আজ বারুণী
উৎসর্গ–
আনন্দরপা অমতরপা অনন্তরপা
–তিন কন্যাকে
.
আজ বারুণী। গঙ্গায় আজ কাঁচা আমের ছড়াছড়ি।
ঘাটে থৈ থৈ ভীড়। বয়স্কদের ভীড়টাই বেশি। সদ্য ওঠা কাঁচা আম মাথার উপর ধরে, ডুব দিয়ে উঠেই ফেলে দিচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে আম। কেউবা দূরে ছুঁড়ে ফেলছে।
ছোট ছোট দলে ছেলেরা জলে অপেক্ষা করে আছে আম সংগ্রহের জন্য। কেউ গলাজলে দাঁড়িয়ে, কেউবা দূরে ভেসে রয়েছে। আম দেখলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। একসঙ্গে দু-তিনজন চীৎকার করতে করতে জল তোলপাড় করে এগিয়ে যায়। যে পায়, প্যান্টের পকেটে রেখে দেয়, পকেটটা আমে ভরে গিয়ে ফুলে উঠলে, জল থেকে উঠে ঘাটের কোথাও রেখে আসে। সেই আমে হাত দেয়ার সাধ্য কার নেই। পরে আমগুলো ওরা বিক্রি করে পথের ধারে বসা বাজারে, অনেক কম দামে।
আজ গঙ্গায় ভাঁটা, জল অনেকটা সরে গেছে ঘাট থেকে। সিঁড়ি এবং তার দু’ধারে ইটবাঁধানো ঢাল পাড় শেষ হয়ে কিছুটা পলিমাটি, তারপর জল। স্নান করে, কাদা মাড়িয়ে বিরক্ত মুখে উঠে আসতে হচ্ছে। তারপর অনেকে যায় ঘাটের মাথায়, ট্রেন লাইনের দিকে মুখ করে বসা বামুনদের কাছে, যারা পয়সা নিয়ে জামাকাপড় জমা রাখে, গায়ে মাখার সর্ষে বা নারকেল তেল দেয় এবং কপালে চন্দনের ছাপ আঁকে। রাস্তার একধারে বসা ভিখারীদের অনেকে উপেক্ষা করে, কেউ কেউ করে না। দু’ধারের ছোট ছোট নানান দেবদেবীর দুয়ারে এবং শিব লিঙ্গের মাথায় ঘটি থেকে গঙ্গাজল দিতে দিতে, কাঠের, প্লাস্টিকের, লোহার, খেলনার ও সাংসারিক সামগ্রীর দোকানগুলির দিকে কৌতূহলী চোখ রেখে অধিকাংশই বাড়ির দিকে এগোবে। পথের বাজার থেকে ওল বা থোড় বা কলম্বা লেবু ধরনের কিছু হয়তো কিনলেও কিনতে পারে। তারপর, রোদে তেতে ওঠা রাস্তায় খালি-পা দুত ফেলে বাড়ি পৌঁছবে বিরক্ত মেজাজে।
তেলচিট্টে একটা ছেঁড়া মাদরে উপুড় হয়ে বিষ্টুচরণ ধরও ডলাই-মালাই করাতে করাতে বিরক্ত মুখে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। বিষ্টু ধর (পাড়ায় বেষ্টাদা) আই. এ. পাশ, অত্যন্ত বনেদী বংশের, খান সাতেক বাড়ি ও বড়বাজারে ঝাড়নমশলার কারবার এবং সর্বোপরি সাড়ে তিনমণ একটি দেহের মালিক। ওই সমবয়সী চল্লিশ বছরের একটি বিশ্বস্ত অস্টিন সর্বত্র ওকে বহন করে।
বিষ্টু ধরের বিরক্তির কারণ, হাত পনেরো দূরের একটা লোক। পরনে সাদা লুঙ্গি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে রঙিন ঝোলা। তার দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে। বিষ্টু বুঝতে পেরেছে, লোকটা হাসছে তার দেহের আয়তন দেখে। এরকম হাসি, বাচ্চা ছেলেরাও হাসে। বিষ্টু তখন দুঃখ পায়, তার ইচ্ছা করে ছিপছিপে হতে।
কিন্তু বিষ্টু বিরক্ত হচ্ছে যেহেতু এই লোকটা মোটেই বাচ্চা নয়। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। নুন আর গোলমরিচের গুড়ো মেশালে যেমন দেখায়, মাথার কদমছাঁট চুল সেই রঙের। বয়সটা পঞ্চাশের এধারে বা ওধারে বছর পাঁচেকের মধ্যে হতে পারে। লোকটার গায়ের রঙ ধুলোমাখা পোড়ামাটির মত; আর চোখের চাহনি! ধূসর মণি দুটো দেখলে মনে হবে বোধহয় সর্যের দিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তাকিয়ে থেকেই মণির কালো রঙটা ফিকে হয়ে গেছে। চাহনিটা এমন, দেখলে মনে হয় যেন তার মনের সঙ্গে মেলে না সেইসব ব্যাপারগুলো ব্লোটর্চের মত পুড়িয়ে দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে যাবে। চোয়াল দুটোকে শক্ত করে ধরে আছে জেদ।
মালিশওলা ডান হাঁটটা বিষ্টুর কোমরে চেপে ধরে মেরুদণ্ড বরাবর ঘাড় পর্যন্ত দ্রুত ওঠানামা করাতে লাগল পিস্টনের মত। বার দশেক এইভাবে হাঁটু ব্যবহারের পর মালিশওলা নমকারের ভঙ্গিতে হাতের তাল, জোড়া করে বিষ্টুর পিঠে জোড়াতালুর কোদাল চালাল।
এরপর বিষ্টু চিত হবার চেষ্টা করল। পারছিল না, মালিশওলা ঠেলেঠলে গড়িয়ে দিতেই সে অভীষ্ট লাভ করল। আরক্ষাকারী গামছাটি ঠিকঠাক করে বিষ্টু গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিল, “তানপুরো ছাড়।”
মালিশওলা দশ আঙুল দিয়ে বিষ্টুর সারা শরীরের চর্বিগুলো খপাখপ খামচে টেনে টেনে ধরে ছেড়ে দিতে লাগল।
“তবলা বাজা।”
মালিশওলা দশ আঙুল দিয়ে বিষ্টুর গলা থেকে কোমর অবধি ধপাধপ চাটাতে শুরু করল। চোখ বাজে প্রবল আরামে নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে তার মনে হল, লোকটা নিশ্চয় এখন ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। বিষ্টু তখন খুবই বিরক্ত বোধ করে বলল, “সারেগামা কর।”
মালিশওলা নির্দেশ পেয়েই আঙুলগুলো দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে লাগল বিষ্টুর সর্বাঙ্গে। আঙুলগুলো শরীরে কিলবিল করায় সুড়সুড়ি লাগছিল এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় চর্বি থলথল করে কেঁপে উঠতেই বিষ্টু শুনল খুকখুক হাসির শব্দ।
চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষ্টু বলল, “এতে হাসির কি আছে, য়্যা?”
সেকেণ্ড কুড়ি পর বিষ্টু জবাব শুনল, “মাসেজ হচ্ছে না সঙ্গীতচর্চা হচ্ছে?”
“যাই হোক না, তাতে আপনার কি?”
“ব্লাডপ্রেশারটা মেপেছেন?”
“আপনার দরকার?”
“ব্লাড শ্যুগার পরীক্ষা করিয়েছেন। কোলেসটেরল লেভেলটাও দেখেছেন কি?”
“কে মশাই আপনি, গায়ে পড়ে এত কথা বলছেন। চান করতে এসেছেন, করে চলে যান।”
“তা যাচ্ছি। তবে আপনার হার্টটা বোধহয় আর বেশিদিন এই গন্ধমাদন টানতে পারবে না।”
“কি বললেন?”
বিষ্টু ধর উঠে বসার জন্য প্রথমে কাত হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথাটি তুলল। তারপর দুহাতে মেঝেয় চাপ দিয়ে উঠে বসল।
লোকটি কাঁচমাচ, হয়ে বলল, “অবশ্য হাতি কিংবা হিপোর কখনো করোনারি অ্যাটাক হয়েছে বলে শুনিনি, সুতরাং আমি হয়তো ভুলও বলতে পারি।”
বিষ্টু ধর রাগে কথা বলতে পারছে না, শুধু চোখ দিয়ে কামান দাগতে লাগল। লোকটি পাঞ্জাবি খুলল। লুঙ্গি খুলল। ভিতরে হাফ প্যান্ট।
অবশেষে বিষ্টু ধর কোনক্রমে বলল, “আপনাকে যে কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।”
“আমার বৌও ঠিক এই কথাই বলে।”
“আপনি একটা ন্যুইসেন্স।”
“আমার ক্লাবের অনেকে তাই বলে।”
“আপনার মত লোককে চাবকে লাল করা উচিত।”
লোকটি আবার ছেলেমানুষের মত পিটপিট করে তাকাল।
“আচ্ছা, আমি যদি আপনার মাথায় চাঁটি মারি, আপনি দৌড়ে আমায় ধরতে পারবেন?”
কথাগুলো বলেই লোকটি এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছোটার ভঙ্গিতে জগিং শুরু করল। অনেকে তাকাল, অনেকে ভাবল পাগল।
বিষ্টু হতভম্ভ হয়ে লোকটির জগ করা দেখতে লাগল। চাঁটি মারার ভঙ্গিতে হাতটা তুলে লোকটি হঠাৎ বিষ্টুর দিকে ছুটে এল। বিষ্টু ডুব দেবার মত মাথাটা নিচ করল। লোকটি হাত তুলে রেখেই পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“পারবেন ধরতে যদি চাঁটিয়ে যাই। আমার কিন্তু আপনার থেকে অনেক বয়েস।”
জগ করতে করতে লোকটি আবার এগিয়ে আসছে। বিষ্টু ধর বুনো মোষের মত তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল। তাইতে লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নাচের ভঙ্গিতে শরীরটাকে পেণ্ডুলামের মত ডাইনে এবং বামে দুলিয়ে তিড়িং তিড়িং লাফালাফি শুরু করল। বিষ্টু থাবার মতো দুটো হাত তুলে অপেক্ষা করছে। দৃশ্যটা অনেককে আকৃষ্ট করল।
“আমি রোজ একসারসাইজ করি। আইসোমেট্রিক, ক্যালিসথেনিক, বারবেল, বুঝলেন রোজ করি। দারণ খিদে পায়। আপনার পায়?”
বিষ্টু ধর কথা না বলে, শুধু ‘ঘোৎ’ ধরনের একটা শব্দ করল।
“খিদের মুখে যা পাই তাই অমৃতের মত লাগে, এই সুখ আপনার আছে?”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই লোকটি জগ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে শেষ ধাপ পর্যন্ত গিয়ে আবার উঠে এল।
তিনবার এইভাবে ওঠানামা করে সে বিষ্টু ধরের পাঁচ গজ তফাতে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। হাত দুটো নামিয়ে বিষ্টু তখন খানিকটা দিশাহারার মতই লোকটির কাণ্ড দেখছিল। ওর চোখে এখন রাগের বদলে কৌতূহল। মনে মনে সে ছিপছিপে শরীরটার সঙ্গে নিজের স্থূলত্ব বদলাবদলি করতে শুর করে দিয়েছে।
“খাওয়ায় আমার লোভ নেই। ডায়টিং করি।” ভারিক্কি চালে বিষ্টু ধর ঘোষণা করল এবং গলার স্বরে বোঝা গেল এর জন্য সে গর্বিত।
লোকটি দু’পা এগিয়ে এসে বলল, “কি রকম ডায়টিং!”
“আগে রোজ আধ কিলো ক্ষীর খেতুম, এখন তিনশো গ্রাম খাই; জলখাবারে কুড়িটা নুচি খেতুম, এখন পনেরোটা; ভাত খাই মেপে আড়াইশো গ্রাম চালের, রাতে রুটি বারোখানা। ঘি খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, গরম ভাতের সঙ্গে চার চামচের একবিন্দুও বেশি নয়। বিকেলে দু’ গ্লাস মিছরির সরবত আর চারটে কড়াপাক। মাছ-মাংস ছুঁই না, বাড়িতে রাধাগোবিন্দ বিগ্রহ আছে। আর হপ্তায় একদিন ম্যাসেজ করাই এখানে এসে। আমার অত নোলা নেই, বুঝলেন, সংযম কেচ্ছসাধন আমি পারি। হার্টের ব্যামো-ফ্যামো আমার হবে না, বংশের কারো হয়নি। বাজি ফেলে সত্তরটা ফুলুরি খেয়ে কলেরায় বাবা মারা গেছে, জ্যাঠা গেছে অম্বলে।”
“এত কেচ্ছাসাধন করেন! বাঁচবেন কি করে?”
লোকটি এগিয়ে এসে বিষ্টু ধরের ভুড়িতে হাত বুলিয়ে দিল।
“আঃ, সুড়সুড়ি লাগে,” বিষ্টু হাতটা সরিয়ে দিয়ে ক্ষুণ্ণস্বরে বলল, “আমার বৌও ওই কথা বলে। সকাল থেকে রাত অবধি ব্যবসা দেখি। সর্ষে, চিনি, ডাল নানান জিনিসের কারবার। এত খাটনির পর এইটুকু খাদ্য! তারপর এই অপমান।”
“কে করল?”
লোকটি আবার হাত বাড়াতেই বিষ্টু একপা পিছিয়ে বলল, “না, সুড়সুড়ি লাগে।”
“কে অপমান করল?”
“কেন, আপনি হাতি-হিপো বললেন না! জলহস্তির ইংরিজি হিপো তা কি আমি জানি না, আমি কি অশিক্ষিত?”
“না না, আমি আপনাকে অশিক্ষিত তো বলিনি।” লোকটি বিব্রত হয়ে চশমা মুছতে মুছতে বলল, “আপনার ওজনটা খুব বিপজ্জনক হার্টের পক্ষে।”
‘বিপজ্জনক মানে?” বিষ্টু ধর তাচ্ছিল্য প্রকাশের চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত স্বর। “আমি কি মরে যেতে পারি।”
“তা পারেন। আর নয়তো কেচ্ছসাধনের কষ্ট করতে করতে, রোগে ভুগে ভুগে বেঁচে থাকবেন কয়েকটা বছর।”
বলেই লোকটি দু’ হাত তুলে সামনে ঝুঁকে পিঠটা ধনুকের মত বেঁকাল। হাতের আঙ্গুল পায়ে ছুঁইয়ে আবার সিধে হল।
“আপনি আমার থেকে চার হাজার গুণ বড়লোক, কিন্তু চার লক্ষ টাকা খরচ করেও আপনি নিজের শরীরটাকে চাকর বানাতে পারবেন না।”
“কি রকম! কি রকম!”
লোকটি তার ডান কনুই শরীরে লাগিয়ে পিস্তল ধরার মত হাতটা সামনে বাড়াল।
“এইবার আমার হাতটা নামান তো।”
অবিশ্বাসভরে বিষ্টু ধর হাতটার দিকে তাকাল। শিরা উপশিরা গাঁট সমেত হাতটাকে শুকনো শিকড়ের মত দেখাচ্ছে।
“নামান নামান।”
ফুলো ফুলো আঙুল দিয়ে বিষ্টু লোকটার কব্জি চেপে ধরে নিচের দিকে চাপ দিল। নড়ল না এক সেন্টিমিটারও। ঠোঁট কামড়ে বিষ্টু জোরে চাপ দিল। হাতটা একই জায়গায় রয়েছে। বিষ্টু এবার সব শক্তি প্রয়োগ করল। কপালে ঘাম ফুটছে। কিছু লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। তাদের চোখে বিস্ময়, লোকটার সাফল্যে না বিষ্টুর ব্যর্থতায় বোঝা যাচ্ছে না। বিষ্টু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে পাতলা হাসি আর চোখ পিটপিটানি দেখতে পেল। হাতটা সে নিচে নামাতে পারছে না। বিষ্টু হাল ছেড়ে দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল।
“কি করে পারলেন!”
“জোরে বলতে শুধু গায়ের জোরই বোঝায় না। মনের জোরেই সব হয়। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শরীরের দুর্বলতা ঢাকা দেওয়া যায়। শরীর যতটা করতে পারে ভাবে, তার থেকেও শরীরকে দিয়ে বেশি করাতে পারে ইচ্ছার জোর। সেজন্য শুধু শরীর গড়লেই হয় না, মনকেও গড়তে হয়। শরীরকে হুকুম দিয়ে মন কাজ করাবে। আপনার মন হুকুম করতে জানে না তাই শরীর পারল না।”
বিষ্টু ধর বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, “ইচ্ছে করে, খুব রোগা হয়ে যাই।”
ঠিক এই সময়ই গঙ্গার তীর থেকে তীক্ষ্ণ। চীৎকার ভেসে এল, “কো ও ও ও… নি ই ই ই। কো ও ও ও…নি ই ই ই”
লোকটি গঙ্গর দিকে তাকাল।
.
০২.
গঙ্গায় একটা আম ভেসে চলেছে ভাঁটার টানে। তিনজন সাঁতরাচ্ছে সেটাকে পাবার জন্য। কোমর জলে দাঁড়িয়ে দু-তিনটি বছর চোদ্দ-পনেরোর ছেলে জল থাবড়ে হৈচৈ করে ওদের তাতিয়ে তুলছে। সমানে-সমানে ওরা যাচ্ছে। মাথা তিনটে দু’ধারে নাড়াতে নাড়াতে, কুনই না ভেঙ্গে সোজা হাত বৈঠার মত চালিয়ে ওরা আমটাকে তাড়া করেছে।
হঠাৎ ওদের একজন একটু একট করে এগিয়ে যেতে শুরু করল, অন্য দু’জনকে পিছনে ফেলে। তখনই চীৎকার উঠল—”কো ও ও ও…নি ই ই ই। কো ও ও ও…নি ই ই ই।” পিছিয়ে পড়া দু’জনও গতি বাড়াল।
আমটা প্রায় প্রথম ছেলেটির মুঠোয় এসে গেছে। হঠাৎ সে থমকে গেল। হাত ছুঁড়ছে কিন্তু এগোল না। বার দুয়েক তার মাথাটা জলে ডুবল। তারপর সে রাগে চীৎকার করে ঘুরে গিয়ে লাথি ছুঁড়ল।
ততক্ষণে পিছন থেকে একজন ওকে অতিক্রম করে আমটা ধরে ফেলেছে।
“পা টেনে ধরেছিল।” বিষ্টু ধর বলল।
লোকটি হেসে চশমাটা খুলে ঝোলায় রাখল। ঘাটের বাইরের দিকে সেখানে কয়েকজন উড়িয়া ব্রাহ্মণদের একজনের কাছে ঝোলাটা রেখে এসে, লোকটি অতি সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। চশমা ছাড়া, মনে হচ্ছে, লোকটি যেন অন্ধ।
জলের কিনারে কাদার উপর তখন মারামারি হচ্ছে, একজনের সঙ্গে দু’জনের। কাদা ছিটকোচ্ছে। লোকেরা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে সরে গেল। দু-তিনটি ছেলে ওদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।
“ঠিক হ্যাঁয়, চালা, আরো জোরে।”
পা থেকে মাথার চুল কাদায় লেপা কঞ্চির মত সরু চেহারাটা তার লম্বা হাত দুটো এলোপাথাড়ি ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। অন্য দুজন সেই বিপজ্জনক বৃত্তের বাইরে কুঁজো হয়ে তাক খুঁজছে।
“ফাইট, কোনি ফাইটা চালিয়ে যা বক্সিং।”
দু’জনের একজন পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর পড়ে গেল দু’জনেই।
“অ্যাই অ্যাই ভাদু, চল টানবি না কোনির। তাহলে কিন্তু আমরা আর চুপ করে থাকব না।”
কোনির পিঠের ওপর বসা ভাদু, চল ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে কোনির মাথা ধরে, কাদায় মুখটা ঘষে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। কোনি পা ছুঁড়ল।
কোমরে চাড় দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করল। তারপর ঝটকা দিয়ে ভাদুর ডান হাতটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে এসে কামড়ে ধরল দুটো আঙুল।
চীৎকার করে ভাদু লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কোনি উঠে দাঁড়িয়ে ভাদুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“খুবলে নোর তোর চোখ, বার কর আম। আমাকে চোবানো! পুঁতে রাখব তোকে এই গঙ্গামাটিতে। হয় আম দিবি নয় চোখ নোব।”
দুহাতের দশটা আঙুল ঈগলের নখের মত বেকিয়ে চিত হয়ে পড়া ভাদুর চোখের সামনে কোনি এগিয়ে আনতেই, দুটি ছেলে ওকে ঠেলে সরিয়ে আনল।
“ছেড়ে দে চন্ডু, হাত ছাড় কান্তি। শোধ নিয়ে ছাড়ব। আমাকে চোবানো?”
কোনির ঠোঁটের কোণে ফেনা, সামনের দাঁত হিংস্রভাবে বেরিয়ে রয়েছে। হিলহিলে লম্বা দেহটা সামনে-পিছনে দুলছে কেউটের ফণার মত।
“এই ভাদু ও আম কোনির। বার করে দে। নয়তো সত্যিই চোখ তুলে নেবে কিন্তু!”
ভাদু ডান হাতটা চোখের সামনে ধরে দেখছিল। শিউরে উঠে বলল, “রক্ত বেরোচ্ছে! দাঁত বসিয়ে গত্তো করে দিয়েছে।”
কোনির হাত ছেড়ে দিয়ে কান্তি এগিয়ে এসে ভাদুর প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল। কয়েকটা কাঁচা আম বার করে, বড়টি বেছে নিয়ে কোনির দিকে ছুঁড়ে দিল।
লুফে নিয়েই কোনি কামড় বসাল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত মখে বলল, “কি টক রে বাবা। মা গঙ্গাকে এমন আমও খেতে দেয়!”
আমটা জলে ছুঁড়ে দিয়ে সে মুখ থেকে ছিবড়ে ফেলতে ফেলতে ভাদুর কাছে এল।
“দেখি তো কেমন গত্তো হয়েছে।”
খপ করে ভাদুর হাতটা ধরে সে ভ্রূ কুচকে আঙুলটা তুলে দেখল।
“ভাগ, কিচ্ছু হয়নি। নাম, নাম জলে নাম। যেমন কাজ করেছিস তেমনি ফল পেয়েছিল। আমাকে রাগালে কি হয়, এবার বুঝলি তো।”
কয়েকটি ডুব দিয়ে লোকটি কোমরজলে দাঁড়িয়ে গামছা ঘষছিল পিঠে। কানে এল পাশের এক বৃদ্ধের আপনমনের গজগজানি।
“জ্বালিয়ে মারে হতভাগার। গঙ্গার ঘাটটাকে নোংরা করে রেখেছে হাঘরে হাভাতের দল। মা গঙ্গাকে উচ্ছুগ্গো করা আমই রাস্তায় বসে বেচবে। জুটেছে আবার এক মেয়েমদ্দানী, বাপ-মাও কিছু বলে না।”
লোকটি আবার ডুব দিতে যাচ্ছিল, থেমে গিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল।
“মেয়েমদ্দানীটা কে?”
“কে আবার দেখতে পাননি, চোখ তো একজোড়া রয়েছে।”
লোকটি মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। চশমাছাড়া ঝাপসাভাবে দেখল, ভাদুর হাত ধরে কোনি টানাটানি করছে। কাদামাখা কোনির মধ্য দিয়ে এক একবার একটি মেয়ে ফুটে ফুটে উঠছে যেন। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা কাদামাখা চুল মাথায় বসে। প্যান্টে গোঁজা গেঞ্জী শরীরের সঙ্গে লেপটে দ্বিতীয় পরত চামড়া হয়ে আছে। দীঘ সরু দেহ। সরু পা, সরু হাত। লোকটি ঠাওর করতে পারছে না, কোনি ছেলে কি মেয়ে।
দুটো ঢেউ পর পর লোকটিকে ধাক্কা দিল। বিষ্টু ধর জলে নেমেছে।
“আচ্ছা, শরীরটাকে চাকর বানানো, সেটা কি ব্যাপার?”
“সোজা ব্যাপার। লোহা চিবিয়ে খেয়ে হকুম করবেন হজম করো, পার্কস্থলী হজম করবে। বলবেন, পাঁচ মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে চলো, পা জোড়া অমনি পৌঁছিয়ে দেবে। সখ হল গাছের ডাল ধরে বলবেন, হাত দুটো আপনাকে ঝুলিয়ে রেখে দেবে। এইসব আর কি।”
লোকটি জল থেকে উঠে আলতোভাবে মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে সিঁড়িতে দাঁড়াল। ভিজে গামছাটা নিংড়ে পায়ে লাগা মাটি ধুয়ে গঙ্গার দিকে তাকাল। ঝাপসাভাবে দেখল, পাড়ের কাছে জলে কিলবিল করছে মানুষ। তার মধ্যে কোনিকে চিনে নেওয়া সম্ভব হল না।
লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে, ঝোলা কাঁধে চশমা মুছতে মুছতে লোকটি একবার সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল, চশমা চোখে দিয়ে পাড়ের ডাইনে-বাঁয়ে তাকাল, হঠাৎ নজরে এল গঙ্গার বুকে চারটি কালো ফুটকি। তারা সিকি গঙ্গা পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
লোকটি আপনমনে একবার বলল: “কোনি। কো ও ও নি।”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভিজে গামছাটি পাগড়ির মত মাথায় জড়িয়ে লোকটি বাড়ির পথে রওনা হল।
মিনিট পনেরো পর, সরু গলির মধ্যে একতলা টালির চালের একটি বাড়িতে লোকটি ঢুকলো। সদর দরজার পরই মাটির উঠোন। টেনেটনে একটি ভলিবল কোর্ট তাতে হয়ে যায়। লঙ্কা, পেঁপে, জবা থেকে চলিকুমড়ো পর্যন্ত, উঠোনটা নানান গাছে দখল হয়ে আছে। একদিকে টিনের চালের রান্নাঘর ও কলঘর আর একদিকে দালান ও তার পিছনে দুটি ঘর। একতলা বাড়িটি চারদিকের উঁচু বাড়িগুলোর মধ্যে খুব শান্তভাবে যেন উবু হয়ে বসে। উত্তর দিকের বাড়ির মালিক হলধর বর্ধন এই একতলা বাড়িটি কেনার জন্য বার দুয়েক প্রস্তাব করেছে, কিন্তু লোকটি, সংসারে যার স্ত্রী এবং দুটি বিড়াল ছাড়া আর কেউ নেই, বিনীত ভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করে।
বাড়ির কলে জল আসে সামান্য। লোকটির স্ত্রীর নাম লীলাবতী। জল খরচ করাটা লীলাবতীর সখ, বিড়াল পোষার মতই। ফলে লোকটিকে স্নান করার জন্য প্রায়ই রাস্তার টিউবওয়েলটির সাহায্য নিতে হয়। আজ সকাল থেকে টিউবওয়েলের মুখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে না। তাই বহুকাল পর সে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল।
লোকটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে উঠোনে টানানো তারে ভিজে প্যান্টটা মেলেছে, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল ঢলঢলে প্যান্ট পরা বেটে, হৃষ্টপষ্ট একজন।
“ক্ষিদ্দা, তোমার জন্য অনেকক্ষণ বসে আছি, আর বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। দোকান থেকে কে বৌদিকে ডাকতে এসেছিল, “আসছি’ বলে সেই যে গেছে–
“ভেলো, চটপট একটু চা বানা দেখি।”
“বৌদি যদি এসে পড়ে!”
ক্ষিদ্দা অর্থাৎ ক্ষিতীশ সিংহ কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বলল, “তাহলে থাক, বরং তুই কি জন্যে এসেছিস বল?”
“ক্লাবের আজকের মিটিংয়ে যাবে নাকি?”
“নিশ্চয় যাব ছেলেরা খাটবে না, ডিসিপ্লিন মানবে না, জলে নেমে শুধু ইয়ারকি ফাজলামো করবে। এসব ছেলেদের ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে বলাটা কি এমন দোষের! একজনও কি তাই নিয়ে কিছু ভাবে? আর ক্ষিতীশ সিঙ্গি কি বলল অমনি তাই নিয়ে কাউনসিলের মিটিং ডাকা হল।”
“সেজন্য তো নয়, আসলে হরিচরণদা আর তার গ্রুপটার রাগ আছে তোমার ওপর। ওরাই শ্যামল আর গোবিন্দকে উসকে তোমার এগেনস্টে চার্য আনিয়েছে।”
“আমি তা জানি। হরিচরণের বহুদিনের ইচ্ছে চিফ ট্রেনার হওয়ার। আমাকে বলেওছিল গত বছর। আমি বলেছিলুম, হরি, একটা চ্যামপিয়ন শুধু খাওয়া দাওয়া আর ট্রেনিং দিয়েই তৈরী করা যায় না রে। তার মন-মেজাজ বুঝে তাকে চালাতে হয়। ট্রেনারকে মনস্তাত্ত্বিক হতে হবে, তার মানে কমনসেন্স প্রয়োগ করতে হবে। গুরুকে শ্রদ্ধেয় হতে হবে শিষ্যের কাছে। কথা, কাজ, উদাহরণ দিয়ে মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা বাসনা জাগিয়ে তুলতে হবে। তাকে মোটিভেট করতে হবে। এসব তোর দ্বারা সম্ভব নয়। তুই শুধু চেঁচামেচি গালাগালি করেই খাটাতে চাস, চিফ ট্রেনার হওয়া তোর কম্মো নয়।”
“ক্ষিদ্দা, তোমার এই লেকচার দেবার বদ অব্যেসটা ছাড়ো। এককথায় যেখানে কাজ হয়, তুমি সেখানে দশ কথা বলে। হরিচরণদাকে অত কথা বলার কি দরকার ছিল। যাকগে, আজ তুমি মিটিংয়ে যেও না, ওরা ঠিক করেছে তোমাকে অপমান করবে।”
“করে করবে।” এই বলে ক্ষিতীশ তার পায়ে মাথা ঘষায় ব্যস্ত বিশুকে কোলে তুলে গলা চুলকে দিতে লাগল। চোখ বু’জে বিশু ঘরর ঘরর শুরু করল।
“তাহলে যাবেই!” নেমে যাওয়া প্যান্ট এবং কণ্ঠস্বর হ্যাঁচকা দিয়ে টেনে তুলে ভেলো বলল।
ক্ষিতীশ ঘরের দিকে যেতে যেতে অস্ফুটে বলল, “হুঁ।”
তখনই বাড়িতে ঢুকল লীলাবতী সিংহ। অতি ছোট্টখাট্ট, গৌরবর্ণ এবং গম্ভীর। পায়ে চটি, হাতে ছাতা। দুজনের দিকে তাকিয়ে অবশেষে ভেলোকে বলল, “বেলা অনেক হয়েছে, চাট্টি ভাত খেয়ে যেও।”
ভেলোর হঠাৎ যেন কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল। ঘড়ি দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল, “না বৌদি, ইসস বড্ড দেরী হয়ে গেল, বাড়িতে ভাত নিয়ে বসে আছে। আমি এখন যাই। ক্ষিদ্দা, তোমর কিন্তু না গেলেই ভাল।”
ভেলো চলে যেতেই লীলাবতী প্রশ্ন কবল ক্ষিতীশকে, “না গেলেই ভাল মানে?”
“আজ ক্লাবের একটা মিটিং আছে। ও বলছে সেখানে আমাকে নাকি কেউ কেউ অপমান করবে যাতে ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যাই।”
“তাহলে তো ভালই হয়। ক্লাব-ক্লাব করে তো কোনদিন ব্যবসা দেখলে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকেই কিনা দোকান দেখতে হয়। নেহাত ছেলেপুলে নেই তাই। যদি ক্লাব তোমায় তাড়ায় তাহলে আমি বেঁচে যাই।”
লীলাবতী রান্নাঘরে ঢুকল। ক্ষিতীশ বিষণ্ণ চোখে দালানে বসে বিশুর মাথায় আনমনে হাত বোলাতে লাগল। এই সময় খুশি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডন দিয়ে, হাই তুলে ধীরে ধীরে সে চামরের মত কালো লেজটি উঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল ক্ষিতীশের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে।
“কই এসো।” রান্নাঘর থেকে ডাক এল।
ক্ষিতীশ অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে গিয়ে ভাত খেতে বসল।
খাওয়ার আয়োজন সামান্য। রান্না হয় কুকারে। প্রায় সবই সিদ্ধ। এটা খরচ, সময় ও শ্রম সংক্ষেপের জন্য নয়। ক্ষিতীশ বিশ্বাস করে, বাঙালিয়ানা রান্নায় স্বাস্থ্য রাখা চলে না। এতে পেটের বারোটা বাজিয়ে দেয়। সেইজন্যই বাঙালীরা শরীরে তাগদ পায় না, কোন খেলাতেই বেশি উঠতে উঠতে পারে না। খাদ্যপ্রাণ যথাসম্ভব অটুট থাকে সিদ্ধ করে খেলে এবং সর্বাধিক প্রোটিন ও ভিটামিন পাওয়া যায় এমন খাদ্যই খাওয়া উচিত।
প্রথম দিকে লীলাবতী বিদ্রোহী হয়েছিল, সরষেবাটা, শুকনো লঙ্কাবাটা, পাঁচ ফোড়ন, জিরে, ধনে প্রভৃতি বস্তুগুলি রান্নায় ব্যবহারের সুযোগ হারিয়ে। তুমুল ঝগড়া এবং তিনদিন অনশন সত্যাগ্রহেও কাজ হয়নি। ক্ষিতীশ তার সিদ্ধান্তে গোঁয়ারের মত অটল থাকে। তার এক কথা : শরীরের নাম মহাশয় যা সহাবে তাই সয়। অবশেষে লীলাবতী সপ্তাহে একদিন সরষে ও লঙ্কা বাটা ব্যবহারের অনুমতি পায়, শুধুমাত্র নিজের খাবারের জন্য। ক্ষিতীশ কখনো যজ্ঞিবাড়ির নিমন্ত্রণে যায় না। ক্লাবের ছেলেমেয়েদের সে প্রায়ই শোনায় : ‘ডাক্তার রায় বলতেন, বিয়ে বাড়ির এক একটা নেমন্তন্ন খাওয়া মানে এক এক বছরের আয়ু কমে যাওয়া। বড় খাঁটি কথা বলে গেছেন।’
ক্ষিতীশ কথা না বলে খাওয়া শেষ করল।
ও যে রাগ করেছে লীলাবতী বুঝতে পেরেছে। বলল, “ক্লাব থেকে তাড়াবে কেন? কি দোষ করলে?”
ক্ষিতীশ পাল্টা প্রশ্ন করল, “তুমি এখন আবার দোকানে গেছলে কেন?”
গ্রে স্ট্রিটে ট্রামলাইন ঘেষে একফালি ঘরে দোকানটি। নাম ‘প্রজাপতি’। আগে নাম ছিল ‘সিনহা টেলারিং’। দুটি দর্জিতে জামা-প্যান্ট তৈরী করত, আর দেয়াল আলমারিতে ছিল কিছু সিন্থেটিক কাপড়। ক্ষিতীশ তখন দোকান চালাত। দিনে দু’ঘন্টাও দোকানে বসত না। দুপর বাদে তাকে সর্বদাই পাওয়া যেত জুপিটার সুইমিং ক্লাবে। তারপর একদিন সে আবিষ্কার করল আলমারির কাপড় অর্ধেকেরও বেশি অদৃশ্য হয়েছে, দোকানের ভাড়া চার মাস বাকি এবং লাভের বদলে লোকসান শুরু হয়েছে।
তখনই লীলাবতী হস্তক্ষেপ করে, দোকানের দায়িত্ব নেয়। টেলারিং ডিপ্লোমা পাওয়া দুটি মহিলাকে নিয়ে সে দোকানটিকে ঢেলে সাজায় নিজের গহনা বাঁধা দিয়ে। নাম দেয় ‘প্রজাপতি’। পুরুষদের পোশাক তৈরী বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র মেয়েদের এবং বাচ্চাদের পোশাক তৈরী করে। দোকানে পুরুষ কর্মচারী নেই এবং চার বছরের মধ্যেই প্রজাপতি ডানা মেলে দিয়েছে। আগে তিনদিনে ব্লাউজ তৈরী করে দেওয়া হত, এখন দশদিনের আগে সম্ভব হচ্ছে না। লীলাবতী তার গহনাগুলির অর্ধেকই ফিরিয়ে এনেছে।
“এখন তো আর জায়গায় কুলোয় না, তাই বড় ঘর খুঁজছি। হাতিবাগানের মোড়ে একটা খোঁজ পাওয়া গেছে। আমাদেরই এক খদ্দরের বাড়ি। বাড়ির গিন্নি এসেছিল মেয়ের ফ্রক করতে। তাই গেছলুম কথা বলতে।” লীলাবতী এঁটো থালাটা টেনে নিয়ে তাতে ভাত বেড়ে, ডাল মাখতে মাখতে বলল।
ক্ষিতীশের প্রবল আপত্তি ছিল তার খাওয়া থালায় লীলাবতীর ভাত খাওয়ায়। ‘আনহাইজীনিক। এইসব কুসংস্কারেই বাঙালী জাতটা গোল্লায় গেল।’ এই বলে ক্ষীতিশ তক শুরু করেছিল। কিন্তু লীলাবতী যখন অতিরিক্ত ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘এটা আমার ব্যাপার, মাথা ঘামিও না।’ তখন মুহূর্তে বুঝে যায় আর কথা বাড়ালে তাকেই গোল্লায় যেতে হবে। তবে ক্ষিতীশ তার প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। লীলাবতীর খাওয়ার সময় তাই কখনোই সে সামনে থাকে না।
শোবার ঘরের দেয়ালে ক্ষিতিশের বাবা-মা, ধ্যানমগ্ন মহাদেব, কুরুক্ষেত্রে অর্জনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ এবং ম্যাগাজিন থেকে কেটে বাঁধানো মেডেল গলায় ডন শোলাণ্ডার ও ভিকট্টি স্ট্যাম্পে দু’হাত তুলে দাঁড়ানো ডন ফ্রেজারের ছবি, পাশাপাশি টাঙানো। এ ছাড়া আছে–সাধারণত যা থাকে–খাট, আলমারি, বাক্স, আলনা এবং টুকিটাকি সাংসারিক জিনিস। পাশের ঘরে বই, ম্যাগাজিন, একটা তক্তপোশ এবং ভার নীচে ট্রেনিংয়ের জন্য রবারের দড়ি, স্প্রিং, লোহা ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঘরে ক্ষিতিশ দুপুরে এক ঘন্টা ঘুমোয়। পাখা নেই, বিছানা নেই। ওর মতে, চ্যামপিয়ন হতে গেলে শুধু শিষ্যকেই নয়, গুরুকেও কঠোর জীবন যাপন করতে হবে। অবশ্য তার কোন শিষ্য নেই।
তক্তপোশে শুয়ে চোখ বুজে ক্ষিতীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিষ্য কোথায়!
ঘুম আসার ঠিক আগের মুহূর্তে, ক্ষিতিশের আবছায়া চেতনায় ফুটে উঠল লম্বা দুটো হাত বৈঠার মত গঙ্গার জলে উঠছে আর পড়ছে।
মিলিয়ে গিয়ে নতুন আর একটি ছবি সে দেখল। ফণা তোলা কেউটের মত হিলহিলে কাদায় লেপা সরু একটা দেহ। লম্বা লম্বা হাত এলোপাথাড়ি ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। ফাইট কোনি, ফাইট।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে ক্ষিতীশ অকারণেই অস্ফুটে উচ্চারণ করল, “কো ও ও নি।”
সম্ভবত নামটা তার ভাল লেগেছে।
.
০৩.
টেবল টেনিস বেড়িটায় কাপড় বিছিয়ে টেবল। সেটা ঘিরে সাত জন বসে। তার মধ্যে একটি চেয়ার খালি। ওরা চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ঘরের বাইরে কয়েকটি ছেলে, কার যেন প্রতীক্ষ্ণয়।
জুপিটার সুইমিং ক্লাবের নতুন প্রেসিডেন্ট এবং এম এল এ বিনোদ ভড়, ডান দিকে ঝকে সম্পাদক ধীরেন ঘোমকে বলল, “একটাই অ্যাজেন্ডা, না আরো আছে?”
ধীরেন ঘোষ তার সরু গলাটি যথাসম্ভব লম্বা করে চশমার নীচের অংশের প্লাস পাওয়ারের মধ্য দিয়ে টেবলে রাখা কাগজের দিকে তাকাল।
“মেন আইটেম একটাই, আর যা আছে তা খুবই মাইনর।”
“কোরাম হয়েছে তো?”
“হ্যাঁ, সবাই হাজির।” ধীরেন ঘোষ এরপর ব্যস্ত হয়ে বলল, “জগু, চা-সন্দেশ দিতে বল।”
যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র, তখনই দরজাটা খুলে গেল। ক্ষিতীশ সিংহ ঘরের প্রতিটি লোকের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে, প্রেসিডেন্টের মুখোমখি খালি চেয়ারটায় বসার আগে সভাকে নমস্কার জানাল।
জগু জিজ্ঞাসু চোখে ধীরেন ঘোষের দিকে তাকাল, মাথা হেলিয়ে ধীরেন ঘোষ বলল, “একটু পরে আনবি।”
“আমার দেরী হয়ে গেল।” ক্ষিতীশ ফিকে হেসে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল।
“না না, মিনিট চারেক মাত্র দেরী হয়েছে।” বিনোদ ভড় ঘড়ি দেখে ধীরেন ঘোষকে বলল, “আমার কিন্তু একটু তাড়া আছে।”
“নিশ্চয় নিশ্চয়, এখুনি শুরু করছি। বেশিক্ষণ লাগার মত কিছুই নেই, শুধু সুইমারদের চিঠিটা ছাড়া। আর সেটা আগেই সারকুলেট করা হয়েছে, সুতরাং নতুন করে বলার কিছু নেই।”
“হ্যাঁ আছে।”
সবাই ক্ষিতীশের দিকে তাকাল।
“আমার বিরদ্ধে চার্জগুলো স্পষ্ট করে চিঠিতে বলা নেই। সেগুলো জানতে চাই।”
সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।
বিনোদ ভড় বলল, “ধীরেনবাব, ওর বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তাহলে বলন।”
ধীরেন ঘোষ বিব্রতভাবে হরিচরণ মিত্তিরের দিকে তাকাল, হরিচরণ নড়ে চড়ে বসল।
“ক্ষিদ্দা সম্পর্কে অভিযোগ ছেলেদের, মানে সুইমারদের। যারা সাত বছর, আট বছর আমাদের ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নামছে, মেডেল আনছে। মানে, আমাদের মুখোজ্জ্বল করছে।”
“বাজে কথা।” ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল, “মেডেল হয়তো আনে কিন্তু মুখোজ্জ্বল করার মত কিছুই করেনি। শ্যামল চার বছর আগে এক মিনিট চার সেকেণ্ডে হানড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল টানতো, এখনো তাই টানে। এটা কি মুখোজ্জ্বল করার মত ব্যাপার?”
হরিচরণ কথাগুলো না শোনার ভান করে বলতে লাগল, “এইসব সুইমাররাই হচ্ছে ক্লাবের প্রাণ। এদের নিয়েই ক্লাব টিকে আছে, এগিয়ে চলেছে। এরা উচ্ছল, এরা চঞ্চল। এদের হান্ডেল করতে হলে এদের মত হয়ে এদের সঙ্গে মিশতে হবে, বুঝতে হবে, আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হবে।”
“তার মানে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারবে, পড়াশুনো করবে না, ট্রেনিং করবে না–একে উচ্ছলতা বলে মানতে হবে! এদের সঙ্গে তাল রেখে আমাকে আধুনিক হতে হবে, তবেই এদের হান্ডেল করা যাবে।”
“কিন্তু ওদের মন-মেজাজ বোঝার ক্ষমতা, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ক্ষিদ্দার নেই।”
হরিচরণ সকলের মুখের দিকে তাকাল। তিন-চারটি মাথা নড়ে উঠল এক সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে। ক্ষিতীশের চোখ পিটপিট করতে লাগল, পুরু লেন্সের ওধারে।
“ক্ষিদ্দা জনিয়ার ছেলেদের সামনেই শ্যামলকে তার টাইম আর আমেরিকার ১২ বছরের মেয়েদের টাইমের তুলনা করে অপমান করেছেন : গোবিন্দ এখনো ব্রেস্ট স্ট্রোকে বেঙ্গল রেকর্ড হোল্ড করছে, লাস্ট ইয়ারেও বোমবাই ন্যাশনালে গেছল, তাকে বলেছেন কান ধরে ক্লাব থেকে বার করে দেবে। সুহাস ইনফ্লুয়েঞ্জায় পড়ে দিন দশেক আসতে পারেনি। তার বাড়িতে গিয়ে ক্ষিদ্দা সুহাসের বাবাকে যা তা কথা বলে এসেছেন। অমিয়া আর বেলা জুপিটার ছেড়ে অ্যাপোলোয় গেছে শুধুই ক্ষিদ্দার জন্য। উনি ওদের চুল কাটতে চেয়েছিলেন। পুরুষদের মত। ওদেরও বারবেল নিয়ে একসারসাইজ করার জন্য ঝগড়া করতেন। ওদের ড্রেস, ওদের সাজ নিয়ে রোজই খিটখিট করতেন। লাস্ট ইয়ারে আপনারা দেখেছেন, ওই দুটি মেয়ের জন্যই স্টেট মিটে অ্যাপোলো টিম চ্যামপিয়নশিপ পায়।”
হরিচরণ থামল। ক্ষিতীশের দিকে এতক্ষণ সে তাকায়নি। দেখল মুচকি মুচকি হাসছে। তাইতে সে অস্বস্তি বোধ করে ধীরেন ঘোষ, প্রকল্পে বসাক এবং বদু চাটুজ্জের মুখের দিকে তাকাল।
নস্যির কৌটো বার করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে বদু চাটুজ্জে সিধে হয়ে বসল।
“প্রেসিডেন্ট স্যার, আমার একটা কথা বলার আছে। ট্রেনার যে হবে তার উপর ছেলেদের বা মেয়েদের শ্রদ্ধা থাকা চাই, আস্থা থাকা চাই। সে যেটা বলবে ওরা যেন নিশ্চিতে চোখ বুজে সেটা করতে পারে। কিন্তু ক্ষিতীশ ওদের মা বলে সেটা ওরা বিশ্বাসভরে নিতে পারে কি?”
বদু চাটুজ্জে নাটকীয়তা সষ্টির জন্য কথা থামিয়ে রুমাল বার করল। নাক মুছল গভীর মনোযোগে। রমাল পকেটে রাখল।
‘ক্ষিতীশ নিজে কখনো সাঁতার কাটেনি। কমপিটিশনে কখনো নেমেছে বলে জানি না। ওর কথা ছেলেমেয়েরা কেন গ্রাহ্য করবে?”
“সে কি!” প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় অবাক হয়ে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। “আপনি সাঁতার জানেন না?”
ক্ষিতীশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “সাঁতার জানি না বলতে বদু নিশ্চয় মিন করছে, আমি কখনো কোন কমপিটিশনে মেডেল পাইনি। তাই না?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তাই-ই বলছি।” ব্যস্ত হয়ে বদু বলল। “কোচের রেপ্যুটেশন থাকা দরকার। নয়তো ছেলেমেয়েরা মানবে কেন? হরিচরণকে ওরা মানে কেন? ইণ্ডিয়া চ্যামপিয়ন ছিল, অলিমপিকেও গেছে। গঙ্গায় ১৩ মাইলের কমপিটিশন পর পর তিনবার জিতেছে।”
“আপনি ওলিমপিকে গেছলেন!” বিনোদ ভড়ের বিস্মিত ভ্রূ কপাল বেয়ে চুলে গিয়ে ঠেকল।
কিঞ্চিৎ গদগদ স্বরে হরিচরণ বলল, “লন্ডনে ফরটি এইট গুলিপিকে আমি দেড় হাজার মিটারে ইণ্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করেছি। ওয়াটারপোলো টিমেও ছিলুম।”
“কি রেজাল্ট করেছিলেন?” প্রেসিডেন্ট ঝুঁকে পড়ল টেবলে।
হরিচরণ দ্রুত সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, “পয়েন্ট ফাইভ সেকেন্ডের জন্য ব্রোন্জটা মিস করেছি।”
হঠাৎ বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল ক্ষিতীশ। সবাই তার দিকে তাকাল।
কাশি থামিয়ে ক্ষিতীশ বলল, “আই অ্যাম সরি। মাঝে মাঝে আমার এরকম হয়।”
প্রেসিডেন্ট বিরক্ত চোখ দুটো সরিয়ে নিয়ে আবার রাখল হরিচরণের মুখে।
“গোল্ড পেয়েছিল আমেরিকার ম্যাকলেন। জল থেকে উঠে আমায় বলেছিল, তুমি পাশে ছিলে তাই এত ভাল চার্জ পেয়েছি।”
“বটে বটে, তা আপনি কি বললেন?”
“আমি আর কি বলব, ওকে কনগ্রাচুলেট করে বললাম, ইণ্ডিয়াতে যে টাইম করে এসেছি সেটা যদি আজ করতে পারতুম তাহলে……”
হরিচরণ থেমে গেল।
খুক খুক, একটা শব্দ হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বিরক্ত হয়ে বলল, “অবার আপনি কাশছেন? নিশ্চয় আপনার কাশির অসুখ আছে।”
ক্ষিতীশ মুখ নিচ করে ফিসফিসিয়ে বলল, “হরি, গোল্ড না সিলভার, তাহলে কোনটে হতো?”
হরিচরণ উত্তেজিত ধরে বলল, “মেডেলের কথা তো আমি বলিনি, তুমি হঠাৎ গায়ে পড়ে টিপ্পুনি কাটছ কেন?”
“জেলাসি।”
নস্যির কৌটোয় চাঁটা দিয়ে বদু মন্তব্য করল।
“ক্ষিতীশ বড় ফালতু কথা বলে।” কার্তিক সাহা এতক্ষণে মুখ খুলল। “বারবার দেখেছি, কখনই ও হরিকে সহ্য করতে পারে না।
“জেলাসিই হোক ফেলাসিই হোক, আমাকে পাঁচজনের সামনে বিদ্রূপ করে তুমি কি আনন্দ পাও ক্ষিদ্দা বলো তো?”
ক্ষিতীশ চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে টেবলে রাখল। কঠিন স্বরে বলল, “আমার বিরুদ্ধে আর কি অভিযোগ আছে ধীরেন?”
ধীরেন ঘোষ তাড়াতাড়ি ঝকে কয়েকটা কাগজ উল্টেপাল্টে বলল, “এই সবই আর কি। অভিযোগ এনেছে সুইমাররা। ওরা বাইরেই আছে। প্রেসিডেন্ট যদি বলেন তো ওরা নিজেরাই এখানে এসে বলতে পারে।”
“না, তার দরকার নেই।” ক্ষিতীশ চশমাটা চোখে পরল, “অভিযোগগলি সত্যি।”
টেবলের মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কেউ মাথা নাড়ল, কেউ নড়েচড়ে বসল। ওদের ভাবভঙ্গিতে এই কথাটাই ফুটে উঠল–এইবার, তাহলে বাছাধন এইবার কি বলবে?
“আমি জানি ওরা কি বলবে। বলবে, আমি জলে নামি না, খাটতে বলি, না খাটলে গালাগালি করি। আপনারা বলবেন, আমি রেজাল্ট দেখাতে পারিনি তিন চার বছর, আমার ব্যবহারে সুইমাররা বিদ্রোহ করেছে।”
“এমনকি মারবেও বলেছে।” যজ্ঞেশ্বর ভট্ট চাষ কথাটা বলেই. ধীরেন ও হরি চরণের একটি দেখে থতমত হয়ে, “কি কাণ্ড, এখনো চা দিয়ে গেল না।” বলতে বলতে উঠে বেরিয়ে গেল।
“অভিযোগের জবাব নিশ্চয় আমাকে দিতে হবে।”
প্রেসিডেন্ট গম্ভীর হয়ে বলল, “সেটা আপনার ইচ্ছে। কিছু বলার থাকলে নিশ্চয় আমরা শুনব।”
সারা ঘর উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। চশমাটা আবার টেবলে রেখে ক্ষিতীশ চোখ বোঁজে।
“এই ক্লাবে আমি প্রথম আসি পঁয়ত্রিশ বছর আগে। ধীরেনও তখন আসে। বছর পাঁচেক পর হরিচরণ। ওদের মত জুপিটারকে আমিও ভালবাসি। আমিও চাই জুপিটারের গৌরব, চাই ভারতের সেবা হয়ে উঠকে জুপিটার। এই গৌরব এনে দেয় সাঁতারুরা, ওয়াটারপোলো লেয়াররা, ডাইভাররা। ওদের পারফরমেন্স যত উঠবে, গৌরবও তত বাড়বে। আমার যা কিছু চেষ্টা, তা ওদের উন্নতির জন্যই। এজন্য আমি কঠোর হয়েছি, গালিগালাজও দিয়েছি।”
ক্ষিতীশের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে ঘরটা গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল।
“সাঁতারে অবিশ্বাস্য রকমে পৃথিবী এগিয়ে গেছে। আর আমরা আমাদের এক একটা রেকর্ডের বয়স দশ বছর পনেরো বছর। পঁচিশ বছর হতে চললো শচীন নাগের রেকর্ডের বয়স! কেন এই থমকে থাকা? যেভাবে পৃথিবী এগোচ্ছে, আমাদেরও সেইভাবে এগোতে হবে।”
“এসব এমন কিছু কথা নয়। আমাদেরও জানা আছে। শুনতে ভালই লাগে।” হরিচরণ ভারিক্কি চালে বলল এবং প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। “আসল যে জিনিস ফুড, সেটা কই? খাটবে যে খাদ্য কই? তা যখন পাওয়া যাবে না তখন খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে টি বি রোগ ধরিয়ে দিয়ে লাভ কিছু হবে?”
“ঠিক কথা। ফুড কই?”
যজ্ঞেশ্বর টেবল চাপড়ে বলে উঠল।
প্রেসিডেন্ট এবং ধীরেন ঘোষ মাথা নাড়ল। বদু কৌটো থেকে বড় এক টিপ নসি বার করল।
বাজে কথা।
ক্ষিতীশ চাপা এবং দৃঢ়স্বরে বলল।
“আজ পর্যন্ত কেউ টি বি রগী হয়েছে সাঁতার কেটে, এমন কথা শুনিনি। আসলে এটা অলস ফাঁকিবাজদের, যাদের উচ্চকাঙ্ক্ষা নেই তাদের অজুহাত। যতটকু খাদ্য আমরা জোটাতে পারি, সেই অনুপাতে আমরা ট্রেনিং করি না। শ্যামল, গোবিন্দ বিদ্যেবুদ্ধির জন্য নয়, সাঁতারের জন্যই চাকরি পেয়েছে। কিন্তু সাঁতারকে তারা এর বিনিময়ে কি দিচ্ছে? এরা অকৃতজ্ঞ। এরা গুছিয়ে রোজ পাঁচ টাকাও যদি খাওয়ার জন্য খরচ করে, ডিসিপ্লিনড লাইফ লীড করে, নিয়মিত কঠিন ট্রেনিং করে, তাহলে দু’বছরেই এরা এক মিনিটে একশো মিটার ফ্রি স্টাইল কাটবে, এক পাঁচে ব্যাক স্ট্রোক কাটবে।”
“তাহলে এদের ট্রেনিং করাতে পারেননি কেন?” ধীরেন বলল।
“ছেলে ফেল করলে দোষটা মাস্টার মশায়েরও।” কার্তিক কনুই দিয়ে বদুকে খোঁচা দিল।
“নিশ্চয়, শুধু ওদের অকিতজ্ঞ বলে নিজের দোষ খালন করলে কি চলে!”
“না, আমি দোষ স্খালন করতে চাই না। বরং আমি বলতে চাই, এদের দিয়ে আর কিছু হবে না। এদের বয়েস হয়ে গেছে, এদের মনে পচ ধরেছে। এদের পিছনে পরিশ্রম করে লাভ নেই।”
‘আমি বিশ্বাস করি না।” হরিচরণের তীব্র ধরে ক্ষিতীশও বিস্মিত হল।
“কি বিশ্বাস করিস না?”
“এদের দিয়ে এখনো টাইম কমানো যায়। আমি করাতে পারি। আমি পারি এদের খাটাতে। পচ-টচ ধরেছে এসব বাজে কথা।”
ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ হরিচরণের মখের দিকে তাকিয়ে রইল।
“তাহলে তুই দায়িত্ব নে। আমি আজ থেকে চিফ ট্রেনারের পদ ছেড়ে দিলাম। রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেব। আমি কাল থেকে আর আসব না।”
“না না, আসবে না এটা কি কথা!” বদু ব্যস্ত হয়ে উঠল। “এতদিনকার মেম্বার!”
ক্ষিতীশ হাসল ম্লানভাবে, তারপরই চোখ দুটো পিট পিট করে উঠল। প্রেসিডেন্টকে লক্ষ করে বলল, “ট্রেনার হতে গেলে নামকরা সাঁতারু হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। পৃথিবীর নামকরা কোচেরা-ট্যালবট, কারলাইল, গ্যালাঘার, হেইন্স, কাউন্সিলম্যান এরা কেউ ওলিম্পিক চ্যামপিয়ন নয়। জলে নেমে এদের কোচ করতে হয় না। এরা সুইমারদের কোচ, নভিসদের নয়। জলের উপর থেকেই অনেক ভাল লক্ষ করা যায়, তাই ডাঙ্গতেই আমি থাকি।”
“ক্ষিদ্দা, তুমি দেখছি এইসব কোচেদের সঙ্গে নিজেকে এক পংক্তিতে ফেললে।” যজ্ঞের কৃত্রিম বিস্ময় চোখে ফোঁটাল।
“ওরা ওয়ার্ল্ড চ্যামপিয়ন, অলিম্পিক চ্যামপিয়ন তৈরী করছে, তুমি তো একটা বেঙ্গল চ্যামপিয়নও তৈরী করতে পারনি!” কার্তিক সাহার গলায় বিদ্রূপ মোচড় দিল।
“পারবে পারবে, নিশ্চয় পারবে। ওয়ার্ল্ড রেকড় আমরা শিগিরিই পাব, তাই না ক্ষিতীশ?” ধীরেন ঘোষ মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
“চ্যামপিয়ন সুইমার তৈরী করা এদেশে সম্ভব নয়। প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় এতক্ষণে কথা বলল।
ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল।
“কোন দেশেই সম্ভব নয়। চ্যামপিয়নরা জন্মায়, ওদের তৈরী করা যায় না। ওদের খোঁজে থাকতে হয়, লক্ষণ মিলিয়ে চিনে নিতে হয়। ক্লান্তঘরে কথাগুলো বলে ক্ষিতীশ দরজার দিকে এগোল।
“সেই ভাল, এবার থেকে তপস্যা শুরু করো ক্ষিদ্দা।”
“ক্ষিতীশ, চা-টা খেয়ে যাও।”
“ক্ষিতীশবাব, ক্লাবে আপনার কিন্তু রেগুলার আসা চাই।”
ঘর থেকে বেরিয়েই ক্ষিতীশ দেখল শ্যামল, গোবিন্দ এবং আরো চার পাঁচটি ছেলে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল সে। ওরা হঠাৎ কাঠের মতো হয়ে গেল।
“তোদের অনেক বকেছি-ঝকেছি, কট, কথাও বলেছি। আর এসব শুনতে হবে না। আজ থেকে আমি আর এ ক্লাবের ট্রেনার নই। সাঁতারটা মন দিয়ে করিস।”
ক্ষিতীশ মাথা নামিয়ে ধীর পায়ে ক্লাবের বাইরে এসে দাঁড়াল।
কমলদিঘির কালো জলের উপর পকের আলোগুলো খড়ির মত দাগ টেনেছে। জুপিটার ক্লাববাড়ির চড়োর ঘড়িতে আটটা বাজতে পাঁচ। দিঘিটা আকারে গোল। তাকে ঘিরে ইট বাঁধানো রাস্তা। নারী পুরুষ শিশর ভীড়ে রাস্তাটা গিজগিজ করছে। আলোগুলোর নীচে তাস খেলা চলছে, অকসন ব্রিজ বা টোয়েন্টিনাইন। মাঝে মাঝে দমকা চীৎকার উঠছে তাসের আড্ডা থেকে! বেঞ্চগুলোয় বসার স্থান নেই। ফলগাছের ঝোঁপগলো লোহার বেড়ায় ঘেরা। বেড়ায় ঠেস দিয়ে যুবকরা গল্প করছে। ঘুগনি, আলকাবলি, বাদাম, ঝালমুড়ি বা কুলফি মালাইওয়ালার ব্যবসায়ে ব্যস্ত।
দুটি হাত রেলিংয়ে রেখে ক্ষিতীশ দিঘির অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে। জুপিটারের ঠিক উল্টোদিকেই অ্যাপোলোর ক্লাববাড়ি। ডাইভিং বোর্ডের কংক্রিট কাঠামোর থামগুলো অন্ধকারে ব্রহ্মদতির পায়ের মত জল থেকে উঠেছে।
“ক্ষিদ্দা।”
চমকে পেছনে তাকাল ক্ষিতীশ।
“ভেলো!”
“কি হল ক্ষিদ্দা?”
“কি আবার হবে, ছেড়ে দিলুম।”
“ভালই করেছ। ঝগড়াঝাটি, গোলমাল হয়নি তো?“
“না।”
ক্ষিতীশ মুখটা আবার জলের দিকে ঘোরাল। হাওয়া বয়ে আসছে জলের উপর দিয়ে। বাতাসে জলের কণা, আর শ্যাওলা আর ঝাঁঝির আঁশটে গন্ধ। পঁয়ত্রিশ বছর এই শুঁকে আসছে ক্ষিতীশ। তার কাছে এর থেকে বাস পৃথিবীতে নেই।
ভেলো পাশে এসে দাঁড়াল।
“ভেলো, কি করি এখন বল তো রে। একেবারেই বেকার হয়ে গেলুম।”
“এবার প্রজাপতিকে বরং দেখাশুনো করো। বৌদি একা মেয়েমানুষ, অন্যরাও মেয়ে, পুরুষমানুষ একজন থাকা দরকার। কখন কি মুশকিলে ওরা পড়ে যাবে তার ঠিক কি!”
“তোর বৌদি মানুষটি ছোট্টখাট্ট, কিন্তু আমার থেকে দশগুণ লম্বা কাজের বেলায়। প্রজাপতিতে দারোয়ানি ছাড়া আমায় দিয়ে আর কোন কাজ হবে না।”
“তাহলে?”
ক্ষিতীশ আবার জলের দিকে তাকিয়ে রইল।
“ক্ষিদ্দা, যদি রাগ না করে তো একটা কথা বলি।”
ক্ষিতীশ মুখ ফেরাল।
“তুমি অ্যাপোলোয় চলো।”
“না, ওরা জুপিটারের শত্রু। কতকগুলো স্বার্থপর লোভী মূর্খ আমায় দল পাকিয়ে তাড়িয়েছে বলে শত্রুর ঘরে গিয়ে উঠব?”
“কিন্তু ওখানে তুমি জল পাবে, শেখাবার ছেলেমেয়ে পাবে, কাজ চাইছ কাজ পাবে। অপমানের শোধ তোমায় নিতে হবে। শ-মিত্র বাছবিচার করে কি লাভ?”
ক্ষিতীশ বিব্রতমখে চুপ করে রইল। তার মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সেটা তাকে এই মুহূর্তে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে দিচ্ছে না। জুপিটারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক, কিন্তু সাঁতারু তৈরী করা তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, ব্রত। লক্ষ্যপূরণ করতে হলে নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে বেরোতেই হবে। কিন্তু তা কি সে পারবে? ক্ষিতীশ মাথাটা ঝাঁকালো।
“তাহলে হেদো কিংবা গোলদিঘির কোন ক্লাবে চলো।”
“কোথাও গিয়ে আমি টিকতে পারবো না রে।” ক্ষিতীশ হাঁটতে শুরু করল একটু জোরেই।
“চুপচাপ বসে থাকবে?” ভেলো হ্যাঁচকা দিয়ে প্যান্ট টেনে তুলে ক্ষিতীশের পাশাপাশি থাকার জন্য প্রায় ছুটতে শুরু করল।
“আমি এবার সত্যিকারের কাজ করতে চাই। সবাইকে দেখিয়ে দেব একবার। চ্যামপিয়ন তৈরী করব আমি। গড়ব আমি মনের মতো করে। একবার, শুধু একবার যদি তেমন কারুর দেখা পাই।”
মাথা নিচু করে ক্ষিতীশ হনহনিয়ে কমলদিঘির গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে গেল। ভোলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গেটের পাশে দাঁড়ানো আল কাবলিওলাকে বলল, “জাস্তি ঝাল দিয়ে চার আনার বানাও।”
.
০৪.
সকাল আটটা প্রায়।
ক্ষিতীশ বাজার করে ফিরছে। জুপিটারে আর সে যায় না। সকাল-বিকাল এখন তার কোন কাজ নেই। অবশ্য বাজার করাটা তার নিত্যদিনের কাজগলির অন্যতম। সে বাজারে যায় বাড়ির কাছের বস্তির সরু গলি দিয়ে, ফেরে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে চিনড্রেনস পার্কটাকে ঘরে অন্য পথ ধরে।
আজ ফেরার পথে দেখল পার্কে খুব ভীড়। বিশ্রাম চালাটায় টেবল চেয়ার পাতা। লাউডস্পীকারে হিন্দি ফিল্মের গান বাজছে। হঠাৎ বন্ধ করে ঘোষণা হল–”নেতাজী বালক সঙ্ঘের উদ্যোগে কুড়ি ঘন্টা অবিরাম ভ্রমণ প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কাল রাত আটটায়। শেষ হবে আজ বিকেল চারটায়।”
লাউডস্পীকারে অন্য একটা চাপা গলা শোনা গেল : “এই শালা, চারিটায় কি রে, বল, চারি ঘটিকায়। অ্যালাউনস করতে হলে শুদ্ধু করে বলতে হয়।”
“য লেখা আছে তাই তো পড়ছি।”
“দে দে, আমাকে মাইক দে।”
এরপর অন্য এক কণ্ঠে শোনা গেল; “প্রতিযোগিতা শুরু হইয়াছে কল্য রাত্রি আট ঘটিকায়, উদ্বোধন করেন অতীতদিনের খতকীতি ফুটবল খেলোয়াড় শ্রীকৃষ্ণ প্রসাদ মাইতি। পতিযোগিতা সমাপ্ত হইবে অদ্য বৈকাল চারি ঘটিকায়। পুরস্কার বিতরণ করিবেন সন্ধেয় জননেতা ও আমাদের সঙ্ঘের প্রধান পিষ্টপোষক শ্রীবিষ্টুচরণ ধর মহাশয়। পতিযোগিতায় নেমেছিল বাইশজন পতিযোগী, আটজন অবসর নিয়েছে ইতিমধ্যে।
ক্ষিতীশের চোখ হঠাৎ আটকে গেছে কঞ্চির মত লম্বা, নিকষকালো একটি চেহারাতে।
গোলাকৃতি পার্কটিকে ঘিরে রেলিং। তার থেকে ছয় হাত ভিতরে সিমেন্টের পথটা বেড় দিয়েছে মধ্যস্থলের ঘাসের জমিকে। প্রতিযোগীরা পথ ধরে হাঁটছে ক্লান্ত, মন্থরগতিতে। অধিকাংশেরই বয়স ১৬-১৭। বৈশাখের ভয়কর রোদ মাথায় নিয়ে তপ্ত সিমেন্টের ওপর ওদের সারা দপর হাঁটতে হবে।
পরনে ঢিলে ফল পান্ট, ঢলঢলে বশ শার্ট, পায়ে হাওয়াই চটি। চলটা ছেলেদের মত হলেও, ঘাড়ের কিনারে পৌঁছে গেছে। রাস্তার মাঝ থেকে ক্ষিতীশ রেলিংয়ের ধারে সরে এল।
ক্ষিতীশের চোখ অনুসরণ করতে লাগল শুধু একজনকেই। পার্কের মধ্যে শিশু ও বালকদেরই ভীড়। বয়স্করা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে শুধুমাত্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রতিযোগীদের চোখে রাত্রি জাগরণ, ক্লান্তি আর ক্ষুধার ছাপ। পার্কের চক্কর প্রায় ৭৫ মিটারের। ওদের কেউ কেউ চেনা লোকেদের দেখে শুকনো হাসছে, দু-চারটে কথা বলছে। গঙ্গায় সাঁতারের সঙ্গী সেই তিনটি ছেলে পার্কের মধ্যে ঘাসের উপর দিয়ে কোনির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওর সঙ্গে কথা বলল। কোনি হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বলছে। চটিজোড়া খুনে পথের পাশে রাখল। উদ্যোক্তদের দেওয়া লজেঞ্জস পকেট থেকে বার করে ওদের নিনকে দিয়ে, একটা মখে পরল। হাঁটতে হাঁটতে সে মুখের কাছে হাত তুলে জলপানের ইশারা করতেই নেতাজী বালক সঙ্ঘের একজন ছুটে গিয়ে তাকে এব গ্লাস জল দিয়ে এল। তিন-চার চক্করের পর আবার সে চটি পরল।
ক্ষিতীশের হুঁশ ফিরল যখন তার প্রতিবেশী অমলবাবু, অফিস যাবার পদে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “কি দেখছেন ক্ষিতীশবাব, বাঙালীদের ক্রীড়াচর্চা?”
লোকটিকে ক্ষিতীশ একদমই পছন্দ করে না, শুধুই নাটকীয় ঢঙে বাঁকা বাঁক কথা বলে।
“কি আর করবে বলুন, আমরা ওদের ক্রীড়াচর্চার জন্যে কিছু বাবস্থা তো করে দিইনি। ওরা ওদের মতোই যা হোক ব্যবস্থা করে নিয়েছে।”
কথায় কথা বাড়ে। তাই ক্ষিতীশ আর না দাঁড়িয়ে বাড়িমুখো হল।
সদর দরজা তালাবন্ধ। লীলাবতী বেরিয়েছে। অবশ্য দ্বিতীয় চাবি ক্ষিতীশের কাছে আছে। ঘড়ি দেখে সে জিভ কাটল। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট দেরী হয়েছে, অর্থাৎ লীলাবতী এতই রেগেছে যে রান্না না চাপিয়েই বেরিয়ে গেছে।
ক্ষিতীশ রান্নার উদ্যোগ শুরু করল। আনাজ কুটতে বসে বারবার তার ইচ্ছে করল পার্কে গিয়ে কোনিকে দেখতে। এই দ্বিতীয়বার সে ওকে দেখলে।
অবিরাম হাঁটা ব্যাপারটা সে একদমই পছন্দ করে না। এতে বুদ্ধির দরকার হয় না আর বলদের মত শুধু পার খাওয়া। স্পীড দরকার হয় না, পেশীর জোর লাগে না, পাল্লা দিতে হয় না আর একটা মানুষের সঙ্গে। একে স্পোর্ট বলতে ক্ষিতীশের ভীষণ আপত্তি।
একবার সে গোলদিঘিতে চীৎকার করে তার আপত্তিটা জানিয়েছিল ১০ ঘণ্টা সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড লাভে প্রয়াসী এক সাঁতারুকে। “ওরে বুদ্ধু, এখনে যে একটা ওলিমপিক মেডেল সাঁতার কেটে আমরা পাইনি আর এসব বুজরুকি দেখিয়ে রেকর্ড করে কি তুই দেশের মান বাড়বি?”
ক্ষিতীশকে জনাচারেক চেনা লোক টেনে সরিয়ে না দিলে হয়তো সে তখনি জলে ঝাঁপিয়ে সম্ভাব্য বিশ্ব রেকর্ডটিকে তছনছ করে দিত। তবে সে এইটকু মাত্র মানে, এইসব অবিরাম ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়ে কার কেমন সহ্যশীলতা কেমন একগয়েমি সেটা বোঝা যায়। কিন্তু কি লাভ তাতে হয় যদি না সশঙখল ট্রেনিং আর টেকনিকের মারফত সেগুলো বড় কাজে লাগানো হয়।
অপচয়। ক্ষিতীশ এই সব অপচয় দেখে বিরক্ত বোধ করে। খুব বিরক্ত বোধ করে। কিন্তু এখন সে ছটফট করছে পার্কে যাবার জন্য। উঠে গিয়ে ঘড়ি দেখল। হিসেব কষে বার করল কোনি প্রায় চোদ্দ ঘন্টা হাঁটছে। এখনো ছ’ঘন্টা বাকি। ভয়ংকর এই শেষের ছ’ ঘন্টা। টিকতে পারবে কি?
.
কুকার রান্না চাপিয়ে ক্ষিতীশ দরজায় তাল এঁটে আবার বেরিয়ে পড়ল।
পার্কে দর্শকদের সংখ্যা ক্ষীণ। গাছের ছায়ায় কিছু আর বিশ্রাম-চলায় উদ্যোক্তারা। কোনি হাঁটছে, মাথায় ছেঁড়া বেতের টপি। ক্ষিতীশ গুনে দেখল ওরা তোরোজন। একজন বসে গেছে। পার্কে ঢুকে সে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়াল। কোনি যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কোনির গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে চিবুকে, চোখ দুটি বসে গেছে, গালের উঁচু হাড় দুটো আরো উঁচু ঠোঁটের চামড়া শুকনো। কিন্তু মাথাটা তুলে যেভাবে পাতলা দেহটাকে সে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাইতে ক্ষিতীশের মনে হল, আকাশ থেকে আগুন ঝরলেও কোনির চলা থামবে না।
কেন মনে হল, ক্ষিতীশ তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না। শুধু এইটুকুই সে বলবে, একটা লোক নিজের সম্পর্কে কি ভাবে, সেটা বোঝা যায় চলার সময় মাথাটা সে কেমনভাবে রাখে তাই দেখে।
ক্ষিতীশ বাড়ি ফিরল বারোটায়। লীলাবতী কথা বলছিল দোকানের দুটি মেয়ের সঙ্গে। ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “হাতিবাগানের ঘর কি হল?”
“অনেক টাকা সেলামি চায়। সম্ভব নয়।”
সে ঘরে ঢুকে গেল। অন্যমনস্কের মত স্নান ও খাওয়া সেরে সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল। তিনটে বাজার সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে পড়ল।
তেরো থেকে আট, বসে গেছে পাঁচজন। পার্কে এখন বেশ ভীড়। লাউডস্পীকার রেকর্ড বাজানো বন্ধ করে নানাবিধ ঘোষণায় মত্ত। এরই মাঝে প্রতিযোগীদের জানিয়ে দেওয়া হল, আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিট বাকি।
কোনি হাঁটচ্ছে। ক্ষিতীশ জানতো ও হাঁটবে এবং শেষ করবে। ক্লান্তি ওর পদক্ষেপে ধরা পড়ছে। সকালের সেই তিনটি ছেলে ওর পাশাপাশি ঘাসের উপর দিয়ে চলছে। কোনি দু’একবার ওদের কথা শুনে হাসল। ক্ষিতীশ লক্ষ করল ডান পা-টা টেনে টেনে হাঁটছে। অন্য প্রতিযোগীদের মধ্যে দুটি বছর দশেকের ছেলে, বেশ তাজাই দেখাচ্ছে।
“আমাদের আজকের সভাপতি বরেণ্য জননেতা ও এই সঙ্ঘের হিতষ্যি শ্রীযুৎ বিষ্টুচরণ ধর মহাশয় তার শত কাজ ফেলে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। এজন্য আমরা গর্বিত।
ক্ষিতীশ লাউডস্পীকার থেকে কান সরিয়ে চোখ পাঠাল চালার নীচে। সেখানে টেবলের উপরে ইতিমধ্যে একটি সাদা চাদরের ও তোড়াভরা দুটি ফুলদানির আবির্ভাব ঘটেছে। তার পিছনে বসে আজকের সভাপতি।
তারে, এ তো গঙ্গার ঘাটে দেখা সেই হিপোটা! ক্ষিতীশ অবাক হয়ে গেল।
“আর কুড়ি মিনিট বাকি প্রতিযোগিতা শেষ হতে। তারপরই পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান।”
লাউডস্পীকারে ফিসফাস আলোচনা শোনা গেল। “বলতে ভুল হয়ে গেছে, পুরস্কার বিতরণের আগে সভাপতি মহাশয় তার ভাষণ দেবেন।”
আটজনেই শেষ করল প্রতিযোগিতা। পার্কে হাজির প্রায় একশো শিশু বালক ও বয়স্ক ভীড় করে দাঁড়াল চালার সামনে। ক্ষিতীশও এগিয়ে গেল।
তার চোখ খুঁজতে খুঁজতে কোনিকে পেল। সিমেন্টের সিঁড়ির ধাপে বসে পা ছড়িয়ে দু’হাতে টিপছে ডান উর।
“ওরে বাব্বা, আর আমি হাঁটার রেসে নামছি না। দুর দুর, ফাস সেকেন থাড নেই।”
“তোকে তত পই পই বলেছিলুম, নাম দিস না। আমি আর ভাদু একবার নেমেই টের পেয়ে গেছলম, বোগাস ব্যাপার।”
“কান্তি যে বলেছিল, লোকেরা এসে পিন দিয়ে টাকা আটকে দেয় জামায়, কই দিল না তো??
“এসব ছোটখাটো কম্পিটিশনে দেয় না।”
“তোকে বলেছে! কোনি যদি ফ্রক পরে নামতো দেখতিস, অন্তত বিশ-পঁচিশ পেয়ে যেত। প্যান্ট শার্ট পরলে তো ওকে ছেলে দেখায়।”
“ঘোড়ার ডিম দিত, এখানকার লোকেরাই কঞ্জুস।”
“না রে, ঠিকই বলেছে ভাটা, আমাকে প্যান্ট পরলে ছেলেদের মতই তো দেখায়। এই দ্যাখ তো চণ্ডু, প্রাইজ-ফ্লাইজ কি দেবে, পরে একদিন বাড়ির বাইরে, মা মেরে ফেলবে যদি কিছু, হাতে করে না নিয়ে যাই।”
লাউডস্পীকারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাগলি শেষ হয়েছে। সভাপতি বিষ্টু ধর বক্তৃতা দিতে শুরু করেছে। “ ক্ষিতীশ হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে কোনিদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, “তুমি সাঁতার শিখবে?”
মুখটা তুলল সে। কাঁচা-পাকা কদমছাঁট চুলে ভরা মাথা আর পর লেনসের পিছনে জ্বলজ্বলে দুটি চোখের দিকে একটু বিরক্তভরেই তাকাল। তারপর আবার সে নিজের পা টিপতে লাগল।
“শিখবে সাঁতার?”
‘সাঁতার আমি জানি।“
“না, জান না।”
ঝটকা দিয়ে চল ঝাঁকিয়ে কোনি আবার মুখ তুলল।
“আপনি জনেন?”
“হ্যাঁ জানি। আমি দেখেছি তোমায় গঙ্গায়। ও সাঁতার চলবে না। সাঁতার শেখার জিনিস।”
“যা জানি তাতেই গঙ্গা এপার-ওপার করতে পারি, শেখার আবার আছে কি?”
“অনেক কিছু শেখার আছে।”
“আমার দরকার নেই শিখে, যা জানি তাই যথেষ্ট।”
ক্ষিতীশের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে কোনি দাঁড়াল। চেঁচিয়ে ডাকল, “অ্যাই গোপলা, শুনে যা।”
টেবলে স্তূপীকৃত নানাবিধ প্রাইজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা খালি পা ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে বছর বারোর একটি ছেলে এগিয়ে এল।
“হ্যাঁ রে, মা কিছু বলেছে?”
“যাও না বাড়িতে, পিটিয়ে তোমার চামড়া তুলে নেবে।“
“দাদা?
“দাদা আজ কাজে যায়নি, জ্বর হয়েছে। মা’র সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তোমাকে নিয়ে। দাদা বলেছে, বেশ করেছে কোনি।”
ক্ষিতীশ ভাবল, আর একবার কোনির সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু ততক্ষণে কোনিকে ডেকে নিয়ে গেছে নেতাজী বালক সম্মের কর্মকর্তারা। প্রতিযোগীদের হাতে একটি করে খাবারের ঠোঙা দেওয়া হচ্ছে।
“এই যে শরীর, একে চাকর বানাতে হবে।”
ক্ষিতীশ ফিরে তাকাল বক্তৃতাকারীর দিকে। মাইক্রোফোনের পিছনে একটি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা চর্বির ঢিপি। ক্ষিতীশ ভীড় কেটে চাতালের দিকে এগোল।
“কি করে তা সম্ভব? আপনার লক্ষ লক্ষ টাকা আছে কিন্তু পারেন কি আপনি আর্চ করতে, পীকক্ হতে? যদি কেউ আপনাকে চাঁটি মেরে পালায়, পারবেন কি তাকে দৌড়ে গিয়ে ধরতে? না, পারবেন না, আমি জানি আপনি পারবেন না।”
সভাপতির পিছন থেকে কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “একবার পরীক্ষা করে দেখব নাকি?”
বিষ্টু ধর পিছন দিকে তাকাল। ক্ষিতীশকে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল। মাইকে হাত চাপা দিয়ে চাপা গলায় বলল, “সব জায়গায় ইয়ারকি করবেন না।“ তারপর হাত সরিয়ে বলতে শুরু করল, “কেন পারবেন না, জানেন কি কারণটা? কারণ, আপনার শরীর ফিট নয়। আর ফিটনেস আসে নিয়মিত ব্যায়াম থেকে।”
বিষ্টু ধর পিছন ফিরে তাকাল। ক্ষিতীশ মাথা হেলিয়ে তারিফ জানাল।
“ব্যায়াম সেইজন্যই সকলের করা দরকার। হাঁটাও একটা ব্যায়াম। তাই নেতাজী বালক সম্বের তরণ কমীদের, যারা দিনরাত পরিশ্রম করে আজকের এই প্রতি যোগীতাকে সফল করে তুলেছে, তাদের বললাম তোমরা হাঁটার ব্যবস্থা করো, আমি আছি তোমাদের সাথী। এটা সমাজসেবার কাজ, আমি থাকব তোমাদের পাশে পাশে।”
“উঁহু, আগে আগে। নেতৃত্ব দিতে হলে সামনে থাকতে হয়।”
বিষ্টু ধর পিছনে তাকিয়ে, কোঁচকাল। তারপর মাথা হেলাল, “পাশে পাশেই বা বলি কেন, আমি থাকব আগে আগে। সমাজের কল্যাণের জন্য, মানুষকে সুস্থ সবল করার জন্য যখনই সংগঠন গড়ে উঠবে, সবার আগে আমাকে ছুটে আসতেই হবে।”
‘ছোটর কথা চেপে যান।” পিছন থেকে ফিসফিস শোনা গেল, “যদি কেউ বলে একট ছুটে দেখান?”
বিষ্টু ধর ঢোঁক গিলে বলল, “কিন্তু ছুটেই বা আসব কেন! মানুষ ছোটে কখন? যখন সে ভয় পায়, দিশাহারা হয়। কিন্তু জনগণ সহায় থাকলে আমি ভয় পাব কেন? জনগণই পথ বলে দেবে, সুতরাং দিশাহারা হবে কেন? না, আপনাদের আশীর্বাদ থাকলে আমি ভয় পাব না। সঠিক পথেই আপনাদের সেবা, দেশের ও দশের সেবা করে যেতে পারব। তাই আজ প্রতিযোগীদের এই কথা বলেই বক্তব্য শেষ করব, শরীরকে ফিট না করলে পরিশ্রম করতে পারবে না! পরিশ্রম না করলে দেশ গড়ে তুলতে পারবে না। তাই আজ যে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তোমরা হাঁটা শুরু করলে…”
বিষ্টু ধর পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে লাগল। “এই যে হাঁটা, এ হাঁটা জীবনের পথে…”
বিষ্টু ধর অসহায়ভাবে পিছনে তাকাল।
“ভুলে গেছেন?”
ঘাড় নেড়ে অসহায়ভাবে বিষ্টু ধর ফিসফিস করে বলল, “রবি ঠাকুরের একটা পদ্য লিখে এনেছিলাম, পাচ্ছি না।”
“বলুন, এই যে যাত্রা শুরু হল ছোট্ট এই পার্কে—”
মাইক্রোফোনে গমগম করে উঠল সভাপতির আবেগভরা কণ্ঠ, “এই যে যাত্রা শুরু হল, ছোট্ট পার্কে—”
“ধীরে ধীরে তা বহত্তর জীবনের দিকে, সুখ-সমন্ধিভরা জীবনের দিকে তোমাদের নিয়ে যাক। এই পার্ক পরিক্রমা রপান্তরিত হোক বিশ্ব পরিক্রমায়, জয় হিন্দ।”
বিষ্টু ধর হুবহু বলে গেল ক্ষিতীশের প্রম্পট শুনে। শুধু জয় হিন্দের পর গলা কাঁপিয়ে যোগ করল, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”
পুরস্কার দেওয়া হল; প্লাস্টিকের কিট ব্যাগ আর তোয়ালে পেল যারা ২০ ঘন্টা সম্পূর্ণ করেছে। ১৬ ঘন্টার পরে যারা অবসর নিয়েছে তাদের শুধুই ব্যাগ আর ১২ ঘন্টার পরে যারা তাদের শুধুই তোয়ালে। কোনি পুরস্কার নিয়ে ব্যাগটা উল্টেপাল্টে দেখল। সভাপতিকে নমস্কার জানানোর দরকারও মনে করল না। খাবারের ঠোঙাটা ব্যাগের মধ্যে ভরে সে ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, “চ বাড়ি যাই, এটা মাকে দিতে হবে।”
ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনি চলে যাচ্ছে।
ক্ষিতীশ একদৃষ্টে তাকিয়ে। মাথাটা উঁচু কঞ্চির মত শরীরটা দুলছে। সঙ্গে ওর বন্ধু, ভাদু আর চণ্ডু। পার্ক থেকে বেরিয়ে ওরা ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্ষিতীশের মনে হল, ওর বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে হতো।
“আপনাকে বেষ্টা দা ডাকছে।”
“কে বেষ্টা দা?” অন্যমনস্ক ক্ষিতীশ বলল।
“আজ যিনি সভাপতি।”
ক্ষিতীশকে দেখেই বিষ্টু ধর একগাল হেসে বলল, “ফিনিশিংটা, সবাই বলছে দারুণ হয়েছে।“ তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “ইনকিলাব জিন্দাবাদটা অ্যাড করলুম, তার কারণ আছে। আমার প্রগ্রেসিভ নেচারটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। চলুন চলুন, আমার গাড়ি রয়েছে, আপনাকে সব বলছি, আমার বাড়ি চলুন।”
বিষ্টু ধর আগামী সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়াবে। তাই এখন থেকেই সে তোড়জোড় শুরু করেছে। পাড়ায় পাড়ায় নানান ব্যাপারে টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছে আর তাতে সভাপতি হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। নির্দলীয় সমাজসেবক হিসাবে সে ভোট চাইবে।
বিষ্টু ধর গাড়িতে বসে কথাগুলো জানিয়ে দিল।
বাড়ি পোঁছে বলল, “আপনাকে আমার দরকার।”
“আমাকে?”
“হ্যাঁ, আপনি আমার ইস্পীচ-রাইটার হবেন, বক্তৃতা লিখে দেবেন। অবশ্য এজন্য টাকা দোব। রাজী?”
“আমি তো খেলার ব্যাপার ছাড়া আর কিছু জানি না!” ক্ষিতীশ বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে বলল।
“সেইজন্যেই তো আপনাকে চাই। খেলা নিয়েই বক্তৃতা দিতে চাই, আর কিছু, নিয়ে নয়। বিনোদ ভড় হচ্ছে সিটিং এম এল এ। খেলার লাইনের লোক। অনেক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। আমিও খেলার লাইন ধরে ক্যামপেন করব। বিনোদ ভড় মিনিস্টার হতে চায়।”
সিগাড়া মুখে দিয়ে ক্ষিতীশ বলল, “ভেবে দেখি।”
.
০৫.
রবীন্দ্র সরোবরে এক মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতা।
পঁচিশজন প্রতিযোগী। বাইশটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে।
স্টারটিং পয়েন্টে ভীড়। প্রতিযোগীরা তেল মাখায় ব্যস্ত। উদ্যোক্তা ঢাকুরিয়া স্পোর্টস ক্লাবের অনুরোধে ক্ষিতীশ প্রতিযোগিতার রেফারী অফ দ্য কোর্স। সাঁতারুদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে নৌকোয়।
স্টারটিং পয়েন্ট থেকে একটু এগিয়ে সে আর ভেলো নৌকোয় বসে।
“ক্ষিদ্দা, কে জিতবে বলল তো? সবারই মনে হচ্ছে।”
“সুবীরের নামা অন্যায় হয়েছে। এসব কম্পিটিশনে নামীদের থাকা উচিত নয়। ও তো ন্যাশনাল জুনিয়ার রেকর্ড হোল্ড করছে।”
“যা বলেছ। তবে বেশির ভাগই আনকোরা দেখছি।”
ভেলো সারি দিয়ে দাঁড়ানো সাঁতারুদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, “এই লাল কস্ট্যুমপরা মেয়েটা কে বলো তো? কখনো তো দেখিনি!”
এত দর থেকে ক্ষিতীশ, পরে লেনসের মধ্য দিয়ে, শাদা টুপি মাথায়, লাল রঙে মোড়া তুষারধবল একটি দেহমাত্র দেখতে পেল।
“কে, তা আমি জানব কি করে!”
“না, এমনিই বলছি। বালিগঞ্জ ক্লাবের ট্রেনার প্রণবেন্দ বিশ্বাসকে দেখলুম কিনা মেয়েটার সঙ্গে। খুব বড়লোক মনে হল। ওই যে সবুজ মোটরটা, ওটায় করে এসে নামল। সঙ্গে বাবা-মাও যেন রয়েছে।”
‘তুই বড্ড বেশি দেখিস।”
“না দেখে উপায় আছে, মোমের পুতুলের মত চেহারা! ওর পাশেই দ্যাখো, পোড়ামাটির কেলে পিলসুজের মত একটা। কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে দ্যাখো।”
ক্ষিতীশ দেখার চেষ্টা করল। সেকেণ্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা শব্দ, “কোনি?”
ঠিক তখনই স্টার্টারের বন্দকে গর্জে উঠল।
সাঁতারুরা এগিয়ে যাবার পর ক্ষিতীশদের নৌকোটা পিছু নিল।
সুবীর এবং আরো গুটি দশেক ছেলে একঝাঁকে এগিয়ে গেছে। তারপরেও আর এক ঝাঁক। সব শেষে তিনটি মেয়ে ও দুটি বাচ্চা ছেলে।
পাঁচশো মিটার পর্যন্ত এরা পাঁচজন প্রায় একসঙ্গেই ছিল। তারপরই লাল কস্ট্যুম ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে শুরু করল।
“ক্ষিদ্দা, স্ট্রোক দেখেছ! শরীরটা কেমন ভাসিয়ে রেখেছে।”
ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ লক্ষ করে বলল, “মাথাটা ঠিকমত নাড়ানো হচ্ছে না। সেন্ট্রাল পোজিশনে না থাকলে শরীরের ব্যালান্স নষ্ট হয়, স্পীডও কমিয়ে দেয়; শরীরটা রোল করছে বড় বেশি। কনুই আরো উঠবে…”
“অ্যাই অ্যাই, অমনি তোমার শুরু হয়ে গেল খুঁত ধরা।”
“খুঁত না ধরলে দোষ সারবে কি করে?”
“ও কি তোমার ছাত্তর?”
“নাইবা হলো।”
সামনের দু’ ঝাঁকের সাঁতারুদের কেউ কেউ এবার মন্থর হয়ে পিছিয়ে পড়ছে। ক্ষিতীশ ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল। বাচ্চা ছেলে দুটির সঙ্গে কোনি আসছে বৈঠার মত হাত চালিয়ে, দু’ধারে মাথা নাড়াতে নাড়াতে। ওদের থেকে অন্তত কুড়ি মিটার সামনে আর একটি মেয়ে, সমান তালে একই গতিতে সাঁতরে চলেছে। লাল কস্ট্যুমের মেয়েটি তার থেকে আরো তিরিশ মিটার সামনে এবং একটি ছেলের থেকে হাত দশেক পিছনে।
“কো ও ও নি ই ই।”
সরোবরের পূর্ব তীর থেকে একটা চীৎকার ভেসে এল।
ক্ষিতীশ আর ভেলো একসঙ্গেই তাকাল, বছর পচিশের, শামবর্ণ একটি রুগ্ন যুবক পাড় ঘেঁষে ছুটছে। পরনে ধুতি ও নীল শার্ট। চটি জোড়া হাতে।
‘কো ও ও নি ই ই…কো ও ও নি ই ই।”
গলার স্বরটা আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। পাড়ে ভীড় জমেছে। সাঁতার দেখতে। তাদের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে ছুটছে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকাচ্ছে। মখখানি অসহায়।
“কো ও ও নি ই।”
চীৎকারটা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল।, ক্ষিতীশ দেখল কোনিকে পিছনে ফেলে বাচ্চা দুটি এগোচ্ছে। লাল কস্ট্যুম দুটি ছেলেকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।
“কে বলো তো ক্ষিদ্দা?”
“জানি না, কোনো কম্পিটিটারের বাড়ির লোক হবে হয়তো।”
পাড়ের রাস্তা ধরে ধীর গতিতে সবুজ রঙের একটা ফিয়াট চলেছে। গাড়ির জানলায় উৎকণ্ঠিত একটি পুরুষ ও একটি মহিলার মুখ। মাঝে মাঝে হর্ন দিচ্ছে।
“কো ও ও ন ই ই।”
নৌকোটা ছপছপ শব্দে দাঁড় ফেলে এগোচ্ছে। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে নীলশার্ট পরা যুবকটি দাঁড়িয়ে। ক্রমশ সে ক্ষিতীশের চোখে ছোট হয়ে ঝাপসা হতে শুরু করল। জলের উপর, অনেক পিছনে, দুটি হাতের ওঠানামা হচ্ছে। তারপর আর দেখা গেল না হাত দুটো। পড়ন্ত রোদে মাঝে মাঝে চিচিক করে উঠছে ছিটকে ওঠা জল।
সামনে হৈ চৈ শোনা গেল। প্রথম প্রতিযোগী সাঁতাব শেষ করেছে। সম্ভবত সুবীরই।
কোনি জল থেকে উঠছে। সাঁতার শেষ করে অনেকেই তখন চল পর্ষত আঁচড়ে ফেলেছে। ম’ইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ঢাকুরিয়া স্পোটিং ক্লাবের সারা বছরের কার্যকলাপের বিবরণ পাঠ করে চলেছে একঘেয়ে সরে। কেউ লক্ষই করল না শেষ প্রতিযোগীর সীমায় পৌঁছনোটা!
পাড়ের কাছে কাদা। কোনির পায়ের গোছ কাদায় ডোবা, শরীরটা সামনে ঝোঁকান, পাড়ে উঠতে গিয়ে সেই অবস্থাতেই সে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটি লাল। সস্তার একটা কালো কস্ট্যুম শীর্ণ দেহের সঙ্গে লেপটে। হাঁপাচ্ছে, পিঠের দিকে পাঁজরের হাড়গুলো চামড়ার নিচে বারবার কেঁপে উঠছে। কাঁধের হাড় দুটো উচ; সরু লম্বা হাত দুটো ঝলছে কাঁধ থেকে। একটু দূরে নীলশার্ট পরা রন যুবকটি দাঁড়িয়ে, মনযোগে লাউডস্পীকারে কান পাতার ভান করে।
টলতে টলতে কোনি উঠে এল। ওর বয়সীই দুটি ছেলে একটু জোরেই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল।
“তবু তো শেষ করেছে।”
“পরের বছরের কম্পিটিশনে প্রথম প্লেস পেতো যদি আর একটু দেরীতে পৌঁছতো।”
কোনি আর একবার তাকাল। নীলশার্ট পরা যুবকটির মখ চড় খাওয়া মানুষের মত অপ্রতিভ, অপমানিত।
.
“সাঁতার শিখবে?”
চমকে কোনি পিছনে ঘুরল।
সেই লোকটা। কাঁচাপাকা কদমছাঁট চল। পরে কাঁচের চশমা।
“লাল কস্ট্যুমপরা মেয়েটি সাঁতার শিখেছে তাই তোমাকে হারালো। তুমিও ওকে হারাতে পারবে যদি শেখো।”
হঠাৎ কোনির দু’চোখ জলে ভরে এল। থরথরিয়ে ঠোঁট দুটি একবার কেঁপে উঠল। তারপরই চোয়াল শক্ত হয়ে বসে গেল।
ক্ষিতীশের চাহনির দপ করে ওঠা শুধু ভেলোই লক্ষ করল এবং অস্বস্তি ভরে সে মাথা নাড়ল।
“ওই যে দাঁড়িয়ে, ও কে?”
“আমার দাদা।” নিজেকে টানতে টানতে কোনি ড্রেসিং রুমের দিকে চলে গেল। ক্ষিতীশ এগিয়ে গেল কোনির দাদাকে লক্ষ করে।
“আমি একজন সাঁতারের কোচ। আমার নাম ক্ষিতীশ সিংহ। আমি আপনার বোনকে সাঁতার শেখাতে চাই।“
ক্ষিতীশ কোন ভূমিকা না করে সোজাসুজি কথাগুলো বলল।
“আমার নাম কমল পাল। আমি একসময় সাঁতার কেটেছি অ্যাপোলোয়। তখন আপনাকে আমি দুর থেকে দেখতাম।” কমল তার পাণ্ডুর অসুস্থ চোখ দুটোয় ঔজ্জ্বল্য আনার চেষ্টা করল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমরা খুবই গরীব। সাঁতার শেখবার পয়সা নেই।”
“আমাকে পয়সা দিতে হবে না।”
“তা বলছি না। সাঁতার শিখতে হলে খরচ আছে, খাওয়া-দাওয়ার খরচ। আমি পারিনি সেইজন্য, পয়সা ছিল না খাওয়ার। বাবা প্যাকিং কারখানায় কাজ করত, টি বি-তে মারা গেল। সাঁতার কেটে এসে খিদেয় ছটফট করতুম। স্কুলে ঘুমিয়ে পড়তুম। বাবা মারা যেতে স্কুল ছাড়লুম, সাঁতার ছাড়লুম। অজ পাঁচ বছর হয়ে গেল।”
“কি করেন আপনি?”
“আপনি বললে লজ্জা পাব।”
“বেশ। তুমি কি করো, বাড়িতে আর কে কে আছেন?”
‘সাত ভাই-বোন, মা। আমি বড়ো, গত বছর মেজো ভাই ট্রেনের ইলেকট্রিক তারে মারা গেছে, সেজো কাঁচরাপাড়ায় পিসির বাড়িতে থাকে। তারপর কোনি আর দু’ বোন এক ভাই। আমি রাজাবাজারে একটা মোটর গ্যারেজে কাজ করি, ওভারটাইম করে শ’ দেড়েক টাকা পাই, তাতেই সংসার চলে। থাকি শ্যামপুকুরে বস্তিতে।”
কমল হাঁপিয়ে পড়ল এই ক’টি কথা বলেই। ভিতরে ভিতরে যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কোন কুণ্ঠা বা সংকোচ না করে সাধারণভাবেই নিজেদের অবস্থার কথা বলল। ওর হাঁপিয়ে ওঠার ধরনটা ক্ষিতীশের ভাল লাগল না। ওর বাবা টি বি-তে মারা গেছে, এটা মনে পড়ে অস্বস্তি বোধ করল।
“নামকরা সাঁতার হবার সখ আমার ছিল। কোনিটাকে দেখতুম ছোট থেকেই ওর খেলাধুলোয় আগ্রহ। আমার ইচ্ছে করে ওকে কোনো একটা খেলায় দিই। গঙ্গায় সাঁতার কাটে শুনেছি, দেখিনি কখনো। দিনরাত টো টো করে শুনেছি ছেলেদের সঙ্গে। অনেকে অনেক কথা বলে আমাকে। আমি তো বাড়িতে ফিরি শুধু ঘুমোবার জন্য। কে কি করছে কিছুই জানি না। তবু মাথা গরম হয়ে উঠলে দু-চার ঘা লাগাই। এর বেশি ওদের জন্য আমি আর কিছু করতে পারি না। ইচ্ছে থাকলেও ওকে সাঁতার শেখাবার সামর্থ্য আমার নেই।”
“সে দায়িত্ব আমার।”
“তার মানে?” ভেলো ব্যস্ত হয়ে এতক্ষণে মুখ খুলল। “দায়িত্ব তোমার মানে?”
“মানে বলতে যা বোঝায় তাই।” ক্ষিতীশ বিরক্তি জানিয়ে কমলকে লক্ষ করে বলল, “গার্জেনরা সাহায্য না করলে কোন ছেলেমেয়েকে শুধু কোচিং দিয়ে বড় করা যায় না। আমি শুধু বাড়ির সহযোগিতা চাই। বাদবাকি দায়িত্ব আমার।”
“আপনি দায়িত্ব নেবেন, সে তো ভাগ্যের কথা।” কমলের চোখের পাতা চকচক করে উঠল। “কিন্তু আমি এক পয়সাও খরচ করতে পারব না। ধার করে কালকেই বারো টাকা দিয়ে ওকে কস্ট্যুম কিনে দিয়েছি। খুবই বাজে জিনিস। কখনো ওর সাঁতার দেখিনি, এই প্রথম দেখলুম। কথা দিয়েছিল, মেয়েদের মধ্যে প্রথম হবেই। দেখলেন তো কি হল!”
ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল।
ভেলে। বলল, “স্ট্রেংথই নেই, আদ্দেকের পর আর টানতে পারছিল না। ওকে এখন খুব খাওয়াতে হবে। তাই না ক্ষিদ্দা?”
“আমরা এখন চলি।”
ক্ষিতীশ পিছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখল দূরে কোনি দাঁড়িয়ে। ফ্রক পরে। কাঁধে প্লাসটিকের ব্যাগ।
“আমার খুবই ইচ্ছে, ও সাঁতার শিখুক, বড় হোক, নাম করুক।” তারপর ইতস্ততঃ করে কমল বলল, “আর, যতটুকু পারি টেনেটুনে চালিয়ে খরচ করার চেষ্টা করব।”
এদিকে প্রাইজ দেওয়া হচ্ছে। নাম ডাকা এবং হাততালির শব্দ লাউডপীকারে ভেসে আসছে।
“মেয়েদের মধ্যে প্রথম……”
ক্ষিতীশ তাকিয়ে ভাইবোনের দিকে। প্রাইজ না নিয়ে চলে যাচ্ছে উটো দিকের পথ ধরে। ভাঙ্গা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে গলে রাস্তায় পড়বে। কমল গলে বেরিয়েছে। কোনি কাত হয়ে মাথা নিচু করে। ঝটকা দিয়ে সে এবার ফিরে দাঁড়াল।
“…বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবের হিয়া মিত্র। টাইম–পঁয়ত্রিশ মিনিট আঠারো সেকেন্ড।”
কোনি মাথা নামিয়ে রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি ক্ষিদ্দা।”
“কি করে বুঝলি।”
“ওই পিলসুজমার্কা সিড়িঙ্গে, কেষ্ট তুলসীর মত রঙ, খেতে পরতে পায় না, ওকে তুমি সাঁতার শেখাবে, আবার দায়িত্বও নেবে?”
“হ্যাঁ, তা না হলে কি শেখানো যায়?”
“দায়িত্ব কথাটার মানে?”
‘মানে, খাওয়া-পরার দায়িত্ব, মানসিক গড়ন, যেটা সব থেকে ইমম্পর্ট্যান্ট, তাই গড়ে তোলার দায়িত্ব, রেগুলার ট্রেনিং করানোর দায়িত্ব, এইসব আর কি।”
“তা হলে তো ওকে বাড়িতে এনে রাখতে হয়।”
“দরকার হলে রাখতে হবে। এককালে গুরুগৃহে থেকেই তো শিষ্যরা শিখতে। সিস্টেমটা খুব ভালো।”
“সিস্টেমের মধ্যে বৌদির কথাটা মনে রেখেছে। তো!”
ক্ষিতীশ রেগে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। থেমে, কান পাতল লাউড-স্পীকারে।
“কনকচাঁপা পাল, আন-অ্যাটচ্ড্! কনকচাঁপা পাল।“ তারপর মদ, ফিসফিস শোনা গেল, “বোধহয় চলে গেছে। থাক রেখে দাও।”
ক্ষিতীশ দেখল, সবুজ ফিয়াটের ধারে লাজুক মুখে হিয়া দাঁড়িয়ে। আনন্দ ফেটে পড়ছে ওর দুই গালের টোলে। এক মহিলা বাক্সটা তুলে মেডেলটা দেখছে আর হাসছে। প্রণবেন্দু ওদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে। সুপুরুষ, সুবেশ এক ভদ্রলোককে সে কি একটা বোঝাবার জন্য হাত পাড়ি দিয়ে বাটারফ্লাই স্ট্রোকের ভঙ্গি করা।
“সামনের বছর দেখা যাবে।” নিজেকে উদ্দেশ করে আপন মনে ক্ষিতীশ বলল।
“কিছু, বলছ ক্ষিদ্দা?”
ক্ষিতীশ জবাব দিল না।
“শেখাবে যে, জল কোথায়? জুপিটারে তুমি আর ট্রেনার নও। তাহলে মেয়েটাকে কোথায় নামিয়ে শেখাবে? অন্য ক্লাবে তোমায় যেতেই হবে।”
“না, আমি জুপিটারেই ওকে শেখাব। দেখি কে আমায় আটকায়। তার আগে আমাকে রোজগারে নামতে হবে রে ভেলো। এখন আমার টাকা চাই। বিষ্টু ধরের সঙ্গে দেখা করা দরকার।”