স্বপনের মায়া
আর পাঁচটা বাচ্চার মতই বেড়ে উঠছিলেন স্বপ্না। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খেতেন। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় আসতেই শুরু হল গোলমালটা। বন্ধুরা কেমন যেন ধীরে ধীরে ‘নারী’ হয়ে উঠছে। তার সেরকম কিছু হচ্ছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফারাকটা আরও স্পষ্ট হতে লাগল। সেদিনই তিনি প্রথম বুঝলেন, তিনি ‘অন্যরকম’। তিনি ‘মেয়েদের মত’ দেখতে হলেও মেয়ে নন। শুরু হল অস্তিত্বরক্ষার লড়াই।
ফ্যামিলি ডাক্তার যেটা বললেন, সেটা নিজের কানকেও বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। ডাক্তারই তাঁকে বললেন, তিনি ইন্টারসেক্স। মানে যাকে বলে হিজড়ে। তার প্রজননতন্ত্র নেই। কথাটা শুনেই ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন। গোপন করলেন নিজের আসল ‘লিঙ্গ পরিচয়’।
কিন্তু, তখনও তো আরও একটা বড় লড়াই বাকি ছিল…রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম। সুপাত্রের সঙ্গে ‘মেয়ে’র বিয়ে ঠিক করলেন বাবা। বয়স তখন সবে ২২ বছর। শুরু হল প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে নিজের, সত্ত্বার সঙ্গে সত্ত্বার যুদ্ধ। মুক্তি চাইলেন এই দ্বিচারিতা থেকে। নারীর শরীরে পুরুষকে ধারণ নয়, বাঁচতে চাইলেন তিনি যা সেটা হয়েই। আর তারপর…
একদিন সাহস করে সবার সামনে সত্যিটা বলেই ফেললেন। প্রকাশ করলেন নিজের পরিচয়।মনের ঝড় নামল,কিন্তু ঝড় উঠল জীবনে। এবার তো তথাকথিত ভদ্র সমাজে তার আর ঠাঁই হয় না! নিজের পরিবারই তাঁকে তাড়িয়ে দিল। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে জায়গা পেলেন ওঁদের মাঝে। যাঁরা ঠিক তাঁরই মত লড়ছে অস্তিত্বরক্ষার লড়াই। সেখানেই পেলেন নতুন বন্ধু, পেলেন নতুন জীবন। স্বপন চায়ের দোকানে আসতেই রমজান বলল সেই ভোরে দোকান খুলতেই মেয়ে কোলে বউটা আশ্রয় চায়। বায়না দেখ মাগীর। স্বপন মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে কাজে বেড়িয়ে যায়।
কি হবে মেয়েটার? এভাবেই রাস্তায় পড়ে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরবে? পরনে ভদ্র ঘরের পোশাক, বোঝাই যাচ্ছে পরিবার অবস্থাপন্ন। ফুটফুটে চাঁদের মতন চেহারা। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, বড় বড় চোখ। তাকালে কেমন যেন করে ওঠে মন। হাত পা ঠিকই আছে দেখা যায়, কিন্তু মনে হয়না হাঁটতে জানে বা পারে। একটা জড় বস্তুর মতন পড়ে আছে ফুটপাতের এক কোনে, কাপড়-চোপড়ে পায়খানা-প্রসাব করে ভাসিয়েছে। হাঁটতে পারলে সরে বসতো। পায়খানা-প্রসাব যে নোংরা, সেই বোধটাই হয়তো নেই? কেননা খাওয়ার বোধটাও ছিল না। একটা বনরুটি দিয়েছিল, ছুঁয়েও দেখেনি।কি করে খেতে হয়, সে জ্ঞানটুকুনও নেই হতভাগীর।স্বপ্ন ভাবল মেয়েটা যদি তার হতো।
রাতে এসে শুনলো স্বামীর অত্যাচারের হাত থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল।সেখানে যেতেই দাদা বৌদি তখনই গাড়িতে উঠিয়ে এখানে নামিয়ে দিয়ে বলে এখানে কোথাও ঠাঁই পেয়ে যাবি। সেই মা ও মেয়েকে আশ্রয় দিলেন তিনি। শুরু হল ‘বাবা’-র দায়িত্ব পালন। ‘বধাই’ (শিশুর জন্মের খবর পেয়েই চলে যাওয়া নবাজাতকের বাড়ি। সেখানেই নেচে গেয়ে উপার্জিত টাকা) থেকে মাস গেলে যে আয় হত, সেখান থেকেই একটা ভালো পরিমাণ টাকা, প্রতি মাসে সেই নির্যাতিতা মহিলাকে দিতে থাকলেন।
স্বপন অহঙ্কারের সঙ্গে বলেন, ” কোনওদিন ভালো স্বামী হওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আজ আমি হিজড়ে। তাই সন্তানের জন্ম দিতে পারিনি। কিন্তু জীবন আমায় একটা সুযোগ দিয়েছে বাবা হওয়ার। আমি বাবা। আমি আমার মেয়ে মায়াকে পেয়েছি।”
মায়াকে বিস্তর ডাক্তার দেখিয়ে করেছে চিকিৎসা। পুরোপুরি সুস্থ হবে না কখনোই, তবে জড় বস্তুর জীবন থেকে অনেকটাই বের হয়ে আসবে সে। মায়া এখন টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলে জানাতে পারে, রঙ পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুকি করতে পারে, শব্দ করে হাসতে পারে। এক কোনায় একা বসে দিন কাটায় না।স্বপনের বড় ইচ্ছা মায়াকে বিশেষ শিশুদের একটি স্কুলে ভর্তি করাবার। সেই নিষ্পাপ-সরল শিশুটির ভালোবাসার সারল্যে মোড়া ভীষণ সহজ একটি সম্পর্ক স্বপন হিজড়ার।