Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ব্যতিক্রমী শরৎচন্দ্র || Purabi Dutta

ব্যতিক্রমী শরৎচন্দ্র || Purabi Dutta

বাংলা সাহিত্য-প্রীতি হেতু প্রচুর সাবেকি ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখনী আমাকে আকৃষ্ট সর্বাধিক করেছে। দিনে দিনে নানাভাবে তাঁকে নিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসে চিরকালীন সমাজবার্তা উপলব্ধি অনুধাবন হেতু অনেক বিশ্লেষণাত্বক আলোচনাও করেছি ।

এবারে মানুষ শরৎচন্দ্র কেমন ছিলেন তার ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে? এ বিষয়ে একটু লিখবার ইচ্ছে হলো। ব্যক্তি ও লেখক হিসাবে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী সর্বস্তরে, সর্বকালে। অপ্রাসঙ্গিক হবে কি– সেই একশ বছর আগে তিনি তাঁর অসাধারণ এক চরিত্রের মুখে যা লিখেছিলেন—

“আধুনিক সভ্যতার বাহন তোরা, তোরা মর! কিন্ত যে সভ্যতা তোদের এমনধারা করিয়াছে, বইতেই যদি হয়ত সেই সভ্যতাকে রসাতলের পানে বহিয়া নিয়া যা….”
“শ্রীকান্ত”, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

এ অনুভূতি আজকের দিনে অতি প্রকট, সন্দেহ নেই।

অশনে, বসনে,চলনে, বলনে কোন নিয়মই তিনি গ্রাহ্য করতেন না। শেষ বয়সেও রাতের খাবার নিয়ে গভীর রাত অবধি নির্বিকারে হিরণ্ময়ী দেবী অভুক্ত বসে থাকতেন। কোন অভিযোগ অভিমান কিছুই প্রকাশ করতেন না। শরৎচন্দ্র বুঝতেন, চেষ্টা করতেন শুধরে নিতে কিন্ত তাঁর ধরণই যে সৃষ্টিছাড়া। হিরণ্ময়ী দেবীও তা বুঝতেন।বড়ো সুন্দর ছিল তাদের সম্পর্ক। তাই সারা রাত ধরে সাহিত্য আলোচনা যখন স্তিমিত, প্রভাত কালে — টকটকে কস্তাপাড়ের গরদ শাড়িতে নিজেকে মুড়ে হিরণয়ী দেবী জলভরা কাঁসার বাটি শরৎচন্দ্রের পায়ের কাছে রাখেন। শরৎচন্দ্র পায়ের বুড়ো আঙুল ছূইয়ে একটু জল স্পর্শ করেন। সাহিত্যিক রাধারানী দেবী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন,– “আপনি এসব বিশ্বাস করেন”— শরৎচন্দ্রের প্রত্যুত্তর— “আমি কি বিশ্বাস করি, সে কথা নয় ,ও বিশ্বাস করে সেটাই আমার কাছে বড়ো”।

রাধারানী দেবী শরৎচন্দ্রকে ডাকতেন “বড়দা” বলে। শরৎচন্দ্রও তাকে বোনের মতো ভালবাসতেন। প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর কলকাতার দক্ষিণে খোলামেলা স্থানে বাড়ি করলেন ” ভালবাসা” কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী। বোনের বাড়ির সংসার গুছোতে শরৎচন্দ্র হাঁট থেকে গৃহস্থালী সরঞ্জাম কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে কন্যার জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথ নাম দিলেন “নবনীতা” আর অসুস্থ অবস্থায় শরৎচন্দ্রও নাম রাখলেন -” অনুরাধা”। সকল নারীজাতিই ছিল তাঁর ভগিনীসমা ।

নবনীতার জন্মের তিনদিনের পর মৃত্যু হয় শরৎচন্দ্রের।

অস্বাভাবিক ঘটনা পরাম্পরায় শরৎচন্দ্রের জীবনে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের দুই ঘটনাকেই বলা যায় তিনি প্রায় বাধ্য হয়েই তাদের মায়াদৃত হয়েই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্ত তাদেরকে অবহেলা করেন নি, প্রকৃতই স্ত্রীর মর্যাদায় ভালবাসতেন।
নারী দরদী শরৎচন্দ্র সর্ব স্তরের নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। পতিতালয়ে তিনি যেতেন, শুধুমাত্র পতিতাদের দুঃখকষ্টের খোঁজখবর করবার জন্য। সেখানে বসে সাহিত্য রচনাও করতেন। পতিতারাও তাঁকে বলতেন ” দাদাঠাকুর”।
পতিতালয়ে যেতেন বলে সমাজে তাঁর বদনাম ছিল। কিন্ত শরৎচন্দ্র সে বদনামের কোন তোয়াক্কা করতেন না, বা কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজনও মনে করতেন না।

সর্বকালেই লেখকরা প্রত্যক্ষ কিছু অভিজ্ঞতার জন্য কিছু না কিছু অসামাজিক আচরণ করতেন, ও করেন অজ্ঞাতসারে বা নির্ভীকাচারে। কিন্ত শরৎচন্দ্রের মতো এমন কেউ আছেন কি যিনি বিন্দুমাত্র নিজ চরিত্রের ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যাপারেও চূড়ান্ত উদাসীন।

বিভিন্ন নেশা গ্রহণ জ্ঞানাকাঙ্খিতের নিমিত্ত যথাচার, কিন্ত তার জন্য সমাজে নিজের কোন সাফাই মতলব বহন করতেন না। খেটো ধূতী পরিধানে আটপৌরে জীবনযাপনে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তবে ফুলেল তেলের সুবাস নিতেও বাঁধ সাধতেন না।

এক কথায় চরম স্পষ্টভাষী — “সাহিত্য রচনা বিষয়ে পরিষ্কার মন্তব্য– আমি ত কিছু বানিয়ে লিখি না, বাস্তবে আশেপাশে ,যা দেখি তাই লিখি।”
সাহিত্যিক বনফুলের কাছে মন্তব্য। নিজের কোন কৃতিত্বের স্বীকার নেই, শুধুই লেখার মাধ্যমেই সমাজে চরিত্রগুলি তুলে ধরা। যে বার্তা তিনি রেখে গেছেন ঐসব লেখনীতে তা যে কালজয়ী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

হিরণ্ময়ী দেবী(মোক্ষদা নাম পরিবর্তে শরৎচন্দ্র রেখেছিলেন)র সাথে শরৎচন্দ্রের সত্যিকারের বিবাহ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় কিছু ছিল। মৃত্যুর কিছু আগে কয়েকজন হিতৈষী তাঁকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন করতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন ওসব ভরং করতে তিনি পারবেন না। বিবাহ দ্বন্দতত্ত্ব বর্তমানে কি ব্রাত্য, এর উত্তর ভবিষ্যত দেবে।

সভ্য সমাজে এমন নিখাদ স্পষ্ট মানুষ বলেই কি তাঁর রচনা এত বাস্তব ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।

নর নারীর প্রকৃত প্রেম তিনি তাঁর সাহিত্যে দেখিয়েছেন বিশ্বাসের ভিত্তিতে ও গভীরতায়।
“সতী” গল্প এ তিনি দেখিয়েছেন–
নির্মলা সতী স্বীকৃতি পেলেও স্বামী হরিশ উকিলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা ছিল না। অবিশ্বাস ও ভালবাসা সহাবস্থান করে না, চুম্বকের দুই প্রান্তসম।
ভালবাসতে কি সকলেই জানেন–
” বড়দিদি ” গল্পে মাধবীর সখীর স্বামীর বয়ানে লিখেছিলেন–
“যাহার রূপ আছে, সে দেখাবেই,যাহার গুণ আছে সে প্রকাশ করিবেই। যাহার হৃদয়ে
ভালবাসা আছে– যে ভালবাসিতে জানে– সে ভালোবাসিবেই।”

আর
“বিপ্রদাস” উপন্যাসে, বন্দনার কাছে ধরা পড়েছিল অতি উদার হৃদয়,বড়ো মনের নিপাট ভালোমানুষের চরিত্র বিপ্রদাস—স্পষ্ট ভাষায় বন্দনা বলেছিল– “আপনি আমার মানুষ দিদিকে ভালবাসেন নি, ভালবেসেছেন আদর্শগতভাবে ‘স্ত্রী ‘নামক এক ধারণাকে। “

“চাঁছাছোলা” এই গ্রাম্য কথাটি তার প্রতি খুব খাটে। লেখক বিষ্ণু প্রভাকর তাঁকে নিয়ে লিখেছেন– “ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ”।

মহাপ্রাণই তিনি ছিলেন। পিতার দারিদ্রতা তাকে কষ্ট দিলেও অবস্থা বিপাকে নানাস্থানে নানা পরিবেশে অন্তর্মুখী শরৎচন্দ্র প্রচুর চরিত্র দেখে ক্রমাগত ঋদ্ধ হতেন। আশপাশের সেই বাস্তব মানব চরিত্রের বিশ্লেষণ সবাই কি করতে পারেন। অথচ সাবলীল ভাবে তা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন শরৎচন্দ্র ।

ছিলেন দেশপ্রেমিক।
সুপ্ত সে দেশপ্রেম, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে প্রকাশ পেলো “পথের দাবী”তে।
ছিলেন মানবদরদী। নিজের দারিদ্র উপেক্ষা করে বিনে পয়সার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন দরিদ্রদের। অবশ্যই হোমিওপ্যাথি পড়া করেই। মেধাবী শরৎচন্দ্রের কোন ডিগ্রীর মোহও ছিল না। অথচ পাণ্ডিত্ব ছিল নানা বিষয়ে। বুৎপত্তি ছিল বিজ্ঞানেও।

শরৎচন্দ্রের সম্বন্ধে
লেখার আরও অনেক অনেক আছে– অগাথ সমূদ্রের জলের মতোই সে অফুরান ভাণ্ডার। এখানে সামান্য কয়েক ফোটা জল সিঞ্চনমাত্র।

কোন কিছুর বিলাস তাঁর ছিল না, শুধু কাগজ কলম কালি।

চরিষ্ণু চরিত্র যার, যত্রতত্র চলে ফিরে চলা যার অভ্যাস, তাঁর কি বিলাস ব্যসন এর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে। কোন বোলবোলার পেছনে কোন লিপ্সাই ছিল না।

মাধুকরী বৃত্তিও নয় তাহলে তাঁর বেঁচে থাকতে যে হবে অতএব কোন অর্থকরি কর্মও যে দরকার। তা সামান্য হলেও চলবে। রেঙ্গুনে দিনগুজরানোর জন্য সরকারী কর্ম কিছুটা যেন সুরাহা । আসলে সাহিত্য চর্চা নয় তার ছিল লোকচরিতের সব দলিল লেখা, কিন্ত বস্তুত তাই হয়ে উঠল কথাশিল্পের বাস্তব সাহিত্য, ও অর্থকরিও ।

ক্রমে খ্যাতির শিখরে, যুগান্তরব্যাপী কালজয়ী সব লেখনীর ব্যাপ্তি। গল্প উপন্যাস ছাড়া প্রচুর প্রবন্ধ নানা বাস্তব বিষয় নিয়ে তিনি লিখে গেছেন।

“স্বরাজ- সাধনায় নারী” ছোট্ট নিবন্ধে লিখেছেন–

“….. অত্যন্ত স্বার্থের খাতিরে যে দেশ যেদিন থেকে কেবল তার সতীত্বটাকেই বড় করে দেখেছে , তার মনুষ্যত্বের কোন খেয়াল নয় ,তার দেনা আগে তাকে শেষ করতেই হবে। ….. সতীত্বকে আমিও তুচ্ছ বলি নে, কিন্ত একেই তার নারী জীবনের চরম ও পরম শ্রেয় জ্ঞান করাকে কুসংস্কার মনে করি …..
আমার জীবনের অনেকদিন আমি Sociologyর পাঠক ছিলাম দেশে প্রায় সকল জাতিগুলিকেই আমার ঘনিষ্ঠভাবে দেখবার সুযোগ হয়েছে,— আমার মনে হয় মেয়েদের অধিকার যারা যে পরিমাণ খর্ব্ব করেছে, ঠিক সেই অনুপাতেই তারা কি সামাজিক, কি আর্থিক, কি নৈতিক , সকল দিক দিয়েই ছোট হয়ে গেছে…..”

তাই শরৎচন্দ্র লিখেছেন
“বামুনের মেয়ে” উপন্যাসে অরুণের কাছে ‘কনে চন্দন’ পড়া সন্ধ্যার বয়ানে– “আমিও কাশী চলে যাচ্ছি অরুণদা, ঠাকুরমা ও বাবার সঙ্গে, দেখবো, বিবাহ ছাড়াও আর কোন কাজ আছে কিনা মেয়েদের । “


সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপের তেমন তিনি জড়িত ছিলেন না, কিন্ত দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির পথ সন্ধানে তিনি পরোক্ষভাবে সোচ্চার ছিলেন। ১৩২৮ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কারাদণ্ডের পর শ্রদ্ধানন্দ পার্কে দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে প্রদত্ত “অভিনন্দন স্মারক ” লিখে দিয়েছিলেন।

দেশবন্ধুর সাথে অনেক সাক্ষাৎ খোলাখুলি মতবাদ বিনিময় ও চিঠি পত্রের আদানপ্রদান ছিল। শরৎচন্দ্র লিখিত “স্মৃতিকথা”য় দেশবন্ধুর কথা অনেক উল্লেখ আছে। বরিশালের পথে স্টীমারে রাতের অন্ধকারে নিদ্রাবিহীন দুইজনের অনেক মত বিনিময় তথা মতান্তরও হয়েছিল। উঠে আসে, ভাবুক বাঙালী জাত, চরকা, হিন্দু- মুসলিম ইউনিটি ইত্যাদি।
দেশমুক্তির অস্থিরতায় ,একে অপরকে সহিষ্ণুতার আশ্বাস। দেশবন্ধু বলেছিলেন– “আপনার ত মুসলমান-প্রীতি অতি প্রসিদ্ধ”…..
ওদের সংখ্যা যে দিন দিন বেড়ে উঠছে সে কথাও উল্লেখ করেন।
শরৎচন্দ্র বলেন, “…… নমঃশূদ্র,
মালো,নট, রাজবংশী এদের টেনে নিন, দেশের মধ্যে, দশের মধ্যে, এদের একটা মর্যাদার স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়ে এদের মানুষ করে তুলুন, মেয়েদের প্রতি যে অন্যায়, নিষ্ঠুর, সামাজিক অবিচার চলে আসচে, তার প্রতিবিধান করুন, ওদিকের সংখ্যার জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না।”
নমঃশূদ্র প্রসঙ্গে খুশী হয়ে চিত্তরঞ্জন বলেন– “দেশবন্ধুর এক অর্থও ত চণ্ডাল।”
সত্যিই মানুষ মাত্রই ত চণ্ডাল।
“হরিজন” কি শুধুই এক শ্রেণীর মানুষ।
হরিসৃষ্ট ত সকলই— জলে, স্থলে , অন্তরীক্ষে,আশমানে,অনন্তে —
সকল মানব, জীব, উদ্ভিদ ও আর আর সব জড়ো পদার্থ।

সবশেষে বলি সংক্ষেপে বা এক কথায় বলা যায়
“অনুভবে শরৎচন্দ্র”
শতাব্দীপূর্বে যে সব সাহিত্য — গল্প , উপন্যাস, প্রবন্ধ নিয়ে শরৎচন্দ্র এক ভাণ্ডার উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গিয়েছেন, তা মাটির গহ্বরে এক কলসীতে সযত্নেই আছে। সেসবের রত্নদ্যুতি বর্তমান যুগেও অনুধাবন করা যায়, শুধু তুলে এনে নির্যস টুকু একটু মিলিয়ে নেওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress