Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও বজ্র লামা || Sunil Gangopadhyay » Page 3

কাকাবাবু ও বজ্র লামা || Sunil Gangopadhyay

সকালে উঠে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সন্তুর মনে হল, এক রাত্তিরেই তার চোখ দুটো যেন অনেকটা বসে গেছে। বেশ দুর্বল লাগছে শরীর, টলটল করছে মাথা। তবে জ্বর কমেছে।

কাকাবাবু তৈরি হয়ে নিয়েছেন অনেক আগেই। একটু পরেই ব্রেকফাস্ট এসে গেল।

বাগডোগরায় গিয়ে প্লেন ধরতে হবে, পৌনে বারোটার সময় চেক-ইন করার কথা। সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তেই হবে।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে, তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র প্যাক করে নীচে নামবার সময় সিঁড়িতেই দেখা হয়ে গেল নরেন্দ্র ভার্মার সঙ্গে। সে রীতিমত হাঁপাচ্ছে।

নরেন্দ্র ভার্মা কাকাবাবুকে বললেন, দৌড়তে দৌড়তে আসছি। ভয় পাচ্ছিলাম, এর মধ্যেই চলে গেলে কি না!

কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার? কাল রাত্তিরেই তো তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। এখন হঠাৎ আবার এলে কেন?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সকালবেলাতেই রাষ্ট্রপতি আমায় ডেকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। উনি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। উনি এখান থেকে একবার কালিম্পং যাবেন। তোমরা দুজনে ওঁর সঙ্গে হেলিকপ্টারে যেতে পারো।

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ভাবল, তা হলে আজ আর ফেরা হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি যদি অনুরোধ করেন, তা হলে কোনও মানুষ কি তা অগ্রাহ্য করতে পারে?

কাকাবাবু তবু একটুক্ষণ থেমে বললেন, কিন্তু আমাদের যে আজই প্লেনের টিকিট কাটা আছে? না গেলে টিকিট নষ্ট হবে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সেকথাও আমি রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছি। উনি বললেন, রাজা রায়চৌধুরীর যদি জরুরি কাজ থাকে, তা হলে আটকাবার দরকার নেই। সেইজন্য তিনি তোমাকে একটা চিঠিও দিয়েছেন। নরেন্দ্র ভামা পকেট থেকে একটা খাম বার করলেন।

বেশ পুরু কাগজের সাদা রঙের খাম। এক পাশে রাষ্ট্রপতির নাম ছাপা রয়েছে। ওপরের দিকে ছাপ মারা, কনফিডেনশিয়াল।

কাকাবাবু সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই খামটা খুলে দ্রুত পড়ে নিলেন চিঠিখানা।

তারপর খামসুদ্ধ সেটাকে পকেটে রেখে তিনি নরেন্দ্র ভার্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ চিঠিতে কী লেখা আছে, তুমি জানো?

নরেন্দ্র ভার্মা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, প্রেসিডেন্ট আমাকে কিছুই বলেননি।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। তুমি ওঁকে গিয়ে বলল, আমি আজ আর থাকতে পারছি না। কয়েকদিনের মধ্যেই দিল্লিতে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব?

নীচে নেমে এসে কাউন্টারে বিল মিটিয়ে দিতে দিতে কাকাবাবু ম্যানেজারকে বললেন, ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম, ট্যাক্সি এসেছে?

ম্যানেজার বলল, এখনও তো আসেনি। সকাল থেকে দু-তিনবার ফোন করেছি।

কাকাবাবু বললেন, এই রে, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!

হোটেলের লবি থেকে এগিয়ে এল ফিলিপ তামাং। গুড মর্নিং, গুড মর্নিং, বলে সে কাকাবাবুর ডান হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল।

তারপর জিজ্ঞেস করল, মিঃ রায়চৌধুরী, তা হলে সত্যি সত্যি আজই চলে যাচ্ছেন? আমার চাবাগানটায় একবার ঘুরে যাবেন না?

কাকাবাবু বললেন, আপনার নেমন্তন্নর জন্য আবার ধন্যবাদ। কিন্তু এবার থাকতে পারছি না।

পেছন ফিরে হোটেলের ম্যানেজারকে কাকাবাবু প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, আপনাকে কাল থেকে বলে রেখেছি, তবু ট্যাক্সি জোগাড় করে রাখেননি। এর পর ফ্লাইট মিস করব।

ফিলিপ তামাং বলল, বাগডোগরার জন্য ট্যাক্সি খুঁজছেন? আমার গাড়িতে চলে যান না।

কাকাবাবু বললেন, না, না, আপনার গাড়িতে কেন যাব? পয়সা দিলে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না?

ফিলিপ তামাং বলল, টি বোর্ড থেকে একজন অফিসার আজ আসছেন। আমার গাড়ি তাঁকে আনতে যাবে, এখান থেকে ফাঁকা যাবে সেই গাড়ি। শুধু শুধু আপনি ট্যাক্সির জন্য পয়সা খরচ করবেন কেন?

হোটেলের ম্যানেজার আবার ফোন করার চেষ্টা করছিল, এই কথা শুনে ফোন নামিয়ে রাখল, নরেন্দ্র ভামও তাকালেন কাকাবাবুর দিকে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ট্যাক্সি না পেলে আমি তোমার জন্য সরকারি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারি এক্ষুনি। তবে, এই ভদ্রলোকের গাড়ি যখন ফাঁকাই যাচ্ছে…

যে কোনও কারণেই হোক, ফিলিপ তামাংয়ের গাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাকাবাবুর। কিন্তু সকলে মিলে এমন বোঝাতে লাগলেন যে, কাকাবাবুর আর

বলার কোনও যুক্তি রইল না।

ফিলিপ তামাং বলল, মিঃ রায়চৌধুরীর এইটুকু উপকার করতে পারলেও আমি ধন্য হব।

হোটেলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ফিলিপ তামাংয়ের ঝকঝকে নতুন জিপ গাড়ি। মালপত্র ভেতরে রেখে কাকাবাবু বসলেন ড্রাইভারের পাশে। সন্তুকেও তিনি তাঁর পাশে বসতে বললেন, কিন্তু সন্তু ইচ্ছে করে ভেতরে চলে গেল।

আজ আবহাওয়া বেশ পরিষ্কার। ভোর থেকে একবারও বৃষ্টি হয়নি। রোদে ঝলমল করছে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সন্তু প্রত্যেকবার খুব উত্তেজনা বোধ করে, উৎসুকভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আজ তার শরীর ভাল নেই।

দার্জিলিং শহর ছাড়বার পর ঘুম-এর কাছাকাছি এসে কাকাবাবু একবার পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে সন্তু, তোর মন খারাপ লাগছে নাকি? আরও দু-এক দিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল?

সন্তু অন্যমনস্কভাবে বলল, না।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুই এত মনমরা হয়ে আছিস কেন? সকাল থেকে তোর একটা কথাও শুনিনি।

সন্তু এবার সোজা হয়ে বসল, কাকাবাবুর গায়ে ছোঁয়া লেগে গেলেই তিনি সন্তুর জ্বরের কথা টের পেয়ে যাবেন, তাই সে দূরে দূরে থাকছে। কিন্তু কোনও কথা না বলে ঝিম মেরে বসে থাকলেও কাকাবাবু সন্দেহ করবেন।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমাদের রাষ্ট্রপতি যে তোমাকে চিঠি লিখলেন, ওঁর সঙ্গে কি তোমার আগে পরিচয় ছিল?

কাকাবাবু বললেন, তা ছিল। আমি যখন দিল্লিতে চাকরি করতাম, উনি তখন ছিলেন সেই দফতরের মন্ত্রী। প্রায়ই ওঁর কোয়ার্টারে আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কাল দুপুরে লাঞ্চ খাওয়ার সময় ওঁর সঙ্গে সেই সময়কার অনেক গল্প হল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, উনি তোমাকে চিঠিতে কী লিখেছেন?

কাকাবাবু একবার আড়চোখে গাড়ির ড্রাইভারের দিকে তাকালেন। তারপর ইংরেজিতে বললেন, খামের ওপর কনফিডেনশিয়াল লেখা ছিল দেখিসনি। ওই চিঠির কথা কাউকে বলা যাবে না।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, কালকে তুমি বক্তৃতার সময় একবার বলেছিলে, মানুষ এভারেস্টের চেয়েও উঁচু পাহাড় জয় করবে একদিন। এভারেস্টের চেয়ে উঁচু পাহাড় কি আর আছে?

নেই বুঝি? কখনও তো শুনিনি।

চিন দেশে অনেক বড় বড় পাহাড় আছে। কেউ কেউ বলে, তার দু-একটা নাকি এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। অবশ্য, এখনও সেরকম প্রমাণ সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে পৃথিবীর বাইরে তো আছেই!

পৃথিবীর বাইরে?

তুই মঙ্গল গ্রহের পাহাড়টার কথা পড়িসনি বুঝি? মানুষ কয়েকবার চাঁদে পা দিয়েছে, আর দু-এক বছরের মধ্যেই মঙ্গল গ্রহে নামবে। মঙ্গল গ্রহের অনেক ছবি তোলা হয়ে গেছে এর মধ্যে। তার মধ্যে পরিষ্কার দেখা গেছে একটা মস্ত বড় পাহাড়। হিমালয় তার কাছে ছেলেমানুষ। তার চূড়াটা ছাব্বিশ কিলোমিটার উঁচু, অর্থাৎ এভারেস্টের তিনগুণ। তার নাম দেওয়া হয়েছে, মঙ্গ ওলিম্পাস। সেটা আবার একটা আগ্নেয়গিরি। মানুষ একদিন না একদিন সেই পাহাড়ও জয় করবে নিশ্চয়ই।

এভারেস্টের তিন গুণ? ওরেবাবা!

সন্তু জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, এইসব হোট-ছোট পাহাড়ই দেখতে বেশি ভাল, তাই না? একবার কলকাতা থেকে প্লেনে কাঠমাণ্ডু যাবার সময় এভারেস্টের চূড়া দেখা গিয়েছিল, তোর মনে আছে? প্লেনের পাইলট সবাইকে দেখাল। অনেকগুলো বরফ ঢাকা পিকের মধ্যে একটা এভারেস্ট, তার আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্যই বোঝা গেল না!

সন্তু বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, মঙ্গল গ্রহে মানুষ আছে, কিংবা এক সময় ছিল, তাই না?

কে বলো তোকে? সেরকম কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

আমি একটা বইতে পড়েছি। খুব পাওয়ারফুল দূরবিন দিয়ে মঙ্গল গ্রহের গায়ে সোজা সোজা দাগ দেখা গেছে। সেগুলো আসলে শুকনো খাল। নদী কখনও একেবারে সোজা যায় না। মানুষের মতন কোনও প্রাণী না থাকলে খাল কাটবে কে?

ওটা একটা মজার ব্যাপার। বিজ্ঞানীদের ভাবার ভুল। ব্যাপারটা কী ঘটেছিল জানিস? গত শতাব্দীতে ইতালির একজন বৈজ্ঞানিক, তাঁর নাম গিয়োভানি সিয়াপারেলি, তিনি প্রায় সর্বক্ষণ দূরবিনে চোখ দিয়ে বসে থাকতেন আর আকাশ দেখতেন। একবার তিনি নানারকম দূরবিন অদলবদল করতে করতে হঠাৎ মঙ্গল গ্রহে কতকগুলো দাগ দেখতে পেলেন। দাগ তো নয়, সেগুলো হচ্ছে ভূমির ওপর লম্বা-লম্বা খাঁজ। ইতালিয়ান ভাষায় ওই খাঁজকে বলে Canali, সিয়াপারেলি সেই কথা লিখে গেলেন। তারপরে অনেকে ধরে নিল Canali হচ্ছে ইংরেজিতে Canal বা খাল। তখন পৃথিবীতে সুয়েজ খাল, পানামা খাল এইসব বড়বড় খাল কাটা হচ্ছে তো, তাই মানুষ ভাবল তাদের আগেই মঙ্গল গ্রহের জীরা আরও বড় খাল কেটে ফেলেছে। এখন অনেক ভাল ভাল ছবি তুলে দেখা গেছে, খাল-টাল কিছু নেই ওখানে।

এইরকম বিজ্ঞানের গল্পে পেরিয়ে গেল অনেকটা রাস্তা। কাকাবাবুর এইসব গল্পের স্টক অফুরন্ত।

কার্শিয়াং পর্যন্ত এসে জিপের ড্রাইভার হিল কার্ট রোড ছেড়ে পাঙ্খাবাড়ি রোড ধরল। এই রাস্তাটা খাড়াভাবে নেমে গেছে, ঘন ঘন বাঁক, একটু বিপজ্জনক বটে, কিন্তু খুব সুন্দর। অনেকক্ষণ ধরে দেখা যায় মকাইবাড়ি চাবাগান, কাছাকাছি পাহাড়গুলি একেবারে ঘন সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যায়।

এই রাস্তায় বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছনো গেল বাগডোগরায়।

কাকাবাবু জিপের ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু বখশিশ দিলেন। তারপর ওরা এসে বসল এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে। কাকাবাবু বেছে নিলেন একেবারে পেছনের কোণের দিকে দুটো চেয়ার। মুখের সামনে মেলে ধরলেন একটা ম্যাগাজিন।

অনেক বিদেশি অভিযাত্রী ফিরে যাচ্ছেন আজ। তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই কাকাবাবুর পরিচয় আছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না কাকাবাবুর। এবার শুধু তিনি উঠে গিয়ে কাউন্টারে কী যেন কথা বললেন একজনের সঙ্গে।

কলকাতার ফ্লাইট এসে গেছে। একসময় এখানকার যাত্রীদের সিকিউরিটি চেকের জন্য ডাক পড়ল।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুই একটু বোস, সন্তু, আমি বাথরুম ঘুরে আসছি।

কাকাবাবু সেই যে গেলেন, আর ফেরার নামটি নেই।

সন্তু টের পেল, তার আবার বেশ জ্বর এসে গেছে। মাথাটা প্রচণ্ড ভারী, খুব ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে। তবু জোর করে সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। আর তো এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে কলকাতায়। তারপর বিকেলের দিকে ডাক্তার মামাবাবুকে দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে নিলেই হবে।

সমস্ত লোক ঢুকে গেল সিকিউরিটি এরিয়ার মধ্যে। কাকাবাবু এখনও আসছেন না। এর পর প্লেন ছেড়ে দেবে। বাথরুমে গিয়ে কাকাবাবুর হঠাৎ শরীর খারাপ হল নাকি? একবার দেখতেই হয়। কিন্তু সন্তু ভাবল, ব্যাগ দুটো ফেলে বাথরুমের কাছে যাওয়া কি ঠিক হবে? এয়ারপোর্টে বড় চুরি হয়।

দুটো ব্যাগই দু কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে সন্তু এগিয়ে গেল।

বাথরুম পর্যন্ত তাকে যেতে হল না। সে দেখল, এয়ারপোর্টের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কাকাবাবু। সন্তুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

সন্তু প্রায় দৌড়ে এসে উত্তেজিতভাবে বলল, কাকাবাবু, লাস্ট কল দিয়ে দিয়েছে। শিগগির চলো, এর পর আর যেতে দেবে না।

কাকাবাবু শান্তভাবে বললেন, আমরা এই ফ্লাইটে যাচ্ছি না। টিকিট ক্যানসেল করিয়ে এসেছি। চল, একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা আবার ফিরব।

সন্তু দারুণ অবাক হয়ে বলল, আমরা আবার দার্জিলিং-এ ফিরে যাব?

কাকাবাবু বললেন, তুই তো থেকে যেতেই চেয়েছিলি? তোর কলেজের এখনও ছুটি আছে। চল, আর দু-একটা জায়গায় বেড়িয়ে যাই।

সন্তু যেন আকাশ থেকে পড়ল। কাকাবাবু বারবার বলেছেন, তাঁকে ফিরতেই হবে কলকাতায়। ফিলিপ তামাং-এর নেমন্তন্ন নিলেন না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হেলিকপ্টারে চড়ে কালিম্পং যাবার চমৎকার সুযোগটাও ছেড়ে দিলেন। দার্জিলিং থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে নেমে এসে, এয়ারপোর্টে এক ঘণ্টা বসে থেকে তিনি আবার ফিরতে চান। এর মধ্যে হঠাৎ কী এমন ঘটল?

বেড়াবার নামে কিংবা অ্যাডভেঞ্চারের নামে সন্তু সবসময় উৎসাহে টগবগ করে। কিন্তু আজ তার শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। ভাল লাগছে না কিছুই। এটা যদি কোনও শক্ত অসুখ হয়?

একবার সে চিন্তা করল, কাকাবাবুকে জ্বরের কথা বলবে কি না। যাবার পথে কিছু একটা ওষুধ খেয়ে নেওয়া উচিত।

কিন্তু পরের মুহূর্তেই সে ভাবল, একবার সে তার অসুখের কথা উচ্চারণ করলেই কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। এর আগে সন্তুর কোনওবার শরীর খারাপ হয়নি। সন্তু একবার মুখ ফুটে জ্বরের কথা বললেই কাকাবাবু খুব চিন্তা করবেন, তাঁর প্ল্যান পালটে ফেলবেন।

সে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার দার্জিলিং সবসময় ভাল লাগে। এলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছেই করে না?

এয়ারপোর্টের বাইরেটা এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। একটাই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছতলায়। বোঝা গেল, কাকাবাবু আগেই এর ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে রেখেছেন।

ওরা উঠে বসার পর ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনদিক দিয়ে যাব সার? হিলকার্ট রোড? না…

কাকাবাবু বললেন, ও দুটোর কোনও রাস্তাতেই না। আপনি মিরিক-এর দিক ধরে চলুন।

লোকটি চিন্তিতভাবে বলল, মিরিক হয়ে দার্জিলিং? অসুবিধে আছে, সার। সুখিয়াপোখরির পর রাস্তা খুব খারাপ। দু জায়গায় অনেকখানি করে ভাঙা। এর মধ্যে মেরামত না করে থাকলে যাওয়া যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়, ততদূরেই যাব। রাত্তিরটা কোথাও থেকে গেলেই হবে।

সন্তু ভাবল, এইবার তার জ্বরের কথাটা কাকাবাবুকে জানানো উচিত। এর পর যদি অসুখ খুব বেড়ে যায়? একটা কিছু ওষুধ না খেলে আর চলছে না।

কিন্তু একথাও সন্তুর মনে হল যে, এখন অসুখের কথা শুনলেই কাকাবাবু খুব ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। সন্তুকে বকুনি দেবেন, কেন সে আগে জানায়নি। প্লেনটা ছেড়ে গেল, এখন আর কলকাতায় ফেরাও যাবে না! কাকাবাবু আবার দার্জিলিং ফিরে যেতে চাইছেন, নিশ্চয়ই বিশেষ কোনও গোপন উদ্দেশ্য আছে! সন্তুর অসুখের জন্য সেই প্ল্যানটা নষ্ট হয়ে যাবে? ধুত, সামান্য বৃষ্টিতেই তার এমন জ্বর হয়ে গেল! অসুখ হবার আর সময় পেল না!

সন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলল না। গাড়িতে উঠে সে কাকাবাবু আর তার মাঝখানে হ্যান্ডব্যাগটা রাখল। যাতে ছোঁয়া না লাগে।

গাড়িটা চলতে শুরু করার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, খিদে পেয়েছে? দুপুরের লাঞ্চ খেতে হবে। শিলিগুড়িতে এখন খেয়ে নিবি, না মিরিকে গিয়ে খাবি?

সন্তুর খিদেই পাচ্ছে না। সকালবেলা হোটেলে সে ব্রেকফাস্টও পুরো খায়নি। মুখখানা বিস্বাদ হয়ে আছে।

সে বলল, পরে। এখন না!

কাকাবাবু বললেন, এই পথে গেলে একটা ভারী সুন্দর ডাকবাংলো পড়ে। সেটার নাম লেপচা জগৎ। যদি জায়গা পাওয়া যায়, রাত্তিরটা সেখানেই থাকব।

সন্তু বলল, ডাকবাংলোর নাম লেপচা জগৎ? বেশ অদ্ভুত তো?

কাকাবাবু বললেন, সাহেবদের আমলের পুরনো বাংলো। সাহেরা খুঁজে খুঁজে চমৎকার জায়গা বার করে সেখানে বাংলো বানাত। এককালে এই পুরো দার্জিলিং জেলাটা লেপচাদেরই ছিল। সেইজন্যই বোধ হয় ওইরকম নাম।

মিরিক পর্যন্ত রাস্তা বেশ পরিষ্কার। পৌঁছতে কোনও অসুবিধে হল না। বেলা প্রায় আড়াইটে।

এখানে একটা টুরিস্ট লজ আছে। লাঞ্চ খাওয়ার জন্য কাকাবাবু সেখানে গাড়ি থামাতে বললেন। তারপর ড্রাইভারকেও ডেকে নিয়ে এলেন খাবার টেবিলে।

সন্তুর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ কিছু না খেলে কাকাবাবু সন্দেহ করবেন। জোর করেই সে ডাল-ভাত-মুরগির মাংস খেয়ে নিল, তারপর বাথরুমে মুখ ধুতে গিয়ে সব বমি করে ফেলল।

সন্তুর ইচ্ছে করছে নিজের গালে চড় মারতে। এরকম বাজে অসুখ তার আগে কখনও হয়নি। কাকাবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে সে কোনওদিন তাঁকে অসুবিধেয় ফেলেনি। জ্বরটা কি কিছুতেই কমবে না

এর পরেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। দারুণ বৃষ্টি। ড্রাইভারটি জিজ্ঞেস করল, সার, এর মধ্যে আর এগোবেন? আকাশের যা অবস্থা দেখছি, এ বৃষ্টি সহজে থামবে না মনে হচ্ছে। টুরিস্ট লজে ঘর খালি আছে। আজ রাতটা এখানেই থেকে যান না?

কাকাবাবু বললেন, না, এখানে থাকব না। আমরা এগোব।

ড্রাইভার বলল, এই বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে যাবার রিস্ক আছে। কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, আপনাকে বেশি টাকা দেব!

ড্রাইভারটি তবু আপত্তির সুরে বলল, কিন্তু সুখিয়াপোখরির পর আর কিছুতেই যাওয়া যাবে না। আমি এখানে খবর নিয়েছি, তারপরে দার্জিলিং-এর রাস্তা খুব খারাপ হয়ে আছে, এই বৃষ্টিতে আবার ধস নামবে।

কাকাবাবু বললেন, সুখিয়াপোখরি গিয়েই আপনাকে ছেড়ে দেব!

দার্জিলিং ফিরে যাবার জন্য কাকাবাবু এরকম অদ্ভুত জেদ ধরেছেন কেন, তা সন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করেও কোনও লাভ নেই।

বৃষ্টি যদি কমে, সেইজন্য মিরিকে অপেক্ষা করা হল প্রায় এক ঘণ্টা। একবার একটু কমল বটে, কিন্তু গাড়িটা স্টার্ট করার খানিক বাদেই যেন আবার আকাশ ভেঙে পড়ল, এবার বৃষ্টির সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রের গর্জন।

এই অবস্থায় জোরে গাড়ি চালানো বিপজ্জনক। সুখিয়াপোখরি। পৌঁছতে-পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। এখানে অবশ্য তেমন বৃষ্টি নেই। পাহাড়ের এই এক মজা, কোথাও দারুণ বৃষ্টি, কোথাও একেবারে শুকনো খটখটে। সুখিয়াপোখরি অবশ্য শুকনো নয়, খুব মিহি ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে, এরকম বৃষ্টিতে গা ভেজে না।

ড্রাইভারকে টাকা মিটিয়ে দিলেন কাকাবাবু।

ড্রাইভারটি বলল, কাল সকালবেলা দার্জিলিং-এর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। কাল কটায় বেরুবেন, সার?

কাকাবাবু বললেন, কালকে আর আপনাকে দরকার নেই।

ড্রাইভারটি অবাক হয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তাকে আর সে সুযোগ না দিয়ে বললেন, আয় সন্তু!

সুখিয়াপোখরি জায়গাটা ঠিক গ্রামও নয়, শহরও নয়। এমনি কিছু বাড়িঘর, কয়েকটি দোকানপাট রয়েছে। কিছু অল্পবয়েসী ছেলে ক্যারম খেলছে একটা চায়ের দোকানের সামনে। ক্যারমবোর্ডটা একটা উঁচু টেবিলের ওপর রাখা, এরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলে।

সেই চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন কাকাবাবু। সন্তুর দুহাতে দুটো ব্যাগ। রাস্তাটা উঁচুর দিকে উঠে গেছে। ক্রাচ নিয়ে পাহাড়ে উঠতে কাকাবাবুর কষ্ট হয়, তবু তিনি গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

একটা টিলার ওপরের দিকে একটা বেশ সুন্দর কাঠের বাড়ি। সামনের লম্বা বারান্দায় অনেকগুলো ঝুলন্ত ফুলের টব।

সিঁড়ি দিয়ে সেই বারান্দায় উঠে গিয়ে কাকাবাবু একটা দরজায় ঠকঠক করলেন।

কয়েকবার ঠকঠক করার পরও কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে কাকাবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, ক্যাপটেন নরবু? ক্যাপটেন নরবু?

এবার ভেতর থেকে কেউ একজন রুক্ষ গলায় বলল, কৌন হ্যায়?

তারপর দরজাটা খুলে গেল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, তাই কোনও লোককে দেখা গেল না।

কাকাবাবু বললেন, হালো, ওলড বয়?

লোকটি বলল, হু ইজ ইট! গেট আউট! আই ডোনট সি এনি ওয়ান অ্যাট দিস আওয়ার?

কাকাবাবু বললেন, ক্যাপটেন নরবু, তুমি আমায় চিনতে পারছ না?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল লোকটি। তারপর হঠাৎ বিকট উল্লাসের আওয়াজ করে বলে উঠল, রাজা রায়চৌধুরী? রাজা রায়চৌধুরী? সত্যিই রাজা রায়চৌধুরী, না আমি চোখে ভুল দেখছি!

লোকটি দুহাতে এমন জোরে জড়িয়ে ধরল কাকাবাবুকে যে, তাঁর হাত থেকে ক্রাচ খসে পড়ল।

বারান্দার আলো জ্বালার পর দেখা গেল শক্ত-সমর্থ জোয়ান সেই পুরুষটিকে। তবে, তাঁর বয়েস কাকাবাবুর চেয়েও একটু যেন বেশি, সারা মুখে আঁকিবুকি দাগ। গায়ে একটা পুরনো ওভারকোট। তিনি কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের চোটে একেবারে নাচতে শুরু করলেন আর বারবার বলতে লাগলেন, এত দিন পর তুমি এলে? সত্যি আমার বাড়িতে এলে? রাস্তা চিনতে পারলে? ঠিক এগারো বছর পর দেখা, তাই না?

এক সময় কাকাবাবু কোনওরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, আগে চা খাওয়াও! তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। এই আমার ভাইপো, সন্তু। ওকে তুমি আগে দেখোনি!

ক্যাপটেন নরবু এবার সন্তুকেও জড়িয়ে ধরে উঁচুতে তুলে নিলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, আরে, এর গা এত গরম। এর তো খুব জ্বর।

কাকাবাবু অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, জ্বর?

না, না, সেরকম কিছু না, সেরকম কিছু না, বলে সন্তু একটু পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও ক্যাপটেন নরবু তাকে ধরে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। কাকাবাবু তার কপালে হাত দিয়ে বললেন, তাই তো, বেশ টেম্পারেচার দেখছি। চোখ দুটোও বেশ লাল। কখন জ্বর এলো? আগে বলিসনি কেন?

সন্তু বলল, এই একটু আগে। আমি নিজেও তো বুঝিনি।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, আমার কাছে ওষুধ আছে। ঠিক হয়ে যাবে। আগে বসো, চা খাও।

ভেতর দিকে উঁকি দিয়ে একজন কাউকে চা বানাতে বলে ক্যাপটেন নরবু এসে বসলেন সন্তুর পাশে। বারান্দায় বেশ কয়েকটা বেতের চেয়ার ছড়ানো রয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, বুঝলি সন্তু, এই ক্যাপটেন নরবু এক সময় আর্মিতে ছিলেন। আমরা সিমলাতে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। দুজনে একসঙ্গে শিকার করতে গেছি অনেকবার।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, রাজা রায়চৌধুরী দুবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। গ্রেট ম্যান। এরকম বন্ধু হয় না। আমার বাড়িতে আসার জন্য কতবার নেমন্তন্ন করেছি, এত দিনের মধ্যে একবারও আসেননি।

কাকাবাবু বললেন, কোনও খবর না দিয়ে এসে পড়েছি এবার। তোমাকে বাড়িতে পাব কি না তাও তো জানতাম না! আজকের রাতটা লেপচা জগৎ বাংলোতে থাকব ঠিক করেছিলাম। তোমার জিপে সেখানে পৌঁছে দেবে?

ক্যাপটেন নরবু বললেন, মাথা খারাপ! এদিকে এসে তোমরা ডাক বাংলোতে থাকবে? আমার এত বড় বাড়ি খালি পড়ে আছে। আমি এখানে একলা থাকি। আচ্ছা রায়চৌধুরী, আমার বাড়িটা কী করে চিনলে বলো তো?

কাকাবাবু বললেন, তুমি যেরকম ডেসক্রিপশান দিয়েছিলে, সেটা মনে ছিল। সুখিয়াপোখরিতে টিলার ওপরে কাঠের বাড়ি। একটা চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে রাস্তা। এখানে তো মোটে একটাই চায়ের দোকান।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, আগে একটা খবর দিতে পারতে না? সত্যিই যদি আমি বাড়িতে না থাকতাম? আজই আমার শিলিগুড়ি যাবার কথা ছিল। বৃষ্টির জন্য বেরোইনি!

কাকাবাবু বললেন, চা নিলাম। তোমাকে না পাওয়া গেলেও রাত কাটাবার মতন একটা জায়গা ঠিক পাওয়া যেতই, কী বলল! কিন্তু সন্তুর যে জ্বর এসে গেল, তার কী হবে? তোমাকে নিয়ে এদিকটায় আমার কিছু ঘোরাঘুরির প্ল্যান ছিল।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, ওর জ্বর আমি আজকের মধ্যেই সারিয়ে দিচ্ছি। আমার কাছে ভাল ওষুধ আছে। সেই ওষুধেও যদি না সারে, তা হলে এখানে এক তিব্বতি লামার কাছে নিয়ে যাব, তিনি সব অসুখ সারিয়ে দিতে পারেন।

কাকাবাবু হেসে বললেন, ধন্বন্তরি লামা! হ্যাঁ, এঁর কথা শুনেছি। একবার দেখা করার ইচ্ছে আছে। আগে সন্তুকে তোমার ওষুধটাই দাও।

ক্যাপটেন নরবু দুহাতে সন্তুর মাথাটা চেপে ধরলেন। সেইভাবে একটুক্ষণ থাকার পর বললেন, হ্যাঁ, বেশ জোর ঠাণ্ডা লেগেছে। জ্বরটা সহজে যাবে না। একদম বেড রেস্ট নিতে হবে। দুদিন বিছানা থেকে ওঠা চলবে না, বুঝলে?

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমি একটা ঘর দেখিয়ে দাও। সন্তু এখনই গিয়ে শুয়ে পড়ক বরং।

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে আপত্তি করে বলল, না, না। আমি এখন শোবো না।

আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, আগে খাবার-দাবার খাবে, তারপর তো ঘুমাবে। তোমরা খুব ভাল দিনে এসেছ। আজ ময়ূর শিকার করেছি, ময়ুরের মাংস আমি নিজে রান্না করেছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি এখনও শিকার করো, নরবু? আমি শিকার একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। নিরীহ পশু-পাখি মারতে আমার একটুও ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া ময়ূর তো আমাদের ন্যাশনাল বার্ড। ময়ূর মারা নিষেধ!

ক্যাপটেন নরবু বললেন, তোমরা যেরকম পেখম-মেলা বড় বড় ময়ূর দেখো, এগুলো সেরকম নয়। এ একরকম পাহাড়ি ময়ূর, বহুত পাজি! ফসল নষ্ট করে। আমি কমলা লেবুর ফার্ম করেছি, সেখানেও এসে উৎপাত করে খুব। ঝাঁকঝাঁক আসে। বন্দুক দিয়ে একটা-দুটো মারলে তবে অন্যগুলো পালায়।

কাকাবাবু বললেন, তুমি কমলালেবুর ফার্ম করেছ? কাল সকালে দেখতে যাব।

এইসময় এক বৃদ্ধা একটা ট্রেতে করে চায়ের পট আর তিনটে কাপ এনে রেখে গেল একটা টেবিলে।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, দাঁড়াও, মাস্টার সন্তু, তুমি চা খেও না। আমি তোমার জন্য খুব স্ট্রং দাওয়াই নিয়ে আসছি।

কাকাবাবু নিজের চা তৈরি করে নিলেন। ক্যাপটেন নরবু ভেতরে চলে ৫০২

গিয়ে একটু বাদেই একটা বড় কাচের মগ ভর্তি কী যেন নিয়ে এসে সন্তুকে বললেন, আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে খাও। দ্যাখো খারাপ লাগবে না।

কাচের মগের মধ্যে অনেকটা খয়েরি রঙের গরম পানীয়। বেশ ঘন। প্রথমে একটা চুমুক দিয়ে সন্তুর মনে হল, খেতে সত্যি খারাপ নয়। এলাচ, দারুচিনি আরও কী সব যেন আছে। কমলালেবুর গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।

খানিকটা খেতেই সন্তুর কান গরম হয়ে গেল, চোখ ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। জিনিসটা ঠিক ঝাল নয়, তবে বেশ ঝাঁঝ আছে। সন্তুর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে।

ক্যাপটেন নরবু কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, রাজা, তোমরা এসেছ, সেজন্য আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু আমার আর একটা কৌতূহলও হচ্ছে। শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যই কি এই ঝড় বাদলের দিনে তুমি সুখিয়াপোখরি এসেছ? না, এখানে তোমার অন্য কোনও কাজও আছে?

চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মৃদু হেসে কাকাবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল তো বটেই। তা ছাড়া, আমার এখানে ঠিক কোনও কাজ নেই, তবে একটা কৌতূহল মেটানোর ইচ্ছে আছে। সে ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, কী ব্যাপার বলো তো?

কাকাবাবু উঠে গিয়ে বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, বাঃ, বৃষ্টি থেমে যাবার পর বেশ জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাতাসে কী যেন একটা ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাক। তারপর বাগানে বসে গল্প করতে করতে তোমায় সব বলব!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress