ঘরের কিচ্ছা বাইরে বলা ঠিক না
ঘরের কিচ্ছা বাইরে বলা ঠিক না। তারপরেও জানতে চাচ্ছেন যখন বলি–গত রোজার ঈদে আমি নিজে শখ করে একটা শাড়ি কিনে আনলাম। হালকা সবুজের উপর লাল ফুল। বড় ফুল না, ছোট ছোট ফুল। সে শাড়ি দেখে মুখ বাঁকা করে বলল, তোমাকে শাড়ি কে কিনতে বলেছে! লাল শাড়ি আমি পরি? আমি লম্বা মানুষ। বহরে ছোট জাকাতের শাড়ি একটা কিনে নিয়ে এসেছ!
জাকাতের শাড়ি ব্যাপারটা বুঝলাম না।
গরিব-দুঃখীকে দানের জন্যে দেয়া শাড়ি। শাড়ি বলা ঠিক না। বড় সাইজের গামছা।
শেষ প্ৰশ্ন করি–আপনার স্ত্রীর প্রতি আপনার এখন তা হলে কোনো ভালবাসা নেই?
ভালবাসা থাকবে কেন বলুন। ভালবাসা থাকলে এই শীতের রাতে আমি স্টেশনে পড়ে থাকি?
এলা নামের মহিলা হাতের টর্চলাইট জ্বালিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে চারদিক সবুজ আলোেয় ছয়লার করে আবার বাতিটা নেভাল। মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনি স্টেশনে থাকতে আসায় আমার জন্যে খুব লাভ হয়েছে।
কী লাভ?
আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আপনার মতামত পেয়েছি। মতামত রেকর্ড করা থাকবে।
ম্যাডাম কি এখন চলে যাবেন?
হ্যাঁ চলে যাব।
তেমন খাতির-যত্ন করতে পারলাম না, দয়া করে কিছু মনে নেবেন না। নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
খাতির-যত্ন যথেষ্টই করেছেন এবং আমি আপনার দ্রুতায় মুগ্ধ। আপনাকে একটা সুসংবাদ দিতে যাচ্ছি। আমি মনে করি এই সুসংবাদ শোনার অধিকার আপনার আছে।
জ্বি ম্যাডাম সুসংবাদটা বলেন। দুঃসংবাদ শুনে শুনে কান ঝালাপালা। একটা সুসংবাদ শুনে দেখি কেমন লাগে।
আপনার ভালো লাগবে। ভবিষ্যৎ পৃথিবী, যেখানে থেকে আমি এসেছি সেই পৃথিবীতে পুরুষ সম্প্রদায় নেই। শুধুই নারী।
মোবারক হোসেনের মুখ হা হয়ে গেল। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে পুরুষ নেই! শুধুই নারী! এর মধ্যে সুসংবাদটা কোথায় মোবারক হোসেন ধরতে পারলেন না। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে শুধুই পুরুষ, নারী নেই এটা শুনলেও একটা কথা ছিল।
এলা বলল, পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার শতকরা আশি ভাগ ছিল নারীপুরুষঘটিত সমস্যা। প্রেমঘটিত সমস্যা। একসঙ্গে জীবনযাপনের সমস্যা। ইতিহাসে এমনও আছে যে শুধু একটি নারীর জন্যে একটি নগরী ধ্বংস হয়ে গেছে। আছে না?
জ্বি আছে। ট্রয় নগরী।
গ্যালাকটিক ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে সংঘটিত অপরাধের শতকরা ৫৩ ভাগ নারীঘটিত।
মোবারক হোসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন-খাঁটি কথা বলেছেন। ধর্ষণ, এসিড মারা, নাবালিকা হত্যা পত্রিকা খুললেই এই জিনিস। আল্লাহপাক দয়া করেছেন, এখানে পত্রিকা আসে না।
এলা বলল, মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে বিজ্ঞান কাউন্সিল একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে পৃথিবীতে পুরুষ এবং মহিলা বলে দুধরনের মানবসম্প্রদায় থাকবে না। হয় থাকবে শুধু পুরুষ অথবা শুধু মহিলা। যুক্তিসঙ্গত কারণেই শুধু মহিলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ মহিলাদের ভেতরই দুরকমের ক্রমোজোম x এবং y আছে। বুঝতে পারছেন তো?
কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন বললেন, জ্বি। আপনার কথাবার্তা পানির মতো পরিষ্কার। দুধের শিশুও বুঝবে।
বংশবৃদ্ধির জন্যে একসময় পুরুষ এবং রমণীর প্রয়োজন ছিল। এখন সেই প্রয়োজন নেই। মানবসম্প্রদায়ের বংশ বৃদ্ধি এখন মাতৃগর্ভে হচ্ছে না। ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে। শিশুপালনের যন্ত্রণা থেকেও মানবসম্প্রদায়কে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
ও।
এলা বলল, বর্তমান পৃথিবী সুন্দরভাবে চলছে। সমস্যাহীন জীবনযাত্রা। তারপরেও বিজ্ঞান কাউন্সিলে মাঝে মধ্যে প্রশ্ন ওঠে-পুরুষশূন্য পৃথিবীর এই ধারণায় কোনো ত্রুটি আছে কি না। তখনই তথ্য সংগ্রহের জন্যে প্রাচীন পৃথিবীতে স্কাউট পাঠানো হয়। আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের পাঠানো তথ্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে-পুরুষশূন্য পৃথিবী আদর্শ পৃথিবী।
মোবারক হোসেন ভয়ে ভয়ে বললেন, আমরা পুরুষরা কি খারাপ?
আলাদাভাবে খারাপ না, তবে পুরুষ যখন মহিলার পাশে থাকে তখন খারাপ।
সবুজ আলো আবারো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আলো নিভে যাবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত মোবারক হোহাসেন চোখে কিছু দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর তিনি দেখলেনঘরে আর কেউ নেই। তিনি একা। মোবারক হহাসেন সিগারেট ধরলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত হলেন এতক্ষণ যা দেখেছেন সবই চোখের ধান্দা। মন মেজাজ ছিল খারাপ, শীতও পড়েছে ভয়াবহ। সব মিলিয়ে চোখে ধান্দা দেখেছেন। একা একটা স্টেশনে থাকা ঠিক না। আবারো চোখে ধান্দা লাগতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে বের হয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়াটাও অত্যন্ত অপমানকর। কিন্তু কী আর করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে বারবার অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাসায় ফিরে গেলেও খাওয়াদাওয়া করা যাবে না। কিছুটা রাগ তাতে দেখানো হবে।
মোবারক হোসেন বাড়িতে ফিরলেন। মননায়ারা বলামাত্র হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। মননায়ারা এর মধ্যেই ফুলকপি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল করেছেন। এবং সেই ঝোল এত সুস্বাদু হয়েছে যা বলার না! রান্নাবান্নার কোনো ইতিহাসের বই থাকলে কৈ মাছের এই ঝোলের কথা স্বর্ণাক্ষরে সেই বইয়ে লেখা থাকার কথা। মোবারক হোসেনের খুব ইচ্ছা করছে এই কথাটা স্ত্রীকে বলা। শুনলে বেচারি খুশি হবে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। কারণ মননায়ারার চোখ লাল এবং ফোলা। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। মোবারক হোসেন যতবারই রাগ করে বাইরে চলে যান ততবারই মনোয়ারা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেন। এই তথ্যটা মোবারক হোসেনের মনে থাকে না। মোবারক হোসেন নরম গলায় বললেন–বউ ভাত খেয়েছ।
মনোয়ারা ভেজা গলায় বললেন, না।
মোবারক হোসেন ভাত মাখিয়ে নলা করে স্ত্রীর মুখের দিকে এগিয়ে বললেন, দেখি হা করো তো।
মনোয়ারা বললেন, টং করবে না তো। তোমার টং অসহ্য লাগে।
অসহ্য লাগলেও এ ধরনের ঢং মোবারক হোসেন প্রায়ই করেন। এলা নামের মেয়েটাকে এই গুরুত্বপূৰ্ণ কথাটা বলা হয় নি।
মোবারক হোসেন মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে বললেন, কই খাও! ভাত হাতে কতক্ষণ বসে থাকব!
মনোয়ারা বললেন, বুড়ো বয়সে মুখে ভাত! ছিঃ!
ছিঃ বললেও তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর মুখভরতি লজ্জামাখা হাসি।