গঙ্গার ভূত
ছেলেবেলা ভূতের গল্প শুনতে খুব ভালবাসতাম। রাতে ভূতের গল্প শোনার আনন্দটাই আলাদা। পিসিমার কাছে শুয়ে শুয়ে আমরা অনেক জন রাত অবধি নানা গল্প শুনেছি। সেগুলো তখন আর গল্প থাকত না, আমাদের সব সত্যি মনে হতো। পিসিমা তখন আমাদের দুবেলা পড়াতেন। পড়া হয়ে গেলে রাত অবধি আমরা বেশ কয়েকজন পিসিমার কাছে থাকতাম। আমাদের কয়েকটা বাড়ির অভিভাবক সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতেন যে আমরা ওখানে খুব ভালো আছি। মাঝখানে পিসিমা দোতলার বারান্দায় শুতেন, দুপাশে একদিকে মেয়েরা আরেকদিকে ছেলেরা শুতাম। খনার বচন, রাজা রানীর গল্প, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, রূপকথা, সঙ্গে অবশ্যই থাকত ভুতের গল্প। তখন আমরা সব আরও কাছাকাছি হয়ে শুতাম। পিসিমা শুরু করার আগে বলতেন, তোরা ভয় পাবি না তো? আমরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলতাম তুমি বল ভয় পাব না। সেই সময় বেশিরভাগ বাড়িগুলো হ্যারিকেন লম্ফে হালকা আলো ও অন্ধকার হয়ে থাকতো। গলাকাটা ভূতের গল্প অনেক শুনেছি ছোটবেলায়। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল গঙ্গার ঘাট। দুপুরে আর সন্ধের সময় নাকি গলাকাটা ভূত এসে ঘাটে বসত। সেসময় গঙ্গায় অনেক মরা ভেসে যেত। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে নিয়ে যেত। যাদের গলাকাটা তারা গঙ্গার ঘাটে বসে থাকতো অনেকে নাকি দেখেছে। ওই কারণে দুপুর হয়ে গেলে কেউ আর গঙ্গার ঘাটে যেত না। সন্ধ্যাবেলা ও তাই। যারা যারা দেখেছিল আমাদের তার গল্প বলতো। কানাই দারা জাল দেওয়ার জন্য নৌকা নিয়ে মাঝেমধ্যে ঘাটে বসত। জলে বসে বসে কখনো কখনো তাদেরকে দেখেছে। তাই কেউ গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যেবেলা আর যেত না। পাশে ছিল একটা বড় বট গাছ। গাছগুলো মাঝেমধ্যে এত জোর হাওয়া দিত, মনে হতো গাছের ডালগুলো এক্ষুনি মড়াত করে ভেঙে পড়বে। অথচ কোন ঝড় ছিল না। আশপাশে মনে হতো কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। কেউ টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেলে আর কিছু দেখতে পেত না। এভাবে দিনের পর দিন চলত। আমাদের এই গঙ্গার ঘাটে আরেকটি অসুবিধা ছিল। যদি কোন ভাবে কেউ ডুবে যেত, তাহলে তিন জনকে নেবে অর্থাৎ তিন জনের মৃত্যু হবে। জলের নিচে ওর আটটা বসে থাকতো। তাই সচরাচর কেউ ঘাটের দিকে যেত না। এসব নিয়ে পিসিমা যখন গল্পটা বলতো আমরা ভয়ে পিসি মাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতাম। গায়ের মধ্য দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে যেত। সে কী ভয়? মনে হতো আর বাড়ি যাব না। লেপ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। পিসিমা মাঝে মাঝে বলতো, পরের দিন থেকে আর ভূতের গল্প বলবো না। তোরা ভয় পাস। আমরা পরের দিন আবার বায়না করতাম। বেশি ভয় লাগতো বাথরুমে যেতে। মায়ের আঁচল ধরে সব জায়গায় যেতাম। সঙ্গে মায়ের বকুনি ছিল_কেন ভূতের গল্প শুনিস? রাতে যদি এত ভয় পাবি। এইভাবে একটার পর একটা ভুতের গল্প শোনার জন্য উদ্বিগ্ন হতাম। রাত হলেই সে কি ভয় হতো। মশারির মধ্যে ঢুকে পড়লে আর বুঝি ভূত ধরতে পারবেনা। তাই কোনোরকমে তাড়াতাড়ি খেয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়তাম। পিসিমা এইভাবে অনেকগুলো গল্প আমাদের সবাইকে শোনাতো। একসাথে সবাই মিলে খুব আনন্দ করতাম।