কিছু?
চিপস চিবোতে-চিবোতে আর-একবার প্রকাণ্ড হলঘরের মতো জায়গাটাকে নিরীক্ষণ করল টুপুর। আমতা-আমতা করে বলল, কই, সেভাবে তো..
আমার অবজারভেশনটা বলব? পার্থ ফুট কাটল, ওই যে টেলিফোন বুথের সামনে তিনটে লোক দাঁড়িয়ে… ওরা মনে হচ্ছে একটু সন্দেহজনক। সম্ভবত ওরা ক্যারিয়ারের কাজ করে।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, সেটা কী?
সিঙ্গাপুর থেকে নানা ধরনের জিনিসপত্র কিনে এনে এখানকার বাজারে বেচা হয়। এই ধর, ফ্যান্সি মার্কেটে, বাগরি মার্কেটে… কেনাকাটা আর চোরাপথে মাল আনার বন্দোবস্ত করে এই সব ক্যারিয়াররা। এদের পিছনে থাকে বড় কোনও ব্যবসায়ী বা স্মাগলার। লাভের গুড় সেই লোকটাই খায়, এরা ক্যারি করে আনার জন্য কিছু পয়সা পায় শুধু।
কী কাণ্ড, কাস্টমস এদের ধরে না?
কখনও ধরা পড়ে, কখনও বেরিয়ে যায়। ওই ঝুঁকিটুকুর জন্যই তো টাকা দেওয়া হয় ওদের। লোক তিনটেকে ভাল করে দেখল টুপুর। চেহারায় এমন কিছু বিশেষত্ব নেই। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। পোশাক-আশাকও নিতান্ত সাধারণ। নিজেদের মধ্যে হাত
নেড়েনেড়ে গল্পগুজব করছে লোকগুলো। টুপুরের মনে পড়ল, শুল্ক দপ্তরের অফিসাররা এদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছিলেন। জেরা করছিলেন কি? হবেও বা।
ভাবনাটার সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা প্রশ্নও উঁকি দিয়েছে টুপুরের মাথায়। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা পার্থমেসো, এরা কি নিষিদ্ধ ড্রাগটাগও নিয়ে আসে? ওই যে কাগজে মাঝে-মাঝে বেলোয়, দমদম বিমানবন্দরে কোকেন বা হেরোইন ধরা পড়েছে…
হ্যাঁ, ওসব দ্রব্যও তো ক্যারিয়াররাই বহন করে আনে, এবার পাৰ্থর বদলে মিতিনের জবাব, তবে সিঙ্গাপুর থেকে ড্রাগ আনা ভীষণ কঠিন।
কেন?
ড্রাগের ব্যাপারে সিঙ্গাপুর গভর্নমেন্ট সাংঘাতিক কড়া। ড্রাগসমেত কেউ সেখানে ধরা পড়লে তার একটাই শাস্তি। ডেথ, প্ৰাণদণ্ড। অতএব খেয়াল রেখো… এটা শুধু তোমাকে নয়, তোমার মেসোকেও বলছি, সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে নিজের হ্যান্ডব্যাগটি সম্পর্কে সাবধান। আত্মভোলা হয়ে থাকলে চলবে না। ড্যাবড্যাব করে ডিউটি-ফ্রি শপে জিনিস দেখছ… পুট করে কেউ ব্যাগে একটা প্যাকেট খুঁজে দিল… ব্যস, তা হলেই তুমি গেলে।
এই শর্মা মোটেই অত ক্যালাস নয়, পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, সুডোকু প্র্যাকটিস করার পর থেকে আমার চোখকান আরও অনেক বেশি খুলে গিয়েছে।
দ্যাটস গুড। কফি শেষ করে কাগজের কাপটা পার্থর হাতে ধরিয়ে দিল মিতিন, এটা বিনে ফেলে এসো তো।
বুমবুম বলল, আমায় দাও। আমি ফেলে আসছি।
ফাঁকা কাপদুটো নিয়ে দৌড় লাগাল বুমবুম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উলটো দিকের সোফায় বসে থাকা এক ভদ্রলোক উঠে এসেছেন। পার্থর চেয়ে খানিক বড়ই হবেন বয়সে। শ্যামলা রং, গাট্টাগোট্টা। চেহারা, হাইট মাঝারি, মাথায় অল্প টাক। পরনে কালো ট্রাউজার্স আর আকাশ নীল বুশশার্ট। অনেকক্ষণ থেকেই এদিকে তাকিয়ে ছিলেন ভদ্রলোক, বারকয়েক চোখাচোখিও হয়েছে টুপুরের সঙ্গে, টুপুর তেমন আমল দেয়নি।
ভদ্রলোক বিনীত স্বরে পার্থকে বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আগে কোথাও আমাদের দেখা হয়েছে কি?
পার্থ থতমত খেল সামান্য। বলল, না মানে… আমি তো ঠিক… মনে করতে পারছি না।
যদি কিছু মনে না করেন… আপনার নামটা জানতে পারি?
পার্থপ্রতিম মুখার্জি।
নামটাকেও বুঝি মনে-মনে হাতড়ালেন ভদ্রলোক। মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু আমার যে খুব… আচ্ছা, আপনি কি সেন্ট পল্স স্কুলে পড়তেন?
না তো। আমি সেন্ট কালী, বলেই পার্থ একগাল হাসল, আমি কালীপ্রসাদ বিদ্যামন্দিরের ছাত্র ছিলাম।
ও। তাহলে কি কর্মসূত্রে কোথাও…?
আপনি কোথায় কাজ করেন? পাৰ্থ চোখ সরু করল।
আমার কাপড়ের ব্যাবসা। বড়বাজারের পগেয়াপট্টিতে। আপনি কি যান ওদিকে?
না তো। আমি বউবাজারে একটা ছোট প্রেস চালাই। ক্যানিং স্ট্রিটে যাই মাঝে-মাঝে। কাগজ কিনতে।
ও। তাহলে হয়তো শিয়ালদা-টিয়ালদা কোথাও… আমি শিয়ালদা হয়েই বাড়ি ফিরি তো।
হতে পারে। আবার হয়তো আমি নয়, আমার মতো আর কাউকে দেখেছেন। একই টাইপের ফেসকাটিং তো আরও থাকতে পারে।
তাই কি? ভদ্রলোকের তবু যেন ধন যাচ্ছে না। চোখ পিটপিট করে বললেন, আচ্ছা… বাই এনি চান্স… আপনি কি আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে থাকতেন কখনও? বা মানিকতলার কাছাকাছি?
না না, আমি বরাবর দক্ষিণ কলকাতায়। আগে ভবানীপুরে ছিলাম, এখন ঢাকুরিয়ায়।
তা হলে বোধ হয় ঢাকুরিয়াতেই আপনাকে দেখেছি। প্রায়ই তো ঢাকুরিয়া যাই। আমার এক মাসির বাড়ি। ওই পাড়াতেই সম্ভবত..
আপনার মাসির বাড়ি কোথায়? স্টেশনের এপার? না ওপার? স্টে
শনের পশ্চিম দিকে। বাবুবাগান।
আমরা থাকি পুবে। শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোডে। পার্থ একগাল হাসল, একমাত্ৰ শিয়ালদা টু ঢাকুরিয়া ট্রেন ছাড়া আমাদের দেখা হওয়ার কিন্তু সম্ভাবনা খুব কম।
তাই হবে। হয়তো ট্রেনে, কিংবা রাস্তায়..ভদ্রলাক এবার যেন একটু লজ্জিত, সরি, মিছিমিছি আপনাকে বিরক্ত করলাম।
আরে না, আমি একদমই মাইন্ড করিনি। বরং ভালই তো, আলাপ পরিচয় হয়ে গেল।
তা ঠিক। নতুন-নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে আমারও বেশ লাগে। ভদ্রলোক হাসলেন, আপনারা কদ্দূর চললেন? সিঙ্গাপুর? নাকি ভায়া সিঙ্গাপুর অন্য কোথাও?
আমাদের দৌড় সিঙ্গাপুর পর্যন্তই।
বেড়াতে?
ওই আর কী? আলটপকা একটা সুযোগ জুটে গেল, ভাবলাম ঘুরেই আসি।
বেশ করেছেন। সিঙ্গাপুর ভারী সুন্দর শহর। …কদিন থাকছেন তো?
তিন দিন, দুরাতের প্যাকেজ টুর।
আই সি। তার মানে কোনও ট্র্যাভেল কোম্পানির সঙ্গে যাচ্ছেন? ওরাই ঘোরাবে?
ঠিক তা-ও নয়। আমরা নিজেরাই ঘুরব ফিরব। পেঙ্গুইন কোম্পানি শুধু আমাদের হোটেলের ব্যবস্থাটা করে দেবে।
পেঙ্গুইন?
পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনাল। নাম শুনেছেন?
মনে হচ্ছে, শোনা-শোনা। আপনাকে যেমন দেখা-দেখা মনে হচ্ছিল। বলেই ভদ্রলোক দরাজ গলায় হেসে উঠলেন, আমার এই এক বদরোগ, বুঝলেন। হঠাৎ হঠাৎ কোনও মানুষকে চেনা-চেনা মনে হয়। অথবা কোনও নাম শুনেই মনে হয় শোনা-শোনা। আমার মা বলেন…
ভদ্রলোকের মা কী বলেন তা আর শোনা হল না। বোর্ডিং গেট খুলে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে লাউঞ্জে চকিত ব্যস্ততা। সিট নম্বর অনুযায়ী ডাক চলছে মাইক্রোফোনে, সুড়ঙ্গপথের মতো লম্বা এয়ারব্রিজে একে-একে ঢুকে পড়ছে যাত্রীরা।
প্লেনের গেটে বিমানসেবিকাদের সুস্বাগতম পেরিয়ে টুপুররা নিজেদের সিটে এসে বসল। প্ৰকাণ্ড উড়োজাহাজ। প্রতিটি সারিতে দশজনের বসার জায়গা। দু দিকে জানলার ধারে তিন তিন ছয়, মধ্যিখানে চার। রাত্রিবেলা বাইরে কিছু দেখার নেই, তার উপর বসাও যাবে একসঙ্গে, তাই ভেবেচিন্তে মাঝের সিটই নিয়েছে পার্থ।
কাঁটায়-কাঁটায় এগারোটা পঞ্চাশে রানওয়ে ধরে ছুটল প্লেন। টুপুরের বিমানযাত্রা এই প্রথম নয়, গত বছরই মুম্বই যাতায়াত করেছিল আকাশপথে। তবু বিমান আকাশে উড়তেই বুকে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ শরীর যেন হালকা হয়ে গেল সহসা। এবার কানে তুলো লাগাব-লাগাব করেও লাগায়নি শেষ পর্যন্ত। একটু পরে কানদুটো যেন ভোঁ-ভোঁ করতে লাগল। একে নাকি বলে হাই অল্টিটিউড সিনড্রোম। পার্থমেসোর ভাষায়, উঁচুতে ওঠার গেরো। প্লেন নীচে নামার পরেও নাকি বেশ খানিকক্ষণ থেকে যায় ভোঁ-ভোঁ ভাব। কান কটকটও করে কখনও কখনও।
মিতিনমাসির পরামর্শমতো বেশ খানিকক্ষণ শ্বাস ধরে রেখে, ছাড়া-নেওয়া করে কান দুটোকে সমে ফেরাল টুপুর। সিটবেল্ট খোলার সংকেত পেয়ে ভাল করে গুছিয়ে বসেছে। প্লেন ছাড়ার আগেই হেডফোন বিলি করা হয়েছিল যাত্রীদের, যন্ত্ৰ কানে লাগিয়ে বুমবুম চোখ রেখেছে সামনের সিটের পিঠে লাগানো খুদে মনিটরে। কার্টুন দেখছে। মিতিনমাসিই চালিয়ে দিয়েছে। টুপুর, মিতিনমাসি, আর পার্থমেসোর সামনে, মনিটরে, ফুটে উঠেছে বিমানের যাত্রাপথ। এখন বিমান ঠিক কোথায়, কতটা উচ্চতায়, সেখানকার তাপমাত্রাই বা কত, সবই দেখা যাচ্ছে পরদায়।
কোল্ড ড্রিঙ্কস আর চানাচুরের প্যাকেট দিয়ে গেল হাস্যমুখ বিমানসেবিকা। আর-একটু পরে বুঝি নৈশাহার দেবে। বুমবুমের চানাচুর নিমেষে শেষ, হাত বাড়িয়েছে টুপুরের প্যাকেটে। পার্থও চিবোচ্ছে কচরমচর করে। মেনুকার্ডটা উলটেপালটে দেখে নিয়ে বলল, আমি কিন্তু সেদ্ধ-সেদ্ধ কন্টিনেন্টাল খাব না।
মিতিন মুচকি হেসে বলল, সে তো আমি জানি। সাধে কি তোমায় ভেতো বলি!
ভাতকে অত হেলাফেলা কোরো না ম্যাডাম। জাপানিরা ভাত খায় বলেই এত কর্মঠ। এত বুদ্ধিমান। ইন ফ্যাক্ট, ভাতের জন্যই আমার অঙ্কে এত মাথা?
শুধু কটা সংখ্যা মেলানো অঙ্ক নয়, স্যার। একটা পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে পৌঁছনোটাও অঙ্ক। আর সে ব্যাপারে তোমার মগজ ঢুঁঢু।
কী করে বুঝলে?
তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে। একটা সম্পূৰ্ণ অচেনা লোক তোমার পেট থেকে যাবতীয় খবর নিয়ে চলে গেল, অথচ তুমি তার সম্পর্কে কিছুই জানার চেষ্টা করলে না!
কেন, জেনেছি তো। উনি একজন বস্ত্রব্যবসায়ী। বড়বাজারে দোকান।
ব্যস, ওইটুকুই। বলো তো, ভদ্রলোকের নাম কী?
পার্থ একটুক্ষণ মাথা চুলকোল। তারপরই গুম। ঘাড় উঁচিয়ে দেখল এদিক-ওদিক। হঠাৎই সিট ছেড়ে উঠে গেছে। ভদ্রলোককে খুঁজে বের করে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে।
টুপুর সভয়ে বলল, সর্বনাশ, পার্থমেসোকে তুমি রাগিয়ে দিলে তো! এখন ভদ্রলোককে না উলটোপালটা প্রশ্ন করে বসে।
ছাড় তো, মিতিন পাত্তাই দিল না। ছোট্ট মনিটরে আঙুল রেখে বলল, এদিকে তাকা। দ্যাখ, আমরা বাংলাদেশ পেরিয়ে এখন। বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে যাচ্ছি। কাছাকাছি ল্যান্ড এখন মায়ানমার।
মানে মগের মুলুক?
হুম। বৰ্মায় আগে কত বাঙালি থাকত, জানিস? একসময় তো ধুয়ো ছিল, এদেশে কিছু হচ্ছে না, বর্মা পাড়ি দাও। সাহিত্যিক। শরৎচন্দ্রই তো বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা চলে গিয়েছিলেন। ওখানকার মান্দালয় জেলে আমাদের এখানকার স্বাধীনতাসংগ্রামীদের রাখা হত।
টুকটাক ইতিহাস আর ভূগোল নিয়ে কথা চলছিল। আলোচনা পুরোপুরি জমে ওঠার আগেই পার্থ ফিরে এসেছে। ধপাস করে সিটে বসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, পেট থেকে কথা আমিও বের করতে পারি।
মিতিন চোখ দিয়ে ইশারা করতেই টুপুর জিজ্ঞেস করল, কী কী জানলে গো পার্থমেসো?
এভরিথিং। ভদ্রলোকের নাম, সুজিত দত্ত। থাকেন সোদপুরে। এইচ-বি টাউনে। পগেয়াপট্টির দোকানটা ওঁর ঠাকুরদার আমলের। দোকান ছাড়াও সুজিতবাবুর আর-একটা ব্যাবসা আছে। এক্সপোর্টইমপোর্টের। সেই কাজেই বছরে বেশ কয়েকবার সিঙ্গাপুরে যেতে হয় ওঁকে। বিয়ে-থা করেননি। অত্যন্ত মাতৃভক্ত। বাবা হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যাওয়ার পর মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু বোঝেন না। পাৰ্থ তেরচা চোখে মিতিনকে দেখল, কী, আর কিছু জানতে চাও?
না। তবে ইনফরমেশনগুলো সত্যি না মিথ্যে, তা তো বোঝার উপায় নেই।
মানে? তুমি বলতে চাও, ভদ্রলোক মিথ্যে বললেন?
হতেও পারে। যাচাই করার তো কোনও উপায় নেই।
খামোকা উনি বানিয়ে বানিয়ে বলবেন কেন?
সে আমি কী করে বলব! জাস্ট মনে হল, তাই..
পার্থ গোমড়া মুখে বলল, টুপুর, তোর মাসির স্বভাবটা বেজায় কুচুটে হয়ে গিয়েছে। সব ব্যাপারে টিকটিকিপনা করা চাই। ভাল্লাগে না।
মিতিন হেসে ফেলল, রাগ করছ কেন? ঠেকেছি তো দু- একবার, তাই ভয় হয়। হঠাৎ কোনও উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে বেড়ানোর অর্ধেকটাই তো মাটি।
টুপুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ভদ্রলোককে কি তোমার উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে?
বলতে পারছি না রে, না হলেই তো মঙ্গল!