Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তৃতীয় নয়ন || Samaresh Majumdar

তৃতীয় নয়ন || Samaresh Majumdar

পলাশপুরে আমার বাবা কাজ করতেন। ও-অঞ্চলের সমস্ত চা-বাগানগুলোর মধ্যে পলাশপুরের বেশ নামডাক ছিল তখন। উৎপাদন ও আয়তনের প্রখ্যাতি ছাড়াও পলাশপুর চা-বাগানের বাবুদের কোয়ার্টারেই প্রথম বিজালিবাতি জ্বলেছিল। ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঙরাভাসা ঝরনার তীব্র স্রোতে হুইল বসিয়ে ডায়নামো চালিয়ে অ্যাটকিন্স সাহেব এই বিজালিবাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। একটা পাঁশুটে আলো জ্বলত কোয়ার্টারগুলোতে। রাত দশটা বাজার সঙ্গে-সঙ্গে তার আয়ু যেত দপ করে ফুরিয়ে। তবু তার জন্যে আশপাশের চা বাগানগুলো ঈর্ষা করত পলাশপুরকে। আমার বাবা ওই ফ্যাক্টরি দেখাশোনা করতেন।

জলপাইগুড়িতে আমাদের একটা বাড়ি ছিল। আমার ঠাকুরদা পলাশপুর থেকে রিটায়ার করে ওখানে বাড়ি করেছিলেন। আমি আর দিদিভাই ঠাকুরদার কাছেই থাকতাম। দিদিভাই সেকেন্ড ক্লাসে পড়ত বলে ঠাকুরদা কালীপুজোর ঠিক একদিন আগে আমাদের পলাশপুরে যাওয়ার। অনুমতি দিতেন। ঠাকুরদা ছিলেন বেশ রাশভারী। চাকুরিকালে তাঁর দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। তিনি বলতেন ম্যাট্রিক পাশ করলেই দিদিভাইকে বিদায় করে দেবেন।

বিরাট তিস্তার চরটা ঠাকুরদার প্রকাণ্ড ছাতির তলায় মাথা গুঁজে হাঁটতে-হাঁটতে পেরিয়ে আসতাম আমি আর দিদিভাই। পেছনে স্যুটকেস কাঁধে লাটুকাকু। অনেকদিনের পুরোনো চাকর বলে ওকে আমরা কাকু বলতাম। তখন তিস্তার জল নেই বললেই চলে। মাঝে একটা পা পাতা-ডোবানো। জলের শীর্ণ স্রোত বইলেও রুপোলি বালির চরটা ধু-ধু করত। মাঝে-মাঝে কাশবনের মধ্যে দিয়ে পথ হয়ে গেছে হেঁটে-হেঁটে। আর বিকট শব্দ করে বার্নিশ-কাছারি যাতায়াত করত ভাঙাচোরা ট্যাক্সিগুলো প্যাসেঞ্জার নিয়ে। কেন জানি না, ওগুলোকে শহরে ঢুকতে দেওয়া হত না। ঠাকুরদা ওগুলোকে দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। বলতেন, হেঁটে গেলে স্বাস্থ্য ভালো হয়।

বার্নিশে এসে ঠাকুরদা আমাদের বাসে উঠিয়ে দিতেন। বাসে ওঠার আগে আমরা তাঁকে প্রণাম করতাম। আমাদের মাথায় হাত দিয়ে কি একটা মন্ত্র যেন তিনি পড়তেন। বাস ছাড়ার আগে ঠাকুরদা কন্ডাক্টরকে বারবার করে বলে দিতেন, কোথায় আমাদের নামিয়ে দিতে হবে। বাস ছাড়ার পর স্পষ্ট দেখতাম তাঁর চোখ ছলছল করছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতাম, আমরা যতক্ষণ না চোখের আড়ালে যাচ্ছি ততক্ষণ উনি দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে বিমর্ষ মুখে লাটুকাকু।

দু-ধারে শাল দেওদার আর আম-কাঁঠালের সারির মধ্যে কালো ফিতের মতো তেলতেলে পিচের। রাস্তাটা ধরে বাস ছুটত। দিদিভাই বসে থাকত খুব গম্ভীরভাবে। আর মাঝে-মাঝে আমাকে বলত, বাইরে হাত রেখোনা অন্তু। গাড়ি থামলেই কন্ডাক্টর চেঁচাত, ময়নাগুঁড়ি-ধূপগুঁড়ি-গয়েরকাটা বীরপাড়া। আর আমি সময় দেখতাম। পলাশপুর পৌঁছতে কত দেরি।

সবুজ গালিচার মতো ছাঁটা চা-গাছগুলোর মধ্যে নীল রঙের জমিতে সাদা রঙে পলাশপুর টি এস্টেট লেখা সাইনবোর্ডটা চোখে পড়তেই বুকের ভেতরটা ছটফট করে উঠত। চেঁচিয়ে বাসটা থামাতেই চোখে পড়ত মা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। পিচের রাস্তাটা, যেটা আসাম অবধি। গিয়েছে, সেখান থেকে আমাদের কোয়ার্টারের বারান্দা প্রায় আধ ফার্লং। আমি স্যুটকেসটা। মাটিতে রেখে, দিদিভাইকে পেছনে ফেলে এক লাফে একটা পাথরের সিঁড়ি টপকে দু-পাশের পাতাবাহার গাছগুলোর মধ্য দিয়ে ছুটতে-ছুটতে গিয়ে মাকে প্রণাম করতাম। আমার হাঁপাননা দেখে মা যখন হেসে বলতেন, বোকা ছেলে, দৌড়ে আসতে হয়? –তখন মায়ের বুকে মুখ। ডুবিয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগত। অথচ দিদিভাই আসত মৃদু পায়ে। মাকে প্রণাম করেই জিজ্ঞাসা করত, চিঠি পেয়েছিলে আমার? সেকেন্ড ক্লাসে উঠতে আমার তখন দু-বছর বাকি ছিল।

আর ঠিক তখনই ওদের দেখতে পেতাম। বাস থামতেই ওরা ছুটে এসেছে। আমার বুকের ভেতরে একটা চাপা আনন্দ পাক দিয়ে উঠত। দিদিভাই বলত, এখন যেও না অন্তু, হাতমুখ ধোবে চলো। করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকাতাম। মা তখন কী সুন্দর করে হাসতেন। দিদিভাই-এর চাইতে মাকে আমার অনেক বেশি ভালো লাগত। দিদিভাইটা যে কবে ম্যাট্রিক পাশ করবে।

দল বেঁধে হাঁটতে-হাঁটতে আমরা মাঠের মধ্যিখানে চলে এলাম। সেই ঝাঁকড়া চাঁপাফুলের। গাছটার তলায় টিনের ছাউনি দিয়ে মণ্ডপ করা হয়ে গেছে। তিনদিকের অর্ধেক টিন দিয়ে ঘিরে দিয়ে গেছে বাগানের কুলি। বুড়িমাংরার মা তখন মণ্ডপের মাটি গোবর দিয়ে নিকোচ্ছিল। মাঝখানে ইট আর লাল মাটিতে ঠাকুর বসাবার বেদির জায়গা করা হয়েছে। একটা মাটিতে গোবরে মেশা গন্ধ আসছিল নাকে আর সেইসঙ্গে মিষ্টি চাঁপার বাস। ওপরের গাছটায় ডালগুলো সোনা হয়ে গেছে ফুলে।

ঠাকুর গড়া হয়ে গেছে রে? আমি মণ্ডপটা দেখতে-দেখতে বললাম।

ধুস! মন্টু বলল, শ্রীচরণদা সবে এখন মাথা লাগাচ্ছে।

ডাকিনী-যোগিনী? আমার খুব কৌতূহল হচ্ছিল।

ওদের মাথা লাগানো হয়ে গেছে। শ্রীচরণদা নাকি বদমাশ, সেই কবে মাটি লেপে গিয়েছিল আর আজ এসেছে মাথা লাগাতে। মাথা ছাড়া ঠাকুরকে দেখতে কী খারাপই না লাগছিল? হাঁটতে হাঁটতে বিশু বলল।

আমরা এই চা-বাগানের ছেলেরা সোনাদের কোয়ার্টারের দিকে হাঁটছিলাম। শ্রীচরণদা ওখানে প্রতিমা গড়ছেন। সোনাদের কোয়ার্টারের সামনে এক ফালি জমিতে চালাঘর করে শ্রীচরণদা প্রতিমা তৈরি করেন।

তোরা এতক্ষণ ওখানে ছিলি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

হ্যাঁ রে। তোকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তো গেলাম। জানিস, সোনা বলছিল যে তুই এবার আসবি না। ঝুনু বলল।

কেন আসব না কেন? আমি তো অবাক!

তুই নাকি জলপাইগুড়িতে থেকে খুব ভালো ছেলে হয়ে গেছিস, এবারে ফার্স্ট হবি। তা আমি বললাম, অন্তু না এসে পারেই না। তাহলে আরতি দেবে কে?

ঝুনুর কথা শুনে আমার এত আনন্দ হল যে আমি এই রেডি গেট সেট গো বলে দৌড়াতে লাগলাম।

সবার আগে সোনাদের কোয়ার্টারের তারের বেড়াটার সামনে গিয়ে দেখলাম শ্রীচরণদা একটা চ্যাপটা কাঠি দিয়ে ঠাকুরের গলার ভাঁজ ঠিক করছেন একটা লম্বা টুলে চড়ে। জিভ লাগানো হয়ে গেছে। শ্রীচরণদার কুঁজো সাকরেদটা ডাকিনী-যোগিনীর তদারকে ব্যস্ত ছিল। প্রতি বছর। লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে শ্রীচরণদা আমাদের চা-বাগানে আসেন। সোনাদের বাড়ির সামনে এই একচিলতে উঠোনে টিনের চালাঘর করে পোয়াল দড়ি দিয়ে ঠাকুর বানাতে বসে যান। হোক না যেদিন ইচ্ছে বাবুদের কালীপুজো কমিটির মিটিং, শ্রীচরণদা জানেন বায়না তাঁর বাঁধা। এক একদিন এক-এক বাড়িতে খেয়ে শ্রীচরণদা আপন অধিকার নিজেই জাহির করে বেড়ান বাগানময়। ডিউটিতে যাওয়ার সময় বাবুরা সাইকেল থামিয়ে হয়তো বলে যান, শ্রীচরণ, এবার যেন ঠাকুরের চোখ সুন্দর হয়, গতবারটা যা টেড়া করেছিলে! সঙ্গে-সঙ্গে মাটিমাখা হাত দুটো কপালে তুলে জিভ কাটেন শ্রীচরণদা, তা কখনও হতি পারে না বাবুমশায়, মা আমার পাপ দেবেন গো! তারপর প্রতিমাকে মাটি মাখিয়ে শ্রীচরণদা সেই যে উধাও হলেন আর দেখাই নেই। সমস্ত চা-বাগানের মানুষকে দারুণ উদ্বিগ্ন করে রেখে শ্রীচরণদা তখন আশেপাশের বাগানগুলোর প্রতিমা গড়ছেন। আর কালীপুজোর আগের দিন সকালে এসে একগাল হেসে হলদে ছোপ ধরা দাঁতগুলো বের করে বললেন, এলাম গো।

ওদের আমি দেখতে পেয়েছিলাম। এই চা-বাগানের সব ছোট ছেলেমেয়ে আর মহিলারা টুলে বেঞ্চিতে বসে আছে। সোনাদের কোয়ার্টারের এই বারান্দাটা এখন সাময়িকভাবে সবার। আকর্ষণ। আতর মাসিমা, সোনার মা বসেছিলেন একটা বেতের চেয়ারে। আমাকে দেখেই ডাকলেন, আয় অন্তু, ভেতরে আয়। তোর ঠাকুরমার বাতের ব্যথাটা সেরে গেছে?

হ্যাঁ। বলে তারের গেটটা খুলে আমি ভেতরে ঢুকলাম।

এই যে, ছোট কত্তা এসে গেছেন দেখছি। আমাকে দেখে শ্রীচরণদা হাত থামালেন। বড় কত্তার শরীর ভালো তো? উত্তরে আমি ঘাড় নাড়লাম। শ্রীচরণদা যেবার প্রথম ঠাকুর গড়ার বায়না পান সেবার ঠাকুরদা ছিলেন পুজো কমিটির সেক্রেটারি। ঠাকুরের প্রসাদ দিয়ে সেবারই আমার অন্নপ্রাশন হয়েছিল। শ্রীচরণদা ঠাকুরদাকে বলতেন, বড় কত্তা, আর সেই সুবাদে আমি ছোট কত্তা।

আসলে আমার এখন কী যে ভালোই না লাগছিল! এই চেনা পরিবেশে, জন্ম-ইস্কুল যা আমি দেখে আসছি, জলপাইগুড়ি থেকে এখানে এসে এদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার বুকের ভেতর একটা আনন্দ চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়ছিল। প্রতি বছরের মতো সোনাদের কালো রঙের লম্বা। কানওয়ালা কুকুরটা গন্ধরাজ গাছটার তলায় বাঁধা আছে। আমাকে দেখে লেজ নাড়ছে সেটা। কানে এল, আরমাসিমা ঝুনুর মাকে বলছেন, ছোঁড়াটা বড় হলে ওর বাপের মতো লম্বা হবে। ঝুনুমাসিমা জবাবে যেন বললেন, শহরে থেকে খুব শান্ত হয়ে গেছে, বেশ মিষ্টি মুখটা।

কথাগুলো শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। বিশু, ঝুনু, মন্টুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমার মনে হল, গতবার জলপাইগুড়ি যাওয়ার সময় আমি কৌটোতে করে এক মুঠো মাটি নিয়ে গিয়েছিলাম। জলপাইগুড়ির বাড়ির উঠোনে সেই মাটি রেখে দিয়ে রোজ একবার করে দেখতাম আর চা-বাগানের কথা ভাবতাম। তখন মনে হত আমি বিশুদের কাছেই আছি। এক রাত্রে এমন বৃষ্টি হল যে পরদিন সেই মাটিটাকে আলাদা করে চিনতে পারিনি আর।

বারান্দার এক কোণে মোড়ায় একটা খয়েরি ফ্রক পরে দুই বিনুনি ঝুলিয়ে সোনা বসেছিল। হাতের চেটোয় গাল রেখে। ড্যাবডেবে চোখে আমাকে দেখছিল ও। সোনার গাল দুটো যেমন ফরসা তেমনি ফোলা। আমরা ওকে একা পেলেই রসগোল্লা, রসগোল্লা বলে খ্যাপাতাম। আর ও কিছুক্ষণ রেগেমেগে শেষে ভ্যাঁ করে গলা ছেড়ে কাঁদত।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে কখন হল বুঝতে পারিনি। সোনাদের বারান্দার একধারে একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে তারের শিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। চালাঘরের এদিকে কোনও লাইন নেই ইলেকট্রিকের। সাইকেলের ঘণ্টাগুলো তখন বাজতে শুরু করেছে আধো অন্ধকার মাঠের মধ্যে। বাবুরা সব অফিস থেকে ফিরতে শুরু করেছেন। ফ্যাক্টরিটা আমাদের কোয়ার্টারগুলো থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরে। আমরা এতক্ষণ উবু হয়ে বসে ঠাকুরগড়া দেখছিলাম। মাটির কাজ শেষ। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েই দুরে মাঠের ওপাশে চা-বাগানের রাস্তায় পাতলা অন্ধকারে সাইকেলের লাইট জ্বেলে বাবাকে আসতে দেখে আমি তারের গেটটা খুলে ছুটতে লাগলাম বাড়ির দিকে। এতক্ষণে আমার শীত-শীত করছিল। গরম জামা গায়ে না দেখেলে বাবা ভীষণ রাগ করবেন মায়ের ওপর।

বাবা বাড়িতে একটা ছোটখাটো পোলট্রি ফার্ম করেছিলেন। ভালোজাতের কয়েকটা লেগহর্ন মুরগি ছাড়াও কাঁঠালগাছের তলায় হাঁসের ঘর ছিল, বাড়ির পেছনে আঙরাভাসা ঝরনার ধারে। আমাদের খড়ের ছাউনি দেওয়া গোয়ালঘরে চারটে ভাগলপুরী গরু সারা বছর ধরে দুধ দিত। কালীপুজোর আগের দিন সেই দুধ জমিয়ে এক কড়াই ভরতি নলেনগুড়ের পায়েস হত। লালরঙা সেই পায়েস থেকে অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ বেরত। বাড়ি ফিরেই দেখতাম, মা আর দিদিভাই উঠোনের তুলসীতলায়, বারান্দায়, কাঁঠালতলায়, খিড়কি দুয়ারে চৌদ্দপিদিম দিচ্ছেন। চৌদ্দপিদিম দিলে ভূতপেত্নি আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পাবে না। তারপর মা আমাদের বাটিভরতি করে পায়েস। খাওয়াতেন। শীতকালে সেই প্রথম আমাদের পায়েস খাওয়া।

বাবার গলা পেলেই আমার বুক দুরুদুরু করে উঠত। যা ভয় করতাম ঠিক তাই। বাবা আমাকে ডেকে পাঠাতেন। এই সময়টাই ছিল সব চাইতে মারাত্মক। বাবা আমাকে একটার-পর–একটা প্রশ্ন করে যেতেন। কেন গত পরীক্ষায় আমি অঙ্কে নম্বর কম পেয়েছি, কেন ঠাকুমাকে বিরক্তি করি, কেন সন্ধের আগে বাড়ি ফিরি না–এই সব। কোনও উত্তর দিতে না পেরে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর দিদিভাই তখন বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে হাজার অভিযোগ জোগান দিত। বাবার সঙ্গে দিদিভাই-এর ব্যবহার ছিল সহজ। মাকেই বরং ও ভয় করত। আমার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ উলটো। বাবার প্রশ্নে আমি যখন নাজেহাল হয়ে পড়েছি তখনই রান্নাঘর থেকে মা আমাকে পায়েস খেতে ডাকতেন। ডাকটা আমার কানে অমৃত বর্ষণ করত।

একটু বাদেই সোনাদের কোয়ার্টারের সামনে থেকে কাঁসর বাজার শব্দ আসত। ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মণ্ডপে। সঙ্গে-সঙ্গে আমার ইচ্ছে হত মণ্ডপে ছুটে যেতে। তাই পা টিপেটিপে, বাইরের ঘরে রেডিও-র পাশে সোফায় বসে কাগজপঠনরত বাবার সামনে দিয়ে মুখটাকে খুব নিরীহ করে, যেন বাড়ির বারান্দায় একটু দাঁড়াচ্ছি এমনি ভঙ্গি করে যেই হাঁটতাম অমনি বাবার গম্ভীর গলা কানে আসত, ফুলহাতা সোয়েটারটা পরে যাও। পায়ে মোজা নেই কেন? ঠান্ডা না লাগালে আর চলছে না?

একটা লম্বা টুলে হ্যাজাকটা রাখায় মণ্ডপটা কেমন ঝলমল করছে। বেদিতে ঠাকুরকে বসানো হয়েছে। কী বিশ্রী লাগছিল হ্যাজাকের উজ্জ্বল আলোয় ঠাকুরকে দেখতে। ভাঁজে-ভাঁজে মাটিতে যেন ফাটল ধরেছে একটু। ঠাকুরের গায়ে কোথায় রং নেই একটুও। মন্টু বলল, শ্রীচরণদানা এইমাত্র আমাদের বাড়িতে খেতে গেল!

সোনাকে নিয়ে আরমাসিমা এইমাত্র এলেন। এ চা-বাগানের একমাত্র পুজোর সমস্ত আচার অনুষ্ঠানে মেয়েদের নেতৃত্ব করেন আতরমাসিমা। সোনাকে দেখলাম একটা ভারী শাল গায়ে জড়িয়ে এসেছে। দেখেই বুঝতে পারছিলাম ওটা আতরমাসিমার শাল। মণ্ডপের তিনদিকের অর্ধেক খোলা জায়গাগুলোতে সুনীতদারা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল যাতে ঠান্ডা হাওয়া না। আসে। আজ সারারাত জেগে সুনীতদারা মণ্ডপ সাজাবে। বিনু মাস্টার একটা কাগজে ডেকোরেশনের একটা প্ল্যান এঁকে বাদলদাকে বোঝাচ্ছিলেন। বিনু মাস্টার এখানকার জুনিয়ার স্কুলে সংস্কৃত পড়ান, সেইসঙ্গে ড্রয়িংও। অনেকগুলো বাঁশ আর লাল নীল কাগজ আনা হয়েছে। মণ্ডপে। বড়রা, মানে এই বাগানের ডাক্তারবাবু, টাইপবাবু, পাতিবাবু, মালবাবুরা সব গলাবন্ধ সোয়েটার অথচ চাদর আর মাথায় বাঁদরটুপি পরে গল্প করছিলেন একধারে। ঝুনুর বাবা, এই বাগানের ডাক্তারবাবু, পুজোর দিন পাঁঠা বলি দিয়ে থাকেন। উনি বলেন, সারা জীবনে এক কোপে উনি একশো আটাশটা পাঁঠা বলি দিয়েছেন। এক কোপে না কাটলে নাকি মা অসন্তুষ্ট হন। মন্টুর বাবা বললেন, আপনি মশাই রক্ষক, আবার ভক্ষকও। ডাক্তারি করে মানুষ বাঁচান আবার এক কোপে পাঁঠাও বলি দেন। ঝুনুর বাবা হো-হো করে হেসে উঠলেন। লোকে বলে, উনি নাকি শক্তি সাধনা, না কী বলে, করেন। এর মধ্যে দিদিভাইকে নিয়ে মা একবার ঘুরে গেছেন। মাকে লালপেড়ে শাড়িটা পরায় কী সুন্দর লাগছিল। দিদিভাই এসেছিল মুখে রুজ মেখে সাদা রঙের ওপর কালো নকশা তোলা কার্ডিগান পরে। দিদিভাইকে এখানে ঠিক মানাচ্ছিল না। কেমন শহুরে-শহুরে লাগছিল ওকে। ও বোধহয় তাই চেয়েছিল। চা-বাগানের অন্যান্য মেয়েরা দিদিভাইকে কেমন চোখে যেন দেখছিল। সুনীতদার সব কাজ থামিয়ে মায়ের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল, স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম দিদিভাই-এর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। দিদিভাই এখানে বেশ ডাঁট নিয়ে থাকে। এখানকার কারোর সঙ্গে মিশতে চায় না। মা আমাকে ডেকে বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। বাবার নাকি আজ নাইটডিউটি আছে। একটু বাদে মা আর দিদিভাই টর্চ জ্বেলে বাড়ি চলে গেলেন। সুনীতদা গেল মা-দের পৌঁছে দিয়ে আসতে। সুনীতদা কলকাতায় কলেজে পড়ে।

আমরা, মানে আমি, বিশু, মন্টু, খোকন, ঝুনু, ঠাকুরের সামনে একটা সতরঞ্চিতে বসেছিলাম। সোনাও আমাদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল। ও বলল, জানিস, এখনও সন্দেশ কেনা হয়নি পুজোর।

আমি বললাম, তোর তো সন্দেশ খাওয়ার জন্য লাল পড়ছে।

মুখ ভেঙছে সোনা বলল, ইস, তুই তো অঞ্জলি দেওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে সন্দেশ চুরি করিস থালা থেকে, আমি দেখেছি!

হ্যাঁ তুই দেখেছিস!

আমার খুব খারাপ লাগল কথাটা। মন্টু বলল, জানিস, আমার না কেমন ম্যাজিক লাগে। এই এখন দেখে যাচ্ছি এইরকম, আর সকালে এসে দেখব ঠাকুর কেমন সুন্দর প্রতিমা হয়ে গেছে।

আমি বললাম, সুনীতদাদের কি মজা, না? ওরা কেমন রাত জেগে ডেকোরেশন করতে-করতে ঠাকুরের প্রতিমা হয়ে যাওয়া দ্যাখে।

ঝুনু বলল, ইস, আমরা যে কবে বড় হয়ে ডেকোরেশন করব!

আমরা আমাদের বড় না হওয়া নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আপশোস করলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা মতলব এল, এই আজ রাত্রে ঠাকুর রং করা দেখবি?

ঝুনু মুখ বেঁকাল, কি করে দেখব? মা তো আসতেই দেবে না।

মন্টু বলল, বাবা বলবে, সামনে পরীক্ষা–অসুখ করবে।

বোঝা গেল আমাদের কাউকেই বাড়ি থেকে ছাড়বে না। একমাত্র আসা যায় ভোরে। তখন শিউলি ফুল কুড়োবার নাম করে বেরোনো যায়। অবশ্য এই ব্যাপারটা যদিও মেয়েদের একচেটিয়া, তবুও। লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজোর দিন অন্ধকার থাকতেই চা-বাগানের সব মেয়েরা, আঠারো থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চা অবধি মাঠের চারটে শিউলি গাছের তলায় বসে যায় সাজি ভরে শিউলি ফুল কুড়োতে। এমন সময় বিশু কি ভেবে হঠাৎ বলল, ও আজ রাত্রে আসবেই। রাত ঠিক। বারোটার সময় ও লুকিয়ে-লুকিয়ে এসে বড় শিউলি গাছটার সামনে দাঁড়াবে। আমি বললাম, আমিও আসব। আজ রাত্রে ঠাকুর রংকরা দেখবই। আমার মাথায় তখন ঘুরছিল, বাবা আজ নাইটডিউটি দিতে যাবেন।

রাত দশটা নাগাদ বাবা গরম অলেস্টার, মাথায় উলের টুপি, হাঁটু অবধি মোজা পরে ডিউটিতে গেলেন সাইকেলে চড়ে তিন ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে। মা একটা ফ্লাস্কে কফি তৈরি করে দিয়েছেন। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। এখন মা লন্ঠন জ্বেলে রেখেছেন। একটু আগে ঠিক দশটা বাজতেই। ইলেকট্রিক আলোটা নিবে গিয়েছে। বাবা চলে যেতেই আমি খাট থেকে নেমে মায়ের খাটে উঠে এলাম। আমাকে বাবার সঙ্গে শুতে হত, দিদিভাইকে মায়ের সঙ্গে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কিরে ভয় লাগছে বুঝি?

আমি ঘাড় নেড়ে মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম। মা তখন লন্ঠনের আলোয় গল্পের বই পড়ছিলেন। একটু বাদে আমি ফিসফিস করে বললাম, মা, আমি ঠাকুরগড়া দেখতে যাব।

মা পড়তে-পড়তে বললেন, ঠাকুর তো হয়ে গেছে।

আমি বললাম, না রং করা হয়নি। আমি কখনও রঙ করা দেখিনি। ওরা সবাই আসবে। তুমি একবার বলো মা!

মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না, তোমাকে যেতে দেব না। এখন বাইরে হিম পড়ছে। তোমার ঠান্ডা লাগবে। তোমার বাবা শুনলে ভীষণ রাগ করবেন।

কিন্তু আমি মাকে ছাড়লাম না। বারংবার কাকুতিমিনতি করতে শুরু করলাম। ভাগ্যিস দিদিভাই এখন মড়ার মতো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। যখন অনেক নাকিকান্না কেঁদে প্রায় হাল ছেড়ে। দিয়েছি আর বিশুর কাছে মনে হচ্ছে ছোট হয়ে গেছি তখন হঠাৎ মা বললেন, ঠিক আছে, যাও তুমি। তবে তোমাকে কথা দিয়ে যেতে হবে।

কী কথা, বলো? আমি ঝলমলে মুখে বললাম।

তোমাকে পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করতে হবে, প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটা করে চিঠি দেবে আর একদম ঠান্ডা লাগাবে না।

এ তো সামান্য, মা যদি আমাকে তিনদিন ভাত না খেতে বলতেন তবে তাতেই আমি রাজি হয়ে যেতাম। মা বললেন, এবার তুমি ঘুমোয়। বারোটার সময় আমি তোমাকে তুলে দেব। মড়ার। মতো ঘুমের ভান করে শুয়েছিলাম, বড় ঘড়িতে ঢংঢং করে বারোটা বাজতেই লাফিয়ে উঠলাম, মা তখনও বই পড়ছিলেন। আমাকে উঠতে দেখে হেসে বললেন, এই ঘুম হচ্ছিল তোমার?

গলাবন্ধ সোয়েটারের ওপর চাদর জড়িয়ে, মাফলারে কান ঢেকে ছোট টর্চটা নিয়ে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম তখন মনে হল আমার রক্ত বোধহয় জমে যাবে। এক-একটা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগছে আর দাঁতগুলো ঠকঠক করে আওয়াজ তুলছে। বাইরে কী ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ির সামনে বড় শিউলি গাছটার তলায় এসে দাঁড়ালাম। বিশু এখনও আসেনি। শিউলি গাছের তলায় ঘাসগুলো সাদা চাদর পরেছে যেন। শিউলি ফুলগুলো গালিচার মতো ছড়িয়ে আছে। মাথার ওপর টুপটুপ করে শিউলি ঝরছিল। কান পাতলে শিশিরের শব্দ শোনা যায় পাতায়-পাতায়। মাঠের ওপাশে বড় রাস্তার ওধারে মাড়োয়ারি দোকানটা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। পিচের রাস্তাটা যেটা আসাম অবধি গিয়েছে, সেখানে মাঝে-মাঝে এক-একটা লড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছিল। গাড়ির হেডলাইটে সমস্ত জায়গাটা হঠাৎ আলোকিত হয়ে পরক্ষণেই অন্ধকারের গাঢ়ত্ব তুলছিল। দুরে মাঠের মধ্যিখানে মণ্ডপ থেকে একটুখানি আলো বাইরে পড়েছিল আর। মাঝে-মাঝে ওদের কথাবার্তা অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। এদিকে সবকটি কোয়ার্টার অন্ধকারে ডালপালা মেলে দিয়েছে। পাতাবাহার গাছগুলোর ওপাশে একটা বিরাট দেওদার গাছ আছে। ঝুনু বলেছিল, গাছে নাকি একটা সাহেব-ভূত বিরাট পা ঝুলিয়ে বসে-বসে চুরুট খায়। মাঠের মধ্যে এত ঝাঁকঝাঁক জ্বলন্ত জোনাকি দেখে আমার সেই চুরুটের কথা যেই মনে পড়ল অমনি গা টা ছমছম করে উঠল। দূরে সাঁওতাল লাইনে মাদল বাজছে। ধেউদির গান তৈরি হচ্ছে লাইনে লাইনে। ওদের সম্মিলিত কন্ঠের গান খুব অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

অন্ধকারটা একটু চোখ-সাওয়া হয়ে গিয়েছিল এরই মধ্যে। হঠাৎ দেখলাম কে যেন মাঠের পাশ ধরে দৌড়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই টর্চ জ্বালাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। অন্ধকারে টর্চটা নিবিয়ে ফেলে একবার ভাবলাম, তারপরে টর্চ জ্বেলে কাছে যেতেই সোনা এগিয়ে এল।

তুই? আমি ধাক্কাটা সামলাচ্ছিলাম, কী করে এলি?

কেন? মা-রা তো পাশের ঘরে শোয়, দিদা ঘুমোতেই আমি পা টিপেটিপে চলে এলাম। সোনা নির্বিকার।

আতরমাসিমা ভীষণ রাগ করবেন! আমি ওকে বোঝাতে চাইছিলাম যেন।

ইস, জানতেই পারবে না। আমার দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি? তোরা একাই মজা করে দেখবি, না? সোনার গলায় অভিযোগ।

হঠাৎ লক্ষ করলাম সোনার গায়ে গরম কাপড়ের নামমাত্র নেই। ফুলহাতা একটা গরমের ফ্রক পরেছে ও। তাড়াতাড়িতে হয়তো পরে আসতে পারেনি কিছু।

আমি বললাম, সোনা, তোর ঠান্ডা লাগছে?

সোনা ঘাড় নেড়ে না করলেও বুঝতে পারছি ঠান্ডা ওর লাগছেই।

বিশুটা এখনও এল না। আমি বললাম।

দাঁড়া, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি।

কিন্তু বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে বিশু এল না তখন আমরা দুজন আস্তে-আস্তে মাঠের মধ্যে দিয়ে শিশিরে পা ডুবিয়ে এগোতে লাগলাম মণ্ডপের দিকে। একটু এগোতেই গ্রামাফোনের সুর শুনতে পেলাম। রেকর্ড বাজছে, আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে। এই রাত্রে, নির্জন রাত্রে গানের সুর অতিরিক্ত আওয়াজ আনছিল। রাত জাগতে হলে নাকি গ্রামাফোন বাজানো দরকার। কিন্তু কোনও বাড়ি থেকে রেকর্ড দিতে চায় না বলেই এই রেকর্ডটা সুনীতদাদা আমাদের বাড়ি থেকে প্রতিবছর নিয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, এই নিশুতি চতুর্দশীর রাত্রে যখন চা-বাগানের ছোট্ট পৃথিবীটা অথৈ ঘুমে সুপ্ত, যখন জোনাকিগুলো বিরাট মাঠের মধ্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত, তখন মণ্ডপের ক্ষীণ আলো এত দূরে অন্ধকারে দাঁড়ানো আমার চোখে গহন সমুদ্রে আলোকস্তম্ভের মতো কাজ করছিল। দূরে সাঁওতাল লাইনে মাদল বাজছে আর সম্মিলিত সুরে গানের ধুয়ো অন্ধকারকে চিরে এই মাঠের বুকে এসে গানের সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে আমাদের কানে কনসার্টের মতন বাজছিল। পায়ে-পায়ে আমরা মণ্ডপের দিকে এগিয়ে গেলাম।

কে রে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে? বিনু মাস্টার হাঁক দিলেন।

গলাটা শুনেই পাতাবাহার গাছগুলোর পাশে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। এখন আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় ভয় সঞ্চারিত হল। ওরা যদি আমাদের ওপর খুব রেগে যায়। সোনা সিঁটিয়ে আমার গায়ের সঙ্গে লেপটে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে আমাদের ওরা অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না। একঝলক বাতাস। মণ্ডপের ওপরের রাশ-রাশ চাঁপাফুলের গন্ধ আমাদের মাখিয়ে গেল।

আরে সাড়া দিচ্ছে না কেন? সুনীত, দ্যাখ তো কে দাঁড়িয়ে আছে। বিনু মাস্টার মণ্ডপের ভেতরে বাখরি চাঁচাতে-চাঁচাতে বললেন।

সুনীতদারা সারা মণ্ডপে বাঁশের ফ্রেম করে কাগজে আটা মাখাচ্ছিল। বিনু মাস্টারের কথায়, ভূতটুত হবে বাবা বলে মণ্ডপের সামনে এসে চিৎকার করে ডাকল, কে বাবা, সাড়া দাও, নইলে বাঁশ ছুঁড়ে মারব।

কথাটা শোনামাত্রই আমার মুখ দিয়ে বের হল, আমি।

আমিটা কে?

আমি, আমি অন্ত।

ততক্ষণে সুনীতদা, বাদলদা আমার কাছে এসে পড়েছে, আরে তোরা? তোরা কী করছিস এখানে? দ্যাখো বিনুদা–।

আমাদের টানতে-টানতে সুনীতদা মণ্ডপের ভেতরে নিয়ে এল। বিনুমাস্টার আমাদের দেখে চোখ কপালে তুললেন, কী কাণ্ড! তোরা এখানে এত রাত্রে! বদমায়েস ছেলেরা সব, যাও-যাও।

আর ততক্ষণে আমাদের নিয়ে মণ্ডপের দাদাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। ছোঁড়াটার জলপাইগুড়ি গিয়ে বড় বোলচাল বেড়ে গিয়েছে। এমন অবাধ্য সব। আজকালকার ছেলেগুলো কাউকে মানতেই চায় না। আচ্ছা বাড়ি থেকেই বা ছাড়ল কী করতে। বাবা-মা-র দায়িত্বজ্ঞান কীরকম। নিশ্চয় পালিয়ে এসেছে। ইত্যাদি-ইত্যাদি। বিনুমাস্টার বললেন, যাও সুনীত, ওদের বাড়ি পৌঁছে দাও। তুমি সঙ্গে যাও।

সোনা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। কথাটা শুনেই ডানহাতটা দিয়ে চোখ রগড়ে ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করল।

সোনার কান্না শুনে শ্রীচরণদা পরিত্রাতার ভূমিকা নিলেন, আহা, কাঁদ কেনে মা ঠাকুরুন। আহা, তোমরা আবার বকতিছ কেনে? আসিই যখন পড়িছে তবে থাকুক কেনে হেথায়।

সোনার কান্না আরও বেড়ে গেল। বিনুমাস্টার আমাদের কিছুক্ষণ দেখে শেষে বললেন, আচ্ছা থাক, আর কাঁদতে হবে না। যাও ওই কোনায় গিয়ে চুপটি করে বসে থাকো। একটিবার গণ্ডগোল করলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

আমরা সুড়সুড় করে টিনের বেড়ার কাছে সতরঞ্চির ওপর গিয়ে বসলাম। ওরা আবার কাজে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেল। ঠাকুরের গায়ে সাদা রং বোলানো হয়ে গেছে। কী বিশ্রীই না লাগছে। ঠাকুরকে দেখতে। বিনুমাস্টারের বাঁশকাটার শব্দ আসছিল মণ্ডপের সামনে থেকে। একটু বাদে আমার কানের কাছে সোনা ফিসফিসিয়ে বলল, কেমন বোকা বানিয়ে দিলাম বল তো! না কাঁদলে ঠিক বাড়ি পাঠিয়ে দিত।

ঠাকুরের পেছনে গ্রামাফোনে তখন বাজছিল, প্রলয় নাচন নাচলে যখন হেনটরাজ।

শ্রীচরণদানীল রং গুলছিলেন একটা বড় বালতিতে। রঙের গন্ধ আসছিল নাকে। শ্রীচরণদার কুঁজো সাকরেদটা ঠাকুরের পায়ের নিচে শোয়া শিবের গায়ে সাদা রং বোলাচ্ছিল। ডাকিনী যোগিনীকে দুটো সাদা পেত্নির মতো লাগছিল দেখতে। ডেকরেশন চলছে। একটা মন্দির হবে। ঠাকুরের বেদিটা মন্দিরের ঠিক মাঝখানে থাকে। সুনীতদা কাগজ কেটে দিচ্ছিল, বাদলদারা আঠা মাখাচ্ছিল এখন। হঠাৎ সুনীতদা উঠে আমাদের কাছে এগিয়ে এল। হাঁটুগেড়ে আমাদের সামনে বসে আমার কানটা মলে দিয়ে বলল, আগে থেকে প্ল্যান করে আসা হয়েছে না? খুব পেকেছ তুমি! তারপর সোনার দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর সোনামণি, মাকে বলে দেবে না তো সুনীতদা সিগারেট খায়! সোনা মাথা নেড়ে না বলল। সুনীতদা ডান হাতে সোনার ফোলা ফোলা গাল দুটো টিপে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে।

সুনীতদা চলে যেতেই সোনা মুখ লাল করে বলল, অ-সো-ব্য! আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল সুনীতদার ওপর।

মাথার ওপর টিনের চালে চাঁপাগাছের পাতা চুঁইয়ে শিশির পড়ছিল টপটপ করে। সোনা আমার কাছে বসেছিল। তোর শীত লাগছে সোনা। জিজ্ঞাসা করতেই ও ঘাড় নাড়ল হ্যাঁ। আমার চাদরটা নে তুই বলে চাদরটা খুলে এক প্রান্ত ওর পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে আর-একটা প্রান্ত আমার গায়ে জড়িয়ে দুটো মুখ সামনে এনে পায়ের তলায় গুঁজে দিলাম। একটু বাদেই চাদরের মধ্যে বেশ একটা ওম হল। সোনার কাঁধের সঙ্গে আমার কাঁধ জুড়ে গিয়ে ঠান্ডা আর লাগছিল না।

বাদলদা বলছিল, শালা আমাদের বাগানে একটাই তো পুজো, তবু ডেকরেশনের বেলায় কী কিপ্টেমি। মাল না ছাড়লে ডেকরেশন হয়।

বিনুমাস্টার বলল, সবাই পুজোর পর গান্ডেপিন্ডে গিলতে চায় তো কি হবে! ঠাকুরের গায়ে নীল রং বোলানো হল। কুঁজো সাকরেদটা ডাকিনী-যোগিনীকে নীল রংনা বুলিয়ে মেটে রং করতে আরম্ভ করল। নীল রঙের পেঁচাটা পড়ায় ঠাকুরকে কেমন যেন লাগছিল। একটা বড় তুলি রঙের বালতিতে ডুবিয়ে শ্রীচরণদা বড়-বড় পোঁচ টানছিলেন ঠাকুরের গায়ে। মাথাটা এখনও নেড়া বলে মুখটা বিশ্রি লাগছিল। সোনা আর কাঁপছিল না। ওর আঙুল আমি ধরেছিলাম, কী ঠান্ডা ওর হাতটা।

ঠাকুরের গায়ে রং কি বল তো? সোনা জিজ্ঞাসা করল।

কেন, ঠাকুরের গায়ে রং তো নীল। আমি বললাম।

নীল রং হয়ে গেছে। মা বলত কালোও হয়। তাই তো নাম কালী।

এখনও জামা পরায়নি।

ধ্যাত ঠাকুর জামা পরে নাকি! মা বলেছে যুদ্ধ করে মানুষের হাত কেটে ঠাকুর জামা করে পরেছে।

শিবের বাঘছালটা কিন্তু এখনও হয়নি। ভুলে যাবে না তো।

এখন ঠাকুরের হাতের চেটোতে, জিবে, পায়ে লাল রং বোলালেন শ্রীচরণদা। সুনীতদারা লাল নীল কাগজে সমস্ত মণ্ডপ জুড়ে মন্দির করে ফেলেছে। এখন আর গ্রামোফোন বাজছে না। বিনুমাস্টার রং তুলি সাজাচ্ছিল। শ্রীচরণদা যখন ঠাকুরের বুকের কাছে খয়েরি রং বোলাচ্ছেন তখন পেছন থেকে কে যেন জিভে করে চকচক শব্দ করল। শ্রীচরণদা একবার তুলিটা থামিয়ে আবার রং করতে লাগলেন। সুনীতদা ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে এক হাত কোমরে রেখে সিগারেট টানতে-টানতে বলল, শালা, শ্রীচরণদার এলেম আছে মাইরি। তুলির টানে-টানে মায়ের সুরত। খুলে যাচ্ছে।

সামনে থেকে বিনুমাস্টার ধমকে উঠল, এই সুনতে, মাকে শালা বলছিস কোন আক্কেলে রে?

সুনীতদা বলল, এক্সকিউজ মি বিনুদা। তবে মা তো এখনও কমপ্লিট হয়নি। না আঁকা হলে তো আবার লাইফ আসে না।

সোনা আমার হাঁটুর ওপর ঝুঁকে পড়ে ঠাকুর রং করা দেখছিল। আমার এখন ঠাকুরকে দেখতে খুব খারাপ লাগছিল। শ্রীচরণদা যত রং বোলাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে ঠাকুর কেমন ন্যাংটো ন্যাংটো। সাধনদা উঠে এসে সুনীতদার পাশে দাঁড়াল, শালা কী করেছে মাইরি।

সুনীতদা বলল, চেহারা দেখেছিস!

বাদলদা কী যেন দেখে বলল, অবস্যার্ড।

ওরা খুব চাপা গলায় কথা বলছিল যাতে বিনুমাস্টার না শুনতে পায়। বাদলদা একসময় বলল, আমাদের বাগানটা মাইরি একদম সাহারা। একটাও নেই যার দিকে তাকানো যায়।

সাধনদা বলল, কেন, অন্তুর দিদি!

সঙ্গে-সঙ্গে সুনীতদা ধমকে উঠল, অ্যাই! তারপর নিচু গলায় বলল, সোনাটা মাইরি ফিউচারে–। বলে চোখ টিপল।

এই, আস্তে। বাদলদা কথাটা বলে আমাদের দিকে তাকাল।

আমার খুব অবাক লাগছিল ওদের কথা শুনে। কেমন রহস্যজনক লাগছিল আমার। আমি বুঝতে পারছিলাম না। সোনার দিকে তাকালাম। ওর নাক দিয়ে জল গড়াতেই ও টেনে নিল সেটা। সাধনদা একবার বলেছিল কী সেপ। মানে কী আদল? –আদল মানে, আকৃতি? ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে সাধনদা কথাগুলো বলেছিল। তারপর সোনার দিকে। সোনাকে ঠাকুরের মতো কল্পনা করে আমার খুব হাসি পেল।

সোনা বলল, এই হাসছিস যে!

এমনি। আমি বললাম।

সুনীতদাটা না খুব অসবো।

হ্যাঁ।

তোর দিদির সঙ্গে ভাব আছে। চিঠি দেয়।

যাঃ।

হ্যাঁরে! আমি জানি। সোনা কথাটা বলতেই সুনীতদার ওপরে ভীষণ রাগ হতে লাগল।

এই সোনা, তুই না বড় হলে–

অ্যাই! সোনা আমাকে চিমটি কাটল রেগে।

শ্রীচরণদা ঠাকুরের মাথায় চুল লাগালেন আঠা দিয়ে। পেছনে একটা স্টোভ জ্বলছিল বলে সোঁ সোঁ আওয়াজ আসছে। বোধহয় চা হচ্ছে। এখন বোধহয় শেষ রাত। অন্ধকারে জোনাকি জ্বলা। থেমেছে। দূরের সাঁওতাল লাইনের মাদলের শব্দ থেমে গেছে। চারপাশ কী আশ্চর্য থমথমে। শুধু মাথার ওপরে টিনের চালে শিশির পড়ছিল।

ডাকিনী-যোগিনী, সাপ, শিব, শেয়াল সব রং করা হয়ে গেছে। সাপটাকে কী চকচকে লাগছিল। যেন জীবন্ত। বিনুমাস্টার মন্দিরের দেওয়ালের ছবি আঁকছেন, একটা মেয়ে পুজোর থালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে যেন।

সুনীতদারা সবাই ঠাকুরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুরকে দেখতে-দেখতে আমার ভেতরটা কেমন করছিল। এখনও চোখ আঁকা হয়নি বলে অন্ধ লাগছিল ঠাকুরকে। সোনার হাতটা চেপে ধরে বললাম, তোর হাতটা কী নরম।

সোনা বলল, তোরটাও। ছেলেদের হাত এত নরম হয় না।

ইস। ব্যাডমিন্টন খেলে-খেলে আমার হাতে কড়া পড়ে গেছে বলে।

এখন ঠাকুরের চোখ আঁকবে। সোনা কথাটা বলে ড্যাবডাবে চোখে ঠাকুরের দিকে তাকাল।

সুনীতদা একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে হ্যাজাকটা তুলে ধরল। বিনুমাস্টার বলল, এখন কেউ ডিসটার্ব করিস না যেন, চোখ আঁকায় খুব মনোযোগ দরকার হয়।

আলোটা ওপরে তোলায় ঠাকুরের সারা গায়ে আলো ঝলমল করছিল। মুখটা খুব ভয়ঙ্কর লাগছিল আমার। বুকের কাছটায় চোখ যেতেই আমার মনে পড়ল জিভের সেই চকচক শব্দটা। আমার কেমন লজ্জা-লজ্জা করছিল। সোনা বড় হলে কি কালীমার মতো হবে। সোনার মুখের দিকে। তাকিয়ে আমি কালীর মুখ মেলাতে চাইলাম, এই সোনা জিভ বের কর তো। সোনা অবাক হয়ে। জিভ বার করতেই আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। না, সোনাকে ওরকম দেখাচ্ছেনা।

শ্রীচরণদা খুব ধরে-ধরে দুটো চোখ আঁকলেন। সুন্দর চোখ দুটো। এবার কপালের চোখ। বিনুমাস্টার বলল, এবার কেউ আওয়াজ করবে না, তৃতীয় নয়ন আঁকা হবে। জ্ঞানচক্ষু। ঠাকুরের প্রাণ আসবে। সাধন শঙ্খ বাজাবে আঁকা হলেই। ওরা সবাই শঙ্খ, কাঁসর নিয়ে তৈরি হল। সুনীতদা হ্যাজাকটা একটু ওপরে তুলে নিল।

শ্রীচরণদার আড়ালে ঠাকুরের মুখটা ঢাকা পড়েছিল। সোনা আমার গায়ের ওপর ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করছিল। আমি এখান থেকে শুধু ঠাকুরের বুক আর উরু দেখতে পাচ্ছিলাম। আলো পড়ে চকচক করছে। দেখতে-দেখতে আমার মাথার মধ্যে কেমন করতে লাগল। কান দুটো গরম হয়ে উঠল। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না, শুধু আমার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আর কখনও, যখন ঠাকুরকে রং করা হয়নি বা সকালে যখন প্রতিমা-হয়ে-যাওয়া ঠাকুরকে দেখেছি তখনও এসব কোনওদিন মনে হয়নি। আমি মা কালীর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সম্মোহিতের মতো, সোনা মা কালী হয়ে গেছে কিনা দেখবার জন্যে ডান হাতটা সোনার বুকের কাছে নিয়ে গেলাম। সোনার প্রায় সমতল বুকের ওপর যখন আমার হাত তখন আচম্বিতে সোনা শব্দ করে উঠে কেঁদে ফেলল। আর তৎক্ষণাৎ শাঁখ আর কাঁসর ঘন্টার শব্দ উঠল। কপালের চোখ আঁকা গেছে তখন।

সোনার চিৎকারে ওরা সব ছুটে এল, আরে কাঁদছিস কেন, এই, এই সোনা, ভয় পেয়েছিস! সোনা কাঁদতে-কাঁদতে বাঁ-হাত দিয়ে আমায় দেখিয়ে দিল। আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল হঠাৎ। একবার সোনার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ ফেরাতেই দেখলাম মা কালী খাঁড়া হাতে লাল জিভ বার করে যেন তেড়ে আসছে। আমার মেরুদণ্ডে একটা শীতলতা জীবনে প্রথমবার। এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে আমি হঠাৎ সেই ভোর হয়ে আসা অন্ধকারে, আলোকিত পুজোমণ্ডপ ছেড়ে, মাঠের মধ্যে দিয়ে ভয়ঙ্কর কালীমূর্তির চোখ এড়াতে প্রাণপণে দৌড়োতে লাগলাম। সমস্ত মাঠ জুড়ে থাকা ফিকে অন্ধকার যেন হঠাৎ জমাট হয়ে মা-কালীর জিভের মতো আমার চোখের সামনে ঝুলছিল। কোথায় আমি পালাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress