Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জলপাইগুড়ি শহরের দুর্গোৎসব || Purabi Dutta

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জলপাইগুড়ি শহরের দুর্গোৎসব || Purabi Dutta

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জলপাইগুড়ি শহরের দুর্গোৎসব

১৯৫০/৬০ সালের উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর, জলপাইগুড়িতে দুর্গোৎসব কেমন ছিল, তা একটু আলোকপাত করতে চাই, সে তো এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। মননে, স্মরণে, নখদর্পনে তা এতই জাজ্জ্বল্যমান যে বলতে বা লিখতে একটুকুও ঠোক্কর খেতে হবে না।

তবে স্মৃতি চারণে জলপাইগুড়ির পটভূমিতে আরও কিছু বলে নিতে হবে যা না বললে ঠিক উৎসবের ছবি যথাযথ ফুটে উঠবে না। সমাজ , জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ সবই ত অন্যরকম ছিল, ভালো মন্দের নিরিখে প্রশ্ন নয়, অবশ্যই। তবে কেমন ছিল?
বিংশ শতাব্দীর মধ্যগগনে জলপাইগুড়ির শারদ উৎসব?

ধীরে লয়ে ক্ষয়ে , উপছে পড়া প্রাণপ্রাচুর্যে আর আধুনিক বিজ্ঞান ছোওয়া জগৎ থেকে বলা যায় বর্তমান থেকে তা ঠিক একশ আশি ডিগ্রী তফাত। খুব স্বাভাবিক।

আমি এখনকার দুর্গোৎসব দেখে ত চমৎকৃত, থিম, লেসার বিম,আলোক চঞ্চল ছবি, ধামাকা মিউজিক, রঙ্গীন স্বপ্নসাগর । কিন্ত এখনকার ছেলে মেয়েরা হয়ত “হ্যাজাক্” বা “ডায়নামো” শব্দগুলিই জানে না। স্বাভাবিক। থাক্ তবে এ শব্দ বন্ধন দুটিও ত মূল গল্প দুর্গাভাসান চিত্রপটে বিদ্যমান। তার আগে কিছু ভূমিকা ত বলে নিতেই হবে।

ফিরে যাই সেই সময়ে যুগপৎ স্বাধীনোত্তর ও রবীন্দ্রোত্তর যুগে।

জলপাইগুড়ি তখন উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর হলেও আয়তনে খুব বড়ো ছিল না।

পশ্চিম পাড়ের শেষ সীমানায় ছিল আমার বড়মাসীর বাড়ি ও আরও একটি বাড়ি– জীবন গতি রায়( His Master Voice, এর কর্ণধার)যার বাড়িতে অহরহ কলকাতা থেকে আসতেন– গায়ক গায়িকা, অপরেশ লাহিড়ী ও বাঁশরী লাহিড়ী, সঙ্গে ছোট্ট বাপী লাহিড়ী। আমার বড় মেসোমশাই (ডঃ অবনীধর গুহ নিয়োগী) এর নামে সে রাস্তার নাম এখন ” অবনী সরনি লেন”। বড়মাসীর বাড়ির পর ছিল হরিৎ মাঠ আর মাঠ , ধানী জমিতে ধান গাছ কখনো সবুজ কখনো সোনালী , ছিল জলাশয় আর পাটখেত। বিশ্বাস হবে কি মাসীর বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যেতো শুধু ধু ধু সবুজ মাঠ আর মাঠ, দৃষ্টি আটকে যেতো মেঘশূন্য উত্তর পশ্চিম আকাশের গায়ে– “কাঞ্চনজঙ্ঘা”— সকালে সোনালী চমক বিকেলে কমলা লাল আর একটু সন্ধ্যাকালোয় , নীচে লাইন দিয়ে পর পর বিজলী বাতির মেলা— “তিনধরিয়া”, পাহাড়ে প্রথম পা রাখবার সোপান। তো সুদুর মাঠের পর খড় ছাওয়া মাটির ঘর পুকুর গেরস্থালী– তারা “বাহে” সম্প্রদায়, আদিবাসী। চাষবাস তাদের জীবিকা আদিবাসীদের সাথে আদত করেই ত বাংলা,বিহার, উড়িষ্যা, সুদুর মারোয়ার থেকেও সভ্যঘন বসতি গড়েন জলপাইগুড়ির বাসিন্দাদের পুর্বপুরুষেরা। ঠিক যেভাবে আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ান দের সাথে শ্বেতাঙ্গরা ।

বাহেদের শুভনাম– “রাজবংশী”, পরে উত্তর বঙ্গের “কামতাপুরী” আন্দোলনেও তারা অংশগ্রহণ করেন।

তারা অত্যন্ত সরল সাদাসিধে জীবন চালাতেন ঘরে ও বাইরে, কোন সঙ্কোচ ছিল না। মঙ্গোলিয়ান চেহারা— পটলচেরা চোখ বা তিলফুল নাসিকার প্রশ্নই নেই। বেশিরভাগ হলদেটে ফর্সা। লোভনীয় ছিল তাদের ত্বক– পেলব গায়ের চামড়া আর ঝকঝকে হাসি। আর হ্যাঁ, এ মসৃণ পাতলা ত্বক বলেই হয়ত একটু বয়স্কদের মুখে পড়ত অসংখ্য বলি রেখার আলপনা যাকে বলে “crows feet”।

মনোরঞ্জনের ব্যবস্থার জন্য তাদেরও ছিল তাদের সংস্কৃতিতে নানা সামাজিক নাটক ও গান।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—
তো সেসব বলতে গেলে অনেক সময় নেবে। ও কথা থাক্।

আমার দাদু ও মামারা পেশায় উকিল ও যোদ্দার ছিলেন মানে কিছু খাস চাষজমিজমা ছিল আর সে সবের জন্য ছিল বাহে প্রজারা, মূলত ধান ও পাট উৎপাদন।

সে সুবাদে মা(দিদিমা ) গরুরগাড়ি করে জমি পরিদর্শনে মাঝে মাঝে যেতেন সাথে তার নয়নের মণি, আমি, এই পূরবী। সে অনেক কথা! কিন্ত এত কথা এখানে কেন। শিরোনামের সাথে কি কোন সম্পর্ক আছে? হ্যাঁ, আছে। আছে রাজবাড়ির পূজোসংবাদ। স্বাধীনতার পর আর পাঁচ রাজাদের মতোই তারাও সরকার অধীনস্থ, বলাই বাহুল্য। তখন আদিবাসী রাজবংশী রাজা ছিলেন প্রসন্ন দেব রায়কত। যার কন্যা প্রতিভার বিবাহ হয়েছিল পশ্চিম বাংলার পূর্বতন মূখ্য মন্ত্রী জ্যোতি বসুর অগ্রজ স্বদেশ বসুর সাথে। রাজা প্রসন্ন দেব রায়কতের নামেই পরে হয়েছিল মেয়েদের কলেজ– পি ডি কলেজ। রানী অশ্রুমতীর নামে হাসপাতাল।প্রসন্ন দেবের পিতা ফণীন্দ্রদেবের নামে আছে ছেলেদের হাই স্কুল জলপাইগুড়ি শহরে। “ফণীন্দ্রদেব স্কুল”। বলা বাহুল্য রাজারা সকলেই ছিলেন প্রজাবৎসল। আমার দিদিমার পিতা স্বর্গীয় ইন্দ্রকুমার চৌধুরী পেশায় মোক্তার ছিলেন এবং তৎকালীন রাজার প্রধান পরামর্শদাতা। রায়কত পাড়ায় ছিল তার বাড়ি,– আমার দিদিমার বাপের বাড়ি। শহরের অন্যান্য গণ্য মান্য ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে অসুয়াবোধ ছিল ও পরে রাজার এক ভোজসভায় ইন্দ্রকুমারের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এখন তা কিংবদন্তী। সে অন্য ইতিহাস, সে কথা এখানে নয়।

জলপাইগুড়ির শহরের বুক চিরে গিয়েছে চওড়া নয় অথচ অতি অতল গভীর কালো জলের করলা নদী।

করলা নদীকে মাঝখানে রেখেই দুপাশে শহর গড়ে উঠেছিল। এক পাড়ে কিছু স্কুল, থানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন পাওয়ার হাউজ, রেস কোর্স, কিংসাহেবের ঘাট, শ্মশান ঘাট। সিনেমা হল— ওপারে ছেলেদের জেলা স্কুল , টাউনক্লাব মাঠ , হাসপাতাল , দিন বাজার, রাজবাড়ি ইত্যাদি।

করলা নদী এপাড় ওপারে হতে ছিল শহরে তিনটি পুল, একটি আমাদের স্কুলের সামনে, যেখানে নদীতে দুর্গা ভাসান হতো—তা ঝোলনা মানে দোলনা পুল। লোকজন বেশি হলেই তা দুপাশে দুলে উঠত। হ্যাঁ। সে কথায় ত পরে আসছি ।

একটি লোহার পুল, আর একটি প্রধান– পাকাপোক্ত চওড়া বাঁধান পুল, যেখান দিয়ে যানবাহন চলত পথচারীদের সাথে। করলা নদী চওড়া বেশি (২০/৩০ ফুট) নয়। সহিষ্ণু স্রোতস্বিনী গভীরতা অনেক— কালো টলটলে পরিষ্কার জল । পাহাড় থেকে বয়ে এসে জলপাইগুড়ি শহরের মধ্যমণি হয়ে শহর পেড়িয়ে মিশেছে সে তিস্তা নদীর সাথে জলপাইগুড়ির জেলারই মন্ডলঘাটে। করলা তিস্তার উপনদী।

রায়কত পাড়ার প্রান্তে ছিল সিংহ দরজা নিয়ে বিশাল দোতলা রাজবাড়ি। সিংহ দরজায় ছিল আক্ষরিক অর্থেই দুপাশে দুটি সিংহ। গেট পাড়িয়ে বাঁ- পাশেই ছিল সার সার কয়েকটা হাতি, কেউ গেলেই কাছে , ওমনি শুঁর তুলে প্রণাম জানাত। কপালে আঁকা থাকত সাদা ও লাল রঙের আলপনা। পেছনের একটি পা বাঁধা থাকত মোটা লোহার চেন দিয়ে মাটিতে পোঁতা শক্তপোক্ত লোহার থামের সাথে। হাতিরা সেজন্য শুধুই এক পা এগোত আর এক পিছোতে পারত।সর্বদাই তাই করতো তারা। সামনে অদূরে ছিল ঘোড়াশাল। তার পেছনে দোতলা দালান। আমরা সেদিকে যেতাম না, আমরা ডানদিকে ঘুরে যেতাম নাটমন্দির ছাড়িয়ে পূজো মণ্ডপে।

কেন লিখছি এ পূজোর কথা,না দুটি কারণ এক — রাজবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মাটির প্রতিমা। মাঝখানে দুর্গা। খুব সম্ভব ছিল দু-হাত। দু পাশে দুই সখী জয়া ও বিজয়া। নেই সিংহ ও অসুর। লক্ষ্মী,সরস্বতী, কার্তিক গণেশ কেউ নেই। নেই শিব , নেই কলাবউ যথাযথ। আর সব টকটকে লাল রঙ, না অন্য কোন রঙ নেই, একটু স্থুল অবয়ব।

কেমন এক থমথমে ভাব।
চারদিক মাদকতাময় ছাতিম ফুলের সুবাস, শীতল হাওয়া, আকাশ কালোতে বাঁকা চাঁদ আর নক্ষত্র চুমকি।

অনেক আগে কোন পূর্বপুরুষ রাজা স্বপ্নে নাকি এমন মা দুর্গা দেখেছিলেন আর তাই চলে আসছে।

আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল নবমীর দিন রাজবাড়িতে ও ঢুকবার রাস্তা থেকেই বসত মেলা।

এখন বলি আদিবাসী বাহেদের প্রসঙ্গ কেন বলেছিলাম, কারণ দূর দূর থেকে শহরের বিশেষ পশ্চিম প্রান্ত থেকে তারা আসত রাজবাড়ির পূজো ও মেলা দেখতে। তারা “র ” উচ্চারণ করত না বলত “আজবাড়ি” অসম্ভব নিরলস ও কর্মঠ বাহে সম্প্রদায় –সবাই নগ্ন পায়ে হেটে আসত। মেয়ে বা বধূরা সাদা বা রঙিন চাদরে পিঠে বেঁধে আনতেন তাদের ছোট সন্তান শিশুদের। রানি রঙ গোলাপী বা তুঁতে রঙ তাদের ছিল পছন্দের রঙ, বেশিরভাগ মেয়েরা ঐ সব রঙের শাড়ি টাইট করে বুকে বেঁধে পড়ে আসত, কোন ব্লাউজ বা কাচুলী পড়ত না , থাকত হাতে কোন পোটলা ও ছিপছিপে এক লাঠি। পুরুষেরা সাদা ধূতী উচু করে পড়ত আর ঐ রঙিন সার্ট। সারাদিন তারা আসত রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। দূর থেকে দেখা যেতো তাদের পোষাকের উজ্জ্বল রঙ। ঠিক একই ভাবে তাদের দেখা যেতো রাজবাড়ির আর এক মেলাতেও— পদ্মাপূজার মেলা বসন্ত কালে।

রাজবাড়ির সামনে ছিল বিশাল সরোবর। একবার নাকি জল দুধ হয়ে গিয়েছিল, সেই থেকে নাম দুধপুকুর। সে অনেক গল্প।

একটু দূরে ছিল দেবী চৌধুরানীর ঘাট। নদী জলধারা সেখানে অতল তলে তিরতির —হারিয়ে গেছে গতিরেখা। জঙ্গল ঝোঁপঝাঁড়– ভবানী পাঠকের আস্তানা, সুরঙ্গ পথ, আধভাঙা বাসন্তী রঙা ইটের হদিশ এক রহস্য।

শহরের আর এক পাশে উত্তর পশ্চিম থেকে গড়িয়ে গেছে পুব দক্ষিণ দিকে তিস্তা নদী। বিচিত্র তার রূপ প্রতি ঋতুতে ঋতুতে। শীতকালে দুপাশে সোনালী বালির বন্ধুর স্তুপ রাশি রাশি। মাঝখানে তির তির করছে অগভীর এক ঘোলা জলের রেখা। বর্ষায় সে এক রাক্ষসী রূপ। কোথায় বালির স্তুপ— সে এক বিশাল চওড়া ভয়ঙ্কর উচ্ছৃঙ্খল এক নদী। আর বসন্তে সে এক মোহময়ী সবুজ পান্না রঙের আদল । বরষায় সে নিয়ে আসত পাহাড় উৎস থেকে অজস্র জলধারা , ভেঙে পড়ত সমতলে — “হরপা” বান। প্রতি বছর বাদলকালে জলপাইগুড়ি ভেসে যেতো ঘোলা জলের বন্যায়। তিস্তার ঘোলা জলের সাথে স্থানীয় সব পুকুর ভাসত। উঠোনে কলকল করে তোড়ে ঠান্ডা জল কখনো ঘোলা কখনও টলটলে পরিষ্কার। এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি তিন সিঁড়ি ডুবে যেতো । পুকুর ভাসা আশ্রয়হীন কচি মাছের ঝাঁক দল উঠোনে এসে থমকে যেতো——এদিক ওদিক দিশেহারা।

স্কুলে আমাদের গরমের ছুটি হতো না হতো বর্ষার ছুটি। প্রতি বর্ষায় আমাদের স্কুলের একতলা জলমগ্ন থাকত, যতদিন না তিস্তার বাঁধ দেওয়া হয়।

খুব সম্ভব ১৯৫৮ সালে তিস্তার বাঁধ প্রকল্পে মুস্কিল আসান হয়। আর ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে হয় বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা– সারা শহর ডুবে গিয়েছিল, ১২/১৪ফুট জলের তলে।

তিস্তা পাহাড় থেকে নেমে এসে দার্জিলিঙ সিকিম জলপাইগুড়ি হয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশে। মিলিত হয় ব্রহ্মপুত্র নদীতে। তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের উপনদী।

জলপাইগুড়িতে বেড়াবার জায়গা ছিল — কিং সাহেবের ঘাট, রেসকোর্স , তিস্তার চড় অবশ্যই শীতকালে। সে তিস্তার বালির চড় ত বিশাল ব্যাপ্তির। ছিল তেজিয়ান ঘোড়া— লাগাম ও চাবুক হাতে সহিস। ছিল মাথায় আলপনা নিয়ে হাতী,পিঠে হাওদা, মাহুতের মুচকি হাসি। হাতি ঘোড়ার পিঠে ত চড়তেই হবে। ছিল লাল সাটিনের ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবী পড়া অতি ফর্সা মেয়েলী যুবক , পায়ে ঘুঙুর ,নাচের গমক, হাতে সাদা কাগজের ঠোঙায়– ” দাদুর চানাচুর “, খেতেই হবে। ছিল বুড়ির চুল , গ্যাস বেলুন , সাপ বেলুন, কাগজ চড়কি যা নিয়ে দৌড়লে রঙিন চরকিও সা সা করে ঘুরত। কোন বিজলী বাতি ব্যবস্থা ত ছিল না, যতক্ষন দিনের আলো। একটু ঘোর হলেই সব শুনশান ফাঁকা।

জলপাইগুড়ি নাম নিয়েও অনেক কিম্বদন্তি নবম দশক শতাব্দীতে এ স্থানকে বলা হতো বরেন্দ্রভূমি একসময় প্রচুর জলপাই ফলের গাছ ছিল। তাই জলপাইগুড়ি। আবার জনশ্রুতি অনুযায়ী জল্পেশ্বর নামে এক হিন্দু রাজার দ্বারা একসময় এই অঞ্চল শাসিত হয়েছিল৷ সেই থেকেই জলপাইগুড়ি। জল্পেশ্বরই জলপাইগুড়ির বিখ্যাত শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যেটি বর্তমানে  উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত একটি পৌরাণিক মন্দির “জল্পেশ ধাম ” নামে খ্যাত। জল্পেশর হল ভগবান শিবের একটি রূপ। এই জল্পেশ্বর রাজার নাম থেকেই জল্পেশ্বর মন্দির এবং জলপাইগুড়ি নামের উৎপত্তি এমনটা অনুমান করা যেতেই পারে। শহর ছাড়িয়ে উত্তর মুখে জলপাইগুড়ি জেলায় — জল্পেশ্বর মন্দির। অনেকবার গিয়েছি। ২০১১ সালেও দর্শন করেছি। এখনও হাতি রাখা আছে। হাতির পিঠে চড়ার আমোদন বরাত। খুবই সাজানো গোছান রঙের বাহুল্য শুধু চরম অবহেলা সুস্থ শৌচাগার ব্যবস্থার , চরম দুর্গতিগ্রস্ত।

আসলে একটি দেশের উন্নতির মাপকাঠির ধারণা প্রথম বিশ্বে না গেলে ঠিক বোঝা যায় না। সেখানে এমন শৌচাগারের অঢেল সজাগ ব্যবস্থা গ্রাম শহর সর্বস্থলে। আর শৌচাগার কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা তাদের স্কুল থেকেই অর্থাত প্রায় শিশু অবস্থা থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যা আমরা একটুকু সতর্ক নই। সবসময় একটা অবচেতন ধারণা প্রতিমুহূর্তে জমাদার গিয়ে পরিচ্ছন্ন করে আসবে।

গৃহস্থালীতেও তাই, আমাদের মেয়েদের রাশিকৃত শাড়ি কিনতে যতটা মনোযোগী তার এক কণাও শৌচাগারের জন্য খরচ বা পরিচ্ছন্ন রাখতে নজর নেই। আর ঐ শৌচাগার ব্যবহারের দিকে কোন ট্রেনিং নেই। সবসময়ই নরকবস্থা আর তা নির্বিকারভাবে সবাই মেনে নেন। যাক্ এবারে বলি দুর্গা পূজার কথা। তখন আক্ষরিক অর্থেই ঠিক চারদিন উৎসব চলত। ষষ্ঠী পূজোর বোধন ব্যাপার যা ছিল তা এতো গুরুত্বপূর্ণ যে ঠিক শুধু উৎসব বললে কম বলা হবে।

পূজোর দিনগুলোতে ভোরবেলা উঠে প্রথম কাজ ছিল শিউলি ফুল কুড়োন আর তারপর স্নান সেরে মালা গাঁথা। সেজেগুজে মালা নিয়ে যেতাম পাড়ার পূজো মন্ডপে। শিয়াল পাড়ার মেয়ে ছিলাম, এমনই এক নাম পাড়ার ,কদমতলার এক অংশ। হয়ত অনেক শিয়াল কলোনি ছিল আগে। তবে তখনও প্রচুর শেয়াল ছিল। কুকুর মানুষদের ভয় পেতো, তাই রাতে বার হতো। সুযোগ পেলেই বাড়ির হাঁস, মুরগী চুরি করত। দিনের বেলাও সুযোগ পেলেই রান্না ঘরের দাওয়ায় মাঝে মাঝে উঠে আসত উদ্দেশ্য ঐ চুরি। যদি ডিম মাছ কিছু পাওয়া যায়। আমরা হেই বললেই ছুটে পালাত । খুব সতর্ক, চোয়াল চওড়া মুখ, ঝাকড়া লেজ। দেখতে সুন্দর। অত্যন্ত লোভী ও খাটি চোর ।অনেকসময় মানুষের বাচ্চা মুখে নিয়েও চম্পট দিতো। না শিয়াল না নেকড়ে আর এক ধরনের জন্তুও ছিল তাদের নাম “বাঘডাসা”। স্বভাব শেয়ালের মতোই কিন্তু দুঃসাহসী।

মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঝোঁপের ঝাঁড়ে শিয়ালরা ডেকে উঠত –উঃ হাঃ হাঃ হা করে। প্রথম একজন তারপর আর একজন , দুজন শেষে সকলে সমস্বরে ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া চীৎকার। আমার কিন্ত বেশ ভালো লাগত। তিস্তার চড়ে মাঝে মাঝে শীতকালে বাঘ আসত, তখন শিয়ালরা নিজেদেরকে সাবধান করত এক বিশেষ ডাকে শোনাত “ফেউউ…” সবাই বলত বাঘ এসেছে তিস্তার চড়ে। তাই ফেউ ডাকছে।

যাহোক পূজোর কথায় ফিরে আসি। সকালে মালা দিয়ে আমরা চুপ করে পূজো দেখতাম।– যেন এক বিশাল পরিবার ছোটরা ত বটেই উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা আসলে সকলেই বয়স্কদের মান্যতা দিতো । গোটা পাড়ার যেন এক বাড়ি। অঞ্জলি প্রসাদ ,দুপুরে ভোগ সব একসাথে সন্ধ্যায় সেজেগুজে আরতি সব চলত আনন্দের সাথে। একটু যখন বড়ো হয়ে উঠলাম দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতো সব ছেলেমেয়েদের মধ্যেই একটা রোমান্টিক সুরের সূচনা গড়ে উঠত।

প্রসঙ্গত বলি। লেখক দেবেশ রায় জলপাইগুড়ির এ সি কলেজে পড়তেন , পাড়ার অমূল্য মিত্র ছিলেন এ সি কলেজের প্রফেসর,তার বাড়িতে খুব আসা যাওয়া ছিল। অমূল্য মিত্র আমার বাবার বন্ধুও ছিলেন কলকাতায় পড়ার সুবাদে এক মেসে থাকা কালীন, ছিলেন আমার বড়মামাও, আইন পড়তেন, আরও অনেকে।। আমার পিতা বড়োমামার বন্ধু সুবাদে আমার মায়ের সাথে বিবাহ হয়েছিল। সে অন্য গল্প। অমূল্য মিত্রের মেয়ে ফুল্টু ওড়ফে কাকলী আমার চেয়ে দু বছরের ছোট, স্কুলে পড়ত। অনেক বয়সের তফাত দেবেশ রায় ও ফুল্টুর । সম্পর্ক প্রথমে বুঝি নি। অনেক পরে জেনেছি।

পূজোর দিন গুলো ত হৈচৈ করে কেটে যেতো সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল দশমীর দিন। সেই দিনটির কথা ভুলবার নয়, ছিল এক স্বর্গীয় আনন্দ বোধ। ছোট বড় সবাই অপেক্ষায় থাকত। দশমীর দিনের জন্য। দশমীর দিন সন্ধ্যা থেকে সব বাড়ির খুব বয়স্ক ব্যতীত সকলেই সেই কালো জলের করলা নদীর তীরে।

দশমীতে উঠোনে এক আলপনা দিতেন মা চালবাটা জলে গুলে, মাঝখানে এক জলভরা ঘট সিঁদুর ছোওয়া আমের পল্লব সহ আর একটা ধামা দিয়ে ঢাকা থাকত, সব বাড়িতেই তেমন। পাড়ার সব বাড়িগুলিই খুব বড়ো ছিল। ছিল গরু ছাগল হাঁস পুকুর ইত্যাদি। সব লাল বা সবুজ বা না রঙ করা টিনের চালের ঘর সব।

— করলা নদীর ঘাটে , যেখানে আমাদের স্কুল। ছিল এক ঝোলনা পুল লোহার দড়ি দিয়ে পাড়ে বাঁধা। সেখান থেকেই নদীতে ভাসান শুরু হতো। শহরের সব প্রতিমা তখন সে নদীতে– বড়ো বড়ো ফেস্টুনে লেখা থাকত, উকিল পাড়া, কেরানী পাড়া , পান্ডা পাড়া, শিল্প সমিতি পাড়া, স্টেশন পাড়া, বাবু পাড়া, কদমতলা, শিয়াল পাড়া সব সব সেখানে। একাধিক নৌকো জুড়ে, প্রতিমা, ডায়নামো, হ্যাজাক, ধূপধুনো, ঢাকঢোল বাজনা, মাইকে গান। নাচ আরতি গানের জলসা কি না হচ্ছে।

কালো গভীর জলে দশমীর চাঁদ রোশনাই। সব শব্দ মিলিয়ে এক ডুম ডুম আওয়াজ ফুল ধূপ পরিমল গন্ধ, একটু হেমন্ত ছোওয়া শীতহাওয়া এক আবেশ অনুভূতি। মাঝিদের লম্বা লম্বা লগি বা বাঁশ দিয়ে ঠেলে নৌকা চালানো। একবার এদিক যাচ্ছে আবার ওদিক — চলাচল। নৌকায় নৌকায় প্রতিযোগিতা। হাসি গল্প ফুল ছুড়ে দেওয়া পাড়ের দর্শকদের। কেউ পাড় থেকে উঠছেন কেউ পাড়ে নাবছেন। আমার প্রথম নৌকো চড়ার অভিজ্ঞতাও ছিল এক চমকপ্রদ। কদমতলার নৌকো পাড় ঘেঁষে এলে ছোট্ট আমিকে পাড়ার দাদারা নৌকায় তুলে নিল অবশ্যই আমার ছোটমামার অনুমতিতে। আমি ত ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসেছি। একটু পর দেখি পাড়ের লোকজন সব সরে সরে যাচ্ছে আসলে relative velocity র প্রথম অভিজ্ঞতা। নৌকোতে ত চাকা থাকে না জল আর স্থলের ত আসমান জমিন ফারাক। ভাসমান যানের এক চমক অনুভব।

কালো আকাশে সোনালী আধখানা চাঁদ নীচে ডায়নামোর ঘুট ঘুট শব্দের আলো, ঘুঙুর শব্দ নাচের, বাজি ফটকার শব্দ, আলোর ফুলঝুরি , গানের মন মাতানো স্বর— এক ঠাকুর আসছে নৌকোতে আর এক যাচ্ছে সবার মুখে হাসি আর চীৎকার– দুর্গা মাইকি জয়। বিসর্জন আর হয় না। কেন হবে, এ আনন্দ যতক্ষণ ধরে রাখা যায়। রাত এগারোটার পর প্রতিমা নিরঞ্জন হতো। আর ঝুপ করে কি মনখারাপ। সারাগায়ে জল ছেটানো—

তখন কিন্ত মনে পড়ে না পূজোতে কোনদিন বৃষ্টি হতো। আকাশে কাশবনে ফুলে ফলে মলয় বাতাসে সত্যিই শরৎকাল।

নদীর পাঁড়ে প্রথম মেয়েদের ও বাচ্চাদের দাঁড়াবার ব্যবস্থা ও পেছনে ছেলেদের বাঁশ দিয়ে তৈরি ব্যবস্থা।

নদীর পাড় থেকে একটু উঁচুতে রাস্তায় বসে মেলা , সেখানে রঙচঙ মোমের পুতুল , সোলার পাখি, নানান ভেঁপু বাঁশী। নানা টক ঝাল মিষ্টির মুখরোচক খাবার। ঘর সাজানোর সামগ্রী, তালপাতার সেপাই থেকে হাতপাখা। ঘর গেরস্থালীর জিনিস পত্র, ছুড়ি কাচি থেকে তৈজসপত্র, মাটির পুতুল থেকে হাড়ি কলসি। তামার সৌখীন বস্তু ও পূজার বাসন। কত আর বলব….
ভারাক্রান্ত মন আর হাতে লাল মোমের পুতুল সবুজ সোলার পাখী। মুখে ভেঁপু বেশী নিয়ে ফিরে আসতাম। শূন্য মন্ডপে বিশাল পিলসুজে একা প্রদীপ জ্বলছে, বুকে এক মোচড়— আবার এক বছর পর।

বাড়িতে এলে মা আলপনার ধামা খুলে দিতেন। আমরা প্রথম সেখানে প্রণাম করতাম। তারপর মাকে ও সকল গুরুজনদের প্রণাম, মা আশীর্বাদ করতেন সব সময় ধান দুর্বা দিয়ে — এক পেতলের থানায় সাজানোর থাকত ধান দুর্বা সিঁদুর ,প্রদীপ, চন্দন ফুল আর মিষ্টি মুখ করার জন্য বাতাসা ও সন্দেশ যা অল্প ভেঙ্গে মুখে দেওয়া।

তারপর সে রাত থেকে পরদিন চলত বিজয়ার মিলন উৎসব , যত চেনা পরিচিত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব। চলত নারকেল নাড়ু, তক্তি। তিলের নাড়ু। নিমকী, গজা, আরো কত কি। পরের দিন গুলো লাগাতার বিজয়া চলতেই থাকত। একটা হিসেব ছিল লক্ষ্মী পুজো অবধি অর্থাত, দেবীপক্ষকাল পর্যন্ত। কিন্তু অনেকে সুবিধার্থে কালীপূজা অবধি শিথিলতা টানতেন।

তারপর সত্তুর দশক থেকে সে সব বন্ধ হয়ে যায়। নৌকা ও মাঝির অভাব মনোরঞ্জনের অন্য আকর্ষণ, নদীর নাব্যতা সংশয় আরও অনেক কারণ। শুরু হয় লড়ি করে কলকাতার মতন, দুর্গাভাসান । পরিবর্তন ত মেনে নিতেই হয়। ২০২০ লক ডাউনের আগে শেষবার জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম। অত্যন্ত মর্মাহত লোকসংখ্যা ত বেড়েছে স্বাভাবিক। অজস্র টোটো চলছে সর্বত্র,চলমান জনগণের সাথে, বিশৃঙ্খল অবস্থা সেটাই বড়োকথা। ধূলোবালির আধিক্য। করলার দুরন্ত বেগের কালোজল উধাও,স্রোতহীন ফ্যাকাসে সবুজ। চিন্তিত সরকারী বেসরকারী সংস্থা নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য। পুকুর নিয়ে টিনের চালের বাড়িগুলোও নেই, দালানবাড়ি , ফ্ল্যাটের সারি বিগবাজার ইত্যাদির সমারোহ। যাক্।

না পরিবর্তন ত হবেই। সে পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। এ প্রগতির পরিবর্তন, শিক্ষা, অর্থ, জীবনযাত্রা , লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অ-স্থিরতা, বিষয় ও লোকচরিত মূল্যবোধ, সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক নব নব সাজ সরঞ্জাম ইত্যাদি — অনেক অনেক পরিবর্তন।

সময় এগিয়ে যায়। আজ যা নতুন কাল তা পুরনো। এগিয়ে যাচ্ছে দিনবদলের পর পর যাত্রাপালা। শুধু মনোজগতে চিত্রিত হতে থাকে সময়ের থমকে থাকার দৃশ্যপট। জাগতিক নিয়মে সে দৃশ্য পট ছবি মুছে যাবে একদিন, দলিল রইবে এ এক লেখনীতে, হয়ত আরও কিছুদিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *