মিত্তির বাড়ি : উপসংহার
বড়ো মজার এই মিত্তির বাড়ি।
চন্দন রঙের তিনতলা এই বাড়িটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘আনন্দ নিকেতন’। তিন পুরুষের বসবাস। সমৃদ্ধি এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। সূর্যোদয়ে সদর দরজা খুলে যায়। তারপর অবারিত দ্বার। তোমরা এসো, তোমাদের সুখ, দুঃখ, সমস্যা নিয়ে। শ্রোতা পাবে, সহানুভূতি পাবে, সমাধান পাবে।
রাত আড়াইটের আগে আলো নেভে না। কারও খেয়াল চাপলে রাত বারোটার সময় নতুন ফরমুলায় রান্না চাপতে পারে। এই বাড়িতে যত রাত বাড়ে ততই যেন উৎসব বাড়ে। ছোটোখাটো কোনো পারিবারিক সমস্যা নেই বললেই চলে।
সবকটা মানুষের মুখের দিকে তাকালেই পড়ে ফেলা যায় মনের কথা। অদ্ভুত, অলৌকিক এক আনন্দের রাজ্যে সবাই আছে। কোনো মনে কোনো সংকীর্ণতা নেই। ভাঙা সংসারের ঘা—খাওয়া অনেকেই এই বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় খুঁজে পায়। পরে প্রশ্ন নিয়ে ফিরে যায়, সব সংসারই কেন এমন সুখের সংসার হয় না!
আজ বাড়ির সামনে আকাশি রঙের একটা ট্যুরিস্ট বাস দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে একটা ব্যানার লাগানো। গেরুয়া রঙের জমির ওপর বড়ো বড়ো করে লেখা মিত্তির স্পেশ্যাল। মালপত্তর সব উঠছে। গান্ধারী অতি সাবধানে একটা প্যাকিং বাক্স তুলছে। বড়ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে ওটা?’
গান্ধারী উদ্ভাসিত মুখে বললে, ‘সাত রকম’।
‘কী সাত রকম?’
‘আচার গো আচার?’
বড়ভাই উচ্ছ্বসিত, ‘ইউ আর গ্রেট, গান্ধারী, সেই মহাভারতের আমল থেকেই তুই গ্রেট। সাবধানে, একবারে সামনে রাখ। ঝাঁকুনিতে সর্বনাশ না হয়ে যায়।
‘হবে নি গো। সব প্যালেটিকে প্যাক করা।’
মেজভাই ড্রেসট্রেস করে বড়র পাশে দাঁড়িয়েছেন এসে। বড় জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁরে গ্রেটের বড় কী, আরও আরও গ্রেট?’
‘গ্রেটেস্ট।’
‘আ, আওয়ার গান্ধারী ইজ গ্রেটেস্ট।’
‘ভুল হল।’
‘কেন, ভুল হল কেন? গ্রেট, গ্রেটার, গ্রেটেস্ট।’
‘একা তো আর গ্রেটেস্ট হওয়া যায় না, অনেকের মধ্যে গ্রেটেস্ট। গ্রামারে পড়োনি, সুপার রিলেটিভ ডিগ্রি! অনেকের মধ্যে যে গ্রেট, সেই গ্রেটেস্ট।’
‘ঠিক আছে। পৃথিবীতে যত গান্ধারী আছে, তাদের মধ্যে এই গান্ধারীটা গ্রেটেস্ট।’
পাড়া—প্রতিবেশীরা সব পথে নেমে এসেছেন। হন্তদন্ত হয়ে প্রমোদবাবু ঘটনাস্থলে প্রবেশ করলেন, এই বলতে বলতে, ‘কীভাবে ছুটতে ছুটতে এলুম উলটো পাঞ্জাবি পরে। ভেতরের পকেটটা বাইরে। তখন থেকে ভাবছি, পকেট কী করে ছোটো হয়ে যায়। এ তো সিগারেট নয়।’
তারপর দম নিয়ে বড়কে জিজ্ঞেস করলেন,
‘যাচ্ছ কোথায়, হোল ফ্যামিলি?’
‘আমরা সবকটা মিত্তির সদলে পুরী চলেছি। জগন্নাথদেবকে দর্শন করব। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙব। কোনারকে পিকনিক করব, সাক্ষীগোপাল দেখব, ভুবনেশ্বরে উদয়গিরি, খণ্ডগিরি।’
প্রমোদবাবু চোখ বড়ো বড়ো করে শুনলেন, তারপর অভাবনীয় এক হুংকার, ‘না, যাবে না, সবকটা মিত্তির একসঙ্গে যাবে না।’
‘কেন?’
‘এই গাড়ির সঙ্গে আর একটা গাড়ির যদি হেড—অন কলিসান হয়। ওভারটেক করতে গিয়ে স্কিড করে যদি টার্ন টার্টল হয়, সব মিত্তির একসঙ্গে খতম।’
বড় বললেন, ‘এসব হবে কেন।’
প্রমোদবাবু বললেন, ‘হবে না কেন?’
‘হবে না এই কারণে যে আমরা আপনাকেও ধরে নিয়ে যাব।’
‘আমার পাঞ্জাবি যে উলটে আছে।’
‘এক্ষুনি সোজা করে দোবো।’
‘আমার মালপত্তর ব্যাগ—ব্যাগেজ!’
‘দরকার নেই। আমাদের সব আছে।’
‘বাড়িতে খবর!’
‘বাস থামিয়ে, ভ্যাঁক ভ্যাঁক হর্ন।’
‘তাহলে?’
‘উঠে পড়ুন। একেবারে সামনের সিটে জানলার ধার।’
প্রমোদবাবু ধরা গলায়, ‘তোমরা আমার কে গো?’
‘আমরা আপনার একগাদা মিত্তির।’
বাস ছেড়ে দিল। মিত্তির স্পেশ্যাল। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। পাড়া একদম খালি হয়ে গেল। দুর্গা, দুর্গা!’