Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশল্যকরণী (২০১০) || Samaresh Majumdar » Page 3

বিশল্যকরণী (২০১০) || Samaresh Majumdar

বাংলোয় ফিরে এসে অর্জুন দেখল, লছমন বাগানে কাজ করছে। স্টেফি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জঙ্গল দেখছেন। কাছে যেতে স্টেফি বললেন, মুশকিল হয়েছে। মি. সোম বললেন, এখান থেকে ইউ এস এ-তে কুরিয়ার করা যাবে না। তার জন্যে শহরে যেতে হবে।

কুরিয়ারে কী পাঠাবে?

ওই পাতাগুলো। ইউনিভার্সিটি স্পেসিমেন দেখতে চাইছে। একটু আগে মেল এল। আমি পাতাগুলোর ফোটো তুলে স্ক্যান করে পাঠিয়েছি। তাতে তো ওরা বুঝবে না।

তুমি তো ঠিকঠাক পাতা পাওনি এখনও। ওটা পেলেই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু স্টেফি, দেখছ তো, বিশল্যকরণী এখানে একটু ওখানে একটু ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। যদি ওর রস সত্যি কাজে লাগে তা হলে তো তোমার প্রচুর পাতা নিয়মিত লাগবে।

ঠিক কথা। এখানকার মাটি, আবহাওয়ার সঙ্গে মিল আছে এমন জায়গা বেছে নিয়ে ওখানে বিশল্যকরণীর চাষ করব। বিশাল বাগান তৈরি করতে তো অসুবিধে নেই। স্পনসররা খরচ মিটিয়ে দেবে। স্টেফি বললেন।

বাঃ। উইস ইউ গুড লাক।

অর্জুন ঘরে গিয়ে দেখল অমল সোম চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। সে পাশে বসে লোকটার ব্যাপারে যা জেনেছে তা খুলে বলল। সব শুনে অমল সোম বললেন, নির্ভেজাল বেড়ানো দেখছি তোমার পছন্দ নয়। কিন্তু লোকটা যে সত্যি কথা বলছে তার প্রমাণ কী?

কোনও প্রমাণ নেই। তবে ওই অবস্থায় বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে বললে যত বড় অভিনেতা হতে হয়, লোকটা বোধহয় তত বড় অভিনেতা নয়।

.

দুপুরের খাওয়া শেষ হলে স্টেফি আবার বিশল্যকরণী পাতার সন্ধানে বেরোতে চাইলেন। মেজর সেজেগুজে তৈরি। অর্জুন জানাল, তার পায়ে একটু ব্যথা হয়েছে, রেস্ট নিতে চায়। অমল সোম তাকে অব্যাহতি দিলেন। দুপুর সওয়া দুটোয় ওঁরা বেরিয়ে গেলেন। তিনজনেই লাঠি জোগাড় করে নিয়েছেন। স্টেফির হাতে একটা ঝোলা।

লছমন ওদের যাওয়া দেখছিল ভানুপ্রসাদের পাশে দাঁড়িয়ে। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি যাবেন না বাবু?

নাঃ। ওই পাতা খুঁজতে আমার ভাল লাগবে না।

কী পাতা বাবু?

ভালুপ্রসাদ তাকে বুঝিয়ে বলল মেমসাহেব কী কারণে অতদুর থেকে এসেছেন!

হাসল লছমন, দুর! ওই পাতা দিয়ে যদি এত বড় কাজ করা যেত, তা হলে এতকাল বনেবাদাড়ে পড়ে থাকে? কবে সাফ হয়ে যেত। যাকগে, মেমদের মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তা ঘোরে। একবার একটা সাহেব এসেছিল কীভাবে পাখি ডিমে তা দেয় তার ফোটো তুলতে। লম্বা গাছগুলোয় উঠে দিব্যি ঘণ্টার পর-ঘণ্টা বসে থেকে ফোটো তুলল। কিন্তু ফিরে যাওয়া ওর ভাগ্যে লেখা ছিল না।

কেন?

ঘাড় মটকে মেরে দিয়েছিল কেউ।

কে?

জানি না। পুলিশ লাশ নিয়ে গিয়েছে, খুনিকে ধরতে পারেনি।

হঠাৎ অর্জুন ভানুপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বিরিয়ানি রাঁধতে পারো?

চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু এখানে বিরিয়ানির মশলা তো নেই। তা ছাড়া মাংস আনা দরকার। ভানুপ্রসাদ বলল, ওসব জিনিস রাজাভাতখাওয়াতেও পাওয়া যাবে কি না জানিনা।

লছমন বলল, কে বলল পাওয়া যায় না? সব পাবে ওখানে।

ভানুপ্রসাদ মাথা নাড়ল, এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একা যাওয়া-আসা করতে পারব না।

ঠিক আছে। লছমন, তোমার তো সব চেনাজানা। তুমি সঙ্গে যাও। মেমসাহেব এসেছেন আমেরিকা থেকে, ওঁকে ভাল খাওয়ানো দরকার। অর্জুন বলল।

কিন্তু! লছমন দ্বিধায় পড়ল, আমি বাংলো ছেড়ে যাব কী করে? মালিকের নিষেধ আছে। ওই যেদিন মাইনের টাকা দিতে লোক আসে, সে-ই সব বাজার করে আনে।

আরে, তোমার মালিক তো অমলদার পরিচিত। কিছুক্ষণের জন্যে আমাদের কাজে বাইরে গেলে নিশ্চয়ই তিনি রাগ করবেন না। ততক্ষণ আমি তোমার হয়ে পাহারা দিচ্ছি। অর্জুন বলল।

তবু রাজি হচ্ছিল না লছমন। কিন্তু ভালুপ্রসাদ তাকে নিচু গলায় কিছু বলতে সে মত বদলাল। লছমন বলল, ঠিক আছে, বলছেন যখন, যাচ্ছি। সন্ধের আগেই ফিরে আসব। আপনি একটু বেশি টাকা দিয়ে দেবেন। হাতে টাকা নেই, কেরাসিন তেল কিনতে হবে।

অর্জুন ভানুপ্রসাদকে উপরে ডেকে নিয়ে গিয়ে শ’চারেক টাকা দিয়ে বলল, দেখে-শুনে নিয়ে এসো। বেশি দেরি কোরো না।

ওরা গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল অর্জুন। চারধার কী ভীষণ চুপচাপ, ঝিঁঝির শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এই জনমানবশূন্য পৃথিবীতে লছমন একা থাকে কী করে? লছমন যে এত সহজে যেতে রাজি হবে তা ভাবেনি অর্জুন। ভানুপ্রসাদ নিশ্চয়ই ওকে কোনও পানীয়ের লোভ দেখিয়েছে। সেই পানীয় পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে ওরা! ভানুপ্রসাদকে সতর্ক করা যেত, কিন্তু ইচ্ছে করেই সে না বোঝার ভান করেছে।

.

সকালে যেদিকটায় যাওয়া হয়েছিল সেদিকে না গিয়ে উলটো দিকের জঙ্গলে ঢুকেছিলেন ওঁরা। ভয় পাওয়া একটা বুনো শূকর প্রায় ওঁদের গায়ের কাছ দিয়ে এমনভাবে ছুটে গিয়েছিল যে, মেজর চিৎকার করে উঠেছিলেন, কী হচ্ছে কী!

সেটা শুনে স্টেফি হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন। আরও কিছুক্ষণ পরে অমল সোম একটা বিষাক্ত সাপ মারলেন। মেরে বললেন, না মেরে উপায় ছিল না! নইলে আমি মারা পড়তাম।

মেজর হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, স্টেফি, আফ্রিকা আর এই ডুয়ার্সের জঙ্গলের মধ্যে কোনটা বেশি ভয়ংকর বলো তো?

আমি কখনও আফ্রিকায় যাইনি।

তা হলে তোমার একবার যাওয়া দরকার। ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন এইট্টির শীতকালে আমি প্রথম মাসাইমারায় যাই।

মেজর! চাপা গলায় সতর্ক করলেন অমল সোম।

ওঃ। এটা সত্যি ঘটনা!

দাঁড়িয়ে গেলেন অমল সোম, তার চেয়ে সত্যি ঘটনা হল, কাছাকাছি কোনও জন্তুর দল আছে। হাতি বা বাইসন মনে হচ্ছে। গন্ডারও হতে পারে।

মাই গড!

আমাদের ওদিকে আর এগোনো ঠিক হবে না।

কিন্তু আমরা তো এখনও একটাও স্পেসিমেন পেলাম না। স্টেফি বললেন।

পেয়ে যাবে। ধৈর্য ধরো। অমল সোম কথাগুলো বলেই দেখলেন একটা বিশাল গঁড় কুড়ি গজ দূরত্বে গাছের ডাল সরাচ্ছে। তিনি চাপা গলায় বললেন, পিছন দিকে দৌড়োও। নইলে সবাই মারা যাব।

মেজরও দৃশ্যটি দেখেছিলেন। তাকে ওই মোটা শরীর নিয়ে আগে দৌড়োতে দেখা গেল। জঙ্গলে শরীর আটকে যাচ্ছে, ছড়ে যাচ্ছে হাত-মুখ। পিছনে একাধিক হাতির চিৎকার। মেজর পিছিয়ে পড়ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, হৃৎপিণ্ড লোহার বলের মতো হয়ে গলার কাছে উঠে এসেছে। বরং স্টেফি দ্রুত তাদের ছাড়িয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলেন। মেজর আর দৌড়োতে পারছিলেন না। ওঁর অবস্থা দেখে অমল সোম বললেন, গাছে উঠতে পারবেন?

ক্যান ট্রাই। ফ্যাসফেসিয়ে বললেন মেজর।

বাঁ দিকের একটা গাছের ডাল নীচে পাওয়ায় তাই ধরে মেজরকে নিয়ে কোনওমতে উপরে উঠলেন অমল সোম। তারপর সেটায় রেখে আর একটা উপরের ডালে উঠে এলেন। শেষ পর্যন্ত যে দূরত্বে পৌঁছোলেন সেখানে হাতির শুড় পৌঁছোনো সম্ভব নয়। মেজর কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। একটার পর-একটা হাতি গাছের তলায় জড়ো হয়ে গিয়েছে। নেতা হাতিটি উপরের দিকে মুখ করে শুড় নাচাল কয়েকবার। রাগে চিৎকার করল। একবার এগিয়ে এসে মোটা গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা দিয়ে বুঝল, ওই গাছ ওপড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।

এতক্ষণে মেজরের গলায় স্বাভাবিকতা ফিরে এল, উই আর সেফ।

অমল সোম কিছু বললেন না।

আপনি কিছু বলছেন না যে?

দয়া করে শক্ত হাতে ডালটা ধরে থাকুন।

আছি। কিন্তু আজ একটা ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহ থাকল না।

কী ব্যাপারে?

আমার পূর্বপুরুষ অবশ্যই হনুমান কিংবা ওইজাতীয় বনমানুষ ছিলেন। এই বডি নিয়ে কীভাবে উঠে এলাম বলুন তো? মেজর যেন নিজের পিঠ চাপড়ালেন।

হাতিগুলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে গেল।

নামতে পারবেন? অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন।

কেন?

আশ্চর্য! মেয়েটার কথা ভুলে গেলেন? ও যে সেই দৌড়ে চলে গেল, কোথায় গেল, বাংলোয় পৌঁছোতে পারল কি না, খোঁজ নেবেন না?

শিয়োর। মাথা নাড়লেন মেজর, কিন্তু নামব কী করে? নীচের দিকে তাকালেই তো মাথা ঘুরছে।

অমল সোম ওঁকে নামাবার চেষ্টা করলেন। নীচের ডালটায় পৌঁছে শেষ রক্ষা হল না। হুড়মুড়িয়ে নীচে পড়লেন মেজর। পড়ে স্থির হয়ে গেলেন। তাঁর পাশে চলে এসে অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি?

না। চোখ বন্ধ করেই মেজর বললেন, শরীরে ক’টা ফ্র্যাকচার হয়েছে বুঝতে চাইছি।

একটাও হয়নি। অত চর্বি ভেদ করে হাড় পর্যন্ত আঘাত পৌঁছোবে না। চলুন, মেয়েটার খোঁজ করি। যদি বাংলোর পথ ধরে তা হলে ঠিক আছে, কিন্তু যদি উলটো দিকের জঙ্গলে ঢুকে যায় তা হলে বিপদে পড়তে পারে। অমল সোম বললেন।

খোঁজাখুঁজি আরম্ভ হল। চিৎকার করে ওঁরা ডাকতে লাগলেন, স্টেফি! স্টেফি!

কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। মেজর বললেন, নিশ্চয়ই বাংলোয় ফিরে গিয়েছে। আজকালকার মেয়ে, তার উপর আমেরিকান, ও ভুল করবে না।

অমল সোম দাঁড়ালেন। তিনি নিজেই বাংলোটা কোন দিকে ঠাওর করতে পারছিলেন না। স্টেফি তো দৌড়োচ্ছিল, ওর পক্ষে ভুল করা খুবই স্বাভাবিক।

.

জানলা দিয়ে নয়, একেবারে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অর্জুন চেঁচিয়ে ডাকল, বাদল, চলে এসো। তিনবার ডাকার পরে একমুখ সন্দেহ নিয়ে বাদল নামের লোকটা বুনো ঝোঁপ ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। অর্জুন তাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল।

কোনওরকমে নদী পার হয়ে এল বাদল। ও খুব আতঙ্কিত তা বুঝতে পেরে অর্জুন বলল, ভয়ের কিছু নেই। এখন বাংলো খালি। লছমন বাজারে গিয়েছে। এসো।

লোকটাকে নিয়ে দোতলায় উঠে এল অর্জুন। বলল, এখানে চারটে ঘর। সব ঘরেই আমাদের কেউ না কেউ থাকে। তুমি পিছনের বারান্দায় থাকবে। এসো।

রান্নাঘরের মধ্যে দিয়ে পিছনের বারান্দায় বাদলকে নিয়ে এল অর্জুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার সেই বিছানা কোথায়?

ওখানেই পড়ে আছে।

ওঃ। যাও, চটপট নিয়ে এসো। এই বারান্দায় শোবে তুমি। রোদ, বৃষ্টি গায়ে লাগবে না। বাথরুমের দরকার হলে ওই দরজায় আস্তে আস্তে শব্দ করবে। ভানুপ্ৰসাদ আমাদের ড্রাইভার, ও-ই এখন রান্না করছে, ওকে তোমার কথা বলে রাখব। ও শব্দ শুনে দরজা খুলে দিলে চটপট বাথরুম করে আসবে। খাবার ঠিক সময়ে ভানুপ্রসাদ দেবে। কিন্তু খেয়াল রেখো, ওর সঙ্গে গল্প। করবে না। অর্জুন বুঝিয়ে বলতে বাদল মাথা নাড়ল। তারপর দ্রুত নেমে গেল বাংলো থেকে।

মিনিটদশেক পর লোকটা যখন ফিরে এল বগলে ভাঁজ করা বিছানা নিয়ে, তখন অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এত দেরি হল?

নদীতে জল বাড়ছে। দেখুন, পাজামা ভিজে গিয়েছে। তারপর হাঁড়িটাড়িগুলো এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখে এলাম, যা কেউ খুঁজে পাবে না। উনুনটা ভেঙে মাটি চাপা দিতে হল। আমি ওই বারান্দায় চলে যাই? বাদল জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, যাও। মনে রেখো কোনও শব্দ করবে না।

বাদল এগোচ্ছিল, কিন্তু অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওই লোকটার নাম কী?

কোন লোক?

যাকে ওরা কিডন্যাপ করেছিল, যার প্রাণ তুমি বাঁচিয়েছিলে।

বিজয়বাবু, বিজয়াদ গুপ্তা।

কোথায় বাড়ি?

শিলিগুড়ি। বহুত বড় ব্যবসাদার।

ঠিক আছে, চলে যাও। আমি এপাশ থেকে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। ভালুপ্রসাদ যে ঘরে শুচ্ছে সেই ঘরের দরজা দিয়ে বাদলকে পিছনের বারান্দায় বের করে দিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল অর্জুন।

মেজর বা স্টেফির এই বারান্দায় আসার প্রয়োজন হবে না। সরাসরি পথও নেই। অমলদার ক্ষেত্রেও তাই। একমাত্র ভানুপ্রসাদ জানবে, ওকে না জানিয়ে বাদলকে এখানে রাখার উপায় নেই। খাবার দেবে কে?

অর্জুন বারান্দায় পায়চারি করতে গিয়ে দেখল, স্টেফির ঘরের দরজা খোলা।

সে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে ভিতরের দিকে তাকাতেই ল্যাপটপটাকে দেখতে পেল। ওরকম মূল্যবান জিনিস খোলা জায়গায় ফেলে গিয়েছেন স্টেফি? অবশ্য এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে চুরি করতে কেউ আসবে না, এটাও ঠিক। অর্জুন ঘরে ঢুকে ল্যাপটপটা তুলতে গিয়ে একটু থমকাল। তারপর ওটা খুলে মিনিটতিনেক চেষ্টা করতেই মুখে হাসি ফুটল তার। না, বাদল মিথ্যে বলেনি। মিসিং পার্সন ইন নর্থবেঙ্গল, কারেন্ট মান্থ-এ বিজয়াদ গুপ্তার নাম ফুটে উঠেছে। শিলিগুড়ির বিখ্যাত কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক, তিনটে চা-বাগানের শেয়ারহোল্ডার মি. গুপ্তাকে কেউ বা কারা ডুয়ার্সের জয়ন্তী বাংলো থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে। যদি কেউ মি. গুপ্তার সন্ধান দিতে পারে, তা হলে তাকে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। যোগাযোগ করুন। এক, ডি এস পি, শিলিগুড়ি, ও সি রাজাভাতখাওয়া। দুই, করমচাঁদ . গুপ্তা, বাবুপাড়া, শিলিগুড়ি। টেলিফোন ২৫৯২০০৩।

ল্যাপটপ বন্ধ করে ওটাকে আলমারির মধ্যে রেখে শিলিগুড়ির নাম্বার ডায়াল করল অর্জুন। একটু পরেই রিং শুরু হল। তারপর হিন্দিভাষী একজন সাড়া দিলেন, হেল্লো।

করমচাঁদজি আছেন?

বলতেছি।

নমস্কার। আমি অর্জুন। সত্যসন্ধান করা আমার নেশা এবং পেশা।

কী সন্ধান?

আপনি ঠিক বুঝবেন না। আপনার আত্মীয় বিজয়াদ গুপ্তার খবর পেয়েছেন?

না। আপনি, আপনি জানেন?

আমি খবর পেয়েছি তিনি ভুটান সরকারের পুলিশের হেফাজতে আছেন। আপনারা দার্জিলিং-এর এস পি-কে বলুন ভুটান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

দাদা বেঁচে আছে তো?

কিডন্যাপারদের হাত থেকে পালিয়েছেন বলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। ঠিক আছে। রাখছি।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার ঠিকানা দিন!

অর্জুন উত্তর না দিয়ে লাইন কেটে দিল। ল্যান্ডলাইনে ফোনটা করেছিল বলে করমচাঁদ তার মোবাইল নাম্বার পাবে না।

দরজা ভেজিয়ে বাইরে আসতেই ওঁদের দেখতে পেল অর্জুন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় অমল সোম আর মেজর গেটের দিকে এগিয়ে আসছেন। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, প্রচণ্ড ধকল গিয়েছে ওঁদের উপরে। সে দ্রুত নেমে দূরত্বটা পেরিয়ে গেট খুলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আপনাদের? স্টেফি কোথায়?

অমল সোম বললেন, খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। হাতির দলের সামনে পড়ায় আমরা দৌড়ে পালিয়েছিলাম। স্টেফিও দৌড়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ও আমাদের দলছাড়া হয়ে যায়। এতক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করেও ওর হদিশ পেলাম না। ভেবেছিলাম, স্টেফি বাংলোয় ফিরে এসেছে। নাঃ, আবার খুঁজতে বেরোতে হবে।

মেজর হাঁপাচ্ছিলেন, ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। নইলে কোন মুখে ওদেশে ফিরব?

কিন্তু এত বড় জঙ্গলে খুঁজে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে বলুন। ওরা চিরুনিতল্লাশি করে ওঁকে বের করতে পারবে, অর্জুন বলল।

অমল সোম বললেন, এদিকে সন্ধে হতে তো দেরি নেই। দেখি, ডি এফ ও-কে ফোন করি। সেলফোনের নাম্বার টিপলেন অমল সোম। কানে চেপে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে যন্ত্রটির দিকে তাকিয়ে বললেন, যাচ্চলে। সব সাদা।

অর্জুন বলল, নাম্বারটা বলুন। আমারটা দিয়ে চেষ্টা করি।

অর্জুনের ফোনে ডি এফ ও-কে পাওয়া গেল। অমল সোেম তাকে স্টেফির সমস্যা জানালেন। ডি এফ ও বললেন, উনি দেখছেন কী করা যেতে পারে।

এই সময় ভানুপ্রসাদের গাড়ি ফিরে এল। অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, এরা কোথায় গিয়েছিল?

খাবারদাবার কিনতে। অর্জুন বলল।

মেজর বললেন, স্টেফি না ফেরা পর্যন্ত আমরা কেউ কিছু খাব না।

ভানুপ্রসাদ স্টেফির ব্যাপারটা শুনে বলল, চলুন সাব। আমরা খুঁজে দেখি। মেমসাহেব রাস্তা হারিয়ে নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছেন।

লছমন বলল, গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

ভানুপ্রসাদ তাকাল ওর দিকে, কেন?

এই জঙ্গলে হারিয়ে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। লছমন বলল, জঙ্গল গিলে ফেলে তাকে। আর এক ঘণ্টার মধ্যে রাত নেমে যাবে। আপনারাও ফেরার পথ খুঁজে পাবেন না।

মেজর খেপে গেলেন, মার্ডারার? মোস্ট সাসপিসিয়াস ক্যারেক্টার!

অর্থ বুঝল কি না সেই জানে, লছমন তার ঘরের দিকে চলে গেল।

অর্জুন ভানুপ্রসাদকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকল। চিৎকার করে স্টেফিকে ডাকছিল সে। ভানুপ্রসাদ চেঁচাচ্ছিল, মেমসাব! মেমসাব! কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। ক্রমশ জঙ্গলের ভিতরে ছায়া ঘন হয়ে আসছিল। ভানুপ্রসাদ বলল, আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। রাত্রে তো খুঁজে পাব না। যদি মেমসাব না আসেন, কাল ভোরে চলে আসব জঙ্গলে।

কথাটা যুক্তিপূর্ণ।

.

বিরিয়ানি রান্না স্থগিত হল। ক্রমশ অন্ধকারে চারপাশ ডুবে যেতে ভানুপ্রসাদ চা এনে দিল তাঁদের। তাতে চুমুক দিয়ে অর্জুনের খেয়াল হল, বাদলের কথা এখনও বলা হয়নি ভানুপ্রসাদকে। এই সময় বারান্দায় লছমনকে দেখা গেল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী চাই?

আপনারা আমার উপর রাগ করছেন স্যার, কিন্তু আমি আপনাদের সতর্ক করে দিয়েছিলাম। আমার কথা শুনে যদি চলে যেতেন, তা হলে মেমসাহেব বেঁচে যেতেন। দুটো হাত বুকের উপর জড়ো করে বলল লছমন।

তোমার ধারণা মেমসাহেব মারা গিয়েছেন?

জিভ বের করল লোকটি, ছি ছি। তবে মন তো সবসময় কু ডাকে।

কী বলতে এসেছ?

শুনলাম, বিরিয়ানি হবে না আজ। ভালই করেছেন। আমি বলি কী, তাড়াতাড়ি যাই হোক কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ুন। ভোরের আগে কেউ দরজা খুলবেন না।

কেন? অর্জুনের কপালে ভাঁজ পড়ল।

মানুষের রক্ত পান করলে তেনারা ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। তখন বাইরে আসাই ভাল। কোন মানুষের রক্ত কারা পান করল?

আপনি কি ভাবছেন মেমসাব বেঁচে আছেন?

এই জঙ্গলে পথ হারিয়ে সারারাত কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। চিতা না খাক, নেকড়ে শেষ করে দেবে। আর তেনাদের খপ্পরে পড়লে তো কথাই নেই।

তখন থেকে তেনারা তেনারা করছ, তেনাদের নাম কী?

রাত নামলে ওই নাম উচ্চারণ করতে নেই। আচ্ছা, ভানুপ্রসাদকে বলবেন আমার জন্যে রাতের খাবারের দরকার নেই। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে চিড়ে-মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। লছমন কপালে আঙুল ছুঁইয়ে নেমে গেল বারান্দা থেকে।

অর্জুন বসার ঘরে ঢুকল। অমল সোম তাকালেন। মেজর দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন।

অমল সোম বললেন, মেয়েটা যদি গাছে উঠতে পারে তা হলে বিপদে পড়বে না।

বিপদে পড়বে না! খিঁচিয়ে উঠলেন মেজর, কেন? গাছে সাপ নেই? পাইথন একটা মোষ গিলে ফেলে, মানুষ তো ছার!

কিন্তু এই রাতে ডি এফ ও-কে জানানো ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি?

আমরা এখন থানায় গিয়ে ডায়েরি করতে পারি। পুলিশ যদি এখনই স্টেফির খোঁজে জঙ্গলে সার্চ করে তা হলে ওকে পেয়ে যাবই। মেজর বললেন।

এই সময় ভানুপ্রসাদ গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে থানায়? জিজ্ঞেস করে দেখুন। অমল সোম কাঁধ নাচাতেই অর্জুন তার সেলফোন বের করে নাম্বার টিপল। রিং হল। অর্জুন সাড়া পেতেই কথা বলল, নমস্কার। আমি অর্জুন বলছি। চিনতে পারছেন? ধন্যবাদ। এখন আমরা একটা ফরেস্টের লাগোয়া বাংলোয় আছি। বাংলোটার মালিক শিলিগুড়ির ব্যবসায়ী সুধাংশুশেখর দত্ত। রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী যাওয়ার রাস্তায় এসে বাঁ দিক ধরে এখানে পৌঁছোনো যায়। আমরা চারজন ছিলাম। একজন মহিলা, তিনি আমেরিকান, গবেষণার কাজে এসেছেন। আজ জঙ্গলে গিয়ে মহিলা হারিয়ে যান। না না, হাতির ভয়ে পালিয়ে আসছিলেন সবাই, মহিলা বোধহয় রাস্তা ভুল করেছেন! ওঁর নাম স্টেফি। যদি লোকাল থানাকে ইনফর্ম করেন, ওঁরা ওঁকে খুঁজে বের করতে পারে। একটানা কথাগুলো বলে গেল অর্জুন। তারপর ওপাশের কথা শুনল। ফোনের লাইন কেটে দিয়ে অর্জুন বলল, জলপাইগুড়ির এস পি সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। উনি নোট করে নিয়েছেন। এটাই ডায়েরি বলে ট্রিট করা হবে। উনি এখনই লোকাল থানাকে নির্দেশ দিচ্ছেন কাজ শুরু করতে।

সোফায় বসে অর্জুন বলল, আমার বিশ্বাস, কালই স্টেফিকে পেয়ে যাব।

কী করে বিশ্বাস হচ্ছে? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

এই জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী আছে বটে কিন্তু কোনও ম্যানইটার নেই। থাকলে সেই খবর আমরা জলপাইগুড়িতে বসে জানতে পারতাম। যাকগে, আপনারা যখন জঙ্গলে গিয়েছিলেন তখন আমি একটি লোককে সাহায্য করেছি। অর্জুন বলল।

অমল সোম তাকালেন, কিছু বললেন না।

অর্জুন বলল, পিছনে যে নদী রয়েছে তার পরেই পাহাড় শুরু। ওটা ভুটানের। ওই পাহাড়ে ভুটান সরকারের পুলিশ খুব সতর্ক নয়। তার ফলে ভারতীয় উগ্রপন্থীরা ওখানে আশ্রয় নিয়ে এখানে হামলা চালায়। ওরা বড়লোক ভারতীয়দের কিডন্যাপ করে ভুটানে নিয়ে গিয়ে মোটা টাকা দাবি করে। টাকা পেলে ছেড়ে দেয়। যাকে আমি সাহায্য করেছি সে পাকেচক্রে ওদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইদানীং মানাতে পারছিল না। কয়েকদিন আগে ওরা শিলিগুড়ির এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীকে কিডন্যাপ করে জয়ন্তী থেকে। মোটা টাকা মুক্তিপণ চায়। কিন্তু ওদের কপাল খারাপ হওয়ায় একদিন ভুটানি পুলিশ। পথভুল করে ক্যাম্পের কাছে চলে আসায় ওরা পালাতে বাধ্য হয়। এই লোকটিকে নির্দেশ দেয় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীকে মেরে ফেলতে। সেই নির্দেশ পালন করেনি লোকটা। ব্যবসায়ীর প্রাণ সে বাঁচিয়ে দেয়। সম্ভবত ভুটানি পুলিশের হেফাজতে আছে ব্যবসায়ী। কিন্তু লোকটি ভয় পাচ্ছে উগ্রপন্থীরা এবার তাকে মেরে ফেলবে। ফলে সে জঙ্গলে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়ে এখানে চলে আসে। লছমনের সঙ্গে ওর পরিচয় ছিল। কিন্তু উগ্রপন্থীদের ভয়ে লছমন ওকে বাংলোয় আশ্রয় দেয়নি। নদীর ওপারের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বলেছে। রোজ চাল-আলু দিয়ে আসে লোকটাকে। ওদিকে সাপের উপদ্রব বেশি থাকায় উগ্রপন্থীরা আসতে ভয় পায়। তারা লছমনকে বলেছিল জঙ্গলে নজর রাখতে। মাঝে মাঝে রাত গম্ভীর হলে ওরা এখানে আসে। লছমন তাই লোকটাকে অন্য কোথাও চলে যেতে চাপ দিচ্ছিল। আমাদের বলেছিল বাংলোয় না থাকতে। কারণ, উগ্রপন্থীরা চায় বাংলোটা ফাঁকা থাক। আমি লছমনকে ভানুপ্রসাদের সঙ্গে বাজারে পাঠিয়ে লোকটাকে এই বাংলোয় তুলে এনেছি। পিছনে বারান্দায় আছে লোকটা। ও যে এখানে আছে তা লছমন জানে না।

পিছনে শব্দ হতেই অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে ভানুপ্রসাদকে দেখতে পেল। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অর্জুনের কথাগুলো শুনছিল সে।

গুড জব। লোকটার নাম কী? অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন।

বাদল।

লোকটাকে এখানে আসতে বলল। মেজর বললেন।

আজই না। ও ঘাবড়ে যেতে পারে। অর্জুন উঠল, ভানুপ্রসাদ, তুমি তো সব শুনেছ। সাবধান, লছমন যেন জানতে না পারে।

কেউ জানবে না সাহেব।

চলো। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।

নিঃশব্দে দরজা খুলতেই দেখা গেল বারান্দার ভিতরের কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে লোকটা। অর্জুন নিচু গলায় ‘বাদল’ বলে ডাকতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে। হাতে সেই কাটারি। অর্জুন বলল, শোনো, এর নাম ভানুপ্রসাদ। যখন যা দরকার হবে ওকে ডেকে বলবে।

মাথা নেড়ে নীরবে হ্যাঁ বলল বাদল।

ভানুপ্রসাদ জিজ্ঞেস করল, চা খাবে?

বাদলের মুখ হাসিতে ভরে গেল। দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

অর্জুন ইশারায় ভানুপ্রসাদকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, বেশি ভাব করার দরকার নেই। খেয়াল রেখো, বারান্দায় যেন আলো না পড়ে।

ভুটানের পাহাড়ে উগ্রপন্থীরা ক্যাম্প করেছে এই খবর কলকাতার কাগজে ছাপা হয়েছে। ভারত সরকারের চাপে পড়ে ভুটান সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। বর্ডার পেরিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রে গেলে ধরা পড়ার ভয় নেই বলে তারা বহালতবিয়তে রয়েছে। অমল সোমের সঙ্গে অর্জুন এই ব্যাপারে কথা বলছিল। মেজর বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

রাত বাড়ছে। ভানুপ্ৰসাদ আজ চিকেন আর ভাত বানিয়েছিল। তাই খেয়ে সবাই যে-যার ঘরে চলে গেলে অর্জুন অন্ধকার বারান্দার এক কোণে এসে দাঁড়াল।

কী ভাবছ?

অর্জুন দেখল, অমল সোম তার পিছনে এসে দাঁড়ালেন।

বুঝতে পারছি না। অস্বস্তি হচ্ছে।

হুম। আমি তোমার কথা শোনার পর অন্য কিছু ভাবছি। স্টেফি যদি উগ্রপন্থীদের হাতে পড়ে, তা হলে ভয়ানক বিপদ হবে। ও আমেরিকান, জানামাত্র ওরা প্রচুর টাকা মুক্তিপণ চাইবে।

বোধহয় সেই ভয় নেই। ওরা থাকে ভুটানের পাহাড়ে। নদী পেরিয়ে এদিকে আসে বিশেষ পরিকল্পনা থাকলে। স্টেফি জঙ্গলে পথ হারিয়েছে। তার সঙ্গে ওদের দেখা হওয়া সম্ভব নয়।

লেট্‌স প্রে দ্যাট।

অর্জুন কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। কাল রাতের লোকদুটো গেট খুলে ঢুকছে। ভিতরে এসে বাংলোর দিকে তাকাল। বাংলোর কোনও ঘরে আলো জ্বলছে না। ওরা ধীরে ধীরে বাংলোর পিছন দিকে চলে গেল।

অর্জুন অমল সোমকে বলল, কিচেনের জানলায় চলুন।

নিঃশব্দে জানলার পাশে এসে শব্দ না করে সেটা ঈষৎ খুলতেই গলা শুনতে পেল। তুই আমাদের সঙ্গে দু’নম্বরি করছিস লছমন!

বিশ্বাস কর আমি কিছু জানি না।

আজ বিকেলে ওকে ওই নদীর ওপারে আমাদের একজন দূরবিনে দেখেছে। ওখানে কেউ থাকলে তুই জানতে পারবি না?

তা হলে আজই এসেছে।

ওখানে কোথায় লুকিয়ে থাকা যায় জানিস?

জানি।

চল, গিয়ে দেখি।

এই রাত্রে? ওখানে সাপ আছে।

তুই আগে যাবি। সাপ থাকলে তোকে কামড়াবে।

অত্যন্ত অনিচ্ছায় লছমনকে দেখা গেল ওদের নিয়ে নদীর দিকে যেতে।

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, উগ্রপন্থীদের লোক?

তাই তো মনে হচ্ছে। চলুন, নীচে যাই।

কী করতে চাও?

ওই দু’জনকে আটকালে জানা যাবে ওরা আজ স্টেফিকে পেয়েছে কি না। অর্জুন বলল, তা ছাড়া বাদলের প্রাণ বাঁচাতেও ওদের আটকানো দরকার। আমি ভানুপ্রসাদকে ডাকছি। ওর সাহায্য দরকার হবে।

অর্জুন ভালুপ্রসাদকে ডাকতে গেল। অমল সোম দেখতে পেলেন, একটা টর্চের আলো জ্বেলে কেবল তিনটে ছায়ামূর্তি নদী পার হচ্ছে। এখন নদীর জল সম্ভবত বেড়ে গিয়েছে। কারণ, ওদের পার হতে সময় লাগল। ওপারে পৌঁছে তিনজনই চোখের আড়ালে চলে গেল। অমল সোম বুঝলেন, ওরা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেল।

ইতিমধ্যে ভানুপ্ৰসাদকে নিয়ে চলে এসেছে অর্জুন। অমল সোম বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ওদের আটকাতে চাও। কীভাবে? ওরা সশস্ত্র কি না তা তুমি জানো না।

অন্ধকারের সুযোগটা নেব। ওরা দু’জন। আমি আর ভালুপ্রসাদ যদি আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ি, তা হলে লোক দুটোকে কবজা করতে পারব। ওদের অস্ত্র থাকলেও বের করতে পারবে না।

নদীর ধারে চলে এসে গাছের আড়ালে দাঁড়াল ওরা। হঠাৎ ওপার থেকে চেঁচামেচি ভেসে এল। একজন খুব উত্তেজিত হয়ে গালাগালি দিচ্ছে। তারপরেই দেখা গেল একজনকে ঠেলতে ঠেলতে বাকি দু’জন নদীতে নামল। সেই দু’জনের একজন টর্চ ধরেছে বলে মুখ পরিষ্কার হচ্ছিল না। অমল সোম বললেন, লছমনকে গালাগাল দিচ্ছে কেন?

ওরা নদী পার হচ্ছিল। অর্জুন বলল, ওরা লছমনের দেখানো জায়গায় বাদলকে খুঁজে পায়নি। নিশ্চয়ই ওকে এখন অবিশ্বাস করছে।

ভানুপ্রসাদকে বোধহয় আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল অর্জুন। সে দ্রুত ওপাশের আড়ালে চলে এল। ওরা নদীর এপারে পৌঁছে গিয়েছে এর মধ্যে। একজন বলল, তুই বেইমানি করেছিস লছমন। বেইমানদের কী সাজা দেওয়া হয় তা তুই জানিস! শেষবার জিজ্ঞেস করছি, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বাদলকে?

আমি জানি না, বিশ্বাস কর। আজ দুপুরেও ওকে ওখানে দেখেছিলাম। পাথরের উনুনে রান্না করেছিল। ওগুলো তুলে নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে।

জানিস না। জোরে ধাক্কা মারতেই উপুড় হয়ে পড়ে গেল লছমন।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, বাদলকে এই বাংলোর ভিতরে লুকিয়ে রাখেনি তো?

আমার তাই সন্দেহ হচ্ছে। আগে ব্যাটাকে বেঁধে ফ্যাল, তারপর খুঁজে দেখব। ওর ঘরে গিয়ে দ্যাখ, নিশ্চয়ই দড়ি পাবি।

প্রথম লোকটার কথা শুনে দ্বিতীয় লোকটা চোখের আড়ালে চলে যেতেই ভানুপ্রসাদ বিদ্যুৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অর্জুন চটপট মুখ চেপে ধরল লোকটার। ওর কোমর থেকে দিশি রিভলভার বের করে শাসাল, আওয়াজ করলেই মেরে ফেলব।

লোকটাকে উপুড় করে ওরই জামা দিয়ে এমনভাবে বেঁধে ফেলল অর্জুন যে, নড়তে-চড়তে পারছিল না আর। দ্বিতীয় লোকটা দড়ি নিয়ে ফিরে এসেই আক্রান্ত হল। তাকেও বেঁধে ফেলতে অসুবিধে হল না। লছমন মাটিতে বসে ফ্যালফ্যাল করে ব্যাপারটা দেখছিল। অর্জুন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এদের তুমি চেনো? এরা কারা?

লছমন চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল, না।

সঙ্গে সঙ্গে তার চুলের মুঠো ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে অর্জুন বলল, ওরা তোমাকে আজ শেষ করে দেবে জানা সত্ত্বেও তুমি সত্যি কথা বলবে না?

লছমন জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকাল। অর্জুন হাসল, বেশ, তা হলে ওদের বলে দিচ্ছি, বাদলকে চাল-আলু তুমি সাপ্লাই দিতে। তোমরা দুজন একসময় একসঙ্গে জেল খেটেছিলে।

আপনি, আপনি জানলেন কী করে? লছমন বিভ্রান্ত।

জানি। এরা ওই দলের লোক, যারা ব্যবসায়ীদের কিডন্যাপ করে। অর্জুন বলল, হ্যাঁ কি না?

মুখে শব্দ না করে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল লছমন।

লোক দুটোকে বসিয়ে দেওয়া হল। দু’জনের দুটো হাত পিঠের দিকে টেনে বাঁধা হয়েছে। দুটো পা শক্ত করে বেঁধেছে ভানুপ্রসাদ। এবার অমল সোম এগিয়ে এলেন, তোমরা তো সাধারণ সদস্য। কেউ নেতা নও। আমরা যা জিজ্ঞেস করব তার উত্তর দিলে তোমাদের ছেড়ে দিতে পারি।

লোক দুটো কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

অজুর্ন জিজ্ঞেস করল, বিজয়চাঁদ কোথায় আছেন?

দ্বিতীয়জন মাথা নাড়ল, আমি জানি না।

তুই?

প্রথমজন বলল, ক্যাম্পে ছিল। আমরা যখন ক্যাম্প ছেড়েছিলাম তখন লোকটা বাদলের হেফাজতে ছিল। বাদল জানে।

বাদলকে খুঁজছিস কেন? মেরে ফেলবি ওকে?

ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

কীভাবে?

বিজয়চাঁদকে ছেড়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই বিজয়চাঁদ ওকে টাকার লোভ দেখিয়েছে।

তোদের দলের বাকিরা এখন কোথায়?

ওপারে। এখান থেকে দেড়মাইল দূরে। আমরা আজই এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতাম, কিন্তু…! বলেই থেমে গেল দ্বিতীয়জন।

কিন্তু কী? অর্জুন ধমকাল।

প্রথমজন বলল, অনেক বলে ফেলেছিস তুই!

না, মানে…! দ্বিতীয় লোকটির মুখে ভয় ফুটল।

অমল সোম তার হাত তুলে নিয়ে কনুই-এর নীচে চাপ দিতেই লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। অমল সোম হাত সরিয়ে বললেন, মুখ না খুললে তোমার হাত চিরজীবনের জন্যে অসাড় করে দেব।

আজ সন্ধের সময় একটা নতুন মুরগি পেয়ে গিয়েছি আমরা। সাদা মেমসাব। শেষ রাত্রে নেতা এসে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ঠিক হবে। আমরা এখানে থাকব, না সরে যাব। যা জানি বলে দিলাম। আমি আর পারছি না। গলায় কান্না মিশল লোকটার।

কেন?

এ একটা জীবন? চোরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। টাকা যা আসছে তা আমরা কেউ চোখে দেখতে পাচ্ছি না। ওসব নাকি অস্ত্র কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

অমল সোম উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নির্দেশে ওদের মুখে কাপড় গুঁজে হাত পা বাঁধা অবস্থায় লছমনের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দেওয়া হল।

ভানুপ্রসাদ লছমনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এর কী হবে?

সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ল লছমন, আমি ওদের ভয়ে সবসময়। মিথ্যে কথা বলেছি। এখানে থাকলে ওরা আপনাদের বিপদে ফেলতে পারে মনে করে চলে যেতে বলেছি, ভূতের ভয় দেখিয়েছি। আমায় মাপ করুন।

অমল সোম বললেন, তুমি বাংলোর বারান্দায় গিয়ে বসো। ওখান থেকে নামবে না।

অর্জুন লছমনকে নিয়ে বাংলোর বারান্দায় চলে এল। লছমন কাতর গলায় বলল, বাবু, আমাকে ছেড়ে দিন। এখনই যদি এখান থেকে না পালিয়ে যাই

তা হলে মারা পড়ব।

কীভাবে?

ওরা ফিরে না গেলে দলের লোকেরা খুঁজতে আসবেই।

পুলিশকে ওদের কথা আগে জানাওনি কেন?

মাথা নাড়ল লছমন, পুলিশকে জানালে ওরা ঠিক খবর পেয়ে যেত। হাতজোড় করল সে, আপনারাও ভোর হলে এখান থেকে চলে যান বাবু।

তুমি ভিতরে এসো।

হারিকেনের আলোয় বাদলকে দেখে ভূত দেখার মতো অবস্থা লছমনের। কোনওরকমে বলল, তু-তুই! তুই এখানে?

আমি ওকে জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছি। না আনলে ওর কী অবস্থা হত তুমি জানো। যাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে তারা নিশ্চয়ই ভালবাসার কথা বলত না।

তুই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলি? প্রায় চিৎকার করে উঠল বাদল।

আঃ। চেঁচিয়ো না।

না নিয়ে গেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলত! লছমন মিনমিনে গলায় বলল।

তুই আমাকে খতম করতে ওদের নিয়ে গিয়েছিলি?

যা হওয়ার তা হয়েছে, এখন বাঁচতে চাস তো এখান থেকে পালিয়ে চল।

আমি তোর সঙ্গে কোথাও যাব না।

অর্জুন বলল, মান-অভিমান করে লাভ নেই।

অমল সোম ঘরে ঢুকলেন, নাঃ। ও দুটোকে উপরে নিয়ে আসাই ভাল। লছমন যেমন নীচে থাকে তাই থাক। ওর সঙ্গে ভানুপ্রসাদ থাকবে, যাতে পালাতে না পারে। যদি ওই দুটোর সন্ধানে কেউ ঢোকে তা হলে লছমন বলবে সে কিছুই জানে না, কোনও লোক আজ রাত্রে বাংলোয় ঢোকেনি।

ভোরের আগেই আসতে পারে। অর্জুন বলল, কাল তিনজন এসেছিল। আজ এই দু’জন ফিরে না গেলে তৃতীয় ব্যক্তি এদের সন্ধানে আসতে পারে।

ভানুপ্ৰসাদ আর লছমন একে-একে ওই দু’জনকে উপরে নিয়ে এসে পিছনের বারান্দায় শুইয়ে রাখল। অমল সোম বাঁধনগুলো আরও শক্ত করে দিলেন। লছমন আর ভানুপ্রসাদ নীচে নেমে গেলে অমল সোম বললেন, আর রাত জেগে লাভ নেই। শুয়ে পড়া যাক!

অর্জুন বলল, কিন্তু স্টেফিকে উদ্ধার কীভাবে করবেন?

যেভাবেই করো, আজ রাত্রে নিশ্চয়ই তা করা সম্ভব নয়। কাল সকালে ভাবা যাবে। আর এ ব্যাপারে বাদল বোধহয় আমাদের সাহায্য করতে পারবে।

বাদল? কীভাবে?

কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক অর্জুন।

অমল সোমের কথা শেষ হওয়ামাত্রই একটা হালকা গর্জন কানে এল। বাদল দৌড়ে কাছে এসে বলল, বোধহয় বাঘ!

নিজের ঘরে যেতে যেতে অমল সোম বললেন, অর্জুন, মেজরকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দাও। চিত হলেই ওঁর নাক থেকে বাঘের আওয়াজ বের হয়!

না। ওই রাত্রে কেউ আর এই বাংলোয় ঢোকেনি। যতই বিছানায় শুয়ে থাক, ঘুম ভেঙে ছিল বারবার। যখন ভোর হল, জঙ্গলে পাখিরা তুমুল চেঁচামেচি শুরু করল, তখন অর্জুন বারান্দায় বেরিয়ে এল। লছমনের ঘরের দরজা ভেজানো। একটা অস্বস্তি নিয়ে দরজা ঠেলতেই ভানুপ্রসাদকে দেখতে পেল। পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। লছমন নেই। দ্রুত নদীর ধারে এসে চারদিকে তাকাল। না, কোথাও তার চিহ্ন নেই। ফিরে গিয়ে ভানুপ্রসাদকে কয়েকবার ডাকতেই সে চোখ খুলল। অর্জুনকে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, লছমন কোথায়?

ও তো ওপাশে শুয়ে ছিল।

কখন শেষবার দেখেছ।

রাত্রে।

চারপাশ খুঁজে দ্যাখো তো।

ভালুপ্রসাদ খুঁজতে বের হল। বাংলোর ভিতরে লছমন নেই। গাড়ির কাছে গিয়ে মুখ শুকিয়ে গেল তার। ফিরে এসে বলল, সাহেব, কাল গাড়ির চাকা খোলার চেষ্টা করেছিল কেউ!

খুলতে পেরেছিল?

না।

একটু আলগা করতে পেরেছিল।

লোকটা চেয়েছিল গাড়িটাকে অকেজো করে আমাদের বিপদে ফেলতে।

কী হয়েছে? বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন অমল সোম।

ব্যাপারটা জানাল অর্জুন।

এরকম কিছু ঘটতে পারে তা আমাদের ভাবা উচিত ছিল। লছমন চেয়েছিল যাতে গাড়ি নিয়ে আমরা ওকে খুঁজতে বেরোতে না পারি। ও নিশ্চয়ই গভীর রাত্রে জঙ্গলের পথ ধরবে না। গিয়েছে আলো ফুটতে। তোমরা খানিকটা যাও গাড়ি নিয়ে। যদি বেশিদূর যেতে না পারে ও, দ্যাখো। অমল সোম ভিতরে চলে গেলেন।

চাকা টাইট করে ভানুপ্ৰসাদ অর্জুনকে নিয়ে বের হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওরা গভীর জঙ্গলে মোড়া কাঁচা রাস্তা ধরে যাচ্ছিল। এখনও রোদ নরম, তাই জঙ্গলের ভিতরে ঘন ছায়া নেতিয়ে রয়েছে। কিছু দূর যাওয়ার পর ব্রেক চেপে গাড়ি থামাল ভানুপ্রসাদ। পাশের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা পায়েচলা পথ চলে গিয়েছে। সেটা দেখিয়ে ভানুপ্রসাদ বলল, কাল লছমন রাজাভাতখাওয়ায় যাওয়ার সময় বলেছিল, ওই পথ দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি রাজাভাতখাওয়ায় যাওয়া যায়।

অর্জুন সামনের দিকে তাকাল। রাস্তা এখানে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত সোজা। লছমনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি থেকে নামল অর্জুন, চলো, খানিকটা হেঁটে দেখে আসি।

গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে রেখে ভানুপ্রসাদ সঙ্গী হল। সরু পথ, দু’পাশের গাছগুলোর ডাল-পাতা তার অনেকটাই দখল করে রেখেছে। সেগুলো সরিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হলেও, ওরা চেষ্টা করছিল দ্রুত চলতে। মিনিটদশেক হাঁটার পর জঙ্গল যখন আরও বেশি গভীর, তখন পথ বাঁক নিল। সেখানে পৌঁছোতেই চিৎকার করে উঠল ভানুপ্রসাদ, সাব!

ওকে লক্ষ করে মুখ ফেরাতে দৃশ্যটা দেখতে পেল অর্জুন। মানুষটা মাটিতে পড়ে, আছে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে। একটু কাছে যেতে লছমনকে চিনতে অসুবিধে হল না। ওর বুক-পেট ফেটে চেপটে গিয়েছে মাটিতে। দুটো পা-ই মুচড়ে ছোট হয়ে গিয়েছে। রক্তে মাটি লাল হয়ে আছে এখনও। কোনও মানুষের পক্ষে এভাবে হত্যা করা সম্ভব নয়।

ভানুপ্রসাদ ফিসফিসিয়ে বলল, হাতি, হাতি ওকে মেরেছে। ওই দেখুন!

কিছুটা দূরে পড়ে থাকা হাতির বিষ্ঠা দেখাল ভানুপ্রসাদ।

সেলফোন বের করে অমল সোমকে ফোন করল অর্জুন, জঙ্গলের ভিতরে লছমনের ডেডবডি পড়ে আছে। মনে হচ্ছে হাতির সামনে পড়েছিল। একেবারে স্ম্যাশড। ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার। আপনি যদি বলেন আমরা এখান থেকে থানায় গিয়ে জানিয়ে আসতে পারি।

তার দরকার নেই। আমি ফোনে এস পি-কে বলছি। জায়গাটা ঠিক কোথায়?

আমি কয়েক মিনিট পরে গাড়ির রাস্তায় ফিরে গিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।

মনখারাপ হয়ে গেল অর্জুনের। এখানে আসার পরে লোকটার সঙ্গে তার ঠকাঠকি লাগছিল বটে, কিন্তু এভাবে মরে যাবে কল্পনা করেনি। লোকটা ক্রিমিনাল নয়, স্রেফ উগ্রপন্থীদের ভয়ে ওরকম আচরণ করছিল।

হাঁটতে হাঁটতে ভানুপ্রসাদ বলল, ও যদি গাড়ির রাস্তায় যেত তা হলে এভাবে মরতে হত না। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে শর্টকাট পথ ধরে মারা পড়ল বেচারা!

বড় রাস্তায় পৌঁছে জায়গাটার বর্ণনা অমল সোমকে সেলফোনে জানিয়ে দিল অর্জুন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *