সমাজ: গল্প হলেও সত্যি
গল্প তো অনেক শুনেছেন, পড়েছেন। প্রেম, ভূত, ভয়ংকর, রহস্য-রোমাঞ্চ আরো কত কি! কিন্তু বাস্তবটা জানতে চেয়েছেন কি কখনও ? চারপাশে কি ঘটছে চোখে পড়ছে কি কিছু? কি কেমন চিন্তায় পড়ে গেলেন মনে হচ্ছে, নানা এত ভাবনা চিন্তার কিছু নেই এখানে। আসলে আমরা কেউ তো আর মানুষ নই। পৃথিবীতে মানুষ জন্মানো তো বন্ধ হয়ে গেছে সেই বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই । এখন যা আছে সবাই কলের পুতুল মাত্র! কেনো কি ভাবে তা একটু পরেই জানতে পেরে যাবেন। গত ১০ বছরে অনেক তো গল্প শোনালাম আজ নাহয় একটা বস্তব তুলে ধরি সবার সামনে –
নানা এবার ট্রান্সেলভেনিয়ার জঙ্গল বা কলকাতার জমজমাট কংক্রিটের জঞ্জালের গল্প নয় বরং একটা ছোট্ট শহর কালিয়াগঞ্জ এর কথাই তুলে ধরবো। তার আগে একটা বহুল প্রচলিত সংবাদ পত্রের প্রথম পাতার হেডলাইনটা আপনাদের একটু পরে শোনাই –
” ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা কালিয়াগঞ্জ এর এন এস রোডে নিয়ন্ত্রণ হারা গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু এক যুবকের!..“ বাকিটা আর পড়ার প্রয়োজন হবে না। আপনারা হয়তো ভাবছেন হটাৎ এসব বলছি কেনো এসব তো আপনাদের জানা। কিন্তু আদৌতেও কি তাই ? আপনারা ভাবুন ততক্ষন আমি আপনাদের নিয়ে যাই এসবের গোড়ায়।
সেদিন ছিলো শনিবার। স্বপ্নময়ের ঘুম ভাঙ্গে তার মায়ের চ্যাচানিতে। এমনিতে সে দেরি করে ওঠে না। অবশ্য তার মতো খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে সকাল ১১ টা পর্যন্ত ঘুমানোর কোনো উপায় ও নেই। কিন্তু সেদিনের ব্যাপারটা ছিলো একটু অন্যরকম, তার জীবনের বহু প্রতীক্ষিত দিন। একটা বড় কোম্পানি থেকে চাকরির অফার পেয়েছে স্বপ্নময় আজ তারই ইন্টারভিউ। ভাতের থালাটা তার সামনে এগিয়ে দিতেই এক গ্রাস মুখে তুলে নিয়ে সে বললো ” এবার যেনো হয়ে যায়। এবার হয়ে গেলেই ব্যাস তারপর আমরা সবাই মুক্ত।”
উত্তরে তার মা বললেন, ” সব চেয়ে বড় কথা তোকে আর ওই কাজ করতে হবে না!”
বলাই বাহুল্য দিনের বেলা স্বপ্নময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নোংরা তোলার কাজ করে এবং রাতে যতটুকু ফাঁকা সময় সে পায় তাতে সে তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। হয়তো এত দিনের কষ্টের ফলই আজ পাবে সে।
বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে স্বপ্নময় হটাৎ একটা কালো বেড়াল তার রাস্তা কেটে দিল। স্বপ্নময় নতুন যুগের ছেলে এসবে কি সে বিশ্বাস করে? শতবার বারণ করার পরও বেরিয়ে গেলো সে। সময়টা তখন হয়তো ১০:৩০ এর কাছাকাছি হবে। রাস্তার সবাই দেখেছে আমিও দেখেছি ১২০০ ভল্টের তারটা ছিঁড়ে আঁছড়ে পড়লো গাড়িটার ওপর গাড়িটাও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গিয়ে ধাক্কা মারলো রাস্তার সব চেয়ে নিরাপদ জায়গার দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্নময়কে। শুধু একটা ধপ করে শব্দ ব্যাস সব শেষ। একরাশ আশা একটা ভরসা, একটা ইচ্ছা, একটা মানুষের কঠিন পরিশ্রম। সব শেষ। আমি ছুটে গেলাম দেখলাম না এক্ষুনও প্রাণ আছে। হাসপাতাল নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে। চারিদিকে ভির জমে গেছে সবাই চুপচাপ তামাশা দেখতে এসেছে। গেলাম কয়েকজনের কাছে হাত জোড় করলাম একটা গাড়িও রাজি হলো না। শুধু তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটা বলছে, ” এই যুদ্ধে আমি হেরে গেলাম !” কথাগুলো আজও আমায় তারা করে বেড়ায়। যদি একজনও সেদিন রাজি হয়ে যেত তবেই। ওকে বাঁচানো যেত। কিন্তু এটাতো শুধু একটা ঝলকমাত্র। আসল ঝামেলা তো এখন শুরু হবে। ঘটনাস্থলে পুলিশ, ডাক্তার, প্রশাসনের কিছু উচ্চপদস্থ ব্যাক্তি, নেতা মন্ত্রী সবাই আসে ভিড় জমালো। বিদ্যুৎ বিভাগে একটা কমপ্লেইন জানানো হলো। কিন্তু তাদের কথা হলো রোড ডিপার্টমেন্টের চোদ্দো দফায় কাজ করানোর জন্য বড় বড় তার খোলার জন্য এমন হয়েছে এখানে দোষী হলো রোড ডিপার্টমেন্ট। এবার রোড ডিপার্টমেন্ট- এ কমপ্লেইন করা হলে তাদের বক্তব্য অ্যাকসিডেন্ট তো স্টেট বাস-এ হয়েছে তাহলে এখানে দোষ ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের। কথাগুলো শুনতে মনে পরে যায় ঠিক এমনি এক ঘটনার বিবরণ একজন বিশিষ্ট লেখক দিয়েছেন তার গল্পে। পার্থক্য একটাই এটা হলো নিছক বাস্তব। এভাবে কেস চলতে থাকে ফাইল এই দপ্তর থেকে ওই দপ্তর গড়াতে থাকে, সুরাহা কিছুই হয় না। একটা ছোট শহরে একটা সাধারণ পরিষ্কার কর্মী মারা গেছে তাতে কার কি। আমরা এখানেই তো হেরে যাই, মানুষ হিসেবে। আমরা জন্তুর চেয়ে কিছু কম না। আর যাই হই আমরা মানুষ অন্তত না। যদি হতাম নিশ্চই কেউ না কেউ সেদিন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ছেলেটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। কেউ করেনি কারণ সবাই ভেবেছিল “আমার কি!” আর এটাই আমাদের সব চেয়ে বড় ভুল। গিয়েছিলাম ছেলেটার বাড়ি তার মা ছাড়া আর কেউ নেই। ভেঙে পড়েছেন উনি একদম। আমি আর কিয় বা করতে পারি। দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব শুনলাম শুধু। ভাবলাম গল্পতো সবসময়ই বলি আজ এটা জানানো টা বোধহয় বেশি দরকার।।