মানুষের হাহাকার – পঁচিশ
পরদিন পুলিশ এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজল বাড়িটা। ওরা এটা ফেলছে, ওটা টেনে নামাচ্ছে, এবং কথায় কথায় শালা বানচুত বলছে ভুবনবাবুকে। শালা বানচুত শব্দটি তাঁর প্রতি কেউ কখনও জীবনে ব্যবহার করেনি। তিনি স্থির ধীর মানুষ। সৎ মানুষ। পুত্রের কল্যাণে পুলিশ যা কিছু মুখে আসে গালাগাল করে গেল তাঁকে। তাঁর পরিবারের কেউ গালাগাল থেকে রেহাই পেল না। মানুকে বেজন্মার বাচ্চা বলল কয়েকবার।
পুলিশ ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। দু বার দুটো ব্যাটনের বাড়ি খেল ভানু—বল কোথায় গেছে হারামির বাচ্চা। দেশটাকে জ্বালিয়ে খেল। তারপর পুলিশ অফিসারটি একসময় খুব অমায়িক গলায় ডেকে নিয়ে গেল ভুবনবাবুকে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
রাস্তায় মানুষজন জমে গেছে। রমা রান্নাঘরে নীরজা রান্নাঘরে। মানদা কেবল বলছে, এ—কোন আপদ! পুলিশ সব খুঁজে পেতে দুটো লিফলেট পেল। লিফলেট দুটো দোমড়ানো, বোধহয় একটিতে সুপুরির কুচি রেখেছিল নীরজা এবং একটায় হরীতকী। সেই দুটো সম্বল করে গোঁফে তা দিয়ে একটা বড় রকমের খোঁজখবর মিলে গেছে মতো পুলিশের দলটা বড়বাবুর জন্য দাঁড়িয়ে থাকল।
তখন পুলিশ অফিসারটি দরজা বন্ধ করে বলে গেল, বুড়ো হয়েছেন, কত কিছু দেখতে হবে। আজকাল মানুষ বড়ই ধান্দাবাজ। আপনারা সেকেলে লোক টের পান না। ছেলেটাকে আপনার চোট্টারা সর্বনাশ করে তবে ছাড়ল। কোথা গেছে বলুন! আমরা ধরে এনে শুধরে দেব। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে।
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
পুলিশ অফিসারটি বলল, বড়ই দুঃখময়। দেশে বড় লোক কেবল বড় লোক হচ্ছে, গরিব কেবল গরিব হয়ে যাচ্ছে।
দু দলই লড়াই করবে বলে হাঁকপাঁক করছে। আমাদের হয়েছে মরণ। কার দিকে যাই বলুন। আপনার ছেলেটি কোন দলে গেছে আপনি জানেন! সেটা খুব ভালো দল না। মনীষীদের যখন তখন মাথা কাটছে। আপনি নিশ্চয় জানেন। বাবা যখন পুত্রের খবর আপনি জানবেনই। বলুন—ধরে আনি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে দি।
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
দেশটা দেখতে দেখতে কী হয়ে গেল বলুন। এখন শুধু ধান্দাবাজদের রাজত্ব। রাজনীতি বলুন, অর্থনীতি বলুন সমাজ সংস্কৃতি বলুন সব ধান্দাবাজাদের মুঠোয়। আপনারা সৎমানুষ, সে—সব পথে যাবেন কেন। ছেলেটা আপনার রত্ন। রত্নগর্ভা আপনার স্ত্রী। কোথায় আছে নিশ্চয় জানেন। বলুন বলে ফেলুন।
আমাদের সামনে কোনো আদর্শ নেই। অথচ দেখুন এই দেশেই নেতাজী জন্মলাভ করেছেন। গান্ধীজী বলুন, তিলক বলুন, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, নেহরু কত নাম করব বলুন, তাঁরা সবাই আমাদের এই ভারতবর্ষে জন্মলাভ করেছেন। শিক্ষা, স্বার্থত্যাগ শিক্ষা, অহং শিক্ষা—কী শিক্ষা না দিয়ে গেছেন তেনারা। কিন্তু হল কী—হল কচু। চোর বাটপার জোচ্চোর। ইতর নেমকহারামে দেশটা ছেয়ে গেল। কী বলেন, ঠিক বলিনি! তা যাক এখন বলুন আপনার সুপুত্রটি গেল কোথায়!
ভুবনবাবুর এক কথা, জানি না।
কিন্তু আপনি না জানলে তো হবে না। এত জানেন আর এটা জানবেন না সে কী করে হয়। বয়স হয়ে গেল, দুদিন বাদে নিমতলা যাবেন, মিথ্যে কথা বললে নরকে জায়গা হবে না, ধর্মাধর্ম জ্ঞানতো অন্যের চেয়ে আপনার কম না! মিথ্যা কথা বললে কত বড় পাপ হয় জানেন, মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলে একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন, পড়েছেন নিশ্চয়ই—সামান্য মিথ্যাকথা, অশ্বত্থামা হত নর নহে ইতি গজ, ঠিক মিছা কথাও নয়। একটু ঘুরিয়ে বলা, একটু আস্তে গলা খাকারি দিয়ে বলা, তাতেই কী না নরক দর্শন হয়ে গেল। বলেন এটা ঠিক হল—আমরা কত মিছা কথা বলি আমাদের কী হয়—কচু হয়। মহাভারতেই ও—সব লেখা হতে পারে। তারপরই কী ভেবে বেলাইনে চলে যাচ্ছেন ভেবে অফিসারটি ঘুরিয়ে বলল, না না কী যেন বলেন, মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান। আপনি বড়ই পুণ্যবান মানুষ, বলে ফেলুন, আপনার সাধের বিপ্লবী পুত্রটি কোন নিরুদ্দেশে গেল!
ভুবনবাবুর সেই এক কথা—জানি না।
শুনুন, জানতে হয় কী করে জানিয়ে দিতে পারি। সবই পারি। কিন্তু আমাদেরও বাবা মা ভাই বোন আছে। মনে করবেন না আমরা কলাগাছ ফুঁড়ে বসুন্ধরায় হাজির হয়েছি। সব পারি—আপনি পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি, হাত চালাতে লাগে। সেজন্যই বলছিলাম বলে দিন—ও—সব বিপ্লবে টিপ্লবে বিশ্বাস করবেন না, ও বয়সে আমরাও অনেক বিপ্লব টিপ্লব করার কথা ভেবেছি, মিছিলে ঝান্ডা উড়িয়েছি, তারপর চাকরি হয়ে যাবার পর সাধু পুরুষ হয়ে গেছি। এখন মাগ ছেলে বাদে আর কিছু বুঝি না মশাই। আমার অত রাখঢাক নেই। ডমফাই করতে ভালোবাসি না। দুটো পয়সা কী করে হবে, সেই ধান্ধাতেই থাকি। যা দিনকাল, চোখ বুজলে মাগ ছেলে সব রাস্তায়। আদর্শ ধুয়ে জল খাব? রাশিয়া চীন আমেরিকায় নানা রকমের মগজ ধোলাইর কারখানা আছে, কিন্তু শালা আমাদের দেশিমগজ ধোলাইর মতো মহাকার্যোদ্ধারকারী বটিকা আর একটিও নেই। জয়া বলে একটি প্রেমিকা আছে আপনার পুত্রের সেটা কী জানা আছে?
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
আপনি দেখছি মশাই একেবারে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। পার্থিব বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। কিন্তু সব খবরই পুলিশের খাতায় আজকাল লেখা হয়ে থাকে। জয়া মেয়েটিকে এনে দু হাত এক করে দিলেই বিপ্লবের কেতাতে আগুন ধরে যেত। আপনারা এত প্রাজ্ঞ হয়ে কেন যে এটা বোঝেন না। দু তিনমাসের মধ্যে আপনার ছেলেটির অধোগতি হয়েছে। হরিবল। পুলিশ অফিসারটি ধার্মিক পাঁঠার মতো তারপর একটা হাই তুলল। কিছুতেই কাজ হবে না। আস্ত ত্যাঁদোর লোক। জায়গামতো না নিয়ে গেলে হবে না। পুলিশ অফিসারটি টুপি টেনে দরজা খুলে তারপর দুলাফে বের হয়ে গেল।
ভুবনবাবু স্থির চোখে বসে থাকলেন।
নিচে পুলিশ ভ্যানটি গর্জে উঠল।
রমা এবং ভানু ছুটে দেখল, বাবা স্থির নিষ্পলক।
রমা ডাকল, বাবা কী বলল লোকটা?
ভুবনবাবু রমাকে দেখলেন।
কী বলল?
কিছু না।
এতক্ষণ শাসাচ্ছিল, আপনি কিছু বলছেন না! ভানু কেমন বিরক্ত গলায় কথাটা বলল।
কপাল। বলে ভুবনবাবু উঠে পড়লেন।
রমা নীরজা ভুবনবাবুর পেছন পেছন গেল। ভুবনবাবু করিডোর ধরে হেঁটে কোথাও যাবেন যেন।
রমা বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
জয়াদের বাড়ি যাব।
জয়াদের বাড়ি এখন যেতে হবে না।
কেন, গেলে কী হবে?
রাস্তায় লোকজন জড়ো হয়েছে। নিচে নামলেই আপনাকে আজে বাজে প্রশ্ন করবে। আপনি এখন কোথাও বের হবেন না।
ভুবনবাবু পুত্রকন্যার কথায় নিরস্ত হলেন। চারপাশের মানুষ তামাশা দেখতে ভিড় করেছে। ভুবনবাবু ধীরে ধীরে মানুর ঘরে ঢুকে ওর খাটে বসে পড়লেন। ছেলেটা এমন কী করত যার জন্য পুলিশ এ—ভাবে তাকে অপমান করে গেল! এই অপমান লাঞ্ছনা নির্যাতন শেষ বয়সে তাঁর কপালে লেখা ছিল তবে। মনে মনে বললেন, মানু বাপের দিকটা দেখলি না একবার। সংসারে আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। তুই কোথায় গেলি তাও বলে গেলি না। এত উদ্বেগ নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে! তারপরই মনে হল, না বলে গিয়েছে ভালোই করেছে। পুলিশ তাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। নির্যাতন শেষ পর্যন্ত এমন হতে পারে যে তিনি সব ফাঁসও করে দিতে পারতেন। আর ঠিক দুপুরেই এল দুজন পুলিশ, তারা ভুবনবাবুকে থানায় ধরে নিয়ে গেল।
বিপদের সময় রমার একমাত্র মানুষ অরুণ, যাকে সে ফোনে সব বললে ছুটে এল। সব খুলে বললে, অরুণ বলল, দেখছি। এখন বিকেল হয়ে গেছে, গোবিন্দদা এখানে আছেন। তাছাড়া অরুণের দূর সম্পর্কের এক দাদা বিধানসভার সদস্য। দেশ স্বাধীন হবার আগে বিপ্লবী ছিল, এখন কংগ্রেসি। যখন যে দল ভারী সেখানে নাম লেখাবার প্রবণতা আছে মানুষটার। মানুষটা খুবই রাশভারি, খুব প্রভাব আছে উঁচু মহলে। ছয়কে নয় করতে বড়ই ওস্তাদ মানুষ। অরুণ বুঝতে পারছে এ—সময়ে দাদার স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। মনে মনে সে তার দাদাকে ঘৃণা করে। কারণ সে জানে, ভদ্রলোকের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে। গুণ্ডা বদমাসরা সব এখন এম এল এ। লম্পট হলে তো কথাই নেই—তার দাদাটির ক্ষেত্রে সবই প্রযোজ্য। সে তার শরণাপন্ন হয়ে বিকেলের দিকে ভুবনবাবুকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারল।
কিন্তু এ কী চেহারা মানুষটার! উদভ্রান্তের মতো চোখ। কারও সঙ্গে একটা কথা বলছেন না। পাগল পাগল চেহারা। সিঁড়ি ধরে উঠতে পারছিলেন না। শরীরে হাত দিলেই কঁকিয়ে উঠছেন। রমা বাপের এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল! ভানু কেমন হঠকারী যুবক হয়ে গেল, বলল শালাদের আমি খুন করব।
অরুণ বলল, কোথায় লেগেছে মেসোমশাই।
ভুবনবাবু, বললেন, জল খাব রমা।
ওরা সবাই বুঝতে পারল, পাঁজাকোলে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে। রমা মুখ নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সব রাগ কেন জানি এখন মানুর ওপর গিয়ে পড়ছে। নীরজা দরজায় হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। ভুবনবাবুকে বিছানায় শুইয়ে দিলে, রমা জল নিয়ে এল। ভুবনবাবু উঠে বসতে চাইলেন। অরুণ বলল, বসতে পারবেন?
ভুবনবাবু উঠে ততক্ষণে বসে পড়েছেন। জলটা খেলেন। তারপর বললেন, তোমাদের একটা কথা বলছি, মানু যদি বাড়ি ফিরে আসে, ওকে কিন্তু এসব কিছু বল না।
অরুণ বলল, পুলিশের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। অথচ যা চেহারা দেখছি কোনদিক থেকে ঝড় উঠবে বলা যাচ্ছে না। সেও বলল, মানুকে না বলাই ভালো। ওদের দলটাও বসে নাই। তারপরই অরুণ বলল, আচ্ছা রমা, মানু এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তোমরা কেউ আগে তো আমায় বলনি!
এই প্রথম রমা কেমন মানুর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলল, একে নষ্ট হওয়া বলে অরুণ!
তা হলে তোমাদের আসকারাতেই এটা হয়েছে!
রমা বলল, না তাও না। যা সময়কাল অরুণ, এটাই হওয়ার কথা। আমরা ধরে বেঁধে কতদিন আর সব ঠিকঠাক রাখব। তারপর রমা বুকের আঁচল টেনে বলল, তবে আমরা ওকে আসকারা দিইনি। বাড়িতে খুব বেশি একটা সময় মানু এদিকটায় থাকতও না। পড়াশোনাও মন দিয়ে করল না। অবশ্য ওরই বা দোষ কী বল—চারপাশে যা সব দেখছে!
কী দেখছে?
কী দেখছে না বল?
হঠাৎ রমাকে বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে দেখে অরুণ এই পরিবারের এত দুঃখের সময়েও না হেসে পারল না।
তুমি হাসছ?
না হাসছি না।
দেখছ না চারপাশে কেমন সব ধান্ধাবাজ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর কেমন অপরাধীর গলায় বলল, আমরাও অরুণ ভালো ছিলাম না।
অরুণ আর কথা বলতে পারল না। এই পরিবারে সবারই বুকে কথাটা বড় বেশি বাজল। সংসারে পাপ ঢুকে গেলে এমন হয়—এই এক বিশ্বাস নিয়ে ভুবনবাবু আপাতত চোখ বুজে পড়ে থাকলেন। নীরজা পায়ের কাছে বসে ভুবনবাবুর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
সন্ধ্যার পরই লোডশেডিং। পাড়াটা অন্ধকার। কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। পাশের বাড়িটার একতলায় ব্যাংকের অফিস। ওপরের তলায় ব্যাংকের এজেন্টের কোয়ার্টার। ওদের বাড়িতে এ সি জ্বলে, চারপাশে যখন অন্ধকার থাকে, তখন ও—বাড়িটায় আলো জ্বলে। সেই আলোতে ভুবনবাবুর ঘরটা কেমন আবছা ফ্যাকাশে বিবর্ণ রঙ ধরেছে। টেবিলে ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে গেছিল নীরজা। ভুবনবাবু এখন অন্ধকার পছন্দ করছেন বলে আলোটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেই সময় মনে হল খুট খুট করে কেউ কড়া নাড়ছে। গোপনে মানু ফিরে এল না ত! ভুবনবাবু খুবই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি উঠতে যাবেন, তখন মনে হল কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে। তিনি দরজার মুখে গিয়ে দেখলেন, চুপি চুপি কেউ করিডরে ঢুকতেই নীরজা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। অস্পষ্ট আলোতে তিনি বুঝতে পারলেন না কে ঢুকছে। রমা নীরজা দু জনই আছে। তারাও কিছু বলছে না। তিনি বললেন, কে!
বুককি।
বুককি! সে কে!
ভুবনবাবু মানুর বন্ধুদের খুব একটা চেনেন না। আলো থাকলে তিনি মুখ দেখলে চিনতে পারতেন।
রমা বলল, গোবিন্দবাবুর ছেলে।
অঃ।
তারপরই মনে হল সে যদি মানুর খবর রাখে। রাখারই কথা। বলে যেতেও পারে তাকে! তিনি বললেন, বুককি এদিকে আয়।
খুব সতর্ক বুককি। সে এসে ঘরে ঢুকেই ফিস ফিস করে বলল, জয়াকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ!
জয়াকে!
রমা বলল, জয়াকে দিয়ে কী হবে?
পুলিশের ধারণা জয়া সব খবর রাখে মানুর।
ভুবনবাবু বললেন, জয়া যদি বলে দেয় সব।
রমা নীরজা দাঁড়িয়েছিল। বুককিও দাঁড়িয়ে আছে। ভুবনবাবু খাটে বসে আছেন। আবছা বিবর্ণ অন্ধকারে তিনি বুককির মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। কার কাছে কী আবার বলে ফেলবেন ভয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে আছো কেন, আলোটা এ ঘরে দিতে পারছ না?
রমা তাড়াতাড়ি টেবিল ল্যাম্প এনে রাখলে ভুবনবাবু বুককিকে চিনতে পারলেন। এ বাড়িতে মাঝে মাঝে এসেছে। তিনি বললেন, তুমি জানো মানু কোথায় গেছে?
বুককি কেমন ইতস্তত করতে থাকল।
আমি তো ওর বাবা! ও যতদিন ফিরে না আসবে আমি আর ঘুমোতে পারব না, জানো।
চিন্তা করবেন না। ও ভালো আছে।
কোথায় আছে?
সে আমিও জানি না মেসোমশাই। মানু এদিকে কেমন হয়ে গেছিল।
ওর কাছে প্রায়ই চিঠি আসত। আমিই দিতাম চিঠিগুলি।
তোমাকে কে দিত?
রোগা মতো একটা ছেলে দিয়ে যেত।
তুমি জানতে না, কোথায় থাকে সে।
না। বারবারই এক কথা বলত।
কী বলত?
বলত, অতসব জানার দরকার নেই। মানু বলেছে চিঠি তোমাকে দিতে। তুমি দিয়ে আসবে।
মানুর কাছে আসত না কেন?
এ পাড়ার কেউ কেউ তাকে চিনে ফেলতে পারে। ভয়ে আসত না।
তখনই মনে হল, গৌরীবাবুর ছেলে আজ সাত আট মাস হল পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। বুককি ঠিক এ—পাড়ার ছেলে নয়। সে থাকে জমির লেনে। দুটো বাস স্টপেজ পার হয়ে তাকে এখানে আসতে হয়। জয়া বুককিদের পাড়ার মেয়ে।
রমা বলল, ছেলেটা রোগা ফর্সা মতো?
ঠিক ফর্সা নয়, শ্যামলা রঙ।
চোখ বড় বড়?
চোখ বড় নয় বরং বেশ লম্বা বলা যেতে পারে।
এ পাড়ায় বছরখানেক আগে নানারকম খণ্ডযুদ্ধ লেগে থাকত। কোথায় উত্তরবঙ্গের একটা জায়গায় জোতদার খুন হল তারপর থেকেই ক্রমে শহরটায় কেমন একটা চাপা আক্রোশ কারা ছড়িয়ে যাচ্ছে। শহরের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে যারা বাঁচছে, যারা বস্তিতে থাকে, যাদের জীবনধারণের কোনো অবলম্বন নেই, তাদের পক্ষ হয়ে এই বিপ্লব। অন্নহীন মানুষের জন্য লড়াই। সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে মানুষের মুক্তি নেই এমন সব কথাবার্তা চারপাশে কারা ফিস ফিস করে কানে কানে যেন কেবল বলে যাচ্ছিল।
রমা জানত কোনোরকমে যদি একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারত মানুকে তবে এই কানাকানির ভয় থাকত না। এবং একসময় সে অরুণকে বলেছিল, যে—কোনো একটা কাজ দিয়ে অরুণ ওকে এখন বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। তুমিত জানো, উঠতি ছেলেদের কী ছোঁয়াচে রোগে ধরেছে। ওকে ভুবনেশ্বর পাঠিয়ে দাও। ওখানে তো আমাদের একটা সেল—এম্পোরিয়াম আছে। তুমি ইচ্ছে করলেই পারো।
অরুণ বলেছিল, একটু সময় দিতে হবে।
রমা বলেছিল, কিন্তু জানোতো আমাদের পাড়াটা ভালো না। নষ্ট হয়ে যেতে কতক্ষণ। রমা কিংবা নীরজা অথবা ভুবনবাবু যা আশঙ্কা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত মানু তাই হয়ে গেল।
ভুবনবাবু বললেন, জয়াকে ছেড়ে দিয়েছে?
না।
তুমি বসো না। নীরজা একটা মোড়া এনে দিল। নীরজার চোখমুখ শুকনো। ভানু বাড়ি নেই। অরুণ আর ভানু সেই দাদাটির সঙ্গে পরামর্শ করতে গেছে। কারণ পুলিশের পাল্লায় পড়লে সহজে আর রক্ষা থাকে না। কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে নিয়ে যাবে সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকা ভালো। মস্তান দাদাটিকে পুলিশ খুবই ভয় পায়। তার কারণ দাদাটি তার বাড়ির বসার ঘরে একটা এমন ছবি টাঙিয়ে রেখেছে, যা দেখলে পুলিশের হৃৎকম্প না উঠে উপায় নেই। সেই ফোটোটাই তার তুরুপের তাস।
ভুবনবাবু খুব বিস্ময়ের গলায় বললেন, জয়া ওখানে থাকবে কোথায়?
পুলিশ লক—আপে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ভুবনবাবু আর্ত চিৎকার করে উঠলেন, পুলিশ লক—আপে!
রমা বলল, ও কী মিসায় অ্যারেস্ট হয়েছে?
সে জানি না।
ভুবনবাবু বললেন, ভাবতে পারছি না! তিনি নিজের ওপর দিয়ে যা প্রত্যক্ষ করে এসেছেন, তার যদি বিন্দুমাত্র জয়াকে জিজ্ঞেস করে কিংবা দৈহিক নির্যাতন করে, এবং আরও কিছু উৎকট দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতেই কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা পারোনা বুককি, এখনই গিয়ে থানাটায় আগুন ধরিয়ে দিতে? একটা সামান্য মেয়ে, কী ভালো মেয়ে, শুনেছি মেয়েটা সাত পাঁচে থাকে না, কবিতা লেখে, সেই মেয়েটাকে তোরা নিয়ে গেলি!
রমা বলল, কী বলছ যা—তা বাবা!
ভুবনবাবুর খেয়াল হল, জয়ার পর রমা। এমনকি রমার পর নীরজাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। পুলিশের হাতে অসীম ক্ষমতা। তিনি মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন। আর একটা কথা বললেন না।
নীরজাই কেমন বোকার মতো বলল, ওকে মারধোর করেনি ত কথা বার করার জন্য?
ওর মাতো শুনেই অজ্ঞান। ওর বাবা ছুটোছুটি করছে। ওর পিসিমার দেওর পুলিশে কাজ করে। রুমন আরও সব পাড়ার ছেলেরা থানায় গেছে। পিসিমা গেছে ওর দেওরের কাছে।
ভুবনবাবু শুধু বললেন, কী যে হবে!
তারপর সবাই চুপ। বুককিও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। কার কোপ কার ঘাড়ে পড়বে কেউ বলতে পারে না। কেমন ভীতসন্ত্রস্ত চোখমুখ। পুলিশ যদি জানে সেই পত্রবাহকের কাজ করছে তবে তাকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে। এখন ছুতো পেলেই হয়েছে। বুককি বলল, আজ রাতের ট্রেনে আমিও চলে যাব। মুর্শিদাবাদে আমার মাসিমা থাকেন। তারপরই থামল, না বলা ঠিক হচ্ছে না। বড়ই গোপন রাখা দরকার। কোথা থেকে কীভাবে ফাঁস হয়ে যাবে কেউ জানে না। পুলিশের গুপ্তচর এখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে। তা না হলে জয়ার সঙ্গে মানুর সামান্য সম্পর্ক আছে সেটাই বা টের পেল কী করে পুলিশ। সে উঠে পড়ল। —আমি যাই।
ওরা কেউ আর একটা কথা বলল না। সে উঠে চলে গেল। সকালবেলায় দৈনিক কাগজে ভুবনবাবু দেখলেন, আবার দুজন পুলিশ খুন! ভুবনবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুনের খবরগুলি পড়লেন। পরদিন আবার দেখলেন, খুন, এবার ম্যানেজার এবং পর পর পাঁচদিন, পাঁচ জায়গায় পাঁচটি ম্যানেজার খুন দিনের বেলা, চার পাঁচটি ছেলে প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়েছিল। বাস ট্রাম সব থামিয়ে দিয়েছে। সব লোক নিমেষে ফাঁকা, দরজা—জানালা বন্ধ করে দিয়েছে ভয়ে সবাই। ম্যানেজারকে টেনে এনে গলার নলি কেটে ওরা উধাও হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে দমাদম বোমা ফাটিয়েছে রাস্তায়।
একটা কিছু হচ্ছে। তারই নাম বুঝি বিপ্লব। গাঁয়ে গঞ্জেও সব বীভৎস খবর। স্কুল কলেজে হামলা ছাত্র নিহত হচ্ছে। আগুন দেওয়া হচ্ছে। যেন আজকালকার মধ্যে মুক্তি মিলে যাবে মানুষের। দেয়ালে দেয়ালে লেখা ফুটে উঠছে সত্তর দশক, মুক্তির দশক। সরকার হিমসিম খাচ্ছে, পুলিশ হিমসিম খাচ্ছে। ভয়ে আর কেউ পুলিশের কাজ নিচ্ছে না। কয়েক মাসের মধ্যে বিত্তবান মানুষের মধ্যে ভয়ংকর সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়তে থাকল।
শীতকালে ভানুর বিয়ে হয়ে গেল। নম নম করে কাজ করা হল। মল্লিকা বিয়েতে তার বড় মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। মাঝে ভুবনবাবু একদিন মল্লিকাদের বাড়ি গেছিলেন। স্বামী মারা গেছে পাঁচ সাত বছর আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করত। বড় মেয়ে মিনু সেই সংসারের হাল ধরেছে। মেয়েটা ভালোই রোজগার করে। এখনও মল্লিকার ঘর বেশ রুচিসম্মত। মিনু কী কাজ করে কোথায় কাজ করে বললে মল্লিকা কেন জানি এড়িয়ে গিয়েছিল। মল্লিকা আত্মীয় স্বজনের কাছেও একটা বড় যায় না। ভানুর আশীর্বাদের দিন প্রায় জোর করেই মল্লিকাকে ধরে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখেছেন, সব সময় মল্লিকা খুবই বিষণ্ণ থেকেছে। নিজের অভাবের কথা একসময়ে সে আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল। তখন কেউ বড় একটা সাহায্য করেনি। ভুবনবাবুরও ক্ষমতা ছিল না সাহায্য করার। এবং অভিমানবশেই আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মল্লিকা দূরে সরে গেছে। বউভাতের দিন মল্লিকা মিনু দু’জনেই এসেছিল। মিনু মেসোমশাইর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় কেন জানি কেঁদে ফেলেছিল।
তিনি ভেবেছিলেন, মানুর কথা ভেবে বুঝি মেয়েটা কেঁদে ফেলেছে। তিনি তাড়াতাড়ি তাকে তুলে বলেছিলেন, আমার কপালে এই লেখা আছে মিনু। তুই এজন্য কাঁদিস না।
বলা ভালো মানুর আত্মগোপনের পরের সপ্তাহে থানার পুলিশ অফিসারটিও খুন হয়েছিল। গুজব জয়াকে সেই পুলিশ অফিসারটি ধর্ষণ করেছিল। কে বা কারা অদৃশ্য এক রন্ধ্র থেকে গুলি করেছিল এবং যাবার সময় ওর পুরুষাঙ্গটি কেটে দিয়ে গেছে।