Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলটা দিব্যি ছিমছাম। ঘরে ঘরে টেলিফোন, হিটার, স্নানের ঘরে ঠাণ্ডা-গরম জলের ব্যবস্থা, বিছানার চাদর, বালিশ পরিষ্কার-মোট কথা সব কিছু দেখে মনটা যাকে বলে বেশ প্রসন্ন হয়ে গেল। দিন দশেকের জন্য এসেছি, তাই থাকার ব্যবস্থাটা মোটামুটি ভাল না। হলে মনটা খুঁতখুঁত করে।

পথে কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। সোনাদা এলে পর লালমোহনবাবু তাঁর রাজস্থান থেকে কেনা। কান-ঢাকা চামড়া আর পশমের টুপিটা মাথায় চাপিয়ে নিলেন। পথের দুধারে পাহাড়ের দৃশ্য দেখে উনি কতবার যে বা বলেছেন, তার হিসেব নেই। শেষটায় কার্সিয়ং রেলওয়ে রেস্টোরান্টে চা খাবার সময় ভদ্রলোক সত্যি কথাটা বলে ফেললেন। সেটা হল এই যে, তিনি এই প্রথম দাৰ্জিলিং-এ চলেছেন।

ফেলুদার চোখ কপালে উঠে গেল।

সে কী আপনি এখনও কাঞ্চনজঙ্ঘাই দেখেননি?

নো সার। একগাল হেসে জিভ কেটে বললেন লালমোহনবাবু।

ইস্—আপনাকে প্রচণ্ড হিংসে হচ্ছে।

কেন?

প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার যে কী অদ্ভুত অনুভূতি, সেটা তো আমাদের মধ্যে একমাত্র আপনিই বুঝবেন! ইউ আর ভেরি লাকি, মিস্টার গাঙ্গুলী।

আকাশ পরিষ্কার থাকলে কার্সিয়ং থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, কিন্তু আজ মেঘলা। ঘুম যখন পৌঁছলাম তখন আলো পড়ে আসছে, আর তখনও মেঘ কাটেনি? মোট কথা লালমোহনবাবুর ভাগ্যে ব্যাপারটা এখনও ঘটেনি। এটা অবিশ্যি দাৰ্জিলিং-এর বিখ্যাত ঘটনা। এমনও হতে পারে যে এই দশ দিনের এক দিনও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে না। তা হলে অবিশ্যি খুবই খারাপ হবে। আমি নিজে এর আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে থাকলেও আবার নতুন করে দেখার জন্য উদ্‌গ্ৰীব হয়ে আছি। এই একটা দৃশ্য, যা কোনও দিনও পুরনো হবার নয়।

হোটেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেক খাড়াই উঠেই ম্যাল। যখন পীছলাম, তখন দোকানের আর রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। লালমোহনবাবু বললেন, কী ব্যাপার মশাই, গাড়িটাড়ি দেখছি না কেন? ফেলুদাকে বুঝিয়ে দিতে হল, দাৰ্জিলিং-এর বেশ খানিকটা অংশে গাড়ি চলা নিষিদ্ধ। ম্যালটা হল সে রকম একটা জায়গা। এখানে শুধু হাঁটা চলে আর ঘোড়ায় চড়া চলে। আপনি ঘোড়ায় চড়েছেন কখনও? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

নাঃ, বললেন লালমোহনবাবু। তবে উটেই যখন চড়া আছে, তখন ঘোড়া তো তার কাছে নস্যি।

আগেই বলেছি যে বিরূপাক্ষ মজুমদার বলে একজনের বাড়িতে শুটিং হবার কথা আছে।

আশ্চর্য এই যে, প্রথম দিনই ম্যালে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল! সেটা হল। পুলক ঘোষালের মারফত। শুটিং পার্টি ম্যালে বেড়াতে বেরিয়েছে, পুলক ঘোষাল একবার আগেই দাৰ্জিলিং এসে বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়ি দেখে পছন্দ করে গেছেন, ভদ্রলোকও কোনও আপত্তি করেননি। ফেলুদাকে দেখেই পুলকবাবু এগিয়ে এলেন, তাঁর সঙ্গে একজন ফেল্ট হ্যাঁট আর সুট পরা ভদ্রলোক।

এঁর বাড়িতেই আমরা শুটিং করছি, বললেন পুলকবাবু, ইনি হলেন মিস্টার বিরূপাক্ষ মজুমদার।

তার পর পুলকবাবু আমাদের তিন জনের পরিচয় দিয়ে দিলেন ভদ্রলোককে। আপনার সঙ্গে শুটিং-এর কী সম্পর্ক? ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন মিঃ মজুমদার। ফেলুদা বলল, আমার কোনও সম্পর্ক নেই, তবে আমার এই বন্ধুটি একজন বিখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক। এরই একটি গল্প থেকে ছবিটা হচ্ছে।

বাঃ, ভেরি গুড! ইনি ক্রাইম রাইটার, আর আপনি গোয়েন্দা—ভেরি গুড! প্ৰদোষ মিত্র নামটা তো জানা বলে মনে হচ্ছে। আপনার নাম তো কাগজে বেরিয়েছে কয়েকবার, তাই न्म?

আজ্ঞে হ্যাঁ, বলল ফেলুদা।গত বছর বাসপুকুরে একটা খুনের ব্যাপারে আমি কিছুটা সাহায্য করেছিলাম।

দ্যাট্‌স রাইট, বলে উঠলেন ভদ্রলোক, তাই চেনা চেনা লাগছিল। আমার আবার একটা বাতিক আছে; আমি খবরের কাগজের খবর সংগ্ৰহ করি। আমার সতের বছর বয়স থেকে এই হবি। সব খবর নয়, যাকে বলা যায় একটু গরম খবর। একত্ৰিশটা খণ্ড হয়েছে সেই খবরের খাতার। এখন তো রিটায়ার করেছি; মাঝে মাঝে সেই সমস্ত পুরনা খাতার পাতা উলটে উলটে দেখি। লোকে গল্পের বই পড়ে, আর আমি পুরনা খবর পড়ি। এখন অবিশ্যি আমার একজন হেলপার হয়েছে। রজত—আমার সেক্রেটারি-আমার কাটিংগুলো খাতায় সেঁটে দেয়। আপনার কাটিংও আছে তার মধ্যে।

আমরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিলাম ম্যালের মুখে ফোয়ারাটা ছাড়িয়ে মেন রোডের দিকে। মিঃ মজুমদার বললেন, আমার একটা ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, কেনা দরকার। চলুন না। ওই কেমিস্টের দোকানে।

আমরা গিয়ে দোকানে ঢুকলাম। ভদ্রলোক টিফানিল নামে রাংতায় মোড়া একত্ৰিশটা বড়ি কিনলেন। বললেন, এ হল অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট পিলস্—আমার এক মাসের স্টক। রোজ একটি করে না খেলে আমার ঘুম হয় না।

দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, এক’দিন গিয়ে আপনার খাতাগুলো একটু দেখব।

একশোবার বললেন ভদ্রলোক।ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। এও আপনাকে দেখিয়ে দেব যে, এখনও কিনারা হয়নি এমন পুরনা তদন্তের খবরও আমার খাতায় সাঁটা আছে। আমি বলছি প্ৰায় বিশ বছর আগের কথা।

খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। বলল ফেলুদা।

অবিশ্যি আমার নিজের জীবনটাও কম ইন্টারেস্টিং নয়, বললেন ভদ্রলোক। এক এক সময় ইচ্ছে করে আত্মজীবনী লিখি, কিন্তু তার পরেই মনে হয়—সবগুলো সত্যি কথা তো লিখতে পারব না। আত্মজীবনী লিখতে গেলে কোনও কিছুই গোপন রাখা উচিত নয়। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। যাক গে—এক’দিন আসবেন।

কোন সময় গেলে আপনার ব্যাঘাত হবে না?

দ্য বেস্ট টাইম ইজ ইন দ্য মর্নিং। আমি বিকেলে একটু ঘুরতে বেরোই। মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল ছাড়িয়ে একটু গেলে বাঁয়ে একটা রাস্তা পাবেন যেটা পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে। সেটা দিয়ে কিছু দূর গেলেই দেখবেন, গেটে নয়নপুর ভিলা লেখা একটা বাগানে ঘেরা বাংলো। সেটাই আমার বাড়ি।

ভদ্রলোক হাত তুলে গুড বাই করে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘোড়ায় চাপলেন, সঙ্গে একজন সহিস। ফেলুদা বলল, রুগি মানুষ, খাড়াই ওঠা বারণ, তাই নিশ্চয়ই ঘোড়া ব্যবহার করেন। তবে বেশ লোক, তাতে সন্দেহ নেই।

শুটিং পার্টির সকলে এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে দেখছে, পুলকবাবু এগিয়ে এসে বললেন, মজুমদার মশাইকে কেমন লাগল?

খুব ভাল, বলল ফেলুদা।অসুখ হলে কী হবে, এখনও বেশ তাজা আছেন।

আর সব ব্যাপারে ইন্টারেস্ট। শুটিং-এর বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন।

উনি ছাড়া আর কে থাকেন ওঁর বাড়িতে?

ওর সেক্রেটারি আছেন, রজত বোস। এ ছাড়া জনা তিনেক চাকর, মালী আর সহিংস আছে। ভদ্রলোক বিপত্নীক। ওঁর ছেলে আসছেন কলকাতা থেকে। অন্তত আসার তো কথা। একটিই ছেলে। মেয়ে আছে দুটি, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা কলকাতায় থাকে না।

ভদ্রলোকের হবিটা কিন্তু খুব চিত্তাকর্ষক।

কাটিং জমানোর কথা বলছেন?

হ্যাঁ। অনেকটা আমাদের সিধুজ্যাঠার কথা মনে পড়ছে।

আমারও যে তা মনে হয়নি তা নয়, তবে সিধুজ্যাঠা শুধু খুনখারাপির খবরই জমান না; ইন্টারেস্টিং খবর হলেই সেটা সেঁটে রাখেন।

কথা আর বেশি দূর এগোল না। পুলকবাবু বললেন শুটিং-এর অনেক তোড়জোড় আছে, এবার হোটেলে ফিরতে হবে। আগামীকাল নাকি খুব হালকা আউটডোরের কাজ রাখা হয়েছে; তার পরদিন থেকে আর্টিস্ট নিয়ে কাজ শুরু হবে, আর প্রথমেই বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়িতে কাজ।

দোকানের খোলা ছাতে বসে। হট চকোলেট খেলাম। লালমোহনবাবু খুব তৃপ্তি সহকারে চকোলেটে চুমুক দিয়ে বললেন, মশাই, আমার মন কিন্তু একটা কথা বলছে।

কী বলছে?

বলছে এ যাত্রা বৃথা যাবে না।

বৃথা কেন যাবে? দাৰ্জিলিং-এ এসেছি। চেঞ্জে, এমন চমৎকার ক্লাইমেট, বৃথা কখনও যেতে পারে? পালিউশন-ফ্রি আবহাওয়া—শরীর সারতে বাধ্য।

আমি সেদিক দিয়ে বলছি না, একটা বিজ্ঞ হাসি হেসে বললেন জটায়ু।

তবে কোন দিকে দিয়ে বলছেন?

আমি আপনার পেশার কথা ভাবছি।

আমার পেশা?

আমার মন কেন জানি বলছে যে, আপনাকে কাজে লেগে পড়তে হবে।

ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, আসলে মুশকিলটা করছে আমার পেশা নয়, আপনার পেশা। আপনার স্বভাবই হল অলিতে-গলিতে রহস্যের গন্ধ পাওয়া। অবিশ্যি যদি তেমন কিছু ঘটেই বসে, গড ফরবিড়, তা হলে ফেলুমিত্তির হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না এটা এই তো চাই!

এই তো এ. বি. সি. ডি.-র পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মনোভাব!

এইখানে বলে রাখি, এ. বি. সি. ডি. হল ফেলুদাকে দেওয়া লালমোহনবাবুর খেতাব। এর মানে হল এশিয়াজ ব্রাইটেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর। কাজেই উনি ফেলুদাকে মাঝে মাঝে এ. বি. সি. ডি. বলে সম্বোধনও করে বসেন।

আমি জানি না, কিন্তু বিরূপক্ষ মজুমদারের সঙ্গে যেটুকু আলাপ হল, তাতে আমারও ভদ্রলোককে বেশ রহস্যজনক চরিত্র বলে মনে হল। বছরের পর বছর প্রায় একাই দার্জিলিং-এ পড়ে আছেন। খাতায় গরম গরম খবর সাঁটছেন, আর পুরনো খবর পড়ে দেখছেন; অবিশ্যি তার মানেই যে তাকে ঘিরে কোনও ক্রাইম ঘটবে, সেটা ভাবার কোনও যুক্তি নেই। আসল কথাটা হচ্ছে কী-ফেলুদা চেঞ্জে গেলেও সেখানে শেষ পর্যন্ত তাকে গোয়েন্দার ভূমিকা নিতে হয়, এটা এতবার দেখেছি যে, মন বলছে এবারও সেটা না হয়ে যায় না।

দেখা যাক, কপালে কী আছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *