Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রমা দাঁতে ঘাস কাটছিল। সে ভীষণ রকমের উজ্জ্বল সাদা সিল্ক পরেছে। শরীর ভালো করে ঢেকে বসেছে। পায়ের কাছে অরুণ, লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। স্কুটারটা রাস্তার পাশে দাঁড় করানো। নীল রঙের স্কুটারে কোথা থেকে একটা শালিক পাখি উড়ে এসে বসেছে। শেষ জ্যৈষ্ঠের খাঁ খাঁ দুপুর। মাঠে গভীর নলকূপ থেকে জল উঠছে। ভট ভট শব্দটা প্রকৃতির ভেতর বে—আক্কেলে জোতদারদের মতো যেন হাঁকছে কেবল। আর মাটি যত ভিজে যাচ্ছে চাষ—আবাদের নিমিত্ত সব চাষীরা তত লাঙল ঢুকিয়ে দিচ্ছে অভ্যন্তরে। সে ঘড়ি দেখল। কিছুতেই ঘড়ির কাঁটা চারটেয় এসে থমকে দাঁড়াচ্ছে না। এখন উঠতে হবে। কিছু খুনসুটি করেছে রমার সঙ্গে। এবং রমাকে সে উত্তপ্ত করতে চেয়েছে। সকাল থেকেই বুঝি রমা টের পেয়ে গেছে, ভয়ে রমা ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে ক্রমশ।

সে বুঝিয়েছে, কীসের এত ভয় বুঝি না।

রমা বলেছে, তুমি অরুণ, মেয়েদের কী ভয় বুঝবে না।

আজকালকার তুমি কিছু খবর রাখ না রমা!

একটা বালিকাও তো জানে, কীসে কী হয়। আমি রাখব না কেন। তবে তুমি নিজের দিকটা দেখছ অরুণ।

এত সব তবে কী দরকার ছিল। আগে বললেই পারতে।

আমি কী জানি, সত্যি তুমি একটা জায়গা ঠিক রেখেছ।

না, মনে হচ্ছে, ঘরে বউ আছে বলে তুমি আমাকে পর পর ভাবছ।

পর পর ভাবতে পারছি না বলেই তো যত কষ্ট। তুমি এলেই স্নায়ুতে তোলপাড় আরম্ভ হয়ে যায়। ঘরে তোমার কে আছে কিছুই মনে থাকে না।

থাক তবে। বরং চল, বাড়িতেই রেখে আসি তোমাকে।

সেই ভালো ছিল। কিন্তু ফিরলে মা ঠিক ভাববেন, তোমার সঙ্গে আমার ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। ওরা কষ্ট পাবেন।

রমা বলতে পারত কত রকমের সংকট অরুণ এক জীবনে। ফিরে গেলেই মা বাবা অস্থির হয়ে উঠবে। মানুর জন্যে এমন একটা দামি চাকরির তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছ, আমিই হেতু, আমার কথা তোমার কাছে দিব্যজ্ঞানের মতো—সেটা হারাতে ওরা রাজি নয়। ওরা টের পায়, তুমি আমার কতটুকু ক্ষতি করতে পার। ওরা সব জেনেও চুপচাপ আছে। সংসারে সুখ ব্যাপারটা ভারি দরকার। আমার কাছে অবশ্য এটা খুব অন্যায় ঠেকছে।

তারপর থেকেই দুজনে চুপচাপ। প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে শহরে ফিরতে। কোথাও কোনো রেস্তোরাঁয় যাবে, তারপর কোনো ঘরে, সাদা বিছানা এমনই সব কথা হতে হতে রমা দু’হাটুর মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়েছে। দুজনই খাওয়ার কথা যেন ভুলে গেছে। আগে একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। অরুণ রমাকে ঠিক বুঝতে পারে না। রমা কিছুটা আস্কারা না দিলে সে সাহস পেত না। সেই রমাই গাছের নিচে বসে কেমন সতী—সাধ্বী হয়ে গেল। আসলে প্রকৃতি উদার, উদাস। বাধা বন্ধন না মানার কথা শেখায়। কিন্তু সে কোন প্রকৃতির কোলে উঠে এসেছে! সামান্য পাপবোধ সেও অনুভব করে থাকে। কিন্তু শরীরটা তো ব্যাকরণ নয়, যে নির্দিষ্ট সূত্র ধরে এগোবে।

এবং তার এতটা উদ্যম বিনষ্ট হতে যাচ্ছে ভেবে মুখ কালো করে রেখেছে। কমল এবং তার বউ গোপালপুরে গেছে। ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে গেছে ওকে। ফ্ল্যাটটা ক’দিন ওর জিম্মায় থাকবে। চাবিটা দিয়ে যেত না। কিন্তু কমলের বোন এবং ভগ্নিপতির আসার কথা। ওদের টিকিট কাটা, এবং ফ্যাসাদেই পড়ে গেছিল। চাবিটা অরুণ রাখতে রাজি হওয়ায় খুব সুবিধে হয়েছে। ওরা চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, অফিসে অরুণ নামক একজন সেলস অফিসারের কাছে চাবি রেখে যাচ্ছে। দরকার মতো যেন নিয়ে নেয়। এবং এমন সুযোগ রমা হাতছাড়া করবে সকালেও ঘুণাক্ষরে টের পায়নি। সুতরাং আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে হল না রমার সঙ্গে।

তাহলে ওঠো। ফিরব।

রমা উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ থমথম করছে অরুণের। তাকানো যাচ্ছে না। ভারি কষ্ট ভেতরে বুঝতে পারছে। ভারি বেচারা মনে হচ্ছে অরুণকে।

রমার কেমন কষ্ট হল মুখটা দেখে। সে বলল, চল!

তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব কোথাও।

সেই ভালো।

তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব, না নিজেই ট্যাক্সি করে চলে যাবে?

সে দেখা যাবে।

গাড়ি স্টার্ট দেবার সময় বলল, খুব খারাপ মানুষ আমি না?

খারাপ ভালো বলিনি তো।

যাইহোক, শেষ পর্যন্ত অনিষ্ট কিছু ঘটল না।

এতে আবার শরীরে অনিষ্ট হবার কী আছে বুঝি না।

অরুণ এবার কেমন চিৎকার করে বলতে চাইল, তবে তুমি কী চাও? সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিলে। তারপর বাতাসে ভেসে যাবার মতো গাড়ি ছেড়ে দিল।

ওরা কেউ আর একটা কথা বলল না।

খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনেই দুদিকে তাকিয়ে থাকল।

রমা মাঝে মাঝে অবশ্য চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। কালো ট্রাউজার, চেক—কাটা বুশ শার্ট পরণে পুরুষ মানুষটা কেমন দুঃখী বালকের মতো মুখ করে আছে। তার ঘুড়ি কেটে গেছে মনে হয়।

কাউন্টারে চাইনিজ মেয়েটি বসে দাঁত খুঁটছে। একজন মোটা মতো চাইনিজ ভদ্রলোক উবু হয়ে ফিস ফিস গলায় কথা বলছে। একটা ষণ্ডা মতো মানুষ কোণার টেবিলে গিয়ে বসল। ও—পাশের কেবিনের ভেতর দু’জোড়া পা দেখা যাচ্ছে! একজন পুরুষের এবং একজন যুবতী—টুবতী হবে। তবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পায়ের পাতা থেকে শাড়ি মাঝে মাঝে উঠে যাচ্ছিল।

রমা ন্যাপকিন বিছিয়ে নিল হাঁটুর ওপর। অরুণের দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিল। খাবার স্পৃহা দুজনের কারও আছে বলে আর মনে হচ্ছে না। অরুণ চামচ দিয়ে সামান্য নেড়ে চেড়ে একটু ঝোল ঢেলে নিল।

খাওয়া হয়ে গেলে রমা বলল, দেখি বিল।

বয় বিল নিয়ে এলে অরুণ পার্স বের করল।

আমি দিচ্ছি। রমা ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গেল।

অরুণ ঠান্ডা গলায় বলল, না।

একদিন না হয় আমি দিলামই।

কী দরকার। সে তিনটে দশ টাকার নোট বের করে দিল। আইসক্রিমের সুগন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে তাদের।

তুমি রাগ করছ কেন?

কোথায় রাগ দেখলে। সে খুব আস্তে আস্তে বলল শুধু, সত্যি, বোকা মনে হচ্ছে নিজেকে।

কথাটা ভেতরে গিয়ে কেন যে বিঁধল রমার। সে বলল, আমিও তো কম যাই না। তোমার কী দোষ? তারপর গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, অরুণ, তুমি বুঝবে না।

এতে আর বোঝাবুঝির কী আছে?

আছে বইকি? আমি কি পাথর, আমার কি শরীরে কিছু নেই! আমার কি ইচ্ছে টিচ্ছে বলে কিছু নেই!

অরুণ উঠে দাঁড়াল। সিগারেট জ্বালল। তারপর বের হবার সময় বলল, বার বার মনে হচ্ছে রমা, নিজেকে শুধু অসম্মান করে গেছি। অমলাকে অসম্মান করেছি। তুমি সেই মজাটা কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে কেবল চোখ মেলে সেটাই দেখতে চেয়েছ। কাজের সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছ, এটা ঠিক না।

অরুণ রাস্তায় নেমে আরও কেমন ক্ষেপে গেল। বলল, ন্যায় অন্যায় বোধটা আমারও কম নেই রমা। তবু বুঝি মানুষের অসুখটা ভেতরেই আছে। সে কিছুতেই নষ্ট হতে না পারলে শান্তি পায় না। তোমার ধারণা কিছু হলেই পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। সেটাতো আমার দিক থেকেও হতে পারে। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ।

রমা মাথা নিচু করে রেখেছে। রোদ্দুর। ভীষণ গরম। এই রোদ্দুর এবং দাবদাহ ওদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করছে না। একটা কঠিন সংকটের মুখে ওরা পড়ে গেছে এখন।

বরং আমারই বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা। তুমি তো যে—কোনো দিন শরীর পবিত্র আছে বলে, নতুনভাবে জীবন গড়ে ফেলতে পারবে। আসলে আমি তো তোমার মনের মানুষ না। আর তুমিও জানো আমরা যত দূরেই যাই না কেন একটা বিন্দুতে গিয়ে কখনো আমরা মিলতে পারব না। অমলা তো কোনো দোষ করেনি।

রমা বলল জানি।

সহসা অরুণের মনে হল সত্যি সে একজন অপরিচিতার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। রমার মুখ কঠিন থমথমে। সে কেমন ভয় পেয়ে গেল। বলল, চল, দিয়ে আসি, ওঠো।

রমা পিছনে বসতেই কী যে হয়ে যায়—সেই এক সুমধুর সমীরণে যেন ভেসে যাচ্ছে। পাশের একটা দোকানে আশ্চর্য মিউজিক বাজছে। মিউজিক বাজলে ভেতরে রক্তের ঝড়টা প্রবল হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছিল, ভয়ংকর অবমাননায় অরুণ কাতর হয়ে পড়েছে। একজন পুরুষের এমন উদার এবং নিবিষ্ট আপ্যায়ন সে কেন যে কিছুতেই ঠেলে ফেলতে পারছে না। ভেতরটা কেমন অবশ অবশ লাগছে। ঘুম পাচ্ছে মতো। যা হয় হবে। জীবনটা তো সত্যি ব্যাকরণ নয়। সে বলল, অরুণ আমি যাব।

নিয়ে তো যাচ্ছি।

তোমার সেই ফ্ল্যাটে যাব!

অরুণের ভেতরটা সহসা বিদ্যুৎ চমকের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সে বলল, সত্যি বলছ রমা। সত্যি।

রমা কিছু বলল না। কেবল মুখটা পিঠে ঘসে দিল অরুণের। অরুণ আবার বাতাস কাটিয়ে বের হয়ে যেতে থাকল। অতীব অকিঞ্চিৎকর, জীবনের অন্য সব কিছু—নতুন গ্রহ সন্ধানের মতো মনে হচ্ছে রমার সবকিছু। সে ভেসে যাচ্ছে, রমা ধরে রেখেছে, কেমন এক গোলকধাঁধার ভেতর মাথাটা দুলে উঠছে তার। তখনই মনে হল তার, কিছু টুকিটাকি জিনিস সঙ্গে নেওয়া দরকার। সে বাইক ঘুরিয়ে দিল সাঁ করে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *