অথৈজল (Athaijal) : 01
বাড়িতে কেউ নেই। ডিসপেনসারির কাজ সেরে এইমাত্র বাজার থেকে ফিরে এসেছি।
পাড়ার সনাতন চক্কত্তি বাইরের বৈঠকখানায় বসে আছে।
বললাম—কি সনাতনদা, খবর কি?
সনাতন উত্তর দিল—এমনি করে শরীরটা নষ্ট কোরো না। বেলা একটা বেজে গিয়েছে। এখনও খাওয়া-দাওয়া করনি?
সনাতনের কথা শুনে হাসলাম একটুখানি। আমি জানি, সনাতন আমার মন যোগাবার জন্যে একথা বলছে; সে ভালোই জানে, আমার কেন দেরি হয় ডিসপেনসারি থেকে উঠে আসতে। সকাল থেকে নিঃশ্বাস ফেলবার অবকাশ পাই কখন?
বললাম—রুগীর ভিড় জানো তো কেমন?
সনাতন মুখখানাতে হাসি এনে উজ্জ্বল করবার চেষ্টা করে বললে—তা আর জানি নে? তোমার মতো ডাক্তার এ দিগরে ক’টা আছে? ওষুধের শিশি ধোওয়া জল খেলে রোগ সেরে যায়—
—চা খাবে সনাতনদা?
—পাগল? এখন চা খাবার সময়?
—তা হোক, চলুক একটু।
আমার নিজেরও এখন তাড়াতাড়ি স্নানাহার করবার ইচ্ছে নেই। সনাতনের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে একটু আড্ডা দেওয়া যাক। ডিসপেনসারির চাকর বুধো গোয়ালা চাবি নিয়ে সঙ্গে এসেছিল, তাকে বললাম,—তোর মাকে বল গিয়ে দু’ পেয়ালা চা করে দিতে।
সনাতন চক্কত্তি গ্রামের গেজেট। সে কেন এখানে এসেছে এত বেলায়—ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
চা খেতে খেতে সনাতন বললে—আবদুল ডাক্তারের পসার—বুঝলে ভায়া—
হাসি-হাসি মুখে সে আমার দিকে চেয়ে রইল।
আমি বললাম—ব্যাপার কি?
—আর কি ব্যাপার—একেবারে মাটি!
—কে বললে তোমাকে?
—আমি বলছি। আমি জানি যে—
—কেন, সে তো ভালো ডাক্তার—
—রামোঃ, তোমার কাছে? বলে সেই ‘চাঁদে আর কিসে’! হোমিওপ্যাথির জল কে খাবে তোমার ওষুধ ছেড়ে। বলে ডাকলে কথা কয়। রামু তাঁতীর বউটার কি ছিল? হিম হয়ে গিয়েছিল তো। তুমি গা ফুঁড়ে না ওষুধ দিলে এতদিনে দোগেছের শ্মশান-সই হতে হত।
নিজের প্রশংসা শুনতে খারাপ লাগে না, তা যেই করুক। তবুও আমি অন্য একজন ডাক্তারের নিন্দাবাদ আমার সামনে হতে দিতে পারি না। আমাদের ব্যবসার কতকগুলো নীতি আছে, সেগুলো মেনে চলাতেই প্রকৃত ভদ্রতা। বললাম—ডাক্তার রহিমকে যা-তা ভেবো না। উনি খুব ভালো চিকিৎসা করেন—অবিশ্যি আমি নিজে হয়তো হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিনে, কিন্তু—
সনাতন হাত নেড়ে বললে—না রে ভায়া, তুমি যাই বলো তোমার কাছে কেউ লাগে না। একবার সাইনবোর্ডটা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়—ডাক্তার বি. সি. মুখার্জি এম. বি. মেডিকেল কলেজের ভূতপূর্ব হাউস সার্জন—সোনার পদকপ্রাপ্ত—
—তুমি বোসো দাদা, আমি খেয়ে নিই—
—বিলক্ষণ! নিশ্চয়ই নেবে। তুমি যাও ভেতরে, আমি এই তক্তাপোশে একটু ঘুম দিই।
—বাড়িতে কেউ নেই। তোমার বউমা গিয়েছেন রাজু গোঁসাইয়ের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে। কি একটা মেয়েলি ব্রত উদযাপন। সেই জন্যেই তো এত দেরি করলাম।
একটু পরে স্নান সেরে উঠেছি, গৃহিণী বাড়ি এলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সঙ্গে রাজু গোঁসাইদের বাড়ির ঝি, তার হাতে একটা পুঁটুলি।
আমায় দেখে সুরবালা বললে—কি গো, এখনও খাওনি?
—কই আর খেলাম।
—দাঁড়াও ভাত এনে দিই, লক্ষ্মী জায়গা করে দে—
—খুব খাওয়ালে রাজু গোঁসাইয়েরা? কিসের ব্রত ছিল?
—এয়োসংক্রান্তির ব্রত। তোমার জন্যে খাবার দিয়েছে—
—আমার জন্যে কেন? আমি কি ওদের এয়ো?
—তা নয় গো। তুমি গাঁয়ের ডাক্তার, ডাক্তারকে হাতে রাখতে সবাই চেষ্টা করে।
—না না, ও আমি ভালোবাসি নে। লোকের অযথা ব্যয় করিয়ে দিতে চাই নে আমি। ও আনা তোমার উচিত হয়নি।
—আহা! কথার ছিরি দ্যাখো না। আমি বুঝি ছাঁদা বেঁধে আনতে গিয়েছিলাম—ওরা তো পাঠিয়ে দিলে ঝি দিয়ে।
পৈতৃক আমলের দোতলা কোঠা বাড়ি। আহারাদি সেরে পুবদিকের ঘরে বিশ্রাম করতে গেলাম। বড় পালঙ্কখাটে পুরু গদি-তোশক পাতা ভালো বিছানা। সুরবালার নিজের হাতের সূচের কাজের বালিশ-ঢাকা বালিশের ওয়াড়। খাটের ঝালরও ওর নিজের হাতের। এই একটা বিষয়ে আমার শৌখিনতা আছে স্বীকার করছি, ভালো বিছানা না হলে ঘুম হবে না কিছুতেই। তা ছাড়া ময়লা কোনো জিনিস আমি দেখতে পারি নে, দশদিন অন্তর মশারি ধোপার বাড়ি দিতে হবেই। আমার এক রোগীর বাড়ি থেকে পুরনো দামে একখানা বড় আয়না কিনেছিলাম, ওপাশের দেওয়ালে সেটা বসানো, সুরবালার শখের ড্রেসিং টেবিল পালঙ্কের বাঁ ধারে, তিনখানা নতুন বেতের চেয়ার এবার কলকাতা থেকে আনিয়েছি, সুরবালার ফরমাশ-মতো খান-আষ্টেক বৌবাজার স্টুডিওর ছবি—কালীয়দমন, রাসলীলা, অন্নপূর্ণার শিবকে ভিক্ষাদান, শ্রীশ্রীলক্ষ্মী, শ্রীশ্রীসরস্বতী ইত্যাদি। আমার পছন্দসই আছে একখানা বিলিতি ল্যান্ডস্কেপ—সেও ওই বৌবাজারের দোকানেই কেনা।
জানালার গায়ে জামরুলগাছের ডালটা এসে নুয়ে পড়েছে, তার পেছনেই জাওয়া বাঁশের ঝাড়। শীতের বেলা, এর মধ্যেই বাগানের আমতলায় মুচুকুন্দ চাঁপা গাছটার তলায় ছায়া পড়ে এসেছে, ছাতারে পাখির দল জামরুলগাছটার ডালে কিচ কিচ করছে—বাগানের সুদূর পাড়ের ঘাসের জমিতে আমাদের বাড়ির গরু ক’টা চরে বেড়াচ্ছে।
সুরবালা পানের ডিবে হাতে এসে বললে—একটু ঘুমিয়ে নাও না।
—বাইরে সনাতন চক্কত্তিকে বসিয়ে রেখে এসেছি।
—সে মিনসের কি যাবার জায়গা নেই, এখানে এসে জুটেছে কেন দুপুরে?
—ঘুমুচ্ছে।
—তবে তুমিও ঘুমোও।
সুরবালাকে বেশিক্ষণ দেখতে পাইনে দিনের মধ্যে, খোকা-খুকিদেরও না। বললাম—বোসো আমার কাছে, আবার হয়তো এখুনি বেরুতে হবে। একটু গল্পগুজব করি।
সুরবালা বালিশে হাত রেখে বসল পাশেই। বললে—আজ আর বেরিয়ো না—এত বেলায় এলে—
—পাশের গাঁয়ে একটা শক্ত রুগী রয়েচে, তার কথাই ভাবছি—
—যেতে হবে? কল না দিলেও?
—আমি তাই তো যাই। ফি নিইনে নিজে গেলে। তুমি তো জানো।
—গরুর গাড়িতে চলে না। তোমার শরীরের কষ্ট বড় বেশি হয়।
—দেখি একখানা মোটর কিনবার চেষ্টায় আছি! কলকাতায় গেলে এবার দেখব।
সুরবালা আবদারের সুরে বললে—হ্যাঁগা, নিয়ে এসো কিনে একখানা—আমাদের একটু চড়ে বেড়াবার ইচ্ছে। আনবে এবার?
—কাঁচা রাস্তা যে! বর্ষাকালে—
—কেন, তোমার ডিসপেনসারিতে রেখে দেবে বর্ষাকালে। বাজারে তো পাকা রাস্তা।
—তোমার ইচ্ছে?
—খু-উ-ব। জয়রাজপুরের মল্লিকবাড়িতে তাহলে দুর্গা-পুজোয় মোটর চড়ে নেমন্তন্ন খেতে যাই এ বছর।
—এ বছর কি রকম? সামনের বছর বলো—
—ওই হল। খুনুকে টুনুকে বেশ করে সাজিয়ে মোটরে উঠিয়ে—
—না না, ওদের মাথায় ওসব ঢুকিও না এ বয়সে। ওদের কিছু বলার দরকার নেই।
—আহা! আমি যেন বলতে যাচ্ছি? তুমি বললে, তাই বললাম।
—বেশ, দেখছি আমি। তোমার হাতে কত আছে?
—গুনে দেখি নি। হাজার চারেক হবে। তুমি কিছু দিও—কিনতে হয় ভালো দেখে একখানা—
—ওতেই ভেসে যাবে।…
আমি সামান্য একটু ঘুমিয়ে নিই।
যখন উঠলাম তখন শীতের বেলা একেবারেই গিয়েছে। সুরবালা চা নিয়ে এল। বললাম—বাইরে সনাতনদা বসে আছে নিশ্চয়। ওকে চা পাঠিয়ে দাও—
সুরবালা বললে—মালিয়াড়া থেকে তোমার কল এসেছে, দু’জন লোক বসে আছে। বৃন্দাবন কম্পাউন্ডার এসেছিল বলতে, আমি বললাম, বাবু ঘুমুচ্ছেন।
—এখন আমার ইচ্ছে নেই যাবার।
—সে তুমি বোঝো গিয়ে। কিছু খাবে?
—নাঃ, এই অবেলার শেষে খিদে নেই এখন। জামাটা দাও, নীচে নামি।
বাইরের ঘরে সনাতনদা ঠিক বসে আছে। আমায় বললে—কি হে, ঘুমুলে যে খুব? এরা এসেছে মালিয়াড়া থেকে তোমায় নিতে।
লোক দুটি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলে। একজন বললে—এখুনি চলুন ডাক্তারবাবু, বীরেশ্বর কুণ্ডুর ছোট ছেলের জ্বর আজ ন’দিন। ছাড়ছে না কিছুতেই—
—কে দেখছে?
—গ্রামেরই শিবু ডাক্তার—
—বসুন। পঞ্চাশ টাকা নেবো এই অবেলায় যাওয়ার দরুন—
—বাবু, আপনার দয়ার শরীর। অত টাকা দেওয়ার সাধ্যি থাকলে শিবু ডাক্তারকে দেখাতে যাবো কেন বলুন।
—কত দিতে পারবেন? দশ টাকা কম দেবেন—
সনাতনদা এই সময় বলে উঠল—দরদস্তুর করাটা কার সঙ্গে? উনি হাত বুলিয়ে দিলে রুগীর অসুখ সেরে যায়—কোনো কথা বোলো না।
সনাতনের ওপর আমি মনে মনে বিরক্ত হলাম। আমি তাকে দালালি করতে ডেকেছি নাকি। ও রকম ব্যবসাদারি কথা বলা আমি মোটেই পছন্দ করিনে। সনাতনের প্রতি বিরক্তি প্রকাশের জন্যেই বললাম—দরদস্তুর আমি পছন্দ করিনে বটে, তবে গরিব লোকের কথা স্বতন্ত্র। যাগ গে, আর দশ টাকা কম দেবেন। কিসে যাবো? নৌকো এনেছেন? বেশ।
সনাতন আমার সঙ্গে নৌকোতে উঠল।
রাঙা রোদ নদীতীরে গাছপালার মাথায়; সাদা বকের দল শেওলার দামে, ডাঙার সবুজ ঘাসে চরে বেড়াচ্ছে, শীত আজ ভালোই পড়েছে। উপীন জেলে নদীর ধারে দোয়াড়িতে মাছ ধরছে, আমায় দেখে বললে—বাবু, একটা বড় বাটা মাছ প্যালোম এই মাত্তর—আপনার বাড়ি পেটিয়ে দেবো?
সনাতন বললে—কত বড় রে?
—তা দেড় সের সাত পোয়ার কম হবে না, আন্দাজে বলছি। এখানে তো দাঁড়িপাল্লা নেই।
—বাবুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবি নে তো ব্যাটা কোথায় দিবি? এই অবেলায় সাতপোয়া মাছ নিয়ে দাম দেবার ক্ষ্যামতা আছে ক’জনের এ গাঁয়ে? দে পাঠিয়ে দে।
আমি মৃদু বিরক্তি জানিয়ে বললাম—কি ওসব বাজে কথা বকো ওর সঙ্গে সনাতনদা! মাছ দিতে বললে, বললে—অত কথার দরকার কি?
সনাতন অপ্রতিভ হবার লোক নয়, চড়াগলায় বললে—কেন, অন্যায় অন্যায্য কথা নেই আমার কাছে। ঠিকই বলেছি ভায়া। তুমি ছাড়া নগদ পয়সা ফেলবার লোক কে আছে গাঁয়ে? আসল লোকই তো তুমি—
রোগীর বাড়িতে গ্রামের বৃদ্ধলোকেরা জুটেছে। শিবু ডাক্তারও ছিল। শিবু ডাক্তার সেকেলে আর. জি. করের স্কুলের পাশ গ্রাম্য ডাক্তার। আমাকে দেখে একটু থতমত খেয়ে গেল।
আমি আড়ালে ডেকে বললাম—কি দিয়েছেন? প্রেসক্রিপসানগুলো দেখি।
শিবু বললে—কুইনিন দিচ্ছি।
—ভুল করেচেন। যখন দেখলেন জ্বর বন্ধ হচ্ছে না, তখন কুইনিন বন্ধ করা উচিত ছিল। এ হল টাইফয়েড, সেদিকেই যাচ্চে।
—আমিও তা ভেবেচি—অ্যালকালি মিকশ্চার দু’দিন দিয়েছিলাম।
—কাগজ আনুন। লিখে দিই।
—একটা ডুশ দেবো কি? ভাবছিলাম—
—না। বাই নো মিনস—
গৃহকর্তা কাঁদো-কাঁদো হয়ে এসে বললেন—আপনি আমাদের জেলার ধন্বন্তরি। ছেলেটা মা-মরা, ছ’মাস থেকে মানুষ করেছি—
আমি আশ্বাস দেওয়ার সুরে বললাম—ভয় নেই, ভগবানকে ডাকুন। সেরে যাবে, আমরা উপলক্ষ মাত্র। সঙ্গে লোক দিন, ওষুধ নিয়ে আসবে।
শিবু ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে বললে—ওষুধ স্যার আমার ডিসপেনসারি থেকে—
—আপনার এখানে সব ওষুধ নেই। আমি সম্প্রতি কলকাতা থেকে আনিয়েচি—সুবিধে হবে।
—যে আজ্ঞে স্যার।
শিবু একটু দমে গেল। ওষুধের দামে ভিজিটের তিনগুণ আদায় করে থাকে এই সব পল্লীগ্রামের ডাক্তার—আমার জানা আছে, আমি তার প্রশ্রয় দিই নে। পাঁচ আনার ওষুধের দাম আদায় করে দু’ টাকা।
সন্ধ্যার পর নৌকোতে ফিরলাম। অন্ধকার রাত, ঝোপে-ঝাড়ে শেয়াল ডাকচে, জোনাকি জ্বলচে। এক জায়গায় শব নিয়ে এসেচে দাহ করতে। নদীতীরে বাবলাতলায় পাঁচ-ছ’জন লোক বসে জটলা করচে, তামাক খাচ্ছে, দুজনে চিতা ধরাচ্ছে।
সনাতনদা হেঁকে বললে—কোথাকার মড়া হে?
এরা উত্তর দিলে—বাঁশদ’ মানিকপুর—
—কি জাত?
—কর্মকার—
—বুড়ো না জোয়ান?
ধমকের সুরে বললাম—অত খবরে তোমার কি দরকার হে? চুপ করে বোসো। ধরাও একটা সিগারেট, এই নাও।
সনাতন একটু চুপ করে থেকে বললে—একটা কথা আছে। আমাদের গ্রামের তুমিই এখন মাথা। তোমাকে বলতেই হবে। রামপ্রসাদ চাটুয্যে আমাদের গ্রামের লালমোহন চক্কত্তির মেয়েটার কাছে যাতায়াত করচে অনেকদিন থেকে। এ খবর রাখো?
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম—সে কি কথা? শান্তিকে তো খুব ভালো মেয়ে বলেই জানি।
—তুমি ও খবর কি রাখবে? নিজের রুগী নিয়েই ব্যস্ত থাকো। দেবতুল্য মানুষ। এ কথা তোমাকে বলব বলেই আজ নৌকোতে উঠেচি। এর একটা বিহিত করো।
—তুমি প্রমাণ দিতে পারো?
—চক্কত্তি পাড়ার সব লোক বলবে কাল তোমার কাছে। কালই সব ডাকাও।
—নিশ্চয়ই। এ যদি সত্যি হয় তবে এর প্রশ্রয় আমি দিতে পারি নে গাঁয়ে। আমায় তো জানো—
—জানি বলেই তোমার কানে তুললাম কথাটা—এখন যা হয় করো তুমি।
—শাসন করে দিতে হবেই যদি সত্যি হয়, কাল সব ডাকি। দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না, দেবোও না কখনো।
—সে আর আমি জানি নে! কুঁদির মুখে বাঁক জব্দ। তুমি ভিন্ন ভায়া এ গাঁয়ে মানুষ কে আছে, কার কাছে বলব! সবাই ওই দলের।
রাত্রে সুরবালাকে কথাটা বললাম। সে বললে—শান্তি ঠাকুরঝি এদিকে তো ভালো মেয়ে, তবে অল্প বয়সে বিধবা, একা থাকে। তুমি কিছু বলো না আগে—মেয়েমানুষের ব্যাপার। আগে শোনো। মুখে সাবধান করে দিলেই হবে।
আমি ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম—মুখে সাবধানের কর্ম নয়। দুর্নীতি গোড়া থেকে চেপে মারতে হয়—নইলে বেড়ে যায়। সেবার হরিশ সরকারের বৌটাকে কেমন করে শাসন করে দিয়েছিলুম জান তো? যার জন্যে দেশছাড়া হয়ে চলে গেল।
সুরবালা শান্ত সুরে বললে—সেটা কিন্তু তোমার ভালো হয় নি। অতটা কড়া হওয়া কি ঠিক?
—আলবৎ ঠিক। যা-তা হবে গাঁয়ের মধ্যে!
—চিরকাল হয়ে আসচে। ওসব দেখেও দেখতে নেই। নিজের নিয়ে থাকো, পরের দোষ দেখে কি হবে? ভগবান আমাদের যথেষ্ট দিয়েচেন—সবাই মানে চেনে ভয় করে গাঁয়ের মধ্যে। সত্যি কথা বলি তবে, শান্তি ঠাকুরঝি কাল আমার কাছে এসেছিল। এসে আমার হাত ধরলে। বললে, এই রকম একটা কথা আমার নামে দাদার কাছে ওঠাবে লোকে, আমার ভয়ে গা কাঁপচে। তুমি একটু দাদাকে বোলো বৌদি। বেচারি তোমার কাছে নালিশ হবে শুনে—
—ওসব কথার মধ্যে তুমি থেকো না। সমাজের ব্যাপার, গ্রামের ব্যাপার—এ অন্য চোখে দেখতে হয়। শাসন না করে দিলে চলে না—বেড়ে যাবে।
পরদিন গ্রামের পল্লীমঙ্গল সমিতির সভ্যদের ডাকাই। শান্তির ব্যাপারটা সম্বন্ধে পরামর্শ করবার জন্যে।
পরামর্শ করবার প্রয়োজন নেই আমি জানি। এ সমিতির আমিই সব, আমার কথার ওপর কেউ কথা বলবার লোক নেই এই গাঁয়ে। আমিই সমিতির সেক্রেটারি, আমিই সভাপতি—আমিই সব।
সভায় আমি নিজেই প্রস্তাব করলাম, রামপ্রসাদ চাটুয্যেকে ডাকিয়ে এনে শাসন করে দেওয়া যাক। সকলে বললে—তুমি যা ভালো মনে করো।
সনাতনদা বললে—রামপ্রসাদ ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স আদায়কারী বলে ওর বড্ড বাড় বেড়েছে। লোকের যেন হাতে মাথা কাটছে—আরে সেদিন আমি বললাম, আমার হাত খালি, এখন ট্যাক্সটা দিতে পারচি নে, দুদিন রয়ে সয়ে নাও দাদা। এই বলে, তোমার নামে ক্রোকী পরওয়ানা বের করব, হেন করব, তেন করব—
আমি বললাম—ও সব কথা এখানে কেন? ব্যক্তিগত কোনো কথা এখানে না ওঠানোই ভালো। তুমি ট্যাক্স দাও নি, সে যখন আদায়কারী, তখন তোমাকে বলবে না কি ছেড়ে দেবে?
শম্ভু সরকার বললে—সে তো ন্যায্য কথা।
আমি বললাম—শাসন করব একটু ভালো করেই। কাল দারোগা আমার এখানে আসচে, দারোগাবাবুকে দিয়েই বলাই। তাহলে ভয় খেয়ে যাবে এখন।
সভা থেকে ফিরবার পথে মুখুয্যে পাড়ার মোড়ে কাঁটালতলায় দেখি কে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, বোধ হয় আমার জন্যে অপেক্ষা করচে। আমি গাছতলায় পৌঁছতেই মেয়েটি হঠাৎ আমার পায়ে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শশব্যস্তে বলে উঠলাম—কে? কি হয়েচে, ছাড়ো ছাড়ো, পায়ে হাত দেয় যে—
ততক্ষণে চিনেচি, মেয়েটি শান্তি।
শান্তি লালমোহন চক্রবর্তীর মেজ মেয়ে। বছর বাইশ-তেইশ বয়েস, আমার চেয়ে অন্তত বারো-তেরো বছরের ছোট, আমাকে পাড়াগাঁ হিসাবে দাদা বলে ডাকে।
কান্না-ধরা গলায় বললে—শশাঙ্কদা, আমায় বাঁচাও। তুমি আমার বড় ভাই।
—কি হয়েছে? ব্যাপারটা কি শুনি।
—আমার নামে নাকি কি উঠেচে কথা। আমায় নাকি পুলিশে পাঠাবে, চৌকিদার দিয়ে ধরে থানাতে নিয়ে যাবে। সবাই বলাবলি করচে। তোমার পায়ে পড়ি দাদা—আমি কোনো দোষে দোষী নই—বাঁচাও আমায়।
শান্তিকে দেখে মনে দুঃখ হল, রাগও হল। লালমোহন কাকার মেয়ে গাঁয়ে বসে এমন উচ্ছন্ন যাচ্চে। এ যতই এখন মায়াকান্না কাঁদুক—আসলে এ মেয়ে ভ্রষ্টা, কলঙ্কিনী। ওর কান্না মিথ্যে ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দুঃখ হল ভেবে, লালমোহন কাকা এক পঞ্চাশ বছরের বুড়োর সঙ্গে তেরো বছরের মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভবের হাটবাজার তুলে দিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন—দু’বছর চলে না যেতে যেতেই জামাই শ্বশুরের অনুসরণ করলেন। পনেরো বছরের মেয়ে চালাঘরে মায়ের কাছে ফিরে এল সিঁথির সিঁদুর মুছে। গরিব মা, নিজের পেট চালায় সামান্য একটু জমি-জমার আয়ে। ভাইও আছে—কিন্তু সে নিজের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আলাদা বাস করে। মাকেই খেতে দেয় না—তায় বিধবা বোন!
এ অবস্থায় কেউ যদি মেয়েটিকে প্রলোভন দেখায়—বিপথে পা দিতে সে মেয়ের কতক্ষণ লাগে?
মুখে কড়া স্বরে বললুম—শান্তি, রাস্তাঘাটে সে সব কথা হয় না। আমার বাড়িতে যেও, তোমার বউদি থাকবেন, সেখানে কথাবার্তা হবে; তবে তোমাকে থানাপুলিশের ভয় যদি কেউ দেখিয়ে থাকে সে মিছে কথা। পুলিশের এতে কি করবার আছে? বাড়ি যাও, ছিঃ!
শান্তি তবুও কান্না থামায় না। আকুল মিনতির সুরে বলল—একটু দাঁড়াও দাদা, পায়ে পড়ি, একটু দাঁড়াও!
আঃ কি মুশকিল! শান্তির সঙ্গে নির্জনে কথাবার্তা বলতে দেখলে কেউ কিছু মনেও করতে পারে। ও মেয়ের চরিত্র কেমন জানতে আর লোকের বাকি নেই।
বললাম—বিশেষ কিছু বলবার আছে তোমার?
—শশাঙ্কদা, তুমি আমায় বাঁচাবে?
—হ্যাঁ হ্যাঁ—হবে, হবে। কোনো ভয় নেই।
পরক্ষণেই শান্তি এক অদ্ভুত ধরনে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলে—সত্যি শশাঙ্কদা? আমি—আমাকে—
আমি এতক্ষণ বুঝতে পারিনি ও কি বলতে চাইচে, এইবার ওর কথার সুরে ও মুখের ভাবে বুঝে নিয়ে অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চাইলাম। আমি ডাক্তার, ও সাহায্য চাইচে আমার কাছে, কিন্তু এ সাহায্য আমার দ্বারা হবে ও ভাবলে কেমন করে? আশ্চর্য!
শান্তি মুখ নিচু করে ধীরে ধীরে পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল।
অবশেষে আমার মুখে কথা ফুটলো। আমি বললাম—তুমি এতদূর নেমে গিয়েচ শান্তি? তুমি না লালমোহন কাকার মেয়ে? কত ভালো লোক ছিলেন কাকা, কত ধার্মিক ছিলেন—এ সব কথা মনে পড়ে না তোমার?
শান্তি আবার কাঁদতে শুরু করলে।
নাঃ, এ সব ছলনাময়ী ঘ্যানঘেনে প্যানপ্যানে মেয়ের প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি জাগে না। পুনরায় কড়া সুরে বললাম—আমার দ্বারা তোমার কোনো সাহায্য হবে এ তোমার আশা করাই অন্যায়। এ সবের প্রশ্রয় আমি দিই নে।
—আমার তবে কি উপায় হবে শশাঙ্কদা?
—আমি বলতে পারি নে। আমি চললাম, তোমার সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবার সময় নেই আমার।
বাড়ি এসে সুরবালাকে সব বললাম। সুরবালা বললে—ওই পোড়ারমুখীই যত নষ্টের গোড়া। রামপ্রসাদ ঠাকুরপোর কোনো দোষ নেই।
—তোমার এ কথা আমি মানলাম না।
—মেয়েমানুষের ব্যাপার তুমি কি জানো? তুমি শান্তির কান্নাতে গলে গিয়েচ, ভাবচ ও বুঝি নিরীহ, আসলে তা নয়, এই তোমাকে বললাম।
—তোমার যুক্তি আমি বুঝতে পারলাম না।
—পারবেও না। ডাক্তারিই পড়েচ, আর কিছুই জান না সংসারের।
রামপ্রসাদের উপর অত্যন্ত রাগ হল। আমাদের গ্রামের মধ্যে এমন সব কাজ যে করতে সাহস করে, তাকে ভালোভাবেই শিক্ষা দিতে হবে।
দারোগাকে একখানা চিঠি লিখে পাঠালুম। দারোগা লিখলে—একদিন আপনাদের ওখানে গিয়ে লোকটাকে এমন জব্দ করে দেব যে, সে এ মুখে আর কোনোদিন পা দেবে না।
রামপ্রসাদ চাটুয্যে লোকটি মদ খায় বলে তার ওপর শ্রদ্ধা কোনোদিনই ছিল না। কতদিন তাকে বলেছি—রামপ্রসাদদা, লিভারের অসুখ হয়ে মরবে। এখনো মদ ছাড়।
কোনোদিন সে কথায় কান দেয় নি। বলতো—কোথায় মদ খাই বেশি? তুমিও যেমন ভাই! হাতে পয়সা কোথায় যে বেশি মদ খাব?
অথচ সবাই জানে, রামপ্রসাদ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। রামপ্রসাদের বাবা হরিপ্রসাদ আবাদে কোনো এক বড় জমিদারের নায়েবী করে অনেক পয়সা রোজগার করে যথেষ্ট জায়গা-জমি রেখে গিয়েছিলেন। হরিপ্রসাদের দুই বিবাহ ছিল, দ্বিতীয় পক্ষের তিনটি ছেলে এখনও নাবালক, বিমাতা বর্তমান—রামপ্রসাদের নিজেরও দু-তিনটি মেয়ে। নাবালক বৈমাত্র ভাইগুলির ন্যায্য সম্পত্তির উপস্বত্ব একা রামপ্রসাদই ফাঁকি দিয়ে ভোগ করে। এ নিয়েও ওকে আমি একদিন বলেছিলাম। আমি গ্রামে বসে থাকতে কোনো অবিচার হতে পারবে না। রামপ্রসাদ সে কথাতেও কান দেয় নি।
দারোগা আমার বাড়িতে এল। এসে বললে—আজই আপনাদের সেই লোকটাকে ডাকান তো!
—খাওয়া দাওয়া করে ঠাণ্ডা হন, ওবেলা সকলের সামনে ওকে ডাকব।
—বেশ, তাহলে এবেলা আমি এখানে খাব না, মণিরামপুরে একটা সুইসাইডের কেস আছে, তদন্ত করে আসি, ওবেলা বরং চা খাব এসে।
দারোগা সাইকেলে চলে গেল।
বিকেলের দিকে দারোগা ফিরে এল। রামপ্রসাদের ডাক পড়ল গ্রামের পল্লীমঙ্গল সমিতির ঘরের সম্মুখবর্তী ক্ষুদ্র মাঠে। লোকজন অনেক জড় হল ব্যাপার কি দাঁড়ায় দেখবার জন্যে। রামপ্রসাদ চোখে চশমা দিয়ে ফরসা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সভায় এসে হাজির হল। গ্রামের সব লোকই আমার পক্ষে। ডাক্তারকে কেউ চটাবে না।
দারোগা রামপ্রসাদকে জিজ্ঞেস করলে—আপনার বিরুদ্ধে গ্রামের লোকের কি অভিযোগ জানেন?
রামপ্রসাদ শুষ্কমুখে বললে—আজ্ঞে—আজ্ঞে—না।
—আপনি গ্রামের একটা মেয়েকে নষ্ট করেছেন।
—আজ্ঞে, আমি!
—হ্যাঁ, আপনি।
আমার ইঙ্গিতে সনাতনদা বললে—উনি সে মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে দিনকতক রেখেছিলেন। উনি বিপত্নীক। আর একটা কথা, বাড়িতে ওঁর একটা মেয়ে প্রায় বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে, অথচ সেই মেয়েমানুষটাকে উনি বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখেন।
দারোগা বললে—আমি এমন কথা কখনো শুনি নি। ভদ্রলোকের গ্রামে আপনি বাস করেন, অথচ সেই গ্রামেরই একটি মেয়েকে আপনি এভাবে নষ্ট করেছেন?
সনাতন বললে—সে মেয়েও ভদ্রঘরের মেয়ে, স্যার। উনিই তাকে নষ্ট করেছেন।
—মেয়েটি কি জাতের?
—ব্রাহ্মণ বংশের স্যার। সে কথা বলতে আমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে—ওঁর ঘরে সোমত্ত মেয়ে, অথচ উনি—
দারোগা রামপ্রসাদের দিকে চেয়ে বললে—একি শুনছি? আপনাকে এতক্ষণ ‘আপনি’ বলছিলাম, কিন্তু আপনি তো তার যোগ্য নন—‘তুমি’ বলতে হচ্ছে এইবার। তুমি দেখছি অমানুষ। ভদ্দরলোকের গ্রামের মধ্যে যা কাণ্ড তুমি করছ, ব্রাহ্মণের ছেলে না হলে তোমাকে চাবকে দিতাম! বদমাশ কোথাকার!
রামপ্রসাদের মুখ অপমানে রাঙা হয়ে এতটুকু হয়ে গেল। সে হাজার হোক, গ্রামের সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে, চশমা চোখে, ফরসা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেড়ায়, যদিও লেখাপড়া কিছুই জানে না—এভাবে সর্বসাধারণের সমক্ষে জীবনে কখনো সে অপমানিত হয় নি। লজ্জা ও ভয়ে সে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। পুলিশকে এই সব পল্লীগ্রামে বিশেষ ভয় করে চলে লোকে, তার সঙ্গে যোগসাজস করেছে আমার মতো ডাক্তার, এ অঞ্চলে যার যথেষ্ট পসার ও প্রতিপত্তি। ভয়ে ও অপমানে রামপ্রসাদ কাঠের মতো আড়ষ্ট হয়ে দারোগার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
দারোগা বাজখাঁই আওয়াজে ধমক দিয়ে বললে—উত্তর দিচ্ছ না যে বড়, বদমাশ কাঁহাকা!
রামপ্রসাদ আমতা আমতা করে কি বলতে গেল, কেউ বুঝতে পারলে না।
আমি তবুও একটা কথা দারোগাকে এখনো বলি নি। সেটা হল শান্তির বর্তমান শারীরিক অবস্থার কথা। শান্তি যতই দুশ্চরিত্র হোক, সে আমার সাহায্য চেয়েছিল চিকিৎসক বলে। রোগীর গুপ্ত কথা প্রকাশের অধিকার নেই ডাক্তারের, সাহায্য আমি তাকে করি না করি সে আলাদা কথা।
বৃদ্ধ চৌধুরী মশাই আমায় বললেন—যথেষ্ট হয়েছে বাবাজী, হাজার হোক ব্রাহ্মণের ছেলে, ওকে ছেড়ে দাও এবার। কাঁদো-কাঁদো হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু রামপ্রসাদ কাঁদো-কাঁদো হয় নি, ওটা বৃদ্ধের ভুল। ভয়ে ও এমন হয়ে গিয়েছে। বাপের অনেক সম্পত্তি ছিল, তার বলে সে বাবুগিরি করছে, লোকের উপর কিছু কিছু প্রভুত্বও করেছে, কিন্তু লেখাপড়া না শেখার দরুন দারোগা পুলিশকে তার বড় ভয়। পুলিশের দারোগা দিন-দুনিয়ার মালিক এই তার ধারণা। আমি এটুকু জানতাম বলেই আজ দারোগাকে এনে তাকে শাসনের এই আয়োজন। নইলে অনেক ভালো কথা বলে দেখেছি, অনেক শাসিয়েছি, তাতে কোনো ফল হয় নি। আমি চৌধুরী মশাইকে বললাম—ওকে ভালো করে শিক্ষা না দিয়ে আজ ছাড়ছি নে। এ ধরনের দুর্নীতির প্রশ্রয় দিতে পারি নে গাঁয়ে।
রামপ্রসাদ হাতজোড় করে বললে—এবারের মতো আমায় মাপ করুন দারোগাবাবু—
দারোগা বললে—আমি তোমার কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেব—যাতে এমন কাজ আর কখনো ভদ্রলোকের গ্রামে না করো। তাতে লিখে দিতে হবে—
রামপ্রসাদ আরও ঘাবড়ে গিয়ে বললে—এবারের মতো আমায় মাপ করুন দারোগাবাবু।
—মুচলেকা না দিয়েই? কক্ষনো না। লেখো মুচলেকা!
পাড়াগাঁয়ের লোক রামপ্রসাদ, যতই শৌখিন হোক বা বাবু হোক, পুলিশ-টুলিশের হাঙ্গামাকে যমের মতো ভয় করে। আমি জানি এ মুচলেকা দেওয়ার কোনো মূল্যই নেই আইনের দিক থেকে, কোনো বাধ্যবাধকতাই নেই এর—রামপ্রসাদ কিন্তু ভয়ে কাঁটা হয়ে গেল মুচলেকা লিখে দেওয়ার নাম শুনে।
—দাও, দাদা—লেখো আগে।
—এবার দয়া করুন দারোগাবাবু। আমি বরং এ গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, বলুন আপনি—
—কোথায় যাবে?
—পাশের গ্রামে বর্ধমবেড়ে চলে যাই। আপনি যা বলেন।
—সেই মেয়েটিকে একেবারে ছেড়ে চলে যেতে হবে—
—আপনার যা হুকুম।
দারোগা আমার দিকে চেয়ে বললে—তাহলে তাই করো। বছরখানেক এ গাঁ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও। মেয়েটির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না আর, এই বলে দিচ্ছি।
—যে আজ্ঞে—
—ক’দিনের মধ্যে যাবে?
—পনেরোটা দিন সময় দিন আমায়।
—তাই দিলাম। যাও, এখন চলে যাও।
দারোগাবাবু আমার বাড়ি চা খেতে এসে বললে—কেমন জব্দ করে দিয়েছি বলুন ডাক্তারবাবু? আর কখনো ও এপথে পা দেবে না, যদি ওর জ্ঞান থাকে। কি বলেন?
—আমার তাই মনে হয়।
—কবে আমার ওখানে আসছেন বলুন—একদিন চা খাবেন আমার বাড়ি।
—হবে সামনের সপ্তায়।
—ঠিক তো? কথা রইল কিন্তু।
—নিশ্চয়ই।
দারোগা চলে গেলে সুরবালার সঙ্গে দেখা হল বাড়ির ভেতরে। সে বললে—হ্যাগা, আমি কি তোমার জ্বালায় গলায় দড়ি দেব, না মাথা কুটে মরবো?
—কেন, কি হল?
—কি হল? কেন তুমি রামপ্রসাদবাবুকে আজ অমন করে পাঁচজনের সামনে অপমান করলে বলো তো? তোমার ভীমরতি ধরবার বয়েস তো এখনও হয় নি?
—কে বললে তোমাকে এসব কথা?
সুরবালা ঝাঁঝের সঙ্গে বললে—আমার কানে কথা যায় না ভাবছ? সব কথা যায়। নাক-ছেঁদা গিন্নি এসে আমায় সব কথা বলে গেল—বৌমা, এই রকম কাণ্ড। নাক-ছেঁদা গিন্নি অবিশ্যি খুব খুশি। তোমাকে নমস্তস্যৈ কে না করবে এ গাঁয়ের মধ্যে! এ কাজটা কি ভালো?
—নাক-ছেঁদা গিন্নি এ সংবাদ এর মধ্যে পেয়ে গিয়েছেন? বাবাঃ, গাঁয়ের গেজেট কি আর সাধে বলে! তা কি বকবে শুধুই, না খেতে টেতে দেবে আজ?
সুরবালা আর এক দফা সদুপদেশ বর্ষণ করলে খাওয়ার সময়। গ্রামের মধ্যে কে কি করছে সে সব কথার মধ্যে আমার থাকার দরকার কি? নিজের কাজ ডাক্তারি, তা নিয়ে আমি থাকতেই তো পারি। সব কাজের মধ্যে মোড়লি না করলে কি আমার ভাত হজম হয় না?
আমি ধীরভাবে বললাম—তা বলে গাঁয়ে যে যা খুশি করবে?
—করুক গে, তোমার কি? যে পাপ করবে, ঈশ্বর তার বিচার করবেন। তোমার সর্দারি করতে যাওয়ার কি মানে? অপরের পাপের জন্যে তোমায় তো দায়ী হতে হবে না।
—কি জানো, তুমি মেয়েমানুষের মতো বলছ। আমি এখন এ গাঁয়ে পল্লীমঙ্গল সমিতির সেক্রেটারি, পাঁচজনে মানে চেনে। এ আমি না দেখলে কে দেখবে বলো। গ্রামের নীতির জন্যে আমি দায়ী নিশ্চয়ই।
—বেশ, ভালো কথায় বুঝিয়ে বল না, কে মানা করেছে? অপমান করবার দরকার কি?
—বুঝিয়ে বলি নি? অনেক বলেছি। শুনতো যদি তবে আজ আমায় এ কাজ করতে হত না।
সুরবালা যা-ই বলুক, সে মেয়েমানুষ, বোঝেই বা কি—আমি কিন্তু আত্মপ্রসাদ অনুভব করলাম সে রাত্রে। আমি থাকতে এ গ্রামে ও সব ঘটতে দেব না। একটা পুরুষমানুষ ভুলিয়ে একটা সরলা মেয়ের সর্বনাশ করবে, এ আমি কখনই হতে দিতে পারি নে।
সুরবালা এখানে আমার সঙ্গে এক মত নয়। সে বলে রামপ্রসাদের দোষ নেই। শান্তিই ওকে ভুলিয়েছে। অসম্ভব কথা, শান্তিকে আমি এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি, মাখন মাস্টারের স্কুলে যখন পড়ি, শান্তি তখন ছোট্ট শাড়ি পরে সাজি হাতে পাঠশালার বাগানে ফুল তুলতে আসত, আঁচলে বেঁধে গুগলি কুড়িয়ে নিয়ে যেত নাক-ছেঁদা গিন্নিদের ডোবা থেকে—সেই শান্তি কাউকে ভোলোতে পারে!
সকালে উঠে আমি দূরগ্রামে ডাকে চলে গেলাম। ফিরে আসতেই সুরবালা বললে—আজ খুব কাণ্ড হয়ে গেল—কি হাঙ্গামাই তুমি বাধিয়েছ!
—কি হল?
—শান্তি ঠাকুরঝি সকালে এসে হাজির। কেঁদেকেটে মাথা কুটে সকালবেলা সে এক কাণ্ডই বাধালো। আমার পায়ে ধরে সে কি কান্না, বলে—শশাঙ্কদা এ কি করলেন? আমি তাঁকে বিশ্বাস করে সব কথা বললাম, অথচ তিনি—
সুরবালা সব কথা জানে না, আমি বললাম—ওর ভুল। ওর কোনো গোপন কথা সেখানে প্রকাশ করিনি—
সুরবালা অবাক হয়ে বললে—কর নি?
—কক্ষনো না।
সুরবালা আশ্বস্ত হওয়ার সুরে বললে—যাক, এ কথা আমি কালই বলব শান্তিকে।
আমি রেগে বললাম—ওকে আর বাড়ি ঢুকতে দিও না—
—ছিঃ ছিঃ, মানুষের ওপর অত কড়া হতে নেই, তুমি তাকে কিছু বলতে পারো তোমার বাড়ি এলে?
—খুব পারি, যার চরিত্র নেই সে আবার মানুষ?
—আমার একটা কথা রাখবে লক্ষ্মীটি?
—কি?
—থাকগে তোমার ডাক্তারি। চল এ গাঁ থেকে আমরা দিনকতক অন্য জায়গায় চলে যাই।
—কেন বল তো?
—কেন জানি নে। তোমার মোড়লগিরি দিনকতক বন্ধ রাখ। লোকের শাপমন্যি কুড়িয়ে কি লাভ? রামপ্রসাদকে দারোগা গাঁ ছেড়ে যেতে বলেছে—এটা কি ভালো?
—ওই এক কথা পঞ্চাশ বার আমার ভালো লাগে না। যে দুশ্চরিত্র, তাকে কখনো এ গাঁয়ে আমি শান্তিতে থাকতে দেব না।
—আমার কথা শোনো লক্ষ্মীটি, তোমার ভালো হবে।
কিন্তু ওসব কথায় কান দিতে গেলে পুরুষমানুষের চলে না। মনে মনে শান্তির ওপর খুব রাগ হল। আমার বাড়িতে আসবার কোনো অধিকার নেই তার। এবার ঢুকলে তাকে অপমান হতে হবে।
সনাতনদা বিকেলের দিকে আমার এখানে চা খেতে এসে হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি। বলে— আরে, তুমি যা করলে—বাবাঃ—পেটে খিল ধরে যাচ্ছে হেসে—
—কি, হয়েছে কি সনাতনদা?
সনাতনদা দম নিয়ে বললে—ওঃ! রও, একটু সামলে নিই—
—কি ব্যাপার?
—হ্যাঁ, জব্দ করে দিলে বটে! বাবাঃ, কুঁদির মুখে বাঁক থাকে? কার সঙ্গে লেগেছে রামপ্রসাদ ভেবে দেখেছে কি? পুরুষমানুষের মতো পুরুষমানুষ বটে তুমি! সমাজে চাই এমনি বাঘের মতো মানুষ, নইলে সমাজ শাসন হবে কি করে?
সনাতনদার কথাগুলো আমার ভালোই লাগলো। সনাতনদাকে লোকে দোষ দেয় বটে, কিন্তু ও খাঁটি কথা বলে। বেঁটেখোটো লোক, অপ্রিয় কথাও বলতে অনেক সময় ওর বাধে না। অমন লোক আমি পছন্দ করি।
তবুও আমি বললাম—যাক, পরনিন্দে করে আর কি হবে সনাতনদা, ওতে যদি রামপ্রসাদটা ভালো হয়ে যায়, আমি তাই চাই। ওর ওপর অন্য কোনো রাগ নেই আমার।
সনাতনদা গলার সুর নিচু করে বললে—ও কাল কি করেছিল জানো? তোমাদের ওই ব্যাপারের পরে কাল বড় মুখুয্যে মশায়ের কাছে গিয়েছিল। গিয়ে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললে—আমাকে পাঁচজনের সামনে এই যে অপমানটা করলে, আপনারা একটা বিহিত করুন। নইলে গ্রামে বাস করি কি করে?
—কি বললেন জ্যাঠামশায়?
—বললেন, শশাঙ্ক হল গ্রামের ডাক্তার—শুধু ডাক্তার নয়, বড় ডাক্তার। বিপদে আপদে ওর দ্বারস্থ হতেই হয়। তার বিরুদ্ধে আমরা যেতে পারব না। এই কথা বলে বড় মুখুয্যে মশায় বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। সত্যিই তো, ছেলেপিলে নিয়ে সবাই ঘর করে, কে তোমাকে চটিয়ে গাঁয়ে বাস করবে বল তো?
—তা নয় সনাতনদা। এ জন্যে আমায় কেউ খোশামোদ করুক—এ আমি চাই নে। ডাক্তারি আমার ব্যবসা, কিন্তু সমাজের প্রতিও আমার একটা কর্তব্য আছে, যেটা খুব বড়। যতই তার ওপর রাগ থাকুক, বিপদে পড়ে ডাকতে এলে বরং শত্রুর বাড়ি আমি আগে যাব। ওই রামপ্রসাদদার যদি আজ কোনো অসুখ হয়, তুমি সকলের আগে সেখানে আমায় দেখতে পাবে।
সনাতনদা কথাটা শুনে একটু বোধ হয় অবাক হয়ে গেল, আমার মুখের দিকে খানিকটা কেমন ভাবে চেয়ে রইল। তারপর কতকটা আপন মনেই বললে—শিবচরণ কাকার ছেলে তুমি, তিনি ছিলেন মহাপুরুষ লোক, এমন কথা তুমি বলবে না তো কে বলবে?
সনাতনদা আমার মন রাখবার জন্যে বললে। কারণ এ গ্রামে কে না জানে, আমার বাবা তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির অর্ধেক উড়িয়েছিলেন মদে আর মেয়েমানুষে। তবে শেষের দিকে হাতে পয়সা যখন কমে এল, তখন হঠাৎ তিনি ধর্মে মন দেন এবং দানধ্যান করতে শুরু করেন। প্রতি শীতকালে গরিব লোকের মধ্যে বিশ-ত্রিশখানা কম্বল বিলি করতেন, কাপড় দিতেন—এসব ছেলেবেলায় আমার দেখা। পৈতৃক সম্পত্তির যা-কিছু অবশিষ্ট ছিল, তা তিনি উড়িয়ে দেন এই দানধ্যানের বাতিকে। কেবল এই বসত বাড়িটুকু ঘুচিয়ে দিতে পারেননি শুধু এই জন্যে যে, সেকালে লোকের ধর্ম ছিল, ব্রাহ্মণের ভদ্রাসন কেউ মর্টগেজ রাখতে রাজি হয় নি।
সন্ধ্যার সময় ওপাড়া থেকে ফিরছি, পথে আবার শান্তির সঙ্গে দেখা। দেখা মানে হঠাৎ দেখা নয়, যতদূর বুঝলাম, শান্তি আমার জন্যে ওৎ পেতে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। বললাম—কি শান্তি, ব্যাপার কি? এখানে দাঁড়িয়ে এ সময়?
শান্তি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে বললে—তোমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি শশাঙ্কদা।
আমি বড় বিপদে পড়ে গেলাম। এ ভাবে নির্জন পথে শান্তির মতো মেয়ের সঙ্গে কথা বলা আমি পছন্দ করি নে। বললামও কথাটা। তার দরকার থাকে, আমার বাড়িতে সে যেতে পারে। তার বৌদির সামনে কথাবার্তা হবে। পথের মাঝখানে কেন?
শান্তি বললে—শশাঙ্কদা, তোমার ওপর আমার ভক্তি আগেও ছিল, এখন আরও বেশি।
আমি এ কথা ওর মুখ থেকে আশা করি নি, করেছিলাম অনুযোগ—তাও নিতান্ত গ্রাম্য ধরনে, অর্থাৎ গালাগালি। তার বদলে এ কি কথা! এই কথা শোনাবার জন্যে ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে! বিশ্বাস হল না।
বললাম—আসল কথাটা কি শান্তি?
—আর কিছু না, মাইরি বলচি শশাঙ্কদা—
—বেশ, তুমি বাড়ি যাও—
শান্তি একটু হেসে বললে—আমার একটা কথা রাখবে শশাঙ্কদা? তোমার ডাক্তারখানা থেকে আমায় একটু বিষ দিতে পার?
আমার বড় রাগ হয়ে গেল। বললাম—ঘোর-পেঁচ কথা আমি ভালোবাসি নে, যা বলবে সামনা-সামনি বলো। ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিলাম—কোনো কথা থেকে এ কোন কথার আমদানি করলে? বিষ কি হবে? খেয়ে মরবে তো? তা অনেক রকম উপায় আছে মরবার। আমায় এর জন্যে দায়ী করতে চাও কেন জিজ্ঞেস করি? ভক্তি আছে বলে বুঝি?
শান্তি বললে—ঠিক বলেছ দাদা। আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকবো না। দাঁড়াও একটু পায়ের ধুলো দ্যাও দাদা—
কথা শেষ করেই শান্তি আমার পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে দুহাতে পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দিলে। মনে হল, ও কাঁদচে, কারণ কথার শেষের দিকে ওর গলা কেঁপে গেল যেন।
পায়ের ধুলো নিয়ে মাথা তুলেই ও আর কোনো কথাটি না বলে চলে যেতে উদ্যত হল।
আমার তখন রাগটা কেটে গিয়ে একটু ভয় হয়েছে। মেয়ে-মানুষকে বিশ্বাস নেই, সত্যি সত্যি মরবে নাকি রে বাবা!
বললাম—দাঁড়াও, একটা কথা আছে শান্তি।
শান্তি ফিরে দাঁড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বললে—কি?
—সত্যি সত্যি মরো না যেন তাই বলে।
—তা ছাড়া আমার কি আছে করবার? সমাজের পথ আজ বন্ধ হল, সব পথ বন্ধ হল, বেঁচে থেকে লাভ কি বলো?—
—সমাজের পথ কে বন্ধ করলে? অন্য লোকের দোষ দাও কেন, নিজের দোষ দেখতে পাও না?
—আমি কারো দোষ দিচ্ছি নে শশাঙ্কদা, সবই আমার এই পোড়া অদৃষ্টের দোষ—কথা শেষ করে শান্তি নিজের কপালে হাতের মুঠো দিয়ে মারতে লাগল, আর থামে না।
ভালো বিপদে পড়ে গেলাম এ সন্ধ্যাবেলায় পথের মধ্যে। বাধ্য হয়ে ওর কাছে গিয়ে ধমক দিয়ে বললাম—এই! কি হচ্ছে ও সব?
শান্তি তবুও থামে না, আমি তখন আর কি করি, ওর হাতখানা ধরে ফেলে বললাম—ছিঃ ওরকম করতে নেই—যাও, বাড়ি যাও—কি কেলেঙ্কারি হচ্ছে এ সব?
শান্তি বললে—না দাদা, আর কেলেঙ্কারি করে তোমাদের মুখ হাসাবো না। নিজের ব্যবস্থা নিজেই করছি শীগগির—বলে আবারও সেই রকম অদ্ভুত হাসলে।
—আর যাই করো, আত্মহত্যা মহাপাপ, ও কোর না—
—কে বললে?
—আমি বলছি। শাস্ত্রে আছে।
শান্তি হেসে বললে—আচ্ছা দাদা, তোমরা শাস্তর মানো?
—মানি।
—আত্মহত্যে হলে কি হয়?
—গতি হয় না।
—বেশ তো, হ্যাঁ দাদা, আমি মলে তুমি গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসতে পারবে না আমার নামে? বেঁচে থাকতে না পার পোড়ারমুখী বোনের উপকার সাহায্য করতে—মরে গেলে কোর।
শান্তির কথা শুনে আমার বড় মমতা হল ওর ওপর। কেমন এক ধরনের মমতা। সুর নরম করে বললাম—ও সব কিছু করতে হবে না শান্তি—
—তা হলে বলো তুমি উপকার করবে?
—তোমার উপকার করা মানে মহাপাপ করা। তুমি যে উপকারের কথা বলছ, তা কখনও ভালো ডাক্তারে করে না। আমি নিরুপায়।
—সত্যি দাদা, সাধে কি ভক্তি হয় তোমার ওপর? তোমার পায়ের ধূলির যোগ্য কেউ নেই এ গাঁয়ে।
—আমার কথা ছেড়ে দাও শান্তি। আর একজন আছে এ গাঁয়ে—সে সত্যিই কোনো দুর্নীতি দেখতে পারে না সমাজের—সনাতনদা।
শান্তি অবিশ্বাসের সুরে বললে—তুমি এদিকে বড্ড সরল শশাঙ্কদা, ওকে তুমি বিশ্বাস করো?
—কেন?
—সনাতনদা এসেছে কাজ বাগাতে তোমার কাছে। খোশামোদ করা ছাড়া ওর অন্য কোনো কাজ নেই—
—যাকগে, ও কথার দরকার নেই, আমার কাছে কথা দিয়ে যাও তুমি, আত্মহত্যার কথা ভাববে না।
—আমার উপায় হবে কি তবে?
—সে আমি জানি নে। তার কোনো ব্যবস্থা আমায় দিয়ে হবে না।
—তা হলে আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করি, তুমি যখন কিছুই করবে না—
শান্তি চলে গেল বা ওকে আমি যেতেই দিলাম। আর বেশিক্ষণ ওর সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা আমার উচিত হবে না। হয়তো কেউ দেখে ফেলবে, তখন পাঁচজনে পাঁচকথা বলতে শুরু করে দেবে, শান্তির যা সুযশ এ গাঁয়ে!
বাড়ি ফিরে সুরবালাকে কথাটা এবার আর বললাম না কি ভেবে, কিন্তু সারা রাত ভালো ঘুম হল না। সত্যি, শান্তির উপায় কি? একা মেয়েমানুষ, কি করে এ দারুণ অপযশ থেকে নিজেকে রক্ষা করবে,—আর হয়তো ছ’মাস পরে সে বিপদের দিন ওর জীবনে এসে পড়বেই। আমার দ্বারা তখন সাহায্য হতে পারে, তার পূর্বে নয়।
কিন্তু সকালবেলা যা কানে গেল তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
বেলা সাড়ে আটটা। সবে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি, এমন সময় সনাতনদা আর মুখুয্যে জ্যাঠামশায়ের বড় ছেলে হারাধন হন্তদন্ত হয়ে হাজির। ওদের চেহারা দেখে আমি বুঝলাম, একটা কিছু ঘটেছে! আমি কিছু বলবার পূর্বেই সনাতনদা বললে—এদিকে শুনেছ কাণ্ড?
—কি ব্যাপার?
—শান্তি আর রামপ্রসাদ দুজনে কাল ভেগেছে।
—কে বললে? কোথায় ভাগলো?
—নাক-ছেঁদা গিন্নি ভোরবেলায় পুজোর ফুল তুলতে গিয়েছিলেন বড় মুখুয্যে মশায়ের বাড়ি। তিনি শুনলেন শান্তির মা ঘরের মধ্যে কাঁদছে। শান্তি নেই, তার বাক্সের মধ্যে কাপড় ও দু-একখানা যা সোনার গহনা ছিল তাও নেই। ওদিকে দেখা গেল রামপ্রসাদও নেই।
—আমি অবাক হয়ে বললাম—বল কি?
সনাতনদা বললে,—তোমার কাছে গাঁ-সুদ্ধ সবাই আসছে শান্তির মাকে নিয়ে। এর কি করবে করো।
আমি বললাম—এর কিছু উপায় নেই সনাতনদা। শান্তি নিজের পথ নিজে করেছে। আপদ গেছে গাঁয়ের। এ নিয়ে কোনো গোলমাল হয় এ আমার ইচ্ছে নয়।
সুরবালা বললে—মেয়েমানুষকে চিনতে এখনও তোমার অনেক দেরি। শান্তি ঠাকুরঝিকে বড্ড ভালোমানুষ ভেবেছিলে, না?
বর্ষা নেমেছে খুব। দুজায়গায় ডাক্তারখানায় যাতায়াত, জলকাদায় সাইকেল চলে না—গরুর গাড়ি যেখানে চলে সেখানে গরুর গাড়ি, নয়তো নৌকো যেখানে চলে নৌকো। ছইয়ের বাইরে বসে দেখি বাঁকে বাঁকে পাড়-ভাঙা ডুমুর গাছ কিংবা বাঁশঝাড়ের নীচে বড় বড় শোলমাছ ঘোলা জলে মুখ উঁচু করে খাবি খাওয়ার মতো ভাসছে, কোথাও ভুস করে ডুব দিলে মস্ত বড় কচ্ছপটা।
মঙ্গলগঞ্জের কুঠিঘাটে নৌকো বাঁধা হয়। নেমে যেতে হয় সিকি মাইল দূরে মঙ্গলগঞ্জের বাজারে—এখানেই আমার একটা শাখা ডাক্তারখানা আজ দুমাস হল খুলেছি। সপ্তাহের মধ্যে বুধবার আর শনিবার আসি। সনাতনদা কোনো কোনো দিন আসে আমার সঙ্গে, কোনো দিন একাই আসি।
ডাক্তারখানা মঙ্গলগঞ্জের ক্ষুদ্র বাজারটির ঠিক মাঝখানে। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে। এখানকার লোকের পীড়াপীড়িতেই এখানে ক্লিনিক খুলেছি, নয়তো রোগীর ভিড় কোনোদিনই কম পড়েনি আমাদের গ্রামে। এখানেও লেখা আছে সমাগত দরিদ্র রোগীগণকে বিনা দর্শনীতে চিকিৎসা করা হয়।
ডাক্তারখানায় পৌঁছবার আগেই সমবেত রোগীদের কলরব আমার কানে গেল।
কম্পাউন্ডার রামলাল ঘোষ দূর থেকে আমায় আসতে দেখে প্রফুল্লমুখে আবার ডিসপেনসারি ঘরের মধ্যে ঢুকল। আমার মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অত ভিড় দেখে। ভেবেছিলাম কাজ সেরে সকাল সকাল সরে পড়ব এবং সন্ধ্যার আগে বাড়ি পৌঁছে চা খেয়ে সনাতনদার সঙ্গে বসে এক বাজি পাশা খেলব, তা আজ হল না দেখচি।
—কত লোক?
—প্রায় পঁয়ত্রিশজন ডাক্তারবাবু।
—গরুর গাড়ি?
—দু’খানা।
—মেয়ে রোগী?
—সাত জন।
—খাতা নিয়ে এসো, তাড়াতাড়ি করো—
রামলাল ঘোষ হেসে বললে—বাবু, তা হবে না। দুটো অপারেশনের রোগী।
অপ্রসন্ন মুখে বললাম—কি অপারেশন? কি হয়েছে?
—একজনের ফোঁড়া, একজনের হুইটলো।
—দূর, ওসব আবার অপারেশন? নরুন দিয়ে চেরা—তুমি আমায় ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে। ডাক দাও সব জলদি জলদি—মেঘ আবার জমে আসছে। একটু চা খাওয়াবে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, বড় স্টোভটা তো জ্বালতেই হবে, জল গরমের জন্যে। আগে চা করে দিই।
এই সময় বাজারের বড় ব্যবসাদার জগন্নাথ কুণ্ডু এসে নমস্কার করে বললে—ডাক্তারবাবু, ভালো তো?
—নিশ্চয়ই, নয়তো এই দুর্যোগে কাজে আসি?
—একটা কথা, কিছু চাঁদা দিতে হবে। সামনের ঝুলনের দিন এখানে ঢপ দেবো ভাবছি।
—তা বেশ। কোথাকার ঢপ?
—এখনো কিছু ঠিক করি নি। কেষ্টনগরের রাধারানী, রানাঘাটের গোলাপী কিংবা নদে শান্তিপুরের—
—আচ্ছা আচ্ছা, যা হয় করবেন, আমার যা ক্ষমতা হয় দেব নিশ্চয়ই। এখন কাজের ভিড়ের সময় বসে বসে বাজে গল্প করবার অবসর নেই আমার।
জগন্নাথ কুণ্ডু যাবার সময় বলে গেল—ওদিকে গিয়ে একবার কাজকর্ম দেখবেন টেকবেন, আপনারা দাঁড়িয়ে হুকুম দিলে আমরা কত উৎসাহ পাই।
অপারেশন করে নৌকোতে ওঠবার যোগাড় করছি, এমন সময় এক নূতন রোগী এল। তার কোমরে বেদনা, আরও সব কি কি উপসর্গ। মুখ খিঁচিয়ে বলি—আজ আর হবে না, একটু আগে আসতে কি হয়?
—বাবু, বাড়িতে কেউ নেই, মোর ছোট ছেলেডা হাতে ধরে নিয়ে এল, তবে এ্যালাম। একটু দয়া করুন—
আবার আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল, যা ভেবেছিলুম সেই সন্ধেই নামল। এ সময়ে অন্তত জন্তিপুরের ঘাট পেরুনো উচিত ছিল। নৌকায় উঠে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। রুগীদের বিরক্তিকর একঘেয়ে বোকা বোকা কথা, স্টোভের ধোঁয়ার সঙ্গে মেশানো আইডোফরমের গন্ধ, ফিলটার থেকে জল পড়বার শব্দ, সামান্য কুইনিন ইনজেকসন করবার সময় চাষীদের ছেলেমেয়েদের বিকট চিৎকার, যেন তাদের খুন করা হচ্ছে গলা টিপে—এ সব মানুষের কতক্ষণ ভালো লাগে?
মাঝিকে বললাম—বাপু অভিলাষ, একটু বেশ নদীর মাঝখান দিয়ে চল, হাওয়া গায়ে লাগুক।
—বাবু, কুঁদিপুরের বাঁওড়ের মুখে গলদাচিংড়ি মাছ নেবেন বললেন যে?
—সে তো অনেক দূর এখনো। একটু তো চলো।
সারাদিনের পর যখন কাজটি শেষ করি তখন সত্যিই বড় আরাম পাই। মঙ্গলগঞ্জ থেকে ফেরবার পথে এ নৌকাভ্রমণ আমি বড় উপভোগ করি। সনাতনদা সঙ্গে থাকলে আরও ভালো লাগে। একা থাকলে বসে বসে দেখি, উঁচু পাড়ের গায়ে গাঙশালিকের গর্ত, খড়ের বনের পাশে রাঙা টুকটুকে মাকাল ফল লতা থেকে দুলছে, লোকে পটলের ক্ষেত নিডুচ্চে।
ভেবে দেখি, ভগবান আমায় কোনো কিছুর অভাব দেন নি। বাবা যা জায়গা-জমি রেখে গিয়েছেন, আর আমি যা করেছি তার আয় ভালোই, অন্তত ষাট-সত্তর ঘর প্রজা আছে আশেপাশের গাঁয়ে। আম-কাঁঠালের বড় বড় দুটো বাগান, তিনটে ছোট বড় পুকুর, পঁয়ত্রিশ বিঘে ধানের জমিতে যা ধান হয় তাতে বছরের চাল কিনতে হয় না। সুরবালার মতো স্ত্রী। পাড়াগাঁয়ে অত বড় বাড়ি হঠাৎ দেখা যায় না—অন্তত আমাদের এ অঞ্চলের পাড়াগাঁয়ে বেশি নেই। নিজে ভালো ডাক্তার, মেডিকেল কলেজের ভালো ছেলেই ছিলাম। কেষ্টনগরে কিংবা রানাঘাটে ডাক্তারখানা খুলতাম কিন্তু বাবা নিষেধ করেছিলেন। তখন তিনি বেঁচে, আমি সবে পাশ করেছি মাস দুই হল। খুলনা জেলার জয়দিয়া গ্রামে আমার এক মাসিমা ছিলেন, তিনি আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন, পরীক্ষা দিয়ে তাঁদের ওখানে মাস-দুই গিয়ে ছিলাম। সেখানেই খবর গেল পাশের। বাড়ি ফিরতেই বাবা জিগ্যেস করলেন—কোথায় বসবে, ভাবলে কিছু?
—তুমি কি বলো?
—আমি যা বলি পরে বলব, তোমার ইচ্ছেটা শুনি।
—আমি তো ভাবছি রানাঘাট কিংবা কেষ্টনগরে—
—অমন কাজও কর না।
—তবে কোথায় বলো?
—এই গ্রামে বসবে। সেই জন্যে তোমাকে চাকরি করতে দিলাম না, তুমি শহরে গিয়ে বসলে গাঁয়ের দিকে আর দেখবে না, এ বাড়িঘর কত যত্নে করা—সব নষ্ট হবে। অশত্থ গাছ গজাবে ছাদের কার্নিসে, আম-কাঁঠালের বাগান বারোভূতে খাবে। পৈতৃক ভিটেয় পিদিম দেবার লোক থাকবে না। গাঁয়ের লোকও ভালো ডাক্তার চেয়েও পাবে না। এদের উপকার করো।
বাবার ইচ্ছার কোনো প্রতিবাদ করি নি। আমার অর্থের কোনো লালসা ছিল না। সচ্ছল গৃহস্থঘরের ছেলে, খাওয়া পরার কষ্ট কখনো পাই নি। গ্রামে থেকে গ্রামের লোকের উন্নতি করব—এ ইচ্ছাটা আমার চিরকাল আছে—ছাত্রজীবন থেকেই।
গ্রামের লোকের ভালো করব এই দাঁড়ালো বাতিক। এর জন্যে যে কত খেটেছি, কত মিটিং করে লোককে বুঝিয়েছি! পল্লীমঙ্গল সমিতি স্থাপন করেছি, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গ্রামের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়েছি, গাঁয়ে গাঁয়ে গিয়ে জন-স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়েছি।
ঠিক সেই সময় একটি ঘটনা ঘটল।
হরিদাস ঘোষের স্ত্রীর নামে নানা রকম অপবাদ শোনা গেল। বাইশ-তেইশ বছরের যুবতী, স্বামী কলকাতায় ঘিয়ের দোকান করে, মাসে দু-একবার বাড়ি আসে কি-না সন্দেহ। পাশের বাড়ির নিবারণ ঘোষের ভাইপোকে নাকি লোকে দেখেচে অনেক রাত্রে হরিদাসের ঘর থেকে বেরুতে। আমার কাছে রিপোর্ট এল। দুর্নীতির ওপর আমি চিরদিন হাড়ে চটা, মেয়েটিকে কিছু না বলে নিবারণ ঘোষের ভাইপোকে একদিন উত্তম মধ্যম দেওয়া গেল। হরিদাস ঘোষকেও পত্র লেখা গেল। তারপর কিসে থেকে কি ঘটলো জানি নে, একদিন হরিদাসের স্ত্রীকে রান্নাঘরের আড়া থেকে দোদুল্যমান অবস্থায় দেখা গেল। গোয়ালের গরুর দড়ি দিয়ে একাজ নিষ্পন্ন হয়েচে। তাই নিয়ে হৈ চৈ হল, আমি মাঝে থেকে পুলিশের হাঙ্গামা মিটিয়ে দিলাম।
লোকের ভালো করতে গিয়ে অপবাদ কুডুতেও আমি পেছপা নই। দুর্নীতিকে কোনো রকমে প্রশ্রয় দেব না এ হল আমার প্রতিজ্ঞা। এতে যা হয় হবে। বড় মুখুয্যেমশায় গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও প্রবীণ লোক। কোনো মামলা মোকদ্দমা বাধলে মিটিয়ে দেবার জন্যে উভয় পক্ষ তাঁকে গিয়ে ধরতো। দু পক্ষ থেকে প্রচুর ঘুষ খেয়ে একটা যা হয় খাড়া করতেন। আমি ব্যবস্থা করলাম, পল্লীমঙ্গল সমিতির পক্ষ থেকে গ্রামের ঝগড়া-বিবাদের সুমীমাংসা করে দেওয়া হবে, এজন্যে কাউকে কিছু দিতে হবে না। দু-একটা বিবাদ এভাবে মিটিয়েও দেওয়া গেল। মুখুয্যে জ্যাঠামশায় আমার ওপর বেজায় বিরক্ত হয়ে উঠচেন শুনতে পেলাম। একদিন আমায় ডেকে বললেন—শশাঙ্ক, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।
—আজ্ঞে বলুন জ্যাঠামশায়।
—তুমি এসব কি করচো গাঁয়ে?
—কি করচি বলচেন?
—চিরকাল মুখুয্যেদের চণ্ডীমণ্ডপে সব ব্যাপারের মুড়ো মরেচে। তোমায় কাল দেখলাম ন্যাংটো হয়ে বেলতলায় খেলে বেড়াতে, তুমি এ সবের কি বোঝো যে মামলার মীমাংসা করো। আর যদিই বা করলে তো নমস্কারি বলে কিছু আদায় করো। একদিন লুচি পাঁটা দিক ব্যাটারা। শুধু হাতে ও কাজে গেলে মান থাকে না বাপু। ওটা গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরের হক পাওনা, দু’টাকা জরিমানা করলে, একটাকা বারোয়ারি ফান্ডে দিলে, একটাকা নিলে নিজের নজর—এই তো হল বনেদি চাল। তবে লোকে ভয় করবে, নইলে যত ব্যাটা ছোটলোক মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে যে!
—আপনাদের কাল চলে গিয়েচে জ্যাঠামশায়। এখন আর ওসব করতে গেলে—
মুখুয্যে জ্যাঠামশায়ের গলার শির ফুলে উঠল উত্তেজনায়। চোখ বড় বড় হল রাগে। হাত নেড়ে বললেন—কে বলেচে, চলে গিয়েচে? কাল এতটুকু চলে যায় নি। তোমরা যেতে দিচ্চ। কলেজে-পড়া চোখে-চশমা ছোকরা তোমরা, সমাজ কি করে শাসনে রাখতে হয় কি বুঝবে? সমাজ শাসন করবে, প্রজা শাসন করবে জুতিয়ে। তুমি থেকো না এর মধ্যে, শুধু বসে বসে দ্যাখো, আমার চণ্ডীমণ্ডপে বসে জুতিয়ে শাসন করতে পারি কি না।
আমি হেসে বললাম—সে জানি, আপনি তা পারেন জ্যাঠামশায়। কিন্তু আজকাল আর ওসব চলবে না।
মুখুয্যে জ্যাঠা ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললেন—আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে বসে শুধু দ্যাখো বাবাজি—
কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল যুগ সত্যিই বদলে যাচ্চে। নইলে কেউ কি কখনো শুনেচে তাঁর বড় ছেলের চেয়েও বয়সে ছোট কোনো এক অর্বাচীন যুবক গ্রামের ও সমাজের মাতব্বর হয়ে দাঁড়াবে তিনি দুচোখ বুজবার আগেই।
শুধু বললেন—এই আমতলার রাস্তা দিয়ে কেউ টেরি কেটে যেতে পারতো না। যাবার হুকুম ছিল না। একবার কি হল জানো, গিরে বোষ্টমের ভাই নিতাই বোষ্টম গোবরাপুরের মেলা থেকে ফিরচে, দুপুর বেলা, বেশ গুন গুন করে গান করতে করতে চলেচে, মাথায় টেরি। আমি বসে কাছারির নিকিশি কাজ তৈরি করচি। বললাম—কে? তো বললে—আজ্ঞে আমি নিতাই। যেমন সামনে আসা অমনি চটি না খুলে পটাপট দু ঘা পিঠে বসিয়ে দিয়ে বললাম—ব্যাটার হাতে পয়সার গোমর হয়েচে বুঝি? কাল নাপিত ডাকিয়ে চুল কদমছাঁট ছেঁটে এখানে দেখিয়ে যাবি। তখন তা করে। রাশ রাখতে হলে অমনি করতে হয়, বুঝলে?
আমি মুখুয্যে জ্যাঠার কথার কোনো প্রতিবাদ করি নি। তিনি কিছু বুঝবেন না।
সেদিন চলে এলুম, কিন্তু বড় মুখুয্যেমশায় মনে মনে হয়ে রইলেন আমার শত্রু। বড় ছেলে হারানকে বলে দিলেন, আমার বাড়িতে যেন বেশি যাতায়াত না করে, আমার সঙ্গে কথাবার্তা না কয়। এমন কি নাতির অন্নপ্রাশনের সময় আমাকে নিমন্ত্রণ করবার আগে একটি কথাও জানালেন না। পাড়াগাঁয় সেটা নিয়ম নয়। কোনো বাড়িতে ক্রিয়াকর্মের সময় পাড়ার বিশিষ্ট লোকদের ডেকে কি করা উচিত বা অনুচিত সে সম্বন্ধে পরামর্শ করতে হয়, তাদের দিয়ে ভোজ্যদ্রব্যের তালিকা করাতে হয়। সে সব কিছুই না। শুকনো নেমন্তন্ন করে গেল তাঁর মেজ জামাই। তাও অন্নপ্রাশনের দিন সকালে। একটা কথাও তার আগে আমায় কেউ বললে না।
সনাতনদা বললে—এর শোধ নিতে হবে ভায়া। আমরা সবাই তোমার দলে। তুমি যদি বলো, এপাড়ার একটি প্রাণীও মুখুয্যেবাড়ি পাত পাড়বে না।
—আমি তা বলচি নে। সবাই খাবে মুখুয্যে-জ্যাঠার বাড়ি।
সনাতনদা অবাক হয়ে বললে—এই অপমানের পরেও তুমি যাবে? না না, তা আমরা হতে দেব না। আমার উপর ভার দ্যাও, দ্যাখো কোথাকার জল কোথায় মারি! কে না জানে ওঁর বংশে গোয়ালা অপবাদ আছে? ওঁর মেজ খুড়ী বিধবা হয়ে ওই নিবারণ ঘোষের কাকা অধর ঘোষের সঙ্গে ধরা পড়েন নি?
—আঃ, কি বলচ সনাতনদা? ওসব মুখে উচ্চারণ কোরো না। আর কেউ যদি না-ও যায়, আমি খেতে যাব।
—বেশ, তোমার ইচ্ছে। গাঁয়ের লোক কিন্তু তোমার অপমানে ক্ষেপে উঠেছে।
—তাদের অসীম ধন্যবাদ। বাড়ি গিয়ে ডাবের জল খেয়ে ঠাণ্ডা হতে বলো।
নিমন্ত্রণের আসরে ভিন্নগ্রামের বহুলোকের সমাগম। দু-তিনটি চাকর অভ্যাগতদের পদধৌত করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করচে। মস্তবড় জোড়া শতরঞ্জি পড়েচে চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায়। উঠোনজোড়া নীল শামিয়ানা টাঙানো। একপাশে দুটি নতুন জলভরতি জালা, জালার মুখে পেতলের ঘটি, জালার পাশে একরাশ মাটির গেলাস।
আমায় ঢুকতে দেখে মুখুয্যে জ্যাঠামশায় কেমন একটু অবাক হয়ে গেলেন। তখুনি সামলে নিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন—আরে শশাঙ্ক যে, এসো এসো।
—একটু দেরি হয়ে গেল জ্যাঠাবাবু। রুগীপত্তর দেখে আসতে—
—ঠিক ঠিক, তোমার পশার আজকাল—
—আচ্ছা, আমি একবার রান্নাবান্নার দিকে দেখে আসি কি রকম হল।
—যাও যাও, তোমাদেরই তো কাজ বাবা।
সেই থেকে বিষম খাটুনি শুরু করলাম। মাছের টুকরো কতবড় করে কাটা উচিত, চাটনিতে গুড় পড়বে—না চিনি, বাইরের অভ্যাগতদের নিজের হাতে জলযোগ করানো, খাওয়ার জায়গা করা, বালতি হাতে মাছের কালিয়া ও পায়েস পরিবেশন, আবার এরই মধ্যে ভোজসভায় এক গেঁয়ো ঝগড়া মেটানো। পল্লীগ্রামের ব্রাহ্মণভোজন বড় সাবধানের ব্যাপার, পান থেকে চুন খসলে এখানে অঘটন ঘটে। একজন নিমন্ত্রিতের পাতে নাকি মাছ পড়ে নি—দুবার চেয়েচেন তিনি, তবুও কেমন ভুল হয়ে গিয়েচে। এত তাচ্ছিল্য সহ্য হয়? সে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়ান আর কি! শামিয়ানার তলায় যত ব্রাহ্মণ খেতে বসেছিল সবাই হাত গুটিয়ে বসলে, কেউ খাবে না। ব্রাহ্মণভোজন পণ্ড হবার উপক্রম হল। ভোজ্যবস্তুর বালতি হাতে পরিবেশকেরা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েচে।
আমি ছিলাম ভাঁড়ারঘরে, একটা হৈ চৈ শুনে ছুটে বাইরে গেলাম। মুখুয্যে জ্যাঠার ছেলে হারান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে মাছের বালতি, আমায় দেখে বললে—একটু এগিয়ে যান দাদা—আপনি দেখুন একটু—
রণাঙ্গনে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম। এর সামনে হাতজোড় করি, ওর সামনে মুখ কাঁচুমাচু করে মাপ চাই। মাছ? কে দেয়নি মাছ? অর্বাচীন যত কোথাকার! এই, এদিকে—নিয়ে এসো বালতি। যত সব হয়েচে—মানুষ চেনো না? রায়মশায়ের পাতে ঢালো মাছ। উনি যত পারেন—দেখছো না খাইয়ে লোক? খান খান, আজকাল সব কেউ কি খেতে পারে? আপনাদের দেখলেও আনন্দ হয়। নিয়ে এসো, মুড়ো একটা বেছে এই পাতে। সন্দেশের বেলা এই পাত ভুলো না যেন। দয়া করে খান সব। আপনারা প্রবীণ, সমাজের মাথার মণি, ছেলে-ছোকরাদের কথায় রাগ করে? ছিঃ, আপনারা হকুম করবেন, আমরা তামিল করবো। খান।
দু-একজন ভিন্ন গ্রামের নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ বললেন—এই তো! এতক্ষণ আপনি এলেই পারতেন ডাক্তারবাবু। কেমন মিষ্টি কথাবার্তা দ্যাখো তো। পেটে বিদ্যে থাকলে তার ধরনই হয় আলাদা।
হেঁকে বললাম—এদিকে মাছ নিয়ে এসো বেছে বেছে। মুড়ো দাও একটা এখানে—
যে বেশি ঝগড়াটে, তার পাতে মাছের মুড়ো দিয়ে ঠাণ্ডা করি। সামাজিক ভোজে মাছের মুড়ো দেওয়া হয় সমাজের বিশিষ্ট লোকদের পাতে। চাঁপাবেড়ের ঈশান চক্কত্তির পাতে কস্মিনকালে ভোজের আসরে মাছের মুড়ো পড়ে নি—কারণ সে ঝগড়াটে ও মামলাবাজ হলেও গরিব। সে আজ বাধিয়ে তুলেছিল এক কাণ্ড, ওর পাতে মাছের মুড়ো দেওয়ার দুর্লভ সম্মানে লোকটার রাগ একেবারে জল হয়ে গেল। আমার দিকে চেয়ে হাসি-হাসি মুখে বললে—সন্দেশের সময় তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকো বাবাজি—
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই—। এই আমি দাঁড়ালাম, কোথাও যাচ্চি নে।
ভোজনপর্ব সমাধানান্তে যে যার বাড়ি চলে গেল, সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আমি ভাঁড়ার ঘর থেকে ডালঝোলদধিসন্দেশ মাখা হাতে ও কাপড়ে বেরিয়ে নিজের বাড়ি যেতে উদ্যত হয়েছি, মুখুয্যে জ্যাঠা পেছন থেকে ডেকে বললেন—কে যায়?
—আজ্ঞে আমি শশাঙ্ক।
—খেয়েচ?
—আজ্ঞে না।
—কোথায় যাচ্চ তবে? সোনা ফেলে আঁচলে গেরো?
—সমস্ত দিনের ইয়ে—বাড়ি গিয়ে গা ধুয়ে—
—সে হবে না। গা এখানেই ধোও পুকুরঘাটে। সাবান কাপড় সব দিচ্চে।
—আজ্ঞে তা হোক জ্যাঠামশায়। আমি বরং—
মুখুয্যে জ্যাঠামশায় এসে আমার হাত ধরলেন।
—তা হবে না বাবাজি, তুমি যাচ্চ খাবে না বলে, আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি আজ আমার জাত রক্ষে করেছ—তুমি না থাকলে আজ ব্রাহ্মণভোজন পণ্ড হয়েছিলো। খুব বাঁচিয়ে দিয়েচ বাবাজি। আমি তোমাকে আজ যে কি বলে আশীর্বাদ করবো, বেঁচে থেকো—দীর্ঘজীবী হও। চললে যে?
—আমি যাই—
—কেন?
—আপনি তো আমায় নেমন্তন্ন করেন নি জ্যাঠাবাবু?
আমার গলার মধ্যে একটু অভিমানের সুর এসে গেল কি ভাবে নিজের অলক্ষিতে।
মুখুয্যে জ্যাঠামশায় কাতরভাবে আমার হাত দুটো ধরে বললেন—আমার মতিচ্ছন্ন। রত্ন চিনতে পারি নি। তুমি আমার কানটা মলে দাও—দাও বাবাজি—
আমি জিভ কেটে হাত জোড় করে বিনীতভাবে বলি—ওকি কথা জ্যাঠামশায়! আমি আপনার ছেলের বয়সী, আমাকে ওকি কথা!
—বেশ, চল আমার সঙ্গে। পুকুরে নাইবে, সাবান দিচ্চি। তোমাকে না খাইয়ে আমি জলস্পর্শ করবো না। চলো—
সনাতনদা সেই রাত্রেই আমার বৈঠকখানায় এল। বললে—খুব ভায়া, খুব! দেখালে বটে একখানা!
—কি রকম?
—আজ তো উলটে গিয়েছিল সব! তুমি এসে না সামলালে—খুব বাঁচান বাঁচিয়েচ।
আমার কেমন সন্দেহ হল, আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে বললাম—তোমার কাজ, সনাতনদা?
—কে বললে?
—তুমি ওদের উসকে দিয়েচ? ঈশান চক্কত্তিকে তুমি খাড়া করেছিলে?
—হ্যাঁ, আমি না হুতো—
—ঠিক তুমি। আমি নাড়ী টিপে খাই তা তুমি জানো? বলো হ্যাঁ কি না?
সনাতনদা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। বললে—তা তোমার অপমান তুমি তো গায়ে মাখলে না—আমাদের একটা কিছু বিহিত করতে হয়! তবে হ্যাঁ—দেখালে বটে! তুমি অন্য ডালের আম, আমাদের মতো নও। যারা যারা জানে, সবাই দেখে অবাক হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বোকাও বলেছে।
আমি তিরস্কারের কড়াসুরে বললাম—এমন করে আমার উপকার করবে না সনাতনদা, অনিষ্টই করবে; আমি তোমাদের দলাদলির মাথায় ঝাড়ু মারি। আমি ওসবের উচ্ছেদ করবো বলেই চেষ্টা করচি। এতে যে আমার দলে থাকবে থাকো, নয়তো দূর হয়ে চলে যাও—গ্রাহ্যও করি নে। কুচুক্কুরেপনা যদি না ছাড়তে পারো—আমার সঙ্গে আর মিশো না।
সনাতনদা খুব দমে গেল, কিন্তু সেটা চাপবার চেষ্টায় সহাস্য সুরে বললে—হয়েচে, নাও নাও। লেকচার রাখো, একটু চা করতে বলে দাও দিকি বৌমাকে।
মঙ্গলগঞ্জ ডিসপেনসারির কাজ সেরে বার হয়েচি সেদিন, সকাল সকাল বাড়ি ফিরবো, নৌকো বাঁধা রয়েচে বাজারের ঘাটে, এমন সময় ভূষণ দাঁ এসে বললে—আজ যাবেন না ডাক্তারবাবু, আজ যে ঝুলনের বারোয়ারি—
—কখন?
—একটু অপেক্ষা করতে হবে, সন্দের পর আলো জ্বেলেই আসর লাগিয়ে দেবো।
—যাত্রা?
—না ডাক্তারবাবু, আজ খেমটা। ভালো দল এসেচে একটি। কেষ্টনগরের। অনেক কষ্টে সুপারিশ ধরে তবে বায়না বাঁধা।
আমার তত থাকবার ইচ্ছা নেই। খেমটা নাচ দেখবার আমি পক্ষপাতী নই, তবুও ভাবলাম এ সব অজ পাড়াগাঁয়ে আমোদ-প্রমোদের তেমন কিছু ব্যবস্থা নেই, আজ বরং একটু থেকে দেখেই যাই। অনেকদিন কোনো কিছু দেখি নি। একঘেয়ে ভাবে ডাক্তারিই করে চলচি।
এ সব জায়গায় খেমটা নাচওয়ালীদের বিশেষ খাতির, সেটা আমি জানি। বাজার-সুদ্ধ মাতব্বর লোকেরা স্টেশনে যায় খেমটার দলের অভ্যর্থনা করতে। ওদের বিশ্বাস, খেমটাওয়ালীরা সবাই সুশিক্ষিতা ভদ্র ও শহুরে মেয়ে, তারা এ পাড়াগাঁয়ে এসে কোনোরকম দোষ না ধরে, আদর যত্ন ও ভদ্রতার কোনো খুঁৎ না বের করে ফেলে। ভূষণ দাঁ সব সময় হাত জোড় করে ওদের সামনে ঘুরচে, কখন কি দরকার হয় বলা তো যায় না! শ্রীশ দাঁর আড়তে খেমটার দলের জায়গা দেওয়া হয়েচে—এ গ্রামের মধ্যে ঐটিই সব চেয়ে বড় আর ভালো বাড়ি।
সনাতনদা এলে আজ বেশ হত। অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে, গল্প-গুজব করবার লোক থাকলে আনন্দে কাটে। বর্ষাকাল হলেও আজ দুদিন বৃষ্টি নেই। ম।লগঞ্জের ঘাটের উপরেই একটা কদম গাছে থোকা থোকা কদম ফুল ফুটেচে। সজল মিঠে বাতাস, এখানে বৃষ্টি না হলেও অন্য কোথাও বৃষ্টি হয়েচে।
নেপাল প্রামাণিকের তামাকের দোকান বাজারের ঘাটের কাছেই। আমাকে একা বসে থাকতে দেখে সে এল। বললাম—নেপাল, একটু চা খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারো?
নেপাল তটস্থ হয়ে পড়লো।—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখুনি করে নিয়ে আসছি দোকান থেকে।
আমি বললাম—খেমটা আরম্ভ হতে কত দেরি?
—সন্দের পর হবে ডাক্তারবাবু। কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করবো?
—না না, শুধু চা করো। আমার এখানেই হবে, স্টোভ আছে, সব আছে, কেবল দুধ নেই।
—দুধ আমি বাড়ি থেকে আনছি। খাওয়ার ব্যবস্থা না করলে কষ্ট হবে আপনার। কখন খেমটা শেষ হবে, তখন বাড়ি যাবেন—সে অনেক দেরি হয়ে যাবে। খাবেন কখন? সে হয় না।
এখানকার বাজারের মধ্যে ভূষণ দাঁ ও নেপাল প্রামাণিক—এরা সব মাতব্বর লোক। ওরাই চাঁদা ওঠায়, বারোয়ারির আয়োজন করে বছর বছর। পাঁচজনে শোনেও ওদের কথা। আমি যখন এখানে ডাক্তারখানা খুলেচি, সকলকেই সন্তুষ্ট রাখতে হবে আমায়। সুতরাং বললাম—তবে তুমি কি করতে চাও?
—খানকতক পরোটা ভাজিয়ে আনি আর একটু আলুর তরকারি।
—তার চেয়ে ডাক্তারখানায় স্টোভে দুটি ভাত চড়িয়ে দিক আমার কম্পাউণ্ডার।
—সে অনেক হাঙ্গামা। কোথায় হাঁড়ি, কোথায় বেড়ি, কোথায় চাল, কোথায় ডাল!
একটু পরে নেপাল চা করে নিয়ে এল, তার সঙ্গে চাল-ছোলা ভাজা। আমি বললাম—তুমিও বসো, একসঙ্গে খাই।
নেপাল বসে বসে নানারকম গল্প করতে লাগলো। ওর জীবনটা বেশ। শোনাবার মতো জিনিস সে গল্প। এ সব বাদলার বিকেলে চালছোলা-ভাজার সঙ্গে মজে ভালো।
বললাম—নেপাল, দুটি বিয়ে করলে কেন একসঙ্গে?
—একসঙ্গে তো করি নি, এক বছর পর পর।
—কেন?
—প্রথম পক্ষের বৌ আমাকে না বলে বাপের বাড়ি পালিয়ে গেল, সেই রাগে তাকে ত্যাগ করবো বলে যে-ই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছি, অমনি প্রথম পক্ষের বৌও সুড় সুড় করে এসে ঢুকলো সংসারে। আর নড়তে চাইলে না, সেই থেকেই আছে। দুজনেরই ছেলেমেয়ে হচ্চে। এখন মনে হয়, কি ঝকমারিই করেছি, তখন অল্প বয়স, সে বুদ্ধি কি ছিল ডাক্তারবাবু? এখন পাঁচ-পাঁচটা মেয়ে, কি করে বিয়ে দেবো সেই ভাবনাতেই শুকিয়ে যাচ্ছি—আর একটু চা করি?
—বেশ।
দুজনেই সমান চা-খোর। রাত আটটা বাজবার আগে আমাদের দু-তিন বার চা হয়ে গেল। নেপাল বসে বসে অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী বলে যেতে লাগলো। কোন পক্ষের বৌ ওকে ভালোবাসে, কোন বৌ তেমন ভালোবাসে না—এই সব গল্প।
—প্রথম পক্ষের বৌটা সত্যিই ভালো। সত্যিই ভালোবাসে। দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করেছিলাম বটে কিন্তু ও আমার ওপর রাগ করে নি।
—ছোটবউ কেমন?
—ওই অমনি একরকম। সুবিধে না।
—কেন?
—তেমন আঠা নেই কারো ওপর। আমার ওপরও না, থাকতে হয় তাই থাকে, সংসার করতে হয় তাই করে।
—দেখতে কে ভালো?
—বড়বৌ।
এমন সময় ভূষণ দাঁ নিজে এসে জানালে আসর তৈরী হয়েচে, আমি যেন এখুনি যাই।
নেপাল প্রামাণিক বললে—ডাক্তারবাবু, আপনার খাবার কি ব্যবস্থা হবে?
—খেমটা দেখে চলে যাবো বাড়িতে। গিয়ে খাব।
—খেমটা ভাঙ্গতে রাত একটা। আপনার বাড়ি পৌঁছুতে রাত সাড়ে তিনটে। ততক্ষণ না খেয়ে থাকবেন? তার চেয়ে একটা কথা বলি।
—কি?
—বলতে সাহস হয় না, চলুন, আমার বাড়ি। বড় বউকে বলেই এসেচি, আমি খেতে যাবার সময় সে আপনার জন্যে পরোটা ভেজে দেবে। আর যদি না খান, আমি কলাপাতে মুড়ে পরোটা ক’খানা এখানেই নিয়ে আসবো এখন।
—ওসব দরকার নেই, আর একবার চা খেলেই আমার ঠিক হয়ে যাবে।
—চাও করবো এখন আপনার স্টোভে, তার আর ভাবনা কি? চা যতবার খেতে চান, তাতে দুঃখ নেই। আপনি বসবেন, না আসরে যাবেন?
আসরে গিয়ে বসলাম। নিতাই শীলের কাপড়ের দোকান ও হরি ময়রার সন্দেশ মুড়কির দোকানের পিছনে যে ফাঁকা জায়গা, ওখানটায় পাল খাটানো হয়েচে। তার তলায় বড় আসর। আসরের চারিদিকে বাঁশের রেলিং। চাষাভুষো লোকের জন্যে আসরের বাইরে দরমা পাতা, ভেতরে বড় শতরঞ্জি ও মাদুর বিছানো। চার-পাঁচটা বড় বড় ঝাড় ও বেল ঝুলছে, দুটো হ্যাজাক লণ্ঠন। মোটের উপর বেশ আলো ফুটেচে আসরে। আমি যখন গেলুম, তখন খেমটা নাচ আরম্ভ হয়েচে।
একপাশে খানকতক চেয়ার বেঞ্চি পাতা, স্থানীয় বিশিষ্ট ও সম্ভ্রান্ত লোকদের জন্যে। আমাকে সবাই হাত ধরে খাতির করে চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসালে।
পাশে বসে আছে মঙ্গলগঞ্জ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট রামহরি সরকার—পাশের গ্রামে বাড়ি, জমিজমাযুক্ত পাড়াগাঁয়ে সম্পন্ন গৃহস্থ। পেটে ‘ক’ অক্ষর নেই, ধূর্ত ও মামলাবাজ। তার সঙ্গে বসেচে গোবিন্দ দাঁ, ভূষণ দাঁর জ্যেঠতুতো ভাই—কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রীটে রংয়ের দোকান আছে, পয়সাওয়ালা, মূর্খ ও কিছু অহঙ্কারী। সে নিজেকে কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যবসাদারদের একজন বলে গণ্য করে, এখানে পাড়াগাঁয়ে এসে এই সব ছোট গানের আসরে ছোটখাটো ব্যবসাদারদের সঙ্গে দেমাকে নাক উঁচু করে বসেছে। আমায় সে চেনে, একবার ওর ছোট নাতির ঘুংড়ি-কাশির চিকিৎসা করেছিলাম এই মঙ্গলগঞ্জে আর-বারে। ওর ওপাশে বসেছে কুঁদিপুর গ্রামের আবদুল হামিদ চৌধুরী, ঐ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও লোকালবোর্ডের মেম্বার। আবদুল হামিদের বাড়ি একচল্লিশ গোলা ধান, এ অঞ্চলের বড় ধেনো মহাজন, দশ-পনেরোখানা গ্রামের কৃষক সব আবদুল হামিদের খাতক প্রজা। তার পাশে বসে আছে কলাধরপুরের প্রহ্লাদ সাধুখাঁ, জাতে কলু, তিনপুরুষে ব্যবসাদার। হাতে আগে যত টাকা ছিল, এখন তত নেই, সরষের ব্যবসায়ে ক’বার ধরে লোকসান দিয়ে অনেক কমে গিয়েচে। প্রহ্লাদ সাধুখাঁর ভাই নরহরি সাধুখাঁ তার ডানপাশেই বসেচে। নরহরি এই মঙ্গলগঞ্জে ধানপাটের আড়তদারি করে।
গোবিন্দ দাঁ পকেট থেকে একটি সিগারেট বার করে বললে—আসুন ডাক্তারবাবু।
—ভালো আছেন?
—বেশ আছি। আপনি?
—মন্দ নয়।
—এ পাড়াগাঁ ছেড়ে আর কোথাও জায়গা পেলেন না? কতবার বললাম—
—আপনাদের মতো বড়লোক তো নই। অন্য জায়গায় গেলে চলতে পারে কি? কি রকম চলচে আপনাদের ব্যবসা?
—আগের মতো নেই, তবুও এক রকম মন্দ নয়।
আবদুল হামিদ চৌধুরী বললে—কতক্ষণ এলেন ডাক্তারবাবু?
—তা দুপুরের পরই এসেচি। এতক্ষণ চলে যেতাম, ভূষণ দাঁ গিয়ে ধরলে গান না শুনে যেতে পারবো না। ভালো সব?
—খোদার ফজলে একরকম চলে যাচ্চে। আমাদের বাড়িতে একবার চলুন।
—আমি ডাক্তার মানুষ, বাড়িতে নিয়ে গেলেই ভিজিট দিতে হবে, জানেন তো?
—ভিজিট দিতে হয়, ভিজিট দেওয়া যাবে। একদিন গিয়ে একটু দুধ খেয়ে আসবেন।
কলাধরপুরের প্রহ্লাদ সাধুখাঁ হেসে বললে—সে ভালো তো ডাক্তারবাবু। ট্যাকাও পাবেন, আবার দুধও খাবেন। আপনাদের অদেষ্ট ভালো। যান, যান—
রামহরি সরকার এতক্ষণ কথা বলবার ফাঁক পাচ্ছিল না, সেও একজন যে-সে লোক নয়, মঙ্গলগঞ্জ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। পাড়াগাঁ অঞ্চলে এ সব পদে যারা থাকে, তারা নিজেদের এক একজন কেষ্টবিষ্টু বলে ভাবে, উন্নাসিক আভিজাত্যের গর্বে সাধারণ লোক থেকে একটু দূরে রাখে নিজেকে।
রামহরি এই সময় বললে—ডাক্তার আর এই গিয়ে পুলিশ, এদের সঙ্গে ভাব রাখাও দোষ, না রাখাও দোষ। পরশু আমার বাড়ি হঠাৎ বড় দারোগা এসে তো ওঠলেন। তখুনি পুকুর থেকে বড় মাছ তোলালাম, মাছের ঝোল ভাত হল।
আবদুল হামিদ চৌধুরীর মনে কথাটা লাগলো। সেও তো বড় কম নয়, ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার, পুলিশ কি শুধু রামহরি সরকারের বাড়িতেই আসে, তার ওখানেও আসে। সুতরাং সে বললে—ও তো আমার বাড়ি দুবেলা ঘটচে। সে দিন বড়বাবু আর মেজবাবু একসঙ্গে এ্যালেন আশুডাঙা খুনী কেসের এনকোয়ারী সেরে। দুপুর বেলা, ভাত খেয়ে চক্ষু একটু বুজেচি, দুই ঘোড়া এসে হাজির। তখুনি খাসি মারা হল একটা, সরু চালের ভাত আর খাসির মাংস হল।
রামহরি বললে—রাঁধলে কে?
—ওই দোবেজি বলে এক কনস্টবল আছে না, সে-ই রাঁধলে।
—মাংস রাঁধলে দোবেজি?
—না, মাংস রাঁধলে বড়বাবু নিজে। ভালো রসুই করেন।
গোবিন্দ দাঁর ভালো লাগছিল না এ সব কথা, সে যে বড় তা দেখানোর ফুরসত সে পাচ্চে না। এরা তো সব পাড়াগাঁয়ে প্রেসিডেন্ট। এরা পুলিশকে খাতির করলেও সে থোড়াই কেয়ার করে। খাস কলকাতা শহরে ব্যবসা তার, সেখানে শুধু ওঁরা জানে লাটসায়েবকে আর পুলিশ কমিশনারকে।
গোবিন্দ বললে—পুলিশের হ্যাপা আমাদেরও পোয়াতে হয়। সেবার হলো কি, আমরা হ্যাবাক জিংকের পিপে কতগুলো রেখেচি দালানে, তাই সার্চ করতে পুলিশ এল।
আমি বললাম—কিসের পিপে?
—হ্যাবাক জিংকের পিপে। ব্যাপারটা কি জানেন, বিলিতি হ্যাবাক জিংকের হন্দর সাড়ে উনিশ টাকা, আর সেই জায়গায় জাপানী জিংকের হন্দর সাড়ে সাত টাকা। আমরা করি কি, আপনার কাছে বলতে দোষ কি—বিলিতি হ্যাবাক জিংকের খালি পিপে কিনে তাতে জাপানী মাল ভরতি করি।
—কেউ ধরতে পারে না?
—জিনিস চেনা সোজা কথা না। ও ব্যবসার মধ্যে যারা আছে, তারা ছাড়া বাইরের লোকে কি চিনবে? চেনে মিস্ত্রিরা, তাদের সঙ্গে—
গোবিন্দ দুই আঙ্গুলে টাকা বাজাবার মুদ্রা করলে।
প্রহ্লাদ সাধুখাঁ কথাটা মন দিয়ে শুনছিল, লাভের গন্ধ যেখানে, সেখানে তার কান খাড়া হয়ে উঠবেই, কারণ সে তিন-তিন পুরুষ ব্যবসাদার। সে বললে—বলেন কি দাঁ মশায়, এত লাভ? গোবিন্দ ধূর্ত হাসির আভাস মাত্র মুখে এনে গলার সুরকে ঘোরালো রহস্যময় করে বললে—তা নইলে কি আজ কলকাতা শহরে টিকতে পারতাম সাধুখাঁ মশাই? আমার দোকানের পাশে ডি. পাল এ্যাণ্ড সন—লক্ষপতি ধনী, টালা থেকে টালিগঞ্জ এস্তোক আঠারোখানা বাড়ি ভাড়া খাটচে, বড়বাবু মেজবাবু নিজের মোটরে দোকানে আসেন, সে মোটর কি সাধারণ মোটর? দেখবার জিনিস। তাদের বলা যায় আসল বড়বাবু মেজবাবু। মেয়ের বিয়েতে সতেরো হাজার টাকা খরচ করলে। মোটর গাড়ি থেকে নেমে আমার দোকানে এসে হাতজোড় করে নেমন্তন্ন করে গেলেন। আসল বড়বাবু মেজবাবু তাঁদের বলা যেতে পারে। নইলে আর সব—হুঁ—
আবদুল হামিদ চৌধুরী পুলিশের দারোগাদের বড়বাবু ছোটবাবু বলেছিল একটু আগে। সে এ বক্রোক্তি হজম করবার পাত্র নয়। বললে—তা আমরা পাড়াগাঁয়ে মানুষ, আমাদের কাছে ওঁরাই আসল বড়বাবু, মেজবাবু। এখানে তো আপনার কলকাতার বাবুরা আসবেন না মুশকিল আসান করতে। এখানে মুশকিলের আসান করবে পুলিশই।
প্রহ্লাদ সাধুখাঁ কুঁদিপুর ইউনিয়ন বোর্ডের অধীনে বাস করে। সুতরাং ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ চৌধুরীকে তুষ্ট রাখার তার স্বার্থ আছে। সে আবদুল হামিদকে সমর্থন করে বললে—ঠিক বলেচেন মৌলবী সাহেব, ঠিক বলেচেন। কলকাতার বাবুদের কি সম্পর্ক?
গোবিন্দ দাঁ বললে—সে কথা হচ্চে না। আসল বড়লোকের কথা হচ্চে। তোমার এখানে যদি চুনোপুঁটি মাছের টাকা টাকা সের হয়, তবে কি পুঁটি মাছের কদর রুই মাছের সমান হবে? পাড়াগাঁয়ে সব সমান, বলে, বনগাঁয়ে শেয়াল রাজা। ডাক্তারবাবু কি বলেন?
এই সময় আমার চোখ পড়লো আসরের দিকে, দুটি সুসজ্জিতা খেমটাওয়ালী লঘু পদবিক্ষেপে আসরে ঢুকল। একটির বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের কম নয় বরং বেশি। সমস্ত গায়ে গহনা—গিলটির কি সোনার, বোঝবার উপায় নেই। গায়ের রংয়ের জলুস অনেকটা কমে এসেচে। ওর পেছনে যে মেয়েটি ঢুকল তার বয়স কম, ষোল কি সতেরো কিংবা অতও নয়, শ্যামাঙ্গী, চোখ দুটিতে বুদ্ধি ও দুষ্টুমির দীপ্তি, অত্যন্ত আঁটসাঁট বাঁধুনি, সারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোথাও ঢিলেঢালা নেই, মুখশ্রী সুন্দর, সব চেয়ে দেখবার জিনিস তার মাথায় ঘন কালো চুলের রাশ—মনে হয় সে চুল ছেড়ে দিলে যেন হাঁটুর নীচে পড়বে। এর গায়ে তত গহনার ভিড় নেই, নীল রঙের শাড়ি ও কাঁচুলি চমৎকার মানিয়েচে নিটোল-গড়ন দেহটিতে।
ওরা নাচ গান আরম্ভ করেচে।
বড় মেয়েটি নাচতে নাচতে আমাদের কাছে আসচে, কারণ সে বুঝেচে এই চাষাভুষোর ভিড়ের মধ্যে আমরাই সম্ভ্রান্ত। সে মেয়েটা বার বার এসে আমাদের কাছে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচতে লাগলো।
আবদুল হামিদ চৌধুরী দু’টাকা প্যালা দিলে। প্যালা দিয়ে সে সগর্বে আমাদের দিকে চাইতে লাগলো। গোবিন্দ দাঁ সেটা সহ্য করতে পারলে না, পাড়াগাঁয়ের ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট কি তাদের মতো শাঁসালো ব্যবসাদারের কাছে লাগে? থাকলেই বা বাড়িতে একচল্লিশটা ধানের গোলা। অমন ধেনো মহাজনকে ক্লাইভ স্ট্রীট ও রাজা উডমন্ট স্ট্রীটের রঙ ও হার্ডওয়ারের বাজারে এবেলা কিনে ওবেলা বেচতে পারে, এমন বহুৎ ধনী সওদাগর তার দোকানে এসে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বৌ-ভাতের নেমন্তন্ন করে যায়।
গোবিন্দ দাঁ একটা রুমালে দুটি টাকা বেঁধে খেমটাওয়ালীর দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে।
আমি এ পর্যন্ত কিছু দিই নি, শেষ অবধি যখন কৃপণ প্রহ্লাদ সাধুখাঁও একটা টাকা প্যালা দিয়ে ফেললে, তখন আমার কেমন লজ্জা-লজ্জা করতে লাগলো। না দিলে এই সব অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে লোক, যারা নিজেদের যথেষ্ট গণ্যমান্য ও সম্ভ্রান্ত বলে ভাবে, তারা আমার দিকে কৃপার চোখে চাইবে। এরা ভাবে খেমটার আসরে বসে খেমটাওয়ালীকে প্যালা দেওয়াটা খুব একটা ইজ্জতের কাজ বুঝি। এ নিয়ে আবার এদের আড়াআড়ি ও বাদাবাদি চলে। এক রাত্রে আসরে বসে বিশ-চল্লিশ টাকা প্যালা দিয়ে ফেলেছে ঝোঁকের মাথায়, এমন লোকও দেখেচি।
এবারে নাচওয়ালীটি আমার কাছে এসে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাইতে লাগলো :
‘ও সই পিরিতির পসরা নিয়ে ঘুরে মরি দেশ বিদেশে’—
আমারই সামনে এসে বার বার গায়, ভাবটা বোধ হয় এই, সবাই দিচ্ছে তুমি দেবে না কেন। আমার পকেটে আজকার পাওনা দশ-বারোটি টাকা রয়েচে বটে, কিন্তু আমি ভাবছি, ওদের দেখাদেখি আমি যদি এই নর্তকীদের পাদপদ্মে এতগুলো টাকা বিসর্জন দিই তবে সে হবে ঘোর নির্বুদ্ধিতার কাজ।
এই সময় আমার নাকের কাছে রুমাল ঘুরিয়ে আবদুল হামিদ চৌধুরী আবার দুটাকা ছুঁড়ে ফেলে দিলে খেমটাওয়ালীর দিকে। দেখাদেখি আরও দু-তিনজন প্যালা দিলে এগিয়ে গিয়ে।
এইবার সেই অল্পবয়সী নর্তকীটি আমার কাছে এসে গান গাইতে লাগলো। বেশি বয়সের মেয়েটিই ওকে আমার সামনে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলে, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। ও তো হার মেনে গেল, এ যদি সফল হয় কিছু আদায় করতে।
আমি প্রথমটা ও মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখি নি। এখন খুব কাছে আসতে ভালো করে চেয়ে দেখলাম যে বেশ দেখতে। রঙ ফরসা নয় বটে কিন্তু একটি অপূর্ব কমনীয়তা ওর সারা দেহে। ভারি চমৎকার বাঁধুনি শরীরের। যতবার আমার কাছে এল, ওর ঢল ঢল লাবণ্যভরা মুখ ও ডাগর কালো চোখ দুটি আমার কাছে বিস্ময়ের বস্তু হয়ে উঠতে লাগলো। গলার সুরও কি সুন্দর, অমন কণ্ঠস্বর আমি কখনো শুনি নি কোনো মেয়ের।
আমাদের গ্রামে শান্তি বেশ সুন্দরী মেয়ে বলে গণ্য, কিন্তু শান্তি এর পায়ের নখের কাছে দাঁড়াতে পারে না।
আবার মেয়েটি ঠিক আমার সামনে এসেই গান গাইতে লাগলো। আমার দিকে চায়, আবার লজ্জায় মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়। আবার আমার দিকে চায়—সে এক অপূর্ব ভঙ্গি। আমার মনে হল, এখনো ব্যবসাদারি শেখেনি মেয়েটি, শুধু অন্য নর্তকীটির শিক্ষায় ও এমনি করচে। বোধ হয় তাকে ভয় করেও চলতে হয়।
হঠাৎ কখন পকেটে হাত দিয়ে দু’টি টাকা বার করে আমি সলজ্জ ও সকুণ্ঠভাবে মেয়েটির সামনে রাখলাম। মেয়েটি আমায় প্রণাম জানিয়ে টাকা দুটি তুলে নিলে।
গোবিন্দ দাঁ ও আবদুল হামিদ চৌধুরী বলে উঠল—বলিহারি!
আরও দুবার মেয়েটি আমার কাছে ঘুরে ঘুরে গেল। আমি দুবারই তাকে টাকা দেবার জন্যে তুলেও আবার পকেটে ফেললাম। কেমন যেন লজ্জা করতে লাগলো, দিতে পারলাম না পাছে আবদুল হামিদ কি গোবিন্দ দাঁ কিংবা প্রহ্লাদ সাধুখাঁ কিছু মনে করে। কিন্তু কি ওরা মনে করবে, এসব ভেবেও দেখলাম না।
আবদুল হামিদ আমায় একটা সিগারেট দিলে, অন্যমনস্ক ভাবে সেটা ধরিয়ে আবার নাচের দিকে মন দিলাম।
অনেক রাত্রে নাচ বন্ধ হল। গোবিন্দ দাঁ বললে—ডাক্তারবাবু, বাকী রাতটুকু গরীবের বাড়িতেই শুয়ে থাকুন, রাত তো বেশি নেই, সকালে চা খেয়ে—
আমার মন যেন কেমন চঞ্চল। কিছু ভালো লাগচে না। কোথাও রাত কাটাতে আমার ইচ্ছে নেই। মাঝিকে নিয়ে সেই রাত্রেই নৌকো ছাড়লাম। গভীর রাত্রের সজল বাতাসে একটু ঘুম এল ছইয়ের মধ্যে বিছানায় শুয়ে। সেই অল্পবয়সী মেয়েটি আমার চোখের সামনে সারা রাত নাচতে লাগলো। এক একবার কাছে এগিয়ে আসে, আমি রুমাল বেঁধে প্যালা দিতে যাই, সে তখুনি হেসে দূরে সরে যায়, আবার কিছুক্ষণ পরে কাছে এগিয়ে আসে।
মাঝির ডাকে ঘুম ভাঙলো। মাঝি বলছে—উঠুন বাবু, নৌকো ঘাটে এসেচে।
উঠে দেখি ওপারের বড় শিমুল গাছটার পিছনে সূর্য উঠেছে, বেলা হয়ে গিয়েচে। দীনু বাড়ুই ঘাটের পাশে জেলে-ডিঙিতে বসে মাছ ধরচে, আমায় দেখে বললে—ডাক্তারবাবু রাত্তিরি ডাকে গিয়েছিলেন? কনেকার রুগী?