চুপকথার কান্না
নীলিমার আজ যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেল।
একি দেখছে সে! তার মাথা ঘুরছে। পৃথিবীটা যেন দুলছে। এটা কি তার কর্মফল!
একরাশ শূন্যতা তার বুকের ভিতরটা যেন গ্ৰাস করে নিলো।
বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে নীলিমা।লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলো। কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়াকালীন পাড়ার সুমন নামে একটি ছেলের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাবা মা জানতে পেরে মেয়েকে বোঝায়, সুমন ভালো ছেলে হলেও গ্ৰীলের কারখানায় কাজ করে। মালিক নয়, কর্মচারী মাত্র। অতি সামান্য মাইনে। তোকে খাওয়াবে কি? তাছাড়া এখন তোর পড়াশোনাও শেষ হয়নি, গ্ৰেজুয়েশনটা কর তারপর ভালো পাত্র দেখে আমরাই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবো।
কিন্তু নীলিমা নিজের মতো, যে কি সেই। তাই বাবা মা ভিতরে ভিতরে পাত্র দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করতে থাকেন।নীলিমা জানতে পেরে এক কাপড়ে বেড়িয়ে গিয়ে সুমনকে বিয়ে করে নেয়।
মেয়ের এরকম ঘটনায় নীলিমার বাবা মা মেয়েকে ত্যাজ্য কন্যা করেন।
নীলিমা আর সুমন পাড়া ছেড়ে দূরে গিয়ে বাড়ি ভাড়া করে সংসার পাতে।
বছর ঘুরলে নীলিমার কোল আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে কন্যা। নীলিমা আদর করে নাম রাখে মিষ্টি।
সুখেই কাটছিলো দিন। হঠাৎ একদিন রাতে নীলিমা দেখে সুমন মদ্যপ অবস্থায় ঘরে ফিরেছে।
নীলিমা অবাক। বলে, তুমি যে নেশা করো জানতাম না তো?এই সর্বনাশা খাওয়া কবে থেকে শুরু করলে!
সুমন বললো, আমি খাই না। আজ কারখানার প্রতিষ্ঠা দিবস ছিলো, তোমায় বলা হয়নি।
সেখানে পার্টিতে সকলের সঙ্গে একটু খেয়েছি।
নীলিমা বলে, এইসব ছাইপাঁশ আর খেয়োনা। এতে তোমারও ক্ষতি, সংসারেরও ক্ষতি।
সুমন ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝায় আর খাবেনা।
কিন্তু মাঝে মাঝেই খায়, নীলিমা বেশ বুঝতে পারে।গন্ধ পায়। সংসারে অশান্তি শুরু।
শেষকালে মিষ্টি যখন তিন বছর তখন সুমন লিভার ক্যান্সারে মারা যায়।
নীলিমা পড়ে অথৈ জলে। বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কিভাবে সে সংসার চালাবে!
শেষে বাড়িওয়ালির সহায়তায় একটা বুটিকের দোকানে কাজ পায় এবং সেখান থেকে যে আয় হয় কষ্ট করে সংসার চালানো এবং মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড়ো করে।
মেয়ে এখন এমবিএ করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে।
মেয়ে মিষ্টি মা’কে খুব ভালোবাসে, যত আবদার মায়ের কাছে। সবরকম কথা মায়ের সঙ্গে শেয়ার করে।
কিন্তু ইদানীং নীলিমা লক্ষ্য করছে মিষ্টি অফিস থেকে ফিরতে দেরি করছে। বেশভূষারও পরিবর্তন হয়েছে।
ছোটো ছোটো ওয়েস্টার্ন ড্রেসের প্রতি আগ্ৰহ বেড়েছে।
নীলিমা বারণ করলে বলে,- মা এসব নিয়ে তুমি অত মাথা ঘামিও না,যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। কত মেয়ে পরছে, সব মেয়েই কি খারাপ?
তুমি সেই সেকেলেই রয়ে গেলে।
নীলিমা চুপ হয়ে যায়, কিন্তু মনে মনে তার দুশ্চিন্তা হয়, কেমন একটা অশনিসংকেত যেন হাতছানি দেয়। ভয়ে মনের চুপকথাগুলো গুমড়ে কাঁদে। কাউকে প্রকাশ করতে পারে না। শুধু মনে হয়, মেয়ের এমন পরিবর্তন, বিপথে চলে যাচ্ছে না তো? আমার মতো ভুল কিছু করে বসবে নাতো? মনের মধ্যে হাহাকার আর চুপকথার কান্না।
আজ সকালে মিষ্টি বেরোবার সময় একটা মিনিস্কার্ট পরেছে দেখে নীলিমা জিজ্ঞাসা করলো, কি রে তুই অফিসে যাচ্ছিস নাকি অন্য কোথাও! আগে কোথায় যাচ্ছিস না যাচ্ছিস সব বলতিস – এখন কিছুই বলিস না, হয়তো তোর সময় হয়না। বুঝি তুই খুব ব্যস্ত তাই মা’কে সময় দিতে পারিস না।
এই যে ড্রেসটা পরে যাচ্ছিস এটা অফিসে এলাও?
মিষ্টি – কেন মা! এলাও না হলে আমি কি পরে যেতাম?ওটা আমেরিকান কোম্পানি জানবে। ড্রেসের কোনো বাইন্ডিংস নেই। তাছাড়া আজকে অফিসে একটা পার্টি আছে, যেমন ইচ্ছা ড্রেস পরা যাবে।
রাত অনেক হয়েছে, মিষ্টি এখনো ঘরে ফেরেনি। নীলিমা চিন্তায় অস্থির। কাকে জানাবে? বাড়িওয়ালি ছাড়া কেউ তো সাহায্য করবার নেই।
কিন্তু নীলিমার সংকোচ হচ্ছে। এতো রাতে মেয়ে বাইরে, কী করে বলবে?
মেয়ের চালচলনে এমনিতেই মনের মাঝে কু-ডাকে। অসহায় চুপকথার বেদনা কুরে খায় সবসময়।
কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না নীলিমা।
রাত্রি প্রায় দেড়টা নাগাদ কলিং বেল বেজে উঠলো। নীলিমা তাড়াতাড়ি দরজা খুললো। নীলিমার চক্ষু চড়কগাছ।
দুজন কলিগের কাঁধে ভর দিয়ে মেয়ে মদ্যপ অবস্থায় ঘরে ঢুকলো।