Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আজও নবনীতা ফোনের ডায়াল ঘোরাল। এ সময়টাতে কেউ বাড়ি থাকে না। এ—সময়টাতে আরতী মাসি ঘুমিয়ে থাকে। সে শুধু একা। ক’দিন স্কুল বন্ধ—কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষার সিট পড়েছে স্কুলে। স্কুল ছুটি থাকলে দিনটা বড় দীর্ঘ মনে হয়! বিকেল বেলাটায় সে প্রতিদিনই ফোন করছে—কিন্তু আশ্চর্য একটাই জবাব, সে বাড়ি নেই। কোথায় গেছে বললে কিছু বলছে না। বাড়ির ছেলে কোথায় গেছে বলতে এত সংকোচ কেন নবনীতা বুঝতে পারে না। নানুদা বেটাছেলে, মেয়ে হলে এক কথা ছিল—একজন পুরুষমানুষের খবর দিতে ওদের এত দ্বিধা কেন নবনীতা বুঝতে পারে না। নানুদের বাড়ির নম্বর ঠিকানা কিছুই সে জানে না। ভাগ্যিস সে ফোনের নম্বরটা চেয়ে রেখেছিল। এবং এখন নবনীতার একটাই কাজ, যখনই একা থাকে, নিরিবিলি থাকে, রিং করে বলে, হ্যালো নানুদা আছে? নানুদা নেই! আবার হ্যালো, নানু আছে, নানু নেই। হ্যালো কে আপনি? আমি মিতা, আমি দাদু, আমি নানুর দিদিমা—নানুদা নেই কেন? কোথায় গেছে? কবে আসবে?

অপর প্রান্ত থেকে এক জবাব, জানি না।

কিন্তু আমার যে নানুদাকে খুব দরকার ছিল। ওকে বললেন আমি ফোন করেছিলাম। বলবেন কিন্তু। আমার নাম নবনীতা। ওর বাবার বন্ধুর মেয়ে আমি। আমার বাবার নাম….

ততক্ষণে ফোন ছেড়ে দিয়েছে। সে বাধ্য হয়ে আজ বাবার নামও বলল। কারণ সে যে বাজে মেয়ে নয়, সে খুব ভালো মেয়ে—বাবার নাম বলতেও যার কুণ্ঠা নেই কোনো, সে কেন নানুদা কোথায় জানতে পারবে না।

নবনীতা চুপচাপ রিসিভারটা হাতে নিয়ে বসে থাকল। বড় নিষ্ঠুর নানুদার আত্মীয়স্বজন। সে তো নানুদাকে খেয়ে ফেলবে না। বরং বাড়িতে ভয় নানুদাই তাকে খেয়ে ফেলবে। আসলে নানুদার চোখে এক আশ্চর্য মায়ার খেলা আছে। মানুষের বাবা আত্মহত্যা করলে বোধহয় এমনই চোখমুখ হয়ে যায়। কেমন চোখের মধ্যে এক অতল গভীরতা। নবনীতা সব ভুলতে পারে—কিন্তু নানুদার চোখের অতল গভীরতার কথা ভুলতে পারে না। নানুদা ঠিকই বলেছিল, অনেক দাদা জুটে গেল তোমার নবনীতা। তবে আর ভাবনা কী। সত্যি এ বয়সে কী করে যে অজস্র দাদা জুটে যায়! দাদারা আজকাল বাড়িতে আসছে—তারা বেল বটস পরে চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা করে গোঁফ সরু করে তার দিকে চেয়ে থাকতে ভালোবাসে। এবং শরীরের সব পোশাক ভেদ করে দাদারা সবাই তার সব কিছু দেখতে চায় আজকাল। একজন দাদা তো একদিন একা পেয়ে জোরে জড়িয়ে ধরল, চুমো খেল। সে বাধা দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। নিজের মধ্যেই কী যে থাকে! একটা ইচ্ছে ইচ্ছে ভাব সহসা শরীরে মাথাচাড়া দিয়ে যে উঠল আর তাতেই সে কাত হয়ে গেল। কিন্তু পরে সম্বিত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দাদাটিকে ধিক্কার দিল। বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে আর আসবেন না। এলে বাবাকে বলব, আপনি ভালো না। এ—ছাড়া নবনীতা অন্য দাদাদের কথাটা বলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। সেই যে ভয় পেল দাদাটি, তারপর থেকে সত্যি আর এ মুখো হচ্ছে না। নবনীতার মনে হয়েছিল কাপুরুষ। পৃথিবীতে কারও কাছে এসব কথা বলা যায় না, আহাম্মকটা তাও যদি জানত।

যাই হোক নবনীতার দিন ভালো কাটছে না। স্কুল থেকে ফিরেই বলত নবনীতা, কেউ আমায় ফোন করেছে?

না তো!

কেউ করেনি!

না তো!

কোনো ফোন আসেনি!

বাবা রাত করে ফেরেন। বাবা মাঝে মাঝে নেশা করে বাড়ি ফেরেন। মাও সংসারে এত অঢেল সময় যে বাড়িতে একা বসে থাকতে পছন্দ করে না। মার বন্ধুবান্ধবরা মিলে একটা কাটা কাপড়ের এজেন্সি নিয়েছে পার্ক স্ট্রিটে। হাল ফ্যাশানের ডিজাইনের ফ্রক নানা জায়গায় চালান দিয়ে মার হাতে আজকাল অনেক পয়সা আসছে। মা বলেছে এখন আর ভাড়াবাড়ি নয়। নতুন ফ্ল্যাট। ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনসে। ওখানে উঠে গেলে নানুদার সঙ্গে জীবনেও আর তার দেখা হবে না। অন্তত উঠে যাবার আগে নানুদার ঠিকানা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। নানুদা ফিরে এলে তাকে ফোন করলে অন্য কোনো নবনীতা জবাব দেবে। তার আগে সে একবার ভাবল এক্সচেঞ্জ থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানার চেষ্টা করবে বাড়ির ঠিকানাটা কী। একবার সে বাবাকে দেখেছিল, এভাবে বাড়ির ঠিকানা পেতে। ঠিকানা পেলে কোনো দাদার সঙ্গে সে ঠিক ও—ঠিকানার পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আজকাল বাড়িতে খুব কড়াকড়ি চলছে। সেই যে নানুদার সঙ্গে গোপনে সিনেমা দেখে এসেছিল সেই থেকে। এ—বয়সে নাকি ছেলেমেয়েদের মাথা ঠিক থাকে না। যে—কোনো অসম্ভব ঝুঁকি জীবনে নিতে ভ্রুক্ষেপ করে না তারা। তাকে কোথাও যেতে হলে আরতী মাসিকে সব বলে যেতে হয়।

নবনীতা রিসিভারটা এবার রেখে দিল। খুব একা এবং নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে নিজেকে। কটা দিন তার বেশ হৈ—হুল্লোড়ের মধ্যে কেটে গেছে। বহরমপুরে বাবার মেসো থাকে। সেখানে দুদিন, গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাওয়ার মধ্যেও ছিল আশ্চর্য আনন্দ। সবাই মিলে গাড়ি করে গিয়েছিল লালবাগ, তারপর নদী পার হয়ে খোসবাগ। সিরাজের কবরের পাশে সুন্দর মতো আমবাগান, সেখানে সবুজ ঘাস, ওরা ঘাসের ওপর বসে গরম ফুলকো লুচি মাংস খেয়েছে।

নানুদাটা যে কী—সঙ্গে থাকলে কী ক্ষতিটা ছিল!

এ—সময় মনে হল নবনীতার এ—বাড়িতে কেউ রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে দিয়েছে, নতুন দম্পতি একতলার বাসাটায় উঠে এসেছে। সঙ্গে একজন অফিসেরই বেয়ারা অথবা পিয়ন থাকে বাড়িতে। সকাল বিকেল স্বামী স্ত্রী সেজেগুজে কোথায় যায়। আজ বোধহয় যাওয়া হয়নি। নতুন বউকে ছেড়ে এক দণ্ড কোথাও গিয়ে থাকতে বোধহয় মানুষটার কষ্ট হয়। অফিস যায় সবার শেষে, আসে সবার আগে। ছাদে উঠলে বউটি তার সঙ্গে আলাপও করেছিল। মিষ্টি হাসিখুশি মুখ। নতুন বিয়ে হলে সবারই এমনটা হয়। ওর ইচ্ছা হল, উঁকি দিয়ে দেখে এখন বউটি কী করছে। অসময়ে আজ রেকর্ড প্লেয়ার বাজছে কেন! সিঁড়ির কার্নিশ থেকে হাঁটু গেড়ে বসলে, ওদের শোবার ঘরটা স্পষ্ট, জানালায় কারুকাজ করা পর্দা, বাতাসে উঠে গেলেই কিছুটা আব্রু খুলে যায়। দেখা যায় গোদরেজের লকার, নতুন পালিশ করা খাট, ছোট সেন্টার টেবিলে, শিয়রের কাছে এক গেলাস জল রেকাবে ঢাকা। এসব দেখতে দেখতে নবনীতার কখনও কখনও গলা শুকিয়ে যায়।

সে উঠে এসে দেখল বউটি সামনে দাঁড়িয়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঘসছে। পাশে মানুষটি বসে আছে। পা দোলাচ্ছে। আর সিগারেট খাচ্ছে। একবার উঠে খচ করে কী যেন টিপে দিল। বাজছে কোনো মিউজিক। অবেলায় মানুষটা এমন কেন করছে? সারা রাতটা তবে কী করবে? এসব মনে হতেই দেখল বউটি বড় করে সিঁদুরের টিপ পরছে। প্রসাধন করছে। এবং সায়া শাড়ি খুলে ফেলছে। নবনীতা বুঝতে পারছে না সায়া শাড়ি খুলে ফেলার আগে এত করে প্রসাধন করার কী দরকার থাকতে পারে। পুরুষমানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে পর্দার আড়ালে এবং তারপরই বাতাসে ঢেউ খেলে গেলে সে দেখল, সেই পুরুষমানুষ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। বউটি এগিয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলায় আলো জ্বেলে নিয়েছে। পর্দা ফেলা বলে যে সামান্য অন্ধকার ছিল সেটাও থাকতে দিল না। নবনীতার চোখমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকল। সেই আগের মতো গলা কাঠ—নিচে মনে হল খুট খুট শব্দ। আরতি মাসি চলে আসতে পারে। দৌড়ে নিচে নেমে গেল এবং খাটে হাত পা বিছিয়ে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ।

আরতি এ—ঘরে এলে নবনীতা জলটা খেয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। সন্ধ্যায় সংস্কৃতের মাস্টারমশাই আজ আসবেন। কিছু টাস্ক করা বাকি। এগুলো করে রাখা দরকার ছিল। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। শরীরে আজকাল যে কী হয়! নানুদার কথা ভাবলেই মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। নানুদা বড় নিষ্ঠুর তুমি। তোমাকে এত ভালো লাগে, তুমি তা টের পাও না কেন।

সে উঠে এবার দেরাজের কাছে গেল। সেখানে একটা বড় অ্যালবামে নতুন ফোটো। ফোটোগুলি সে দেখবে বলে অ্যালবামটা টেনে বের করল। দাদারা কত রকমের ছবি তুলেছে তার। একটা গাছের নিচে বসে আছে সেই ছবি, দৌড়াচ্ছে সেই ছবি—সুন্দর সুন্দর সব ফ্রিজ সট। কখনও বাতাসে চুল উড়ছে, কখনও চোখ উদাস, কখনও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। এতসব ছবি তার নিজের। সে প্রায় দেখতে নায়িকার মতো। সিনেমায় সে যদি একটা চান্স পেত। তাঁর চোখ মুখ যে—কোনো উঠতি নায়িকার চেয়ে সুন্দর, সে উঁচু লম্বা। একবার কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিল—নায়িকা চায়। তার ইচ্ছে একটা ছবি গোপনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ওর ওই একটা আলস্য আছে—হবে হবে করে শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠে না।

নানুদাকে প্রথম দিন দেখেই ভেবেছিল বাঃ বড় সুন্দর হয়েছে দেখতে নানুদা। যুবক সন্ন্যাসীর মতো দেখতে। রেশমের মতো দাড়ি গোঁফ গালে। হাত দিয়ে ইচ্ছে হয়েছিল দেখতে কত নরম—কোনো উলের বলের মতো কিনা—আর এসব ভাবলেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে—সে তার মনের কথাটা কিছুতেই দুম করে বলে ফেলতে পারেনি। আবার দেখা হলে বলবে, নানুদা তুমি আমাকে ভালোবাসবে? আমি তোমার যা ভালো লাগবে তাই করব। কিন্তু সে মানুষটার পাত্তা নেই।

তখনই সে কী ভেবে তার সবচেয়ে সুন্দর ম্যাকসি বের করে ফেলল। গলায় মুখে পাউডার বুলাল। কপালে সুন্দর করে লাল টিপ পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল—এমন শরীর নিয়ে তার এখন কান্না পায়। তার কিছুই ভালো লাগে না কেন! পড়াশোনা ভালো লাগে না। এখন শুধু বেড়াতে ভালো লাগে। সে চিৎকার করে বলল, আরতি মাসি আমি কাকলীদের বাড়ি যাচ্ছি।

আরতি বলল, কাকলীদের বাড়িতে এখন কী করতে যাবে!

কাজ আছে।

কী কাজ বলবে তো! দিদি এলে কী বলব!

দিদি আসার আগেই ফিরে আসব।

আমি কিছু জানি না!

ভারি ঝামেলা দেখছি—পড়া দেখে আসব, তাও তোমাদের জ্বালায় জানতে পারব না।

পড়ার কথায় আরতি আর কিছু বলতে পারল না। দাদামণি মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই আলগা। এই একটা বিষয়ে আরতির মাতব্বরি নবনীতার ওপর খাটে না। যেতে না দিলেই দাদামণি এলে নালিশ করবে—আমি কী করব, আরতি মাসি যেতে না দিলে আমি কী করব। তখন দাদামণির দুটো একটা ধমক খেতেও হতে পারে। আরতি অগত্যা বলল, যাও। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। দিনকাল ভালো না—যেখানে সেখানে খুন টুন হচ্ছে।

আজকাল পত্রিকার খুব খুনের খবর ফলাও করে বের হচ্ছে। ক’দিনের মধ্যে চেতলার কাছে একটা সতেরো বছরের মেয়ে খুন হয়েছে, শোভাবাজারের কাছে একটি তেরো চোদ্দো বছরের মেয়েকে কারা তুলে নিয়ে গেছে। কিশোরী মেয়েদের কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে—আন্ত—রাজ্য মেয়ে চালানকারীদের উপদ্রব বাড়ছে এমনই সব খবর পত্রিকায় আজকাল লেখা থাকে। পত্রিকা পড়লে নবনীতার গা—টা শির শির করে। সে বলল, যাব আর আসব।

আসলে নবনীতা এখন বের হতে চায়। চারপাশে কেবল আনন্দ উজাড় করে দিচ্ছে প্রকৃতি। ঠান্ডা বাতাস বইছে। পার্কের কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছগুলিতে ফুলের সমারোহ। সেজেগুজে সব মানুষেরা যেন কোথায় যাবে বের হয়ে পড়ছে! এ—সময়ে একা ঘরে থাকতে কার মন চায়! এবং বিকেল বেলাটার যেন কী মোহ আছে—তাকে সবসময় ঘর থেকে বের করে নিতে চায়। একটু পার্কে ঘুরে বেড়ানো, কিংবা রাস্তায় যেতে যেতে সুন্দর যুবকদের দিকে দূর থেকে সামান্য চোখ তুলে তাকানোর মধ্যে আছে আশ্চর্য এক মনোহারিণী জীবন। সে কাকলীর বাড়িতে যাবার পথে এসবই দেখবে। কাকলী যদি ওর সঙ্গে একটু বেড়াতে বের হয়, ওর ইচ্ছে, সে কাকলীকে নিয়ে একদিন যাবে মানুদের বাড়িতে। কারণ একা যাওয়া ঠিক হবে না। কোনো মেয়েই কোনো যুবকের বাড়িতে একা যেতে বোধহয় পছন্দ করে না। সে আজ ভারি সেজেগুজে বের হয়েছে। খোঁপায় গুঁজেছে গোলাপ ফুল। রানি ক্লিয়োপেট্রার জীবন নিয়ে একটা ছবি সে দেখেছিল। নিজেকে সে আজ ক্লিয়োপেট্রার মতো দুর্ধর্ষ করে তুলেছে।

রাস্তায় নেমেই সে বুঝতে পারল সারা পৃথিবী এ—মুহূর্তে তাকে উঁচু হয়ে দেখছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ভয়ংকর লোভী দৃষ্টি তার শরীরটার প্রতি। এমনকি পার্কের বুড়ো লোকগুলিও বাদ গেল না। ভারী দৃপ্ত এবং অহংকারী হয়ে উঠছে তার শরীর। সে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। কোনোদিকে দেখছে না মতো সে হাঁটছে। আসলে সে সবই দেখছে। গ্রীষ্মের রোদ্দুর মেঘমালায় ছেয়ে যাচ্ছে বলে পার্কের চারপাশে সবুজ সমারোহ। বাতাসে কোনো ধূলিকণা উড়ছে না। নির্মল পৃথিবীতে সে এখন যুবতী নারী। মন এ—সময়টাতেও এত চঞ্চল হয়ে ওঠে যে কোনটা সে চায় কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

ক্লিনিক হাউজের রোয়াকে সেই বকাটে ছোকরারা আজও তাকে দেখে শিস দিল। এবং অশ্লীল দুটো একটা কথাবার্তা—যেন এদের মা বোন নেই—এবং আর যা মনে হয়, এরা তো তাকে ভালোবাসতেও পারে। ভালোবাসার জিনিস দূরের মনে হলেই ক্ষেপে যায় যুবকেরা। ঠিক নানুদার মতো এরা তাকে আর ভাবতে পারে না।

একদিন মনে হয়েছিল, বাবাকে বলবে সব, পরে ভেবে দেখেছে বাবা শুনলে কী ভাববে। নবনীতা জানে এদের থেকে ভয়ের কিছু নেই। সে একবার ভাবল, কাছে গিয়ে বলবে, এই আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে? এই একটু বেড়াব। তখন কী হবে নবনীতার তাও জানা। সবাই এত ভালো ছেলে হয়ে যাবে যে কে আগে প্রাণ করিবে দান গোছের হয়ে যাবে। তার ইজ্জত রক্ষার্থে ওরা তখন হেলায় জীবন দান করতে পারে। এসব মনে হয় বলেই নবনীতা কিছু মনে করে না। অশ্লীল কথাবার্তা নতুন শিখলে যা হয়। এবং সে যে খুব একটা কড়াশাসনে রয়েছে, সেও জেনে ফেলেছে ওদের সব কথার অর্থ কী। আসলে একটাই অর্থ, আমরা বড় হচ্ছি, তোমরা বড় হচ্ছ, আর অপেক্ষায় থাকতে পারছি না।

নবনীতা কেমন স্বগতোক্তি করল, সে তো আমারও। সে এবারও আরও দূরে এসে বুঝল ওদের আর দেখা যাচ্ছে না। এদের মুখগুলি তার চেনা। চুল বেশ লম্বা করে ঘাড় পর্যন্ত ছেঁটে দেওয়া। একটা কালোটুপি ঘাড় পর্যন্ত বসিয়ে দিলে যা হয়—এরা সুচলো দাড়ি রেখেছে সিনেমা হিরোদের মতো, চুল কাটে সিনেমা হিরোদের মতো। সবকিছুই ভাবে সিনেমা হিরোদের মতো। স্বপ্নও দেখে সিনেমা হিরোইনের। নবনীতার তাই শখ সে একদিন বড় হিরোইন হয়ে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার এটা বেশি করে মনে হয়। অবশ্য এখন নানুদার মতো একজন যুবক তার পাশে থাকলে ভালো হয়। খুশিমতো খাওয়া গেলেই হল—জীবনের আর কী দরকার এ—সময় আর সে কিছু মনে করতে পারে না।

নবনীতা দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল খুট খুট করে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওপরে জানালা খোলা। কেউ বাড়ি না থাকলে জানালা বন্ধ থাকত। কাকলী বাড়ি থাকলে এতক্ষণ দৌড়ে নেমে আসত। সে কড়া নেড়ে আবার ডাকল কাকলী।

তখন বুড়ো মতো মানুষটার গলার শব্দ পাওয়া গেল। কাকলীর দাদু সিঁড়িতে কে কে করে নেমে আসছে।

আমি নবনীতা দাদু।

আরে নবনীতা। প্রিয়নাথ ভারী প্রসন্ন গলায় কথাটা বলল। এসো এসো।

কাকলী বাড়ি নেই?

ওরা গেছে ভুবনের বাড়িতে।

নবনীতা বলল, তা হলে যাই। কাকলীকে বলবেন, আমি এসেছিলাম।

এসো না। ওরা এক্ষুনি চলে আসবে।

নবনীতা ইতস্তত করছিল। বুড়ো মানুষদের তার কেন জানি কখনও ভালোমানুষ মনে হয় না। কাকলীর দাদু খুব শক্ত সমর্থ মানুষ। চুল এখনও কালো রেখেছে। চুল কালো না কলপ মাখে বুড়োটা। সে বলল, কাকলীর আসতে খুব দেরি হবে নাতো?

না না। এল বলে।

নবনীতা দরজার ভিতরে ঢুকে গেল। বাড়িতে আর কেউ নেই কিনা সে এখনও জানে না। মাসিমা থাকবে না কারণ কাকলীর দাদু, ওরা তা হলে বলত না। রান্নার মেয়েটা যদি থাকে। সে ভেবেছিল কাকলীকে নিয়ে সে বেড়াতে বের হবে। কিন্তু কাকলী নেই। সে আবার কী ভেবে বলল, থাক আজ দাদু, কাল আসব।

প্রিয়নাথ লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। বেশ দীর্ঘকায় মানুষ। সিঁড়িতে আরও লম্বা হয়ে গেল যেন কথাটা শুনে! —ভয় কী এসো না।

না না ভয় নয়। আমি বলছিলাম কী….। কাকলীর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

প্রিয়নাথ বলল, বোস, ওরা চলে আসবে।

নবনীতা কী করবে বুঝতে পারছে না। সে যে খুব আর বালিকা নেই, সে যে ইচ্ছে করলেই দাদুর ঠাট্টা তামাসার মধ্যে আগের মতো মজা পায় না সেটা বোঝায় কী করে! তবু শালীনতা বোধ ওর খুব তীব্র। খুবই খারাপ দেখায় না গেলে। সে উঠে প্রিয়নাথের ঘরে বালিকার মতো মুখ করে ঢুকে গেল। এবং বেশ দূরত্ব রেখে সে একটা চেয়ারে বসল।

আর এই ঘরটাতে এলেই সে একজন বুড়ো মানুষের গন্ধ পায়। প্রিয়নাথ না থাকলেও সে টের পেত এ—ঘরে একটা বুড়ো মানুষ থাকে। কিন্তু এখন সে এই গন্ধটা পাচ্ছে না কেন! সে দেখল প্রিয়নাথ জানালার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দিতে দিতে বলল তোমার বাবা কেমন আছেন?

ভালো।

একদিন মাকে নিয়ে বেড়াতে এসো।

আসব।

আসলে দুই প্রজন্মের ফারাক এত বেশি যে—কোনো কথা খুঁজে পাওয়া ভার। প্রিয়নাথ বারবারই নবনীতার সুন্দর পোশাক লক্ষ্য করছে। তাদের সময়ে মেয়েরা এত সুন্দর করে সাজতে জানত না। তার ভারি আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল নবনীতাকে। কিন্তু ওই যে বয়েস, মনে হচ্ছে বড় তাড়াতাড়ি জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই বয়েসও কেন আকাঙ্ক্ষার এত বেশি চাড় ভেবে পায় না।

নবনীতারই বা ভালো লাগবে কেন! সে উসখুস করছিল। দু—বার উঠে গিয়ে রাস্তায় উঁকি দিয়েছে। অথবা নিচের সিঁড়িতে যদি পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই না। কাকলীর দাদু ঘরের মধ্যে কৌটা খুলে কী খুঁজছে। দুটো বোতলের ছিপি খুলে ফেলল। এবং সে যে এ—ঘরে আছে তা যেন খেয়াল নেই তার।

তখন বাধ্য হয়ে নবনীতা বলল, আমি যাই দাদু।

আরে না না। চা করছি। চা খাও। ততক্ষণে ওরা এসে যাবে।

নবনীতা কী বলবে বুঝতে পারল না। না, বলতে পারত, কিন্তু চায়ের প্রতি ওর একটা আজন্ম প্রলোভন আছে। সে বলল, কেউ তো নেই।

তাতে কী হয়েছে। আমি কী খুব বুড়ো মানুষ ভাব! মনে হল প্রিয়নাথ এবার সত্যি যুবক হয়ে যাবে। সে প্রায় একজন যুবকের মতোই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং রান্নার গ্যাস জ্বেলে জল চাপাল।

নবনীতার এটা খারাপ লাগছিল। সে বলল, আমি করছি। আপনি এ—সময় বুঝি চা খান?

ওই অভ্যাস। তবে সবই তো ছেড়ে দিয়েছি। এটা এখনও আছে। তুমি করবে! আহা আমার কী সৌভাগ্য। এসো না ভিতরে। তুমি তো আমার নাতিন। এত সুন্দর করে সাজো কেন?

নবনীতা লজ্জা পেল। কিছু বলল না।

এই বয়সে আমরা এত সাজতে জানতাম না। তোমাকে আদর করলে রাগ করবে নবনীতা!

সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, যান আমাকে কেন, কাকলীকে করতে পারেন না!

প্রিয়নাথ হাসল। বলল, ওকে তো সব সময় করি—তোমাকে করলে কেমন না জানি লাগবে।

নবনীতার চোখমুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।

তখন এই শহরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বাসে ট্রামে অফিস ফেরত মানুষেরা গাদাগাদি করে ফিরছে। ভাবতেই পারবে না একজন উঠতি যুবতী একজন প্রৌঢ় মানুষের সামনে এমনভাবে মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। চোখমুখ লালচে। নবনীতার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হতে পারে। সে বলল, না যাই। কাকলী এলে কিন্তু বলবেন, ওকে আমার খুব দরকার।

প্রিয়নাথ তখন হা হা করে হেসে উঠল। এবং তুই তুকারি আরম্ভ করে দিল কথাবার্তায়। বলল, তুই কী রে! আমাকে দাদু ডাকিস, আদর করলে তোর কী ক্ষতিটা হবে! এই বলে কাপে চা ঢালল। তারপর বলল, নে না। এই নে বলে সে ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট, ফ্রিজ থেকে দুটো সন্দেশ দিল বের করে।

নবনীতা কেমন বোবার মতো হাতে তুলে নিল সব। বুড়ো মানুষটা আসলে তাকে নিয়ে মজা করছে। সে সব সত্যি ভেবে সামান্য আহাম্মকের কাজ করেছে। খুব কাচুমাচু গলায় বলল, আপনি কিন্তু কাকলীকে কিছু বলবেন না।

বললে কী হবে?

না বলবেন না।

কেন দোষের কী আছে। আমি তো তোকে নিয়ে বিছানায় শুইনি!

ভারী অসভ্য আপনি।

প্রিয়নাথ তার গাল টিপে বলল, সব বুঝিস তা হলে!

নবনীতার হাত পা কাঁপছিল। কত তাড়াতাড়ি চা খাওয়া যায় যেন তার পাল্লা দিচ্ছে। তারপর প্লেট মেঝেতে রেখে সে প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকল।

প্রিয়নাথ বলল, এই তুই চলে গেলে সব বলে দেব। বলব, তুই আমাকে ভালোবাসিস। তুই আমার বউ। বেশ জমবে।

নবনীতার কেমন দ্রুত শ্বাস ওঠানামা করছিল। বুড়ো মানুষটা কী সত্যি কিছু করতে চায়—না মজা—না পাগল, তাও সে বুঝল না। সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকল। তার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। মাথাটা কেমন তার ঘুরছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *