সৃজনশীলতার উৎকর্ষ সাধনে সংগঠনের ভূমিকা
বিষয়টি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত কঠিন হলেও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে, এর উপরে লিখতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটা মনে জাগে তা হল, সৃজনশীলতায় সত্যিই কি সংগঠনের ভূমিকা আছে? সাহিত্যের নিরিখে হোক বা উৎকর্ষতার খাতিরেই হোক, সৃজনশীলতা মানুষের জন্মগত প্রতিভার বিকাশ। আলাদা আলাদা মানুষের আলাদা আলাদা প্রতিভা আর এই প্রতিভার বিকাশে পরিবেশ এবং পরিজন বড়জোর সহযোগিতা করতে পারে। এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উক্তি প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেছিলেন, জ্ঞানের আলো তা সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই জ্বলুক না কেন, তা একদিন সারা বিশ্বকে আলোকিত করবে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির আঙিনায়, রবীন্দ্র পূর্ব এবং রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে যে সমস্ত নমস্য মহাজ্ঞানী মহাজন ও সমাজ সংস্কারক, রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঋষি বঙ্কিম চন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত, ও আরও আরও যারা মহাজন, জ্ঞানী জন, গুণী জন, বিজ্ঞানী এবং নমস্য জন আছেন তাদের লেখায় বা আবিষ্কারে বা সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টায় কোন সংগঠনের প্রভাব আছে বলে জানা নেই। কিন্তু, তাদের প্রতিভার যে বর্ণময় আলোকচ্ছটা সৃজনশীলতার সর্বোৎকৃষ্ট উৎকর্ষে পৌঁছেছিল সে বিষয়ে প্রমাণপত্র দাখিলেরও প্রয়োজন নেই।
এবার আসি রবীন্দ্রোত্তর যুগ, কল্লোলযুগ বা কল্লোলোত্তর যুগের কথায়।
এই যুগে নতুন সাম্যবাদী চিন্তার ঢেউ আছড়ে পড়ে সারা বিশ্বের সাথে আমাদের দেশ ভারতবর্ষে , বিশেষ করে কলকাতায় ও সারা বঙ্গভূমিতে। এই নতুন চিন্তার ঢেউ পুরাণো সব কিছুকে ভেঙে তছনছ করে চিন্তার জগতে এক নবজাগরণ ঘটায়। একক প্রতিভারা সম্মিলিত হয়, দল বাঁধার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, এবং বেশ কিছু মধ্য মেধার সাম্যবাদে উৎসর্গীকৃত প্রাণ সাম্যবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রভূত সংখ্যক প্রতিভাধর মানুষের সাথে জোট বাঁধেন। তৈরি হয় গণসংগঠন। গণনাট্যসংঘ তার মধ্যে অন্যতম। সাম্যবাদ প্রচারের জন্য একটা আবরণ এবং সংগঠনের দরকার ছিল। কেননা ধনতান্ত্রিক বিদেশী প্রভুরা এই নতুন মতবাদটিকে সহ্য করতে পারতেন না। তাই গোপনে গণসংযোগ বাড়ানোর জন্য সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ইত্যাদি জনপ্রিয় মাধ্যমকে ব্যবহার করে গণসংযোগ রাখার একটা প্রয়াস করা হয়েছিল। নাম করলে এতো নাম ভীড় করে আসবে তা অকল্পনীয়। সেখানে গায়ক, নায়ক, কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক,পাঠক ও সাধক সবাই আছেন। তারা সকলেই যে বিশাল প্রতিভাবান ছিলেন এমন নয় কিন্তু তাদের সৃষ্টিশীলতায় আমরা ধন্য। তবু বলি, সৃষ্টিশীলতা মানুষের নিজস্ব। জন্মের সাথে ঈশ্বরের আশীর্বাদকে সাথে করে বয়ে আনা এক অমূল্য সম্পদ । সংগঠন সেই প্রতিভাকে জোট বেঁধে কোমর কষে লড়তে শিখিয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিচারের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ সংগ্রামকে সাবলীলতা দান করেছে, কিন্তু দক্ষ বা অদক্ষকে প্রতিভাধর করতে পারেনি। বরং আমরা দেখেছি, গণসংগঠন করতে গিয়ে, ছেঁড়া চটি আর ঝোলা ব্যাগ সম্বল করে সৃষ্টিশীল প্রতিভার অপমৃত্যু হয়েছে দারিদ্রে আর দুর্দশায়, অনাহারে আর চিকিৎসা হীনতায়। আদর্শকে আঁকড়ে ধরে শ্রেণী সংগ্রামে কত প্রাণ অকালে ঝরে গেছে , বহু প্রতিভার অপমৃত্যু হয়েছে, আর সাহিত্যের আঙিনায় কতো যে একপেশে চিন্তার উদয় হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই, আর বাকীটা ইতিহাস।
উপসংহারে বলি, সৃজনশীলতা আলাদা, আর সংগঠন আলাদা। সৃজনশীলতা হচ্ছে আপন প্রতিভার বাধা বন্ধন হীন স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীন উন্মেষ, আর সংগঠন হচ্ছে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট আদর্শের বুনিয়াদী ব্যবস্থা, সংগঠনের মানুষ এই ব্যবস্থার বাইরে বেরোতে পারে না, বেরোতে চাইলে তাকে সংগঠন ত্যাগ করতে হয়। সুতরাং, এই দুটিকে একই সাথে একই নিরিখে বিচার করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার শুধু নয় হয়তো উচিত ও নয়।