Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাগলা সাহেবের কবর || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

পাগলা সাহেবের কবর || Shirshendu Mukhopadhyay

রাত্রিবেলা একা ঘরে শুতে

রাত্রিবেলা একা ঘরে শুতে একটু ভয় ভয় করছিল হরির। জীবনে সে কখনও একা ঘরে শোয়নি, একখানা গোটা বাড়িতে একা শোওয়া তো দুরস্থান। তার ওপর সাহেবপাড়ার মতো নির্জন জায়গায়।

কিন্তু উপায়ই বা কী? হ্যারিকেনের সলতে কমিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে সে নিঃসাড়ে শুয়ে নিজের বুকের ঢিবঢিবিনি শুনল কিছুক্ষণ। ইঁদুরের শব্দ, বাতাসের শব্দ, শেয়াল বা বেড়ালের ডাক, সবই তার চেনা। ঝিঁঝির ডাকও সে কতই শুনেছে। তবু এই অচেনা নির্জন জায়গায় সব কটা শব্দই তার ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছিল। ঘুম আসছিল না।

তবে পেটে ছাতু ও ভাতের যে দুটি পাহাড় ঢুকেছে, তার প্রভাবে এবং লেপের ওমের ভিতরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরেই নিজের অজান্তে তার ঘুম এসে গেল।

ঘুমটা ভাঙল মাঝরাতে। কী একটা অনির্দেশ্য অস্বস্তি, মনের মধ্যে একটা সুড়সুড়ি, একটা রহস্যময় কিছু ঘুমের মধ্যেও টের পেয়ে আচমকা সে চোখ মেলল। মেলেই সে পট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শিয়রের জানালার দিকে।

জানালার বাইরে ফিকে অন্ধকার, একটা ঝুপসি গাছ। বন্ধ কাঁচের শার্সির গায়ে একটা ছায়া কি? অনেকটা মানুষের আকৃতির মতো? চোখটা দুহাতে রগড়ে নিয়ে আবার চাইল হরি। কোনও ভুল নেই। একটা লোক শার্সির ওপাশ থেকে চেয়ে আছে ঘরের মধ্যে।

হরি কিছু না ভেবে-চিন্তেই বালিশের পাশ থেকে টর্চ আর পাশে শোয়ানো লাঠিটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে “কে, কে, কে ওখানে” বলে বিকট চেঁচিয়ে উঠল।

ছায়াটা টক করে সরে গেল।

হরি দৌড়ে গিয়ে জানালা খুলে চেঁচিয়ে উঠল, “ও জগুরাম? জগুরা-আ-ম।”

দারোয়ানের ঘর তার ঘর থেকে দেখা যায়। জগুরামের ঘরে একটা টেমি উশকে উঠল। দরজা খোলার শব্দ হল। জগুরাম বেরিয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কাছে এসে বলল, “ক্যা হুয়া?”

উত্তেজিতভাবে হরি বলে উঠল, “আমার জানালায় একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল।”

জগুরাম খুবই উদাস মুখে বলল, “তো ক্যা হুয়া? চোর-ডাকু কোই হোগা। শো যাও।”

লোকটার এরকম উদাসীনতা দেখে হরি ভারী রেগে গেল। বলল, “চোর এসেছিল শুনেও তুমি গা করছ না?”

এর জবাবে জগুরাম যা বলল, তার তুলনা নেই। সে হিন্দিতে বলল, “দুনিয়াটাই চোরচোট্টায় ভরে গেছে। তারা আর যাবেই বা কোথায়? আর রাতে ছাড়া তাদের কাজের সুবিধেও হয় না কিনা! এখানে চোর-ডাকাত মেলাই আছে। ওসব নিয়ে ভাবলে মোতিগঞ্জে থাকাই যেত না।”

জগুরাম চলে যাওয়ার পর হরি আর ঘুমোতে পারল না। ঘড়িতে দেখল রাত সাড়ে তিনটে। হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ভাবল, এখানে যদি থাকতেই হয় তা হলে ভয়ডর ঝেড়ে ফেলতে হবে। চোর-ডাকাত যে-ই এসে থাকুক, সে ভয় পেয়েছে জানলে ফের আসবে।

হরি টর্চ আর লাঠি নিয়ে উঠল। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। টর্চ জ্বেলে জানালার নীচের মাটি প্রথমে পরীক্ষা করল হরি।

পায়ের ছাপ ভাল বোঝা গেল না বটে, তবে কয়েকটা পাতাবাহারের গাছ ভেঙে থেতলে গেছে।

ছায়ামূর্তিটা ডান দিকে সরে গিয়েছিল। সুতরাং হরি টর্চ নিবিয়ে সেদিকেই সন্তর্পণে এগোল। শেষ রাতে ফিকে একটু জ্যোৎস্না দেখা দিয়েছে। কুয়াশায় মাখা সেই জ্যোৎস্নায় চারদিকটা ভারী ভুতুড়ে আর অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এ যেন মানুষের রাজ্য নয়, কোনও রূপকথার জগৎ।

বাগানের এপাশটায় অনেক ঝুপসি গাছপালা। তার ছায়ায় গাঢ় অন্ধকারে মৃদু জ্যোৎস্নার ইকড়ি-মিকড়ি। হরি চারদিকে চেয়ে পরিস্থিতিটা বুঝবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল বাগানের পাঁচিলটা এক জায়গায় ভাঙা। আর সেই ভাঙা জায়গাটায় একটা লোক যেন গুঁড়ি মেরে বসে আছে।

হরি গাছের ছায়ায় ছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে এগোতে লাগল। তার যে ভয় না করছিল এমন নয়। কিন্তু আজ রাতে সে ভয় নিকেশ করতে বদ্ধপরিকর। মোতিগঞ্জে টিকে থাকতে গেলে বুকের পাটা চাই।

লোকটাও অদ্ভুত। ভাঙা পাঁচিলটায় উঠে স্থির হয়ে বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে সামনের দিকে কিছু দেখছে বোধহয়! হরির দিকে তার পিঠ।

লোকটার কাছে গিয়ে হরি হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে চাপা গলায় বলল, “একটু নড়েছ কি মাথা ফাটিয়ে দেব। চুপচাপ সুড়সুড় করে ভাল ছেলের মতো নেমে এসো।”

লোকটা খুব আস্তে ঘাড় ঘোরাল। তাকে খুবই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে মুখে আঙুল তুলে ফিসফিস করে বলল, “চুপ। শব্দ করলেই বিপদ।”

হরি লাঠিটা উঁচিয়ে বলল, “আবার চোখ রাঙানো হচ্ছে? একটু আগেই

তুমি আমার জানালায় উঁকি মেরেছিলে? চোর কোথাকার।”

লোকটাও খ্যাঁক করে উঠল, “হুঁ, জানালায় উঁকি মারলেই বুঝি চোর হয়ে যায় লোকে! বেশ কথা তো! উঁকি দিয়েছি তো কী হয়েছে, কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়েছে তাতে?”

হরি অবাক হয়ে বলল, “তাই বলে মাঝরাত্তিরে উঁকি দেবে?”

“ওঃ, খুব পাপ হয়েছে বুঝি? পাড়ায় নতুন কে লোক এল তাই দেখতে একটু উঁকি দিয়েছি, আর অমনি বাবা কী চিল-চ্যাঁচানি! যেন ওঁর সর্বস্ব নিয়ে ভেঙ্গে পড়েছি। নেওয়ার তোমার আছেটাই বা কী হে ছোঁকরা? একটা টিনের তোরঙ্গ আর গুচ্ছের বইখাতা। ছ্যাঃ, ওসব ছোঁবে কোন্ চোরে?”

“তা হলে তুমি চোর নও?”

লোকটা এবার একটু নরম গলায় বলল, “চোর হতে যাব কোন্ দুঃখে? আমার প্যালারাম রেলে চাকরি পেয়ে গেছে না? এখন আর কে চুরি করে? বুড়ো বয়সে ওসব কি আর পোয়? তবে যদি সত্যিই চুরি করার মতলব থাকত, তবে কি আর তোমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙত হে ছোঁকরা? এই পটল দাসের এলেম তো জানো না, তোমার তলা থেকে বালিশ বিছানা অবধি সরিয়ে ফেলতুম, তুমি টেরটিও পেতে না।”

বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার বয়স্ক লোকটিকে এবার একটু ভাল করে দেখল হরি। মুখে কাঁচাপাকা একটু দাড়ি আর গোঁফ আছে। মাথায় একটা পুরনো উলের টুপি। গায়ে একখানা খাকি রঙের ছেঁড়া সোয়েটার। পরনে ধুতি। পায়ে কেস আর মোজা। চোখে ধূর্ত দৃষ্টি। হরি টর্চটা নিবিয়ে ফেলে বলল, “তা হলে তুমি চোর ছিলে?”

“ছিলুম তো ছিলুম। অত খতেন কিসের? চোর হলেও আজকালকার ছোঁকরা-চোরদের মতো গবেটচন্দ্র ছিলুম না। চরণ, ছিদাম, দুখে, এদের জিজ্ঞেস করে দেখো, পটল দাসের নাম শুনলেই জোড়হাত করে কপালে ঠেকাবে। চোর কথাটা শুনতে খারাপ, কিন্তু এলেম দেখালে সব কাজেই ইজ্জত আছে। তবে এই হালের ছোঁড়ারা মানতে চায় না। তা না মানুক।”

হরি লাঠিটা নামাল, লোকটাকে ভয়ের কিছু নেই। তবু মুখে বলল, “জগুরামকে ডাকলে এক্ষুনি তোমাকে ধরে পুলিশে দেবে।”

“কোন্ আইনে? চুরি করতে গিয়ে তো ধরা পড়িনি হে। তার ওপর পুলিশ কি হাতের মোয়া যে ডাকলেই পাবে? এখান থেকে থানা মাইলটাক দূরে। দারোগাবাবু কনেস্টবলবাবারা এ-সময়ে ঘুমোন, ডাকলে ভারী রেগে যান।”

হরি হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তা তুমি ওই ভাঙা পাঁচিলে উঠে কী করছ? নেমে এসো। আজ তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।”

“ছাড়তে হবে না। আমি তো ধরাও পড়িনি এখনও। ছাড়বার তুমি কে। হে? ভাবছিলাম ভদ্রবাবুদের বাড়িটা এই ফাঁকে একটু দেখে যাব। দিনে কালে এবাড়ি থেকে কত কী সরিয়েছি। কিন্তু ঢুকতে ঠিক সাহস হচ্ছে না। কী যেন একটা দেখলাম। ভাল করে দেখার জন্য ঘাপটি মেরে বসে আছি তখন থেকে।”

“কী দেখেছ?”

“কী দেখেছি সেইটেই তো ঠিক বুঝতে পারছি না। সেই আগের চোখও নেই। বাঁ চোখটায় ছানি এসেছে। প্যালারাম অবশ্য বলেছে শহরে নিয়ে গিয়ে চোখ কাটিয়ে আনবে। তখন সব আবার আগের মতো দেখতে পাব।”

হরি ধৈর্য হারিয়ে বলল, “কিন্তু কী দেখলে সেটা বলবে তো?”

“দেখলুম যেন ওই গোলাপ-ঝোঁপটার কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। মতলব নিশ্চয়ই ভাল ছিল না। দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল বাড়িটার দিকে চেয়ে। এমন সময় আর-একটা লোক যেন মাটি খুঁড়ে লোকটার পিছন দিকে উদয় হল। তারপর প্রথম লোকটার মাথায় একটা ইট তুলে দড়াম করে বসিয়ে দিল। লোকটা একটাও শব্দ করতে পারেনি। কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল। তখন দ্বিতীয় লোকটা তার পা ধরে হেঁচড়ে নিয়ে গোলাপ-ঝোপে লাশটা ঢুকিয়ে দিয়ে কোথায় হাওয়া হল। বুড়ো বয়সে এখন ঠিক আর এগিয়ে যেতে সাহস পেলুম না। খুন যদি হয়ে থাকে তবে সাক্ষী থাকাটাও বিপদের কথা।”

হরি উত্তেজিত হয়ে বলল, “ও বাড়িতে কে থাকে?”

“কেউ না। বুড়ো অবিনাশ ভদ্র ছিল। তা সেও গতবারে মরে গেল। ওয়ারিশও কেউ নেই। বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে।”

“দরোয়ান?”

“নাঃ। দরোয়ানের মাইনে দেবে কে? বললুম না ওয়ারিশই নেই।”

হরি বলল, “কিন্তু আমাদের তো ব্যাপারটা দেখা উচিত।”

পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “ওরে না রে বাবা, না। হুট করে কিছু করে বসতে নেই। তার ওপর আমার ছানিপড়া চোখে কী দেখতে কী দেখেছি তারই ঠিক কী? এই তো সেদিন দেখলুম পুকুরের ধারে দিব্যি এক রামধনু উঠেছে। নাতিকে ডেকে দেখাতে গেলুম, তা সে বলল, রামধনুটনু কিছুই নাকি নেই। আমি ভুল দেখেছি।”

“ভুল দেখেছ কি না সেটাও তো দেখা দরকার।”

পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “ন্যায্য কথা। কিন্তু ভয়টাও সেখানেই। যদি ভুল না দেখে থাকি, তবে লাশের কাছে যাওয়াটা উচিত নয়।”

“কিন্তু লোকটা তো না-ও মরে গিয়ে থাকতে পারে।”

“তা বটে।”

“এখনও তুলে নিয়ে মুখে জলটল দিলে বেঁচে যাবে হয়তো। কিন্তু সারা রাত হিমের মধ্যে পড়ে থাকলে মরেই যাবে।”

“সেও ঠিক কথা। কিন্তু আমার কেমন যেন সাহস হচ্ছে না।”

হরি এবার একটু গরম হয়ে বলল, “যখন চুরি করে বেড়াও, তখন ভয় করে না? এখন ভয় করলে চলবে কেন?”

পটল দাস এবার চোখ পাকিয়ে বলল, “চুরি মানে কেবল চুরিই? সেটা কি আর্ট নয়? আর আমাকে ছিচকে চোর পেয়েছ? পটল দাস কখনও ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না, মনে রেখো।”

“আমি কালই রটিয়ে দেব যে, তুমি চুরি করতে এসে আমার কাছে ধরা পড়ে গেছ।”

একথায় পটলের চোখ কপালে উঠল। বলল, “ও বাবা, তুমি যে বেশ পাজি তোক দেখছি। পটল দাস এখনও ধরা পড়েনি জীবনে, তা জানো? কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।”

“খুব করবে। এক্ষুনি তোমাকে জাপটে ধরে ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচালে জগুরাম আর তার বউ দৌড়ে আসবে। তারপর ঘরে পুরে তালা দিয়ে রাখব। সকালে সবাই এসে দেখবে।”

একথায় পটল দাস খকখক করে হায়েনার হাসি হাসল। তারপর বলল, “জাপটে ধরবে? বটে! তা ধরার চেষ্টা করে দ্যাখো তো কী হয়।”

“কেন, মারবে নাকি? আমার গায়ে মেলা জোর তা জানো? পড়াশুনোয় তেমন ভাল না হতে পারি, কিন্তু গায়ের জোরে কম নই।”

“থাক, অত বড়াই করতে হবে না। তোমার চেয়ে ঢের-ঢের জোয়ান পালোয়ান দেখেছি। পটল দাসের বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্যে তো মরেনি। এখনও অনেক ভোজবাজি দেখাতে পারি। দেখি না কেমন জাপটে ধরে রাখতে পারো। এসো দিকি পালোয়ানচন্দর।”

হরি এই ছোটখাটো বুড়োসুড়ো লোকটার কথা শুনে না-হেসে পারল না। একে ধরা নাকি আবার একটা ব্যাপার? সে চোখের পলকে দু হাতে জাপটে ধরল পটল দাসকে।

ধরল বটে, কিন্তু ভারী অবাক হয়ে দেখল, পটল দাসের বদলে সে ধরেছে খানিক হাওয়া বাতাসকেই। পটল তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ফিকফিক করে হাসছে। হরি ব্যাঙের মতো একখানা লাফ দিয়ে গিয়ে একেবারে ঘাড়ের ওপর পড়ল পটলের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পটলও হুবহু ওরকমই একখানা লাফ মারল সঙ্গে-সঙ্গে, এবং ভোজবাজির মতো চার হাত তফাত হয়ে গেল দু’জনের মধ্যে।

হরি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “তুমি ভূত নও তো?”

পটল দাস ফিক করে হেসে বলল, “তা ভূতও বলতে পারো। ভূত মানে অতীত। আমার কি আর সেই দিনকাল আছে? বেঁচে থেকেও মরা। তা হলে বুঝলে তো আমাকে ধরা অত সহজ নয়?”

হরি বোকার মতো মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। যদি সত্যিই ভূত না হয়ে থাকো, তবে বলতেই হয়, তুমি বেশ ওস্তাদ লোক।”

পটল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এ আর কী দেখছ? আরও কত কী শিখেছিলাম। হস্তলাঘব, মুখবন্ধন, বায়ু-নিয়ন্ত্রণ, কুম্ভক। কোথাও কাজে লাগল না। প্যালারামকে শেখানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওর মায়ের জন্যই হল না। সে বলল, না, ছেলে তোমার মতো চোর হবে না।”

“আমাকে শেখাবে?”

“তুমি? তুমি শিখে কী করবে?”

“চুরি করব না। তবে শিখে রাখব।”

“শেখাতে পারি, তবে শর্ত আছে।”

“কী শর্ত?”

পটল বেশ লজ্জার সঙ্গে ঘাড় চুলকে বলল, “লেখাপড়া শিখিনি বলে আমাকে বড় হেনস্থা করে লোকে। ছেলেবউও বড্ড গঞ্জনা দেয়। তা আমার বড় ইচ্ছে, লেখাপড়া শিখে ওদের জব্দ করি। শেখাবে?”

“শেখাব।”

কথাবার্তায় হঠাৎ বাধা পড়ল। ভদ্রবাবুদের বাগান থেকে হঠাৎ একটা ক্ষীণ আর্তনাদের শব্দ এল।

দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে শুনল। তারপর পটল বলল, “পালাও, ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো গে। আমিও এই বেলা সরে পড়ি।”

“কিন্তু পটলদা, ব্যাপারটা না দেখে পালানোটা কি ঠিক হবে?”

“ওঃ, তুমি জ্বালালে দেখছি। আচ্ছা, চলো। বেগতিক দেখলে আমি কিন্তু সরে পড়ব।”

দেওয়ালটা দু’জনে ডিঙোল। আগে পটল, পিছনে হরি।

পটল সাবধান করে দিয়ে বলল, “খবরদার, টর্চ জ্বেলোনা। টর্চ খুব খারাপ জিনিস। আমার পিছু-পিছু এসো। চোখে ছানি হলে কী হয়, অন্ধকারেও সব ঠাহর করতে পারি।”

ঘাসজমি ডিঙিয়ে ঝোঁপটার কাছে পৌঁছে পটল বলল, “এইখানে।”

বেশি খুঁজতে হল না। গোলাপ-ঝোঁপের ভিতর থেকে দু’খানি পা বেরিয়েই ছিল। পটল আর হরি টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনল লোকটাকে। জ্যোৎস্নার ফিকে আলোতেও হরি মুখোনা চিনতে পেরে আর্তনাদ করে উঠল, “সর্বনাশ।”

পটল পট করে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, “আস্তে। চেঁচালে বিপদে পড়বে। তা লোকটা কে?”

“ও হল গোপাল। আমরা এক ক্লাসে পড়ি।”

পটল ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এত অল্প আলোয় ঠিক চিনতে পারছি না। কোন্ গোপাল বলো তো। সেই ঝিকু সর্দারের ছেলেটা নাকি?”

“আমি ঝিকু সর্দারকে চিনি না। তবে গোপালকে সবাই ভয় পায়।”

পটলের ভু সটান হয়ে গেল, “তা হলে ঠিকই ধরেছি। ঝিকুরই ছেলে। তা বেঁচে আছে নাকি?”

গোপাল বেঁচেই ছিল। তবে জ্ঞান নেই। মাথার পিছন দিকটা থেঁতলে গিয়ে রক্তে একেবারে ভাসাভাসি কাণ্ড। মাঝে বোধহয় জ্ঞান একটু ফিরেছিল। তখনই ককিয়ে উঠেছিল যন্ত্রণায়।

হরি সভয়ে বলল, “এখন কী হবে পটলদা?”

পটল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঝিকুর ছেলের গায়ে হাত তোলা

যার-তার কর্ম নয়। একটু আগেই বলছিলে না, সবাই ওকে ভয় পায়। তা ভয় ওকে সাধে পায় না। তবে ওকে নয়, ভয় ওর বাপকে। এখন এই কাণ্ডের পর ঝিকু ক’টা লাশ নামায়, দ্যাখো। দশ বছর আগে হলে ঝিকুর হাতে বিশ-পঞ্চাশটা খুন হয়ে যেত। এখন অত হবে না। কিন্তু কত হবে তা এখনই বলতে পারছি না। আমি বলি কি, এইবেলা পালাও।”

“কিন্তু এ যে আমার বন্ধু।”

“তা বটে, কিন্তু ঝিকু…”। “তখন থেকে কেবল ঝিকু-ঝিকু করছ কেন? ঝিকুটা কে?”

“এ-তল্লাটে যখন এসে পড়েছ তখন চিনবেই একদিন। আমি পাপমুখে সব বলি কেন? বন্ধুকে যদি ফেলে যেতে না চাও, তবে চলো ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে তোমার ঘরেই তুলি।”

তাই হল। দু’জনে ধরাধরি করে গোপালকে নিয়ে ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে হরির ঘরে এনে তুলল।

হরি বলল, “কিন্তু রক্তে যে ভেসে যাচ্ছে। একজন ডাক্তার ডাকলে হয়? এত হেমারেজ হলে তো মরে যাবে। রক্তটা এখনও ক্লট বাঁধেনি। হেমাটোমো…”

পটল চোখ বড় বড় করে হরির কথা শুনছিল। হঠাৎ বলল, “তুমি কি ডাক্তারের ছেলে?”

“কী করে বুঝলে?”

“অনেক জানো দেখছি। তবে ভয় নেই। আমাকে সবসময়ে ওষুধ-বিষুধও রাখতে হয়। তবে টোটকা।”

বলেই পটল পোশাকের ভিতরে কোথায় হাত ভরে একটা শিশি বের করে আনল। তাতে খানিকটা কালচে তেল। যত্ন করে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। আর-একটা শিশি বের করে হরির হাতে দিয়ে বলল, “খুব যন্ত্রণা হলে ছিপিটা খুলে একটু শুকিয়ে দিও। ওতেই কাজ হবে।”

হরি ডাক্তারের ছেলে বলেই তার সঙ্গে তুলো ব্যাণ্ডেজ ওষুধ থাকে। গোপালের মাথা ব্যান্ডেজে নিপুণ হাতে বেঁধে সে শিশিটা নিয়ে ছিপি খুলে একটু শুকে দেখল। চন্দন, গোলাপের আতর এবং আরও কিছু সুবাস-মেশানো একটা মাদক গন্ধ। সে অবাক হয়ে বলল, “এ তো স্মেলিং সল্ট নয়! তবে এটা কী?”

পটল মাথা নেড়ে বলল, “ডাক্তারি ওষুধ ছাড়াও দুনিয়ায় মেলা ওষুধ আছে। ওসব গুপ্তবিদ্যের খবর ডাক্তাররা জানেও না। এ হল কালী কবরেজের মুষ্টিযোগ। ওর নাকে একটু ধরেই দেখ না, কী হয়।”

আশ্চর্যের বিষয়,শিশির মুখটা গোপালের নাকের কাছে ধরার কিছুক্ষণ পরেই ধীরে-ধীরে গোপাল চোখ মেলে চাইল। দৃষ্টিটা ঘোলাটে, অস্বচ্ছ। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর চোখ স্বাভাবিক হয়ে এল। উদভ্রান্তের মতো সে চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলে উঠল, “ওরা পাগলা-সাহেবের কবর খুঁজছে।”

হরি গোপালের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “কারা? কী খুঁজছে?”

পটল দাস চাপা গলায় বলে উঠল, “সর্বনাশ!”

গোপাল একবার উঠে বসবার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণে সে সাঙ্ঘাতিক দুর্বল। তার ওপর মাথায় চোটটাও বেশ জোরালো রকমের। উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ফের লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।

হরি আবার তাকে শিশি শোঁকাতে যাচ্ছিল। পটল তার হাতটা ধরে বাধা দিয়ে বলল, “থাক। এখন ওকে ঘুমোতে দাও।”

হরি জিজ্ঞেস করল, “গোপাল কী সব বলল বলো তো! পাগলা-সাহেবের কবর না কী যেন!”

পটল খুব অবাক হয়ে বলল, “কই, আমি তো কিছু শুনতে পেলুম না! আমার কান সেই কখন থেকে ভোঁ-ভোঁ করছে, পরশু কানে একটা শ্যামাপোকা ঢুকেছিল তো!”

“কিন্তু এতক্ষণ তো আমার কথা দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলে!”

“তা বটে। কিন্তু পোকাটা এই একটু আগে কানের মধ্যে নড়াচড়া শুরু করেছে। উরে বাবা, যাই, কানে একটু গরম তেল দিই গে।”

পটল দাস যে কিছু একটা চেপে যেতে চাইছে তা বুঝতে কষ্ট হল না হরির। তবে এই অবস্থায় সে আর এ-নিয়ে কথা বাড়াতে চাইল না। শুধু বুঝল, কেউ বা কারা পাগলা সাহেবের কবর খুঁজছে, এই হল মোদ্দা কথা। এটা খুব একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার বলেও তার মনে হল না। সে পটল দাসের দিকে চেয়ে বলল, “আমাকে পাঁচ শেখাবে বলেছিলে, মনে আছে তো! তার বদলে আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাব।”

পটল ঘাড় কাত করে বলল, “খুব মনে আছে। তবে দিনের বেলা আমার সুবিধে হবে না। রাতবিরেতে চলে আসব’খন। ভোর হয়ে আসছে, এবার গিয়ে আমাকে গর্তে ঢুকে পড়তে হবে। আসি গে।”

“এসো। এর বাড়িতে একটা খবর দিও।” পটল দাস রাজি হয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

হরি ঠায় বসে রইল গোপালের পাশে।তারপর একসময়ে ঢুলুনি এসে গেল তার। চোখ বুজে ফেলল। তারপর আর কিছু মনে রইল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *