Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুষ্টচক্র – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

দুষ্টচক্র – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

মোড়ের মাথায় একটা রিকশা পাওয়া গেল‌, তাহাতে চড়িয়া আমরা উত্তর দিকে চলিলাম। লক্ষ্য করিয়াছি‌, আমহার্স্ট স্ত্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আশেপাশে সামনে পিছনে যখন জোয়ারের সমুদ্রের মত জনস্রোত ছুটিয়াছে‌, তখনও আমহার্স্ট স্ট্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আমহার্স্ট স্ট্রীট সমুদ্রের সমান্তরাল সঙ্কীর্ণ খালের মত নিস্তরঙ্গ পড়িয়া আছে।

রাস্তায় উত্তর প্রাস্তে আসিয়া একটি নম্বরের সামনে রিকশা থামিল‌, আমরা নামিলাম। ব্যোমকেশ নম্বর মিলাইয়া বলিল‌, ‘এই বাড়ি।’

বাড়িটি ঠিক ফুটপাথের ধারে নয়‌, মাঝখানে একটু খোলা জমি আছে‌, তাহাতে কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় বাড়িটিকে রাস্ত হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতল বাড়ির উপরতলা অন্ধকার‌, নীচের একটা জানোলা দিয়া পত্রান্তরাল ভেদ করিয়া ঝিকিমিকি আলো আসিতেছে।

আমরা ছেট ফটক দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

সামনের ঘর টেবিল চেয়ার দিয়া সাজানো‌, যেন অফিস ঘর। একটি লোক চেয়ারে বসিয়া অলসভাবে পেন্সিল দিয়া কাগজের উপর হিজিবিজি কাটিতেছে। আমরা দ্বারের কাছে আসিলে সে চোখ তুলিয়া চাহিল।

সুপুরুষ বটে। বয়স আন্দাজ পয়ত্রিশ‌, টকটকে রঙ‌, কোঁকড়া চুলের মাঝখানে সিঁথি‌, নাক চোখ যেন তুলি দিয়া আঁকা। আমিও বিশু পালের মত মুগ্ধ হইয়া গেলাম।

ব্যোমকেশ দ্বারের নিকট হইতে বলিল‌, ‘আসতে পারি? আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী‌, ইনি অজিত বন্দ্যো।’

অভয় ঘোষালের চোখের দৃষ্টি সতর্ক। তারপর সে অধর প্রান্তে একটি মুকুলিত হাসি ফুটাইয়া বলিল‌, ‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! কী সৌভাগ্য। আসুন।’

আমরা গিয়া অভয় ঘোষালের মুখোমুখি বসিলাম। সে পেন্সিল নামাইয়া রাখিয়া বলিল‌, ‘কি ব্যাপার বলুন দেখি। সম্প্রতি কোনো কু-কাৰ্য করেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

ব্যোমকেশ হাসিল‌, ‘আপনাকে দেখতে এলাম।’

অভয় ঘোষাল বলিল‌, ‘ধন্যবাদ! আমি তাহলে একটি দর্শনীয় জীব। আপনি নিজের ইচ্ছেয় এসেছেন‌, না কেউ পাঠিয়েছে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পাঠায়নি কেউ। কিন্তু মহাজন বিশু পাল তাঁর দুঃখের কথা আমাকে শোনালেন‌, তাই ভাবলাম আপনাকে দর্শন করে যাই।’

‘ও–শিশুপাল।’ অভয় ঘোষাল ক্ষণেক থামিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে কেউ পাঠিয়েছে। বুঝেছিলাম‌, কিন্তু শিশুপালের কথা মনে আসেনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘জানেন বোধ হয়‌, বিশু পালের পক্ষাঘাত হয়েছে।’

অভয় বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল‌, ‘তাই নাকি; আমি জানতাম না। মাস তিনেক আগে শিশুপাল আমার বাড়িতে এসেছিল‌, আমাকে চৌদ-পুরুষান্ত করে গেল। ভগবান আছেন।’ তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনো উষ্মা প্রকাশ পাইল না। পেন্সিলটা তুলিয়া লইয়া সে আবার কাগজে হিজিবিজি কাটিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখান থেকে ফিরে গিয়েই তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল। সেই থেকে তিনি নিজের বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছেন। অবশ্য পক্ষাঘাতাই তাঁর বাড়িতে আবদ্ধ থাকার একমাত্র কারণ নয়। আপনার ভয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হন না।’

‘আমার ভয়ে–বলেন কি! আমি খাতক‌, সে মহাজন‌, আমারই তার ভয়ে লুকিয়ে থাকার কথা।’ অভয় ঘোষাল ভ্রূ তুলিয়া পরম বিস্ময়ভরে কথাগুলি বলিল‌, কিন্তু তাহার অধর-প্রান্তে হাসি লাগিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাঁর ভয় হয়েছে আপনি তাঁকে খুন করবেন।’

‘এই দেখুন। যত দোষ নন্দ ঘোষ! আমি একটিবার খুনের মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলাম‌, অমনি সবাই ভেবে নিলে আমি খুনী আসামী–আমি যে বেকসুর খালাস পেয়েছি সেটা কেউ ভাবল না।’ অভয় ঘোষাল একটু থামিয়া অপেক্ষাকৃত মন্থর কণ্ঠে বলিল‌, ‘তবে একটা কথা সত্যি। আমার কোষ্ঠীর ফল–যারা আমার শক্রতা করে তারা বেশি দিন বাঁচে না।–উঠছেন নাকি?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ। আপনাকে দেখতে এসেছিলাম‌, দেখা হয়েছে। এবার যাওয়া যাক। —একটা কথা বলে যাই। বিশু পালের যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় আমি খুব দুঃখিত হব। এবং আপনিও শেষ পর্যন্ত দুঃখিত হবেন।’

অভয় ঘোষালের মুখে হঠাৎ পরিবর্তন হইল। মুখের হাসি মুছিয়া গিয়া চোখে একটা নৃশংস হিংস্বতা ফুটিয়া উঠিল। সে নির্নিমেষ সৰ্প-চক্ষু মেলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল।

আমার বুকের একটা স্পন্দন থামিয়া গিয়া আবার সবেগে চলিতে আরম্ভ করিল। এই দৃষ্টি বিশু পালকে ভয়ে দিশাহারা করিয়াছিল। চোখের দৃষ্টিতে মৃত্যুর শপথ এত স্পষ্টভাবে আর কাহারো চোখে দেখি নাই।

ব্যোমকেশ তাহার প্রতি একটি অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল‌, ‘চল অজিত।’

ফুটপাথে পৌঁছিয়া দেখিলাম, রাস্তায় পরপারে একটা ট্যাক্সি দাঁড়াইয়া আছে। ড্রাইভারকে ডাকিবার জন্য হাত তুলিয়াছি, ট্যাক্সিটা চলিতে আরম্ভ করিল, দ্রুত বেগ সংগ্ৰহ করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

আমি ব্যোমকেশের পানে চাহিলাম। সে বিলীয়মান ট্যাক্সির দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘ভেতরে কেউ ছিল?’

বলিলাম, ‘দেখিনি। ড্রাইভারটা কিন্তু আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাই ভেবেছিলাম খালি ট্যাক্সি। হয়তো পিছনের সিটো কেউ ছিল ৷ ‘

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ চলিতে আরম্ভ করিল, ‘কেউ বোধ হয় আমাদের পিছু নিয়েছিল।’

‘কে পিছু নিতে পারে?’

‘ডাক্তার রক্ষিত ছাড়া আর তো কেউ জানে না যে আমরা এখানে এসেছি।’

‘কিন্তু কেন? কী উদ্দেশ্য?’

‘তা জানি না। অবশ্য সমাপতনও হতে পারে। ট্যাক্সিতে আমাদের অজানা আরোহী ছিল, কোনো কারণে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল, তারপর চলে গেল।’

রাত্রি সাড়ে সাতটা। আমরা পদব্ৰজে বাসার দিকে চলিলাম। মনে কিন্তু একটা ধোঁকা লাগিয়া রহিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *